ডিজায়ার_আনলিশড
✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব-১৭
আজকের সকালটা ছিলো অন্যরকম। ভিলা এস্পেরেন্জার ডাইনিং টেবিলে বসে আছে জাভিয়ানের মা কার্গো চৌধুরী, আর তার খালা রেজিনা আর তান্বী। সবাই একসাথে নাস্তা করতে বসেছে। জাভিয়ান এখনো টেবিলে আসেনি। পরিবেশ কিছুটা শান্ত, তবে আগের দিনের পারিবারিক ঝগড়ার রেশ এখনো রয়ে গেছে। কথায় কথায় রেজিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “জাভিয়ান কি আর অতিরিক্ত ওয়াইন পান করা ছাড়বে না? ওর কিডনির সমস্যা হতে পারে, কার্গো।”
রেজিনার প্রশ্নে কার্গো চৌধুরী এক মুহূর্ত হাসলেন— তিক্ত একটা হাসি দিয়েই বললেন “ওয়াইন ছাড়বে? তাও আবার জাভিয়ান?”
কার্গো চৌধুরী প্লেটে মনোযোগ দিতে দিতে বললেন। “তুমি তো জানো না রেজিনা, একবার আমি ওর ওয়াইনের বোতল ফেলে দিয়েছিলাম বলে… আমাকে রিভলবার দিয়ে শুট করতে এসেছিল! আর ঘরের সব ভেঙেচুরে একাকার করে দিয়েছিল।”
কার্গো চৌধুরীর এই কথাগুলো যেন টেবিলে বোমা ফাটালো।কথাটা কানে যেতেই তান্বীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো! তার হাত থেকে প্রায় কাঁটা চামচটা পড়ে যাচ্ছিল। রক্ত হিম হয়ে এলো তার। তান্বীর মনে পড়লো—কাল রাতে ওইতো জাভিয়ানের সব ওয়াইনের বোতল বাথরুমে ফেলে দিয়েছে!
তান্বী মুহূর্তেই গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো। তার বুক ধড়ফড় করছে। কালকের মতো সামান্য শাস্তি নয়, জাভিয়ান যে তার জন্য কী ভয়ংকর বিপদ নিয়ে আসতে পারে, কার্গো চৌধুরীর কথা শুনে সে সেই কঠিন সত্যটা উপলব্ধি করলো। তবে তান্বী এটাও ভাবতে থাকলো তাহলে ওকে এখনও জাভিয়ান কিছু বললো না কেনো? ওয়াইন ফেলার অপরাধে।
.
.
.
অন্যদিকে, মেক্সিকোর সেই পুরোনো গোডাউনে তখনো লুসিয়া চেয়ারে বাঁধা অবস্থাতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।ফারহান নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করলো। তার হাতে একটি বালতি ছিলো পানি ভর্তি। সে কোনো কথা না বলেই সেই এক বালতি ঠান্ডা পানি সপাং করে লুসিয়ার ওপর ছুঁড়ে মারলো! ঠান্ডা জলের ধাক্কায় লুসিয়া ধড়মড় করে উঠে বসলো। তার চুল, পোশাক সব ভিজে একাকার। ক্রোধে সে ফুঁসতে লাগলো এবং উচ্চস্বরে ইংরেজিতে চিৎকার করে গালাগাল দিতে শুরু করলো।
ফারহান শান্তভাবে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকালো।
“তোমার পরিবার আসলে কেমন পরিবার, লুসিয়া?”
ফারহানের কণ্ঠে ছিল তীব্র বিদ্রূপ। “রাত পার হয়ে গেল মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে, আর কারো কোনো খোঁজ নেই! এদিকে জাভিয়ার এমিলিও চৌধুরী কেমন ভাই তোমার? বোন আটকে আছে শুনেও বসে আছে!”
এই কথা বলার পর ফারহান লুসিয়ার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলো “তোমার মা-ই বা কেমন? নিজের সন্তানের প্রতি দরদ নেই কোনো? খোঁজ নেই! একজন মায়ের তো এখন পাগল হয়ে যাওয়ার কথা, একমাত্র মেয়ে হারিয়ে গেছে!”
ফারহানের মুখে মায়ের কথা শুনে লুসিয়ার চোখ ছলছল করে উঠলো। তার সমস্ত রাগ যেন এক লহমায় মিলিয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বললো, মন খারাপের এক গভীর সুর নিয়ে—”প্লিজ, মা নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।”
ফারহান কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো । “কেন? কেন বলবো না?” লুসিয়া মুখ নামিয়ে নিলো। তার কণ্ঠস্বর তখন শান্ত, কিন্তু তাতে ছিল গভীর এক শূন্যতা—”আমার মা নেই।”
লুসিয়ার মুখ থেকে “আমার মা নেই” কথাটা শুনে ফারহানের কঠিন অভিব্যক্তি সামান্য হলেও নরম হলো। সে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে সে টেবিলের ওপর রাখা ট্রে-এর দিকে ইশারা করলো। “ঠিক আছে। সকালের নাস্তা করার সময় হয়েছে,” ফারহান যেন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।
লুসিয়া তখন নিজের ভিজে যাওয়া পোশাকের দিকে তাকালো। তার চুল থেকে পানি চুঁইয়ে পড়ছে। সে বিরক্তি নিয়ে বললো, “আমি ব্রেকফাস্ট কীভাবে করব? আমার জামাকাপড় তো ভিজিয়ে দিলেন!”
লুসিয়ার কথায় ফারহান এবার তার দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই ফারহান টের পেল—জলে ভেজা লুসিয়ার পোশাক শরীরের সঙ্গে এমনভাবে লেপ্টে আছে যে ভেতরের সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
ফারহান অস্বস্তিতে দ্রুত অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। মুহূর্তের মধ্যে সে নিজের গায়ের ব্লেজারটি খুলে লুসিয়ার দিকে এগিয়ে গেলো। সে তখনও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। এক প্রকার ছুঁড়ে মারার ভঙ্গিতে ব্লেজারটি লুসিয়ার গায়ে জড়িয়ে দিলো।
লুসিয়া কিছুটা অবাক হলো ফারহানের এই হঠাৎ শালীনতা দেখে। তার ভিজে যাওয়া শরীরে ব্লেজারটা জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। এরপর খাবারের দিকে তাকালো। সেই একই সাধারণ রুটি আর বিনসের তরকারি। আবারও তার মন খারাপ হয়ে গেল। এই ধরনের খাবার তার খেতে একদমই ইচ্ছে করছিল না।
নাস্তার ট্রে সামনে রাখা। লুসিয়ার মেজাজ তখনো খিটখিটে। সে এবার মূল প্রসঙ্গে এলো। “আচ্ছা, আমাকে আপনি কিডন্যাপ করেছেন কারণ আপনার বক্তব্য, আমার ভাই আপনার বোনকে তুলে এনে বিয়ে করে আটকে রেখেছে। কিন্তু আপনার বোনকে দেখে তো আমার মনে হয় না তাকে তুলে এনেছে!”
লুসিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। “সে তো দিব্যি নাচতে নাচতে! আমার ভাইয়ের অর্থ ধ্বংস করছে, দেখে তো বোঝাই যায় না তাকে তুলে এনে বিয়ে করেছে। আমার ভাইয়ের কী এমন ঠেকা পড়েছে মেক্সিকোতে এত স্মার্ট, রিচ মেয়ে থাকতে আপনার বোনকে তুলে আনতে যাবে?”
লুসিয়ার কথা শেষ হতেই ফারহানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। সে দ্রুত লুসিয়ার দিকে এগিয়ে এসে তার গাল চেপে ধরলো।
ফারহানের চোখে এবার তীব্র ঘৃণা। “তুমি আসলেই একটা অহংকারী মেয়ে!” ফারহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো। “তবে মনে রেখো, অহংকার পতনের মূল, যা তোমাকে ধ্বংস করবে। আর আমি অহংকারী মানুষদের ঘৃণা করি!”
লুসিয়াও সহজে দমলো না। সে ফারহানের চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, “আর আমিও বাংলাদেশি আনকালচার্ড মানুষদের ঘৃণা করি!”
ফারহান এবার জোরেশোরে হেসে উঠলো। সেই হাসিটা লুসিয়ার কানে যেন বাজলো। “দেখো! যেটা আবার ঘৃণা করো, সেটাই না কপালে জুটে যায়! অবশ্য তোমার মতো মেয়েকে বাংলাদেশের ছেলেরা কখনোই চাইবে না—তাদের আত্মসম্মান আছে। তোমার মতো মেয়েকে ভালোবাসা যায় না,” ফারহান তাচ্ছিল্য ভরে বললো।
লুসিয়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ উল্টে বললো, “ভালোবাসা মাই ফুট! এসব ভালোবাসা বলতে কিছু নেই, চাইনা আমার এসব সস্তা ভালোবাসা!”
লুসিয়ার ‘ভালোবাসা মাই ফুট’ মন্তব্যের জবাবে ফারহান তাচ্ছিল্যের হাসি ধরে রাখলো।”হ্যাঁ! পরে আবার না ভালোবাসার জন্য কাঁদতে বসে যাও,” ফারহান ব্যঙ্গ করে বললো।
লুসিয়ার চোখে দৃঢ়তা। “কখনোই না!”
ফারহান এবার হাসির বদলে মুখে কঠোরতা ফিরিয়ে আনলো। তার কণ্ঠস্বরও হয়ে উঠলো শীতল। “তোমার সাথে তর্ক করার ইচ্ছে আমার নেই। শুধু আজকের দিনটা দেখব, তারপর তোমাকে এখানেই মেরে ফেলে চলে যাবো।”
ফারহানের মুখে এই চরম হুমকি শুনে লুসিয়ার বুকটা কেঁপে উঠলো। কাল রাতে সে ফারহানের প্রতিশোধের খেলার কথা শুনছিল, কিন্তু এখন নিজের মৃ/ত্যু নিশ্চিত জেনে তার সমস্ত অহংকার যেন মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে গেল।
“শুধু আজকের দিনটা দেখব, তারপর তোমাকে এখানেই মে*রে ফেলে চলে যাবো।”—ফারহানের এই চূড়ান্ত হুমকি/র পর লুসিয়ার বুক কেঁপে উঠলেও সে বাইরে কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করলো না।
ফারহান এরপর শান্তভাবে চেয়ার টেনে লুসিয়ার সামনের টেবিলে বসলো। সে হাতে রুটি তুলে নিয়ে লুসিয়াকে নাস্তা খাইয়ে দিতে গেলো।
লুসিয়া তখন ক্রোধে অন্ধ প্রায়। ফারহানের হাতে থাকা খাবারটি সে মুখে নিলো, কিন্তু খাবার চিবানোর বদলে লুসিয়া সমস্ত রাগ একত্র করে ফারহানের আঙুলে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো!
ফারহান অপ্রত্যাশিত এই আক্রমণে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। তার মুখ বিকৃত হলো, কিন্তু সে জোরে চিৎকার করলো না। সে দাঁতে দাঁত চেপে সেই তীব্র ব্যথা সহ্য করে নিলো। তার চোখে এবার রাগ নয়, ছিল প্রতিশোধের খেলা চালিয়ে যাওয়ার এক কঠিন প্রতিজ্ঞা।
ফারহানের আঙুলে কামড় বসানোর পর লুসিয়া তখনো ভয়ে কাঁপছে। তার মনে হঠাৎ এক চরম আতঙ্ক উঁকি দিলো—যদি ফারহান তাকে মে/রে ফেলার আগে আরও নি/র্মম কিছু করে?
লুসিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে মিনতি ভরা কণ্ঠে বললো, “শুনুন, আমাকে মেরে ফেললে সোজা মেরে ফেলবেন, কিন্তু আমার গায়ে টাচ করবেন না।”
লুসিয়ার কথা শুনে ফারহানের চোখে এবার এক গভীর দৃষ্টি ফুটে উঠলো। সে লুসিয়ার দিকে ঝুঁকে এলো। “ছেলেদেরকে তুমি কী মনে করো, আমি জানি না,” ফারহান শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললো। “কিন্তু ফারহান রেহেমান কোনো নারীর সম্মানে হাত দেয় না। কারণ তারও দুটো বোন আছে।অন্য কারো বোনের দিকে কুনজর দেবে না, অন্তত সে।”
ফারহান লুসিয়ার চোখ থেকে চোখ সরালো না। এরপর সামান্য বিরতি দিয়ে সে যোগ করলো— “তবে আরেকটা কথা—তোমার প্রতি আমার কোনো ইনটারেস্টে নেই।”
ফারহানের শেষ কথাটা শুনে লুসিয়ার রাগের পারদ চরমে উঠলো। সে হতভম্ব হয়ে ফারহানের দিকে তাকালো। বাংলাদেশের একটি ছেলে হয়েও তাকে এমন কথা বললো! যেখানে তার জন্য মেক্সিকোর তাবৎ ছেলেরা পাগল, সেখানে এই ছেলে তাকে এভাবে অপমান করলো? লুসিয়ার অহংকারী মনে চরম আঘাত লাগলো।
লুসিয়ার অহংকারী মনে চরম আঘাত লেগেছিল ফারহানের ‘ইনটারেস্ট নেই’ মন্তব্যে। সে কিছু বলার আগেই ফারহান এবার তার ভিজা পোশাকের দিকে ইশারা করলো।
“নিজের পোশাক দেখেছ?” ফারহান কঠোর কণ্ঠে বললো। “পোশাকের কী অবস্থা! কথা বলার ধরন! আর নিশ্চিত, তুমি অনেক ছেলের সঙ্গে ফ্রি মিক্সিং করো। এমন মেয়ের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র পরিমাণেও দয়াও আসবে না।”
ফারহান এবার তার মনের গভীরে থাকা রক্ষণশীল আদর্শটা প্রকাশ করলো, যা লুসিয়ার আধুনিক ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।
“মেয়ে মানুষ হতে হবে ফুলের মতো—দেখতে হবে মায়াবী, যার সুবাস হবে পবিত্র। যেই ফুলের প্রতি শুধুমাত্র একজন ভ্রমরেরই অধিকার থাকবে মধু আহরণ করার।”
ফারহানের মুখে এই রক্ষণশীল ও কাব্যিক কথা শুনে লুসিয়ার চোখে ক্রোধের সঙ্গে এবার তীব্র ঘৃণা মিশে গেলো। এই ছেলে তাকে শুধু অপমানই করছে না, তার জীবনযাপন এবং মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। লুসিয়া মনে মনে ফারহানকে ‘আনকালচার্ড’ বলে আরও বেশি নিশ্চিত হলো।
.
.
.
.
হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পর মেইলস্ট্রোম এখন তার গোপন, সুরক্ষিত এক আস্তানায় বসে আছে। শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে তার চোখে এখন প্রতিশোধের তীব্র আগুন। সে দ্রুত তার বিশ্বস্ত প্রধান সেক্রেটারিকে ডেকে পাঠালো।
মেইলস্ট্রোম কঠোর কণ্ঠে আদেশ করো “দ্রুত বের করো—নাইট রেভেন এখন কোথায় আছে। আর সে কেন আমার ওপর হামলা করলো, তার সঠিক কারণ চাই। আমি বিশ্বাস করি না এটা সাধারণ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।”
তার সহকারী আদেশ মাথা পেতে নিলো।মেইলস্ট্রোম আবার ও বললো “আমার আঘাতের প্রতিশোধ আমি নেবই।”
সহকারী চলে যেতেই মেইলস্ট্রোম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। তার মাথায় তখন দ্বিগুণ চিন্তা—একদিকে তান্বী আর অন্যদিকে নাইট রেভেন।
মেইলস্ট্রোম এরপর সেই আস্তানারই একটি ভেতরের কক্ষে প্রবেশ করলো। কক্ষটি শীতল, আবছা আলোয় ঢাকা। সেখানে অন্য কোনো আসবাবপত্র নেই, শুধু একটি বিলাসবহুল সোফা আর তার ঠিক সামনে, দেয়ালে বিশাল করে রাখা একটি ছবির ফ্রেম। ফ্রেমের ভেতরে থাকা ছবিটি ছিল তান্বীর। ছবিটি সাধারণ নয়—মেইলস্ট্রোম তান্বীর কলেজের সার্টিফিকেট থেকে তার ছবি সংগ্রহ করেছিল। তারপর সেটিকে নিজের মনের মতো করে এডিট করিয়ে নিয়েছে—তান্বীকে সেখানে কালো শাড়ি পরানো হয়েছে, তার চোখের মায়াবী চাহনি আরও গভীর করা হয়েছে। এটা যেন তার কল্পনাজগতের তান্বী। মেইলস্ট্রোম ধীর পায়ে এসে সোফায় বসলো। সে কিছুক্ষণ তান্বীর সেই প্রতিকৃতির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর ছবিটির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো “তুমি কেন আমার কাছে ধরা দিচ্ছ না, soulfalme? তুমি কি জানো না, আমি তোমাকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাবো?
সে সোফায় হেলান দিয়ে, ছবির দিকে তাকিয়ে আরও দৃঢ় কণ্ঠে বললো “একবার তোমাকে পাই, তান্বী। শুধু একবার… তারপর দেখবে। আর কোনোদিন আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবে না। এই পৃথিবীও পারবে না তোমাকে আমার থেকে আলাদা করতে।”
মেইলস্ট্রোমের চোখে তখন শুধুই অধিকারবোধ আর এক ভয়ানক, উন্মত্ত ভালোবাসা।
.
.
.
.
রাতের বেলা। ভিলা এস্পেরেন্জার তার বিলাসবহুল কক্ষে জাভিয়ান প্রবেশ করলো। তান্বী তখনো বিছানায় জেগেই ছিল। জাভিয়ান পোশাক পাল্টাতে শুরু করলে, তান্বী হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো সরাসরি “আপনার বোন লুসিয়া কোথায়? দেখছিনা প্রায় ২৪ ঘন্টা পার হয়ে যাচ্ছে।
জাভিয়ান তার দিকে না তাকিয়েই পোশাক বদলাতে লাগলো।তান্বী বিরক্ত কণ্ঠে বললো “এখানকার কালচারটা কী অদ্ভুত! একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বাড়িতে নেই, অথচ কারো কোনো মাথাব্যথা নেই—কার সাথে যাচ্ছে কী করছে!
জাভিয়ান এবার পোশাক পাল্টানো থামিয়ে তান্বীর দিকে ফিরলো। তার চোখে ছিল বিরক্তি মেশানো এক শীতলতা।জাভিয়ান নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললো “এই পরিবারটা এমনি। তুমিও এমন হওয়া শিখে নাও।”
জাভিয়ান যখন তান্বীকে ‘পরিবারের মতো হওয়া শিখে নিতে’ বললো, তান্বী তখন সোজা জবাব দিলো দৃঢ়ভাবে “সরি, আমার পক্ষে এমন হওয়া সম্ভব না।”
জাভিয়ান কথা ঘুরিয়ে দিলো। সে তখন বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো, “এসব ছাড়ো। তার আগে বলো, তুমি এমন সেক্সি ড্রেস পরে আছো কেন?”
তান্বী অবাক হয়ে নিজের ড্রেসের দিকে তাকালো। “এটা তো নাইট ড্রেস! যেটা আমি প্রতিদিন পরি। এটা আজকে সেক্সি হলো কিভাবে?”
জাভিয়ান তখন তান্বীর পাশে বসলো। তার চোখে ছিল দুষ্টুমি ভরা দৃষ্টি। সে নিবিড় স্বরে বললো “তোমার ফিগার এমনিতেই সেক্সি, তাই যা-ই পরো না কেন, হট লাগে।”
তান্বী রাগে কপাল কুঁচকালো। “ছি ছি! আপনি মেয়েদের বডিতে এত কুনজর কিভাবে দেন?”
জাভিয়ান উত্তেজিতভাবে বললো “বউয়ের দিকে নজর দিতে কিসের প্রবলেম?”
তান্বী সঙ্গে সঙ্গে এই সুযোগটা নিলো। “আপনি আমাকে বউ হিসেবে মানেন? বারবার তো বলেন টাকা দিয়ে কিনে এনেছেন!”
জাভিয়ান এবার পিছিয়ে না গিয়ে এক মুহূর্ত হাসলো—সেই হাসি ছিল শীতল এবং নিষ্ঠুর। সে ঠান্ডাভাবে উত্তর দিলো “ইয়েস, কিনেই তো এনেছি। এখন মডার্ন যুগ। বউও কিনে আনা যায়।”
জাভিয়ানের ‘বউও কিনে আনা যায়’ মন্তব্য শুনে তান্বীর রাগ চরম সীমায় পৌঁছালো। সে আহত ও দৃঢ় কণ্ঠে বললো “আমি কোনো কিনে আনা বউ, টাকার বিনিময়ে বউ—এসব হতে চাই না!”
জাভিয়ান তান্বীর মুখের দিকে তাকালো। তার মুখে তখন এক স্থির, ঠান্ডা হাসি। সে শান্তভাবে তান্বীর একেবারে কাছে সরে এলো।তারপর নিচু স্বরে বললো “তাহলে কি অরিজিনাল মিসেস এমিলিও চৌধুরী হতে চাও?”
তান্বী এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত হলো।
জাভিয়ান আরো তান্বীর কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললো “তাহলে তোমার ভার্জিনিটি আত্মসমর্পণ করতে হবে আমার কাছে।”
জাভিয়ানের সরাসরি শর্ত শুনে তান্বী চমকে উঠলো। এক তীব্র ক্রোধ আর আতঙ্কে সে জাভিয়ানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো। আর চিৎকার করে বললো “আমার কাছে আসবেন না!”
জাভিয়ান সেই ধাক্কায় একটুও টললো না। সে হাসলো। সেই হাসিটা ছিল ভয়ানক আত্মবিশ্বাসের।সে শান্তভাবে বললো
“আমার তোমার কাছে আসতে হবে না, তান্বী। আমার চোখের দৃষ্টি দিয়েই আমি তোমাকে এর অর্ধেক খেয়ে ফেলেছি।“
জাভিয়ানের এই কথা শুনে তান্বী শিউরে উঠলো। সে দেখলো, জাভিয়ানের চোখে তখন এক তীক্ষ্ণ, ক্ষুধার্ত দৃষ্টি—যা সত্যিই যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তান্বী ভয়ে আর অপমানে চোখ নামিয়ে নিলো।
জাভিয়ানের চোখের দৃষ্টির তীব্রতায় তান্বী তখন ভয়ে ও অপমানে কাঁপছে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে ঘৃণাভরে জাভিয়ানকে আঘাত করার চেষ্টা করলো। আর চিৎকার করে বললো “আপনি আসলেই একটা লম্পট!“
তান্বীর কথায় জাভিয়ান একটুও বিচলিত হলো না। সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো, তার মুখে সেই অহংকারী, আত্মবিশ্বাসী হাসি রেখেই নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললো ”ইয়েস, নাম্বার ওয়ান!“
তান্বীর দিকে ‘ইয়েস, নাম্বার ওয়ান!’ বলে জাভিয়ান যখন বিজয়ের হাসি হাসছে, ঠিক তখনি হঠাৎ দরজা নক না করেই কপাট ঠেলে জাভিয়ানের খালাতো বোন কাতারিনা ঘরে ঢুকে পড়লো।
কাতারিনা তান্বীর দিকে এক ঝলক তাকিয়েই জাভিয়ানের দিকে ফিরলো। তার চোখে তখন উদ্বেগ।কাতারিনা সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো “জাভি ভাইয়া! লুসি কোথায়? এখনো আসছে না! ফোনটাও বন্ধ।“
জাভিয়ানের চোখে মুহূর্তে বিরক্তি ফুটে উঠলো। সে কাতারিনার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
তারপর শান্ত কিন্তু তীব্র ধমকের সুরে বলে উঠলো “তুমি কি বেসিক ম্যানার শেখোনি, কাতারিনা? হাজব্যান্ড-ওয়াইফের বেডরুমে নক করে ঢুকতে হয় সেটা জানো তো“
জাভিয়ান জানে, কাতারিনা এমনটাই। তার মনে পড়ে গেল—এর আগে কাতারিনা একবার এমনই নক না করে ঢুকে পড়েছিল। সেদিন জাভিয়ান কেবল একটা তোয়ালে পরা ছিল। কাতারিনা বেশ কিছুক্ষণ স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল, যেন তার ঘোর কাটছিল না। সেই অপ্রীতিকর স্মৃতিটা জাভিয়ানের মনে পড়তেই তার মেজাজ আরও বিগড়ে গেল। সে তখন আরো কঠোর কণ্ঠে বললো “এখন যাও। লুসিয়াকে যখন খুঁজে বের করার দরকার হবে, তখন খুঁজে বের করা হবে।”
কাতারিনা দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, তান্বী বিরক্তি নিয়ে জাভিয়ানের দিকে তাকালো। সে কাতারিনার সঙ্গে জাভিয়ানের আচরণের সুযোগ নিলো খোঁচা দিতে। তাই তাচ্ছিল্যের সুরে বললো “আপনার জন্য কাতারিনাই পারফেক্ট। দু’জনই সেইম টাইপের অসভ্য।”
জাভিয়ান তখন বিছানার দিকে এগিয়ে এসে বললো “সরি, বেইব। প্লাসে (+) প্লাসে (+) তো আকর্ষণ কমিয়ে দেয়। দু’জন একরকম হলে সেখানে কোনো চ্যালেঞ্জ থাকে না।
জাভিয়ান এরপর তান্বীর দিকে আরো একধাপ এগিয়ে এলো, তার চোখে ছিল দখলদারিত্বের আলো।
জাভিয়ান আরও নিচু স্বরে, নিজের দিকে ইঙ্গিত করে বললো “বাট প্লাসে-মাইনাসে কিন্তু আসল আকর্ষণটা তৈরি হয়। বুঝতে পেরেছো?
জাভিয়ান যেন বুঝিয়ে দিলো—তার মতো ‘প্লাস’ (শক্তিশালী, কর্তৃত্বপরায়ণ) সত্তার পাশে তান্বীর মতো ‘মাইনাস’ (নিষ্পাপ, প্রতিবাদী) সত্তাই কেবল তাকে আকর্ষণ করে, কারণ এই বৈপরীত্যেই তার কর্তৃত্ব ও বিজয়ের নেশা তীব্রভাবে বাড়ে।
জাভিয়ানের শেষ কথা শুনে তান্বী যখন বুঝতে পারলো না তার মানে কী, তখন জাভিয়ান তা ধরে ফেললো।
সে তাচ্ছিল্যভাবে বললো “ এই ব্রেইন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে চান্স পেলে? তবে তুমি কিন্তু ম্যাথ, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, বায়োলজি—সবকিছুতেই একদম কাঁচা।“
জাভিয়ানের কটাক্ষ শুনে তান্বী তাৎক্ষণিক জবাব দিলো, তার কণ্ঠে ছিল বিরক্তি। “তো আপনার কী?“
জাভিয়ান তখন আরও কাছে সরে এলো, তার চোখে কর্তৃত্বের দৃষ্টি। সে নিচু স্বরে বললো “আমি সবকিছুতেই প্রো। তাই আমার ওয়াইফকেও সেইম হতে হবে। আমি সব শিখিয়ে দেবো, সমস্যা নেই। ধৈর্য ধরো আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবে।“
তান্বী তখন জাভিয়ানের অতিরিক্ত নৈকট্য সহ্য করতে না পেরে প্রশ্ন করলো। বিরক্তি নিয়ে “আপনি বারবার আমার কাছে আসছেন কেন?“
জাভিয়ান সেই একই হাসি ধরএ থেকে নিচু স্বরে বললো “কারণ তুমিও চাইছো আমি তোমার কাছে আসি, তাই।“
জাভিয়ানের এই সরাসরি মন্তব্যে তান্বী চরম অস্বস্তি বোধ করলো। নিজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ভেঙে যাচ্ছে ভেবে সে দ্রুত এক ঝটকায় সরে গিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো। জাভিয়ান তখন বিছানায় হেলান দিয়ে বসে রইলো। সে তান্বীর দিকে তাকিয়ে হাসলো—বিজয়ীর হাসি।তারপর শান্ত কণ্ঠে বললো “দেখি, আর কত দিন তোমার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে।“
.
.
.
হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়ে মার্কো রেয়েস চৌধুরী অবশেষে ভিলা এস্পেরেন্জায় ফিরেছে। জাভিয়ানের বাবা-মা’র পীড়াপীড়িতে সে সাময়িকভাবে বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হয়েছে, যদিও তার মনে এখন সন্দেহ আর অস্বস্তি বাসা বেঁধে আছে। সে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো। দীর্ঘদিন পর ফিরে আসা সত্ত্বেও রুমে কোনো স্বস্তি নেই, আছে শুধু এক চাপা উত্তেজনা। মার্কো দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো। তার চোখে ক্লান্তি নয়, ছিল এক হিসেবি দৃষ্টি। মার্কো সোফায় শরীর এলিয়ে দিলো। সেদিনের দুর্ঘটনার পর থেকে তার মনে একটাই চিন্তা ঘুরছে: কে তাকে মারতে চেয়েছিল এবং কেন?
মার্কো চোখ বন্ধ করে সমস্ত দৃশ্যগুলো একটার পর একটা সাজাতে লাগলো। সে এখন তার নিজের ঘরে, কিন্তু সে জানে, এই বাড়িও তার জন্য নিরাপদ নয়। তাকে অতি দ্রুত এই ধাঁধার সমাধান করতে হবে, নয়তো আপনজন কারো না কারো খেলার গুটি হয়ে থাকতে হবে। তার মাথায় তখন একটাই কথা—এই অঙ্কের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সে শান্ত হবে না।
চলবে……..
(রিচেক করা হয়নি ভুলত্রুটি দেখলে সাথে সাথে মন্তব্য করে জানিয়ে দিবেন)
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৯
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৭
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২৩
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১২