বেলতুলি – [০৪]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
কামরুল হচ্ছে মুন্সী বাড়ির প্রধান কাজের ছেলে। ওকে পনেরো বছর থাকতেই মশিউর সাহেব এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করিয়েছেন, কামরুল এই বংশেই আজীবন থেকে যাবে। তার সমস্ত খরচের ভার মশিউর সাহেবের এরপর নিবিড়ের ঘাড়ে যাবে। তিনি ভেবেছিলেন কামরুল এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। সে পড়াশোনা করতে চাইবে। সেই অনুযায়ী তিনি স্কুলও ঠিক করলেন, ঠিক ভর্তির আগ দিয়ে কামরুল যখন জানতে পারল সে সাথে সাথে নিষেধ করে দেয়। বলে,
–“পড়ালেখা অইলো মগজের বোঝা। কাম করমু কহন আর স্কুলে স্যারগো বেতের বারি খামু কহন? পড়ার চাইতে কামলা দেওয়া আছান(সহজ)।”
তার ভাষ্যমতে পড়াশোনা ছাড়াই যদি সব পাই, তাহলে আলাদা করে পড়াশোনার কি দরকার? মশিউর সাহেবও আর ওকে কোনো কিছু নিয়ে জোর করলেন না। সোফিয়া খানমের কাজ হলেই হয়। তিনি এতকিছু ঘাটেননি কখনো।
কিন্তু কামরুল এখন বেলতুলির প্রধান বার্তা-বাহক হয়ে গেছে। তার অপর নাম কামরুল দূত। এলাকার চিপা-চাপা, এ বাড়ি সে বাড়ির সব খবর তার পেটে থাকে। তবে তার এক বাড়ির কথা আরেক বাড়িতে লাগানোর স্বভাব নেই। সে সর্বোচ্চ সোফিয়া খানমের বার্তা আরেক বাড়ি পৌঁছায়, আর যদি কেউ সোফিয়া খানমকে কিছু বলতে চায় তবে তার মাধ্যমে বার্তা পাঠায়।
আজকে মুন্সী বাড়ির পরিবেশ গরম। গরম অবশ্য গতকাল থেকেই। সোফিয়া খানম খুব রেগে আছেন নিবিড়ের অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো নিয়ে। এ নিয়ে মা-ছেলের মাঝে দুই দফা লেগেও গেছে। আজও নাস্তার আগে আগে শুরু হয়ে গেছে।
–“এই না বলেছিল বিসিএস ক্যাডার? তো এখন দোকানের মালিক হলো কি করে? আর যাই হোক, ওরা ওদের মেয়েকে যেখানে খুশি বিয়ে দিক। তোর কি দরকার ছিল মাঝে দিয়ে বাম হাত ঢুকানোর? ভালো-মন্দ দিয়ে আমাদের তো কোনো কাজ নেই।”
মশিউর সাহেব সবে বাইরে থেকে হেঁটে এসেছেন। ছেলেও তার সাথেই বেরিয়েছিল, কিন্তু সে এখনো ফিরেনি। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর একই বিষয়ে ঘ্যানঘ্যান শুনে তিনি বিরক্ত হলেন।
–“তোমার এই ঘ্যানঘ্যান থামাবে? নাকি আবার বেরিয়ে যাব?”
–“হ্যাঁ, পারেন তো শুধু হুমকি দিতে! আপনাদের বাপ-ছেলের ব্যাপারে কিছু বলার আমি কে?”
–“তুমি অবশ্যই বলবে, তবে অযৌক্তিক কিছু নয়। আরেক বাড়ির মেয়ের খারাপ চাওয়া ঠিক না।”
সোফিয়া খানম বেশ ক্ষেপে গেলেন এবার। সে কখন আবার রিমঝিমের খারাপ চাইল? সে শুধু চাচ্ছে না তার ঘরের পুরুষরা আরেক বাড়ির মেয়ের ব্যাপারে নাক গলাক। এছাড়া নিবিড়ের জন্য পাত্রীও ঠিক করা আছে। এসব শুনলে লোকে কী বলবে?
–“কী বললেন? আমি খারাপ চাই?”
মশিউর সাহেব কথা বাড়াতে চাইলেন না। মহিলা মানুষের সাথে কথা বাড়ানো মানে নিজের সময় বরবাদ করা। ওই সময়টা কাককে দেখে কাটালেও ভালো। তাই তিনি আঙিনার ইজি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
–“চা করে দাও।”
সোফিয়া খানম ফুঁসতে ফুঁসতে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
মৌনো বাসে উঠতেই শেইনার পাশে সিট পেল। শেইনাও একই বাসে স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েটা বেশ সুন্দরী। স্কুল ইউনিফর্ম পরা, দু’কাঁধে দুই বেণী, ব্যাগটা তার কোলে। মৌনো তার পাশে বসতেই শেইনা মুচকি হেসে সালাম দিল।
–“মৌনো আপু।”
–“একা যাও?”
–“হ্যাঁ, আম্মা বলেছে একা চলাফেরা শিখতে। তবুও কামরুল ভাই বাসে উঠিয়ে দেয়।”
মৌনোর হঠাৎ গতকালকের কথা মনে পড়ে যায়। সে দেখেছিল নিবিড় তাকে বকছিল। মৌনো বলল,
–“গতকাল দেখলাম, ছাদে নিবিড় ভাই তোমাকে বকছে। কিছু হয়েছে?”
বকার কথা শুনে শেইনার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিমিষেই মিইয়ে হয়ে গেল। মুখ ছোটো করে বলল,
–“আর বোলো না, ভাইয়া সবসময় কারণে-অকারণে বকাবকি ছাড়া আর কি পারে?”
–“কেন?”
–“আরে, গতকাল ছাদে আমি কাপড় তুলিনি, গাছে পানি দিচ্ছিলাম। কিছু গাছের মাটি ঠিক করতে গিয়ে শুকনো মাটি হাতে লেগেছিল। সেই অপরিচ্ছন্ন হাত নিয়ে পরিষ্কার কাপড়ে কেন ছুঁয়েছি সে নিয়ে বকাঝকা। বলো তো, এগুলা বকার কোনো কারণ?”
–“নিবিড় ভাই একদমই বদলায়নি।”
–“বদলিয়েছে। যে আগে আট-নয়টার আগে ঘুম থেকে উঠত সে সে এখন কাক ভোরে উঠে বসে থাকে। নিজে তো উঠেই আমাকেও টেনে ওঠায়, ফ্যান বন্ধ করে দেয়। নামাজ শেষ করে ঘুমাতেও দেয় না। ঘুমালেই বলে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিবে। কি যেন বলে, ও হ্যাঁ ওয়ার্কআউট! সেটাও ভাইয়া রোজ করে। আর সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হচ্ছে ‘ডিসিপ্লিন’।”
–“ডিসিপ্লিন?”
–“হুঁ, ভাইয়া এখন ডিসিপ্লিন ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। তার এই নিত্য নিয়ম আমার জীবন পুড়ে ছাঁই করে দিচ্ছে।”
–“তোমাকে ওয়ার্কআউট করতে বলে?”
–“না, তবে পড়তে বসিয়ে দেয়।”
শেইনা আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু তার স্কুল চলে আসে। মৌনো তাকে সান্ত্বনা দেয়,
–“পাগলের কথায় কান দিতে নেই। তুমি গিয়ে মন দিয়ে ক্লাস করো।”
শেইনা চলে গেল। মৌনো একাকী বাসে বসে ভাবছে পূর্বের নিবিড়ের কথা। সেই নিবিড়ের স্বভাব ছিল ভিন্ন। তার ঘর অগোছালো, প্রায়ই জামা-কাপড় নষ্ট করে বাড়ি ফিরত। খুব অপরিচ্ছন্ন আর দেমাগী ছিল সে। অবশ্য এখনো দেমাগী আছে, শুধু বদলিয়েছে তার অপরিচ্ছন্ন স্বভাব। এখন নাকি পরিচ্ছন্নতার ভূত চেপেছে মাথায়। মেডিক্যালের ভাষায় এটাকে একটা রোগ বলে। শুধু রোগের নামটাই সে ভুলে গিয়েভহে। তবে মৌনো নিজের পছন্দ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একদমই পছন্দ করে না। একজন মানুষের তো নিজস্ব পছন্দের স্বাধীনতা থাকতেই পারে। মৌনো নাক কুঁচকে আপনমনে আওড়াল,
–“ডিসিপ্লিনের গুষ্ঠিতে কিল।”
সে ভার্সিটিতে এসে দেখল হাফসা অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করছে। মৌনোকে দেখতেই ছুটে এলো। কম্পিত হাতের চিঠিটা দেখিয়ে বলল,
–“বল তো কে দিয়েছে এটা?”
মৌনো চট করেই ধরতে পারে না।
–“কে?”
–“আ..আশিক!”
মৌনো দেখল হাফসা লাজে লাল হয়ে গেছে। এর মানে কয়েকদিনের মধ্যেই হাফসা নিবিড়কে ভুলে গিয়েছে? বাহ কি উন্নতি! হাফসা কাঁপা গলায় আওড়ায়,
–“আ..আশিক আমাকে প্রেমপত্র পাঠিয়েছে মৌন, আমাকে!”
মৌনো হাই তুলে বলল,
–“তো?”
মৌনোর মধ্যে কোনোপ্রকার সিরিয়াসনেস দেখা গেল না। হাফসা এতক্ষণ পেটে যা জমিয়ে রেখেছিল সব ফুঁস হয়ে গেল তার অনাগ্রহে।
–“এমন দায় সারা ভাব করছিস কেন?”
–“আশিক ভালো ছেলে হলে অবশ্যই আগ্রহ পেতাম। তুইও জানিস, আমিও জানি.. ও কেমন।”
তখনই পেছন থেকে আশিক ডাকল,
–“হাফসা।”
হাফসা চমকে পিছে ফিরে তাকায়। আশিক চমৎকার হাসি দিয়ে দাঁড়ানো। হাফসা মুহূর্তেই গলে গেল, নার্ভাস হয়ে গেল। বলল,
–“জ..জি?”
আশিককে অপ্রস্তুত দেখাল, সে দুই বান্ধবীকেই দেখল। নিখুঁত ভাবে পরিস্থিতি সামলে বলল,
–“ক্লাস শেষে কোথাও বসি?”
–“জি, জি নিশ্চয়ই।”
আশিক চলে গেল। দুই ক্লাস শেষ হতেই সত্যি সত্যি হাফসা তার সাথে দেখা করতে চলে গেল। আর এই ব্রেক টাইমে মৌনো ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তবে সিঁড়ির মুখেই নিবিড়ের সাথে অনাকাঙ্খিত দেখা। মৌনো চমকে তাকায় নিবিড়ের দিকে। নিবিড়, হঠাৎ এই সময়ে? সে রূপালি রঙের টি-শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা। নিবিড় আগে থেকেই লাইট বা চোখে লাগে এমন রং পছন্দ করে না। তাই তার আলমারিতে সব গাঢ় রঙের কাপড় সংগ্রহীত। প্রতিবারের মতোই তার চুল সেট। এই চুল কখনো এক ইঞ্চিও বড়ো দেখেনি সে। মৌনো অস্ফুট স্বরে বলল,
–“আপনি?”
নিবিড় তার চোখ নামিয়ে মৌনোর দিকে তাকাল, তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। প্রতিবারের মতো খসখসে গলায় বলল,
–“কাজ থাকতে পারে না?”
মৌনোর হঠাৎ মনে পড়ল রত্নাও একই ভার্সিটিতে পড়ে। মৌনো তাই ধরে নিল।
–“ওহ হবু বউয়ের সাথে..”
নিবিড় মৌনোর কথার শেষ না শুনেই চলে যায়। মৌনো হতভম্ভ। সে দেখল নিবিড় সোজা প্রিন্সিপালের কক্ষে নক করে ঢুকে গেছে। ওহ আচ্ছা, ডিসিপ্লিন সাহেব তবে রত্নার জন্য আসেনি। মৌনো একটা জিনিস খেয়াল করেছে, নিবিড় রত্নাকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করে না। এমনও শুনেনি রত্না নিবিড় কোথাও আলাদা করে বসে কথা বলেছে। অথচ আজকাল কে না দেখা করে, ঘুরে বেড়ায়? নিবিড়ের মধ্যে আসলেই কোনো রসকষ নেই। ভেতরের কাহিনী কি, কে জানে?
ফেরার পথে মৌনো ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য এলো। তার পাশে হাফসা। হাফসা লাজুক গলায় বলল,
–“উনি বলেছে উনি মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানো ছেড়ে দিয়েছে। আমিই নাকি তার পছন্দ এখন।”
মৌনো কিছু না বলে ঝালমুড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“মামা, পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি দিন তো।”
তখনই কোত্থেকে জাবির এসে হাজির হয়। সাথে রিপন। জাবির বলল,
–“যা চায় দেন। ট্যাকা আমি দিমু। ম্যাডামের থেইক্কা টেকা নিবেন না।”
মৌনো ঘাবড়ে গেল জাবিরকে এখানে দেখে। মৌনো হাফসার হাত ধরে বলল,
–“আজ ঝালমুড়ি খাব না, হাফসা চল।”
মৌনো চলে যেতে নিলে জাবির পিছু ডাকল,
–“এমনে চলে যাইতেছ কেন পরি? কেমন আছি জিগাইবা না? কতদিন পরে তোমার জাবিররে দেখতেছ।”
মৌনো একটুও দাঁড়াল না। হাফসার হাত ধরে টেনে রিকশায় উঠে গেল। জাবির হাসল মৌনোর চলে যাওয়া দেখে, তবে সে পিছু নিল না। জাবির বলল,
–“ম্যাডাম গেছে গা। যাক, আমরাই খামু এহন ঝালমুড়ি। দেহি, বানান দশ ট্যাকা কইরে দুইটা।”
রিপন পাশ থেকে বলল,
–“ভাবি লজ্জা পাইছে ভাই।”
–“পাইব না ক্যা? ভয়, লজ্জা পায় দেইক্ষাই তো জাবির ওরে পছন্দ করছে। ওর ভয়টা দেখলেও আমার ম্যালা ভালো লাগে রে, রিপন।”
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~
বিঃদ্রঃ রেসপন্স কিন্তু কমে যাচ্ছে। যারা পড়বেন সবাই রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। আর কেমন লেগেছে তা ধুমাইয়া কমেন্ট করে জানান। আপনাদের কমেন্টগুলা এত আদর আদর লাগে।❤️
আর হ্যাঁ, আমার নতুন বই “প্রিয় মাহাদ” অর্ডার করেছেন তো?
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ৭
-
বেলতুলি পর্ব ১১
-
বেলতুলি পর্ব ৯
-
বেলতুলি পর্ব ৫
-
বেলতুলি পর্ব ১
-
বেলতুলি গল্পের লিংক
-
বেলতুলি পর্ব ১৩
-
বেলতুলি পর্ব ৩
-
বেলতুলি পর্ব ১৫
-
বেলতুলি পর্ব ১০