অর্ধাঙ্গিনী ( দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
নুসাইবা_ইভানা
পর্ব -২২, 23
জিয়ান কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই রাত যেন বিভীষিকাময়। মাথা নিচু করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
“ডাক্তার এসে বলল, আপনার বাবার বিপি হাই। একটু খেয়াল রাখবেন।”
জিয়ান যেন কিছুটা স্বস্তি পেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “জীবনটা কী থেকে কী হয়ে গেল!”
জিয়ান পকেট থেকে নিজের ফোন বের করল নয়নাকে কল করার জন্য। ফোন বের করে দেখল, নয়নার অনেকগুলো মিসড কল। জিয়ান কলব্যাক করবে, এমন সময় হড়বড় করে অনিকেত এসে জিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এত কিছু হয়ে গেল, তুই আমাকে একবার খবর দিলি না কেন! আন্টির কী অবস্থা এখন?”
জিয়ান অনিকেতকে দেখে কিছুটা ভরসা পেল। অনিকেতকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কী থেকে কী হচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি না।”
“তুই থাক, আমি আন্টির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসছি। আর হ্যাঁ, অবস্থা বুঝে দ্রুত সিঙ্গাপুর শিফট কর আন্টিকে। এভাবে বিপদে ভেঙে পড়লে জীবনে হেরে যেতে হয়। শক্ত কর নিজেকে।”
অনিকেত চলে গেল মিতা বেগমের কেবিনে। ঢোকার আগে অনিকেত স্থির হল। আজকের দিনটা অনিকেতের জন্যও ছিল বেশ ইমোশনাল একটা দিন। আবেগ যারা দমিয়ে রাখতে জানে, তারাই সহজে বাঁচতে পারে। দুঃখ লুকিয়ে স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে নেয় জীবন।
আজ সন্ধ্যায় জাহানারা বেগম আর মাহবুব তালুকদার অনিকেতের চেম্বারে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। অনিকেত যখন প্রেসক্রিপশন লিখছিল, বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিল সামনে বসে থাকা দুজন মানুষের দিকে। তার সামনে তার জন্মদাতা পিতা-মাতা উপস্থিত, অথচ তবুও একে অপরকে কেউ চেনে না। মানুষ যে বলে রক্তের টান, নারীর টান—আচ্ছা, ওনাদের কি ওসব টান অনুভব হয় না আমার জন্য?
মাহবুব তালুকদার বললেন, “ডাক্তার সাহেব, যা যা টেস্ট দরকার লিখে দিন। আমার স্ত্রীর চিকিৎসায় যেন ত্রুটি না থাকে।”
অনিকেত বলল, “জি স্যার। আমি এখানে টেস্টগুলো লিখে দিয়েছি, আপনি করিয়ে নিয়ে আসুন। আজ তো আর হবে না, আগামীকাল রিপোর্ট দেখব। তারপর বোঝা যাবে কী সমস্যা হচ্ছে।”
জাহানারা বেগম অনিকেতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মাহবুব তালুকদার জাহানারা বেগমের হাত ধরে বললেন, “চলো, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। নয়নার বাসায় আসার কথা। অথচ পুরোটা দিন আমরা বাইরে। টেস্টগুলো করিয়ে দ্রুত ফিরতে হবে।”
চেম্বার থেকে বেরিয়ে জাহানারা বেগম বললেন, “তুমি কি ওই ডাক্তার ছেলেটার চোখ-মুখ খেয়াল করে দেখেছ? একদম আমার নাফির মতো মুখের গড়ন। কেন কেড়ে নিলে আমার নাফিকে? ঘৃণা করি আমি তোমাকে।”
মাহবুব তালুকদার মনে মনে বললেন, ‘আমি তোমাকে তোমার নাফির সাথে দেখা করিয়ে এনেছি জাহানারা। যাকে তুমি নাফির মতো ভাবছ, সে’ই নাফি। কিন্তু এই সত্যি আমি কোনোদিন তোমাকে জানাতে পারব না। এতগুলো বছর পর এসব সামনে এনে নিজের বংশের নাম খারাপ করতে পারব না।’
অনিকেতের চোখের কোণে তার অজান্তেই কেমন জল জমে উঠেছে। বুকটা ভারী হয়ে আসছে। যে বাবা-মাকে ছোটো থেকে খুঁজে এসেছে, তারা চোখের সামনে, তবুও বাবা-মা বলে ডাকার অধিকার নেই তার! চেম্বার শেষ করে বের হবে, তার ঠিক আগ মুহূর্তে নাহিদের কল এল। নাহিদ জিয়ানের মায়ের অসুস্থতার সংবাদ দিল। সঙ্গে সঙ্গে অনিকেত চলে এল মেডিকেলে।
(বর্তমান)
অনিকেত কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ভালো করে মিতা বেগমকে চেকআপ করতে লাগল।
🌿
জাহিন সেভাবেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল ঘণ্টা দুয়েক। যখন তার হুঁশ ফিরল, দ্রুত এলোমেলো পায়ে হেঁটে এল ইমার্জেন্সি রুমের সামনে।
ইমার্জেন্সি রুম থেকে একজন নার্স বের হল।
জাহিন তাকে জিজ্ঞেস করল, “পেশেন্টের কী অবস্থা এখন?”
নার্স বলল, “দুঃখিত স্যার, পেশেন্টকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আপনি পেশেন্টের বাসার লোক? তাহলে আমার সাথে চলুন, কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।”
জাহিন যেন আর কোনো কথা শুনতে পারল না। ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে চিৎকার করে বলল, “মা, তুমি না থাকলে আমিও থাকব না এই স্বার্থপর পৃথিবীতে। এখানে সবার কাছে ঘৃণিত আমি। আমি পাপিষ্ঠ, আমি ধ্বংস। আমাকে তোমার সাথে নিয়ে কেন গেলে না মা? আমি আসছি তোমার কাছে।”
জাহিনের চিৎকারে আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে গেল।
জিয়ানও দৌড়ে ছুটে এল। জাহিনের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কী হয়েছে?”
জাহিন জিয়ানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাকে মেরে ফেল ভাই। আমি খুনি, আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। ভাই ও ভাই, আমার শ্বাসটুকু নিয়ে আম্মুকে দিয়ে দে। আমার আম্মুকে ছাড়া আমি বাঁচতে চাই না। মেরে ফেল আমাকে, আমি খারাপ।”
জিয়ান জাহিনকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, “শান্ত হ জাহিন। আম্মুর কিছু হয়নি। আম্মুকে অন্য রুমে শিফট করা হয়েছে। আম্মু ঠিক আছে। তুই একটু স্বাভাবিক হ ভাই আমার।”
জাহিন জিয়ানের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাকে একবার আম্মুকে দেখা। আমার আম্মু।”
জিয়ান জাহিনের হাত ধরে নিয়ে গেল মিতা বেগমের কেবিনের কাছে। লুকিং গ্লাস দিয়ে জাহিনকে তাকাতে ইশারা করল। জাহিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দরজার সামনে বসে পড়ল। নিজেকে কী অসহায় লাগছে তার! এই পরিবারকে সে ছেড়ে দিয়েছিল! অথচ যে ভাইয়ের সাথে এত জঘন্য অন্যায় করেছিল, সেই ভাই তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। যে মেয়ের সাথে বিয়ের পর একটা মুহূর্তও ভালো ব্যবহার করেনি, সে তাকে সান্ত্বনা দিল। পৃথিবীতে পরিবার ছাড়া কেউ নিজের হয় না—এই অনুভূতি জাহিনের মনে শিকড় গেঁড়ে বসল। এখন তার মনে হচ্ছে, তার বাবা তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেননি, ওসবে হয়তো ছিল শাসন। ভালোবাসলে মানুষ তো শাসনও করে? জাহিন যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে লাগল।
অনিকেত রুম থেকে বের হয়ে বলল, “চিন্তার কোনো কারণ নেই, আন্টি সুস্থ হয়ে যাবেন। আশা করি আগামী তিন দিন পর আন্টিকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবি।”
নয়না আর ডাক্তার ইশান এসে উপস্থিত হল সেই মুহূর্তে। নয়না জিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “সব ঠিক আছে? আম্মুর এখন কী অবস্থা?”
জিয়ান নয়নাকে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে বিধ্বস্ত লাগছিল। সেই কখন থেকে ইচ্ছে করছিল, কাউকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারলে মনটা হয়তো একটু শান্ত হতো। নয়না জিয়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে সামলাও। এখন তোমার পরিবারের তোমাকে প্রয়োজন।”
জিয়ান নয়নাকে ছেড়ে দিয়ে নয়নার হাত ধরে রাখল।
অনিকেত বলল, “আন্টি এখন বিপদমুক্ত। আপাতত চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে।”
“জি ভাইয়া, পুরোপুরি খেয়াল রাখব। আচ্ছা, বাবা কোথায়? ওনাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।”
জিয়ান বলল, “বাবা আরেক কেবিনে। ওনাকে স্লিপিং পিল দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।”
নয়না জিয়ানকে বলল, “হাত-মুখ ধুয়ে এসো, খাবার এনেছি। খেয়ে নাও। সারা দিন কিছু খাওনি।”
অনিকেত এত কিছুর মধ্যেও নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ অনিকেত আবিষ্কার করল, নয়না আর তার চেহারায় অনেক মিল আছে।
নয়না জিয়ানকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেহনুর জাহিনকে খাইয়ে দিচ্ছে। অনিকেত আর ঈশান বসে আছে ঢুলতে ঢুলতে।
অনিকেত বলল, “আপনার নাম?”
“ডাক্তার ঈশান। আপনার নাম?”
“ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ।”
“নাইস টু মিট ইউ, ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ। আপনার সাথে জিয়ানের সম্পর্ক?”
“ও আমার বন্ধু। আমরা খুব ক্লোজ, ধরতে গেলে একই পরিবারের। আপনার সাথে সুনয়নার সম্পর্ক?”
“আমরা পরিচিত। সিলেটে পরিচয় হয়েছে আমাদের।”
অনিকেত আর কথা বাড়াল না। তার মন ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে নয়নাকে—তার ছোটোবোন। ইচ্ছে করছে একবার নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।
ঈশান লক্ষ্য করল, অনিকেত এক ধ্যানে নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
🌿
অন্তর নয়নার বাসায় এসেছে তুষিকে খুঁজতে। বাসায় এসে নীলাঞ্জনার সাথে দেখা হয়েছে।
নীলাঞ্জনা অন্তরকে বসিয়ে বলল, “আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন, এর জন্য সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। কোনো দরকার ছিল ভাইয়া, এখানে কেন এলেন?”
“আমি তুষির পরিবারের। তুষি কি এ বাসায় পরশু এসেছিল?”
“না, আসেনি তো।”
“ধন্যবাদ আপু, আমি আজ চলি। জরুরি কাজ আছে।”
“অল্প কিছু খেয়ে যান।”
“আজ না, অন্যদিন আসব। নয়না এলে বলবেন আমার সাথে যোগাযোগ করতে। এই নিন আমার নম্বর। বলবেন, ইমার্জেন্সি খুব।”
“নয়না তো হসপিটালে। ওর শাশুড়ির অবস্থা আশঙ্কাজনক।”
“কোন হসপিটালে? নামটা জানেন আপু?”
“না, সেটা তো জানি না।”
“আপনি কি সুনয়নার কাছে কল করে জেনে নিতে পারবেন? খুব ইমার্জেন্সি, প্লিজ না করবেন না।”
চলবে
অর্ধাঙ্গিনী ( দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
নুসাইবা_ইভানা
পর্ব -২৩
অন্তর বসে আছে মাতুয়াইল ফুট ওভার ব্রিজের নিচের বকুলতলার টি স্টলে। নয়নার সাথে ফোনে কথা বলে চলে এসেছে এখানে। যদিও দোকান বন্ধ। আশেপাশে সব দোকান প্রায় বন্ধ। এত রাতে দু-একটা দোকান যা খোলা আছে, তাও হয়তো হাসপাতালের জন্য। ফাঁকা রাস্তায় শাঁ শাঁ করে দু-একটা দূরপাল্লার বাস চোখের পলকে ছুটে চলছে তাদের গন্তব্যে।
বকুলফুলগুলো পড়ে আছে মাটিতে। কিছু ফুল কুড়িয়ে হাতে নিল অন্তর। চোখের কোণে জমে উঠল অশ্রুর কণা। এই জায়গাটার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তুষি। একদিন বলল, “দেখা করব। আমার পছন্দের জায়গায় আসো তো। শোনো, পাঞ্জাবি পরে আসবে কিন্তু।” সেদিন অন্তর অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পরে এসেছিল। তুষি পরেছিল বাসন্তী রঙের শাড়ি। অন্তর তুষির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তুষি হালকা গলা খাকারি দিয়ে বলে, “মিস্টার হ্যান্ডসাম, এটা ব্যস্ত রাস্তা। এখানে এভাবে তাকিয়ে থাকাটা ঠিক না। চলো এমন কোথাও যাই, যেখানে তোমাকে মন ভরে দেখতে পারব।”
“কাজি অফিসে চলুন।”
“তুমি বললে তো মরুভূমিতেও চলে যাব। কাজি অফিস তো কোনো ব্যাপারই না। চলো।”
তুষি নিজেই অন্তরের হাত ধরে বলে, “চলুন।”
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“আমার সাথে যাচ্ছেন আমার প্রিয় প্লেসে।”
তুষি যখন হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকল, অন্তর বলল, “হাসপাতাল কারো প্রিয় জায়গা কী করে হয়! পাবনা মেন্টাল হাসপাতাল হলে তবুও বুঝতাম। কিন্তু শিশু হাসপাতাল?”
তুষি অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কি আমাকে পাগল বললে?”
“বলার কী আছে! তুমি তো পাগলি।”
তুষি বকুলতলায় এনে অন্তরকে বলে, “এই জায়গাটা সুনয়নার অনেক পছন্দের। ওর সাথে সাথে এখানে আসতে আসতে আমারও পছন্দের জায়গা হয়ে গেছে।”
“সুনয়নার সাথে তোমার এত ভালো সম্পর্ক থাকার পরেও কীভাবে এমন কাজ করতে পারো তুমি?”
“তুমি হয়তো আমাকে ক্ষমা করতে পারছ না। কিন্তু জানো, সুনয়না আমাকে ক্ষমা করে দেবে।”
“আমার মনে হয় না।”
“ও জানে আমার পরিস্থিতি। সেই ক্লাস টুতে থাকতে মাকে হারিয়েছি। এরপর বছর না ঘুরতেই সৎমায়ের সাথে জীবন কাটাতে শুরু করি। আমার সব স্ট্রাগলের গল্প নয়নার জানা। ওর সাথে দেখা হওয়ার আগে আমার জীবন আরও কঠিন ছিল। বেশিরভাগ সময় সকালে আমাকে টিফিন দেওয়া হতো না। ক্লাস সিক্সে পাগলা হাইস্কুলে যখন ভর্তি হই, তখন দেখা হয় নয়না নামক মেয়েটার সাথে। কীভাবে কীভাবে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ও প্রতিদিন আমার জন্য টিফিন নিয়ে আসত। রাতেও মাঝে মাঝে আমার কপালে খাবার জুটত না। সকালে এসে নয়নার দেওয়া নাস্তা খেতাম। আমার বাবার ইনকাম কম ছিল না, মোটামুটি ভালোই ইনকাম করতেন। কিন্তু সৎমা কোনোদিন আপন মা হয় না। সারাদিন বাসার সব কাজ আমি করতাম। যেন ওই বাসায় কোনো আশ্রিতা বা কাজের মেয়ে। শুধু বাবার সামনে আমার সাথে ভালো ব্যবহার করত। আমি জাহিনের সাথে যা করেছি, লোভে করেছি। প্রথমবার জাহিন বিশাল বড় একটা পার্সেল পাঠিয়েছিল। সেখানে ছিল নানারকমের চকোলেট, ড্রেস, মোবাইল ফোন। আমার সৎমা সেটা দেখে আমাকে বলেছিল, জীবনে প্রথম কোনো ভালো কাজ করেছি আমি। ছেলে বড়লোক, আমার সব খরচ তার কাছ থেকে নিতে। দেড় বছর আমি জাহিনের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছি। বলতে গেলে প্রাইভেট খরচ থেকে শুরু করে হাতখরচ—সব ওর টাকায় চলত। আমি বলেছিলাম আমি গরিব, সেটা জাহিন মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম না দারোয়ান চাচার সাথে ওর যোগাযোগ ছিল। ও জানত আমি মিথ্যে বলছি। কারণ সুনয়না তো আসলেই বড়লোক। হয়তো তাকে পরীক্ষা করার জন্য মিথ্যে বলছি, তাই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা পাঠাত প্রতি মাসে। সাথে মাঝে মাঝে বড় বড় পার্সেল তো আসতই। তবে জানো, জাহিন চৌধুরী সত্যি সত্যি সুনয়নাকে অনেক ভালোবাসত। আর আমি লোভে পড়ে তার হৃদয়ের ভালোবাসাকে নষ্ট করে দিয়েছি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তোমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই।”
অন্তর কিছু সময় চুপ থেকে উত্তর দিল, “চলে যাও। তবে মনে রেখো, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমার মতো কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না।”
“আমি জানি আমি ভুল করেছি, কিন্তু ওই সময় সেই জ্ঞান আমার ছিল না। জানো, মেয়ে মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী। এরা অনেক কষ্ট সহ্য করে হলেও একটা নিরাপদ স্থান আঁকড়ে ধরে থাকে। কারণ তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। তুমি যদি কোনোদিন আমার জামার পেছনটা উঠিয়ে দেখতে, তাহলে কাঁদতে ফেলবে। সবচেয়ে বেশি আঘাত পিঠে করত। কখনো খুন্তি পুড়িয়ে লাগিয়ে দিত। কখনো রড দিয়ে পেটাত। এখনো এসব থেকে মুক্তি মেলেনি আমার।”
অন্তর তুষির হাত ধরে সোজা নিয়ে এল যাত্রাবাড়ী এক কাজি অফিসে। বিয়ে করে হয়ে গেল দুজন দুজনার।
তুষি অন্তরের হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, “পরশু দিন বাবার ছুটি। সেদিন বাবাকে সবটা জানিয়ে চলে আসব তোমার কাছে। তোমাকে সাথে করে নিয়েই দেখা করতে যাব নয়নার সাথে। আমার বিশ্বাস, ও আমাকে ক্ষমা করে দেবে।”
অন্তর তুষির হাতে চুমু খেয়ে বলে, “এরপর থেকে জীবনে তোমার কোনোদিন নিরাপদ স্থানে থাকার জন্য কষ্ট সহ্য করতে হবে না। যদি আমিও হই তবুও আর অন্যায় সহ্য করবে না। আমি চাই তুমি মন খুলে বাঁচো।”
তুষি অন্তরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মৃদু স্বরে বলল, “ভালোবাসার ঋণ সারা জীবন আমি ভালোবাসার বিনিময়ে শোধ করব। আজ রাতে আমার শান্তির ঘুম হবে। কত রাত জেগে ভেবেছি কী হবে আমার ভবিষ্যতে? আজ মনে হচ্ছে এতদিনের সব কষ্ট যেন উবে গেল তোমাকে নিজের করে পেয়ে।”
অন্তর তুষির কপালে চুমু দিয়ে বলে, “অর্ধাঙ্গিনী, আজ তো আমাদের বাসর রাত।”
তুষি হেসে বলে, “পরশু দিন আমাদের ফুলশয্যা হবে। দুদিন কষ্ট করে অপেক্ষা করো।”
“একটা লিপ কিস।”
“তোমার ড্রাইভার দেখবে তো লুকিং গ্লাসে।”
অন্তর ড্রাইভারকে বলল, “চোখ বন্ধ করতে।”
তুষির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল অন্তর। মিনিট দুয়েক পরে ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বলে, “বউ না থাকলে বছরের পর বছর কাটানো যায়। কিন্তু বউ থাকার পরেও একা থাকা কষ্টের।”
তুষি মৃদু হেসে বলে, “আর দুটো দিন।”
অন্তর দোকানের বেঞ্চে বসেই সেদিনের সুন্দর দিনটা কল্পনা করল। তার অর্ধাঙ্গিনী তাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল! কেন গেল? এত ভালোবাসার পরেও কি মানুষ ছেড়ে যেতে পারে!
🌿
নয়না জিয়ানের হাত ধরে বলে, “ভেঙে পড়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“এত সুন্দর জীবনটা কীভাবে যেন এলোমেলো হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আর কখনো কিছু ঠিক হবে না।”
“এটা তোমার ভুল ধারণা। যদিও বিপদের সময় এটাই মনে হয়। তবে বিপদ একটা দীর্ঘ রাতের মতো। রাতের আঁধার কেটে যেমন সূর্য ওঠে, ঠিক একদিন বিপদ কেটে নতুন দিনের আলো এসে জীবনে আলোকিত করে তুলবে।”
জিয়ান নয়নার কাঁধে মাথা রেখে বলে, “আমি আর কিছু হারাতে চাই না।”
নয়না জিয়ানের মাথায় ভালোবাসার পরশে হাত বুলিয়ে দেয়। ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকাটা ম্যাজিকের মতো দুঃখ কমিয়ে সাহস যোগায়।
হুট করে জাহিন এসে বলে, “ভাই।”
নয়না কিছুটা সরে বসে জিয়ানের কাছ থেকে।
জিয়ান বলল, “কী রে, কিছু বলবি?”
জাহিন কিছু বলার আগেই নয়না বলে, “আপনি কি তুষির সাথে যোগাযোগ করেছিলেন এই তিন দিনের মধ্যে?”
জাহিন এত কিছুর মধ্যে ভুলেই বসেছিল তুষির কথা। নয়নার মুখে তুষির নাম শুনেই ছুটে বের হয়ে গেল।
নয়নার মুখে ফুটে উঠল টেনশন। জিয়ানের হাত শক্ত করে ধরে বলে, “আমার মন বলছে জাহিন ভাই নিশ্চিত তুষির সাথে কিছু করেছে। সে আবার তুষিকে খুন করে ফেলেনি তো? এই অসুস্থ মস্তিষ্কের লোকটাকে তো বিশ্বাস নেই।”
“কী বলছ এসব! এই কয়দিন তো ও বাসায় আমাদের সাথেই ছিল।”
নয়না বলল, “দেখলে না কীভাবে ছুটে গেল? তুষির সাথে কিছু করলে আমি কিন্তু ভুলে যাব এই অমানুষটা তোমার ভাই।”
নয়না কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন তুলে অন্তরকে কল করল। অন্তর তখনও শুয়ে আছে ফুটপাতের সেই বেঞ্চে। ফোন রিসিভ করে নয়নার কথা শুনে অন্তর ছুটে যেতে লাগল তাদের গোপন আস্তানায়।
চলবে
বিঃদ্র – অর্ধাঙ্গিনী বইটি সংগ্রহ করুন বিজয় বইমেলা থেকে স্টল নাম্বার ৬৫। নয়া উদ্যোগ প্রকাশনী। অর্ধাঙ্গিনী কে ঘরে তুলে নিয়ে আসুন কোলে করে।
“অন্তর আর তুষীর কাহিনি একদম শেষ হয়ে যাবে আর দু-তিন পর্বে। তাই আজকের পর্বে ওদের অতীতটাকে দেখানো হলো।
Share On:
TAGS: অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২, নুসাইবা ইভানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১৬
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৩
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১৫
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৫
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১৮
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২ পর্ব ২০+২১
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৬
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৯
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৪