নির্লজ্জ_ভালোবাসা
লেখিকাসুমিচোধুরী
পর্ব ৫৫ (❌কপি করা নিষিদ্ধ❌)
আয়ানের এমন নির্লজ্জ কথা শুনে তনুজা খান মুহূর্তের জন্য পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হিমি খান দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় পরিস্থিতি বুঝতে পেরে অসহায় গলায় তনুজা খানের উদ্দেশে বললেন।
“বুবু, ছেলেটা আমার প্রচণ্ড রেগে আছে, এখন ও নিজের মধ্যে নেই। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, আমাদের মাঝখানে না যাওয়াই ভালো হবে। তুমি চিন্তা করো না, আয়ান তিথির কোনো ক্ষতি করবে না। ও আগের মতো নেই, এখন আয়ানের চোখে আমি তিথির জন্য গভীর ভালোবাসা আর অধিকার দেখতে পাই। থাকতে দাও ওদের ওদের মতো।”
তনুজা খান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন। তারপর দুজনেই ভারী মনে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন।
এদিকে ঘরের ভেতরে পরিস্থিতি আগুনের মতো তপ্ত। আয়ান তিথিকে লোহার মতো শক্ত হাতের বাঁধনে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। তিথি খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফট করতে করতে তীক্ষ্ণ গলায় বলল।
“আয়ান, ভালোই ভালোই বলছি আমাকে ছাড়ো! তুমি একদম আমাকে ছুঁবে না।
আয়ান তিথির মুখের একদম কাছে মুখ এনে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে আরও শক্ত করে চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
“তোকে আমি ছুঁব না? এইটাই বলতে চাইছিস তো?”
তিথি জেদের বশবর্তী হয়ে মাথা নেড়ে চিৎকার করে বলল।
“হ্যাঁ! একশ বার হ্যাঁ!”
মুহূর্তেই আয়ানের ঠোঁটের কোণে এক ভয়ংকর কামুক আর বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। সে হিসহিস করে বলল।
“ওকে, ছুঁব না।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই আয়ান তিথিকে আবার পাঁজাকোলা করে তুলে এক ঝটকায় বিছানার মাঝখানে ছুড়ে মারল। অপ্রস্তুত তিথি বিছানায় আছড়ে পড়ে নিজেকে সামলানোর আগেই দেখল আয়ান ধীরস্থিরভাবে নিজের শার্টের বোতামগুলো একটা একটা করে খুলছে। তার চোখের দৃষ্টিতে আজ এক আদিম নেশা। সে তিথির দিকে এগোতে এগোতে নেশাগ্রস্ত গলায় বলল।
“তোকে স্পর্শ করব না’তাই না। শুনে রাখ তুই যতো বলবি আমাকে ছুঁবে না আমি তার থেকেও তোকে গভীর ভাবে ছুঁবো। এতদিন নিজেকে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করেছিলাম শুধু তোর পরীক্ষার কথা ভেবে। কিন্তু আজ তোর অবাধ্যতা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেলফ অ্যানিমোর,। ইটস টাইম টু মেক ইউ মাইন ইন এভরি পসিবল ওয়ে। ইউ আর গোয়িং টু ফেইল ইন মাই ইনটক্সিকেটিং লাভ টুনাইট।”
তিথি বিছানায় পেছনে পিছাতে পিছাতে আতঙ্কিত গলায় বলল।
“আয়ান, একদম ভালো হবে না কিন্তু! এগোবে না আমার দিকে! আমি কিন্তু চিৎকার করে সবাইকে জড়ো করব!”
আয়ান শার্টটা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে মারল। তারপর বিছানায় হাঁটু গেড়ে বসে এক টানে তিথিকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে আনল। তার পেশিবহুল শরীরের তাপে তিথি যেন গলে যাচ্ছে। আয়ান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল।
“মার চিৎকার! সবাই জানুক আয়ান কতটা শক্তিশালী পুরুষ, যার আদরের চোটে তার বউ চিৎকার করতে বাধ্য হচ্ছে।”
তিথি চরম রাগে আর অপমানে আয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আয়ান পাহাড়ের মতো অটল। সে এক হাত দিয়ে তিথির দুহাত মাথার ওপরে লক করে দিল এবং অন্য হাতে তার চিবুক উঁচিয়ে ধরে সরাসরি ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। কোনো কোমলতা নয়, বরং এক প্রচণ্ড জেদ আর অধিকারের লড়াইয়ে সে তিথির ঠোঁটে কামড়ের পর কামড় বসাতে লাগল। তিথির গোঙানি আর বাধা দেওয়ার চেষ্টা যেন আয়ানের ভেতরের সেই আদিম নেশাকে আরও উসকে দিল।
বেশ অনেকটা সময় পর তিথি শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এল। ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে পেঁচানো, আর সারা শরীরে এক অদ্ভুত ক্লান্তি। কেন তাকে এই অসময়ে শাওয়ার নিতে হলো, তা তার রক্তিম ঠোঁট আর গলার কাছে থাকা কালচে দাগগুলোই চিৎকার করে বলে দিচ্ছে। আয়ানের সেই উন্মত্ত আ’দর আর অধিকারের চিহ্নগুলো যেন এখনো তার শরীরে আগুনের মতো জ্বলছে।
বিছানার দিকে তাকাতেই তিথির পিত্তি জ্বলে গেল। আয়ান একদম আয়েশ করে বিছানা দখল করে উপুড় হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। চওড়া উন্মুক্ত পিঠটা অনাবৃত, পরনে শুধু প্যান্ট। শান্ত মুখে সে এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যেন মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজটা সে আজই করে ফেলেছে।
আয়ানের এই নিশ্চিন্তে ঘুমানোর ভঙ্গি দেখে তিথির সারা শরীর রাগে রি রি করে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে সে বিড়বিড় করল।
“কী অসভ্য আর স্বার্থপর একটা মানুষ! কিছুক্ষণ আগে নিজের আদিম নেশা মেটাতে আমাকে নিয়ে কীভাবে নাজেহাল করল, শরীরটাকে একদম অবশ করে দিয়েছে রাক্ষসটা আর এখন নিজে কেমন আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে!”
তিথি কিছুক্ষণ গাল ফুলিয়ে আয়ানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাগ আর অভিমানের মাঝে হঠাৎ তার চোখের মণি দুটো চিকচিক করে উঠল। মস্তিষ্কের কোনো এক কোণে একটা দারুণ শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল তার। ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা আর দুষ্টুমিভরা হাসি ফুটিয়ে সে ফিসফিস করে বলল।
“দাঁড়াও মিস্টার দানব, অনেক তো বীরত্ব দেখালে! এবার আমার পালা। এমন মজা দেখাব যে জীবনেও ভুলবে না।”
তিথি পা টিপে টিপে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। তার মাথায় তখন প্রতিশোধের নেশা টগবগ করে ফুটছে।তিথি আলমারি থেকে চিরুনি, কড়া লাল রঙের লিপস্টিক, গাঢ় কাজল আর মেকআপ বক্সটা বের করে আনল। আয়ানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর হতে পারে না। সে পা টিপে টিপে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে বিছানার কাছে এল।
প্রথমে সে খুব সাবধানে আয়ানের সিল্কি চুলগুলো চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দুই ভাগে ভাগ করল। আয়ান ঘুমের ঘোরেই একটু নড়েচড়ে ওঠল।আয়ান ঘুমের ঘোরে একটু নড়েচড়ে উঠতেই তিথির হার্টবিট যেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়! সে স্থির হয়ে রইল। কিন্তু না, আয়ান আজ এতটাই ক্লান্ত যে সে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। তিথি সুযোগ বুঝে ছোট ছোট দুটো রাবার ব্যান্ড দিয়ে আয়ানের মাথার দুই পাশে বাচ্চাদের মতো দুটো ঝুঁটি করে দিল। উফ! আয়ানের ওই গম্ভীর চেহারার সাথে এই পিচ্চি মেয়েদের মতো ঝুঁটি দেখে তিথির তখনই হাসি পাচ্ছে।
কিন্তু খেলা তো কেবল শুরু! তিথি এবার মেকআপ ব্রাশ নিয়ে আয়ানের ফরসা গালে কড়া গোলাপি রঙের ব্ল্যাশন ঘষে দিল। তারপর যত্ন করে আয়ানের পাতলা ঠোঁটে টকটকে লাল কড়া করে লিপস্টিক মাখিয়ে দিল। সবশেষে কাজল নিয়ে আয়ানের কপালে বাম দিকে বিশাল বড় একটা ‘নজর ফোঁটা’ এঁকে দিল যাতে এই ‘পরমা সুন্দরী’র নজর না লাগে!
কাজ শেষ করে তিথি যখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে আয়ানের দিকে তাকাল, তখন আয়ানকে দেখতে একদম মেলায় আসা বিদঘুটে কোনো জোকারের মতো লাগছে। যে কেউ এই অবস্থায় আয়ানকে দেখলে হাসতে হাসতে নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবে।তিথি আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তার ভেতর থেকে একরাশ হাসি খিলখিল করে বেরিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু সে দ্রুত দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল। হাসিতে তার পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম,শরীর কাঁপছে, কিন্তু শব্দ করা যাবে না।
তিথি আয়ানের ওই অদ্ভুত জোকার সাজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কুটিল এক হাসি দিল। তার ভেতরের সব রাগ যেন এই এক দৃশ্যেই জল হয়ে গেছে। সে কোমরে হাত দিয়ে বিজয়ের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এখন বুঝবা চান্দু, আমি তিথি কেমন! হুহ! আমার সাথে পাঙ্গা নিতে আসো? আমাকে ওমন নাজেহাল করার ফল এবার হাতেনাতে ভোগ করো। ঘুম থেকে উঠে যখন আয়নায় নিজের এই ‘হুরপরী’ রূপ দেখবা, তখন বুঝবা কার কপালে আজ শনির দশা আছে!”
তিথি আয়ানের ওই টকটকে লাল ঠোঁট আর মাথার দুই পাশের ঝুঁটি দুটোর দিকে তাকিয়ে আবার হাসিতে ফেটে পড়তে চাইল, কিন্তু অনেক কষ্টে মুখ চেপে ধরে নিজেকে সামলাল। সে দ্রুত নিজের ফোনটা বের করে কয়েকটা অ্যাঙ্গেল থেকে আয়ানের এই ঐতিহাসিক রূপের ছবি তুলে নিল। মনে মনে ভাবল।
“এই ছবিগুলোই হবে আমার তুরুপের তাস। বেশি বাড়াবাড়ি করলে এগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেব, তখন বুঝবে মিস্টার আয়ান খানের ইজ্জত কোথায় যায়!”
আয়ান ঘুমের ঘোরেই হালকা একটা শব্দ করে পাশ ফিরল। তিথি ভয়ে এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে দূরে সরে গেল। কিন্তু না, আয়ান এখনো সেই গভীর নেশাতেই আচ্ছন্ন। তিথি পা টিপে টিপে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো তাকিয়ে বলে গেল,
“জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ, আজ সারা বাড়ি হাসতে হাসতে মাথায় তুলব আমি!”
রৌদ্র তাড়াতাড়ি বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাল। অনেকটা জ্যাম ছিল তাই আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল। রৌদ্র দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে দেখে তুরা নেই। অস্থির হয়ে রৌদ্র ব্যালকনিতে গিয়ে দেখল, তুরা সেখানে অভিমানী মুখে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র বুঝতে পারছে তুরার মনে এখন গভীর অভিমান জমেছে। সে পা টিপে টিপে তুরার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল এবং আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ সেই তপ্ত স্পর্শে তুরা চমকে উঠলেও কোনো প্রতিবাদ করল না,কেবল মাথা নিচু করে রইল। রৌদ্র তুরার গালের নরম ত্বকে ঠোঁট ছুঁইয়ে গাঢ় গলায় বলল।
“রাগ করেছিস? আসলে রাস্তায় অনেকটা জ্যাম ছিল রে, তাই আসতে দেরি হয়ে গেল।”
তুরা তবুও কথা বলল না, মুখ গোমরা করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। রৌদ্র এবার তুরার গালে টুস করে একটা শব্দ করে চুমু খেল। তারপর তুরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে টপ করে সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। নিজের দুই কান ধরে একদম বাচ্চা ছেলেদের মতো করুণ চোখে তাকিয়ে বলল।
“আমার বিবি জান, আমাকে মাফ করে দেন। অনেকটা সময় আপনাকে অপেক্ষা করানোর জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত। বিশ্বাস করেন জান, আমি জ্যামে একদম আটকে ছিলাম।”
রৌদ্রের মতো রাশভারী ছেলের এমন কিউট বাচ্চামো দেখে তুরা আর নিজের হাসি চেপে রাখতে পারল না। সে খিলখিল করে হেসে ফেলল। তুরার সেই হাসিতেই যেন রৌদ্রের সারা দিনের ক্লান্তি ধুয়ে গেল। রৌদ্র এখন তুরার দিকে খুব ভালো করে খেয়াল করল। পরনে তার পছন্দের রঙের শাড়ি, হাতে রেশমি চুড়ি আর জুইলারিতে তুরাকে আজ মারাত্মক মানিয়েছে। একদম অপার্থিব এক পরীর মতো লাগছে তাকে। রৌদ্র মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর, সে আচমকাই এক ঝটকায় তুরাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। তুরা অবাক হয়ে আকাশ থেকে পড়ল এবং ছটফট করে বলল।
“আরে আরে কী করছেন! কী নামান বলছি আমাকে। এইভাবে কোলে নিলেন কেন?”
রৌদ্র তুরার কানের কাছে নিজের তপ্ত মুখ নিয়ে এসে নেশাক্ত গলায় শাসন করল।
“চুপ, একদম চুপ! একটা কথাও বলবি না।”
রৌদ্র তুরাকে কোলে নিয়েই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। ড্রয়িং রুমে তখন রৌশনি খান, হিমি খান, তনুজা খান, তিথি আর আরফা আড্ডা দিচ্ছিল। রৌদ্রের কোলে তুরাকে এভাবে দেখে সবার আড্ডা যেন মাঝপথেই থেমে গেল। সবাই বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। তুরা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল এবং রৌদ্রের বুকে ছোট ছোট কিল-ঘুষি মেরে ফিসফিস করে বলল।
“আপনার কি লাজ শরম সব শেষ হয়ে গেছে? এইভাবে বড়দের সামনে কোলে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? নামান বলছি আমাকে!”
রৌশনি খান অবাক হয়ে মুখ খুলে জিজ্ঞেস করলেন।
“কী হয়েছে তুরার? ওভাবে ওকে কোলে নিয়েছিস কেন রৌদ্র?”
তুরা লজ্জায় লাল হয়ে রৌদ্রের শার্ট খামচে ধরল। কিন্তু রৌদ্র কোনো উত্তর না দিয়ে তুরাকে নিয়ে হল রুমের মাঝখানে উন্মাদনায় গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। সে সবার সামনে উচ্চস্বরে বলতে লাগল।
“তোকে কোলে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরলেও আমার বিন্দুমাত্র কোনো লজ্জা লাগবে না। কারণ আমি পুরো শহর আর সব মানুষকে জানিয়ে দিতে চাই আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছি, আমার হৃদস্পন্দনকে পেয়েছি। আমি আজ কতটা খুশি সেটা সবাই দেখুক, আজ আমার খুশি তারা প্রাণভরে দেখুক!”
তুরা লজ্জায় আর কুলিয়ে উঠতে না পেরে রৌদ্রের চওড়া বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। তনুজা খান, হিমি খান আর রৌশনি খান রৌদ্রের এই অকৃত্রিম পাগলামি দেখে মুচকি হাসলেন। আরফা পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতে লাগল।
“লে ভাই! যখন সিঙ্গেল মানুষের কেউ থাকে না, তখন আরফার এই দৃশ্য দেখে মনের কী অবস্থা হয় সেটা কেউ দেখে না! মনের মাঝে হাহাকারের ইমোজি আসলেও একটাই কথা মুখে আসে কুচ কুচ কুতা হ্যায়!”
আরফার কথা শুনে তিথি হাসিতে ফেটে পড়তে গিয়েও নিজের মুখ চেপে ধরল। সে একবার তুরা আর রৌদ্রের এই অদ্ভুত রোমান্টিক কাণ্ড দেখল, তারপর ফিসফিস করে রসিকতা করে বলল।
“লে হালুয়া! মার হাবা ঝাকানাকা! এদের কান্ড দেখে তো আমারই মাথা ঘুরছে।”
আনোয়ার খান, আরিফুল খান আর আশিক খান তিন ভাই মিলে জরুরি এক কাজ শেষ করে ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। বড়দের দেখে রৌদ্র এবার থামতে বাধ্য হলো। সে সাবধানে তুরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। তুরা লজ্জায় একদম কুঁকড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। আনোয়ার খান, আশিক খান আর আরিফুল খান ক্লান্ত শরীরে ড্রয়িং রুমের সোফায় ধপ করে বসলেন। শরীরের ক্লান্তি মেটাতে আরিফুল খান হিমি খানের উদ্দেশ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন।
“ওগো, আমাদের একটু পানি দাও তো। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে, বড্ড পানি পিপাসা পেয়েছে।”
হিমি খান দেরি না করে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। আনোয়ার খান তুরা আর রৌদ্রের এমন পরিপাটি সাজগোজ দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“কোথাও বের হচ্ছিস নাকি তোরা?”
রৌদ্র বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বিনয়ের সাথে বলল।
“হ্যাঁ বাবা, ভাবছিলাম একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসব।”
আনোয়ার খান মৃদু হেসে সায় দিয়ে বললেন।
“ওহ আচ্ছা, ঘুরে আয়।”
এরই মধ্যে হিমি খান গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলেন এবং তিন ভাই তৃপ্তি করে পানি পান করতে শুরু করলেন। ঠিক সেই চরম মুহূর্তে আয়ান গায়ে একটা টি-শার্ট গলিয়ে আয়েশ করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। আশিক খান, আনোয়ার খান আর আরিফুল খান গ্লাসে চুমুক দেওয়ার মাঝপথেই আয়ানের দিকে চোখ পড়ল। আয়ানের মুখের সেই বিচিত্র অবস্থা দেখেই মুহূর্তে তিন ভাই একসাথে মুখ থেকে মোটরের পানির তোড়ের মতো সব পানি ফিনকি দিয়ে বের করে দিলেন এবং দমবন্ধ করা অবস্থায় সমান তালে কাশতে লাগলেন।
তনুজা খান ঠান্ডা শরবতের ট্রে নিয়ে আসছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে আয়ানের দিকে চোখ পড়তেই তাঁর হাত কেঁপে উঠল। ঠাস করে ট্রে-টা মেঝেতে আছড়ে পড়ল, কিন্তু সেদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই তিনি দুই হাতে পেট চেপে ধরে হাসিতে ফেটে পড়লেন।
আরফা, তিথি, রৌদ্র আর তুরা প্রথমে কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো সিঁড়ির দিকে তাকাল। ততক্ষণে আয়ান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। আয়ানের বিচিত্র রূপ দেখে তুরা আর রৌদ্রের হাসি যেন বাঁধ ভাঙল তারা দুজনেই পাগলের মতো হাসতে শুরু করল। তিথি জানে এবার বিপদ আছে, তাই সে মুখ টিপে হাসতে হাসতে দৌড়ে গিয়ে আনোয়ার খানের পেছনে লুকাল যাতে আয়ান তাকে ধরতে না পারে। হিমি খান আর রৌশনি খান হাসতে হাসতে এতটাই বেসামাল যে, নিজেদের শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজেও হাসি থামাতে পারছেন না। আয়ান ড্রয়িং রুমের মাঝখানে আসতেই আনোয়ার খান, আশিক খান আর আরিফুল খান তিন ভাই সোফায় গড়াগড়ি খেতে লাগলেন। আরফা হাসির চোটে কথা বলতে গিয়ে বারবার তোতলাচ্ছিল। সে কোনোমতে দম নিয়ে বলল।
“ভা… ভা… ভাইয়া! একি! তুমি… তুমি কি জ্যান্ত কোনো কার্টুন নাকি অন্য কিছু? কি সে….।”
বাকিটুকু বলার আগেই আরফা হাসতে হাসতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ল এবং পেট ধরে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আয়ানের সারা মুখে তিথি মেকাপ লিপস্টিক আর কাজলের এমন নকশা করেছে যে, তাকে দেখতে ঠিক যেন একটা রাগী হনুমানের মতো লাগছে।
আয়ান সবাইকে এমন পাগলের মতো হাসতে দেখে আকাশ থেকে পড়ল। সে ভ্রু কুঁচকে সবার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল।
“কি ব্যাপার, সবাই এমন পাগলের মতো হাসছো কেন? হয়েছেটা কী শুনি?”
কিন্তু কারো মুখে কথা নেই, সবাই যেন হাসির বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। কথা বলার মতো শক্তিও কারো অবশিষ্ট নেই। তিথি তো হাসতে হাসতে আনোয়ার খানের গায়ের ওপর প্রায় পড়েই যাচ্ছে মনে হচ্ছে আগের রুমের ভয়ের সেই রেশটা এখন হাসির মাধ্যমে উশুল করছে। আয়ান এবার সত্যিই খেপে গেল। সবার এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে সে উচ্চস্বরে বলল।
“প্লিজ কেউ একজন তো মুখ খোলো! এইভাবে হাসছো কেন সেটা বলবে তো?”
রৌদ্র কোনো রকমে নিজের হাসিটা একটু থামিয়ে, দম নিয়ে ফিসফিস করে বলল।
“সমাধান চাস? বেশি কিছু করতে হবে না, শুধু নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নে।”
বলেই রৌদ্র আবারও হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ল। আয়ান রৌদ্রের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না। সে গটগট করে হেঁটে হলরুমে থাকা বিশাল আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আর নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ পড়তেই আয়ান এক লাফ দিয়ে তিন হাত পেছনে সরে গেল এবং কলিজা কাঁপানো এক বিকট চিৎকার দিয়ে বলল।
“আআআআআআআআআআআআ! ভূত! ভূত! আয়নায় ভূত দেখা যাচ্ছে!”
আয়ানের নিজের চেহারা দেখে নিজে ভয় পাওয়ার দৃশ্যটা দেখে বাড়ির অন্যদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। আনোয়ার খান আর আশিক খান তো হাসতে হাসতে সোফা থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার দশা।
রৌশনি খান, হিমি খান আর তনুজা খান হাসতে হাসতে শেষমেশ ফ্লোরেই বসে পড়লেন এবং কপাল চাপড়াতে লাগলেন। তুরাও হাসির চোটে ভারসাম্য রাখতে না পেরে ফ্লোরে পেট ধরে বসে পড়ল। আরফার অবস্থা সবচাইতে নাজেহাল, হাসতে হাসতে সে প্রায় সেন্স হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে। রৌদ্র কোনোমতে হাসি সামলে নিয়ে আয়ানের কাছে গেল এবং তার কাঁধে জোরে একটা চাপড় মেরে বলল।
“গাধা! ওইটা ভূত না, ওইটা আসলে তুই নিজে!”
আয়ান এবার একটু শান্ত হয়ে বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলল।
“ওহহ।”
কিন্তু পরমুহূর্তেই রৌদ্রের কথার মানে আর নিজের মুখের অবস্থাটা মনে পড়তেই সে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বীভৎস এক চিৎকার দিয়ে উঠল।
“কীহহহহহহহহহহহ!”
রৌদ্র হাসতে হাসতে আবার বলল।
“বিশ্বাস না হলে যা, আবার গিয়ে ভালো করে দেখ।”
আয়ান এবার অবিশ্বাসের চোখে আবার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল হ্যাঁ, আয়নার ভেতরে আগের সেই কিম্ভূতকিমাকার চেহারাটাই দেখা যাচ্ছে। নিজের মুখের এমন বিচ্ছিরি অবস্থা দেখে আয়ান চোখ দুটো চড়কগাছ করে ফেলল। পরক্ষণেই তার মাথায় খেলে গেল যে, তিথির কারসাজি ছাড়া এই কাজ আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আয়ান এবার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তিথির দিকে তাকাল, যে কিনা তখনো ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে হাসছে। আয়ানের সেই রাগী আর বিচ্ছিরি মাখা মুখ দেখে সবার হাসির মাত্রা যেন আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। হিমি খান হাসতে হাসতে হেঁচকি তুলে কোনোমতে বললেন।
“বাবা আমার! আমি আর পারছি না রে, সোনা ছেলে আমার! তুই একটু গিয়ে তাড়াতাড়ি মুখটা ধুয়ে আয়।”
তবুও আয়ান শান্ত হলো না, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে তিথির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে আসলে ঘুম থেকে উঠে নিজের চেহারাটা একবার আয়নায় দেখারও সুযোগ পায়নি। ঘুম ভেঙেছে আর অমনি একটা টি-শার্ট গায়ে গলিয়ে নিচে নেমে এসেছে। আর এটাই ছিল তার জীবনের সবথেকে বড় ভুল! অন্তত মুখটা একবার দেখলেও আজকে এই চরম লজ্জায় পড়তে হতো না। আর এই পুরো ঘটনার মূল কারিগর যে তিথি, সেটা বুঝতে আয়ানের বাকি নেই। আয়ান এবার তিথির দিকে ধেয়ে যেতে লাগল। তিথি অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি আনোয়ার খানকে ঝাপটে ধরল।
রৌদ্র বুঝতে পারছে, আয়ানকে এই অবস্থায় তিথিই সাজিয়েছে। আর এখন খেপে গিয়ে আয়ান যে তিথির কী দশা করবে, তার কোনো ঠিক নেই। রৌদ্র কোনোভাবে নিজের হাসি থামিয়ে, শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আয়ানকে টেনে ধরল। আয়ান রৌদ্রের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করতে করতে চিৎকার করে বলল।
“ভাইয়া আমাকে ছাড়ো! আমি আজকে তিথিকে কাঁচা চিবিয়ে খাব, পানি আর লবণ ছাড়াই খাব! ছাড়ো বলছি, আমার মাথা এখন আগ্নেয়গিরি হয়ে আছে!”
তিথি ভয়ে এবার আরও শক্ত করে আনোয়ার খানকে খামচে ধরল। আনোয়ার খান হাসির চোট সামলে নিয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন।
“আয়ান, ছোট মানুষ দুষ্টুমি করে ফেলেছে। এখন রাগ না দেখিয়ে শান্ত হয়ে মুখটা ফ্রেশ করে আয়। আমাদের হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে রে বাবা!”
আয়ান রাগে কাঁপতে কাঁপতে গর্জে উঠে বলল।
“যেহেতু তোমরা হেসেই নিয়েছো, তাহলে হাসো যত পারো! কিন্তু আমি তিথিকে উচিত শিক্ষা না দিয়ে এখান থেকে এক পা ও নড়ব না। আমি ওর আজ কী করব, তা আমি নিজেও জানি না।”
আয়ান ছাড়া পাওয়ার জন্য পাগলের মতো ধস্তাধস্তি করতে লাগল। বাড়ির সবাই তার কান্ড দেখে আরও বেশি হাসতে লাগল। এদিকে হাসতে হাসতে রৌদ্রেরও গায়ের শক্তি কমে আসছে, যেকোনো সময় আয়ান ছাড়া পেয়ে যেতে পারে। আয়ান চিৎকার করে রৌদ্রকে বলল।
“ভাইয়া প্লিজ ছাড়ো আমাকে! আমার মাথায় এখন চিতার আগুন জ্বলছে, ছাড়ো আমাকে!”
রৌশনি খান কোনো রকমে শ্বাস নিতে নিতে বললেন।
“বাবা আয়ান, অত রাগ করিস না। ছোট মেয়ে এমনি একটু মজা করেছে, তুই তো বুঝিসই। যা বাবা, ঘরে গিয়ে মুখটা ধুয়ে আয়।”
আয়ান যেন এতে আরও জ্বলে উঠল। সে লাফাতে লাফাতে আর ধস্তাধস্তি করতে করতে বলল।
“আমি তখনি শান্ত হবো যখন আমি ওই তিথির কাল্লা ফাটাবো! এর আগে আমি কিচ্ছু শুনছি না!”
বাড়ির সবাই বুঝতে পারছে আয়ান এবার সীমানা ছাড়িয়ে গেছে, সে এখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। আনোয়ার খান এবার বিপদ টের পেয়ে তিথির কানে কানে ফিসফিস করে বললেন।
“তিথি, তুই চট করে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে রাখ। আয়ান এখন ধরা পড়লে তোকে আস্ত রাখবে না!”
তিথি এতক্ষণ হাসলেও এবার তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। সে ভাবল, রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেও তো লাভ নেই এই পাগলা আয়ান তো দরজা ভেঙে হলেও ঘরে ঢুকবে! তিথি কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ কিছু একটা ভেবে নিলো। মুহূর্তেই তার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। সে আনোয়ার খানকে চুপিচুপি বলল।
“চাচা, তাড়াতাড়ি আমাকে একশ টাকা দাও তো!”
আনোয়ার খান আর কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে দিলেন। তিথি চাচার কানে কানে কিছু একটা বলে গায়ের ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো। তারপর বীরদর্পে আয়ানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে ব্যঙ্গ করে বলল।
“পড়ে থাকো তোমার ওই ছাইপাঁশ রাগ নিয়ে! ওই রাগকে এই তিথি থোড়াই কেয়ার করে!”
বলেই তিথি ঝড়ের বেগে বাড়ির বাইরে চলে এল। রাস্তার ধারে একটা সিএনজি পেয়ে সে চট করে তাতে উঠে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে সিএনজি নিয়ে তিথি উধাও! এদিকে রৌদ্রও আয়ানকে ছেড়ে দিল। আয়ান ছাড়া পেয়েই তিরের মতো বাড়ির বাইরে ছুটে এল। কিন্তু বাইরে এসে দেখল চারপাশ ফাঁকা, তিথি কোথাও নেই! থাকার কথাও নয়। আয়ান আবার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। সোজা আনোয়ার খানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
“চাচা, সত্যি করে বলো তিথি কোথায় গেছে?”
আনোয়ার খান এবার বেশ গম্ভীর হওয়ার ভান করে বললেন।
“তিথি আমার কাছে টাকা চাইল তারপর বলল চাচা আমি একটা জায়গায় যাচ্ছি কিন্তু কোথায় গেল সেইটা বলে যায়নি।”
আয়ান চাচার কথা একটুও বিশ্বাস করল না। সে বুঝতে পারছে সবাই মিলে তাকে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। আয়ান গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে বলল।
“চাচা দেখো আমি জানি তুমি জানো তিথি কই গেছে। তাড়াতাড়ি বলো নাহলে কিন্তু ওকে কোনো দিন সামনে পাইলে আমি জ্যান্ত কবর দিবো।”
আরিফুল খান দেখলেন আয়ানের রাগ এখন চরমে পৌঁছেছে। যেকোনো সময় সে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তিনি পরিস্থিতি সামলাতে শান্ত গলায় বললেন।
“দেখ বাবা রাগটা পরে দেখাস। আগে রুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে ফেল। এই অবস্থা নিয়ে বেশি কথা বললে তোর নিজেরই খারাপ লাগবে।”
আয়ান আর কোনো কথা বাড়াল না। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে লম্বা লম্বা শ্বাস নিল। তারপর বড় বড় পা ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। আয়ানের হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে মাটির সাথে যুদ্ধ করছে। সে চলে যেতেই ড্রয়িং রুমে আবার হাসির রোল পড়ল।
আরশি চমৎকার করে পায়েস রান্না শেষ করে শাওয়ার নিয়ে নিল। ভেজা চুল মুছতে মুছতে সে রুমে ঢুকে দেখল শিহাব ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে আছে। কাজের প্রতি তার গভীর মনোযোগ। আরশি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের যত্ন নিতে শুরু করল। হাতে-মুখে আলতো করে ক্রিম মাখিয়ে নিল। হঠাৎ তার খেয়াল হলো গাউনের পেছনের চেইনটা লাগানো হয়নি। এতদিন সে কামিজ পরতেই অভ্যস্ত ছিল, আজ হুট করে এই গাউনটা পরায় চেইন লাগাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সে হাতটা পেছনে নিয়ে অনেক চেষ্টা করল কিন্তু চেইনটা কিছুতেই নাগালে আসছে না। বারবার টেনে টেনে আরশি রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠল।
শিহাব কাজ করতে করতে আড়চোখে আরশির দিকে তাকাল। মেয়েটার চেইন লাগানোর এই ছটফটানি দেখে সে ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশে রাখল। তারপর নিঃশব্দে আরশির ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল। আরশি কিছু বোঝার আগেই শিহাব তার হাতটা সরিয়ে দিল। শিহাবের আকস্মিক স্পর্শে আরশির সারা শরীর শিউরে উঠল। সে আয়নার প্রতিবিম্বে শিহাবের গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। শিহাব অত্যন্ত যত্ন করে আরশির ঘাড়ের ওপর ছড়িয়ে থাকা ভেজা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দিল। তার আঙুলের তপ্ত ছোঁয়ায় আরশি এক অন্যরকম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শিহাব ধীরে ধীরে চেইনটা টেনে আটকে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পরও কোনো শব্দ না পেয়ে আরশি ধীরে ধীরে চোখ খুলল। আয়নায় তাকিয়ে দেখল পেছনে কেউ নেই। সারা ঘরে চোখ বুলিয়েও সে শিহাবকে পেল না। লোকটা কি জাদুকর নাকি? এত দ্রুত কোথায় চলে গেল! আরশি নিজের মনেই একটু হাসল। তারপর চুলগুলো ভালো করে মুছে নিচে চলে এল।
নিচে ডাইনিং টেবিলে তখন শান্ত চৌধুরী, মিনহা চৌধুরী আর শিহাব রাতের খাবারের জন্য বসেছে। আরশিও গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াল। মিনহা চৌধুরী ছেলের প্রিয় খাবারের কথা মাথায় রেখে হাসি মুখে শিহাবকে বললেন।
“তোর প্রিয় খাবার পায়েস রান্না করেছে আরশি। খেয়ে দেখ তো কেমন হয়েছে।”
শিহাব পায়েস খুব পছন্দ করে। সে মায়ের কথায় মৃদু মাথা নাড়ল। মিনহা চৌধুরী এবার আরশিকে স্নেহমাখা গলায় বললেন।
“দাও মা, তুমি নিজের হাতেই সবাইকে পরিবেশন করো।”
আরশি তড়িঘড়ি করে বাটি নিয়ে শিহাবকে দিল। এরপর শান্ত চৌধুরী আর মিনহা চৌধুরীকেও যত্ন করে বেড়ে দিয়ে সে টেবিলের একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তা দেখে মিনহা চৌধুরী বললেন।
“তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন মা? তুমিও বসো আমাদের সাথে।”
আরশি বিনয়ের সাথে হেসে বলল।
“না মা, আগে আপনারা খেয়ে দেখুন। আপনাদের যদি ভালো লাগে তবেই আমি তৃপ্তি করে খেতে পারব।”
শান্ত চৌধুরী চামচ ভরে পায়েস মুখে দিলেন। প্রথম চামচেই তার চোখ দুটো আবেশে বুজে এল। তৃপ্তির এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন।
“আহা! অসাধারণ! কতদিন পর ঠিক আমার মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ পেলাম। আরশি মা, তুমি তো একদম আমার মায়ের মতো করে রেঁধেছো।”
তিনি পরম তৃপ্তিতে একের পর এক চামচ মুখে দিতে থাকলেন। শিহাবও খুব ধীরস্থিরভাবে পায়েস মুখে তুলল। মুখে দিতেই তার জিভে স্বাদের এক অপূর্ব বিস্ফোরণ ঘটল। পায়েসটা যে সত্যিই দুর্দান্ত হয়েছে তা শিহাবের চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, যদিও সে মুখ ফুটে কিছু বলল না। মিনহা চৌধুরী এক চামচ খেয়েই অবাক হয়ে আরশিকে বললেন।
“আরে বাহ! তুমি তো দেখি রান্নায় একদম ওস্তাদ। দারুণ পায়েস হয়েছে তো মা।”
শান্ত চৌধুরী হেসে স্ত্রীকে খোঁচা দিয়ে বললেন।
“হ্যাঁ গো, তোমার চেয়েও ভালো হয়েছে। এবার অন্তত মেয়েটার কাছ থেকে কিছু রান্না শিখে নাও।”
মিনহা চৌধুরী শান্ত চৌধুরীর কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। অভিমানী সুরে বললেন।
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমি রান্না পারি না? আমি বুঝি খারাপ রান্না করি?”
শান্ত চৌধুরী পায়েসের বাটি শেষ করতে করতে হাসিমুখে বললেন।
“একেবারে যে খারাপ করো তা তো বলিনি। তবে আরশির কাছ থেকে কিছু রান্না শিখে নিলে মন্দ হতো না আরকি।”
মিনহা চৌধুরী মিছেমিছি রাগের ভান করে শান্ত চৌধুরীর হাতে একটা চাপড় মারলেন। শান্ত চৌধুরী বাটি রেখে হা হা করে হেসে উঠলেন। সারা ডাইনিং টেবিল হাসিতে ভরে উঠলেও আরশির মনটা বিষাদে ভরে গেল। এত কষ্ট করে যার জন্য পায়েস রান্না করল, সে খেয়ে একবারও মুখ ফুটে কিছু বলল না! আরশি মনে মনে ভাবল, আমি কি তবে তার কাছে এতই তুচ্ছ? শিহাব খাওয়া দাওয়া শেষ করে কোনো মন্তব্য না করেই নিঃশব্দে রুমে চলে গেল। আরশি নিজেকে সামলে নিয়ে কোনোমতে কিছুটা খেয়ে নিল।
খাবার শেষ করে আরশি রুমে ফিরে এল ঠিকই কিন্তু তার মনটা কিছুতেই মানছে না। এক অদ্ভুত অস্বস্তি আর কষ্ট তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তাই সে গুমোট ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা ছাদে চলে এল। আকাশের বিশালতার দিকে তাকিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সে নিজের জীবনের কথা ভাবতে লাগল। মনে মনে ভাবল।
“শিহাব কি কোনোদিন আমাকে বুঝবে না? কোনোদিন কি একটু আপন করে নেবে না? আমি কি মেয়ে হিসেবে এতটাই খারাপ যে আমাকে একটু ভালোবাসাও যায় না? শিহাব চাইলে কি পারত না অন্তত একবার বলতে যে রান্নাটা ভালো হয়েছে? কেন সে আমাকে এভাবে এড়িয়ে চলে?”
ভাবতে ভাবতে আরশির চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে একমনে ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক সেই মুহূর্তে পেছনের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা পরিচিত আওয়াজ ভেসে এল।
“উহুম উহুম! আরশি, বলছিলাম ধন্যবাদ পায়েসটা অনেক সুন্দর হয়েছে।”
শিহাবের গম্ভীর কণ্ঠ কানে আসতেই আরশির ধ্যান ভেঙে গেল। সে তাড়াতাড়ি হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে আগের মতোই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা শব্দও করল না। শিহাব বুঝতে পারল নিচে পায়েসের প্রশংসা না করায় আরশি মনে কষ্ট পেয়েছে। সে এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আরশির ঠিক পাশে দাঁড়াল। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল।
“আরশি একটা কথা বলবো?”
আরশি এক পলক আড়চোখে শিহাবের দিকে তাকাল। তার চোখের কোণে এখনো কান্নার রেখা। সে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ছোট করে বলল।
“হুম।”
শিহাব খুব সহজভাবে প্রশ্ন করল।
“আমাকে কেন ভালোবাসো আরশি? আমি তো তোমার সাথে এমন কোনো কাজই করিনি যার জন্য আমাকে তোমার ভালোবাসতে হবে। তুমি কেন এখনো এই বাড়িতে আছো? চাইলে তো তুমি চলে যেতে পারো। আমি তো তোমাকে আজ পর্যন্ত কোনো অধিকার দেইনি, এমনকি স্বামীর মর্যাদাও দেইনি। তাহলে এই অবহেলার মাঝে কেন পড়ে আছো? আমি জানি একটা মেয়ের বিয়ের পর সব থেকে বড় সুখ থাকে তার স্বামী। যদি সেই স্বামীই পাশে না থাকে তবে তো জীবনটাই বৃথা হয়ে যায়। আমাদের জীবনটাও তো অনেকটা তেমনি হয়ে আছে, তবে তুমি কেন মুক্তি খুঁজছ না?”
শিহাবের মুখে এমন নির্মম প্রশ্ন শুনে আরশি থমকে গেল। সে নিজের দৃষ্টি আকাশের অসীম শূন্যতায় স্থির রেখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বিষাদ মাখা কণ্ঠে গুছিয়ে বলল।
“কাউকে ভালোবাসতে বুঝি কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ লাগে শিহাব সাহেব? ভালোবাসা তো কোনো হিসেব কষে হয় না,ওটা হৃদয় থেকে আসে। আমার একটা মন আছে বলেই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর কেন এই অবহেলা সয়ে পড়ে আছি জানতে চাইলেন তো? আসলে যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে ছেড়ে থাকা যায় না। আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন জানি, তবুও আপনার ছায়া এই বাড়িতে আছে এই ভেবেই আমার মনে এক অদ্ভুত শান্তি জোটে। আমি পড়ে আছি এই আশায় যে, কোনো একদিন হয়তো আপনি আমাকে একটুখানি আপন করে নেবেন।”
রানিং…!
অনেক বড় পর্ব তাই রীচেক দেইনি অলস লাগছে বানান ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেইখো সবাই প্লিজ🙏😫
Share On:
TAGS: নির্লজ্জ ভালোবাসা, সুমি চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪০
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২১
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫৮
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১৯
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৬
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১৪,১৫
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩১