বেলতুলি – [১৩]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
সদর হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ড, কেবিনই পুরাতন। দেখলেই বোঝা যায় অবহেলায় রয়েছে, বহুদিন মেরামতের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। রিমঝিমও এরকম এক কেবিন পেয়েছে। বেশ পুরাতন এক কেবিন। দেয়ালের রং জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে, কক্ষে থাকা জানালাটাও প্রায় ভঙ্গুর। যখন তখন ঝড় নামলে জানালার লোহার পাট লাগানোটা দুষ্কর হয়ে যাবে। আবার জানালা না খুললেও ঘরটা কেমন গুমোট আঁধারে নিমজ্জিত থাকে, আলো আসে না। সহজ ভাষায় ভূতুড়ে ঘরের চেয়ে কম লাগে না। মাথার ওপরের পুরাতন ফ্যানটা ঘটঘট শব্দে চলছে। মৌনো তার জায়গায় থাকলে এক ঘণ্টাতেই মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকত। সে আবার চরম অধৈর্য, ছোটো থেকে ছোটো বিষয়তেও বেশ গড়িমসি। সেদিক থেকে রিমঝিম আবার ব্যতিক্রম। সে সব পরিস্থিতিতেই নিজেকে সামলে, মানিয়ে নিতে জানে। তবে রোগী দেখলে সে হয় ফ্যান বন্ধ করে দেয় আর নয়তো অন্য কেবিনে ব্যবস্থা করে। রোগী আসে সুস্থ হতে, এই ফ্যানের শব্দে আরও অসুস্থ করে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
রিমঝিম আজ হাসপাতাল এসেই কাজিকে চা করে দিতে বলেছে। আজ কেন যেন তীব্র রোদে মাথা ধরেছে। তার কেবিন আগে থেকেই গোছানো, জানালাটাও খুলে দেয়া। প্রতিবারই ডাক্তার আসার আগে কর্মচারীরা ধুলো, ময়লা ঝেড়ে দেয়। সে অতিরিক্ত বলতে শুধু সুইচ চেপে ফ্যানটাই অন করল। পরপর খড়খড়ে কাঠের চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারে ঘুনে খেয়েছে কিছু জায়গায়। তবে কতৃপক্ষ তাকে কথা দিয়েছেন তারা দ্রুতই আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিবেন।
রিমঝিম বরাবরই সরকারি হাসপাতাল অপছন্দ করে। এখানের কোনোকিছুই সঠিক পরিমাণে হয় না। ভালো কিছু তো দেখাই যায় না, ভালোর চাইতে খারাপের মাত্রাটাই বেশি। সরকার দেয়াল তুলে দিয়েছে, শেষ! এটুকুই যেন সবার দায়বদ্ধতা। মেরামত, পরিচ্ছন্নতা কিছুই গুরুত্ব দেওয়া হয় না — অন্তত না বলা অবধি এরা এদের দায়িত্ব ভুলে যায়।
সবে রিমঝিমের চা এসেছে। সে মনোযোগ দিয়ে চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠা দেখছে। এমন সময়ই দরজায় কড়াঘাত পড়ল। রিমঝিম নড়েচড়ে চাইল,
–“আসুন।”
পরপর দরজা ঠেলে প্রবেশ করল প্রণভ। এই সকালে প্রণভকে দেখে সে চমকাল বটে। প্রণভের হাতে সম্ভবত কোনো টেস্টের রিপোর্ট। রিমঝিম বলল,
–“আরে প্রণভ ভাইয়া যে।”
–“হুঁ, নানুর বাকি টেস্টের রিপোর্টগুলোই নিতে আসলাম। ডাক্তার বিকালে আসবে। যেহেতু তুমি আছ, ভাবলাম তোমাকে আগে দেখিয়ে যাই।”
রিমঝিম মাথা নেড়ে হাত বাড়িয়ে নিল রিপোর্টগুলো। রিপোর্টে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল,
–“ভালো করেছেন। আমার শিফট কয়েক মাস সকালেই হবে সম্ভবত।”
প্রণভ মনোযোগী নজরে রিমঝিমকে পরখ করে বলল,
–“তোমার মা মিষ্টি পাঠিয়েছে আমাদের বাড়ি, শুনলাম বিয়ের ডেট দিবে?”
–“জি, বড়োদের তেমনই ইচ্ছে।”
–“কেন? বড়োদের ইচ্ছে কেন? তুমি খুশি নও?”
–“অখুশি নই।”
প্রণভ চুপসে গেল। রিমঝিম রিপোর্ট দেখে বলল,
–“সম্ভবত নানুর নিউমোনিয়ার সমস্যা আছে, সাথে কিডনিতেও সমস্যা। ডায়েবিটিস আছে?”
–“হুঁ।”
–“সাবধানে রাখবেন নানুকে। আমি জানি ফজি নানু ওষুধ খেতে চান না, তবুও জোর করে হলেও খাওয়াবেন।”
প্রণভ মাথা নাড়ায়। রিমঝিম ফাইল ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
–“শুনলাম চাকরি হয়েছে আপনার?”
প্রণভ আলতো হেসে বলল,
–“ইন্টারভিউ দিয়েছি, তবে কনফার্মেশন কল আসেনি। কল আসেনি যেহেতু, এখানেও আমার হয়নি।”
–“আশাহত হচ্ছেন কেন?”
–“আশাহত না, এটাই ধ্রুব সত্য! কেই বা আজকাল সিমের টাকা খরচ করে জানাবে ‘তোমার চাকরি হয়নি।’ তারা তো তাদেরই কল দিবে, যাদের নিয়ে তাদের সিমের টাকা পুষবে।”
–“একটা কলেও বুঝি এত ভাবাভাবি হয়?”
প্রণভ আলতো হেসে বলল,
–“বড়ো মনের মানুষরা ভাবে না, ছোটোলোকেরাই এসব চিন্তা করে।”
প্রণভ উঠতে নিল, রিমঝিম তার নিজের চা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“চা খেয়ে যান ভাইয়া।”
প্রণভ শুকনো করে হাসল। সে আর বসল না।
–“ওটা তোমার চা, ঝিম। অন্যের ভাগে হস্তক্ষেপ করার স্বভাব আমার নেই।”
–“আমি পড়ে নাহয় আমার জন্য আনিয়ে নিতাম..”
–“ভেবো না, আমি যাই। বিয়ের আগ অবধি আশা রাখছি চায়ের দাওয়াত অক্ষত থাকবে।”
রিমঝিম হেসে বলল,
–“জি জি নিশ্চয়ই। সময় করে আসবেন বাড়ি, সুযোগ থাকলে চা করে খাওয়াব।”
নিবিড় চলে গিয়েও বিশেষ লাভ হলো না অবশ্য। সোফিয়া খানম নিজ জেদে অনড়। পরেরদিন সে ঠিক সময়েই স্বামীকে নিয়ে রত্নার বাড়ি চলে গিয়েছেন। রত্না ভেবেছিল নিবিড় আসবে, তাইতো সে একদম পার্লার থেকেই সেজে এসেছিল। যদিও ওখানেও গণ্ডগোল হয়। রত্না যেমন সাজতে চেয়েছিল তা তো সাজিয়ে দেয়-ইনি উলটো আরও তাকে ভূতনি করে দিয়েছে। বাড়ি এসে সে যখনই মুখ ধুতে যাবে তখনই সোফিয়া খানম এবং মশিউর সাহেব এসে হাজির, সাথে তাদের মেয়ে শেইনাও এসেছে। রত্না লজ্জায়, সম্মানহানিতে একদম লাল হয়ে গেছে। শেইনা তাকে দেখে মুখ কুঁচকে ফেলল। আপনমনে ভাবে,
–“ভালোই করেছে ভাইয়া পালিয়েছে। এমন পেত্নি বউ আবার আমার নায়ক ভাইয়ার হয় নাকি?”
কিন্তু সোফিয়া খানম মিষ্টি হেসে বলল,
–“মাশাআল্লাহ, বউমাকে দারুণ লাগছে।”
শেইনা জানে, তার মা এমন কথা বলছে নিবিড়ের ওপর অন্ধ রাগের কারণেই। এখন তিনি অনেক ঝালও হাসি-মুখে খেতে পারবেন। মুখ লাল হবে, চোখের জল নাকের জল এক হবে তাও তিনি পানি স্পর্শ করবেন না। বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক সেরকমই।
রত্না যখন দেখল তার হবু শাশুড়ি মিষ্টি কথা বলছেন, নিবিড় আসেনি— তখন সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অথচ নিবিড় আসেনি কেন তা খেয়ালেই এলো না নিজের চিন্তায়।
সোফিয়া খানম যা-তা বুঝিয়ে শান্ত করেছেন রত্নার বাবা-মাকে। তারাও সোফিয়া খানমের চমৎকার কথা বলার ভঙ্গিতে মজে যান। প্রশ্ন ছাড়াই আয়োজন চলল, সোফিয়াই নিবিড়ের নামের আংটিটা রত্নার অনামিকায় জড়িয়ে দিলেন। রত্নার কেমন যেন অদ্ভুত অনুভব হলো। সে এখন লেফটেন্যান্টের বাগদত্তা! এলাকায় জানাজানি হলে মাটিতে তার পা-ই পড়তে চাইবে না। রত্না আড়ালে কুটিল করে হাসল। আনন্দে এতই বিভোর যে নিবিড়ের অনুপস্থিতি তাকে অস্থির করল না। নিবিড় তো যেতই, সে যে তার বউ হতে পারছে— এই বা কম কিসের?
নিবিড়ের বাগদানের মিষ্টি সর্বপ্রথম মৌনদের বাড়িই এলো। দরজা খুলল মৌনো নিজেই। কামরুলের হাতে মিষ্টি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
–“মিষ্টি কিসের?”
কামরুল ভেতরে আসতে আসতে বলল,
–“আইজকা রত্না ভাবীরে আংটি পরাই আইছে, তারই মিষ্টি।”
মৌনো থমকে গেল কেন যেন। আজ সারাদিন নিবিড়কে দেখেনি। বাড়ি বসে বাগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল বুঝি? মৌনো মুখ গম্ভীর করেই মিষ্টির ট্রেটা হাতে নিয়ে নিল। কামরুল মৌনোর ভাবসাব বুঝল না। হঠাৎ মুখের এমন পরিবর্তন কেন? রাজিয়া শেখও আশেপাশে নেই। সোফিয়া খানমের আদেশ মতো তার কানের কাছে গিয়ে বলা লাগবে তো নিবিড়ের বিয়ে পাকা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সে কোথায়?
–“কাকে খুঁজছিস? আম্মা নামাজ পড়ে।”
কামরুল হম্বিতম্বি ছাড়াই বলল,
–“তুমারে দারুণ একটা খবর দিমুনি আফা?”
মৌনো দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কামরুল তো মূল কথা বলেই দিয়েছে। আর কি বলবে?
–“বল।”
–“কালকে রাইতে রত্না ভাবীকে বিয়া করার ডরে নিবিড় ভাইয়ে ভাগছে। এডা কিন্তু কেউ জানে না এহনো, তুমারে কইলাম। তুমি কাউরে কইয়ো না যে কামরুলে কইছে।”
মৌনো বিস্ময়ে বিমূঢ়। নিবিড় গতকাল রাতেই চলে গেছে? আর সে কিনা ভাবছে নিবিড় তার এঙ্গেজমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত?
–“পালাবে কেন?”
–“আরে, ভাইরে তো ধইরে বিয়া দিতাছে। আমাগো মেমসাব এমনই। খিটখিটে মেজাজের।”
রাজিয়া শেখ আসার আগেই কামরুল বলল,
–“আমি যাই, কিছু লাগলে কইবা।”
রত্নার আজ রাতে খুশির অন্ত নেই। সে নিবিড়ের সাথে যোগাযোগের জন্য নাম্বার পেয়েছে। সোফিয়া খানম নিজেই তাকে দিয়েছেন। রত্না ডায়াল করল নাম্বারে। কিন্তু কী আশ্চর্য, মোবাইল বন্ধ বলছে। সে হতাশ হলো। সে তো জানেও না নিবিড় কোন সময়ে ফ্রি থাকে। কোথায় ভেবেছে হবু বরের সাথে রাত জেগে প্রেম করবে, সেখানে তার সাথে ভুল করে ক’বার কথা হয়েছে তাও জানে না। বিরক্ত হয় রত্না, কেন নিবিড় ডিফেন্সে গেল? এই চাকরি মানেই তো বিরহ, ধ্যাত!
মৌনো সবে বাস থেকে নেমেছে। তখনই কোত্থেকে জাবির এসে তার সম্মুখে দাঁড়ায়। মৌনো ভড়কে গিয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে যায়। জাবির তার পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসল। আজ কেন যেন পান খেতে ইচ্ছে হয়েছিল, তাই সে পান খেয়ে শখ পূরণ করেছে। তার শখের অন্ত নেই। তার ধারণা এই ছোটো জীবনে কোনো শখকেই হেলায় ফেলা ঠিক নয়। ওটা আরও নিজের প্রতি জুলুম।
–“কি জানেমান, আজকাল খুব দেখতেছি আমার থেইক্কা পালাই পালাই করো। এত পালাইলে চলে? তুমারে দেখতেই তো পারি না।”
পরপর সে বাসের হেল্পারের ওপর চেঁচাল,
–“ওই শালা, তুই তোর ভাবীর থেইক্কা ট্যাকা নিছস? ফেরত দে ওরে! আমি ভাড়া দিমু।”
হেল্পার জাবিরকে চিনে। সে কিছুটা ভয় পেয়েই ভাড়া ফিরিয়ে দিতে চাইল,
–“আফা নেন।”
মৌনো বিরক্ত হলো জাবিরের উপর। তবুও বিরক্তি প্রকাশ না করে বলল,
–“রাখুন ভাড়া, ফেরত দেওয়ার কিছু নেই।”
–“ঠিক আছে, তোর ভাবী কইছে দেইখা। থাক আর ফিরত দিস না। যা বাস ছাড়।”
বাস চলে গেল। কিন্তু জাবির তার পিছু ছাড়ল না। জাবিরের ডান হাতে এক পট্টি। জাবির পিছে আসতে আসতে বলল,
–“হাতে ব্যথা পাইছি।জিগাইতা না কেমনে পাইছি?
মৌনো তা এড়িয়ে বলল,
–“পিছু নিবেন না প্লিজ।”
জাবির থেমে গেল। কিন্তু তার সাথের রিপন আর মঞ্জু থামল না। জাবির ওদের বিচ্ছিরি গা(১)লি দিয়ে বলল,
–“এই শা** শুনোস নাই তোগো ভাবী কি কইছে? ও যা কইব তাই অইব। তোরা যাস ক্যা?”
সত্যি সত্যিই জাবির গলিতে আর পিছু নিল না। মৌনো একমনে হাঁটতে হাঁটতে নিবিড়ের কথা ভাবছে। নিবিড়ের সাথে তার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। কিন্তু সে কখনোই তাকে অসম্মান করেনি, খারাপ নজরে তাকায়নি, উলটো সুরক্ষা দিয়েছে। জাবিরের সামনে যেমন তার অস্বস্তি হয়, নিবিড়ের সামনে মোটেও তা হয় না। এটাই বুঝি পুরুষে পুরুষে ভেদাভেদ, পার্থক্য ?
নিবিড় যেতেই জাবিরের উৎপাত যেন আবারও বেড়ে গেছে এলাকায়। আগে কিছুটা দমে থেকেছিল, কিন্তু এখন যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে। কেউ শক্ত গলায় তাকে বারণ করার নেই।
মৌনো মেঘলা আকাশের দিকে তাকাল। তার মনে পড়ে গেল পুরান ঢাকার কাচ্চির দিনটা। কাচ্চি খাওয়া, নিবিড়ের রিকশা ঠিক করে দেয়া, ওড়না গুছিয়ে দেয়া। অথচ আজ দেখো, মানুষটা তার দৃষ্টি সীমানার বাইরে। যেই গলিতে নিবিড়ের ভয় থাকত, এই বুঝি লোকটাকে দেখবে আর চরম ধমক খাবে। অথচ আজ সেই গলিই আজ শান্ত, নীরব। কী যেন একটা নেই, নেই অনুভূতি।মৌনো নিজের অজান্তেই ভাবল,
–“চলে যেতে বলেছি বলে এত দ্রুতই চলে যাবেন, লেফটেন্যান্ট সাহেব?”
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে—
[যারা পড়ছেন, তারা সাড়া দিবেন যেন অন্যান্য পাঠকদের ফিডেও পর্বটি পৌঁছাতে পারে, অগ্রীম কৃতজ্ঞতা❤️]
বিঃদ্রঃ রিচেক দেয়া হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর নজরে দেখবেন। আগামী পর্ব আসবে রবিবার। সুন্দর সুন্দর মন্তব্যের অপেক্ষায়।
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ২
-
বেলতুলি পর্ব ৩
-
বেলতুলি পর্ব ১৩
-
বেলতুলি পর্ব ৬
-
বেলতুলি পর্ব ৫
-
বেলতুলি পর্ব ১১
-
বেলতুলি পর্ব ১৪
-
বেলতুলি পর্ব ৪
-
বেলতুলি পর্ব ১০
-
বেলতুলি পর্ব ৭