Dark_Desire
পর্ব—৪
দূর্বা_এহসান
ডার্ক_ডিজায়ার
তরু হঠাৎ ঝটকা দিয়ে উঠে বসলো।চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে।বুক ধড়ফড় করছে। সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কানে যেন এখনও বাজছে মৃন্ময়ের ভয়ঙ্কর গলা।তরু কাঁপা হাতে গলা ছুঁলো। সেখানে কোনো দাগ নেই। শরীরে কোথাও কামড়ের চিহ্নও নেই।কিন্তু আতঙ্কটা এতটাই বাস্তব ছিল যে সে কেঁদে ফেললো।চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু মুছতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেলো।দেয়ালের আয়নায় নিজের মুখটা স্পষ্ট দেখলো।মুখ ফ্যাকাশে।ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।
বিছানা থেকে নামলো তরু।মেঝেতে পা রাখতেই ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এলো গোড়ালি বেয়ে।দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।তার হাঁটার তালে তালে হাতের শিকলটাও শব্দ করছে।অন্ধকার নিস্তব্ধতার মধ্যে শব্দটা যেন আরও তীক্ষ্ণ।মনে হচ্ছিল শিকলটার ধ্বনি দেয়াল পেরিয়ে গোটা বাড়ির বুক চিরে বাইরে জঙ্গলে ছড়িয়ে যাচ্ছে।তরু দাঁড়ালো।চোখ নামিয়ে শিকলের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো।অভিশপ্ত এক বাঁধন।ভয়কে গিলে আবার পা বাড়ালো তরু।বাইরে বের হতেই নিঃশব্দতা তাকে গিলে খেলো।দেখতে পেলো পুরো বাড়ি অন্ধকার।কোথাও আলো নেই।
শুধু তার ঘর থেকে বেরোনো আলোটা দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে সামান্য আভা ছড়াচ্ছে।পুরো বাড়িটা অন্ধকারে ঢেকে আছে।
হঠাৎ কানে এলো অদ্ভুত সব শব্দ।দূরে শুকনো পাতার মচমচ আওয়াজ।পাশের জঙ্গল থেকে ভেসে এলো রাতচরা পাখির ডাক।একটু দূরে শিয়ালের হুক্কাহুয়া। হাড় কাঁপানো সুরে।
শব্দগুলো একে অপরের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত আতঙ্ক তৈরি করছে।প্রকৃতি যেন নিজেই তার দিকে তাকিয়ে আছে।তরু ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কাঠের সিঁড়ি কঁকিয়ে উঠছে।হঠাৎ বাতাসের ঝাপটা এলো।
দেয়ালের পুরনো জানালাটা জোরে খুলে গেলো।অন্ধকার ভেদ করে এক শীতল ঝড়ো বাতাস ঢুকে তরুর মুখে আছড়ে পড়লো।
সে আঁতকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললো।ঘরের ভেতর ঝুলে থাকা পর্দাগুলো দুলতে লাগলো।যেন অজানা হাত দিয়ে টানা হচ্ছে।তরু ধীরে ধীরে চোখ খুললো। জমে গেলো সে। দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি।শরীর অন্ধকারে ঢাকা।কোনো নড়াচড়া নেই।শুধু চোখ দুটো।অন্ধকারের ভেতর থেকেও জ্বলজ্বল করছে যেন কয়লার আগুন।
হাওয়ার দমকে ছায়াটার চারপাশ কাঁপতে লাগলো।
তবুও সে অটল দাঁড়িয়ে।নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তরুর দিকে।তরুর ঠোঁট শুকিয়ে এলো।গলার ভেতর শব্দ আটকে গেলো।
তবুও হাজার চেষ্টার পর জোরে চিৎকার করে উঠলো তরু।
পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো।এক মুহূর্তের মধ্যে নিস্তব্ধ অন্ধকার ভেদ করে প্রতিটি ঘরে আলো জ্বলে উঠলো।দেয়ালে ঝোলানো লাইটগুলো একসাথে জ্বলে উঠতেই বাড়িটা বদলে গেলো।
তরুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়।সাদা শার্ট, গুটানো হাতা।তরু বিশ্বাস করতে পারলো না।স্বপ্ন না বাস্তব?কিন্তু শরীর আর মন অপেক্ষা করতে পারলো না।সে ঝাপিয়ে পড়লো মৃন্ময়ের বুকে।
দু’হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।মনে হলো এতক্ষণ যেই আতঙ্কে শ্বাস নিতে পারছিল না, সেই আতঙ্ক ঘুচে গেছে।মৃন্ময় হতবাক।তার চোখ এক সেকেন্ডের জন্য বড় হয়ে গেলো। তরুর এই আচরণ সে কল্পনাতেও আনেনি।
মৃন্ময়ের বুকের ভেতর যেন হঠাৎ বজ্রপাত হলো। তরুর কাঁপতে থাকা শরীর তার হাতে জড়িয়ে আছে। মুহূর্তের জন্য নিজের অবস্থান হারিয়ে ফেললো সে। হাত দুটো অনিচ্ছায় উপরে উঠলো, আবার নামলো।
“পাখি”
তার কণ্ঠ ভাঙা।
তরু চোখ বন্ধ করে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো তাকে। বুকের ভেতরের সব দম আটকে রাখা কান্না বেরিয়ে এলো হাহাকারের মতো।
“আমি ভয় পেয়েছিলাম… আমি ভেবেছিলা …” কথাগুলো এলোমেলো।অস্পষ্ট।তবুও স্পষ্ট ছিল সেই ভয়ের ওজন।
মৃন্ময় হঠাৎ তার মাথার দিকে তাকালো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। কপালে ঘামের বিন্দু। ঠোঁট শুকনো। কিন্তু চোখদুটো সেখানে একসাথে আতঙ্ক, স্বস্তি।মৃন্ময় কিছু বলতে গেলো।তরু হঠাৎ তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরলো।
“কিছু বলো না।”
মুহূর্তটা জমাট বাঁধার আগেই হঠাৎ আবার সেই শব্দ।দূরে কোথাও শুকনো পাতার উপর কারো ভারী পদক্ষেপ। দু’জনেই চমকে উঠলো।তরু মৃন্ময়ের বুকে আশ্রয় নিতে চাইলো আবার।
মৃন্ময় তরুর কাঁপতে থাকা ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো। তার স্পর্শে তরুর ভয়ধীরে ধীরে গলে গেলো। নিঃশ্বাসে গরম স্রোত লেগে গেলো তরুর মুখে ।পৃথিবীটা যেন থমকে দাঁড়ালো শুধু এই দু’জনের জন্য।
“হুস,, আমি আছি”
ফিসফিস করলো মৃন্ময়।তরু চোখ বন্ধ করে তার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো। বুকের ভেতর জমে থাকা হাহাকার ফুঁপিয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু এবার সেই কান্নার সাথে মিশে গেলো অদ্ভুত প্রশান্তি।মৃন্ময় শক্ত বাহুতে তাকে কোলে তুলে নিলো। তরু অবাক হলেও প্রতিবাদ করলো না। মাথাটা গিয়ে ঠেকলো মৃন্ময়ের কাঁধে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে তার গালে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। মৃদু উষ্ণতার সঙ্গে ভেসে আসছিল তরুর দেহের কম্পন।
ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো মৃন্ময়।তরুর মনে হচ্ছিলো, মৃন্ময়ের হাতে থাকলে সব বিপদ থেমে যাবে।রান্নাঘরে ঢুকে টেবিলের উপর আলতো করে বসিয়ে দিলো তাকে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু মুছে দিতে হাত বাড়ালো মৃন্ময়। তার স্পর্শে তরু থমকে গেলো।নিঃশ্বাস আটকে গেলো বুকের ভেতর।
মৃন্ময় হাঁড়ি বসালো চুলায়। ভাঁজ করা শার্টের আস্তিন গুটিয়ে নিলো ওপরে। আগুন জ্বলে উঠতেই রান্নাঘর ভরে গেলো সোনালি আভায়। তরু চুপ করে তাকিয়ে থাকলো। প্রতিটি নড়াচড়ার সাথে এই মানুষটা তার ভয়টাকে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিচ্ছে।মশলার ফোড়ন উঠলো গরম তেলে। সেই শব্দ আর ঘ্রাণ তরুর বুকের ভেতর ছড়িয়ে গেলো। মৃন্ময় কাটা পেঁয়াজ, রসুন আর মরিচ একে একে ফেলে দিচ্ছিলো, আর প্রতিটি মুহূর্তে তার হাতের মুভমেন্ট যেন নাচের মতো লাগছিলো তরুর চোখে।
“আপনি অদ্ভুত”
মৃন্ময় পিছনে না তাকিয়েই বলল,
“কেমন?”
“অদ্ভুত”
মৃন্ময়ের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। ধোঁয়া আর মশলার গন্ধে ঘেরা রান্নাঘরের আবহাওয়াটা যেন আরও গাঢ় হলো। সে এবার ঘুরে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রাখলো তরুর সাথে।কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। তরুর কাছে এসে ঝুঁকে তার চুলগুলো আলগা করে কানের পেছনে সরিয়ে দিলো। সেই স্পর্শে তরুর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো।
“কেমন অদ্ভুত?”
সে কিছু বলার আগেই মৃন্ময়ের ঠোঁট নেমে এলো তার কপালে, ধীরে ধীরে গাল বেয়ে নামলো। তরু চোখ বন্ধ করলো। ঠোঁট কেঁপে উঠছে।বুকের ভেতর ধকধক শব্দ প্রতিটা মুহূর্তে যেন আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মৃন্ময়ের ঠোঁট যখন গাল ছুঁয়ে নামতে লাগলো, তরুর হাত ধীরে ধীরে তার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরলো।মৃন্ময় থেমে গেলো।। চোখের গভীরে তাকালো তরুর দিকে।
“পাখি…”
তরু চোখ খুললো না। শুধু নিঃশ্বাস ভাঙা ভাঙা সুরে বললো,
“এভাবে থাকো প্লিজ, আর কোথাও যেও না।”
মৃন্ময়ের বুকের ভেতর অদ্ভুত আলোড়ন। এতদিন যতটা কড়া, যতটা কঠিন হয়ে থেকেছে সেই দেওয়ালগুলো ভেঙে যাচ্ছিল। এ যেন তার সেই পুরোনো পাখি।যার বাসা ছিল তারই কাছে।সে হাত বাড়িয়ে তরুর মুখটা নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে আলতো করে তুলে ধরলো।
তরু এবার চোখ খুললো।মৃন্ময় নিচু হয়ে তার ঠোঁটের খুব কাছাকাছি এসে থেমে গেলো। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছে। মুহূর্তটা এতটাই ঘন যে দু’জনের চারপাশ থেকে সময়, শব্দ, আলো সব মিলিয়ে যাচ্ছিল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে মৃন্ময় তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রাখলো। প্রথমে দ্বিধা, তারপর ধীরে ধীরে সেই চুম্বন গভীর হলো। তরুর হাত শক্ত করে মৃন্ময়ের কাঁধে আঁকড়ে ধরলো। অনেকক্ষণ পর মৃন্ময় ধীরে ধীরে ঠোঁট সরিয়ে নিলো। কপালে আবার চুমু দিলো। তরুর ভেজা চোখে সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখলো।
“এখন ভয় পাচ্ছো?”
আস্তে জিজ্ঞেস করলো মৃন্ময়।
তরু মাথা নাড়লো না, শুধু তার বুকে মুখ গুঁজে বললো,
“না।তুমি থাকলে আর কোনো ভয় নেই।”
মৃন্ময়ের ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটলো। এক হাতে তরুকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে হাঁড়ির চামচ নাড়তে লাগলো সে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই তরুর মাথার ভেতর বজ্রপাত হলো।এক ঝলকে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কালো এক অতীত।মৃন্ময়ের শীতল দৃষ্টি, নিষ্ঠুরতা, সেই ভয়ঙ্কর রাতগুলোর ছায়াতার বুকের ভেতর হঠাৎ হিমশীতল শীতলতা নেমে এলো।
“না “
মনে মনে চিৎকার করে উঠলো তরু।
সে হঠাৎ দু’হাত দিয়ে মৃন্ময়কে ঠেলে দিলো। চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেছে।মৃন্ময় হতভম্ব।
“পাখি!”
তরুর চোখে পানি জমলো। তীব্র কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আপনি সেই মানুষ, যাকে আমি ঘৃণা করি। অথচ আমি আপনার বুকে আশ্রয় নিলাম কেন? আমি… আমি তো আপনাকে ঘৃনা করি।”
কথাগুলো ছুরির মতো গেঁথে গেলো মৃন্ময়ের বুকে। সে এক মুহূর্তের জন্য চোখ নামিয়ে নিলো। ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরলো। তার মুখে কোনো কথা নেই।শুধু চোখের গভীরে জমে উঠলো অন্ধকার।
হঠাৎ ই সে যেন আবার সেই হিংস্র রূপ ধারণ করলো। তার পাখি তাকে ঘৃনা করে? নিজে মুখে বলেছে!হঠাৎই মৃন্ময়ের চোখে এক ঝলক আগুন দপ করে জ্বলে উঠলো। তরুর কথাটা যেন তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলো। ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরলো সে।
“তুই আমাকে ঘৃণা করিস!?”
তার কণ্ঠ কর্কশ।যেন বুকের ভেতর থেকে কোনো পশুর গর্জন বের হচ্ছে।তরু আতঙ্কে পিছু হটতে গেলো, কিন্তু মৃন্ময় এক ঝটকায় তার মুখ চেপে ধরলো। হাতের শক্তি এতটাই ভয়ানক ছিল যে তরুর নিঃশ্বাস আটকে এলো।মৃন্ময়ের চোখ লাল হয়ে উঠেছে। কাছে ঝুঁকে তার গলায় গরম নিঃশ্বাস ফেললো সে।
তরুর চোখ দিয়ে টলটল করে পানি পড়ছে। গলা চেপে ধরার ভয়ে সে কথা বলতে পারছিল না। বুকের ভেতর থেকে কেবল ভাঙা ভাঙা শব্দ বেরোলো।মৃন্ময় ঠাণ্ডা হাসি হেসে উঠলো।
“তুই আমার ছাড়া কারো না।”
সে হঠাৎ করে তরুকে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো। এতটা শক্ত করে, যেন হাড় ভেঙে যাবে। তরুর নিঃশ্বাস রুদ্ধ হতে লাগলো।বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছিল।জানালার কপাট ধপধপ করে বাজছিল। ভেতরে রান্নার আগুন। আর এই আগুনের মাঝখানে মৃন্ময়ের চোখে জ্বলছিল এক অদ্ভুত অন্ধকার।ভালবাসা আর ঘৃণার দহনে মিলেমিশে তৈরি এক অমানবিক আকাঙ্ক্ষা।
চলবে,,,,,
(পার্ট ৫ এ কি হতে পারে বলোতো)
Share On:
TAGS: ডার্ক ডিজায়ার, দূর্বা এহসান
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডার্ক সাইড অফ লাভ পর্ব ১
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১০
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৫
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১১
-
ডার্ক ডিজায়ার গল্পের লিংক
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৩(প্রথমাংশ + শেষাংশ)
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৮
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১২
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৯