মেঘেরওপারেআলো
পর্ব_৩৪
Tahmina_Akhter
—ইনায়া, আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড!
মেঘালয় চরম বিস্ময় নিয়ে নরম সুরে জিজ্ঞেস করে । ইনায়া তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দেয়,
— পাপ তোমার করা অর্জিত সম্পদ নয়, মেঘালয়। মিসেস মেঘালয়ের অর্জিত সম্পদ হচ্ছে পাপ। তোমরা দুজনে পার্টনার। স্বামী-স্ত্রী তোমরা। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। মুদ্রার এপিঠ নোংরা হলে অপর পিঠ এমনিতেই নোংরা হবে।
ইনায়ার কথার আগামাথা খুঁজে পাচ্ছে না মেঘালয়। মেঘালয় উঠে দাঁড়ালো। ইনায়ার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে জবাবে বলল,
— তুমি বরাবরই আমার স্ত্রীকে হেয় করতে চেয়েছো। তাকে ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করো না। কারণটাও, হয়ত আমি। আমাকে না পাওয়ার ক্ষোভ তোমাকে উন্মাদ করে তুলেছে ইনায়া। ফর গড সেইক, তোমার ডার্টি মাইন্ডের গেইমে আমার স্ত্রীকে ইনভলভ করবে না।
— আলোর ভালোবাসা তোমাকে অন্ধ করে ফেলেছে, মেঘালয়।
ইনায়া মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়।
— স্ত্রীর ভালোবাসা পেয়ে যদি আমি অন্ধের খেতাব প্রাপ্ত হই, আই ডোন্ট মাইন্ড।
মেঘালয় এক দুই পা করে পিছিয়ে গেল। ইনায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অবাকের রেশ কাটার আগে আবারও প্রশ্ন করল।
— একটা কালো মেয়ের মধ্যে তুমি কি খুঁজে পেয়েছো?
ইনায়ার প্রশ্ন শুনে মেঘালয় মুচকি হাসে।
— ওর মাঝে কি খুঁজে পেয়েছি তালাশ করিনি কখনো! প্রয়োজনবোধ করিনি। শুধু, আমি এতটুকু জানি। আলো আমার স্ত্রী। আমার দায়িত্ব। আমার বাচ্চার মা। আমার আত্মার আত্মীয়।
মেঘালয় আর এক মূহুর্ত দেরি করল না। অতি দ্রুত চলে গেল আলোর ডাক্তারের কাছে। আলোর অবস্থা সম্পর্কে এখনো কোনো আপডেট মেলেনি।
মাহরীনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেই ইনায়া এসেছিল। এরইমাঝে মেঘালয়ের সঙ্গে তার দেখা। ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর, করিডরে সারিবাঁধা চেয়ারে একটায় বসে অপেক্ষা করছে মাহরীনের জন্য। ইনায়া অদূরে তাকিয়ে ভাবছে মাশফির কথা৷
মাশফি আজ তার মেয়ের সঙ্গে হসপিটালে থাকবে। বাড়িতে ফেরার তাড়া নেই। কল করে বাড়িতে ফেরার কথা বলা মানুষটা নাই। মাশফির কাছ থেকে এসব কথা শোনার পর ইনায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। মানুষটার অভিনয় যে এতটা নিখুঁত যে বোঝার উপায় নেই কোনটা বাস্তব, কোনটা অভিনয়! ইনায়া অনেক প্রশ্নের উত্তর চায়। তবে সঠিক সময়ের অপেক্ষায় আছে। তার আপুর বাচ্চাটা সহি সালামতে ফিরে আসুক। তারপর, না-হয় সব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে।
মাহরীন এবং সিতারা বেগমকে নিয়ে ইনায়া হসপিটাল থেকে বের হলো বাসার উদ্দেশ্য।
আলো বহু কষ্টে চোখ খুলে তাকালো। মাথার ওপর চরকির মত ফ্যান ঘুরছে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না সে। হটাৎ করেই পেটের মাঝে ধারালো ব্যাথা অনুভব করতেই আলোর চোখমুখ কুঁচকে আসে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা অনুভব করে৷ তারপরই, আলোর কি যেন মনে পরে? ডানহাতটা তুলে পেটের ওপরে রাখল। সে কি! নড়াচড়া অনুভব করতে পারছে না কেন সে? আলো একবার পেটের ডানদিকে তো আরেকবার বাম দিকে হাত রাখছে। তার সন্তানের নড়াচড়া যদি কোনোভাবে টের পায়! কিন্তু, তার অস্তিত্ব যে টের পাচ্ছে না! আলোর শরীর ভয়ানকভাবে কাঁপতে শুরু করল। চোখের জল গড়িয়ে হসপিটালের সাদা বেডের ওপর। মাথার নীচে বালিশ দেয়া হয়নি এখনও। বামহাতে এখনো স্যালাইন চলছে। আলোর মৃগীরোগে আক্রান্ত রোগীর মতো কাঁপছে। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
” ডাক্তার সাহেব, আপনার বেলীফুলের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না কেন আমি?”
সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো মেঘালয়। প্রতিটাক্ষন, প্রতিটা সেকেন্ড যেন দীর্ঘ সময়ের মত লাগছিল তার কাছে। আলোর জ্ঞান ফিরে এসেছে প্রায় শেষ রাতের দিকে। একজন নার্স এসে মেঘালয়কে খবরটি জানায়। মেঘালয়ের আলোর কাছে আজ যাওয়ার তাড়া নেই। আলোর কাছে গেলেই, আলোকে কৈফিয়ত দিতে হবে। তাদের বাচ্চার কথা যখন জানতে চাইবে। তখন মেঘালয় কি জবাব দেবে? নাকি বলবে, “আলো আমাদের একটা রাজপুত্র হয়েছিলে। চাঁদের মত রুপ ছিল তার। কিন্তু, ঘোর অমাবস্যা তাকে গ্রাস করেছে। আমি এই হাত দু’টো দিয়ে তোমার নাড়িছেঁড়া মানিককে কবরের স্যাতস্যাতে, শীতল, পোকামাকড়ের বাসস্থানে রেখে এসেছি।”
ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে সূর্যের আলো ঠিকরে পরছে। মেঘালয়ের চোখ জ্বালা করছে। ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। চোখেমুখে পানি দিয়ে বের হয়ে আসে। ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যায়। কড়া এক কাপ দুধ চা খেলো খালি পেটে। তারপর,আবারও রওনা হলো। আলোর সঙ্গে দেখা করা জরুরি। আলোর মুখটা মনে করতে পারছে না। কি অদ্ভুত ব্যাপার! গত দুদিনের ঝড়-ঝাপটায় আলোর মুখটা তার মানসপটে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
নার্সের সঙ্গে কথা বলে পোস্ট অপারেটিভ রুমে ঢুকল মেঘালয়। আলো চোখ বন্ধ করে তখনও নীরবে চোখের জল ফেলছিল। মেঘালয়ের উপস্থিতি সে টের পায়নি। মেঘালয় ধীরপায়ে হেঁটে গেল আলোর বেডের কাছে। বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আলোর শুকিয়ে যাওয়া মলিন মুখখানা দেখে মেঘালয়ের চোখে অশ্রু জমা হচ্ছে। আলো দেখা ফেলার আগেই মেঘালয় অশ্রু মুছে ফেলল। আলতোভাবে আলোর মাথায় হাত রেখে নরম সুরে জিজ্ঞেস করল,
— কেমন আছো, আলো?
তার ব্যক্তিগত ডাক্তার সাহেবের কন্ঠস্বর শুনতে পেলো আলো। চোখ খুলে তাকালো। মেঘালয় দেখল আলোর ভেজা আঁখি পল্লব। কান্নার দমকে তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট জোড়া।
— কান্না করছো, কেন?
প্রশ্নটি করার সময় মেঘালয়ের কন্ঠস্বর কেঁপে উঠল। সে তো জানে আলোর কান্না করার কারণ! বেডের পাশে রাখা টুলে বসল মেঘালয়। আলোর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।
— কান্না করলে তোমার সমস্যা বাড়বে, আলো? সেলাইয়ে প্রবলেম হবে। প্লিজ কান্না বন্ধ করো।
আলোর কান্না থামার বদলে আরও বেড়ে যায়। মেঘালয় আলোর অবস্থা দেখে ভয় পাচ্ছে এখন। মেঘালয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আলোর হাতের পিঠে চুমু দিয়ে বলল,
— আলো? কান্না বন্ধ করো। আমার কথা শুনো। এদিকে তাকাও। আমার দিকে তাকাও তুমি?
আলো ফিরেও তাকায় না। গাল গড়িয়ে চোখের জল অনবরত গড়িয়ে পরছে বেডের ওপর। মেঘালয় অস্থির হয়ে উঠল। আলোর হাতটা শক্ত চেপে ধরে আদেশের সুরে বলল,
–কতবার বলেছি তোমাকে, আমি যার সঙ্গে কথা বলি সে, যদি আমার দিকে না তাকায় আমি কথা বলতে উৎসাহ পাই না।
আলো মেঘালয়ের দিকে তাকালো। আলোর ভেজা চোখ দেখে মেঘালয়ের বুকে তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করল। আলোর মাথা হাত রাখল। আলো চোখ বন্ধ করে ফেলল৷ মেঘালয় আলোর চোখের জল মুছে দিলো। আলোর শূন্য গর্ভের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আলোর প্রেগন্যান্সির খবর মেঘালয় আলোকে জানিয়েছিল। সেদিন খবরটি জানার পর আলোর চোখেমুখে ছিল প্রশান্তির ছাপ। নতুন মা হবার আনন্দ। আর আজও তাদের সন্তানের মৃত্যু সংবাদটি জানাতে হবে মেঘালয়কে। খবরটি জানার পর আজ আলোর অনুভূতি কেমন হবে?
মেঘালয় আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বলল,
— অনাকাঙ্ক্ষিত মেহমান অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চলে গেছে। আর কোনোদিনও তার ঠাঁই হবে না এই ধরনীর বুকে।
আলো চোখবুঁজে এতবড় একটা দুঃসংবাদ হজম করার চেষ্টা করল। কিন্তু…
এতক্ষণ তার মনের ভেতর একটু হলেও আশার প্রদীপ জ্বলছিল এই ভেবে যে, তার সন্তান সুস্থ আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিক যুগে তার এইটুকু বাচ্চাটা হয়ত বেঁচে থাকবে। কিন্তু…
— ডাক্তার সাহেব?
আলো ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানের ওপর দৃষ্টি রেখে মেঘালয়কে ডাকল। মেঘালয় সাড়া দেয়।
— হুম?
আলোর মনে হলো মেঘালয় ভারি নিষ্ঠুর একজন বাবা। আলো তীব্র অভিমান নিয়ে তাকালো মেঘালয়ের চোখের দিকে।
— আপনি আমার কষ্ট টের পাচ্ছেন, ডাক্তার সাহেব? আমার ভেতরটা কেমন দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে! আমি মাতৃত্বের স্বাদ পেলাম ছয় মাস। আমার কোলজুড়ে আমার সন্তান আসার কথা। অথচ, সন্তান এলো না! কষ্ট পেলাম, মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করলাম। তলপেটে বহন করলাম সি-সেকশনের ক্ষত। যেই ক্ষত কখনো চামড়ার সঙ্গে মিলিয়ে যায় না। এতকিছুর স্বাদ গ্রহন করলাম কার জন্য? আমার সন্তানের সুস্থতার জন্যই তো? কই আমার সন্তান? আমার এতদিনের যন্ত্রণা, কষ্ট, নির্ঘুম রাতের ঘুম, সি-সেকশনের ব্যাথা লাঘবের জন্য হলেও তো আমার সন্তানের প্রয়োজন।
আলো ধীরে ধীরে কথাগুলো বলছিল। মেঘালয় সবটা শুনলো। আলোকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা তার জানা নেই। সে নিজেও একই কষ্টে জর্জরিত।
— আমি জানি তোমার কেমন লাগছে!
মেঘালয়ের কথা শুনে আলো তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দেয়।
—আপনি আমার কষ্ট কখনোই টের পাবেন না। আপনি জানেন সন্তান মৃত্যুর খবরের ওজন বহন করা কতটা কষ্টের!
আলোর কথা শুনে মেঘালয়ের পাগলের মত হাসতে শুরু করল। আলো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। গা দুলে ওঠে মেঘালয়ের। আলো ছোট একটা মেয়ে। হয়ত তার বউ হয়েছে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে। বাচ্চাটা সে অন্যকারো বুদ্ধি নিয়ে কনসিভ করেছিল। এত ছোট একটা মেয়েকে সে ভারি কথা বলে তার কষ্ট বাড়াতে চায় না। আলোর কে আছে? মা নেই। বাবা গত হলো খুব বেশিদিন হলো না। আর এখন নিজের সন্তান….
” তুমি আমার কষ্ট কখনোই টের পাবে না। একজন বাবার কষ্ট তুমি কখনোই টের পাবে না। যেই সন্তানকে আদর করে কোলে তুলে রাখার কথা। সেই সন্তানকে বুক থেকে নিষ্ঠুরের মত সরিয়ে কবরের ঠান্ডা মাটিতে শুয়ে রাখার কষ্ট তুমি কখনোই টের পাবে না। শেষবেলায় আদরের সন্তানকে কবরে রেখে যখন কবর থেকে উঠে দাঁড়াতে জমিনের বুকে, সেই কষ্ট তুমি কখনোই টের পাবে না। বাঁশের চাঙ সাজিয়ে মৃত সন্তান আর হতভাগ্য বাবার চিরতরে বিচ্ছেদের দৃশ্য দেখলে তুমি কখনোই সহ্য করতে পারবে না। যেই সন্তানকে ফুলের মত যত্নে রাখতাম, সেই সন্তানের ওপর মাটি ফেলে কবর ভরাট করার কার্য সম্পাদন তুমি করতে পারতে না। আমি বাবা বলেই নিষ্ঠুরের মত সেই কাজ করতে পেরেছি “
মেঘালয়ের হাসি থেমে গেছে সেই কখন! তার মনের কথা মনে রয়ে যায়৷ আলোকে বলা হয়ে ওঠে না। আলোর হাতটা ধরে চুপ হয়ে বসে থাকে। আলো মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলল, মেঘালয়ের মনের অবস্থা। মেঘালয়ের অনেক না বলা কথার সাক্ষী যেন তার নীরবতা। আলোর একবার জানতে ইচ্ছে করল। তার সন্তান দেখতে কেমন হয়েছিল! তার মায়ের মত কালো? নাকি তার বাবার মত সূদর্শন?
জানালার গ্রীল গলিয়ে সূর্যের আলো কেবিন আলোকিত হয়ে উঠল। মেঘালয় জানালার ওপর দৃষ্টি রেখে ভাবছে, তার সন্তান কেমন আছে সেই অন্ধকার কবরে! মায়ের অন্ধকার গর্ভে থেকে বেরিয়ে দুনিয়ার জাঁকজমক আয়োজন দেখা হলো না তার। ফের হারিয়ে গেল মাটির অন্ধকার গর্ভে।
চলমান….
Share On:
TAGS: তাহমিনা আক্তার, মেঘের ওপারে আলো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৩
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৭
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৫
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৬
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৮
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২৪
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৬
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩১
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৪০