born_to_be_villains
methuburu_মিথুবুড়ি
পর্ব_১৫
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
❝মনটা চুরি, মারলে ছুড়ি
আমার বুকে তুই
লাগছে সরম, লজ্জা সরম
লুকায় আমি কই?❞
‘অসন্তোষের ভাঁজ পড়া ভ্রু নিয়ে পিছন ঘুরল ন্যাসো। চোয়ালের রেখায় পাহাড়ি কঠোর গাম্ভীর্য নেমে এসেছে৷
তবে এক ক্ষণেই সেই গম্ভীরতা গলে গিয়ে সূক্ষ্ম বিস্ময়ে বদলে যায় অল্প বয়সের, শ্যামবর্ণা মেয়েটিকে দেখামাত্র।তার ঠিক পিছনে চব্বিশ কপাটি বের করে দাঁড়িয়ে আছে এক তরণী। গায়ের রং চাপা। তবে চেহারাজুড়ে কোমল মায়া ছড়িয়ে। মুখে এমন মায়া যে চোখ ফেরানো মুশকিল। অথচ, আচরণে লাগামহীনতা আর হাসিতে অসংযম।
‘শ্যামকন্যার শ্যামবর্ণে সামনে দাঁতগুলো মুক্তোর মতো আলো ছড়াচ্ছে। অতিরিক্ত খুশি না উত্তেজনায় বাঁ-পা এভাবে নাচাচ্ছে, তা ঠিক বোঝা গেল না। কোমড় ছাপানো চুলগুলোও নাচছে তার তালে তালে।
‘গম্ভীর চোয়াল শক্ত হয় এবার। ন্যাসো চিনে এই মেয়েটাকে। ইমামার সাথে বেশ কয়য়েকবার দেখেছে। তবে হঠাৎ মেয়েটির ঝড়পাতার মতো হানা দেওয়ার কারণ তার তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কে ঢোকার আগে ন্যাসো ফোন রেখে টানটান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল। দু’হাত বুকে ভাঁজ করে রাখল। কণ্ঠে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে আওয়াজ তুললো,
“হোয়াট?”
“ও মাই গড।”
‘বাতাসের বেগে অকপটে ইবরাতের ছুড়ে দেওয়া এমন নির্বিকার জবাবের মানে বুঝতে পারল না ন্যাসো। নরম-পাতলা ভ্রু-জোড়া কুঁচকে উঠল,”মানে?”
‘ইবরাত ব্যাঙের মতো এক লাফে ন্যাসোর সামনে এসে দাঁড়ায়। সম্মুখের মানুষটি তার তুলনায় অধিক হওয়ায় ঘাড় তুলতে হলো তাকে। ইবরাত ঘাড় উঁচিয়ে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি সরাসরি পুরুষটির রুক্ষ চিবুকে নিক্ষেপ করে বলে,
“মানে আপনি কি সিঙ্গেল?”
“কি—হ!”
‘বলা নেই, কওয়া নেই। শুরুতেই জানতে চাচ্ছে সিঙ্গেল কি না। ন্যাসো খুব অবাক। ভারি কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,”এই মেয়ে, কে তুমি?”
‘ইবরাত শিশুর মতো নিষ্পাপ ভঙ্গিতে হাসল। ঢিলেমি ভঙ্গিতে বলে,”ইবরাত…সিঙ্গেল ইবরাত।”
‘তারপর সে আঙুলে গুনতে গুনতে তার সিঙ্গেল লাইফের হিস্ট্রোরি বলতে শুরু করল,
“2019: Single
2020: Single Pro
2021: Single Pro Max
2022: Single Ultra Pro Max
2023: Single Extra Ultra Pro Max
2024: Single Mega Extra Ultra Pro Max
2025: Single Titanium Ultra Flex Pro Max”
‘থেমে, সামনের সবগুলো দাঁত ভাসিয়ে বলল,
“কিন্তু সামনের বছর মিঙ্গেল থাকতে চাই—আপনাকে নিয়ে।” বলে নিজেই খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। অহেতুক, ছদ্ম লজ্জায় দু’হাতের আঁজলায় মুখও ঢেকে ফেলল।
‘যারপরনাই বিস্মিত ন্যাসো। পাশাপাশি বিস্ময়ের সাথে যুক্ত হয়েছে বিরক্তি। গম্ভীরতার ভারে ভাঁজ হয়ে থাকা কপাল টানটান করে ধমকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ইবরাত গদগদ করে বলতে লাগল,
“মিথ্যা বলবো না। যদিও সবসময় সত্য বলি না। আবার প্রয়োজন ছাড়া মিথ্যাও বলি না। এখন কথা হচ্ছে—আপনাকে আমার ভাললাগছে। খুব, খুব, খুব……
এক দেখাতেই আপনার প্রেমে আমি ফিদা। মনে করুন, মরি মরি অবস্থা। বিশ্বাস করুন আমার জীবনে অনেক ছেলে দেখেছি আমি। ভালো-মন্দ সব নজরেই নজর দেখেছি৷ কিন্তু ট্রাস্ট মি, আপনার মতো মাখন আর একটাও দেখিনি। আপনার গায়ের রং এক্কেরে আমার গুদুগুদুর মতো৷”
‘কঠিন মুখাবয়বে হতবাক ভাব ফুটে ওঠে। থতমত খেয়ে যায় ন্যাসো। বীজগণিতের অঙ্কের মতো দুই পৃষ্ঠা হিসাব বাদ দিয়ে সরাসরি শেষ পৃষ্ঠায় গিয়ে উত্তর দেখার মতো শেষ বাক্যটায় এসে ভরকে যায় সে।
“গুদুগুদু মানে?”
“আরে আমার বিড়াল। ওকে আদর করে গুদুগুদু ডাকি। ওয়েট দেখাচ্ছি।” বলতে বলতে ইবরাত ব্যাগ থেকে ফোন বের করে একটা পার্শিয়ান বিড়ালের ছবি দেখায় ন্যাসোকে। বিরক্তি থাকা সত্বেও ফোনের স্ক্রিনে তাকাল ন্যাসো৷
“আমার কিন্তু আরেকটা কুকুরও আছে। ও কালো। এজন্য ওর নাম—কুদুকুুদু।”
‘ন্যাসো একঝলক দেখেই তৎক্ষনাৎ সরে আসে। ইবরাত তখনও কুকুরের ছবি খুঁজছে।
“আরেকটা সোনালি মুরগীর বাচ্চা আছে। ও একদম আদর, আদর। ওর গায়ের রং একদম আপনার চোখের মনির মতো বাদামি। ওর নাম দিয়েছি, চুনুমুনু। আর একটা….
‘নির্বিকার প্রকৃতির অল্পভাষী গম্ভীর মানুষটা এবার ধৈর্যচ্যুত্ত হয়ে রাশভারী কণ্ঠে ধমকে উঠল,
“শাট আপ। আমি জানতে চেয়েছি এতোকিছু?”
‘কেঁপে উঠে মিইয়ে গেল ইবরাত। তবে দমে না। তখনও মিনমিনিয়ে বলে,
“আচ্ছা…তাহলে চলুন না ফরজ কাজটা সেরে ফেলি। বাকি কথা নাহয় সুহাগরাতে হবে।” কথাটা বলার সময় রক্তিম ছাঁচে গড়া গমরঙা গালদুটোয় কৃষ্ণচূড়ার মতো লাজ রক্তিম হয়ে ফুটে উঠল।
‘আরেক দফার ধকম, “আর ইয়্যু ইনসেন?” ধীরে ধীরে ক্রোধের স্ফুরণ ঘটছে সংযত চোয়ালের বাঁকে৷
‘তীব্র এক ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠল নাজুক গড়ন। ইবরাত নির্মল, নিষ্পাপ দৃষ্টিতে তাকাল ন্যাসোর দিকে। নরমস্বরে বলল,
“অবোকাডোর যেমন নিজস্ব স্বাধ নেই ,তেমনি আমার মনে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। বিশ্বাস না করলে বিয়ে করেই দেখুন। আমি অনেক ভালো বউ হবো।”
“এই মেয়ে একটা থাপ্পড়ে ৩২টা দাঁত ফেলে দিবো৷ ফাজলামো হচ,,,,
‘ধমকের মাঝেও কথা কেড়ে নিল ইবরাত। শুধু কেড়েই নিল না, ভুল সংশোধনও করে দিল৷
“আমার ২৮টা দাঁত।”
‘অতীব বিরক্ত কপাল চেপে ধরে চোখমুখ খিঁচে সে। ফোঁস করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে। অতঃপর ওয়ালেট বের করে, কিছু টাকা ইবরাতের হাতে দিয়ে বলল,
“এই মেয়ে, এই নাও টাকা। মাথার ডাক্তার দেখাও।”
‘চোয়াল ফাঁক হয়ে যায় ফ্লার্টি রমণী। ইবরাত ওর হাতে জোরপূর্বক গুঁজে দেওয়া টাকার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
“আজব তো! টাকা দিচ্ছেন কেন?”
“মানষিক ডাক্তার দেখানোর জন্য।”
“একটু মনের কথা বলার জন্য মানুষিক রোগী বানিয়ে দিলেন?”
“রোগীকে কি সুস্থ মানুষ বলবো?” চিড়বিড় করে ন্যাসো।
‘নটখট রমণী লাজুক হেসে মুখ ঢেকে ফেলল,”চাইলে বউও বলতে পারতেন৷”
“জাস্ট বিরক্তিকর।” আপাত ক্ষোভে গজগজ করে সামনে পা বাড়াল ন্যাসো। ইবরাত ছুটে গিয়ে পথ অবরোধ করে দাঁড়ায়। ভ্রু নাচাতে নাচাতে বলে,
“এতো যে আমাকে কথা শুনাচ্ছেন, ধমক দিচ্ছেন। আপনি নিজেই তো আস্তো এক বকলম। আপনি আমার বান্ধবীকে ফলো করেন, আর আমি আপনাকে। অথচ, আপনি ধরতেই পারলেন না। হিহিহি…
‘অকস্মাৎ ন্যাসো এগিয়ে আসে ত্বরিতভাবে। খুব কাছে চলে যায়। হুট করে মসৃণ লালিমার ছোঁয়া মুখের গম্ভীরতা মিলিয়ে যায়। তীক্ষ্ণ চাহনিতে মিশে থাকা সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক রহস্যের ইঙ্গিত দেয়। কেমন যেন মাতাল করা সে চাহনি। থতমত খেয়ে যায় ইবরাত। বাদামী চোখের সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে হিম হয়ে আসে বুক। ন্যাসোকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে, সে পিছিয়ে যায়। ও পিছালে ন্যাসো আরেক কদম এগিয়ে আসে। ঝাপটে পড়ার মতো বেগে বেগে ঝুঁকল সে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“গতকাল, চৌদ্দ মিনিটে ৪৪বার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছো৷ অথচ একবারও আইকন্ট্রাক করতে পারোনি। আবার আমাকেই বোকা বলছে… সিলি গার্ল।” ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল তার৷
‘হতবিহ্বল ইবরাত যেন নড়তে ভুলে যায়। ন্যাসো সরে আসতেই স্তম্ভিত ফিরে পায়। এতক্ষণ পুরুষালীর শরীর থেকে বের হওয়া কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ তার মন গভীরভাবে জমে গিয়েছিল। ন্যাসো আবারও চলে যেতে উদ্যত হলে সে ছুটে গিয়ে দুহাত ছড়িয়ে রাস্তা রুখে দাঁড়াল৷
‘হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,”তারমানে আপনিও আমাকে দেখেছেন, রাইট?” একটু থেমে,”দেখুন আমি মেয়ে হিসেবে এতোটাও খারাপ না। গায়ের রং একটু চাপা হলেও সমস্যা নেই। থানাকা দিয়ে দু’টো ঘষা দিলেই দুইদিনে ফকফকা হয়ে যাবো। বাকি যা বাজে স্বভাব আছে, সেগুলো নাহয় বিয়ের পর বর্জন করব।”
“আমার রুচি এতোটাও খারাপ না। সো বাই।”
‘অকপটে প্রত্যাখ্যান আর অপমানের বিষমাখা তীর ছুঁড়ে দিয়ে সাইড এড়িয়ে চলে যেতে চায় সে। ইবরাত পিছন থেকে ন্যাসোর কোটের অংশ টেনে ধরল। ন্যাসো ঘাড় বাঁকিয়ে পিছন তাকাতেই ইবরাত বাচ্চাদের মতো সরল কণ্ঠ আর কোমল চোখে চেয়ে শুধায়,
“আমি কি দেখতে খুব খারাপ?”
“খুওওওওওওব।”
“আমার চোখ দু’টো দেখুন। মায়াবী না?” ইবরাত ভ্রু উঁচায়। চোখ বড় বড় করে। মনি এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়৷
‘ন্যাসো মুখ বিকৃত করে,”জঘন্য।”
“আর আমার ঠোঁট?”
“জাস্ট লাইক আ ট্রাস।”
‘ইমারত ভেঙে পড়ার বিকট শব্দ ইবরাতের পাঁজরের প্রতিটি পাঁজরে ধ্বনিত হতে থাকে। তবে এতো সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে সে নয়। মুখটা নিম পাতার মতো তেঁতো হয়ে গেলেও আবারও নতুন উদ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যায়৷
“কিন্তু আপনি তো অনেক সুন্দর। দারুণ লম্বা, দেখতে হ্যান্ডসাম, গায়ের টং ঝকঝকা। বাবা-মায়ের থেকে একজন সাদা হলেই হয়। এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমাদের বাচ্চা সুন্দরই হবে—আপনার মতো।”
“এই মেয়ে, সামনে থেকে সরো বলছি। নয়তো এক থাপ্পড়ে রাস্তায় নিয়ে ফেলবো।”
‘ভয়ে সামনে থেকে সরে গেল ইবরাত৷ লোকটাকে এমুহূর্তে যা হিংস্র লাগছে, থাপ্পড় মারতেই পারবে। ন্যাসোর হাঁটতে শুরু করল। ইবরাত নিজেও ন্যাসোর সাথে হাঁটতে শুরু করল।
“আপনাকে আমার সত্যিই খুব পছন্দ। আপনাকে দেখার পর থেকে আর কোনো ছেলের দিকে আমার নজর যায়নি। পিংকি প্রমিজ৷”
‘ন্যাসো পায়ের গতি বাড়ায়। রাগে ফুঁসতে ফুসতে আওড়ায়,
“রেডিকিউলাস।”
‘এতো লম্বা লম্বা পায়ের সাথে ইবরাত তাল মেলাতে পারল না। থেমে গেল সে। হাঁপানি উঠে গিয়ে একটু জোরে হেঁটেই৷ ন্যাসো চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলে,
“ওহে, শখের পুরুষ—মনও দিলা না, দেহও দিলা না। দিয়ে গেলে হৃদয় ভাঙা যন্ত্রণা।”
‘ঘড়িতে সময় দেখে ক্লাসের উদ্দেশ্য সামনে পা বাড়ায় ইবরাত। তখনই হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে আসে রাশভারি কণ্ঠস্বর,
“এই মেয়ে দাঁড়াও।”
‘ইবরাত তাকিয়ে দেখল ন্যাসো দাঁড়িয়ে আছে। ছটফটে সে চটপটে ভঙ্গিতে প্রত্যুত্তর করল তৎক্ষনাৎ,
“জি বস।”
‘ন্যাসো চোখ রাঙায়। ইবরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
“ওকে হ্যান্ডসাম”
‘দৃষ্টি আরও শক্ত হয়। অগত্যা বাধ্য হয়ে ইবরাতকে নুইতে হয়।
“জি ভাইয়া বলুন।”
“তুমি কি সব ছেলেদের দেখেই এভাবে গান গাও?”
‘ইবরাত ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়, “সব ছেলেদের না। যাদের ভালো লাগে, তাদের দেখে গাই।”
“ভন্ড, লম্পট।” দাঁতে দাঁত পিষে হনহনিয়ে চলে গেল ন্যাসো। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ইবরাত ঠোঁট বাঁকায়। বিরবির করে,
“এখন মুখ ফিরিয়ে নিলেই কি? হাসরের ময়দানে তো দেখা হবেই।”
‘ক্লাসের দিকে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখ গেল বিল্ডিংয়ের পিছন দিকে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পুরুষালি দেহের প্রশস্ত সৌষ্ঠব পিঠ৷ উলটো দিক ঘুরে বসার কারণে অস্পষ্ট তার অবয়ব। নিজেকে দিবালোকের নরম মিহি আলো থেকে অস্তিত্বহীন করার ধূর্ত প্রচেষ্টায় সাথে যুক্ত করেছে কালো হুডি। হুডির হুড তোলা বিধায় মুখের আংশিকটুকুও দৃশ্যমান নয়। তার পায়ের নিচে ছড়িয়ে পড়ে আছে কয়েকটা আধাপোড়া ফটোফ্রেম। কালচে ছাইয়ের ভেতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পোড়া হাসি, ভাঙা মুহূর্ত, অর্ধেক বেঁচে থাকা স্মৃতি। বুঝতে কষ্ট হয় না এগুলো কেউ শখ করে পোড়ায়নি।নিশ্চয়ই এক বুক অসহ্য যন্ত্রণার ভার বয়ে, বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নাকে চেপে ধরে, শেষমেশ বাধ্য হয়েছে নিজের সমস্ত স্মৃতি আগুনে ছুঁড়ে ফেলতে। কিছু স্মৃতি থাকে যেগুলো বাঁচিয়ে রাখলে মানুষটা আর বাঁচতে পারে না।
‘তার হাতে ধরা ছিল একটা দামি গিটার। সুরের তারে অনবরত সমন্বয়ে ছুটে চলছে বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনী। হাতের পিঠে খচির ব্ল্যাক কোরাল স্নেকের মাথার ট্যাটু। হাতের প্রতিটি নড়াচড়ায় মনে হচ্ছিল সাপের মাথাটায় যেন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে জীবন্ত হয়ে উঠে ধীরে ধীরে মাথা নাড়াচ্ছে। সেখান থেকেই ভেসে আসছে বিষণ্ন এক সুর। ভাঙা কণ্ঠস্বর,
❝কেন হয় এমন মনে নেই তো মন..
হাওয়া বড়ই বে-রঙিন…
নারে না নয় সহজ পাওয়া তোর মতন
আর কাউকেও কোনোদিন
হারিয়ে গেলাম ফুরিয়ে এলাম
চোখে শুকিয়ে গেল জল
বেঁচে থেকে লাভ কি বল
তোকে ছাড়া আর
খুজেছে জবাব অচল
মন কোথা কার
কি যে বলবো আর এ দূরত্ব টার
দেখি নেই রে কোনো শেষ
তবু দেখ না তুই বসে পাশ’টা তেই
গেলি আলোকবর্ষ দেশ
হারিয়ে গেলাম ফুরিয়ে এলাম
চোখে শুকিয়ে গেল জল
বেঁচে থেকে লাভ কি বল
তোকে ছাড়া আর❞
‘ইবরাত কিছু মুহূর্তের জন্য সেই কণ্ঠে হারিয়ে গিয়েছিল। শব্দের ফাঁকে ফাঁকে টের পাচ্ছিল অব্যক্ত বিষাদ, চাপা বেদনার ভার। কিন্তু এই মুহূর্তে থমকে থাকার অবকাশ নেই।তার হাতে সময় অল্প। কুঁচকানো ভ্রু গুছিয়ে সে ক্লাসের দিকে পা বাড়াল। ইবরাত চলে যেতেই গিটারের সুর থমকে গেল। থেমে গেল অশ্রুপাত। তারপর হঠাৎ অশ্রুসিক্ত স্বর্ণরঙা নয়নের মনিতে জ্বলে উঠল দগদগে আগুনের রেখা। দাঁতে দাঁত পিষে ওঠা তীব্র ঘর্ষণের সাথে ঠোঁটের কোণ থেকে ঝরে পড়ল একফোঁটা হুঙ্কার,
“Love is over. Now war begins.”
‘ক্লাসের নির্দিষ্ট সিটে বসে কথা বলছিল ইমামা আর হিয়া। গৌরব অর্ক আজও ভার্সিটিতে আসেনি। হিয়া ইমামার সঙ্গে কথা বলা শুরু করার পর থেকেই গৌরব তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও হিয়া এতে একটুও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সে জানে এই ছেলের রাগ নামলে ঠিকই নিজের আচরণ নিয়ে কী পরিমাণ আফসোস করবে। এখন তারা দু’ভাগে বিভক্ত। ছেলেরা একদিকে, মেয়েরা আরেকদিকে।
‘কথার মাঝেই হঠাৎ ভেসে এলো ইবরাতের কণ্ঠস্বর। এই মেয়েটা এমনই। যেদিক দিয়ে যায়, সেদিকের গাছপালাও তার উপস্থিতি টের পায়। হেঁটে আসতে আসতে সে গুনগুন করে গাইছে,
“বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
ওরে ওরে, ওরে—আমার জামাইটা কই?”
‘আজকেও পাশের সিটগুলো খালি দেখে গরম নিঃশ্বাস ছাড়ল ইবরাত। ইমামার পাশে বসতে বসতে বলল,
“বাদরগুলো আজকেও আসেনি। ক্লাসে মন বসবে না। চল শপিং করে আসি। অনেকদিন কিছু কেনা হয়না।”
‘শপিংয়ের নাম শুনলেই হিয়ার মুখে আলো জ্বলে উঠল। সে মাথা নাড়িয়ে তৎক্ষনাৎ সাই জানালো। কিন্তু অমত পোষণ করে ইমামা। শুকনো মুখে বলে,
“তোরা যা। আমি যাবো না।”
‘ইবরাত ভ্রু উচায়,”কেন কেন?”
‘ইমামা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল,”আই’ম ব্রোক৷”
‘দু’জনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের প্রশ্নবিহ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে ইমামা আবারও ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।
“সেদিনের পর বাবা আমার কার্ড ব্লক করে দিয়েছে। জন্মদিনে উপহার দেওয়া গাড়িটা পর্যন্ত গ্যারেজ থেকে বের করতে দিচ্ছে না।”
‘ইমামার কথা শেষ হতে না হতেই হিয়া নিজের কার্ডটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। ইমামা কপাল কুঁচকে হিয়ার দিকে তাকানোর সুযোগও পেল না, ঠিক তখনই ইবরাত তার গাড়ির চাবি ইমামার মুখের সামনে তুলে ধরল। শখের বসে স্কুটি চালালেও, বাকিদের মতো ইবরাতেরও ব্যক্তিগত গাড়ি আছে।
‘ইমামা এই মুহূর্তে আশ্চর্য, হতবাক। তার বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে হিয়া হেসে বলল,”হাম হে না, দোস্ত?”
‘ইবরাত কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,”যা, আজকে তুই ড্রাইভ করবি।”
‘কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ইমামা চিৎকার করে উঠল। পরমুহূর্তেই ইবরাতের হাত থেকে গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নিয়ে ছুট দিল। ইমামাকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে দু’জনেই হেসে ফেলল।
‘ওদের বন্ধুত্বটা ঠিক এমনই। সবাই উচ্চবিত্ত হলেও কারও জিনিস শেয়ার করতে কারও দ্বিধা নেই। আর ইবরাত জানত, ইমামার হাতে গাড়ির চাবি ধরিয়ে দিলে সে কখনোই না বলতে পারবে না। ছোটবেলা থেকেই গাড়ির প্রতি এই মেয়ের দুর্বলতা। তাই তো ইমান ওয়াসিম মেয়ের আঠারোতম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল একটি মার্সিডিস।
‘গাড়ি থেকে নেমে ওরা শপিং মলে ঢুকে সোজা লিফটে উঠে পড়ল। লিফট থেকে বেরোবার মুহূর্তে ইবরাতের চোখে পড়ল ভীষণ সুদর্শন এক ছেলে লিফটের ভেতর ঢুকছে। মুহূর্তেই ইউ-টার্ন নিল ইবরাত। আবার ঢুকে পড়ল লিফটে।
‘ইমামা পাশে তাকিয়ে দেখে ইবরাত নেই। হিয়া কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“ওটা কোথায় গেল?”
‘ইমামা জানে তার বান্ধবী কোথায় গেছে। এই মেয়েকে ওরা সবাই খুব ভালো করেই চেনে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মূত্র বিসর্জন দিতে হয়তো।”
‘হিয়া তাতে বিশ্বাস করল না। সত্যটা অনুমান করে নিল। ওরা একদম টপ ফ্লোরে উঠল। অদ্ভুতভাবে টপ ফ্লোরে পৌঁছতেই বাকিরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতে শুরু করল বিশেষ করে ছেলেরা। বিষয়টা একটু চোখে পড়লেও ওরা আর ঘাঁটাল না। নিজেদের পছন্দের শপের দিকে হাঁটা ধরল।
‘ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন ছুটে এলো ইবরাত। হাঁপাচ্ছে। হিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“কিরে, আজ এত তাড়াতাড়ি ছেলে দেখা শেষ?”
‘হাঁপানোর ফাঁকেই ইবরাত ঝাড়ি মারল,”ধ্যাত, লের! আগের মতো আর কাউকেই ভালো লাগছে না রে, দোস্ত।”
‘ইমামা চোখ রাঙায়,”কথায় কথায় তোর গালি না দিলে হয় না?”
‘ইবরাত দাঁত বের করে হাসল,”এটা হেল্পিং ভার্ব।”
‘ইমামা অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে ইবরাতের দিকে। হিয়া তো একটা চাটি বসিয়ে দিয়েছে। ইবরাতের মাথার ভেতর যেন ঝাঁ ঝাঁ উঠে। এরপর ওরা নিজেদের পছন্দের শপের দিকে এগোতে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার ওরা ভেতরে যাচ্ছে আর ভেতরের লোকজন সবাই বাইরে বেরোচ্ছে। যেন এক্ষুনি বেরিয়ে যাওয়ার হাই কমান্ড জারি করা হয়েছে।
‘হঠাৎই ইমামার গোয়েন্দাসুলভ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আটকে যায় অদূরের এক মধ্যবয়সী লোকের ওপর। দূর থেকে লোকটা একহাত বাড়িয়ে আসছে ইবরাতের সংবেদনশীল জায়গায় স্পর্শ করার স্পষ্ট অভিপ্রায়ে। ঠোঁটের কোণে লালসার কুৎসিত হাসি। অনবরত কথা বলতে থাকা ইবরাতের চোখে সেসব কিছুই পড়ে না। কিন্তু স্বল্পভাষী রুক্ষ ইমামা সেটা উপেক্ষা করতে পারে না।
‘সে পায়ের গতি বাড়ায়। ইবরাতকে আড়াল করে সামনে চলে যায়। লোকটা কাছে আসতেই বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ইমামা। শিকারীর মতো শক্ত করে খাবলে ধরে তার হাত। লোকটা চমকে ওঠে। ইবরাত আর হিয়া কী ঘটছে বুঝে উঠতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখে তাদের বান্ধবী এক অচেনা লোকের হাত চেপে ধরে অগ্নিবীণার মতো জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘ইমামার কণ্ঠ বরফশীতল আর ধারালো,
“আপনার ঘরে মা-বোন না-ই বা থাকতে পারে। তাই বলে এভাবে একটা মেয়ের বয়সী মেয়েকে বাজেভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন? আচ্চা আঙ্কেল এটা কি আপনার চরিত্রের সমস্যা, নাকি জন্মের দোষ?”
‘এটুকু মেয়ের মুখে এমন ধারালো বাক্য শুনে লোকটা কেঁপে উঠল। মুহূর্তেই মুখের রং ফিকে হয়ে গেল। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। ঘটনা বুঝতে পেরে ইবরাত তেড়েফুঁড়ে লোকটার দিকে এগোতে চাইলে ইমামা শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরল।
‘ইমামা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন চারজন কালো পোশাকধারী, বিশাল দেহের অধিকারী লোক এসে হাজির। এক নিমেষেই তারা লোকটাকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিল। একজন দৃষ্টি সংযত রেখে প্রায় নতজানু ভঙ্গিতে বলল,
“আপনি হাত নোংরা করবেন না, ম্যাম। আমরা বিষয়টা দেখছি।”
‘মুহূর্তের মধ্যেই তারা লোকটাকে নিয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। হিয়া নিঃশব্দে ইমামার পাশে এসে দাঁড়াল। খানিক দ্বিধা নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“লোকগুলো কে ছিল?”
‘ইমামা ওদের চোখে চোখ রাখল। কোনো শব্দ হলো না। শুধু দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। এরপর ওরা নিজেদের পছন্দের শপের ভেতর পা রাখল। পুরো শপ ইতিমধ্যে ফাঁকা। অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা চারদিকে। এসবের পেছনের কারণ কী, কারা আছে এই ঘটনার আড়ালে সবটাই ইমামা বুঝে ফেলেছে। আজ আর সে তিড়িংবিড়িং করেনি। পোশাকে আংশিক শালীনতা বজায় রেখেছে বরাবরের মতোই। শর্ট কুর্তির সঙ্গে জিন্স, গলায় ঝুলিয়ে রাখা পাতলা একটি স্কার্ফ। তবে ভিন্নতা শুধু চুলে। কোমর ছাপানো লালচে চুলগুলো আজ পিঠে ছেড়ে রাখা৷
“তুই কি ওই খুনিটাকে মাফ করে দিয়েছিস?”
‘ইমামা ভ্রু উঁচিয়ে ইবরাতের দিকে তাকাল।”খুনি?”
“সবটা কিন্তু তুই-ই আমাদের বলেছিস।”
‘ইমামা চুপ করে রইল। ইবরাত কথার সুরে হালকা খোঁচা দিল,”একটা খুনি, যে সিডকে খুন করেছে, এমনকি তোকে মারার চেষ্টা পর্যন্ত করেছে।তাকে এত সহজে মাফ করে দিলি?”
‘ইমামা নীরব। এবার হিয়া কথা তুলল। ওর কণ্ঠে বিস্ময় আর অবিশ্বাস,”যে লোকটা শুধু ফোন না ধরায় অ্যাসিডভর্তি পানিতে ডোবানোর পরিকল্পনা করে, কথা না শোনায় আগুনে পুড়িয়ে মারতে চায়—ওই রকম ভয়ংকর মানুষটাকে তুই এত সহজে ক্ষমা করে দিলি?”
‘এইবার ইমামা মুখ তুলল। হঠাৎ, মেঘলা আকাশে রোদের উঁকি দেওয়ার মতো করে ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ আলোড়ন ফুটে উঠল।
“আই অ্যাম আ ডার্ক রোম্যান্স রিডার, হানি।
অব কোর্স আই ক্যান ফরগিভ মার্ডার, বাট নট চিটিং।”
‘ইবরাত তেরছা চোখে তাকিয়ে, সদর্পে প্রশ্নের তীক্ষ্ণ তীর ছুড়ে দিল,”শুধু কি মাফই করেছিস, নাকি প্রেমেও পড়ে গিয়েছিস?”
‘ইমামার ঠোঁটের কোণে এবার অপ্রকাশিত গর্ভের রেশ,”হোয়েন আ ম্যান ইজ ম্যাসকিউলিন, ড্রিভেন, ভিশনারি, লয়্যাল, পাওয়ারফুল, অ্যান্ড আনস্টপেবল—ইয়েট সফট, কাইন্ড, অ্যান্ড লাভিং টুওয়ার্ড মি হাউ কুড আই নট ফল ফর হিম?”
‘যে গর্ভের সঙ্গে কথা বলেছিল, সেই গর্ভের সঙ্গেই পছন্দ করা একটি ড্রেস নিয়ে ট্রায়াল রুমে ঢুকে গেল ইমামা। তবে দরজাটা বন্ধ আর করা হলো না। বিচ্ছু দু’টো সাপের মতো চ্যালচ্যাল করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কৌতূহলী প্রাণদুটো অস্থির। আকুপাকু করছে।
“এইগুলোই ছিল প্রেমে পড়ার কারণ?”
‘সামনের লম্বাটে মিররে ফিট চেক করতে করতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে ইমামা আওড়াল,”He is a Medusa”
“Medusa” সমন্বিত বিস্ময়ে দু’টো ঠোঁট থেকে শব্দটা ঝরে পড়ল।
‘ইমামা কপাল কুঁচকে ওদের দিকে তাকাল। তবে বিস্ফোরিত অভিব্যক্তিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়েই বেরিয়ে গেল। ওরা পিছু নিল। ইবরাত অস্থির হয়ে জানতে চাইল,
“তুই সামনে থেকে দেখেছিস তাকে?”
‘জামা বাছাই করতে করতে মাথা নাড়িয়ে ইমামা বলল,”Nope.”
‘হিয়া অবাক,”তাহলে?”
“পুরোটাই আমার ধারণা। আদারওয়াইজ আমার রুচি এতটাও খারাপ না।”
‘ওরা আর ইমামাকে ঘাঁটাল না। সত্যি বলতে, ওদের নিজেদেরও লোকটাকে পছন্দ হয়ে গেছে। অচেনা, অজানা একটা মানুষ যেভাবে অজানা মেয়েগুলোকে যেভাবে নিদারুণ ভাবে বুঝিয়ে,নিরেট সত্য তুলে ধরে বন্ধুত্বের সেতু বানিয়ে দিয়েছে—সে কাছে এলে কে জানে আড়ষ্ট মেয়েটার জীবনটা আর কত সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে।
‘এবার তিনজন পূর্ণ মনোযোগ দিল শপিংয়ে। ইবরাত খেয়াল করল আজ কোনো ছেলে সেলসম্যান নেই। নেই কোলাহল, নেই ভিড়। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। মনের মতো করে পুরো শপ ঘুরে যা ইচ্ছে কিনা যাবে।
‘তবে বিপত্তি বাধল বিল পেমেন্টের সময়। কাউন্টারে গেলে জানানো হলো বিল আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। বিহ্বল ইমামা গম্ভীর হয়ে কারণ জানতে চাইলে ক্যাশ কাউন্টারের মেয়েটি অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল,
“আপনাদের বিল দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ম্যাম। আপনাদের বিল অলরেডি পেইড করা হয়েছে। এই যে কার্ড।”
‘ক্যাশ কাউন্টারের পরিচালিকা একটি আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্ল্যাক কার্ড এগিয়ে দিল। ইবরাত আর হিয়ার চোখ দু’টো বিস্ফারিত। হা করে তাকিয়ে থাকে ব্ল্যাক কার্ডের দিকপ। শুধু ইমামাই স্বাভাবিক। বরং ওর চোয়াল আরও শক্ত হয়ে গেল। মনে মনে কাউন্ট করছিল এক, দুই, তিন…
‘কাউন্ট শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। ইবরাত আর হিয়া ইশারায় বলল স্পিকারে দিতে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো আত্মপ্রত্যয়ী, নির্ভার কণ্ঠ
“Just spend your time on me; I’ll pay all your expenses, my love. after-all my card has no limit.”
“মানে?”
‘রিচার্ড ধীরে স্ক্রিনের সামনে মুখ আনল। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল ইমামার পাথুরে-নরম মুখটার দিকে। নিরেট, ঠান্ডা স্বরে বলল,
“I worked so hard just to see my princess happy. Now it’s time to let the money talk.
Go, girls—buy whatever you want.”
‘শেষের কথাগুলো যাদের উদ্দেশে ছিল, তারা এক মুহূর্তও দেরি করল না। হাতভর্তি ব্যাগগুলো কাউন্টারের ওপর রেখে আবার দৌড়। হারিয়ে গেল তথাকথিত নারী-স্বর্গে। ইমামা পাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। ওরা সরে যেতেই মোমঢালা লালিত মুখে এক চিলতে আলোড়ন ফুটে উঠল। লোকটা যে ইতিমধ্যেই তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে এ কথা মুখে না বললেও, মনে মনে ইমামা তা স্বীকার করে নেয়। তার ভারী কণ্ঠের প্রতিটি শব্দেই এমন এক সম্মোহন আছে, যেখানে উষ্ণতায় নরম হয়ে আসা চিজের মতো গলে যায় ইমামা। এখন আর তার পক্ষে কর্কশ ভাষায় কথা বলা সম্ভব হয় না। শব্দগুলো কঠিন হওয়ার আগেই নরম হয়ে যায়। আর প্রতিবাদ করার আগেই সে বুঝে যায় কিছু টান এমন থাকে, যাকে অস্বীকার করা যায় না।ফোন কানে তুলে নিল ইমামা।
“You are so rich.”
“Nope. I’m a rich man—like my…
“My?”
“রিদ?”
‘দরজার বাইরে ফাদারের উপস্থিতি টের পেয়ে রিচার্ড উঠে দাঁড়াল। মরুভূমির মতো রুক্ষ, খরখরে চিবুকে বিরক্তির ছায়া। তবুও কণ্ঠে স্থিরতা অটুট,
“Nothing. Just enjoy your shopping, sweety.”
‘লাইন কেটে গেল। ইমামা পিছন ফিরে তাকাল। দেখল ওরা যা পারছে, তাই নিচ্ছে। এমন না যে ওরা মধ্যবিত্ত। তিনজনই উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কিন্তু ওই যে কথায় আছে মেয়েরা পুরো একটা শপিং মল কিনে ফেলার পরও আফসোস করে বলে, ইশ, আরেকটা শাড়ি কিনতে পারলে ভালো লাগত!
‘এই তিন বান্ধবীর কারোর পরিবারই কারোর চেয়ে পিছিয়ে নয়। সবকিছু থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকের জীবনে কোথাও না কোথাও একটা অপূর্ণতা আছে। ইমামার বাবা ইমান ওয়াসিম তিন আসনের সংসদ সদস্য। অভাব কী, সেটা কোনোদিন বুঝতে দেয়নি। অথচ এত কিছুর পরও মায়ের নিখাদ ভালোবাসাটা ইমামা কখনো পায়নি।
‘হিয়ার পুরো পরিবার আর্মি ব্যাকগ্রাউন্ডের। শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা সব আছে। নেই শুধু একজন মানুষ। নেই ওর বাবা। আর ইবরাত? ইবরাতের তো বাবা-মা দু’জন তো থেকেও নেই। ইবরাতের বাবা একজন রাজনীতিবিদ। ইবরাতের জন্ম কানাডায়। এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে থাকা বহু মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে স্ত্রী-সন্তানকে ঠেলে দেয় বিদেশে। সেই নৈতিক পলায়নের ফলেই কানাডার মন্ট্রিলের এক এলাকার নামই হয়ে গেছে—বেগমগঞ্জ। সব বেগমদের স্থায়ী ঠিকানা। ওখানে স্ত্রী-সন্তানরা বাঁচে নিরাপদ, ঝকঝকে, স্বচ্ছল জীবনে। আর এদিকে তৃতীয় বিশ্বের ক্ষতবিক্ষত এক দেশকে লুটে-পুটে, চুষে-চুষে সেই আরামের জ্বালানি জোগায় তাদের পতিদেবেরা। ক্ষমতা থাকলে দেশ শোষণ, ক্ষমতা ফুরোলেই পালানোর প্রস্তুতি।
রক্ত খাওয়া শেষ হলে অথবা ক্ষমতার চেয়ারে পা হড়কালে এই স্বর্গেই একদিন তারাও এসে হাজির হবে। লুট করা দেশের ছাই পেছনে ফেলে নিজের স্বর্গ বাঁচাতে।
‘কিন্তু এই দূরত্বই একসময় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরায়। শেষমেশ হয় ডিভোর্স। চার বছরের ইবরাতকে তখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে কার সঙ্গে থাকবে? অন্য ভাইবোনদের মতো মাকে না বেছে নিয়ে বোকা ইবরাত বাবাকেই বেছে নিয়েছিল। সেটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। যে বাবার ভালোবাসার জন্য সে সব ত্যাগ করেছিল, সেই বাবার ভালোবাসাই সে পায়নি। রাজনীতিবিদ বাবার কাছে মেয়ের সঙ্গে দু’দণ্ড বসে কথা বলার সময়ও ছিল না। একাকীত্ব আর একগুঁয়েমিতেই কেটেছে ইবরাতের শৈশব।
‘তবে সেই একাকীত্ব ভাঙে স্কুলে ওঠার পর। তার পাঁচজন বন্ধু তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল পরিবার শুধু রক্তের সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়। পরিবারের বাইরেও আরেকটা পরিবার থাকে। সেখানেও ভালো থাকা যায়।
‘ওরা যখন শপিংয়ে ব্যস্ত, পুরো টপ ফ্লোর যখন প্রায় জনশূন্য ঠিক তখনই ক্লিনিং রুমের ভেতর এক অদ্ভুত দৃশ্য ঘটে। একজন মানুষ নিঃশব্দে নিজের পরনের দামি, রুচিশীল পোশাক খুলে ফেলে। তার জায়গায় পরে নেয় ফ্লোর ক্লিনারের নিরীহ পোশাক। পরিচয় বদলায়, মুখ বদলায় তবে উদ্দেশ্য বদলায় না।
‘ব্ল্যাক কার্ড হাতে পেয়ে ইবরাত আর হিয়া এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে ব্যাগ বহন করতে চারজন লোক লেগে যায়। বিল কত ছাড়িয়েছে সেই হিসাব না হয় বাদই থাক। শপ থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে এগোচ্ছিল তারা ঠিক তখনই….
‘হঠাৎ ফ্লোর ক্লিনারের ছদ্মরূপে থাকা সেই রহস্যময় মানুষটা আচমকা ইমামাকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে এল। এক ঝলকে গলায় ঠেকল ধারালো ছুরি। মুহূর্তেই চারপাশ জমে গেল। কানের একেবারে কাছে মুখ এনে, চেনা সেই হিমশীতল কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলল,
“রেড ওয়াইন।”
❌
‘অনেকদিন পর। সবাই কেমন আছেন? আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। সকলের সুস্থতা কামনা করি। হাত একটু স্লো হয়ে গেছে। আশা করি খুব শীঘ্রই আগের স্পিড ফিরে পাবো। রিচেক করা হয়নি। ভুলক্রূটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই রেসপন্স করবেন, কেমন?
Share On:
TAGS: born to be villains, মিথুবুড়ি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
Born to be villains পর্ব ৭
-
Born to be villains পর্ব ৯
-
Born to be villains পর্ব ২
-
Born to be villains পর্ব ১
-
Born to be villains পর্ব ৩
-
Born to be villains পর্ব ১২
-
Born to be villains পর্ব ১৩
-
Born to be villains গল্পের লিংক
-
Born to be villains পর্ব ১১
-
Born to be villains পর্ব ৬