#আড়ালে_তুমি |০২|
#_সাইদা_মুন
মেঘকে চুলের মুঠি ধরে উঠিয়ে আরেকটি থাপ্পড় দেয় গালে। পরপর দুটি থাপ্পড়ে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। একে তো সকাল থেকে না খাওয়া, তার উপর থাপ্পড়! শরীর আর সইতে পারে না, চোখ বুঝে আসে।
চোখ খুলে পানির ঝাপটায়। মেঘের জ্ঞান ফিরতেই তার মা মাহমুদা বেগম আবার তেড়ে আসেন। চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করিয়ে দেন,
-” এই মেয়ে, ভালোই তো নাটক শিখে গেছিস। অজ্ঞান হয়ে ভেবেছিস বেঁচে যাবি।”
এভাবে চুল ধরে টেনে উঠানোর ফলে মাথায় লাগে খুব।
-” আহহ মা, লাগছে খুব। কী করেছি আমি?”
ঠিক তখনই পাশ থেকে রিমি, মেঘের ছোট বোন, আগুনে ঘি ঢালার মতো বলে ওঠে,
-” কি করেছ… ঢং! মনে হচ্ছে কিছুই জানে না, মাত্র জন্ম নেওয়া বাচ্চা।”
মাহমুদা বেগম আরও চটে যান মেঘের উপর,
-” এই তোর নাটক বন্ধ কর। সকালে তোকে পইপই করে বললাম দুপুরের রান্না সেরে দিয়ে জাহান্নামে যা, শুনেছিস আমার কথা?”
-” মা, আমি তো সব তরকারি রেধেই গিয়েছিলাম, শুধু ভাতটা রান্না করিনি। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছিল, ভেবেছিলাম তোমরা তো এটা করে নিতে পারবেই।”
-” কিইই! আমাদের তোর চাকর মনে হয়? তুই রেখে যাবি আর আমরা সেইটা করব?”
-” না না মা, আমি সেটা কখন বললাম?”
-” চুপ! মুখে মুখে তর্ক করছিস আবার? ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পাখা গজিয়েছে! এটা কাটতে কিন্তু বেশি সময় লাগবে না।”
মেঘ বুঝে গেছে, এদের কিছু বললেও লাভ নেই। উল্টো পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে।
-” মাফ করে দাও মা, আর এমন হবে না। এবারের মতো মাফ করো।”
মাহমুদা বেগম মেঘের চুল ছেড়ে দিয়ে বলেন,
-” এই তো, এবার লাইনে এসেছিস! নিজের যোগ্যতায় থাকবি। যা, এক্ষুনি রান্নাঘরের সব গুছিয়ে রাখবি। আর কাল থেকে যেন দেখি না এমন ভুল রিপিট হয়েছে।”
মেঘ আস্তে ধীরে রান্নাঘরে চলে আসে। পেছন থেকে ছোট চাচির কথা শুনতে পাচ্ছে,
-” কতো করে বললাম, একে বিয়ে দিয়ে বোঝা কমাও। একে যে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছো, না জানি কোন কলঙ্ক বয়ে আনে! পরে আমাদেরই সম্মান যাবে।”
মেঘ মেকি হাসে। এসব তার নিত্যদিনের কথা। ক্লান্ত শরীর নিয়েই নিজের কাজে লেগে পড়ে। কী করবে, তাকে যে বুঝার কেউ নেই। তবে এসব তার সয়ে গেছে সেই ১২ বছর বয়স থেকেই, যবে থেকে মেঘের বাবা মারা গেছেন, তারপর থেকেই তার মা মেঘকে দোষারোপ করে। তবে এর কারণও আছে বটে।
(মেঘের যখন ৮ বছর বয়স, তখন তার মা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এক শুক্রবারে মেঘ বায়না ধরে ঘুরতে নিয়ে যেতে, বাবা আরিফ আহমেদের কাছে। তিনিও আদরের মেয়ের কথা ফেলতে পারেননি। স্ত্রী-সন্তানসহ বের হয়েছিলেন।
তবে সেই দিনই ছিল মেঘের জীবনের কাল। মেঘ হঠাৎ একটি বিড়ালের ছানা রাস্তার মাঝে দেখে তাকে বাঁচাতে চলে যায়। বুঝতে পারেনি, তারও তো বিপদ হতে পারে। হঠাৎ মেঘকে রাস্তার মাঝে দৌড়াতে দেখে তার বাবা-মা দুজনেই দৌড়ে যান মেয়েকে রক্ষা করতে। তখনই হাইস্পিডে আসতে থাকা একটি ট্রাকের সামনে পড়েন মাহমুদা বেগম। তার যেন পা জমে গিয়েছিল, সরতেই পারছিলেন না। এদিকে মেয়েকে এক ভদ্রলোক কোলে করে সেফ জায়গায় নিয়ে যেতে দেখে পেছনে ফিরতেই দেখেন স্ত্রীর দিকে তেড়ে আসা ট্রাক।
তিনি চিৎকার করে বলেন স্ত্রীকে,
-” সরে যাও দ্রুত, মাহমুদা! ট্রাক আসছে।”
তবে মাহমুদা বেগমের কোনো সাড়া না দেখে নিজেই গিয়ে স্ত্রীকে ধাক্কা মেরে রাস্তার সাইডে ফেলেন। তবে নিজেকে আর বাঁচাতে পারেননি। মাহমুদা বেগম উল্টে গিয়ে পড়ে যান, যার ফলে পেটে আঘাত পান। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারান।
জ্ঞান ফিরতেই যখন জানতে পারেন, তাঁর স্বামী ও অনাগত সন্তান আর এই দুনিয়ায় নেই, তখন তিনি একধরনের ট্রমায় চলে যান। এরপর থেকেই মেঘকে সহ্য করতে পারেন না। মেঘের জন্যই সব হারিয়েছেন বলে মনে করেন।
এর ৩ বছরের মাথায় মেঘের নানা নানু তার মাকে বিয়ে দিয়ে দেয় সিকদার বাড়িতে। ১২ বছর বয়সি মেঘ যেনো, সৎ বাবার বাড়িতে উটকো ঝামেলা। এরপর থেকেই মেঘ বাস্তবতার সম্মুখীন হতে থাকে।
মেঘের ভীষণ অভিমান তার বাবার উপর। সে ভাবে, যদি ওইদিন বাবা তার কাছে না যেত, তাহলে এতোকিছু হতো না। সে ভাবে, আল্লাহর কাছে যাওয়ার পর বাবাকে এক শহর পরিমাণ অভিমানের কথা বলবে। আর তার বাবা অভিমান ভাঙাবে। কারণ এত বড় শহরে তার এমন কেউ নেই, যে তার অভিমান বুঝবে বা তার কষ্টে পাশে দাঁড়াবে।)
মেঘ হাতের সব কাজ সেরে গোসল করে, খেয়ে একটু বিছানায় শুয়ে পড়ে। কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে, নিজেও জানে না। তবে বিকাল হতেই তাকে ডাকা শুরু হয়। ছোট বোনের ডাকে উঠে রুমে যায়,
-” রিমি, ডেকেছিলি?”
-” হ্যাঁ, আমার জন্য চা করে নিয়ে আসো। মাথাটা ধরেছে, একটু মালিশও করে দিও।”
-” আচ্ছা, আমি নিয়ে আসছি।”
তারপর ছোট বোনকে চা দিয়ে, মাথা মালিশ করে আবার যায় রান্নাঘরে। সবার জন্য বিকেলের নাস্তা বানাতে। নাস্তা বানিয়ে সবাইকে খাইয়ে, আবার এই-ওই ফরমায়েশ শুনতে শুনতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। জলদি করে রান্নাঘরে যায় চা বানাতে, এখনই বড় আব্বু আসবেন। তারপর তার কাজকর্ম থেকে ছুটি।
উনিই একমাত্র ব্যক্তি এই সংসারে, যিনি মেঘকে ভালোবাসেন নিজের মেয়ের মতো করে। মেঘও উনাকে ভীষণ ভালোবাসে। মেঘকে এতদূর পড়িয়েছেন তিনিই। মেঘের সাথে কোনো অন্যায় হতে দেন না। তাই উনি বাড়িতে থাকলে মেঘকে কেউ কোনো কাজ করাতে পারে না।
মিজানুর সিকদার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই, মেঘ চা নিয়ে হাজির। উনি সোফায় বসতে বসতে বলেন,
-” কি দরকার আছে এত কষ্ট করার? তোকে না বলেছি, রান্নাঘরে না যেতে? খালি খাবি আর পড়বি।”
-” উফফ বড় আব্বু, সারাদিন তো শুয়ে-বসে পাড় হয়! তুমি তো আমার হাতের চা পছন্দ করো, তাই একটু কষ্ট করাই যায়। আর পড়ালেখাও আমার ঠিকঠাক আছে।”
-” হয়েছে হয়েছে! রেজাল্ট আসলেই দেখা যাবে, তখন একেবারে ধরব! এবার যা পড়তে বস।”
মেঘ নিজের রুমে চলে আসে। হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসে। এই সন্ধ্যাটুকুই তার শান্তির সময়। এখন বড় আব্বুর কারণে কেউ কিছু বলতেও পারবে না। প্রথম দিন হওয়ায় তেমন কোনো হোমওয়ার্ক নেই। তাই বই একটু ঘেঁটে, মোবাইল নিয়ে বসে। এই মোবাইল এইচএসসিতে এ+ পাওয়ায় বড় আব্বু দিয়েছেন। এ নিয়েও কত কাহিনি হয়েছিল, তা বাদই দেই।
সুমনাকে মেসেজ দেয়,
-” কিরে, কি করিস?”
-” কই থেকে আসলি? সারাদিন একটা খবরও নাই।”
-” তুই তো জানিসই, বড় আব্বু একটু আগে আসলেন, আর আমিও ছুটি পেলাম।”
-” ভাই, তোর এত ধৈর্য কই থেকে আসে বুঝি না। তোর বড় আব্বুকে বলে দে এসব অত্যাচার করে ওরা।”
-” দূর, ধরতে গেলে এই বাড়ির আশ্রিতা আমি। অন্যের ঘাড়ে বসে খেয়ে, তাদের পরিবারের জন্য এইটুকু করতে পারব না?”
-“হয়েছে! তোমার মনটা তো অনেক বড়, ভুলেই গিয়েছিলাম।”
-” এসব বাদ দে, কাল যাবি তো?”
-” তা তো আলবাত যাবো।”
-” কিন্তু আমার তো ভয় করছে রে সুমনা, যদি ধরে ফেলে। ফ্যামিলির কাউকে ডাকলে আমার পড়ালেখা অফ করে দিবে ওরা।”
-” চুরি করার পরের দিন চোর ধরে নাকি, সাথে সাথে?”
-” সাথে সাথে…”
-” তাহলে টেনশন কিসের? এখন আর ধরতেও পারবে না। তবে দুস্ত, আই অ্যাম ইন লাভ।”
-” কিইইই! আবার কার লগে?”
-” আরে মানে, আমি ক্রাশ খেয়েছি।”
-” কোন হতচ্ছাড়া উপর?”
-” রুদ্র চৌধুরীর উপর।”
মেঘ চমকে যায়। এই লোকটির নামই তার জন্য আতঙ্ক,
-” কিইই! এই আতঙ্কের উপর শেষমেশ?”
-” কি বলিস! আমার তো দেখলেই হাগ করতে মন চায়! এত গুড লুকিং, হ্যান্ডসাম, ডেশিং। এতক্ষণ ধরে তো এই আইডিতেই ঘুরছিলাম। আমি পারমানেন্ট ক্রাশ খেয়েছি। আর গানের গলাটা তো… হায় মেয়ে, পিগাল গায়া!
-” দেখি আইডি দে, তোর ক্রাশের ফাটা বাঁশ শুনি! কি এমন আছে?”
সুমনার দেওয়া আইডি লিংকে গিয়ে রুদ্রর প্রোফাইল স্ক্রল করে। ১ লাখ+ ফলোয়ারস, মাঝে মাঝে গানের ভিডিও আপলোড দেয়। একটি ছবিতে চোখ আটকে যায় মেঘের।
ভাবে একটা মানুষকে আল্লাহ এত নিখুঁতভাবে কিভাবে বানায়। লম্বায় ৬ ফুট হবে, জিম করা সুঠাম শরীর- যেন কেউ মারতে আসলে বডি দেখেই আন্দাজ করতে পারবে, এই ছেলের থেকে দ্বিগুণ মার খাবে। ফর্সা গায়ের রঙ, হালকা ব্রাউন ওয়েভি হেয়ার, নাকটা চিকন সরু, গোলাপি পাতলা ঠোঁট যেনো মুখের দিকে তাকালে এক্সট্রা মায়া লাগে। গানের গলাও অনেক সুন্দর।
মেঘও হালকা পাতলা ক্রাশ খায়, তবে নিজের মনকে স্থির করে, এসব ক্রাশ-প্রেম-ভালোবাসা তার জন্য না। বড় আব্বুর মাথা নিচু হবে এমন কোনো কাজ সে করবে না।
সে রাতে আর সজাগ থাকেনি। ঘুমিয়ে পড়ে মেঘ। পরের দিন সকাল সকাল উঠে সব কাজ সেরে, অল্প নাস্তা করে ৯:৩০-এ বের হয় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।
তবে ভার্সিটিতে ঢুকেই রুদ্রর গ্যাং-এর কবলে পড়ে। সেখানে দেখে, আগে থেকেই সুমনাকেও ওরা আটকে রেখেছে। সুমনার করুণ চাহনি দেখে মেঘের মনটা ছেঁৎ করে ওঠে। তবে কি ধরা পড়লো…
চলবে…
—
(বিঃদ্রঃ গল্পের নাম নিয়ে খুবই কনফিউজড ছিলাম তাই আবার চেঞ্জ করেছি। )
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১৮
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১০
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪৪
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৫
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৩২
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৩
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৪
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১৭
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৮
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৭