Golpo ডার্ক ডিজায়ার ডার্ক রোমান্স

ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১১


১১.

Dark_Desire

ডার্ক_ডিজায়ার

দূর্বা_এহসান

মাঝে কেটে গেছে পাঁচদিন।এই পাঁচ দিনে পৃথিবী বদলায়নি, কিন্তু তরু বদলে গেছে অনেক।জ্বর পুরোপুরি না গেলেও মাথার ভার কমেছে।তবু শরীর দুর্বল।মন নিস্তেজ। আর চারপাশের সবকিছু
ধোঁয়াটে।এই সময়টুকুতে মৃন্ময় যেন তার চারপাশে একটা ছোট দুনিয়া তৈরি করেছে।যেখানে তরু আর মৃন্ময় ছাড়া কিছুই নেই।

সকাল থেকে রাত ,সব কাজ মৃন্ময় নিজেই করেছে।তরুর কাপড় ধোয়া, শুকানো, বিছানা বদলানো, ওষুধ খাওয়ানো – সব নিজের হাতে।

তরু একদিন বলেছিল,
“আপনি এগুলো করতে পারবেন না, মৃন্ময়। আমি ঠিক আছি।”

মৃন্ময় কেবল হেসে বলেছিল,
“তুমি এখন শুধু বিশ্রাম নাও, বাকিটা আমি আছি।”

তরু মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। কিছু বলার ছিল না।ওর ভেতরের ঘৃণা, রাগ, অভিমান সব যেন একে একে গলে যাচ্ছে।মৃন্ময়ের নিঃশব্দ উপস্থিতি সেই বরফ গলাচ্ছে প্রতিদিন।অথচ সে নিজেই টের পাচ্ছে না।

রাতগুলোতে যখন ঘুম আসত না।মৃন্ময় জানালার পাশে তাকে কোলে নিয়ে বসে বই পড়ত মৃদু আলোয়।পাতা উল্টানোর শব্দটা এত ধীরে করত যে তরুর নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত হারিয়ে যেত না।
কখনো তরু আধা ঘুমে চোখ খুলে দেখত,ও বসে আছে আগের মতোই, চুপচাপ।মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাত তার দিকে,
তারপর আবার মাথা নামিয়ে পড়া চালিয়ে যেত।

তরু মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখত।এই মানুষটা, যাকে একসময় ঘৃণা করত।সে-ই আজ ওর শরীরের প্রতিটা যন্ত্রণার পাশে নীরব প্রহরী হয়ে বসে আছে ঠিক আগের মতই। তরুর ভেতরে কোথাও একটা গলন,যেন বরফ ধীরে ধীরে গলছে, তবু জেদে বলছে,
“না, আমি নরম হব না।”

সূর্য উঠলে ঘরের ভেতর আলো ঢুকত ধীরে ধীরে।তরু তখন জানালার পাশে বসে থাকত।আর মৃন্ময় রান্নাঘরে কফি বানাত।
চুলায় পানি ফুটতে থাকত।আর তার শব্দ মিশে যেত ঘরের নীরবতার সঙ্গে।

একদিন তরু বলেছিল,
“আপনি ক্লান্ত”

“তুমি বিশ্রাম নিচ্ছো, তাই আমি শান্তি পাচ্ছি।
ক্লান্তি কোথায়?”

তরুর গলায় আটকে গিয়েছিল কিছু কথা।সে আর কিছু বলতে পারেনি।জ্বরের পর শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল।কখনো মাথা ঘোরে, কখনো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়।মৃন্ময় তখন পাশে এসে কপালে হাত রাখে।তরু তার চোখের দিকে তাকায়।মৃন্ময় চুলগুলো সরিয়ে দেয় কানের পেছনে।
আর বলে,
“এভাবে তাকিও না, আমি অভ্যস্ত নই।”

তরু হাসে।খুব আস্তে।এই হাসিটাই তার জীবনের সবচেয়ে সত্য জিনিসগুলোর একটা।দিনগুলো একঘেয়ে, তবু অদ্ভুত শান্তিতে কাটছে।মৃন্ময় এখন তার জন্য খাবারের সঙ্গে ছোট ছোট নোট রাখে। কোনো জোরজবরদস্তি করেনা।যেন তরুর মন মত হতে চাচ্ছে আবারো।
“খেয়ো, ঠান্ডা হলে খারাপ লাগবে।”
“আজ একটু বেশি পানি খেও।”
কখনো শুধু একটা শব্দ “পাখি।”

তরু সেই নোটগুলো পড়ে রাখে বালিশের নিচে।জানালা দিয়ে বাতাস এলে ওগুলো হালকা নড়ে ওঠে,যেন কাগজও বেঁচে আছে, শ্বাস নিচ্ছে।এক বিকেলে মৃন্ময় কাপড় শুকাচ্ছিল বারান্দায়।তরু পেছন থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল।ওর গলার পাশ দিয়ে ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে।আর রোদে সেটা ঝিলমিল করছে।মৃন্ময় আনমনে হাসছে।তরু প্রথমবার বুঝল, যত্নের মধ্যেও পুরুষের একরকম শক্তি আছে।

মৃন্ময় ঘুরে তাকাতেই তরু চোখ নামিয়ে নিয়েছিল।

“কিছু লাগবে?”
মৃন্ময় জিজ্ঞেস করল।

“না”
তরু বলল ধীরে।
“সবকিছুই তো আপনি করছেন।”

মৃন্ময় একটু হেসে বলেছিল,
“এই কাজগুলো করলে শান্তি পাই।
তোমাকে কষ্টে দেখলে নিজেকে ঘৃণা হয়।”

তরু উত্তর দেয়নি।ওর বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি হচ্ছিল।
রাতে,বাইরে তখন হালকা বাতাস।তরু জানালার পাশে বসে গরম দুধ খাচ্ছিল।মৃন্ময় এসে জানালার পর্দা সরিয়ে বলে,
“আগামীকাল বাইরে যাবো।”

তরু চমকে তাকায়,
“বাইরে? কেন?”

মৃন্ময় চুপ করে হাসে।
“তোমার মন বদলাতে।তুমি যেদিন প্রথম আমার সঙ্গে দেখা করেছিলে,সেই জায়গাটা মনে আছে?”

“মনে আছে।লেকের ধারে।”

“কাল সেখানে যাবো।”

তরু তাকিয়ে ছিল তার দিকে।মৃন্ময়ের চোখে কোনো নাটকীয়তা নেই।শুধু ভালোবাসা।যেটা কথা দিয়ে নয়, উপস্থিতি দিয়ে বিশ্বাস করিয়ে দেয়।সেই রাতে তরুর ঘুম এল অনেকদিন পর প্রথমবারের মতো গভীর।জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে পড়েছিল বিছানায়।মৃন্ময় বাইরে বসে ছিল বারান্দায়,
চুপচাপ।হাতে এক কাপ কফি আর চোখে একরকম শান্তি,
যেটা কেবল তখনই আসে।যখন প্রিয় মানুষটা ঘুমোচ্ছে নির্ভয়ে।

রাতের শেষ ভাগে বৃষ্টি পড়ল টুপটাপ করে।ছাদের ওপর, গাছের পাতায়, জানালার কাচে।প্রতিটা শব্দ যেন পুরনো দিনের কোনো সুর।মৃন্ময় চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল।মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই লেকের ছবি।যেখানে তরুকে প্রথম দেখেছিল বৃষ্টির দিনে।ছাতা ভেঙে গিয়েছিল, চুল ভিজে গিয়েছিল,
আর তরু বলেছিল,
“আপনি কি সব সময় এভাবেই অপরিচিতদের সাহায্য করেন?”
মৃন্ময় তখনও জানত না,ওর জীবনের সবচেয়ে অচেনা মানুষটাই একদিন হবে
ওর সবকিছু।


ভাবনা থেকে বের হলো তরু আর মৃন্ময়।লেকের পানি স্থির।তবু তার ভেতর হালকা ঢেউ উঠছে বাতাসে।দু’জনেই দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশিই।কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।তরু একটা বড় আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে।চুল উড়ছে বাতাসে।চোখ নদীর ওপারে।মৃন্ময় একটু দূরে, হাত পকেটে, চোখ তার দিগন্তে নয়।তরুর মুখে।

বৃষ্টি হয়েছে সকালে। মাটির গন্ধে ভরে আছে চারপাশ।লেকের ধারে কিছু ফুল পড়ে আছে, ভেজা ঘাসের ওপর চকচক করছে রোদ।একটা হালকা পাখির ডাক ভেসে এলো দূর থেকে।তারপর আবার সেই নীরবতা।

“মনে আছে? এই জায়গায় আমাদের প্রথম দেখা।”
মৃন্ময় হেসে ফেলল নরম করে।

“ভুলতে পারব নাকি?তুমি রেগে ছিলে, কারণ আমি তোমার বইতে পানি ফেলেছিলাম।”

তরু হালকা মাথা নাড়ল,
“তখন তুমি বলেছিলে, দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ইচ্ছে করে।”

“ইচ্ছে করেই ফেলেছিলাম।”

তরু অবাক হয়ে তাকাল,

“কি!”
মৃন্ময় মুচকি হাসল,
“তোমার সাথে কথা বলার অজুহাত চেয়েছিলাম।”

দুজনেই আবার চুপ।লেকের ওপরে হালকা রোদ পড়ছে.পানিতে আলো নাচছে।তরু ভেতরে ভেতরে ভাবছে গত কয়েকদিনের কথা।কতটা বদলে গেছে সবকিছু!মৃন্ময়,যে মানুষটা একসময় তাকে কষ্ট দিয়েছিল।সেই মানুষটাই গত কয়েকদিনে তার পাশে থেকেছে নিঃস্বার্থভাবে।কিন্তু কেন?

তরু তাকাল তার দিকে।মৃন্ময় এখন পাথরের ওপর বসে.পানির মধ্যে ছোট ছোট ঢেউ ছুঁয়ে দেখছে আঙুল দিয়ে।তার চোখে শান্তি আছে, কিন্তু ক্লান্তিও আছে।তরুর মনে হলো, এই মানুষটা এখন সত্যিই বদলে গেছে।

মৃন্ময় অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তরুর দিকে।তাকে তুমি করে বলল! নাকি সে ভুল শুনলো?

তরু মৃদু গলায় বলল,
“তুমি জানো, আমি তোমাকে কখনো এমন ভাবিনি।”

মৃন্ময় তাকাল।
“কেমন?”
“এমন যত্নশীল,শান্ত।”

মৃন্ময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“হয়তো আমি তখনও এমন ছিলাম। শুধু তুমি দেখোনি, আমি দেখাতে পারিনি।”

তরু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“হয়তো আমরা দুজনেই তখন ঠিক ছিলাম না।”

বাতাসে একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে এলো।দুজনের চোখে জল চিকচিক করে উঠল।কিন্তু কেউ বলল না কিছুই।লেকের জল তখন সোনালী আলোয় ঝলমল করছে, যেন তাদের অতীতকেও মুছে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

তরু মাথা নিচু করল।তার গলার স্বর নরম, কেঁপে ওঠা।

“তুমি এমনভাবে যত্ন নিচ্ছো যে, আমি নিজের ভেতরের রাগটাই খুঁজে পাচ্ছি না আর।যে রাগ নিয়ে আমি তোমার থেকে দূরে গিয়েছিলাম”

মৃন্ময় ধীরে এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়াল।

“তুমি রাগ করো, ঘৃণা করো।যা খুশি করো।কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়ছিনা”

তরু তাকাল তার দিকে।তার চোখের কোণে আলো পড়েছে, সেই চোখে এখন আর হিংস্রতা নেই।যা বিয়েতে ছিল।শুধু ভয়, আর অজানা মমতা।

“তুমি ভয় পাও এখনো?”

তরু প্রশ্ন করল ধীরে।মৃন্ময় মাথা নাড়ল।
“ভয় পাই। যদি আবার হারিয়ে ফেলি এই শান্তিটা।”

তরু একটুখানি হেসে বলল,
“তাহলে ধরে রাখো।আমরা দুজনেই এবার আর হারাব না।”

বলেই তরু হালকা কেঁপে উঠল।তার মন বলে উঠল।এই মুহূর্তটা যদি থেমে যেত!এই লেকের ধারে।এই শান্ত বাতাসে।যেখানে কোনো প্রতিশোধ নেই,শুধু দুইটা ক্লান্ত হৃদয়ের মিশে যাওয়া নীরবতা।

তরু ধীরে বসে পড়ল ঘাসের ওপর।মৃন্ময়ও পাশে বসল।দু’জনের মাঝখানে কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব।

“আমি এই জায়গাটা ভুলতে পারিনি কখনো।”
“আমিও না।তুমি চলে যাওয়ার পরও প্রায়ই আসতাম এখানে।
ভেবেছিলাম একদিন হয়তো তোমাকে আবার পাবো।”

তরু হাসল নিঃশব্দে,
“তুমি পেয়েছো।”

বাতাসে পাতা উড়ে গেল.দুজনেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল লেকের দিকে.জীবনের মতোই, কখনো স্থির, কখনো ঢেউ।

সূর্য তখন ঢলে পড়ছে।আকাশে হালকা গোলাপি রঙ।লেকের পানিতে পড়ে রোদের শেষ রেখাগুলো নেচে বেড়াচ্ছে।মৃন্ময় নিচু গলায় বলল,
“চলো, একটু হাঁটি?”

তরু ধীরে মাথা নাড়ল।দুজনেই উঠে দাঁড়াল।তাদের ছায়া মিশে গেল পানির ওপর পড়া সোনালী আলোয়।একটা নতুন নীরবতা জন্ম নিল।যেখানে অতীতের ব্যথা মিশে গেল বর্তমানের প্রশান্তিতে।

——————

রাত নেমেছে।বৃষ্টি হচ্ছে থেমে থেমে।লেকের ধারে বাতাসে কুয়াশা।দূরে কটেজের জানালায় আলো জ্বলছে।রজনী দাঁড়িয়ে আছে গাছের আড়ালে।গায়ে কালো কোট, মাথায় হুড টানা।
বৃষ্টির ফোঁটায় তার চুল ভিজে গেছে, ঠোঁটের কোণে হাসি।

তার চোখ স্থির।সেই কটেজের দিকে।একটা গাড়ি এসেছে মিনিট দশেক আগেই।আর তখন থেকেই সে দেখছে।দু’জন মানুষ ভিতরে ঢুকেছে, জানালা বন্ধ হয়েছে।রজনী ধীরে শ্বাস ফেলল।
হাতের ভেতর ধরা একটা পুরনো চেইন লকেট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।চেইনটা একসময় ছিল তরুর।এখন সেটা তার মুঠোয়।

তার কণ্ঠে নিচু গলায় নিজেকেই বলল।
“তুমি ভেবেছিলে শেষ হয়ে গেছে?আমি এখনো আছি, মৃন্ময়।”

হালকা বাতাসে পাতার শব্দ।সে মাথা তুলল আকাশের দিকে।
চাঁদ অর্ধেক ঢাকা মেঘে।তার চোখে আলো পড়ে ঝলমল করছে,
কিন্তু সেই ঝলকটা ঠান্ডা.যেমন প্রতিশোধের আগুন নিভে গিয়ে ছাইয়ে জ্বলতে থাকে।

রজনী ব্যাগ খুলে ছোট একটা ডায়েরি বের করল।পাতা উল্টিয়ে থামল এক জায়গায়।তাতে একটা পুরনো ছবি।তরু আর মৃন্ময়।
একসঙ্গে হাসছে।রজনী ছবিটার দিকে তাকাল অনেকক্ষণ।তারপর তরুর মুখের ওপর টানল কালো কলমের দাগ।হাসল নিঃশব্দে।

” আমি ভুলে যাবো?তুই ভুলে গেছিস হয়তো।কিন্তু আমি না তরু।”

তারপর সে ঘড়ির দিকে তাকাল।বৃষ্টির শব্দ ঘন হয়ে আসছে।সে ধীরে ধীরে কটেজের দিকে হাঁটা দিল।পায়ের নিচে কাদা নরম হয়ে যাচ্ছে, জুতো ডুবে যাচ্ছে ভিজে মাটিতে।তবু তার পা থামছে না।দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।হাতে একটা ছোট চাবির গোছা।
একটা চাবি বের করে তাকাল সেটার দিকে, তারপর দরজার নব ছুঁল।কটেজের ভেতর আলো নিভে গেছে পুরোপুরি।

“তুই যেভাবে আমার জীবনটা ভেঙেছিস,আমি সেভাবেই তোর শান্তিটা ভাঙব।”

বৃষ্টি আরও জোরে নেমে এল।তার আঙুল দরজার তালায় স্পর্শ করল।দরজার ফাঁক দিয়ে আলোয় ঝিলিক খেল তার চোখে।তারপর সে ভেতরে পা রাখল।দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

চলবে,,,,

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply