১৩.
Dark_Desire
ডার্ক_ডিজায়ার
দূর্বা_এহসান
রোদের তীব্র তাপ মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙল মৃন্ময়ের। চোখের পাতা ভার।মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে রোদের ছিটে সরাসরি এসে পড়েছে গাল বরাবর। বালিশের দিকটা ঘেঁষে হাত বাড়াতেই খালি বিছানা। ঠান্ডা চাদরের ভাঁজে কেবল সুবাস আছে।সেই পরিচিত নারীর সুবাস।
মৃন্ময় চোখ মেলল ভালো করে।
“পাখি”
একবার ডাকে।কোনও সাড়া নেই।বিছানার পাশের টেবিলে আধখাওয়া জলভর্তি বোতল,তরুর চুলের ক্লিপ, আর একটা বই পড়ে আছে। পাতাটা ভাঁজ করা ১২৬ নম্বর পৃষ্ঠায়। মানে সকালে পড়ছিল।
মৃন্ময় উঠে বসে।ওয়াশরুমের দরজাটা হালকা খোলা।
“পাখি, শুনছো?”
চুপচাপ।সে এগিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলে খোলে। ভেতরে কেউ নেই। তোয়ালে ঝুলছে,ভেজা কাপড় পরে আছে।বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ মৃন্ময়।
এটা তাদের দ্বিতীয় দিন এই কটেজে। একটা পুরনো কাঠের কটেজে উঠেছে।গোটা পাহাড়ের ঢালে, ঘন কুয়াশা আর পাইনগাছের গন্ধে ভরা। ছোট বারান্দাটা থেকে দূরের মেঘের ফাঁকে কখনও কানচনজঙ্ঘা দেখা যায়, কখনও মিলিয়ে যায়।
গতকালও তরু অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে।হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ, চুল উড়ছিল হওয়ায়।
মৃন্ময় মোবাইল খোঁজে। টেবিলে নেই, বালিশের পাশে। ফোন টা হাতে নিয়ে ডায়াল প্যাড অন্ করতেই মনে পড়ে গেলো সে তরুকে ফোন ব্যবহার করতে দেয়নি।
“পাখি”
আবার ডাক দেয়, এবার কণ্ঠে অস্থিরতা।পাশের তাকায়।তাদের লাগেজ, পোশাক সব ঠিকঠাক আছে। শুধু তরুর জ্যাকেটটা নেই।মৃন্ময় ভাবে,হয়তো হাঁটতে গেছে।কিন্তু তাকে না বলে বেরোনোর সাহস দেখাবে না নিশ্চয়ই।
একটা অদ্ভুত অস্বস্তি জমতে শুরু করেছে।সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নিচে ছোট বাগান।সেখানে কিছু ফুল ফুটে আছে।বাতাসে ভেসে আসে তীব্র মাটির গন্ধ। দূরে কোনও মানুষ নেই, শুধু কুকুরের ডাক।সে নিচে নামে।
রিসেপশনে বৃদ্ধ ম্যানেজার।নাম বসু।চা খাচ্ছে।
“স্যার, কিছু লাগবে?”
মৃন্ময় বলে, “আমার স্ত্রী… মানে, ও সকালে কোথাও গেছে বুঝতে পারছি না। আপনি দেখেছেন?”
বসু চশমার ফাঁক দিয়ে তাকাল।
“না তো।হতে পারে হাঁটতে গেছে। পাহাড়ে অনেকে একা বের হয়।কিন্তু সাবধানে থাকাই ভালো। রাস্তাগুলো ফাঁকা।”
মৃন্ময় মাথা নাড়ে। কিন্তু মন শান্ত হচ্ছে না।সে চারপাশে খুঁজতে শুরু করে।পাশের কটেজ। তরুকে ডাক দেয়, “পাখি, তুমি কোথায়?”
কিন্তু নীরবতা।শুধু বাতাসে পাতার সড়সড় আওয়াজ।একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে তার বুকে।কেন জানি হঠাৎ মনে পড়ে গত রাতের কথা।
“না,না।ও এমন করে চলে যাবে না।”
কিছুক্ষণ পর সে পৌঁছালো উপরের তলার একটা রুমের সামনে।সেই ক্লাসমেটের। যে ছেলেটার সাথে তরুকে সে দেখেছিল গত কাল কথা বলতে।তরুকে রিসেপশনে দাড়িয়ে থাকতে বলে ইমার্জেন্সী একটা কল রিসিভ করেছিল।এর ফাঁকেই তরু ছেলেটার সাথে কথা বলেছে। মৃণ্ময় দেখেছে ছেলেটা নিজেই আগ বাড়িয়ে এসেছে।তরু হয়তো সৌজন্যতার খাতিরে কথা বলছিল।কিন্তু সেটা একদম ই পছন্দ হয়নি তার।
ছেলেটা দরজা খুলতেই মৃন্ময়ের চোখে আগুন জ্বলে উঠলো।
“তরু কোথায়?”
ছেলেটা অবাক হয়ে বলে,
“তরু? আমি কিভাবে জানবো।”
“তরু কোথায়?”
“আজব!আমি কিভাবে জানবো।আপনার বউ আপনি ভালো করে জানেন। আর আমি তো ফিরলাম মাত্রই”
“মিথ্যে বলছিস!”
চিৎকার করে উঠলো মৃন্ময়।তার কণ্ঠে এমন এক হিংস্রতা যে ছেলেটা এক পা পেছনে সরে গেলো।
“দেখো, আমি কিছুই জানি না” ছেলেটা শান্তভাবে বলে।
মৃন্ময় পর পর দুবার ঘুষি মারে ছেলেটাকে।কিন্তু ছেলেটা আসলেই কিছু জানতো না। বুঝতে পেরে মৃন্ময় আর সেখানে এক মুহূর্তের জন্যেও দাঁড়ায় না।
সে দৌড়ে আবার ঘরে ফিরে যায়। মনে ভয় জমেছে।আবার কি তাকে ছেড়ে গেছে?হয়তো কোনও চিরকুট, কোনও চিহ্ন আছে রুমে।ড্রেসারের ওপর একটা নোটপ্যাড পড়ে আছে। কিন্তু তাতে কিছু লেখা নেই।
“কোথায় গেল?”
মনটা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।দশটা বাজে। সূর্য এখন তীব্র। মৃন্ময় বাইরে বেরিয়ে পুরো কটেজ খুঁজে দেখে,কোথাও নেই। পাশের পাহাড়ি রাস্তায় দু’জন মেয়ে চা বিক্রি করছে।
সে ছুটে যায় তাদের দিকে
“এই সময়ে কাউকে যেতে দেখেছেন? এক মেয়ে, গ্রে জ্যাকেট পরা?”
বলতে বলতেই ছবি দেখায় তরুর।তারা মাথা নাড়ে।
“না। সকাল থেকে তারা এখানে।দেখেনি”
মৃন্ময় এবার কটেজের সামনের পথ ধরে নিচে নামে। কুয়াশা উঠেছে।রাস্তায় ঝরে পড়া পাতা। সে হাঁটে, হাঁটে, যেন প্রতিটি মোড়েই তরুর ছায়া পাবে।মনে পড়ে,তরুর হাঁটার অভ্যাস ছিল না। সে বলত, “আমি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে পারি না”
পাহাড়ের হাওয়াও তখন খুব ঠান্ডা।তাহলে আজ হঠাৎ বের হবে কেন?
রাস্তায় সবাইকে জিজ্ঞেস করছিল সে।রাস্তায় এক লোক,গায়ে মোটা সোয়েটার। মৃন্ময় এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“এনাকে দেখেছেন?”
লোকটা একটু ভেবে বলে, “না। তবে একজন মহিলা গিয়েছিল। হয়তো সাতটার দিকে। একা ছিল। নিচের দিকে নামছিল। মুখে মাস্ক, চুল খোলা। গায়ে গ্রে রঙের জ্যাকেট ছিল।
মৃন্ময়ের বুক ধক করে ওঠে। “আপনি নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ, তবে দূর থেকে দেখেছি।”
সে বুঝতে পারে, তরু একা কোথাও গেছে। কিন্তু কোথায়? কেন?
মৃন্ময় নিচের দিকে দৌড় দেয়, কিন্তু কয়েকটা বাঁক পার হতেই পথ দুই ভাগ হয়ে যায়। একদিকে ঝর্ণার শব্দ, অন্যদিকে ছোট বাজার।সে থমকে যায়।বাতাসে হঠাৎ ভেসে আসে তরুর হাসির মতো একটুখানি প্রতিধ্বনি।কল্পনা!মৃন্ময় থমকে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়ছে।
“পাখি”
গলা শুকিয়ে গেছে। গলা দিয়ে বেরোয় না ঠিকমতো। চোখের সামনে পথদু’টো.একটা ঝর্ণার দিকে নেমে গেছে, অন্যটা ঘুরে গেছে পাহাড়ি বাজারে। কোনটা বেছে নেবে সে?
ঝর্নার পথটা পাথুরে। ফাঁকে ফাঁকে কুয়াশা জমেছে। মাটিতে শুকনো পাইনপাতা। জুতো স্লিপ করে যায় বারবার, কিন্তু থামে না সে।
“পাখি”
তার গলা ভেঙে যাচ্ছে ডাকতে ডাকতে।ঝর্ণার গর্জন ক্রমে জোরালো। কাছেই নিশ্চয়ই।শেষে এক ফাঁকা জায়গায় এসে থামে মৃন্ময়।সামনে সাদা ধোঁয়ার মতো জল পড়ছে ঝর্ণা বেয়ে। চারপাশে পাথর, শেওলা, আর বাতাসে ঠান্ডা জলছিটে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। শুধু এক কোণে পড়ে আছে একটা পরিচিত জিনিস।গ্রে রঙের জ্যাকেট।মৃন্ময়ের বুকের ভেতর কিছু যেন ছিঁড়ে যায়।সে ছুটে যায়, জ্যাকেটটা তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে। তরুর গায়ের গন্ধ এখনো লেগে আছে তাতে।চোখের কোণে ঝাপসা জল। ঠোঁট কাঁপছে।
“তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে?”
সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ভেজা পাথরের ওপর।ঝর্ণার শব্দে গলা ডুবে যায়, কিন্তু তবু চিৎকার করে ওঠে।
“পাখি”
শব্দটা পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে, বারবার। যেন তরুই ফিরছে অন্য দিক থেকে, মৃদু হাসিতে।
“না… না…”
মাথা নাড়ে মৃন্ময়।
“তুমি এমন করে যাবে না।”
বুকের ভেতর থেকে একরকম গর্জন বেরোয়।
সে মাথা নিচু করে ।চোখের কোনা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।রোদ, কুয়াশা, ঝর্ণার শব্দ।সব মিলিয়ে চারপাশ অদ্ভুত নীরবতায় ঢেকে যায়।
বিপ… বিপ…আজ শব্দটা যেন একটু আলাদা শোনাচ্ছে। যেন তাল বদলে গেছে, তাতে একফোঁটা জীবন ঢুকে পড়েছে।
আরবাজ চেয়ারে বসে, মাথা নিচু করে অরুর হাত ধরে আছে। হাতটা ঠান্ডা, কিন্তু আজ একটু অন্যরকম।মনে হচ্ছে ভেতরে কোথাও খুব সূক্ষ্ম একটা নড়াচড়া হচ্ছে। সে নিজের আঙুল দিয়ে অরুর হাতের উপর আলতো চাপ দিল। একবার। দু’বার।
কোনো উত্তর নেই।তবুও আজ আরবাজের বুকের ভেতর অকারণ একটা ধক ধক উঠছে।
নার্স এসে চুপচাপ মনিটরের দিকে তাকাল, তারপর বলল,
“স্যার, রেসপন্স করছে মনে হচ্ছে।”
আরবাজ তাকাল। চোখের পাতা একবার কেঁপে উঠল অরুর। যেন গভীর ঘুমের মধ্যে কেউ হালকা ডাক শুনে উঠতে চাইছে। ঠোঁট নড়ল অল্প, শব্দ নেই তবুও একটা নাম যেন ফিসফিস করে বেরোতে চাইল।
“অরু”
আরবাজ নিজেই ফিসফিস করে বলল,
“শুনতে পাচ্ছ?”
কোনো উত্তর নেই, শুধু বুকটা ওঠানামা করছে আগের চেয়ে নিয়মিত ছন্দে।আরবাজ চেয়ার টেনে কাছে আনল। চুলের গোছা সরিয়ে দিল মুখ থেকে। সেই চেনা গন্ধ।শ্যাম্পু, ঘাম, আর হাসপাতালের জীবাণুনাশক গন্ধ একসাথে মিশে একটা অদ্ভুত বাস্তবতা তৈরি করেছে।সে বুঝতে পারছে না, ঠিক কোন অনুভূতিটা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।স্বস্তি, না ভয়?
আরবাজ মাথা নিচু করে বলে,
“তুই ফিরবি, শুনছিস? তুই পারবি।”
কথাটা বলার পর ঘরে হঠাৎ একরকম নীরবতা নেমে এলো।
আরবাজ অরুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।ঠোঁটের কোণে কাঁপন, চোখের পাতা সামান্য নড়ল।সে ঝুঁকে গেল আরও কাছে।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, অরুর আঙুল তার হাতের মধ্যে একটু নড়ে উঠল।খুব সূক্ষ্ম, তবুও স্পষ্ট।আরবাজ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল।তার বুকের ভেতর একটা শব্দ,একটা আশা।যেন বছরের পর বছর জমে থাকা কুয়াশা ভেদ করে রোদ ঢুকছে।
“আমি আছি,তুই একা না।”
সেই মুহূর্তে অরুর চোখের পাতা ধীরে কাঁপল।
তারপর এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখের কোণ দিয়ে।
গাল বেয়ে নেমে এল সাদা বালিশে।আরবাজ স্থির।
হাতের মুঠো আলগা করল না।শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল সেই ফোঁটাটার দিকে।যেন ওই এক ফোঁটাতেই প্রমাণ মেলে,জীবন এখনো হাল ছাড়েনি।
চলবে,,,,
Share On:
TAGS: ডার্ক ডিজায়ার, দূর্বা এহসান
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৩(প্রথমাংশ + শেষাংশ)
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১৭
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১২
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১৪
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ২
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১৬
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৪
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৮
-
ডার্ক সাইড অফ লাভ পর্ব – ২