ডিজায়ার_আনলিশড
✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব ৮.
চৌধুরী নিকেতনে সকাল আর হালকা সূর্যের আলো মিলেমিশে প্রশান্ত এক আবহ তৈরি করেছিল। জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী কক্ষে ইজি চেয়ারে বসে হাতের ঘড়ি বারবার দেখছিল। রুমে শূন্যতা, কেবল ঘড়ির টিকটিকি আর দূরে দূরে রোদ ফুটে আসা—সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত চুপচাপ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মনে এক অদ্ভুত চাপ, যেন সময় বাকি আছে মাত্র ১০ ঘণ্টা, আর ২৪ ঘণ্টার শেষের দিকে কিছু বড় ঘটবে।
দরজা হঠাৎ খোলার শব্দ। রায়হান ধীরে ধীরে প্রবেশ করল।
— “স্যার, আমি এসে গেছি অবশেষে, মা বাবা, পরিবারের সাথে সময় কাটিয়ে সত্যি মনটা এখন প্রফুল্ল হয়ে গেছে,” সে বলল।
জাভিয়ান হালকা চোখের ধাঁধা দিয়ে তাকাল,
— “রায়হান, তান্বীর পাসপোর্ট তৈরি করতে হবে। ভিসার কাজও শেষ করতে হবে খুব দ্রুত। কিছুদিনের মধ্যে তাকে নিয়ে মেক্সিকোতে চলে যাবো।”
রায়হান একটু দ্বিধার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,
— “স্যার, কিন্তু মেয়েটি কি রাজি হবে?”
জাভিয়ান ঠান্ডা হেসে বলল,— “রাজি না হলে, রাজি করাবো, যেতে বাধ্য হবে কারন মাথায় রাখো, আমি টাকা দিয়ে কিনে এনেছি তাকে।”
জাভিয়ান আবার ঘড়ির দিকে তাকাল, মনে মনে ভাবল,
“মেয়েটাকে যেভাবেই হোক মেক্সিকোতো নিয়ে যেতে হবে… আর তার জন্য যা করার করবো।”
চুপচাপ অফিসে কেবল আলো, ঘড়ির টিকটিকি এবং দূরের শব্দ—সব মিলিয়ে দিনের শুরুটা যেন বড় কিছু ঘটার প্রস্তাব দিচ্ছিল।
.
.
.
.
দুপুরের খাবারের টেবিলে সবাই বসেছিল—জাভিয়ানের বাবা সায়েম চৌধুরী, মা কার্গো চৌধুরী, দাদি সুফিয়া চৌধুরী এবং তান্বী। টেবিলে হালকা আলো, খাবারের গন্ধ আর ছোটখাট হাসি-ঠাট্টার মধ্যে সকালটা চলে যাচ্ছিল।
হঠাৎ সায়েম চৌধুরী চেয়ার সরিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন,— “মেক্সিকো ফিরে তুমি কিসের কোম্পানি খুলবে, জাভি?”
জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “এখনো ভাবিনি।”
সায়েম চৌধুরী আরও দৃঢ় সুরে বললেন,— “আর কখনো ভাববে? ২৯ বছর পার হয়ে যাচ্ছে, অথচ এখনও কি কাজ করো নাকি কিছুই করোনা, সেটা আমি আজ ও বুঝিনি। শুধু জানতে পেরেছি, ক্যাসিনোতে সময় কাটিমে বেড়াও অলটাইম।”
জাভিয়ান চেয়ার থেকে উঠে হালকা কণ্ঠে বলল,
— “হয়েছে, শেষ। যদি আপনার আর কিছু বলার থাকে তাহলে রেকর্ড করে রাখবেন। আমি এবার উঠলাম।”
টেবিলে হালকা অস্বস্তি নেমে এলো। তান্বী চুপচাপ বসে ছিল, চোখে ভাবনার রেখা। দাদি সুফিয়ার মুখে সামান্য হেসে ওঠার ছাপ, আর বাবা-মায়ের দৃষ্টিতে মিশ্রিত বিস্ময়—সব মিলিয়ে পুরো দুপুরটা এক ভিন্ন রঙে রাঙিয়ে দিল।
.
.
.
.
তান্বী খাবার শেষ করে রুমে ফিরে আসলো। রুমের দরজা খুলতেই দেখলো জাভিয়ান ল্যাপটপে মন দিয়ে কিছু কাজ করছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ তান্বী চুপচাপ বসে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনার বয়স ২৯?”
জাভিয়ান চোখ না তোলেই জবাব দিল,— “হ্যাঁ। কোনো সমস্যা?”
তান্বী তখন বলল,— “আমার হবে মাত্র ১৯+, তাহলে তো আপনি আমার আঙ্কেলের মতো।”
জাভিয়ান কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,— “সময় মতো বিয়ে করলে তোমার বাচ্চা এখন থাকতো কিন্ডারগার্ডেনে, আর তারা আমাকে আঙ্কেল বলে ডাকতো।”
তান্বী আর কিছু বলল না, চুপচাপ বসে পড়ল। কিন্তু মনে মনে চিন্তা চলে গেল—একটি পুলিশ কি করছে এখন? তারা কি পৌঁছায়নি কেনো? বাবা-মা আর ভাই বোনকে উদ্ধার করেছে কিনা,সেই ভয় যেন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
.
.
.
.
একদিনের মধ্যে জাভিয়ান তান্বীর পাসপোর্ট তৈরি করে ফেললো। ইমারজেন্সি পাসপোর্ট যা সে একদিনেই করেছে।রাতের বেলা, পাসপোর্ট হাতে নিয়ে সে তান্বীর কাছে গিয়ে বললো, — “নাও, এবার তৈরি হয়ে যাও। আগামী তিনদিনের মধ্যে আমি তোমাকে নিয়ে মেক্সিকোতে ফিরবো।”
তান্বীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। একদিকে বাবা-মা বন্দি, কেমন আছে তারা তা তো জানেই না, তবুও একটা আশা ছিল—কমপক্ষে বাংলাদেশে থাকলে তাদের কাছে ফিরতে পারবে। কিন্তু মেক্সিকোতে চলে গেলে কি তার প্রিয় মানুষগুলোকে চিরদিনের মতো হারাবে?
হতাশার মধ্যে তান্বী চিৎকার করে বললো,— “আমি কোথাও যাবো না! বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না!”
জাভিয়ান ঠাণ্ডা স্বরে, কিন্তু দৃঢ় সুরে বলল,— “তোমাকে আমি বিয়ে করেছি, ইভেন তোমাকে আনতে আমার কত টাকা খরচ হয়েছে, আর তুমি বলছো যাবো না? তোমাকে যেতেই হবে। আমি যেখানে যাবো, তুমি সেখানেই থাকবে।”
তান্বী চোখে জল নিয়ে বললো,— “আমার মা, বাবা, ভাই, বোন মৃত্যুর মুখে পড়ে আছে, আর আমি এতো দূর চলে যাবো তাদের রেখে?”
জাভিয়ান শান্ত স্বরে উত্তর দিল,— “কাল তোমার জন্য শপিং নিয়ে আসবো। এখন ঘুমাও, আমি গেলাম।”
তান্বী হাত মুড়ে বললো,— “আমি…আমি যাবো না, গেলে আমার লা/শ যাবে আমি না।”
জাভিয়ান আবার তান্বীর কাছে এলো, চোখে দৃঢ়তা আর স্বরে বললো,— “তোমাকে এখন মেক্সিকোতে যেতেই হবে। আমি আরো পরে তোমার পাসপোর্ট করতাম, কিন্তু তুমি যা করেছ—রিকার্দোর বিরুদ্ধে মামলা, তাও আমার ল্যাপটপ দিয়ে বুঝতে পারছো কি করেছো?
তান্বীর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো।
জাভিয়ান পুনরায় চোখে লুকানো শীতলতার সঙ্গে বললো,
— “মাফিয়াদের সম্পর্কে তুমি কি জানো?তোমার কোনো ধারনা আছে? পুলিশ প্রশাসনও তাদের কথা শুনে উঠে বসে। আর তোমার সামান্য এক কেসে কেউ রিকার্দোকে আটক করবে—না। কখনোই না।”
তান্বীর গলা কাঁপতে কাঁপতে বললো,— “ওই রিকার্দোকে ধরানোর জন্য আমার উদ্দেশ্য কখনো ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার মা, বাবা, ভাই আর বোনকে তার হাত থেকে উদ্ধার করা।”
জাভিয়ান হেসে বললো,— “কেউ পারবে না তোমার পরিবারকে রক্ষা করতে, কেউ না।”
তান্বী দৃঢ়ভাবে বললো,— “পারবে, একজন পারবে।”
জাভিয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,— “কে?”
তান্বী নিঃশব্দে, কিন্তু নিশ্চিত সুরে বললো,— “আপনি পারবেন।”
জাভিয়ান চোখে অবিশ্বাসের আভা নিয়ে বললো,— “আমি কেন তোমার পরিবারকে রক্ষা করব? তারা আমার কে হয়?”
তান্বী শান্ত স্বরে উত্তর দিলো,— “কেউ নয়। কিন্তু আপনার মতো লোকেরা গিভ অ্যান্ড টেক পছন্দ করে। আপনারা ডিল করতে ভালোবাসেন। তাই আমিও আপনার সাথে ডিল করতে চাই। আপনি যদি আমার মা, বাবা, ভাই-বোনকে রিকার্দোর হাত থেকে রক্ষা করেন, তবেই আমি একেবারে খুশি হয়ে আপনার সঙ্গে মেক্সিকোতে যাব। আমি জানি, আমাকে বিয়ে করাটাও আপনার কোনো ডিল একটা,আর তার জন্য আপনি যা খুশি করতে পারেন, তেমনি আমি আমার পরিবারের জন্য নিজেকে সেক্রিফাইস করতে পারবো।”
জাভিয়ান কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে কোনো শব্দ না বলেই ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
.
.
.
রিকার্দোর বিশাল আস্তানার সামনের স্লিপিং লবিতে জাভিয়ান হঠাৎ থেমে দাঁড়ালো। চারপাশে উজ্জ্বল লাইট, ভেতরের কাঁচের জানালা দিয়ে ধরা পড়ছে বিশাল হালকা ফোয়ারা, আর তান্বীর বাবা-মার বন্দি থাকার ঘরগুলো—সবকিছুই তীক্ষ্ণ নজরে ধরা দিচ্ছিল। জাভিয়ানের মনের মধ্যে একটাই চিন্তা—এই মুহূর্তে কোনো ভুলের সুযোগ নেই।
ভেতরে ঢুকতেই সে একটি চরম তথ্য পেল। তান্বীর বোন এলিনাকে ইতিমধ্যেই শিপে তুলে দেওয়া হয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনার পর জাভিয়ান দৃঢ়তার সঙ্গে রিকার্দোর সঙ্গে চুক্তি করলো। অনেক টাকার বিনিময়ে রিকার্দো রাজি হলো—তান্বীর বাবা-মাকে ছাড়ানোর জন্য।
জাভিয়ান সঙ্গে সঙ্গে রায়হানকে ফোন করলো। রায়হান গকাজ করছিল, কিন্তু জাভিয়ানের তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে সতর্কতার সঙ্গে সমস্ত ব্যবস্থা নিতে লাগলো। — “রায়হান, শুনেছো? এখনই ব্যবস্থা করো। তান্বীর বাবা-মাকে নিরাপদেবাড়িতে পৌঁছে দাও।”
রায়হান সম্মত হল, দ্রুত গাড়ি প্রস্তুত করতে লাগলো।
জাভিয়ান একপাশে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিলো। তার মনে শান্তি এলো, তান্বী এবার কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই মেনে নেবে মেক্সিকো যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
রিকার্দোর আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসার পর জাভিয়ান গভীরভাবে শ্বাস ফেললো। সে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, ঠান্ডা বাতাসে চুল ছড়িয়ে দেওয়া অবস্থায় নিজের হাতে ফোনে লিপ্ত, হঠাৎ মৃদু হেসে বললো— “উফ, কদিন হলো মেয়েটাকে বিয়ে করেছি, আর এই সময়ের মধ্যেই তো আমার ব্যাংক ব্যালেন্স ফাঁকা করে দেবে, মনে হচ্ছে!”
তার চোখে ঝলক, মনে অদ্ভুত রাগ আর প্রশান্তি—একই সাথে। সে নিজের ভেতরের হাসি ধরে রাখতে পারছিল না। মনে মনে ভাবলো, এই ঘাড়ত্যারা তান্বী কত বড় ঝামেলা, আর কত বড় ধনুক ছুঁড়বে তার জীবনে।
জাভিয়ান একটু পায়চারি করলো, হাতের আঙুলে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে ভাবলো—কতদিন এই মেয়েটাকে নিজের সঙ্গে রাখতে হবে, আর কতটা চালাকি করতে হবে তার বাবার সাথে।
.
.
.
.
গভীর রাতে জাভিয়ান বাড়িতে ফিরে এলো। ঘরটা শান্ত, কেবল হালকা বাতি জ্বলছে। তান্বী তখন গভীর ঘুমে, আর তার চুল ছড়িয়ে আছে বালিশে। হঠাৎ, জাভিয়ান নিঃশব্দে এগিয়ে এসে তান্বীর মুখের ওপর এক গ্লাস পানি ঢেলে দিল।
তান্বী হঠাৎ করেই চমকে ওঠে, জল ঝরানো মুখে হাত মুছে বললো,— “আপনি কি পাগল,আমার মুখে পানি ঢাললেন কেনো?”
জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি লুকিয়ে বললো,
— “তোমার শর্ত পূরণ হয়ে গেছে, এবার প্রস্তুত হও।”
তান্বী বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকালো। জাভিয়ান একটু থেমে বললো, — “তোমার মা-বাবা আর—” হঠাৎ গলার স্বর হালকা করে ফিসফিস করে, “বোন… বলতে যেয়েও থেমে যায় কারন জাভিয়ান জানে এলিনাকে পাচারের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে তবে তান্বীকে সেটা জানতে দেয়া যাবেনা তাই পুনরায় বললো “তোমার বোন! তারা রাতের মধ্যেই নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে যাবে।”
তান্বী চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করলো,— “তাদের নিরাপদে পৌঁছে যাওয়ার প্রমাণ কী?”
জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি নিয়ে বললো,— “মেক্সিকো যাওয়ার দিনই তুমি দূর থেকে দেখতে পারবে তাদের,তবে তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ থাকবে না। এটা আমার শর্ত।”
তান্বীর মনের মধ্যে এক অদ্ভুত চাপ ও অস্থিরতা তৈরি হলো, তবে সে বুঝতে পারলো, জাভিয়ানের নিয়ন্ত্রণ আর পরিকল্পনার বাইরে কিছুই ঘটতে দেওয়া হবে না।
তান্বী রাগ আর উদ্বেগ মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আর আমার ভাই?”
জাভিয়ান কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো। তারপর ধীর গলার সঙ্গে বললো, “তোমার ভাই… সে একজন সন্ত্রাসী ছিল, মাফিয়াদের ডিলার। তাকে আমি ছাড়াতে পারব না। যদি তাকে ছাড়ি, পুরো মাফিয়া সাম্রাজ্য বিপদে পড়বে। বুঝতে পারছো? তাই তার কথা একেবারে ভুলে যাও।”
তান্বীর মুখে আতঙ্ক আর হতাশার ছায়া পড়লো। সে বুঝতে পারলো, তার পরিবার বাঁচানোর জন্য যে যাত্রা শুরু হয়েছে, সেখানে তার ভাইয়ের ভাগ্য আর নিয়ন্ত্রণ আর কারো হাতে নেই।
.
.
.
.
রাতের অন্ধকারে শহর নিস্তব্ধ। দূরের রাস্তার হালকা বাতি ঝলমল করছে, আর আকাশে ম্লান আলো। এক কাঁচের ঘরে, ল্যাপটপের নীল আলোর প্রতিফলনে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়া। চোখে ঝলকাচ্ছে বিশ্বব্যাপী মাফিয়া নেটওয়ার্কের তথ্য, আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের ডেটা, গুপ্তচরদের অবস্থান।
কেউ জানে না, এই সমস্ত শক্তিশালী নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি কে। কেবল একটি ছদ্মনাম—Night Raven। Night Raven অর্থ “রাত্রির রহস্যময় কাক”—ছায়ার মতো অদৃশ্য, বিচক্ষণ এবং শক্তিশালী। কেউ তাকে সহজে চিহ্নিত বা থামাতে পারে না।
Night Raven শুধু মাফিয়া নয় সে মাফিয়াদের গড ফাদার; সে পুরো আন্ডারগ্রাউন্ডের নীরব শাসক। আন্তর্জাতিক ব্যাংক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, দূরের দেশের অপরাধ সিন্ডিকেটের শিপিং রুট বদলাতে পারে, রাজনৈতিক প্রভাবও তার নিয়ন্ত্রণে। পুলিশের প্রশাসনিক সিস্টেম, দুর্নীতিপূর্ণ কর্পোরেট চক্র, শত্রুদের কৌশল—সবই তার চোখের পলকে নিয়ন্ত্রণে।
“Night Raven,” নিজের কাছে ফিসফিস করে বলল সে, “যে কেউ আমার পথে বাধা দেয়, সে শুধু হারবে।”
এক ক্লিকেই ব্যাংক ট্রান্সফার স্থগিত, শিপিং রুট পরিবর্তিত, শত্রুদের পরিকল্পনা ধ্বংস। শহর নিস্তব্ধ, কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডে উত্তেজনা শীর্ষে। কেউ জানে না, এই ছায়া কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় যাবে।
সে ল্যাপটপ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “এভাবে সব আমার নিয়ন্ত্রণেই থাকবে… আর কেউ আমার ছায়াকে ছেদ করতেও পারবে না।”
“Night Raven” কোনও সাধারণ মাফিয়ার চিফ নয়; সে আন্ডারগ্রাউন্ডের সর্বশক্তিমান ছায়া, যার হাতে পুরো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অপরাধমূলক জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে।
.
.
.
.
মেক্সিকোর রাত গভীর আর অন্ধকারময়। মেইলস্ট্রোম তার স্ট্রোম পেইন্ট হাউজের অফিসে বসে আছে, চারপাশে শুধু কম্পিউটার স্ক্রিনের নীল আলো ঝলমল করছে। তার চোখে উদ্বেগের ছায়া, মন ভরা চিন্তায়—তান্বীর নিরাপত্তা।
হঠাৎ সব তথ্য একত্রিত হলো। ফারহান, তান্বীর ভাই, মাফিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল, আর সেই কারণেই রিকার্দো পুরো পরিবারকে বন্দি করেছে। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য—তান্বী আর তার বোন এলিনাকে শিপে তুলে পাচার করা হয়েছে,
যা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ডুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
রাগ আর আতঙ্কের মিশ্রণে মেইলস্ট্রোমের চোখ অগ্নিশিখায় পরিণত হলো। তার হাতে বন্দুক তুলে নিলো, বুলেটের বৃষ্টি শুরু হলো—প্রতি গুলি তার আশেপাশে থাকা তার নিজস্ব ডিলার আর সাইডকিকদের আঘাত করলো। তার দলের লোকেরা একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
কিন্তু এই হিংস্রতা বন্ধ করতে তার মা, ইসাবেলা মোরেলাস, ছুটে এসে দাঁড়ালেন। “মেইলস্ট্রোম, থামো!”—মায়ের কণ্ঠ কাঁপছে, কিন্তু দৃঢ়।
“আমার তান্বী! ওই রিকার্দো বাস্টার্ড ওকে পাচার করেছে!”—মেইলস্ট্রোম চিৎকার করে বলল। “আমি যদি ওই মাদারফাকার রিকার্দোকে মেরে কুটি কুটি করে আমার নেকড়েকে ওর লাশ উপহার না দিতে পারি। অন্যথায় আমি মেইলস্ট্রোম নামের অধিকারী নই!”
ইসাবেলা কঠোর সুরে বললেন, “যা করার করবে আগে সেই মেয়েটাকে উদ্ধার কর।রাগে তুমি পুরো বিশ্ব ধ্বংস করলেও, জীবনের মূল লক্ষ্য হারাবে না।”
মেইলস্ট্রোম এক মুহূর্ত চুপচাপ, তারপর দৃঢ়ভাবে বলল, “ঠিক আছে মম, তাহলে আগে শিপে যাই। আমি তান্বীকে উদ্ধার করেই ফিরবো আর আমার আমার পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।”
শহরের নীরবতা ভাঙল—মেইলস্ট্রোম যেন পুরো শিল্প ধ্বংসের প্রস্তুতি নিলো, একমাত্র উদ্দেশ্য—তান্বীকে উদ্ধার করা।
মেইলস্ট্রোম প্রথমে নিজের হেডকোয়ার্টার থেকে শিপের স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে অবস্থান চিহ্নিত করল। শিপটি সমুদ্রপথে অচল নয়, বরং পুরোপুরি সচল। সে দ্রুত যোগাযোগ করলো মেক্সিকোর বন্দর থেকে প্রস্তুত থাকা স্পিড বোট অপারেশন টিমের সঙ্গে।
“লক্ষ্য চিহ্নিত হয়েছে। স্পিড বোটে চেপে শিপের সঙ্গে লাইন ধরে এগোতে হবে। কোনো ঝামেলা হলে, গুলি করতে হবে,”—মেইলস্ট্রোম নির্দেশ দিলো, কণ্ঠে দৃঢ়তা আর রাগের মিশ্রণ।
গভীর রাতে, মেইলস্ট্রোম নিজেই একটি দ্রুত স্পিড বোটে চেপে সমুদ্রের দিকে ছুটল। জলের ঢেউ শাখা শাখা হয়ে ছিটকে পড়ছিল, কিন্তু তার চোখে শুধু শিপ, শুধু লক্ষ্য। ঘণ্টাখানেকের ধাওয়া শেষে, শিপটি কাছাকাছি এলো।
স্পিড বোট থেকে দূরে শিপটি দেখা গেল—প্রচুর বন্দি মেয়ে এবং রিকার্দোর লোকেরা। মেইলস্ট্রোম দলের লোকদের নির্দেশ দিলো। “সবার লক্ষ্য নির্দিষ্ট—শিপে প্রবেশ করে তান্বী উদ্ধার করা। নিরাপত্তা ভেঙে ফেল, কিন্তু বন্দিদের কোনও ক্ষতি হবে না।”
শিপের উপরে ধ্বংসাত্মক শোরুমের আওয়াজ, রিকার্দোর সিকিউরিটি চোখে পড়ল। মেইলস্ট্রোম তার বন্দুক হাতে তুলে নিলো, স্পিড বোট থেকেই লড়াই শুরু হলো—প্রতি গুলি সঠিক লক্ষ্য খুঁজে নিয়ে রিকার্দোর লোকদের থামাচ্ছে।
মধ্যরাতের নীরবতা ভেঙে গেল, সমুদ্রের ঢেউ হালকা ঝাঁকুনি দিচ্ছিল। শিপের ঝলমলে আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, যেখানে তান্বী তার বন্দি। মেইলস্ট্রোমের চোখে অদম্য রাগ এবং দৃঢ় প্রতিশ্রুতি—এই শিপ থেকে তার তান্বীকে নিরাপদে বের করে আনতে হবে।
হঠাৎ, শিপের এক পাশে ধ্বনিত হলো—রিকার্দো নিজেই আসছে। একটি দ্রুতগতির হেলিকপ্টার দিয়ে সে শিপের দিকে এগোচ্ছে। তার চোখে ধোঁয়া এবং ক্রোধ, মনে হচ্ছে সে আগেই জানে, মেইলস্ট্রোম তার পথে।
মেইলস্ট্রোম শিপের পাশে পৌঁছানোর মুহূর্তে নিজের দলের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লড়াই শুরু হলো—রিকার্দোর লোকেরা প্রতিরোধ করছে, কিন্তু মেইলস্ট্রোম দক্ষতার সঙ্গে এগোচ্ছে।শিপের ভিতরে থাকা মেয়েরা আতঙ্কিত, কিন্তু মেইলস্ট্রোমের চোখে একমাত্র দৃঢ় প্রতিশ্রুতি—যে কোনো মূল্যে তার প্রেয়সীকে উদ্ধার করা।
হঠাৎ রিকার্দো শিপের উপরে উঠে আসে। সে বুঝতে পারে, মেইলস্ট্রোম এত কাছে পৌঁছেছে যে আর কোনো সময় নেই। দ্রুত সে একটি গ্রেনেড—চালু করে শিপের ভেতরে। মুহূর্তের মধ্যে শিপে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, আগুনের শিখা ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে।
শিপটি লম্বা-লম্বা ঢেউ নিয়ে পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু রিকার্দো চতুরতার সঙ্গে তার সঙ্গিদের স্পিড বোটে লাফ দিয়ে নিরাপদে দূরে সরে যায়।
রাতের নীরব সমুদ্র হঠাৎ চিৎকারে ভরে উঠল। শিপটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের সঙ্গে আগুনের শিখায় ঢেকে গেলো সমুদ্রের তলদেশে।ঢেউয়ের সঙ্গে মিলিয়ে সমুদ্রের কোলাহল চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল।
মেইলস্ট্রোম, স্পিড বোট থেকে শিপের দিকে তাকিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। চোখে অশ্রু, হৃদয়ে বিষাদ—শিপের সঙ্গে সঙ্গে তার একমাত্র ভালোবাসা তান্বীরও হারিয়ে গেছে বলে মনে হলো। সমুদ্রের কোলাহলে তার হৃদয় ভেঙে পড়ল, নিঃশব্দে সে শুধু চিৎকার করতে চাইল।
কিছুক্ষণ পর, মেইলস্ট্রোম নির্ধারিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গভীর জলে ঝাঁপ দিল। সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিয়ে সে তার প্রিয় তান্বীর খোঁজ শুরু করল। পানির চাপ, অন্ধকার, এবং গলায় আসা জল—সবকিছুই তাকে থামাতে পারল না।
একজন বিশ্বস্ত সহযোগী, ইসাবেলাকে ফোন করল। সব ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে দিয়ে, আরো একটি উদ্ধার দলের ব্যবস্থা করল।
অন্যদিকে, রিকার্দো সব দেখছিল। সে বুঝতে পারল, মেইলস্ট্রোম বেঁচে গেলে তার জীবনই ঝুঁকিতে পড়বে। তাড়াতাড়ি দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করল, পালানোর প্রস্তুতি নিল। কিন্তু রিকার্দো বোঝার বাইরে, কেনো হঠাৎ মেইলস্ট্রোম তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো—তার জন্য এই রাত চরম চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।
সমুদ্রের গভীরে এখন শুধু অন্ধকার, ধ্বংসপ্রাপ্ত শিপের ধ্বংসাবশেষ, আর একটি অদম্য শিকারির সংকল্প—মেইলস্ট্রোম যে তান্বীকে খুঁজে বের করবে, তা এখন আর কোনো বাঁধা রোধ করতে পারবে না।
মেইলস্ট্রোম সমুদ্রের গাঢ় নীল জলরাশিতে তলিয়ে গেলো। শীতল পানি তার দেহকে ঘিরে নিলো, ঢেউয়ের চাপ তাকে নিচের দিকে টেনে নিয়ে গেল। চোখে অন্ধকার, ফুসফুসে পানি ঢুকছে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে দেহে শূন্যতার অনুভূতি। তলিয়ে যাওয়া, ঘন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া—মনে হচ্ছিলো পৃথিবী আর নেই, শুধু এক অচেতন মানব জলরাশির মাঝে ভাসছে।
ধীরে ধীরে মেইলস্ট্রোমের হাত আর পা দুর্বল হয়ে পড়ল, দেহে শক্তি কমতে লাগল। বুকের হালকা স্পন্দন একাকী নিঃশ্বাসের মতো প্রতিধ্বনিত হলো। সমুদ্রের তলদেশে মুহূর্তেই স্থিরতা নেমে এল—সেখানে শুধু অচেতন এক শক্তিশালী ছায়া, যেন পৃথিবী আর তার সাথে নেই।
তবে ঠিক সেই সময়,ইসবেলার পাঠানো উদ্ধারকারী দল—ডুবুরি আর স্পেশাল গিয়ার পরিধান করা লোকেরা—দ্রুত আস্তে আস্তে সমুদ্রের গভীর থেকে এগিয়ে এল। তারা যন্ত্র ও দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করে মেইলস্ট্রোমকে খুঁজে পেল। অবশেষে, ধীরে ধীরে তাঁরা তাকে শক্ত হাতে ধরে তুলতে শুরু করল।
ওপরে উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেইলস্ট্রোমের দেহ কাঁপছিল, ঠোঁট অচল, চোখ বন্ধ। কিন্তু যাঁরা তাকে উদ্ধার করেছেন, তাঁরা জানতেন—এখনও সে বেঁচে আছে। সমুদ্রের নীল ঢেউয়ের মাঝে এখন শুধু অচেতন, শক্তিশালী এক মাফিয়া, আর তার পাশে উত্তেজনা আর শঙ্কার মিশ্রণ।
প্রতিটি মুহূর্ত যেন অপেক্ষা করছে—মেইলস্ট্রোম যখন আবার জাগবে, তার রাগ, সংকল্প আর শত্রুদের প্রতি প্রতিশোধের আগুন প্রকাশ পাবে।
(চলবে….)
অনেকেই ভাবতে পারেন একদিনে পাসপোর্ট কিভাবে হলো তাহলে বলবে এগুলা সব পরে জানতে পারবেন।অনেক টুইস্ট যোগ হবে সামনে আরো।
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২০
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১০
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৩
-
আযদাহা সব পর্বের লিংক
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৭
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৬
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৯