উড়ালমেঘেরভেলায়
লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক
পর্ব_২১
[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]
রানিয়ার শারীরিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হচ্ছে। বারবার প্রচন্ড পরিমাণে বমি হচ্ছে ওর। আশফি বেগম ছেলে বৌয়ের কাছ থেকে সরছেন-ই না। রানিয়ার পাশে আছেন সর্বক্ষণ। ওকে ধরে রেখেছেন শক্ত করে। ডাক্তার স্পষ্টভাবে বলে গিয়েছেন, রোগীর অবস্থা ক্রমশই এমন হতে থাকলে সেটা তার এবং পেটে অবস্থান করা ভ্রুণের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে৷
রানিয়া সবেমাত্র বমি করে এসে বেডে গা এলিয়ে দিয়েছে। শরীরে আর একরত্তি শক্তি নেই ওর। শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছে। চোখ বুঁজলেই সবকিছু অসহ্যকর লাগছে। আভিয়ানের মুখটা চোখের সামনে একদম স্পষ্টভাবে ভেসে উঠছে বারবার। অথচ আগে কখনো এমন হয়নি। এই-ই প্রথম। ব্যাপারটা ওকে আরো বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। আভিয়ানের বিপদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বারংবার। এসব কারণে রানিয়ার দুশ্চিন্তা, ভয় এবং মনের আশঙ্কা আরো বাড়ছে। এক মুহূর্তও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না ও।
ছোট মামি আভিয়ানের মামাতো ভাইদের পাঠিয়েছেন ওর খোঁজ করতে। এই বিষয়েই ইতিমধ্যে এখানে এসে উপস্থিত হওয়া আভিয়ানের খালাদের বলছিলেন তিনি। রানিয়া বেডে শুয়েই তা শুনতে পেল। ও গলার জোর পাচ্ছে না। তবুও বহুকষ্টে পাশে বসে থাকা শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো, “উনাকে খুঁজে লাভ নেই। এভাবে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের প্রতি না থাকুক, তার কি নিজের সন্তানের প্রতিও কোনো টান নেই মা?”
আশফি বেগম কি বলবেন! আজ তিনি ভাষাহীন। একদিকে ছেলের জন্য চিন্তা, অপরদিকে ছেলে বৌমা আর তার আগত সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা। কোনদিকে যাবেন তিনি! যে পরিস্থিতি, তাতে দুশ্চিন্তায় তো তার-ই প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। কখন জানি তিনি নিজে অসুস্থ হয়ে পরেন। তবে নিজেকে যথাযথ চেষ্টায় সামলে নিয়েছেন। কারণ, এখানে সবকিছু তাকেই হ্যান্ডেল করতে হবে। রানিয়া অসুস্থ, তাকে দেখতে হবে। সবাই দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পরেছে, তাদের সামলাতে হবে। ছেলের জন্য দোয়া করতে হবে।
আশফি বেগম রানিয়ার পিঠে হাত রেখে ওকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, “চিন্তা কোরো না মা। আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখো। তিনি আমাদের নিরাশ করবেন না। আমার ছেলে ঠিকই ফিরে আসবে দেখো। ওর সন্তানের প্রতি ওর টান থাকবে না কেন? টান আছে বলেই ও ফিরবে দেখে নিও।”
“টান যদি থাকতোই, তাহলে এভাবে চলে গেল কেন?”
রানিয়া ওর শাশুড়ির মুখোমুখি বসে স্পষ্টভাবে প্রশ্নটা করলেন। আশফি বেগম এবার নিশ্চুপ হলেন। এই প্রশ্নের জবাব যে তার কাছে নেই। ছেলে ফিরে আসা না অবধি তিনি দৃঢ়ভাবে কোনো কথা-ই বলতে পারছেন না। বললেও সে সকল কথাগুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে রানিয়ার এমন আর্তনাদ, আহাজারি এবং জটিল প্রশ্নগুলোর নিকটে।
ছোট মামি বাইরে থেকে আসার পর আশফি বেগমের কাছে এগিয়ে এসে তার কানে কানে কি যেন বললেন। তৎক্ষনাৎ আশফি বেগমের মুখ কালো হয়ে গেল৷ রানিয়া তখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। ছোট মামির কানে কানে কথা বলার পরে শাশুড়ির মুখের অমন প্রতিক্রিয়া দেখে হুড়মুড়িয়ে বসলো ও। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো— “কী হয়েছে মা? আভিয়ানের খোঁজ পাওয়া গেছে?”
আশফি বেগম চুপ করে রইলেন। কোনো জবাব দিলেন না। যেন নিথর হয়ে গেছেন তিনি। রানিয়ার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে বেডের সাদা চাদরের ওপর পরতে লাগলো। শাশুড়িকে নিরব থাকতে দেখে ওর মন হু হু করে কেঁদে উঠলো। ও পুনরায় শাশুড়িকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “বলুন না মা, কিছু তো বলুন।”
আশফি বেগম রোবটের ন্যায় বললেন, “আমার আভিয়ানের নাগালে ওরা পৌঁছাতে পারেনি। ওরা খোঁজ করতে করতে দক্ষিণ দিকে গিয়েছিল, বহুদূরে। ওদিকে অনেক মানুষকে ওর ফটো দেখানোর পর এক জায়গা থেকে শুনেছে, ওরা চড়াইবিলে গেছে। আর কিছুক্ষণ আগেই নাকি ওদিকে নদীর ওপাড় থেকে অজস্র গোলাগুলির শব্দ ভেসে এসেছে। আগুনের ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠছে। সবাই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। তবে কেউই ওদিকটায় যাওয়ার সাহস করছে না। একরামরাও যেতে পারেনি।”
রানিয়া কথাটা শোনামাত্র হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। ওর চিৎকারে পুরো হসপিটাল কেঁপে উঠলো যেন। ওর আহাজারি উপস্থিত প্রতিটা মানুষের হৃদয়ে কম্পন ধরালো। সবাই এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকলেও এবার বাঁধ ভাঙলো। কেউই আর শান্ত থাকতে পারলো না। আভিয়ান সকলের কলিজার টুকরা। সবাই ওকে অনেক ভালোবাসে। ওর জন্য সকলের হৃদয়ে ঝড় উঠতে লাগলো ক্রমাগত।
.
.
রানিয়া চোখ খুলতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখতে পেল। এতোক্ষণ ও কোথায় ছিল, ওর চারপাশে কি হয়েছে বা হচ্ছে, কিছুই ধারণায় ছিল না। নূন্যতম ঠাহরও করতে পারেনি ও। রানিয়া উঠে বসার চেষ্টা করলো। ছোট খালামণি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ওকে উঠতে দেখে দৌড়ে এলেন তিনি। বালিশে হেলান দিয়ে বসতে সাহায্য করলেন। রানিয়া দেখলো, যেই খালামণি কিছুক্ষণ আগেও কাঁদতে কাঁদতে হুঁশ হারাচ্ছিলেন, তার মুখ এখন স্বাভাবিক। মুখে কিঞ্চিৎ সামান্য বলিরেখা। হাসছেন তিনি। ওর অদ্ভুত ঠেকলো ব্যাপারটা। এমন শোকাবহ মুহূর্তেও কেউ হাসতে পারে? মনে মনে একটু বিব্রতবোধ করলো ও। ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
পরপরই ওকে আরো বেশি বিস্মিত করে দিয়ে সবাইকে উজ্জ্বল হাস্যমুখে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখা গেল।
রানিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো সবাইকে৷ ওর শাশুড়ি সবার সামনে ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে হাসিমুখে বৌমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। পেছনে দাঁড়ানো ইকরামের উদ্দেশ্যে বললেন, “ও ইকরাম মিষ্টি এদিকে দে।”
ইকরাম ভাই সামনে এগিয়ে এসে তার ফুপুর হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিলেন। আশফি বেগম রানিয়ার পাশে বসতেই ও কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো, “এসব কী হচ্ছে মা? হঠাৎ মিষ্টি কেন? এমন সময়ে… আপনার ছেলের কোনো খোঁজ পেলেন?”
“এমন সময়েই তো মিষ্টি প্রয়োজন। জানো মা আমি সবসময় বিশ্বাস করি, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখলে সবকিছু ঠিক থাকে। তিনি সব ঠিক করে দেন। নাহলে দেখোই না, ছেলের বিপদের সময়েও কি আমি এতোটা শান্ত থাকতে পারতাম? শুধু আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছি। তাকে ভরসা করেছি। এজন্যই তিনি আমার আদরের ছেলেকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিলেন। ছেলেটা আমার কত সাধের। দীর্ঘ ছয় বছর অপেক্ষা করার পরে ও আমার কোল জুড়ে এসেছিল। ছেলেকে তো আমি আল্লাহর ওপর ভরসা রেখেই এই কঠিন এবং জীবনের আশংকাজনক পেশায় জড়ানোর অনুমতি দিয়েছি। আর তার ওপর ভরসা আছে বলেই তিনি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
“মানে আপনার ছেলে ফিরে এসেছে?!”
রানিয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হলো। মন চঞ্চল হলো ওর। আশফি বেগম লম্বা একটা হাসি দিয়ে ওর মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ মা। তোমার স্বামী ফিরে এসেছে, তোমার অনাগত সন্তানের বাবা ফিরে এসেছে। অনেকক্ষণ আগেই এসেছে। তুমি হুঁশে ছিলে না বলে জানতে পারোনি।”
“অনেকক্ষণ মানে? কতক্ষণ আগে?”
“এইতো প্রায় ঘন্টা চারেক হবে।”
রানিয়া কথাটা শুনে অবাক হলো। ওর তো মনে হয়েছে, ও আধাঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে। দীর্ঘসময় ঘুমালে তো বুঝতে পারতো। কিন্তু সেরকম কোনোকিছু অনুভবই হয়নি ওর। রানিয়া মুখ ঘুরিয়ে পাশের দেয়ালে তাকিয়ে দেয়ালঘড়িতে দেখলো, এখন সাড়ে এগারোটা বাজে। ও শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করলো, “এখন কি রাত?”
“হ্যাঁ মা। তোমাকে একটু পরে হসপিটাল থেকে নিয়ে যাবো আমরা। তোমাকে শান্ত করার জন্য ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। এজন্য ঘুমিয়ে পরেছিলে তুমি।”
রানিয়া হিসাব করলো। মাগরিবের আজানের সময় ও হুঁশ হারিয়েছিল। তারপর ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। আভিয়ান এসেছে চার ঘন্টা আগে৷ মানে রানিয়া জ্ঞান হারানোর ঘন্টা দেড়েক পরে। হঠাৎ আভিয়ানের কথা মনে পরতেই ও উঠে বসলো। চারিপাশে তাকিয়ে আভিয়ানকে খুঁজতে লাগলো ওর অশ্রুসিক্ত চোখদু’টো।
আশফি বেগম বোধহয় বুঝতে পারলেন ছেলেবৌয়ের মনের দশা। সবাইকে তাগাদা দিয়ে কেবিনের বাইরে নিয়ে গেলেন তিনি। যাওয়ার আগে মিষ্টির প্যাকেটটা কেবিনেটের ওপরে রেখে গেলেন।
.
.
রানিয়া সোজা হয়ে বসে পাশ থেকে পানির বোতলটা উঠিয়ে নিয়ে পানি খাচ্ছিল। তখনই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। ও বোতলের ছিপিটা আঁটকে রেখে সামনে তাকাতেই দেখলো, আভিয়ান দরজার নব ঘোরাচ্ছে আর একদৃষ্টিতে ওকে দেখছে। রানিয়ার দৃষ্টি আঁটকে রইলো আভিয়ানের ওপর। আভিয়ান ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো বেডের কাছে। রানিয়া ভালোভাবে আপাদমস্তক দেখলো ওকে। লোকটার পরনে একটা ব্রাউন কালারের ফুল স্লিভ হাফ জিপার জ্যাকেট এবং ব্ল্যাক কালার ফর্মাল প্যান্ট। বোঝাই যাচ্ছে, আগের পোশাক পাল্টে ফেলেছে আসার পরে। রানিয়া মুখ খুলতে গিয়েছিল সবেই। ও কিছু বলে ওঠার আগেই আচনক আভিয়ান বেডে ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলো। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ওর ওষ্ঠদ্বয়ে মিশিয়ে নিলো নিজের অধর জোড়া।
কিয়ৎক্ষণ পরে আভিয়ান রানিয়াকে ছাড়লো। রানিয়ার চোখজোড়া তখন জলে পরিপূর্ণ। আর কিছু সময় পেরোলেই বোধহয় গড়িয়ে পরবে গাল বেয়ে। ঠোঁট উল্টে রেখেছে না বলা কঠিন অভিমানে। তখনও আভিয়ানের চোখে ওর চোখ আঁটকে আছে। আভিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই দৃঢ়ভাবে বলে উঠলো, “যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত সৈনিকেরা বিষ খেয়ে আত্মহ’ত্যা করে। আর আমার মতো জয়ী যোদ্ধারা জয়লাভ করে ময়দান হতে ফিরে এসে তার সহধর্মিনীর ঠোঁটে চুমু খেয়ে আরো একবার জিতে যায়।”
চলবে
নোটবার্তা: আপনাদের একটা কনফিউশান বা ভুল ধারণা ক্লিয়ার করে দিই। এই গল্পের নায়ক আভিয়ান-ই। অন্য কেউ নয়। আমি গত পর্বে মেজর মেজবাহ ইফতেখারের পরিচয় উল্লেখ করেছিলাম, কারণ সে হবে আমার পরবর্তী গল্পের নায়ক। তার বর্ণনা শুনে বুঝতেই পারছেন চরিত্রটা কতোটা তুখোড় হবে!
যাকগে, মেজর মেজবাহ ইফতেখার আমার পরবর্তী গল্পের নায়ক। তাকে শুধুমাত্র আগেই আপনাদের সাথে পরিচয় করাতে এই গল্পে কাহিনীর মধ্য দিয়ে তার পরিচয়টা উল্লেখ করেছি। মেজবাহ’কে লিখতে গিয়ে আমি নিজেই আঁতকে উঠেছি। কি মারাত্মক একজনকে লিখছি!
আপনাদের কনফিউশান ক্লিয়ার হলো তো?
আমি কখনো সিরিয়াসলি রেসপন্স করার কথা বলি না। তবে আজ অনুরোধ করছি, প্লিজ সবাই একটি বেশি বেশি রেসপন্স করবেন৷ দু’দিন অনিয়মিত থাকায় পেইজের রিচ ডাউন। আমি আজ থেকে আবারও নিয়মিত হচ্ছি ইন শা আল্লাহ।
Share On:
TAGS: উড়াল মেঘের ভেলায়, ঝিলিক মল্লিক
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৭
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৮
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৯
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ২০
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৪
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৩