বেলতুলি – [০২]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
–“শুনলাম, তোর নাকি বিয়ে?”
ভরদুপুরে নিবিড়ের এহেম আশ্চর্যজনক প্রশ্নে মৌনো হতভম্ভ। তার বিয়ে? কবে, কখন? সে তো জানে না।
–“মানে? আমার বিয়ে?”
–“কামরুল তো তাই বলল। বয়স কত তোর?”
মৌনো এতক্ষণে পুরো ঘটনা বুঝতে পারল। সে বয়স এড়িয়ে বলল,
–“বিয়ে আমার নয়, বড়ো আপার। আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।”
নিবিড় বুঝল তার শুনতে কিংবা বুঝতে ভুল হয়েছে। তবে তার মনে দারুণ খটকা। রিমঝিম আর সে তো প্রায় একই বয়সী। খুব সম্ভবত তার থেকে এক বছরের ছোটো। সে তো আরও ভেবেছিল রিমঝিমের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন মৌনোর কথাবার্তা চলছে। কারণ, এই সমাজে এতদিন কোনো মেয়েকে বিয়ে ছাড়া ঘরে বসিয়ে রাখে না।
–“রিমঝিমের ডাক্তারি পড়া শেষ? কী করছে এখন?”
অনেকদিন পর পর এলাকায় নতুন আসলে সবকিছুই নতুন লাগে। নিবিড়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। মৌনো তার না জানাকে কটাক্ষ করতে চাইল। কিন্তু বড়ো আপার ক্ষেত্রে সে ঠাট্টা-মশকরা পছন্দ করে না। বলল,
–“জি, এই তো এক তারিখেই সদর হাসপাতালে ডাক্তারি শুরু করবে।”
–“ইন্টার্নশিপের কি অবস্থা?”
–“মাসখানেক হলো শেষ করেছে।”
মৌনো আশা করেছিল নিবিড় প্রশংসা করবে। এই ২০১০ সালের যুগে একটা মেয়ের ডাক্তারি পাশ কি আর চারটে খানিক কথা? তাও আবার সদর হাসপাতালে চাকরিও পেয়েছে। নিবিড় তার আশায় পানি ঢেলে প্রসঙ্গ বদলে ফেলল,
–“কোথায় যাচ্ছিস?”
–“যাচ্ছি বাজারে, আর ফেরার পথে রাতুলদের বাড়ি বলে আসব আজ পড়াতে যাব না।”
নিবিড় বিরক্ত হলো বাজারের কথা শুনে। সে বাজার, মেলা এবং যেসব জায়গাতে বখাটেদের চলাচল বেশি সেসব জায়গা খুব একটা পছন্দ করে না। মৌনো পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“যেতে বলেছি?”
মৌনো দাঁড়িয়ে গেল।
–“এক্ষুণি বাড়ি যাবি, মেয়ে মানুষের বাজারে যাওয়ার দরকার নেই। কামরুলকে পাঠাচ্ছি, ওকে বলে দে সব।”
অগত্যা, মৌনোর আবারও বাড়িতেই ফিরতে হলো। বাড়িতে মা আর সে ছাড়া কেউ নেই। রিমঝিম আজ একটু হাসপাতালের দিকে গিয়েছে। রিয়াজ সাহেব প্রতিবারের মতো চেম্বারে আর জুনায়েদ, এশা স্কুলে। জুনায়েদ এবার ক্লাস এইটে পড়ছে আর এশা মাত্র ক্লাস ওয়ানে। জুনায়েদই সাথে করে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। মৌনো পড়ছে অনার্স প্রথম বর্ষে। রিয়াজ সাহেব স্বভাবসুলভ এলাকায় দাঁতের ডাক্তার নামে সুপরিচিত। রাজিয়া শেখ ঘরের গৃহিণী, ছেলে-মেয়েদের শাসন করতেই জীবন পেরিয়ে যাচ্ছে।
নিবিড়’রা মৌনোদের তথাকথিত কোনো আত্মীয় নয়। একই এলাকার প্রতিবেশি বলা যায়। তবে ছোটোবেলায় বোনেদের ওদের বাড়ি অবাধ যাওয়া-আসা ছিল। সেই অবাধ চলাফেরার জন্যই হয়তো নিবিড়কে সে কাছ থেকে দেখেছে। নিবিড়ের দৌড়ও কম খায়নি।
নিবিড় সর্বদা মারপিটে দক্ষ ছেলে ছিল। তাকে কেউ কখনো ফুলের টোকাও দিতে পারত না। রোজ কোনো না কোনো ঝামেলা লাগিয়ে ফিরত। এ নিয়ে নিবিড়ের পুলিশ অফিসার বাবা মশিউর সাহেব সিদ্ধান্ত নেন, ছেলেকে আর্মিতে ঢুকাবেন। অন্তত ছেলে সোজা পথে তো আসবে।
মশিউর সাহেব রিটায়ার হয়েছেন কয়েক মাস আগেই। কিন্তু এই কয়েক মাসে তিনি চরম বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। পুরুষ মানুষ কাজে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। যেই শরীর এত বছর ছোটাছুটি, কাজ, থানায় ব্যস্ত ছিল সেই ব্যস্ত জীবন থেকে আচমকা অবসর পাওয়াটা একটা ঘোরের মতো। আগে ভাবতেন কবে রিটায়ার হবেন আর খোলা, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলবেন, আর এখন চিন্তা করেন এত দ্রুত বয়স কেন ফুরালো? তার যেন দিন কাটলে সন্ধ্যা কাটে না, সন্ধ্যা কাটলে রাত কাটে না। সে কি বিচ্ছিরি, বিরক্তিকর একঘেয়ে জীবন। আজকাল বাড়ির বাইরে না গিয়ে সারাক্ষণ খবরের কাগজ, টিভির পড়ে থাকেন। দেশের কোথায় কী হচ্ছে তা ঘাটেন। তাও যদি একান্ত মন না ভরে, চলে যাচ্ছেন পাড়ার টং-এ। যেখানে তারই বয়সী আরও রিটায়ার সঙ্গী আছেন, তাদের সাথে দূর্নীতি, রাজনীতি, খেলা-ধুলা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করতে বসেন। এমনিতে ভদ্রলোক গম্ভীর, পুলিশি ছাপ এখনো চেহারা থেকে কাটেনি। এত সহজে কাটার কথাও না অবশ্য। এখনো এলাকার বাচ্চারা তাকে দেখে মাথা নিচু করে হাঁটে। তারা আবার পুলিশদের বড্ড ভয় পায়। আর মায়েরা তো আছেই, দুষ্টুমি করলেই সবার আগে মশিউর সাহেবের কথা বলে ভয় দেখান।
মশিউর সাহেবের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং অত্যন্ত সুন্দরী ভদ্রমহিলা হচ্ছে নিবিড়ের মা সোফিয়া খানম। তিনি খুব সিরিয়াস মানুষ, ঠাট্টা-মশকরা পছন্দ করেন না। যতটা সম্ভব প্রতিবেশিদের থেকে গা বাঁচিয়ে চলেন। তার একান্ত ধারণা মানুষের সাথে বেশি মেলামেশা করলে মানুষ দাম দেয় না। এজন্য তিনি সবসময় সৌখিনতার সাথে নিজের গম্ভীর ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করেন। দুয়েকটা কাজের কথা ছাড়া কারো সাথেই তার বিশেষ ভাব নেই। কথা-বার্তা বলেন ভীষণ খসখসে গলায়। যেন স্বামীর পুলিশি ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতা তার মাঝেও ভর করেছে। পুলিশের বউ বলে কথা, এনারা নাকি নরম হন না।
নিবিড়রা দুই ভাই এক বোন। তার মেঝো ভাই নীরব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সেই অনুসারে তাকে ঢাকা ছেড়ে রাজশাহী পাড়ি দিতে হয়েছে। পরিবারটা পূর্ণ খুব কমই দেখা যায়। এ নিয়ে সোফিয়া খানমের আফসোসের শেষ নেই, কেন ছেলে-মেয়েগুলো বড়ো হলো? ছোটোই থেকে যেত, অন্তত তার বুকে লেপ্টে তো থাকত। ছোটো মেয়ে শেইরা সবে এসএসসি দিবে।
এখন মোবাইলের যুগ, তার সংযোগহীন সময়ে সোফিয়া খানম বাটন মোবাইল গুতোচ্ছেন। ব্যবহার করেন এয়ারটেল সিম। নেটওয়ার্ক এই পান আবার এই পান না। সে নিয়ে সিম কোম্পানিদের ভালো-মন্দও কম বকেন না। এইযে এখন, ছোটো ছেলেটার জন্য বুক কেমন করছে, অথচ নেটওয়ার্কের জন্য যোগাযোগ করতে পারছেন না। স্বামী গিয়েছেন মসজিদে, যোহরের আযান দিবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এমন সময়ই নিবিড় ঢুকল। সোফিয়া খানম ছেলের উদ্দেশে বললেন,
–“হতচ্ছাড়া নেটওয়ার্ক এমন বিশ্রী কেন?”
নিবিড় কিছু না বলে উপরের ঘরে চলে গেল।।মায়ের সাথে তার মান-অভিমান চলছে, তাই খুব একটা কথা বলে না। ছেলের এভাবে তাকে এড়িয়ে যাওয়া পছন্দ করলেন না সোফিয়া খানম। গলা উঁচিয়ে বললেন,
–“যত যাই করিস না কেন, তুই রত্নাকেই বিয়ে করবি নিবিড়। মিলিয়ে নিস মায়ের কথা।”
শেষ বিকালে পাত্রপক্ষ এলো। সেই সাথে আমন্ত্রিত ছিল নিবিড় এবং মশিউর সাহেব। মৌনো রান্নাঘর থেকে নিবিড়কে দেখতেই বিরক্ত হলো। দ্রুত হাতে নুডুলস রান্না করতে করতে বলল,
–“নিবিড় ভাই এসেছে কেন?”
–“তোর আব্বা ডেকেছেন। জানিসই তো তোর বাপের সাথে মশিউর ভাইজানের কী গলায় গলায় সম্পর্ক। তার পরামর্শ ছাড়া এক ধাপও এগোন না।”
শেষের কথাটুকু রাজিয়া শেখ তিক্ত সুরেই বললেন। পরমুহূর্তে স্বামীর ডাক শুনতেই তিনি মৌনোর দিকে তাকালেন। মৌনোর ততক্ষণে নুডুলস রান্না শেষ, সবেই চুলো থেকে নামাল। রাজিয়া বললেন,
–“এসব ছাড়! যা গিয়ে রিমঝিমকে দেখে আয় কী করছে। তৈরি হলো কিনা? তোর বাবা তো ডাকছেন।”
মৌনো ওড়নায় ঘর্মাক্ত কপাল মুছে চলে গেল। রান্নাঘর থেকে রুমে যেতে বৈঠকঘর পার হতে হয়। তখনই পাত্রের চোখ পড়ে যায় মৌনোর উপর। মৌনো ঘরে গিয়ে দেখল রিমঝিম বিরস মুখে বসা। বোনকে দেখতেই মুখ খুলল,
–“বল তো, আমি কি বাবার বোঝা?”
মৌনো রিমঝিমের অভিমানী কণ্ঠস্বর শুনে বলল,
–“আপা, তোমার এক প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে জিভ ঝুলে আসছে। ডাক পড়েছে তোমার, চলো।”
রিমঝিম মৌনোর সাথে যেতে যেতে বলল,
–“এভাবে অহংটা দেখালি না আজ? আমারও দিন আসবে, আমিও বলব তোকে যেন ঘাড় ধরে বিয়ে দিয়ে দেয়।”
রিমঝিমকে পাত্রপক্ষের সামনে বসানো হয়। মৌনো পর্দার আড়ালেই থেকে গেল। এর আগেও বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে সে, তাই রিমঝিমের জন্য পাত্রপক্ষ আসলে সে নিজ ইচ্ছেতেই সরে সরে থাকে।
কিন্তু দেখা গেল পাত্রপক্ষ খুঁত ধরা শুরু করেছে রিমঝিমের। রিমঝিমের গায়ে বয়সের ছাপ পড়েছে, গায়ের ওজনও লাগছে বেশি বেশি, এছাড়া মুখটাও কেমন কালো হয়ে গেছে। রিমঝিম বেশ বিব্রত হয় এতে। যেখানে তার সবার সাথে ভালো সম্পর্ক সেখানে অচেনা, অজানা মানুষজন তাকে জাজ করছে, কটাক্ষ করছে।
পাত্রর বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ, সে অবশেষে তার ধান্দাটা প্রকাশ করল,
–“আরেকটা মেয়ে দেখেছি। আমার ওকে পছন্দ হয়েছে। দিলে ওই মেয়েটাকেই দেন। কী আগুন রূপ তার।”
পাত্রর মাও কোনো এক ভাবে মৌনোকে দেখেছিলেন। সেও ছেলের সাথে একই সুর তুললেন। বাড়িতে এত গুরুতর পরিস্থিতি, এদিকে এশা উঁকিঝুঁকি দিয়ে মেহমানদের খাবারই দেখে যাচ্ছে।
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে—
বিঃদ্রঃ বেশি বেশি রেসপন্স এবং কমেন্টের অপেক্ষায় আছি। আশা রাখছি গত পর্বের মতো এবারও আপনারা রেসপন্স করবেন।
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ১০
-
বেলতুলি পর্ব ৫
-
বেলতুলি পর্ব ১৪
-
বেলতুলি পর্ব ১২
-
বেলতুলি পর্ব ১৭
-
বেলতুলি পর্ব ১৩
-
বেলতুলি পর্ব ১৫
-
বেলতুলি পর্ব ৯
-
বেলতুলি পর্ব ৭
-
বেলতুলি গল্পের লিংক