ডিজায়ার_আনলিশড ❤️🔥
✍️ #সাবিলা_সাবি
পর্ব-২৪ (প্রথমাংশ)
ইসাবেলার দেওয়া তালিকার তৃতীয় আস্তানার পর চতুর্থ আস্তানাটিতে যখন জাভিয়ান হানা দিল, সেখানেও কেবল পাওয়া গেল বারুদের গন্ধ আর মেইলস্ট্রোমের রেখে যাওয়া কিছু নিথর দেহ। মেইলস্ট্রোম অত্যন্ত সুকৌশলে জাভিয়ানকে এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। প্রতিটি আস্তানা খালি, প্রতিটি ডেন এখন একেকটি পরিত্যক্ত শ্মশান।
জাভিয়ানের সাদা শার্ট এখন মানুষের রক্তে ভিজে সপসপে। তার চোখের সেই ‘ফিক্সেশন’ এখন এক অন্ধ আক্রোশে রূপ নিয়েছে। সে পাগলের মতো চারপাশের আসবাবপত্র ভাঙতে শুরু করল। রায়হান পেছন থেকে এসে তাকে থামানোর চেষ্টা করতেই জাভিয়ান তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
জাভিয়ান গর্জন করে বললো “ও আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে রায়হান! মেইলস্ট্রোম আমাকে নিয়ে পুতুল নাচ খেলছে। মেইলস্ট্রোম ভেবেছে লিস্ট দিয়ে আমাকে ব্যস্ত রাখবে আর ওদিকে আমার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে পালাবে?”
সে পকেট থেকে ফোন বের করে তার স্পেশাল হ্যাকিং ইউনিটের চিফকে ডায়াল করল। জাভিয়ানের কন্ঠস্বর এখন মরুভূমির তপ্ত বাতাসের মতো শুকনো এবং গম্ভীর। “ম্যাক্স, লিসেন টু মি ভেরি কেয়ারফুলি। আইটি সেক্টরের সব প্রটোকল ভেঙে ফেলো। মেইলস্ট্রোমের পার্সোনাল ক্লাউড সার্ভার আর ওর প্রাইভেট কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক হ্যাক করো। আমি চাই ওর প্রতিটি ডেন, প্রতিটি সেফ হাউসের রিয়েল-টাইম ডাটা। যদি কোনো রাডার ডিসকানেক্ট হয়ে থাকে, তবে তার শেষ লোকেশন থেকে ৫০০ মাইল ব্যাসার্ধের ভেতর যা কিছু আছে—সব স্ক্যান করো। আই ওয়ান্ট এভরি বিট অফ ডাটা!আই ওয়ান্ট টু নো হোয়্যার দ্য হেল হি ইজ!”
ম্যাক্স তখন ফোনের ওপাশ থেকে বললো “কিন্তু স্যার, ওর সার্ভারগুলো ‘কোয়ান্টাম এনক্রিপ্টেড’। ওগুলো হ্যাক করা মানে ফেডারেল সরকারের নজরে পড়া। এটা আমাদের পুরো নেটওয়ার্ককে এক্সপোজ করে দিতে পারে।”
জাভিয়ান তখন চিৎকার করে বললো “আই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট দ্য নেটওয়ার্ক! মেক্সিকো সিটি যদি আজ সাইবার অ্যাটাকের কারণে অচল হয়ে যায়, তবে তাই হোক। মেইলস্ট্রোমের কোনো একটা ডিভাইসের সিগন্যাল কি কোনো স্যাটেলাইটে হিট করেনি? ওর কোনো একটা ট্রানজ্যাকশন কি কোনো সার্ভারে রেকর্ড হয়নি? আমি চাই ওর প্রতিটি ‘ফুুটপ্রিন্ট’ ট্রেস করো। মেইলস্ট্রোম যদি পাতালের কোনো কবরেও লুকিয়ে থাকে, আমি চাই সেই কবরের কোঅর্ডিনেটস!”
জাভিয়ান থামল না। সে রায়হানের দিকে ঘুরে হুকুম দিল—”রায়হান, ইন্টারপোল আর ব্ল্যাক-ওয়াটার ইনটেলিজেন্সকে জানিয়ে দাও, মেইলস্ট্রোমের যেকোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যদি এক সেন্টের নড়াচড়াও হয়, আমি যেন এক সেকেন্ডের মধ্যে জানতে পারি। ওর ডিজিটাল অস্তিত্ব আমি আজ মুছে দেব।”
.
.
.
.
এদিকে মেইলস্ট্রোমের তখন মরণপণ লড়াই চলছে। বিচ্ছুর বিষে তার শরীর নীল হয়ে গেছে, মুখ দিয়ে কালচে রক্ত বেরিয়ে আসছে। কিন্তু ঘোরের মাথায় সে এখনো বিজয়ী। সে জানে, জাভিয়ান বাইরে তাণ্ডব চালাচ্ছে, কিন্তু ‘গ্রে শ্যাডো’র ডিজিটাল দেয়াল ভেদ করা পৃথিবীর কোনো হ্যাকারের পক্ষে সম্ভব নয়—এমনটাই তার বিশ্বাস।
ডাক্তাররা যখন তার রক্ত পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে, তখন মেইলস্ট্রোম যন্ত্রণার মাঝেও অস্ফুট স্বরে হাসল। তার মনে হলো, জাভিয়ান হয়তো মেক্সিকোর রাস্তা শাসন করতে পারে, কিন্তু মেইলস্ট্রোম শাসন করে অন্ধকারের অদৃশ্য জাল।
.
.
.
.
ভিআইপি স্যুইটের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তান্বী তখনো জানে না, তাকে উদ্ধারের জন্য জাভিয়ান আজ পুরো মেক্সিকোর ডিজিটাল জগতকে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।
.
.
জাভিয়ানের কমান্ড সেন্টারে হঠাৎ একটি লাল আলো জ্বলে উঠল। ম্যাক্স তখন বললো “স্যার! একটা ব্রেকথ্রু পেয়েছি। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে একটা প্রাইভেট সিগন্যাল বারবার বাউন্স করছে। এটা মেইলস্ট্রোমের পার্সোনাল স্যাটেলাইট ফোনের এনক্রিপশন প্যাটার্নের সাথে ম্যাচ করছে। লোকেশনটা একটা আইসোলেটেড রক আইল্যান্ড… কোডনেম: গ্ৰে শ্যাডো।”
জাভিয়ানের মুখে এক পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল। সে তার হাতে থাকা রিভলবারটা লোড করতে করতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো “হেলিকপ্টার রেডি করো। আজ রাতে সমুদ্রের পানি আর নীল থাকবে না… আজ ওটা মেইলস্ট্রোমের লোকদের রক্তে লাল হবে।”
.
.
.
.
‘গ্রে শ্যাডো’র সেই আভিজাত্যমাখা দামী স্যুইটে তান্বী এখন পুরোপুরি একা নয়। মেইলস্ট্রোমের নির্দেশে চার-পাঁচজন নারী সার্ভেন্ট তাকে ঘিরে আছে। কেউ তার চুল সেট করে দিচ্ছে, কেউ ঘরের কোণ পরিষ্কার করছে। সবার মুখ পাথরের মতো শক্ত, কারো মুখে কোনো কথা নেই।
তান্বী আয়নার সামনে বসে নিজের বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ আগের সেই বীভৎস দৃশ্য—মেইলস্ট্রোমের বিচ্ছু খাওয়া আর মুখ দিয়ে কালো রক্ত বের হওয়া—সেটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে কৌতূহল আর ভয় মেলাতে না পেরে পাশের এক সার্ভেন্টকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল—”আচ্ছা, ওই যে ওনার নামটা যেন কী? মেইল… নাকি ময়দার মেইল? ওই লোকটা কি মারা যাবে? যেভাবে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল, বাঁচবে বলে তো মনে হয় না।”
সার্ভেন্টটি ভ্রু কুঁচকে তান্বীর দিকে তাকাল। সে স্প্যানিশ আর ভাঙা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষা বোঝে না। সে বিরক্তি নিয়ে নিজের ভাষায় কর্কশ স্বরে বলল, “What are you saying? No understand!”
ঠিক তখনই পেছন থেকে আর একজন নারী রক্ষী, যে মেইলস্ট্রোমের এই দুর্গে দোভাষীর কাজও করে, সে এগিয়ে এল। তার চাহনি বেশ তীক্ষ্ণ। সে তান্বীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল—”ওনার নাম মেইলস্ট্রোম, ‘ময়দার মেইল’ নয়। নিজের জিভ সামলে কথা বলো মেয়ে।”
তান্বী একটু ঘাবড়ে গেল, কিন্তু তার ভেতরের বাঙালি স্বভাবটা মরে যায়নি। সে মুখটা একটু বাঁকিয়ে বলল—
“সেটা যাই হোক! মেইলস্ট্রোম-ফ্রোম খুব কঠিন নাম। আমি বাবা এত কঠিন নাম বলতে পারব না। তার চেয়ে ওনাকে ‘ঝড়-তুফান’ ডাকলে কি খুব ক্ষতি হবে? স্ট্রোম মানেই তো ঝড়। তো আপনাদের ওই ঝড়-তুফান সাহেব তো বিচ্ছু খেয়েছে, এখন তো বিছানায় কাতরাচ্ছে। উনি সম্ভবত আর বাঁচবেন না, তাই না?”
তান্বীর কথা শুনে কক্ষের ভেতর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। দোভাষী রক্ষীটি রাগে কয়েক পা এগিয়ে এল তান্বীর দিকে। তার হাতের চাবুকটা মেঝেতে শব্দ করে বাড়ি খেল।
রক্ষী চিৎকার করে বললো “শাট আপ! একদম চুপ! তুমি আমাদের বস-কে মরে যেতে বলছ? তোমার সাহস তো কম নয়! উনি ওই মেক্সিকোর যম। বিচ্ছুর বিষ ওনাকে মারতে পারবে না। কিন্তু উনি যদি সুস্থ হয়ে জানতে পারেন তুমি ওনার মৃত্যু কামনা করছ, তবে জ্যান্ত অবস্থায় তোমাকে এই ক্যাসেলের নিচে সাগরের মাছদের খাওয়াবেন। তোমাকে কবরে পাঠানোর জন্য ওনার এক সেকেন্ড সময়ও লাগবে না!”
রক্ষীর সেই হিংস্র চেহারা দেখে তান্বীর কলিজা শুকিয়ে গেল। সে দ্রুত নিজের ঠোঁট টিপে ধরে মাথা নিচু করে ফেলল। মনে মনে ভাবল— “বাপরে! এই লোকটার চামচারাও তো দেখি বিচ্ছুর মতোই বিষধর। জাভিয়ানের পরিবারের কিছু লোকেরা আমাকে গালি দিত, কিন্তু এই ঝড়-তুফানের লোকজন তো দেখি জ্যান্ত কবর দেওয়ার ভয় দেখায়!”
সে চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল, যদিও জানালা দিয়ে বাইরের কিছুই দেখা যায় না। তান্বীর মনে হলো, এই ‘গ্রে শ্যাডো’ ক্যাসেল থেকে বের হওয়া মানে সাক্ষাৎ যমরাজের ঘর থেকে পালানো।
.
.
.
.
রাত তখন আনুমানিক দুটো। কক্ষের ভেতর এক গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ করেই ভারী বুট জুতোর শব্দে কেঁপে উঠল করিডোর। ধড়মড় করে উঠে বসল তান্বী। তার কক্ষের বিশাল ওক কাঠের দরজাটা এক ঝটকায় খুলে গেল।
দরজায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং মেইলস্ট্রোম। তার গায়ের সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে এখনো রক্তের ছোপ দেখা যাচ্ছে, গায়ের তাপমাত্রা হয়তো এখনো একশো চার ডিগ্রি। কিন্তু তার ধূসর চোখে এখন আর অসুস্থতা নেই, সেখানে এক অদ্ভুত পৈশাচিক জ্যোতি জ্বলছে। তার ডান হাতে একটি চওড়া খঞ্জর, যা থেকে টপটপ করে তাজা রক্ত ঝরছে।পেছনেই সেই দোভাষী রক্ষীটি ভয়ে কাঁপছে, যে কিছুক্ষণ আগে তান্বীকে ধমক দিয়েছিল।
মেইলস্ট্রোম ধীরপায়ে তান্বীর দিকে এগিয়ে এল। তান্বী ভয়ে বিছানার একদম কোণে চলে গেল। মেইলস্ট্রোম রক্ষীটির কলার ধরে হেঁচড়ে তান্বীর পায়ের সামনে নিয়ে এল।তারপর অত্যন্ত নিচু আর শীতল স্বরে বললো “আমার সোলফ্লেম (Soulflame)-এর সাথে কথা বলার সময় তোমার গলাটা একটু বেশি উঁচুতে ছিল না? তুমি ওকে কবর দেওয়ার ভয় দেখিয়েছ?”
রক্ষীটি কান্নায় ভেঙে পড়ল, “বস, মাফ করে দিন! আমি কেবল আপনার পক্ষ নিচ্ছিলাম…”
মেইলস্ট্রোম তখন বললো “আমার পক্ষে থাকার জন্য তুমি নেই। কিন্তু ও ভয় পেয়েছে—সেটা আমার সহ্য হচ্ছে না।”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মেইলস্ট্রোম অমানুষিক ক্ষিপ্রতায় তার খঞ্জরটা রক্ষীর গলার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিল। তান্বীর চোখের সামনে ফিনকি দিয়ে ছিটকে এল গরম রক্ত। তার সাদা সিল্কের গাউনের নিচের দিকটা মুহূর্তেই লাল হয়ে গেল। রক্ষীটি কোনো গোঙানি দেওয়ার সুযোগও পেল না, নিথর দেহটা কার্পেটের ওপর আছড়ে পড়ল।
তান্বী দুহাতে কান চেপে ধরে আকাশফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠল— “নাআআ! ছেড়ে দিন ওকে! দয়া করুন! মারবেন না প্লিজ!”
মেইলস্ট্রোম রক্তমাখা হাত নিয়ে তান্বীর খুব কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। সে তান্বীর গালে লেগে থাকা রক্তের ছিটেটা নিজের আঙুল দিয়ে মুছে দিয়ে ফিসফিস করে বলল—”শান্ত হও, তান্বী। দেখো, ও তোমাকে ভয় দেখিয়েছিল, আমি ওকে শেষ করে দিয়েছি। এখন থেকে আর কেউ তোমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলবে না। এই প্রাসাদে আমার পরেই তোমার স্থান। আজ থেকে তোমার চোখের এক ফোঁটা জলের বদলে আমি এই দুর্গ রক্তে ভাসিয়ে দেব।”
মেইলস্ট্রোমের সেই রক্তমাখা চেহারা আর পৈশাচিক উন্মাদনা দেখে তান্বীর চোখের সামনে পৃথিবীটা ঘুরতে শুরু করল। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে আর সহ্য করতে পারল না; মেইলস্ট্রোমের সেই দানবীয় চাহনির দিকে তাকিয়েই সে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
মেইলস্ট্রোম তার অচেতন দেহটা পরম মমতায় কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর তার কপালে রক্তমাখা ঠোঁট দিয়ে এক দীর্ঘ চুমু খেয়ে বিড়বিড় করল—”ইউ আর মাইন, সোলফ্লেম। জাভিয়ান আজন্ম খুঁজলেও এই রক্তের দেয়াল টপকে তোমার কাছে পৌঁছাতে পারবে না।”
অজ্ঞান তান্বীর ফ্যাকাশে মুখটা মেইলস্ট্রোমের কোলে ঢলে পড়ে আছে। কক্ষের মেঝেতে তখনো সেই সার্ভেন্টের রক্ত তাজা। মেইলস্ট্রোম তান্বীর শরীরে একটি বড় কালো ওভারকোট জড়িয়ে দিল যাতে তার রক্তমাখা সিল্কের গাউনটা ঢাকা পড়ে যায়।
ঠিক তখনই ক্যাসেলের ভেতরে সাইরেন বেজে উঠল। মেইলস্ট্রোমের এক বিশ্বস্ত গার্ড দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল।
গার্ড বললো “বস! জাভিয়ানের তিনটা ব্ল্যাক-হক হেলিকপ্টার আমাদের রেডার জোন ক্রস করেছে। ওরা সরাসরি এয়ার-স্ট্রাইক করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের হাতে সময় নেই!”
মেইলস্ট্রোমের ঠোঁটে এক তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। সে তান্বীকে দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বললো “জাভিয়ান ভাবছে সে আমাকে এক জায়গায় বন্দি করে মারবে? ও জানেই না যে ‘গ্রে শ্যাডো’র আসল পথ আকাশের দিকে নয়, বরং মাটির গভীরে।”
মেইলস্ট্রোম ঘরের বিশাল ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার পেছনে একটি গোপন সুইচ টিপল। এক নিমিষেই বিশাল আয়নাটা সরে গিয়ে একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথ বের হয়ে এল। এই পথটি সরাসরি পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সমুদ্রের একদম তলার একটি গোপন ডকিং স্টেশনে চলে গেছে।
টানেলের ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে আর ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেবল মেইলস্ট্রোমের গার্ডদের টর্চলাইটের আলো সেই অন্ধকারকে চিরে দিচ্ছে। মেইলস্ট্রোম অত্যন্ত দ্রুতগতিতে টানেল দিয়ে এগোচ্ছে। তার বুকের ভেতর তান্বীর অচেতন শরীরের উষ্ণতা তাকে এক অদ্ভুত উন্মাদনা দিচ্ছে।
হঠাৎ ওপর থেকে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। পুরো টানেলটা ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল। পাথরের টুকরো উপর থেকে খসে পড়তে লাগল। জাভিয়ানের প্রথম মিসাইলটি ‘গ্রে শ্যাডো’র প্রধান টাওয়ারে আঘাত হেনেছে।
মেইলস্ট্রোম দাঁতে দাঁত চেপে বললো “জাভিয়ান, ধ্বংস কর এই প্রাসাদ! কিন্তু মনে রাখিস, তুই যখন এই ধ্বংসস্তূপ খুঁড়বি, তখন এখানে আমার বা তান্বীর কোনো অস্তিত্ব পাবি না। আমি ওকে নিয়ে এমন এক জায়গায় যাচ্ছি যেখানে পৌঁছানোর ক্ষমতা তোর ওই মেক্সিকো সিটিরও নেই।”
প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর তারা টানেলের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছালো। সেখানে একটি অত্যাধুনিক কালো সাবমেরিন অপেক্ষা করছে। মেইলস্ট্রোম তান্বীকে নিয়ে সাবমেরিনের ভেতরে প্রবেশ করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাবমেরিনটি নিঃশব্দে সমুদ্রের অতল গহ্বরে ডুব দিল। ওপরের আকাশে তখন জাভিয়ানের হেলিকপ্টারগুলো থেকে ক্রমাগত গুলি আর বোমা বর্ষণ করা হচ্ছে, কিন্তু সমুদ্রের গভীর অন্ধকারে মেইলস্ট্রোম আর তান্বী এখন জাভিয়ানের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জ্ঞান হারানো তান্বী জানলও না যে তার জন্য পুরো একটি পাহাড় আজ অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে। আর জাভিয়ান যখন সেই ধ্বংসস্তূপে নামবে, তখন সে কেবল ছাই ছাড়া আর কিছুই পাবে না।
‘গ্রে শ্যাডো’ ক্যাসেল এখন এক জ্বলন্ত নরক। জাভিয়ানের একের পর এক মিসাইল হামলায় পাথুরে দুর্গটি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। হেলিকপ্টার থেকে র্যাপেলিং করে জাভিয়ান যখন সেই ধ্বংসস্তূপে নামল, তার হাতে রিভলবার আর চোখে রক্তপিপাসা। সে পাগলের মতো প্রতিটি কক্ষ খুঁজছে, পাথরের টুকরো সরাচ্ছে, কিন্তু কোথাও প্রাণের চিহ্ন নেই।
সবকিছু তছনছ করে জাভিয়ান যখন সেই গোপন ভিআইপি স্যুইটের ধ্বংসাবশেষের সামনে পৌঁছালো, তখন দেখল সেখানে কেবল নিথর নীরবতা। মেইলস্ট্রোম বা তান্বী—কেউ নেই। কেবল এক কোণে সেই সার্ভেন্টের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে।
জাভিয়ান এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। তার সারা শরীর কাঁপছে। সে গলার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল— “তান্বীইইই!”
তার সেই গগনবিদারী চিৎকারে পাহাড়ের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হতে লাগল। জাভিয়ান হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো কক্ষের ভেতরটা লন্ডভন্ড করতে শুরু করল। রায়হান দ্রুত দৌড়ে এসে জাভিয়ানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।”স্যার! শান্ত হোন! এখানে কেউ নেই। মেইলস্ট্রোম কোনো গোপন পথ দিয়ে ওকে নিয়ে পালিয়েছে। আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে, পুরো পাহাড় ধসে পড়ছে!”
জাভিয়ান রায়হানকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললো “শান্ত হব? ও এখানে ছিল রায়হান! আমি ওর উপস্থিতি অনুভব করতে পারছি! ওই শয়তানটা ওকে নিয়ে গেছে আর তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছো?”
বলতে বলতে জাভিয়ান হঠাৎ মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার সেই উদ্ধত অহংকার আজ চুরমার। সে উন্মাদের মতো দুহাতে নিজের চুল খামচে ধরল। ঠিক তখনই তার নজরে এল ড্রেসিং টেবিলের ভাঙা আয়নার পাশে পড়ে থাকা একটি লাল রঙের পোশাক—সেই সিল্কের থ্রিপিসটা, যা তান্বী শেষবার পরেছিল।
জাভিয়ান কম্পিত হাতে জামাটা তুলে নিল। পোশাকটি এখনো তান্বীর শরীরের সেই চিরচেনা ঘ্রাণে ম ম করছে। জাভিয়ান উন্মাদের মতো পোশাকটি নাকে চেপে ধরল, দীর্ঘ শ্বাস নিল। মনে হলো ওই ঘ্রাণটুকুই এখন তার বেঁচে থাকার একমাত্র অক্সিজেন। সে জামাটা বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠল।
জাভিয়ান কান্নাভেজা রুদ্ধ স্বরে বললো “আই অ্যাম সরি তান্বী… আই অ্যাম সো সরি। আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারিনি। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, মেইলস্ট্রোমের আমি এমন অবস্থা করবো যা আজ পর্যন্ত কেউ কোনো নরকেও দেখেনি। আমি তোমাকে খুঁজে বের করবই, মরণ দিয়ে হলেও তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনব।”
জাভিয়ানের সেই রুদ্রমূর্তির মাঝে এই অসহায়ত্ব দেখে রায়হানও চোখের জল ধরে রাখতে পারল না।তার দেখা হ্নদয়হীন পাথর মানুষটাও আজ এক টুকরো কাপড়ের মাঝে নিজের পৃথিবীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
.
.
.
.
সমুদ্রের অতল গহ্বরে নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে সেই কালো সাবমেরিন। ভেতরে এক কৃত্রিম স্তব্ধতা। ঠিক সেই মুহূর্তে তান্বীর চোখের পাতা কেঁপে উঠল। তার জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই পৈশাচিক দৃশ্য—মেইলস্ট্রোমের রক্তমাখা খঞ্জর আর সেই রক্ষীর নিথর দেহ।
তান্বী ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার সারা শরীর আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে। তার দাঁতে দাঁত লেগে এক অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। ঠিক তখনই অনুভব করল, তার কাঁধের ওপর পাথরের মতো শক্ত আর শীতল একটা হাতের স্পর্শ।
মেইলস্ট্রোম অত্যন্ত শান্ত কিন্তু গভীর স্বরে বললো “ভয় পেও না সোলফ্লেম। যা হয়েছে তা তোমার ভালোর জন্যই হয়েছে।”
তান্বী কাঁপা কাঁপা চোখে মেইলস্ট্রোমের দিকে তাকাল। লোকটার চোখে এখনো সেই আদিম উন্মাদনা। মেইলস্ট্রোম তান্বীর কাঁধটা আরও শক্ত করে ধরে তার মুখের খুব কাছে নিজের মুখ নিয়ে এল।
“তুমি কি জানো তান্বী, আমার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ কোনটা?”
তান্বী ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, “ক-কী?”
মেইলস্ট্রোম বললো “তোমার নাম। ‘তান্বী’… এই নামটা যখন আমার কানে বাজে, মনে হয় কোনো অপার্থিব সুর শুনছি। তুমি আমার কে জানো? তুমি আমার ‘ডিজায়ার আনলিশড’ (Desire Unleashed)। আমার মাসের পর মাস ধরে জমিয়ে রাখা সেই অবদমিত বাসনা, যা আজ শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে।”
তান্বী অবিশ্বাসে মাথা নাড়তে লাগল। তার দুচোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে “আমি… আমি তো আপনাকে চিনিই না! কোনোদিন দেখিনি আপনাকে। কেন আমার সাথে এমন করছেন? শুধু জাভিয়ানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে এভাবে তিলে তিলে মারছেন?”
মেইলস্ট্রোম এক মুহূর্তের জন্য চুপ থাকল, তারপর তার ঠোঁটের কোণে সেই বাঁকা রহস্যময় হাসিটা ফুটেয়ে বললো “ইয়েস! তুমি জাভিয়ানের সেই সম্পদ, যেটা আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। জাভিয়ান চৌধুরী আজন্ম যা কিছু আগলে রাখতে চেয়েছে, আমি তা-ই কেড়ে নিয়েছি। কিন্তু তোমাকে পাওয়াটা কেবল প্রতিশোধ নয় তান্বী, তোমাকে পাওয়াটা আমার নেশা। ও তোমাকে ডিভোর্স দিক বা না দিক, ও তোমাকে খুঁজে পাক বা না পাক—আজ থেকে এই অন্ধকার সাগরের নিচে তুমি কেবলই আমার।”
তান্বী বুঝতে পারলো সাবমেরিনের বাইরের অন্ধকার পানির মতোই তার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।সাবমেরিনের কৃত্রিম আলোয় মেইলস্ট্রোমের ধূসর চোখ দুটো তখন জ্বলজ্বল করছিল। তান্বী বুঝতে পারছিল না এই লোকটা মানুষ নাকি কোনো দানব, যে খুনের নেশা আর প্রেমের নেশাকে এক করে ফেলেছে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে একটু সাহসের সাথে কথা বলার চেষ্টা করল। “দেখুন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি অনেক বড় ক্ষমতাশীল কেউ, সম্ভবত অনেক বড় কোনো মাফিয়া বস। কিন্তু আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন আপনি কার পেছনে ছুটছেন? আমি বাংলাদেশের একজন অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। জাভিয়ান আমাকে কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিল, ভালোবেসে নয়। আমার মধ্যে এমন আহামরি কিছু নেই যার জন্য জাভিয়ান চৌধুরী আমাকে খুব আগলে রাখবে, কিংবা আপনার মতো একজন মানুষকে আমার জন্য পাগল হতে হবে। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন!”
মেইলস্ট্রোম তান্বীর কথা শুনে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। সে তার তর্জনী আঙুলটা তান্বীর ঠোঁটের ওপর আলতো করে চেপে ধরে বললো “হুশশশ! তুমি নিজেও জানো না তোমার মধ্যে কী আছে, সোলফ্লেম। তুমি আয়নায় কখনো নিজের চোখদুটো ভালো করে দেখেছো? অবিকল হরিণীর মতো মায়াবী দুটো চোখ। এই চোখ যার দিকে একবার তাকাবে, সে তার নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাবে।”
মেইলস্ট্রোম তার হাত বাড়িয়ে তান্বীর একগুচ্ছ চুল ছুঁয়ে দেখল। তার স্পর্শে তান্বী ঘৃণায় শিউরে উঠল, কিন্তু লোকটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
মেইলস্ট্রোম আবার বললো “তোমার এই লম্বা মেঘের মতো চুল… আর তোমার এই ঠোঁট দেখেছো কখনো? যেন কোনো রক্ত কমল ফুলের পাপড়ি! তুমি নিজেকে সাধারণ বলছো? তুমি কোনো সাধারণ মেয়ে নও। তুমি সম্ভবত কোনো রাজ্যের পরি, যে ভুল করে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে চলে এসেছে। আর এই পৃথিবীর বিরল সম্পদ কেবল আমারই প্রাপ্য। জাভিয়ান তোমাকে আগলে রাখুক বা না রাখুক, আমি তোমাকে এমনভাবে আগলে রাখব যে মরণও তোমাকে ছুঁতে ভয় পাবে।”
তান্বী স্তব্ধ হয়ে গেল। মেইলস্ট্রোমের চোখে তখন এক ভয়ংকর অধিকারবোধ। সে বুঝতে পারল, জাভিয়ান হয়তো তাকে স্রেফ একটা ‘ডিল’ মনে করত, কিন্তু এই লোকটা তাকে একটা ‘বিরল বস্তু’ মনে করে—যাকে সে কোনোদিন হাতছাড়া করবে না।
সাবমেরিনটি তখন সমুদ্রের গভীরে আরও গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক যেমন তান্বীর বাঁচার আশাটুকুও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
মেইলস্ট্রোমের সেই নেশাতুর চাহনি আর স্তুতি বাক্যগুলো তান্বীর কানে প্রশংসার মতো নয়, বরং চাবুকের মতো বিঁধছিল। তার অবয়ব জুড়ে এখন কেবল চরম বিরক্তি আর আতঙ্ক। সে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতে দিতে ডুকরে কেঁদে উঠল।
তান্বী মনে মনে বললো “হে আল্লাহ! এখন মনে হচ্ছে সুন্দর হওয়াটাই এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বড় পাপ। আপনি কেন আমাকে কুৎসিত করে বানালেন না? একটু কদর্য দেখতে হলে হয়তো আজ এই ‘ঝড়-তুফান’ লোকের হাতে এভাবে বন্দি হতে হতো না। এই রূপ তো আমার আশীর্বাদ নয়, এ তো আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে!”
মেইলস্ট্রোম তান্বীর মনের হাহাকার বুঝতে পারল না। সে ভাবল তান্বী হয়তো তার কথা শুনে লজ্জা পাচ্ছে। সে আরও কাছে ঝুঁকে এল। সাবমেরিনের মৃদু নীল আলোয় মেইলস্ট্রোমের গালের সেই ক্রুশ চিহ্নটা এখন আরও স্পষ্ট।”কী ভাবছো সোলফ্লেম? তুমি কি ভাবছো জাভিয়ান তোমাকে বাঁচাতে আসবে?আসবেনা ও তোমাকে পাবেইনা কারন তুমি আছো আমার হৃদস্পন্দনের ঠিক পাশেই।”
তান্বী ঘৃণাভরে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল, যেন কোনো অলৌকিক কিছু ঘটে। সুন্দর রূপের যে জালে সে আটকা পড়েছে, সেই জাল ছিঁড়ে পালানোর কোনো পথ তার জানা নেই।
অন্যদিকে, সমুদ্রের উপরিভাগে জাভিয়ান তখনো তান্বীর পোশাকটা বুকে চেপে ধরে আছে। তার চোখ এখন আগ্নেয়গিরির লাভার মতো লাল। সে বুঝতে পেরেছে শত্রু মাটির ওপর নেই, শত্রু এখন অতল গভীরে।
জাভিয়ান চিৎকার করে বললো “সোনার ইনস্ট্রুমেন্টগুলো অন করো! আমি চাই প্রতিটি সোনার ওয়েভ চেক করা হোক। সাবমেরিন হোক কিংবা তিমির পেট—মেইলস্ট্রোম যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, আমি সমুদ্র সেঁচে ওকে বের করব!”
সমুদ্রের অতল গহ্বরে চলতে থাকা সাবমেরিনটি হঠাৎ একটি বিশাল প্রাকৃতিক ফাটলের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করল। এটি মেক্সিকো উপকূল থেকে অনেক দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ভেতর দিয়ে যাওয়া পথ। এই পথের দেয়ালে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণে ‘ম্যাগনেটাইট’ আকরিক থাকায় কোনো প্রকার সোনার (Sonar) বা স্যাটেলাইট সিগন্যাল এখানে কাজ করে না। এটি একটি ‘ডেড জোন’।
মিনিট পনেরো পর সাবমেরিনটি যখন আবার পানির ওপর ভেসে উঠল, তান্বী বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। তাদের সামনে কুয়াশায় ঘেরা এক প্রাচীন দ্বীপ। দ্বীপটি উঁচু উঁচু পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ঢাকা, যা সবসময় মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। এই জায়গার নাম ‘লা ইসলা দেল সাইলেন্সিও’ (Isla del Silencio) বা নিস্তব্ধতার দ্বীপ।
মেইলস্ট্রোম তান্বীর বিস্ময় দেখে মৃদু হাসল। আর বললো “এখানে কারো কোনো ড্রোন বা সাবমেরিন পৌঁছাতে পারবে না সোলফ্লেম। এই দ্বীপের অস্তিত্ব কেবল আমার মস্তিষ্কে আর আমার এই এনক্রিপ্টেড নেভিগেশনে আছে। এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই।”
তান্বী মনে মনে আবার আল্লাহর কাছে পানাহ চাইল। সে দেখল পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা এক রাজকীয় বাংলো, যেখানে মেইলস্ট্রোমের ব্যক্তিগত সশস্ত্র কমান্ডোরা পাহারায় আছে।
তান্বী মনে মনে আবার বললো “আল্লাহ, এ তো কোনো দ্বীপ নয়, এ তো পৃথিবীর শেষ সীমানা।কেউ কি কোনদিন আদৌ এই নিঝুম দ্বীপের হদিস পাবে? নাকি এই ঝড়-তুফান লোকটা আমাকে সারা জীবন এই নির্জনতায় বন্দি করে রাখবে?”
.
.
.
সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জাভিয়ান তখন হিংস্র পশুর মতো গর্জন করছে। তার হ্যাকাররা হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ম্যাক্স তখন বললো “স্যার… সিগন্যাল হারিয়ে গেছে। একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টের পর কোনো সাবমেরিনের অস্তিত্ব আমাদের রাডারে ধরা পড়ছে না। মনে হচ্ছে ওরা কোনো ন্যাচারাল ব্ল্যাক-হোল বা মেটালিক জোনে ঢুকে পড়েছে।”
জাভিয়ান রাগে তার হাতের গ্লাসটা সমুদ্রের পানিতে ছুড়ে মারল। তার ধমনীতে তখন প্রতিশোধের রক্ত ফুটছে।
জাভিয়ান রাগান্বিত স্বরে বললো “সিগন্যাল নেই মানে কী? পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চি স্ক্যান করো! ও যদি চাঁদেও গিয়ে লুকিয়ে থাকে, আমি সেখান থেকেও ওকে টেনে নামাব। মেইলস্ট্রোম… তুই ভাবছিস তুই জিতে গেছিস? খেলা তো কেবল শুরু হলো!”
.
.
.
লা ইসলা দেল সাইলেন্সিও-র সেই রহস্যময় বাংলোর বিশাল ডাইনিং হলে তান্বীকে নিয়ে আসা হলো। দ্বীপের বাইরের সেই গুমোট অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার ঠিক বিপরীতে এই ঘরটি আলোকোজ্জ্বল এবং রাজকীয়। বিশাল এক ওক কাঠের টেবিল জুড়ে সাজানো রয়েছে পৃথিবীর সব দামি আর সুস্বাদু খাবার—লেবানিজ কাবাব থেকে শুরু করে ফরাসি ডেজার্ট, কিছুই বাদ নেই।
মেইলস্ট্রোম তখন তার রক্তমাখা ব্যান্ডেজ বদলে একটি হালকা ধূসর রঙের সিল্কের শার্ট পরেছে। সে চেয়ার টেনে তান্বীকে বসার ইঙ্গিত দিল। তান্বী আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল, খাবারের দিকে তাকানোর রুচিও তার নেই।মেইলস্ট্রোম এক গ্লাস রেড ওয়াইন হাতে নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল।
“খাও সোলফ্লেম। অনেক ধকল গেছে তোমার ওপর দিয়ে। আর হ্যাঁ, একটা কথা…গ্ৰে শ্যাডোতে থাকার সময় তুমি আমাকে কী বলে সম্বোধন করছিলে যেন? ‘ঝড়-তুফান’?”
তান্বী চমকে উঠে তার দিকে তাকাল। সে ভেবেছিল ওই রুমের গার্ডদের বলা কথাগুলো হয়তো এই লোকটা শোনেনি। কিন্তু মেইলস্ট্রোমের কান যে দেয়ালের চেয়েও তীক্ষ্ণ!
মেইলস্ট্রোম তখন বললো “আই জাস্টলাভ ইট! এর আগে কেউ আমাকে এত সুন্দর নাম দেয়নি। সবাই মেইলস্ট্রোম বলতে ভয় পায়, আর তুমি আমাকে একটা ডাকনাম দিলে? ঝড়-তুফান… আমার ব্যক্তিত্বের সাথে বেশ মানানসই, তাই না? অন্তত জাভিয়ানের মতো পানসে কোনো নাম তো দাওনি।”
মেইলস্ট্রোম যখন নিজের মনেই হাসছে আর নামটা নিয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে, তান্বী তখন থালা ভর্তি খাবারের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। আর মনে মনে বললো “ইয়া মাবুদ! এই লোকটা তো দেখি শুধু খু/নি বা পিশাচ নয়, এ আস্ত একটা পাগল! মানুষের গলা কেটে আসার পর কেউ নিজের ডাকনাম নিয়ে এভাবে আহ্লাদ করে? এই ঝড়-তুফান লোকটা নির্ঘাত কোনো মেন্টাল হসপিটাল থেকে শিকল ছিঁড়ে পালিয়েছে। আল্লাহ, আমি কি শেষ পর্যন্ত এক উন্মাদ মাফিয়ার হাতে জীবন দেব?”
মেইলস্ট্রোম এক টুকরো চিজ মুখে দিয়ে তান্বীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তারপর বললো “কী ভাবছো? ঝড়-তুফান কি খুব বেশি ভয়ংকর মনে হচ্ছে? চিন্তা করো না, আমি কেবল জাভিয়ানের মতো মানুষদের দুনিয়ায় ঝড় তুলি। তোমার জন্য আমি কেবল এক পশলা প্রশান্তি হয়ে থাকব।”
তান্বী বিরক্তি আর ঘেন্নায় চোখ সরিয়ে নিল। সে বুঝতে পারল, এই লোকটার সাথে যুক্তিতে জেতা অসম্ভব। সে এখন এক এমন গোলকধাঁধায় বন্দি, যেখানে শিকারি নিজেই তার শিকারকে ‘ভালোবাসার’ নামে পুজো করছে।
তান্বী যখন মেইলস্ট্রোমের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল, মেইলস্ট্রোম তখন মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। তার চেহারায় এক ধরণের প্রশান্তি, যেন সে বড় কোনো যুদ্ধ জয় করে ফিরেছে।”খাবারগুলো নষ্ট করো না সোলফ্লেম।তুমি আমার খুব প্রিয়, তুমি দুর্বল হয়ে যাও এটা আমি চাইনা। আমি আসছি।”
মেইলস্ট্রোম ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তান্বী খাবারের প্লেটগুলোর দিকে ঘৃণার চোখে তাকাল। তার ভেতরে এক তীব্র জেদ কাজ করছে।
তান্বী (মনে মনে) বললো “তুমি ভাবছো তোমার ওই মায়াবী কথা আর রাজকীয় খাবারে আমি ভুলে যাব? কক্ষনো না। আমি পন করছি, আমি তোমার দেওয়া এক দানা অন্নও মুখে তুলব না। দেখি তুমি আমাকে কতদিন আটকে রাখো। আমি যদি না খেয়ে মরার মতো অবস্থায় পৌঁছে যাই, তখন অন্তত জাভিয়ানের কাছে বা কোনো হাসপাতালে পাঠাতে তুমি বাধ্য হবে। এই পিশাচের হাতে তিলে তিলে মরার চেয়ে না খেয়ে মরা অনেক সম্মানের।”
অন্যদিকে, মেইলস্ট্রোম তার স্টাডি রুমে গিয়ে একটি এনক্রিপ্টেড স্যাটেলাইট ফোন বের করল। তার চোখে এখন আর তান্বীর প্রতি সেই মায়া নেই, বরং সেখানে এক গভীর ষড়যন্ত্রের ছায়া। সে একটি নাম্বারে ডায়াল করল। ওপাশে কল রিসিভ হতেই মেইলস্ট্রোম গম্ভীর স্বরে বলল—”হ্যালো… তোকে এই দ্বীপে এখনই আসতে হবে। লোকেশন এবং প্রাইভেট জেটের ডিটেইলস তোর কাছে পৌঁছে যাবে।আমার তোকে এই মুহূর্তে দরকার।”
ওপাশ থেকে এক নারীর তীক্ষ্ণ কিন্তু মিষ্টি কন্ঠস্বর শোনা গেল—”অবশেষে তোমার আমাকে মনে পড়ল ব্রো? কাজটা কি নিয়ে?”
মেইলস্ট্রোম: “এলেই জানতে পারবি,তুই এখানে পৌঁছালে আমাদের ‘পাপেট শো’ শুরু করব। মেক্সিকো থেকে এখনই বের হ।”
ফোনটি রেখে দিয়ে মেইলস্ট্রোম জানালার বাইরে সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটের কোণে ঝুলে রইল এক পৈশাচিক হাসি। তান্বীকে নিজের কাছে রাখাটা যেমন তার নেশা, জাভিয়ানকে তিলে তিলে ধ্বংস করাটা তার তার চেয়েও বড় তৃপ্তি।
.
.
.
ডাইনিং টেবিলের ওপর রাজকীয় খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে জমে যাচ্ছে। তান্বী এক চুলও নড়েনি। তার সামনে রাখা সেই সুস্বাদু কাবাব আর ডেজার্টগুলো তার কাছে এখন বিষের মতো মনে হচ্ছে।
তান্বী (মনে মনে) “তুমি ভাবছো, তোমার এই সোনার খাঁচায় আমি দানা-পানি মুখে তুলে বেঁচে থাকব?আমি যদি না খেয়ে এখানে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাই, তবুও তোমার দেওয়া এক ফোঁটা পানিও আমি স্পর্শ করব না। মরে গেলে অন্তত এই পৈশাচিক নরক থেকে মুক্তি পাব। আল্লাহ, আমাকে ধৈর্য দিন।”
সার্ভেন্টরা কয়েকবার এসে খাবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও তান্বী পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। তার শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, কিন্তু মনের জেদ তাকে স্থির করে রেখেছে।
গভীর রাতে পাহাড়ের ঢালে লুকানো রানওয়েতে একটি নামহীন প্রাইভেট জেট অবতরণ করল। জেটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল এক দীর্ঘদেহী তরুণী। তার পরনে কালো চামড়ার জ্যাকেট, চোখে দামী সানগ্লাস আর ঠোঁটে এক তাচ্ছিল্যের হাসি। মেইলস্ট্রোম নিজে তাকে স্বাগত জানাতে সেখানে উপস্থিত ছিল।
“ওয়েলকাম টু ‘লা ইসলা দেল সাইলেন্সিও’, ভ্যালেরিয়া (Valeria)। ভেবেছিলাম মেক্সিকো সিটির জৌলুস ছেড়ে আসতে তোর দেরি হবে।”
ভ্যালেরিয়া হলো মেইলস্ট্রোমের আপন খালাতো বোন। সে মেক্সিকোর আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিজের দুর্দান্ত সাহসের জন্য পরিচিত। ভ্যালেরিয়া তার সানগ্লাসটা খুলে মেইলস্ট্রোমের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো “ব্রো, তোমার ডাক পাওয়ার পর আমি এক মুহূর্ত দেরি করিনি।তোমার নতুন সব খেলায় আমি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তো তুমি জানোই।”
মেইলস্ট্রোম এক রহস্যময় হাসি দিল। “গুরুত্বপূর্ণ মানে? তুই এই খেলার সবচেয়ে বড় ট্রাম্প কার্ড। চল ভেতরে, তোর জন্য এক চমক অপেক্ষা করছে।”
.
.
.
টানা বারো ঘণ্টা অনশনের পর তান্বী এখন সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে। তার ঠোঁট শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল মেইলস্ট্রোম, আর তার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল সেই রহস্যময়ী তরুণী—ভ্যালেরিয়া।
তান্বী ধীরপদে চোখ মেলে তাকাল। কিন্তু সামনের মানুষটাকে দেখা মাত্রই তার হৃৎস্পন্দন যেন থমকে গেল। সে অবিশ্বাসে নিজের চোখ কচলল। তার মনে হলো সে কোনো দিবাস্বপ্ন দেখছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির পরনে পশ্চিমা পোশাক, চুলে আধুনিক কাট, আর চোখে এক ধরণের হিংস্র চাতুর্য। কিন্তু তার চেহারা… তার সেই গায়ের রঙ, নাকের গড়ন, আর চিবুকের সে ডিম্পলটা….
তান্বী অস্ফুট স্বরে বললো “এলিনা? আপা? তুমি এখানে কীভাবে?”
তান্বী থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। মেয়েটি হুবহু তার বড় বোন এলিনার মতো দেখতে! এলিনা, যার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলো ফারহানের মুখে, সে আজ এই মেক্সিকোর নির্জন দ্বীপে মেইলস্ট্রোমের পাশে দাঁড়িয়ে আছে?
তান্বীর চোখে তখন বিস্ময় আর আনন্দ একাকার হয়ে গেছে। সে সব দুর্বলতা ভুলে সোফা থেকে একপ্রকার ঝাঁপ দিয়ে এসে ভ্যালেরিয়াকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকের ভেতর জমে থাকা সব কষ্ট যেন এলিনা আপার এই পরিচিত চেহারার কাছে মুক্তি পেতে চাইল।
তান্বী কাঁদতে কাঁদতে বললো “আপা! তুমি বেঁচে আছো? তুমি এখানে কীভাবে এলে আপা? আমি তো ভেবেছিলাম আমি আর কোনোদিন তোমাকে দেখতে পাব না!তোমার মৃত্যুর কথা শুনে আমি শেষ হয়ে গিয়েছিলাম তুমি এখানে কেন?”
ভ্যালেরিয়া বিরক্তি আর অস্বস্তি নিয়ে তান্বীকে নিজের শরীর থেকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। সে নিজের জ্যাকেটটা ঝাড়তে ঝাড়তে মেইলস্ট্রোমের দিকে তাকিয়ে বললো “ব্রো, এই মেয়েটা কি পাগল? ও এভাবে আমাকে জাপটে ধরল কেন? আমাকে কি ওর কোনো হারানো আত্মীয় মনে হচ্ছে?”
তান্বী স্তব্ধ হয়ে গেল। এলিনা আপার কন্ঠস্বর তো এমন কর্কশ ছিল না! সে বারবার ভ্যালেরিয়ার মুখের দিকে তাকাচ্ছে—নাকের সেই তীক্ষ্ণতা, চোখের সেই গড়ন, হুবহু এক!
মেইলস্ট্রোম শান্ত গলায় বললো “শান্ত হও সোলফ্লেম। তুমি ভুল করছ। ও তোমার কোনো আপা নয়, ও আমার একমাত্র খালাতো বোন ভ্যালেরিয়া। ওর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এই মেক্সিকো সিটিতেই।”
তান্বী তখন বললো “অসম্ভব! আপনারা মিথ্যে বলছেন! পৃথিবীতে হুবহু একজন মানুষ এমন হতে পারে না। ও আমার এলিনা আপা। আমি প্রমাণ দিচ্ছি! আপনার ফোনটা দিন আমাকে, আমি আপার ফেসবুক আইডি দেখাচ্ছি আপনাদের!”
মেইলস্ট্রোম কিছুটা কৌতূহলী হয়ে ভ্যালেরিয়ার ফোনটা তান্বীর হাতে দিল। তান্বী কাঁপতে কাঁপতে এলিনার প্রোফাইল বের করে সামনে ধরল। ফোনের স্ক্রিনে এলিনার ছবি দেখে মেইলস্ট্রোম আর ভ্যালেরিয়া—দুজনেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য পাথরের মতো জমে গেল। স্ক্রিনের মেয়েটি আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যালেরিয়ার মধ্যে চুলের স্টাইল আর পোশাক ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই। মনে হচ্ছে তারা যমজ বোন।
ভ্যালেরিয়া নিজেও অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বলল যা তান্বী বুঝতে পারল না। মেইলস্ট্রোমের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং কিছুক্ষণ পর একটি পুরনো পারিবারিক অ্যালবাম নিয়ে ফিরে এল। সে একটি পাতা খুলে তান্বীর চোখের সামনে ধরে বললো
“এবার এটা দেখো তান্বী। এটা ভ্যালেরিয়ার ছোটবেলার ছবি। আরেকটা কিশোরী বেলার ছবি এই দেখো ওর মা, মানে আমার খালা। আর এই কিশোরী মেয়েটা ভ্যালেরিয়া। তোমার বোন যদি বাংলাদেশে থাকে, তবে এই মেয়েটি বাইশ বছর ধরে মেক্সিকোর এই অন্ধকার জগতে বড় হয়েছে। ও তোমার বোন এলিনা নয়।”
তান্বী অ্যালবামের সেই ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল।তার মনের ভেতর যে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল, তা এক নিমেষে দপ করে নিভে গেল। যে মেয়েটিকে সে নিজের শরীরের অংশ ভেবে জড়িয়ে ধরেছিল, সে আসলে এক ভয়ঙ্কর মাফিয়ার বোন।
তান্বী মেঝেতে বসে পড়ল। তার ভেতরকার সব শক্তি হারিয়ে গেছে। সে দুহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
তান্বী আর্তনাদ করে বললো “কেন এমন হয়? আল্লাহ, কেন এই পৃথিবীতে এত নিষ্ঠুর সব মিল থাকে? আমি ভেবেছিলাম আমি আমার বোনকে ফিরে পেয়েছি! কেন আমাকে এভাবে বারবার মিথ্যে আশা দিয়ে ভেঙে চুরমার করা হচ্ছে?”
মেইলস্ট্রোম ভ্যালেরিয়াকে ইশারায় পাশের একটি সাউন্ডপ্রুফ স্টাডি রুমে নিয়ে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ হতেই মেইলস্ট্রোম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরের উত্তাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো “দেখলি তো ভ্যালেরিয়া?মেয়েটি সুন্দর না?”
ভ্যালেরিয়া তখনো ঘোরের মধ্যে আছে। সে নিজের আইফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে নিজের মুখ দেখছে আর তান্বীর দেখানো সেই প্রোফাইল ছবির কথা ভাবছে। ভ্যালেরিয়া তখন বললো “ব্রো, এটা স্রেফ কাকতালীয় হতে পারে না! কিন্তু আসল কথা বলো, এই মেয়েটা কে? আর তুমি কেন একে এই দ্বীপে লুকিয়ে রেখেছো?”
মেইলস্ট্রোম ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখে এক পৈশাচিক উজ্জ্বলতা নিয়ে বললো “এই মেয়েটাই সেই মেয়ে, যাকে আমি বাংলাদেশে প্রথম দেখেছিলাম তান্বী। আমার এক মুহূর্তের ভালো লাগা আজ আমার নেশায় পরিণত হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় খবর হলো—এই তান্বী জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীর স্ত্রী যদিও ওটা জাভিয়ানের একটা ডিল ছিলো।”
‘জাভিয়ান’-এর নামটা শোনা মাত্রই ভ্যালেরিয়ার হাত থেকে ফোনটা কার্পেটে পড়ে গেল। তার চোখদুটো বিস্ময়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
মেইলস্ট্রোমের মুখে যখন সে শুনল তান্বী আসলে জাভিয়ানের স্ত্রী, ভ্যালেরিয়ার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। তার ফর্সা মুখটা অপমানে আর ঈর্ষায় মুহূর্তেই রক্তবর্ণ ধারণ করল।
ভ্যালেরিয়া বহু বছর ধরে জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীর জন্য পাগল। জাভিয়ানের সেই পাথুরে ব্যক্তিত্ব, তার নির্দয়তা আর তার ওই রহস্যময় চোখের মোহে ভ্যালেরিয়া নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। সে কতবার জাভিয়ানের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু জাভিয়ান তাকে কখনোই পাত্তা দেয়নি। সেই অহংকারী জাভিয়ান, যে কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাত না, সে কিনা বিয়ে করেছে? তাও আবার এই মায়াকাড়া সাধারণ একটা মেয়েকে?
ভ্যালেরিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো “জাভিয়ান বিয়ে করেছে? ওই আইস-ম্যান, যার হৃদপিণ্ড পাথরে তৈরি, সে এই মেয়েটার প্রেমে পড়েছে? না ব্রো, এটা অসম্ভব! জাভিয়ান কখনোই কোনো মেয়েকে নিজের জীবনে জায়গা দেয় না।”
মেইলস্ট্রোম ভ্যালেরিয়ার কাঁধে হাত রাখল। সে তার বোনের মনের জ্বালাটা অনুভব করতে পারছে।”বিশ্বাস কর আর নাই কর ভ্যালেরিয়া, এটাই সত্যি। জাভিয়ান এখন উন্মাদের মতো মেক্সিকো চষে বেড়াচ্ছে এই তান্বীর জন্য। ও এই মেয়েটার ওপর ‘অবসেসড’। ঠিক যেমন আমি একে পাওয়ার জন্য মরিয়া, জাভিয়ানও একে ফিরে পাওয়ার জন্য যেকোনো ধ্বংসলীলা চালাতে পারে।”
ভ্যালেরিয়ার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল। সে ভাবছে, সে জাভিয়ানের জন্য এতকিছু করল, অথচ জাভিয়ান শেষ পর্যন্ত এই মেয়েটাকে নিজের করে নিল?
ভ্যালেরিয়া পাগলের মতো হাসতে হাসতে বললো “হাহাহাহা! কী অদ্ভুত ভাগ্য! আমি জাভিয়ানের জন্য পাগল, জাভিয়ান পাগল এই তান্বীর জন্য, আর তুমি পাগল সেই একই মেয়ের জন্য! তার মানে আমরা দুই ভাই-বোন এখন একই লড়াইতে লড়ছি? ব্রো, তুমি একে নিজের বিছানায় চাও, আর আমি চাই জাভিয়ানকে। কিন্তু জাভিয়ান যদি ওকে এতই ভালোবাসে, তবে আমি ওকে জ্যান্ত রাখব কেন?”
মেইলস্ট্রোম ভ্যালেরিয়ার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো “খবরদার ভ্যালেরিয়া! তান্বীর গায়ে আঁচড় লাগলে আমি ভুলে যাব যে তুই আমার বোন। জাভিয়ানকে পাওয়ার রাস্তা আমি তোমাকে করে দেব। আমি চাই ও যখন দেখবে ওর স্ত্রী এখন আমার দখলে, তখন ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। আর সেই ভাঙা জাভিয়ানকে তুই কুড়িয়ে নিস। কিন্তু তার আগে, এই মেয়েটাকে আমাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।”
ভ্যালেরিয়া তখন কক্ষের ভেতর পায়চারি করতে শুরু করল। তার মনের ভেতর এখন প্রতিহিংসার দাবানল। সে ভাবছে, যে জাভিয়ান তাকে কোনোদিন ফিরে দেখল না, সেই জাভিয়ানকে সে আজ ধ্বংস করবে। সে মেইলস্ট্রোমের পরিকল্পনায় রাজি হলো, কিন্তু তার মনের এক কোণে তান্বীর প্রতি চরম ঘৃণা দানা বাঁধতে লাগল।
.
.
.
তান্বী তখনো মেঝেতে বসে কাঁদছে। সে জানে না যে পাশের ঘরে তার জীবন নিয়ে এক নতুন ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সে শুধু ভাবছে, যে জাভিয়ানকে সে ঘৃণা করতে চেয়েছিল, সেই জাভিয়ানের কথা ভেবেই তার বুকটা আজ কেন ফেটে যাচ্ছে?
তান্বী (মনে মনে) বললো “জাভিয়ান… তুমি আমাকে একটা ডিল হিসেবে ব্যবহার করেছিলে ঠিকই, কিন্তু তোমার ওই রাগি শাসনও কি এই নরকের চেয়ে ভালো ছিল? এই ঝড়-তুফানের হাত থেকে কে বাঁচাবে আমাকে?”
.
.
.
মেইলস্ট্রোম যখন তান্বীর কক্ষে ফিরে এল, দেখল ডাইনিং টেবিলের রাজকীয় খাবারগুলো ঠিক আগের মতোই পড়ে আছে। তান্বীর অনশন ভাঙার কোনো লক্ষণ নেই। মেইলস্ট্রোম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে খাবারের প্লেটগুলোর ওপর হাত রাখল। খাবারগুলো অনেক আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে।
সে তান্বীর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল—”কী হলো সোলফ্লেম, এখনো খাবার স্পর্শ করলে না যে? খাবারগুলো কি তোমার পছন্দ হয়নি? যদি বাংলাদেশে ঝাল ঝাল কিছু খেতে ইচ্ছে করে, তবে বলো—আমার শেফ এখনই তৈরি করে দেবে।”
তান্বী মুখ ফিরিয়ে বসে রইল। তার কণ্ঠস্বর দুর্বল হলেও তাতে একধরণের জেদ ছিল। “আমি খাব না। আপনি যাই আনুন, আমার গলায় তা নামবে না। আমাকে মুক্তি দিন, আমি শুধু এইটুকু চাই।”
মেইলস্ট্রোম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তান্বীর খুব কাছে এসে বসল। তার চোখে এক মরণঘাতি মমতা ফুটে উঠল। “দেখো তান্বী, তুমি আমার কাছে চাঁদ চাইতে পারো, তারা চাইতে পারো… আমি সব এনে দেব। শুধু এই ‘মুক্তি’ শব্দটা আমার কাছে চেয়ো না। এটা বাদে তুমি যা বলবে, আমি তা-ই শুনব। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেয়ে নাও। নাকি আমি নিজের হাতে খাইয়ে দেব?”
‘নিজের হাতে খাইয়ে দেব’—মেইলস্ট্রোমের এই কথাটায় তান্বী শিউরে উঠল। এই পাগল লোকটার হাতে খাওয়ার চেয়ে না খেয়ে মরা ভালো। কিন্তু তার মাথায় তখন এক বুদ্ধি খেলে গেল। সে ভ্যালেরিয়াকে দিয়ে এখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে পারে, কারণ ওই মেয়েটিই একমাত্র মানুষ যে তার বোনের মতো দেখতে।
তান্বী তখন “না না! একদম না! আমি… আমি খাব। তবে এক শর্তে।”
মেইলস্ট্রোম ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “শর্ত? কী শর্ত?”
তান্বী বললো “আমি এক শর্তে খাবো। ওই যে আপনার বোন… কী যেন নাম ওনার? ম্যালেরিয়া?”
মেইলস্ট্রোমের মুখটা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। সে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তান্বীর দিকে তাকিয়ে বলল—”ওটা ‘ম্যালেরিয়া’ নয় তান্বী, ওর নাম ভ্যালেরিয়া (Valeria)।”
তান্বী তখন বললো “হোক একটা হলেই হলো! নাম দিয়ে কী হবে? ওই ম্যালেরিয়া আপুকে বলুন আমাকে খাইয়ে দিতে। উনি যদি আমাকে খাইয়ে দেন, তবেই আমি খাব। নাহলে আমি না খেয়েই মরব।”
মেইলস্ট্রোম মনে মনে একটু হাসল। সে বুঝল তান্বী আসলে ভ্যালেরিয়ার চেহারার তার বোনের সেই সাদৃশ্যের কারণেই তাকে কাছে চাইছে। মেইলস্ট্রোম ভাবল, এতে হয়তো তান্বীর মনটা একটু শান্ত হবে। “ঠিক আছে। তোমার জেদই জয়ী হোক। আমি ভ্যালেরিয়াকে পাঠাচ্ছি। তবে মনে রেখো সোলফ্লেম, খাবারটা শেষ করতে হবে।”
মেইলস্ট্রোম ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মনে মনে ভাবল, ভ্যালেরিয়া কি পারবে তান্বীর সাথে স্বাভাবিক অভিনয় করতে? কারণ ভ্যালেরিয়ার মনের ভেতর যে বিষ জ্বলছে, তা যদি তান্বী টের পায়, তবে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে।
.
.
.
মেইলস্ট্রোমের নির্দেশে ভ্যালেরিয়া খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে তান্বীর রুমে ঢুকল। তার মনের ভেতরে তখন আগ্নেয়গিরির লাভা ফুটছে—হিংসা আর আক্রোশে সে ফেটে পড়তে চাইছে। কিন্তু রুমে পা রাখামাত্রই দৃশ্যটা বদলে গেল।
তান্বী তখন বিছানার এক কোণে কুঁকড়ে বসে ছিল। ভ্যালেরিয়াকে দেখামাত্রই তার চোখের পলক স্থির হয়ে গেল। মেইলস্ট্রোম যতই বলুক এই মেয়েটি ভ্যালেরিয়া, তান্বীর অবচেতন মন মানতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, কোনো এক জাদুবলে তার এলিনা আপাই তার সামনে দাঁড়িয়ে।
ভ্যালেরিয়া রুক্ষ স্বরে বলল, “নাও, খাও। ব্রো বলেছে তোমাকে খাইয়ে দিতে। আমার একদম ইচ্ছে নেই এসব আদিখ্যেতা করার।”
তান্বী কোনো কথা না বলে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল। সে ভ্যালেরিয়ার খুব কাছে এসে তার চোখের দিকে তাকাল। সেই একই রকম চোখের মণি, একই রকম চাহনি। তান্বী হঠাৎ ভ্যালেরিয়ার হাতটা খপ করে ধরে ফেলল।”আপা.. আমি জানি তুমি ম্যালেরিয়া নও। আমি জানি না কেন তুমি নিজেকে লুকিয়ে রাখছো, কিন্তু তোমার এই হাত… ছোটবেলায় যখন আমি ভয় পেতাম, তখন তুমি ঠিক এভাবেই আমার হাত ধরতে। মনে পড়ে আপা?”
ভ্যালেরিয়া এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিতে চাইল, কিন্তু তান্বীর চোখের সেই টলটলে জল আর আকুতি দেখে সে কেমন যেন জমে গেল। জাভিয়ানের জন্য তার মনে যে ঘৃণা ছিল, তান্বীর এই নিষ্পাপ মুখটা দেখে তার এক শতাংশ যেন গলে গেল।
তান্বী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো “আপা,তুমি জানো জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী? মনে আছে তোমার সামনে দিয়ে আমাকে বিয়ে করে নিয়েছিলো? সে আসলে আমাকে একটা চুক্তির শিকলে বেঁধে রেখেছিল। আর এখন এই ঝড়-তুফান লোকটা আমাকে এই দ্বীপে বন্দি করে রেখেছে। আমার খুব ভয় করছে আপা! তুমি অন্তত আমাকে একটু সাহস দাও। তুমি এই পিশাচটার বোন হতে পারো না, তুমি তো আমার সেই এলিনা আপা যে আমাকে আদরে আদরে বড় করেছে।”
তান্বী ভ্যালেরিয়ার বুকে মাথা রেখে ছোট বাচ্চার মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ভ্যালেরিয়া পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার হাতটা কাঁপছে। সে বড় হয়েছে মেক্সিকোর অন্ধকার জগতে, যেখানে ভালোবাসা বা কান্না দুর্বলতার লক্ষণ। কিন্তু এই মেয়েটার গায়ের গন্ধ, তার গলার স্বর—সবই যেন ভ্যালেরিয়ার ভেতরের কোনো এক সুপ্ত তন্ত্রীতে আঘাত করল।
ভ্যালেরিয়া মনে মনে ভাবল, “এ কী হচ্ছে আমার? আমি তো একে ঘৃণা করতে এসেছি! জাভিয়ানের স্ত্রী হওয়ার অপরাধে একে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন এই মেয়েটার কান্না আমাকে এভাবে আবেগী করে তুলছে? কেন একে আমার নিজের ছোট বোন বলে মনে হচ্ছে?”
ভ্যালেরিয়ার চোখের কোণে এক ফোঁটা জল অলক্ষ্যে চিকচিক করে উঠল। সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তান্বীর পিঠে হাত রাখল। তার সেই রুক্ষ মেক্সিকান মেজাজ মুহূর্তের জন্য যেন বাঙালি মায়ার কাছে হেরে গেল।
ভ্যালেরিয়া অত্যন্ত নিচু স্বরে বললো “আমি তোমার আপা নই তান্বী… কিন্তু… তুমি যদি খাও, তবে আমি তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকব। কাঁদবে না একদম।”
তান্বী চোখের জল মুছে একটু হাসল। ওই হাসিটুকুর মাঝে ভ্যালেরিয়া যেন এক স্বর্গীয় জ্যোতি দেখতে পেল। সে যান্ত্রিকভাবে এক চামচ স্যুপ তুলে তান্বীর মুখে ধরল। তান্বী যেন এলিনা আপুর হাত থেকেই খাবার খাচ্ছে—এই বিশ্বাসে সবটুকু খেয়ে নিল।
তান্বী যখন ভ্যালেরিয়ার হাত থেকে খাবারগুলো খাচ্ছিল, তখন দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল। ভ্যালেরিয়ার মনের ভেতর জাভিয়ানকে নিয়ে জমে থাকা সেই পুরনো ক্ষতগুলো আবার টাটকা হয়ে উঠল। সে নিজেকে আর সামলাতে পারল না।
ভ্যালেরিয়া খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তান্বীকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, জাভিয়ান .. সে তোমাকে কীভাবে বিয়ে করল? ওর মতো মানুষ তো কোনো সাধারণ মেয়ের দিকে ফিরেও তাকানোর কথা নয়। তোমার সাথে ওর পরিচয় কোথায়?”
তান্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার বিয়ের সেই বিষাদময় অধ্যায়টা বলতে শুরু করল। জাভিয়ান কীভাবে তাকে বাংলাদেশ থেকে একপ্রকার জোর করে বা চুক্তির বিনিময়ে নিয়ে এসেছিল, কীভাবে তাকে অবজ্ঞা করত—সবই সে ভ্যালেরিয়াকে জানাল। তান্বী জানত না যে তার প্রতিটি শব্দ ভ্যালেরিয়ার বুকে তীরের মতো বিঁধছে।
সব শোনার পর ভ্যালেরিয়া এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর সে দূরে জানালার দিকে তাকিয়ে এক বিষণ্ণ হাসি হাসল আর মনে মনে ভাবলো “চুক্তি? অবজ্ঞা? অথচ সেই মানুষটা আজ তোমার জন্য পুরো মেক্সিকোকে শ্মশান বানাতে চাইছে! তান্বী, তুমি জানো না তুমি কতটা ভাগ্যবতী।
তারপর হঠাৎ করে সে তান্বীকে বললো “আমি জাভিয়ানকে বহু বছর ধরে চিনি। আমরা একসাথে মেক্সিকোর সবচেয়ে বড় বড় ক্যাসিনোতে বাজি ধরতাম, রাতভর জুয়া খেলতাম। আমাদের জগতটা ছিল একই—রক্ত, টাকা আর ক্ষমতার জগত।”
তান্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জাভিয়ানের জীবনের এই দিকটা তার কাছে সম্পূর্ণ অজানা।
ভ্যালেরিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “ক্যাসিনোর সেই ধোঁয়াময় টেবিলে আমি জাভিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কিন্তু ও তাকাতো কেবল কার্ডের দিকে। আমি ওর জন্য কত রাত অপেক্ষায় কাটিয়েছি, অথচ ও কোনোদিন আমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। যে জাভিয়ান কারো ওপর মায়া দেখায় না, সে তোমাকে বিয়ে করেছে—এটা ভাবলেই আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে।”
ভ্যালেরিয়ার কথাগুলো শুনে তান্বীর বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল। ক্যাসিনো, জুয়া, অন্ধকার জগত—এসব জাভিয়ানের জীবনের অংশ তা সে জানত, কিন্তু জাভিয়ানের সাথে এই মেয়েটির রসায়ন যে এত গভীর হতে পারে, তা সে কল্পনাও করেনি।
ভ্যালেরিয়া টেবিল থেকে গ্লাসটা সরিয়ে নিয়ে সরাসরি তান্বীর চোখের দিকে তাকাল। তার চোখে এখন ঈর্ষার এক তীক্ষ্ণ আভা।”তুমি কি জানো তান্বী, আমি জাভিয়ানকে কতটা ভালোবাসি? ভালোবাসি বললে ভুল হবে অবসেসড।দীর্ঘ পাঁচ বছর আমি ওর ছায়ার মতো পেছনে ঘুরেছি। ও যেখানেই ক্যাসিনো খেলতে যেত, আমি সেখানে হাজির হতাম। ওর প্রতিটি বাজি, ওর প্রতিটি জয়—সবকিছুর সাক্ষী আমি।”
তান্বী থমকে গেল। তার মনের কোণে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করল সে। যদিও সে জাভিয়ানকে ঘৃণা করতে চায়, কিন্তু অন্য কোনো নারীর মুখে জাভিয়ানের প্রতি এমন দাবি তার সহ্য হচ্ছে না।
তান্বী (মনে মনে) বললো “জাভিয়ান… তুমি তো সত্যিই এক রহস্য। তুমি কত মেয়ের সাথে মিশেছো, কতজনের সাথে রাত কাটিয়েছো তার কোনো হিসাব নেই। এই আপুটা, যে হুবহু এলিনা আপার মতো দেখতে, সেও কি তবে তোমার ওই হাজারো বান্ধবীর মধ্যে একজন?“
তান্বীর একটা কথা শুনে ভ্যালেরিয়ার চেহারায় এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময় খেলে গেল, পরক্ষণেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। তান্বীর এই সরলতা ভ্যালেরিয়ার কাছে একধরণের উপহাসের মতো মনে হলো।
তান্বী কিছুটা কৌতূহল আর কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো “আপনি ওকে এত ভালোবাসেন, অথচ আপনি বলছেন ও আপনাকে কোনোদিন পাত্তা দেয়নি! জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীতো চরিত্রহীন! কিন্তু আপনি তো অনেক সুন্দরী, স্মার্ট। সে আপনাকে কেন পছন্দ করল না?”
ভ্যালেরিয়া চিৎকার করে উঠল “কী বললে?! জাভিয়ান ক্যারেক্টারলেস? এসব আজেবাজে কথা তোমাকে কে বলেছে?”
ভ্যালেরিয়ার এই হঠাৎ আক্রমণাত্মক মেজাজে তান্বী কিছুটা দমে গেল, কিন্তু সেও দমবার পাত্রী নয়।”কেন? সে তো নিজেই একবার দম্ভ করে বলেছিল যে তার জীবনে আমি হলাম ৯৮ নাম্বার মেয়ে! তার মানে আমার আগেও তার জীবনে ৯৭ জন ছিল। আর ওই যে আপনার ভাই—ঝড়তুফান মাফিয়াটা—সেও তো বলল যে তারা নাকি একে অপরের পছন্দের নারীর সাথে… ওইসব জঘন্য সম্পর্ক করে। মানে শেয়ার করে।”
তান্বীর মুখে ‘শেয়ার’ করার কথাটা শুনে ভ্যালেরিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল। তার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু সে কিছু বলছে না। সে জানে মেইলস্ট্রোম কেন তান্বীকে এই মিথ্যেটা বলেছে। মেইলস্ট্রোম আসলে তান্বীর মনে জাভিয়ানের প্রতি ঘৃণা তৈরি করতে চায়, যাতে তান্বী কোনোদিন জাভিয়ানের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা না ভাবে।
ভ্যালেরিয়া দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল। সে খুব ভালো করেই জানে যে মেইলস্ট্রোম আর জাভিয়ানের মধ্যে এক অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। কিন্তু মেইলস্ট্রোম যেটা বলেছে, তার ওপর কথা বলার সাহস বা ইচ্ছা—কোনোটাই এখন ভ্যালেরিয়ার নেই। কারণ সে মেইলস্ট্রোমের অনুগত, আবার জাভিয়ানের জন্য তার মনে লুকানো হাহাকার।
ভ্যালেরিয়া শান্ত কিন্তু বিষণ্ণ স্বরে বললো “ব্রো যা বলেছে, সেটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে একটা কথা মনে রেখো তান্বী—মাফিয়াদের জগতে যা দেখা যায় তা সত্যি নয়, আর যা শোনা যায় তার পেছনেও থাকে অনেক গভীর রহস্য।”
ভ্যালেরিয়া তান্বীর প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দিল না। মেইলস্ট্রোম যে বিষবৃক্ষ তান্বীর মনে রোপণ করেছে, তার ওপর কথা বলে ভাইয়ের পরিকল্পনা নষ্ট করার ঝুঁকি সে নিতে চায় না।
ভ্যালেরিয়া শুধু একবার আড়চোখে তান্বীর দিকে তাকাল। মেকআপহীন ফ্যাকাশে মুখ, চোখের নিচে কান্নার কালচে দাগ, এলোমেলো চুল—তবুও মেয়েটার চেহারায় এমন এক মায়াবী আভাআছে যা ভ্যালেরিয়াকে ঈর্ষান্বিত করে তুলল। সে মনে মনে ভাবল, “সাধারণ মেয়ে? না, জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী সাধারণ কোনো কিছুর পেছনে ছোটে না। এই মেয়েটার চোখের ওই গভীরতা যেকোনো পুরুষকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। ওই নিষ্পাপ চাহনিই হয়তো জাভিয়ানের মতো হ্নদয়হীন আর মেইলস্ট্রোমের মতো পিশাচকে বশ করেছে।”
ভ্যালেরিয়া কোনো কথা না বলে কেবল ঠোঁট উল্টে এক রহস্যময় হাসি দিল। তারপর নিজের উঁচু হিলের ‘ঠক-ঠক’ শব্দ তুলে অত্যন্ত রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেই শব্দের প্রতিধ্বনি তান্বীর মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি তৈরি করল।
তান্বী একা ঘরে বসে রইল। তার কানে এখনো মেইলস্ট্রোমের বলা সেই কুৎসিত কথাগুলো বাজছে—তারা নাকি একে অপরের নারী শেয়ার করে! সে ঘৃণাভরে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলল।
.
.
.
.
মেইলস্ট্রোম সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছিল। ভ্যালেরিয়া তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল আর বললো “ব্রো, মেয়েটা তো তোমার আর জাভিয়ানের চরিত্র নিয়ে বেশ সন্দিহান। তুমি কি সত্যিই ওকে বিশ্বাস করিয়েছো যে তোমরা একে অপরের মেয়ে শেয়ার করো?”
মেইলস্ট্রোম ধোঁয়া ছেড়ে বললঝ “ঘৃণা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী দেয়াল, ভ্যালেরিয়া। ও যদি জাভিয়ানকে ঘৃণা করে, তবেই ও পালানোর চেষ্টা করবে না। আমি চাই জাভিয়ান যখন ওর সামনে আসবে, তান্বী যেন ওকে ত্রাণকর্তা নয়, বরং এক জানোয়ার হিসেবে দেখে।”
মেইলস্ট্রোমের কথা শুনে ভ্যালেরিয়া এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। সে তার ভাইয়ের নিষ্ঠুরতা জানে, কিন্তু এভাবে একজনকে মানসিকভাবে শেষ করে দেওয়াটা তার কাছেও একটু বেশিই মনে হচ্ছে। সে মেইলস্ট্রোমের চোখে চোখ রেখে সরাসরি প্রশ্ন করল। “ব্রো, তুমি জাভিয়ানকে ওর চোখে ক্যারেক্টারলেস বানিয়েছো, ওকে ছোট করেছো—এটা তো পেছন থেকে ছুরি মারার মতো কাজ হলো। আমি জানতাম ‘মেইলস্ট্রোম’ শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিরে দেয়, সে কখনো পেছন থেকে আঘাত করে না। তুমি কি তবে দুর্বল হয়ে পড়ছো?”
মেইলস্ট্রোম সিগারেটের ধোঁয়াটা জানালার দিকে ছেড়ে দিয়ে এক বিষণ্ণ কিন্তু তীক্ষ্ণ হাসি হাসল। সে ভ্যালেরিয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়াল, তার চোখে এখন এক ঠান্ডা লড়াইয়ের নেশা।
“এটা পেছন থেকে ছুরি মারা নয় ভ্যালেরিয়া, এটা হলো ‘কৌশল’। যুদ্ধক্ষেত্রে শুধুমাত্র পেশিশক্তি আর ক্ষমতা দিয়ে জেতা যায় না। সেখানে বুদ্ধি আর কৌশলও দরকার হয়। জাভিয়ান শক্তিশালী, সে নির্মম, কিন্তু তার মাথায় কোনো কৌশল নেই। সে শুধু জানে ধ্বংস করতে। আর আমি জানি কীভাবে মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলতে হয়।”
মেইলস্ট্রোম টেবিলের ওপর রাখা ম্যাপটার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলতে লাগল। “জাভিয়ান যদি তান্বীর সামনে হিরো হয়ে আসে, তবে তান্বী ওর পায়ে লুটিয়ে পড়বে। কিন্তু আমি যদি জাভিয়ানের ইমেজটা ওর সামনে এক লম্পট আর জানোয়ারের মতো তৈরি করতে পারি, তবে জাভিয়ান সামনে এলেও তান্বী নিজেই ওর থেকে দূরে সরে যাবে। আমি চাই জাভিয়ান নিজের জয় দেখেও হেরে যাক। ও যখন বুঝবে ওর স্ত্রী ওকে ঘৃণা করে, তখন ওর যে বুকটা ফাটবে—সেই আনন্দটাই আমার আসল জয়।”
ভ্যালেরিয়া অবাক হয়ে তার ভাইয়ের এই গভীর ষড়যন্ত্রের কথা শুনছিল। মেইলস্ট্রোম আসলে জাভিয়ানকে শারীরিকভাবে মারার আগে মানসিকভাবে পঙ্গু করতে চায়।
“জাভিয়ানের কাছে শক্তি আছে, কিন্তু আমার কাছে আছে ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতার চাবিকাঠি। বুদ্ধির এই দাবার চালটা ও ধরতেই পারবে না। ও কেবল শক্তির লড়াইয়ে লড়তে জানে, আর আমি ওর মনের গহীনে আগুন লাগিয়ে দেব।”
ভ্যালেরিয়া কেবল নিজের হিলের ঠক-ঠক শব্দ করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। তার মনে হলো, মেইলস্ট্রোম জাভিয়ানকে নিয়ে এক ভয়াবহ নরক তৈরি করছে। কিন্তু জাভিয়ান কি আসলেও এতটা বোকা? নাকি সে এই কৌশলের জাল ছিঁড়ে ফেরার কোনো পথ ইতোমধ্যে বের করে ফেলেছে?
চলবে………
(এখানে ৭৫০০ শব্দ আছে এরচেয়ে বেশি শব্দ দিলে ফেসবুক লাইট দিয়ে গল্প পড়তে পারবেন না, তাই দুই ভাগে গল্প দিবো। এই পর্বেও আগের পর্বের মতো ২ হাজার রিয়েক্ট করে ফেলুন তাহলে ২৪ এর শেষাংশ পেয়ে যাবেন কারন লেখাই আছে পর্ব।আর যদি না করেন তবে আমার ভালো আমি রেস্ট করতে পারবো। রিচেক করিনি ভুলত্রুটি থাকলে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন)
ডিজায়ার_আনলিশড ❤️🔥
✍️ #সাবিলা_সাবি
পর্ব-২৪ (শেষাংশ)
জাভিয়ানের প্রাইভেট শিপের কমান্ড রুমে তখন এক ভারী স্তব্ধতা। আধুনিক স্ক্রিনগুলোতে প্রশান্ত মহাসাগরের মানচিত্রের নীল আভা জাভিয়ানের পাথুরে মুখে আছড়ে পড়ছে। ঠিক তখনই রায়হান পকেট থেকে একটি পুরনো ফাইল বের করে কথা বলে উঠল। “স্যার, আপনার কি ভ্যালেরিয়ার কথা মনে আছে? সেই মেয়েটি, যে মেক্সিকো সিটির আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাসিনোগুলোতে আপনার ছায়ার মতো লেগে থাকত?”
জাভিয়ান স্ক্রিন থেকে নজর সরিয়ে রায়হানের দিকে তাকাল। তার চোখে এক বিষাক্ত স্মৃতির ঝিলিক নিয়ে বললো “মনে থাকবে না কেন? আমার ক্যাসিনো ক্লাবের সবচেয়ে শার্প জুয়ার পার্টনার ছিল সে। তাসের চালে ওকে হারানো ছিল প্রায় অসম্ভব।”
রায়হান তখন বললো “স্যার, আসল তথ্যটা ও গোপন করেছিল। ভ্যালেরিয়া আসলে মেইলস্ট্রোমের আপন খালাতো বোন! ও শুধু আপনার গেম পার্টনারই ছিল না, ও ছিল মেইলস্ট্রোমের পাঠানো সবচেয়ে বিশ্বস্ত চর।”
জাভিয়ান ডেক-এ পায়চারি করতে করতে একটা শীতল, ক্রুর হাসি দিল। রায়হান অবাক হয়ে দেখল জাভিয়ানের চেহারায় কোনো বিস্ময় নেই। “রায়হান, তুমি কী ভেবেছো আমি এতই বোকা? ভ্যালেরিয়া যে মেইলস্ট্রোমের কাজিন, সেটা আমি ক্যাসিনোতে আমাদের তৃতীয় গেমের দিনই বুঝে গিয়েছিলাম। ওর হাতের উল্কি আর কথা বলার ধরন— সবই মেইলস্ট্রোমের মতোই। তুমি তো জানোই, মেয়েদের প্রতি আমার একধরণের অ্যালার্জি আছে। কেউ আমার খুব কাছে এলে আমার গা ঘিনঘিন করে। কিন্তু তারপরেও যে ভ্যালেরিয়াকে আমি আমার গেম পার্টনার করেছিলাম, তার কারণ একটাই—আমি জানতাম ও মেইলস্ট্রোমের খালাতো বোন। ওকে আমি কাছে রেখেছিলাম যাতে মেইলস্ট্রোমের প্রতিটি খবর আমার নখদর্পণে থাকে।”
রায়হান স্তম্ভিত হয়ে গেল। জাভিয়ানের বুদ্ধির গভীরতা মেপে পাওয়া ভার। সে উত্তেজিত হয়ে বলল—”অসাধারণ স্যার! তাহলে ওকে এবার কাজে লাগান। ওর ক্যাসিনো আইডি আর আইপি ট্র্যাকিং করলেই আমরা ওর খোজ পেয়ে যাব। ও যেখানেই লগ-ইন করবে, আমাদের ট্র্যাকার তাকে ধরবে।”
জাভিয়ান থামল। রায়হানের কাঁধে হাত রেখে সে এক অদ্ভুত প্রশান্তির সাথে বলল—”ইউ আর গ্রেট রায়হান! তুমি প্রমাণ করে দিলে কেন তুমি আমার সেক্রেটারি হওয়ার যোগ্য। মেইলস্ট্রোম ভাবছে আমি রাগের মাথায় অন্ধ হয়ে দ্বীপে ঝাঁপ দেব, কিন্তু আমি ওকে ওর নিজের জালেই জড়াব। ভ্যালেরিয়াকে আমরা সরাসরি টার্গেট করব না, ওকে আমরা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করব মেইলস্ট্রোমের সাম্রাজ্যে ফাটল ধরাতে।”
রায়হানের কথায় জাভিয়ানের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। রায়হান ফাইলটা গুছিয়ে রেখে আরও একটু ঝুঁকে এসে বলল—”স্যার, কাজটা কিন্তু আমাদের জন্য আরও সহজ হবে। ভ্যালেরিয়া আপনার জন্য একদম পাগল ছিল। ক্যাসিনোতে কাটানো সেই দিনগুলোতে ও প্রায়ই আমাকে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞেস করত—কীভাবে আপনার মন গলানো যায়? কী করলে আপনি ওকে একটু আলাদাভাবে দেখবেন, একটু পছন্দ করবেন? ওর এই দুর্বলতাটুকু আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ওকে ইউজ করা এখন খুবই ইজি হবে।”
জাভিয়ান ধীরপদে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন তার মনের ভেতরের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি। জাভিয়ান অত্যন্ত গম্ভীর আর শীতল গলায় বললো “ইউজ তো ওকে আমি করবই রায়হান, তবে তুমি যেভাবে ভাবছো সেভাবে নয়। ভালোবাসা বা ইমোশন দেখিয়ে কাউকে ব্যবহার করা জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীর স্টাইল নয়। ওর আমার প্রতি যে দুর্বলতা, সেটাকে আমি মেইলস্ট্রোমের বিরুদ্ধে এক চরম বীজ হিসেবে ব্যবহার করব।”
রায়হান তখন বললো “বুঝলাম না স্যার। আপনি কি ওকে আমাদের দিকে টেনে আনবেন না?”
জাভিয়ান ধীর গলায় বললো “না। আমি চাই মেইলস্ট্রোম ভাবুক যে ভ্যালেরিয়া অলরেডি আমার সাথে হাত মিলিয়েছে। যখন একজন মাফিয়া তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষের ওপর বিশ্বাস হারায়, তখন তার সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। আমি ভ্যালেরিয়াকে এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি করব, যেখানে মেইলস্ট্রোম নিজেই ওকে শত্রু ভাবতে শুরু করবে। আর সেই সুযোগেই আমি আমার তান্বীকে ওখান থেকে ছিনিয়ে আনব।”
জাভিয়ান তার হাতের গ্লাসটা সজোরে টেবিলের ওপর রেখে বললো “মেইলস্ট্রোম কৌশল খেলছে,রায়হান, ট্র্যাকিং শুরু করো। ভ্যালেরিয়ার আবেগ দিয়ে নয়, বরং ওর অস্তিত্ব দিয়ে আমি মেইলস্ট্রোমের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকব।”
.
.
.
.
তিনটি দিন পার হয়ে গেছে। জাভিয়ান তার তুখোড় কৌশল আর ব্ল্যাক-স্কোয়াড নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের সেই নির্দিষ্ট জোনে অবস্থান করছে ঠিকই, কিন্তু ফলাফল শূন্য। রহস্যময় দ্বীপটির কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, জাভিয়ান যে চালই চালছে, কেউ একজন তা আগেভাগেই জেনে যাচ্ছে এবং পাল্টা চাল দিয়ে জাভিয়ানের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিচ্ছে।
শিপের ডেড-সাইলেন্ট কমান্ড রুমে জাভিয়ান জানালার বাইরে ধূসর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। জাভিয়ান খুব নিচু আর গম্ভীর স্বরে বললো “তিন দিন, রায়হান। তিন দিনেও আমরা ওই দ্বীপের এক ইঞ্চি মাটির নাগাল পেলাম না। প্রতিবার যখন আমরা কোনো সিগন্যাল ট্র্যাক করছি, সেটা ভুয়া প্রমাণিত হচ্ছে। আমার চালগুলো কেউ একজন আগে থেকেই উল্টে দিচ্ছে।”
রায়হান পাশেই দাঁড়িয়ে ল্যাপটপে ডেটা এনালাইসিস করছিল। জাভিয়ানের কথা শুনে সে মাথা তুলল।
জাভিয়ান আবার ও বললো “আমার মনে হচ্ছে রায়হান… আমার এই চালগুলো উল্টে দেওয়ার পেছনে এমন কেউ আছে যে আমার সবচেয়ে কাছের। আমার প্রতিটি নিশ্বাস আর প্রতিটি পদক্ষেপের খবর যার নখদর্পণে।”
এই কথাটা শোনা মাত্রই রায়হানের হাত থেকে একটা ফাইল টুপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। তার মুখটা মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে জাভিয়ানের ছায়ার মতো থাকা রায়হান ভাবতেই পারেনি জাভিয়ান তাকে এভাবে সন্দেহ করবে।
রায়হান অত্যন্ত আহত আর ধরা গলায় বললো “স্যার… আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ তো এই মুহূর্তে আমি। আপনার প্রতিটি প্ল্যান আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তার মানে… আপনি আমাকেই সন্দেহ করছেন?”
রায়হানের চোখে পানি টলমল করে উঠল। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, অপমানে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। সে ভাবল, যে জাভিয়ানের জন্য সে নিজের জীবন দিতে দ্বিধা করেনা, আজ সেই জাভিয়ান তাকেই বিশ্বাসঘাতক ভাবছে!
জাভিয়ান কয়েক মুহূর্ত রায়হানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে এসে রায়হানের কাঁধে শক্ত করে হাত রাখল। জাভিয়ানের কঠিন মুখটায় এক চিলতে মায়ার আভা দেখা দিল। “রায়হান! তুমি কি সত্যিই ভেবেছো আমি তোমাকে সন্দেহ করছি? না রায়হান… আমি এই পুরো পৃথিবীকে অবিশ্বাস করলেও তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহ কোনোদিন করব না। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আমার নিজের মৃত্যুর মতোই ধ্রুব আর সত্যি।”
রায়হান বিস্ময়ে জাভিয়ানের দিকে তাকাল। তার চোখের পানি টুপ করে গাল বেয়ে পড়ে গেল। জাভিয়ান তখন বললো “আমি শুধু অবাক হচ্ছি, তুমি-আমি ছাড়া আর কে এমন আছে যে আমার মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে বসে আছে? যে আমার চালগুলো পড়ার ক্ষমতা রাখে? শত্রু আমার ঘরের ভেতরের কেউই রায়হান, শত্রু আমার ঘরে থেকে কোনো অদৃশ্য সুতোর টানে আমার কাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে।”
রায়হান চোখের পানি মুছে নিজেকে সামলে নিল।জাভিয়ানের এই অগাধ বিশ্বাস তার ভেতরে নতুন শক্তি জোগাল। “ধন্যবাদ স্যার। আপনার এই বিশ্বাসটুকুই আমার কাছে সব। এবার আমি নতুন করে খুঁজব। মেইলস্ট্রোম যদি জাদু জানে, তবে আমরাও বিজ্ঞান দিয়ে তাকে টেনে বের করব।”
জাভিয়ান তখন মনে মনে ভাবল, তবে কি মেইলস্ট্রোম ছাড়াও তৃতীয় কোনো শক্তি এই খেলায় নেমেছে? কেউ কি গোপনে মেইলস্ট্রোমকে সাহায্য করছে? নাকি ভ্যালেরিয়া নিজের অজান্তেই কোনো ট্র্যাকার বা সিগন্যাল জাভিয়ানের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে যা আসলে মেইলস্ট্রোমেরই একটা ফাঁদ?
.
.
.
.
এই তিনটি দিন দ্বীপের সেই রহস্যময় বাংলোর ভেতরের পরিবেশ এক বিচিত্র রূপ নিয়েছে। একদিকে জাভিয়ান যখন বাইরের দুনিয়ায় হন্যে হয়ে খুঁজছে, অন্যদিকে এই বাংলোর এক বদ্ধ ঘরে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত মায়া আর বেদনার গল্প।
তান্বী গত তিনদিন ধরে এক মুহূর্তের জন্যও ভ্যালেরিয়াকে কাছছাড়া করতে চায় না। ভ্যালেরিয়া যতবারই বিরক্ত হয়ে দূরে সরে যেতে চায়, তান্বী ততবারই কোনো না কোনো অজুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। এমনকি রাতেও সে নিজের ঘরে না গিয়ে ভ্যালেরিয়ার সাথে ঘুমানোর বায়না ধরে।
মেইলস্ট্রোম প্রথমে আপত্তি করলেও তান্বীর কান্না আর জেদের কাছে হার মানে। তার মনে হয়েছিল, ভ্যালেরিয়ার চেহারার মিল যদি তান্বীকে শান্ত রাখে, তবে তাই হোক।
রাত তখন দুটো…..
পুরো দ্বীপে সুনসান নীরবতা। জানালার বাইরে কেবল সমুদ্রের গর্জন। ভ্যালেরিয়া পাশে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার শরীরের সেই মেক্সিকান পারফিউমের কড়া গন্ধ ছাপিয়েও তান্বীর কাছে মনে হচ্ছে এটা তার সেই এলিনা আপার গায়ের মায়াভরা গন্ধ।
তান্বী বালিশে মাথা রেখে ভ্যালেরিয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলো জানালার পর্দা চিরে ভ্যালেরিয়ার নাকে আর চিবুকে এসে পড়েছে। তান্বী সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে ভ্যালেরিয়ার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল।
তান্বী মনে মনে বললো “কেন তুমি আমার আপা হয়েও আপা নও? তোমার এই কপাল, এই বন্ধ চোখের পাতা—সবই তো আমার সেই চেনা মানুষের মতো। অথচ তোমার ভেতরে এক বিষাক্ত পৃথিবী লুকিয়ে আছে। আপা, তুমি কি জানো জাভিয়ান আমাকে কচ্ছপের মতো নিজের খোলসে বন্দি করে রেখেছিল? আর এখন আমি এমন এক মানুষের হাতে বন্দি যে আমার শরীর নয়, আমার আত্মাকে সহ বন্দি করতে চায়। আমি কার কাছে যাব আপা?”
ভ্যালেরিয়া ঘুমের ঘোরে একটু নড়ে উঠল। তান্বী দ্রুত নিজের চোখের জল মুছে ফেলল, কিন্তু কান্না থামছে না। সে ভ্যালেরিয়াকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার মনে হচ্ছে, এই শরীরটা যদি তার আপার না-ও হয়, তবুও এই ছোঁয়াটুকু তাকে অন্তত এক রাতের জন্য হলেও নরক থেকে দূরে রাখছে।
তান্বী ফিসফিস করে বলতে লাগল, “আমি জানি না কাল কী হবে।কেউ হয়তো আসবে আমাকে বাঁচাতে আর নয়তো এই ঝড়-তুফান মাফিয়াটা আমাকে চিরকালের জন্য আড়াল করে দেবে। কিন্তু আজ এই রাতে আমি শুধু আমার আপাকে পাশে চাই।”
ভ্যালেরিয়া হঠাৎ চোখ মেলে তাকাল। তান্বীর কান্নার শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেছে। সে দেখল তান্বী তার বুকে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কাঁদছে। ভ্যালেরিয়ার প্রথম ইচ্ছে হলো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে, কিন্তু তান্বীর থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীরটা দেখে সে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল।
ভ্যালেরিয়া খুব নিচু আর কর্কশ স্বরে বললো “আবার কাঁদছো? বলেছি না আমি তোমার আপা নই! আমাকে জড়িয়ে ধরে কেন নিজের সময় নষ্ট করছো?”
তান্বী কোনো উত্তর দিল না, শুধু আরও জোরে আঁকড়ে ধরল। ভ্যালেরিয়া অবাক হয়ে দেখল, তার পাথরের মতো কঠিন হৃদয়ের কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। যে মেয়েটাকে সে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তার চোখের জল এখন ভ্যালেরিয়ার সিল্কের নাইটগাউন ভিজিয়ে দিচ্ছে।ভ্যালেরিয়া অন্ধকারে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভাবল, জাভিয়ান আর মেইলস্ট্রোমের মতৈ মানুষ কেনো এই মেয়েটার জন্য পাগল হয়েছে—কারন এই সাধারণ মেয়েটার মায়ার কাছে সে নিজেও হেরে যাচ্ছে।
.
.
.
.
সময় যেন জাভিয়ানের কাছে থমকে গেছে, কিন্তু মনের ভেতরের অস্থিরতা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। দিনের পর দিন তান্বীর কোনো হদিস না পেয়ে জাভিয়ান এখন এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, যা যেকোনো মুহূর্তে ফেটে পড়তে পারে।
সেই রাতে জাভিয়ান ড্রয়িং রুমের সোফাতেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অবচেতন মনে সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। দেখল, চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা, আর সেই কুয়াশা চিরে তান্বী তার দিকে হেঁটে আসছে। তান্বীর চোখে সেই চিরচেনা মায়া। স্বপ্নে জাভিয়ান সব বাধা ভুলে তান্বীকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরল। তার কপালে, গালে, চিবুকে অসংখ্য চুমু এঁকে দিল সে। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সব হারিয়ে গেলেও এই মুহূর্তটা বাস্তব। জাভিয়ান বিড়বিড় করে বলছিল, “তান্বী, আর কোনো ডিল নেই, আর কোনো শর্ত নেই…তুমি এখন থেকে শুধু আমার হয়ে থাকবে।”
কিন্তু ঠিক তখনই কাঁচ ভাঙার এক বিকট শব্দে জাভিয়ানের ঘুমটা ভেঙে গেল। সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। চারপাশ অন্ধকার, নিস্তব্ধ। জানালার বাইরে বৃষ্টির শব্দ। জাভিয়ান হাহাকারের মতো দুহাত বাড়িয়ে তান্বীকে খুঁজল, কিন্তু তার শূন্য হাতের মুঠোয় ধরা দিল কেবল শীতল বাতাস।
এক নিমেষে জাভিয়ানের ভেতরের সেই ভয়ংকর ‘সাইকো’ সত্তাটা জেগে উঠল। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে, চোখের মণি লাল হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল, তান্বী পাশে নেই—এই ধ্রুব সত্যটা তার মস্তিষ্ক আর নিতে পারছে না। তার ভেতরের সেই পুরনো অসুখ, সেই চরম অধিকারবোধ আর উন্মাদনা তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। সে পাগলের মতো তার ঘরের আলমারি খুলে তান্বীর সেই জামাটা বের করল। সেটা নাকে চেপে ধরে তান্বীর গায়ের ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করল সে। কিন্তু তাতেও তার তৃষ্ণা মিটল না। জাভিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে এল।
জাভিয়ান ফিসফিস করে, নিজের মনেই বললো “তুমি নেই জিন্নীয়া… কিন্তু তোমাকে আমার কাছে অনুভব করতেই হবে। এই শূন্যতা আমাকে মেরে ফেলছে। আমি যদি তোমাকে ছুঁতে না পারি, তবে তোমার অস্তিত্বকে আমি আমার নিজের ভেতরে গেঁথে নেব।”
জাভিয়ান ড্রয়ার থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করল। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখে তখন এক পৈশাচিক উজ্জ্বলতা। সে ঠিক করল, তান্বীকে কাছে পাওয়ার জন্য সে এক চরম কাণ্ড করবে—যা কেবল একজন উন্মাদের পক্ষেই সম্ভব।
সে রায়হানকে চিৎকার করে ডাকল। “রায়হান! এখনই ডক্টরকে ডাকো। আমার শরীরে একটা পার্মানেন্ট ‘মার্ক’ চাই। এমন কিছু যা প্রতি মুহূর্তে আমাকে মনে করিয়ে দেবে তান্বী আমার চামড়ার নিচে মিশে আছে। আর হ্যাঁ, ওই দ্বীপের সিগন্যাল যদি আজ না পাওয়া যায়, তবে আমি এই পুরো শহরটাকেই জ্বালিয়ে দেব। আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না!”
জাভিয়ান সিদ্ধান্ত নিল, তান্বীকে খুঁজে বের করার আগ পর্যন্ত সে নিজেকে শান্ত রাখার জন্য তার শরীরের কোনো এক অংশে তান্বীর নাম বা কোনো চিহ্ন খোদাই করবে, যাতে প্রতিটি যন্ত্রণায় সে তান্বীর অস্তিত্ব অনুভব করে।
জাভিয়ানের ভেতরের উন্মাদনা এখন আর কোনো সীমানা মানছে না। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঘাড়ের বাঁ দিকটা দেখছে। ঠিক কানের নিচ থেকে শুরু করে ঘাড়ের পাশ বেয়ে কাঁধের ওপর পর্যন্ত জায়গাটা সে বারবার স্পর্শ করছে।
সেখানে প্রতিটি রক্তবিন্দুতে সে তান্বীর নাম শুনতে পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, এই নামের ছোঁয়া না থাকলে সে হয়তো আর কয়েক ঘণ্টা পরেই দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে।
জাভিয়ান ডক্টরকে রুমে আসতে বারণ করে নিজেই সেই তীক্ষ্ণ ছুরি আর বিশেষ এক ধরণের কালো কালি নিয়ে বসে পড়ল। রায়হান রুমে ঢুকে দৃশ্যটা দেখে আঁতকে উঠল।
“স্যার! আপনি কী করছেন? ডক্টরকে করতে দিন, আপনি নিজের ক্ষতি করছেন!”
জাভিয়ান এক অমানুষিক শান্ত গলায় বললো “সরে যাও রায়হান। এটা আমার আর আমার তান্বীর ব্যাপার। এই যন্ত্রণাটুকু না পেলে আমি বুঝতে পারছি না যে ও এখনো আমার বেঁচে থাকার কারণ। এই রক্ত যখন ঝরবে, তখন আমি ওর প্রতিটি নিশ্বাস আমার ঘাড়ের কাছে অনুভব করব।”
জাভিয়ান কোনো অ্যানাস্থেশিয়া বা অবশ করার ওষুধ ছাড়াই নিজের ঘাড়ের চামড়ায় ছুরি দিয়ে আঁচড় কাটতে শুরু করল। কানের নিচ থেকে শুরু হয়ে সেই ক্ষত নেমে এল কাঁধের ওপর পর্যন্ত। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল, কিন্তু জাভিয়ানের মুখে কোনো কষ্টের ছাপ নেই; বরং তার চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি।
খুব নিখুঁতভাবে সে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করল—
‘T A N B I’
রক্ত আর কালির সংমিশ্রণে তার ঘাড়ের সেই জায়গাটা লাল-কালো হয়ে এক বীভৎস কিন্তু শৈল্পিক রূপ নিল। রায়হান স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে দেখল, জাভিয়ান যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে না, বরং সে নামের ওপর হাত বুলিয়ে হাসছে।”এবার ও আমার একদম কাছে। কেউ ওকে আমার থেকে দূরে সরাতে পারবে না। মেইলস্ট্রোম আমার শরীর থেকে প্রাণ কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু এই নামটা মুছতে পারবে না।”
সে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখল সেই টাটকা ক্ষত। রক্তের ধারা তার সাদা শার্ট ভিজিয়ে নামছে। জাভিয়ান সেই অবস্থায় রায়হানের দিকে ফিরে তাকাল। তার চোখের মণি এখন টকটকে লাল “রায়হান, এই ক্ষতটা শুকানোর আগেই আমি ওই দ্বীপে থাকতে চাই।
জাভিয়ানের এই সাইকো রূপ দেখে রায়হান বুঝল, এবার ধ্বংস অনিবার্য। জাভিয়ান এখন আর কোনো সুস্থ মানুষ নয়, সে এক রক্তাক্ত প্রেতাত্মা হয়ে তান্বীকে ছিনিয়ে আনতে যাচ্ছে।
.
.
.
মেক্সিকো সিটির হাড়কাঁপানো শীতের এক রাতে, একটি নিভৃত আর্ট স্টুডিওতে সময়ের চাকা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। চারপাশ অন্ধকার, শুধু জাভিয়ানের সামনে রাখা সেই বিশাল বেদীর ওপর কৃত্রিম আলো এসে পড়েছে। তার সামনে নতজানু হয়ে কাজ করছেন পৃথিবীর সেরা কয়েকজন ম্যানিকুইন প্রস্তুতকারক। জাভিয়ানের রক্তবর্ণ চোখে গত কয়েক রাতের নির্ঘুম যন্ত্রণা।
সে প্রতিটি খুঁটিনাটি দেখছে এক অমানুষিক তীক্ষ্ণতায়। তার গম্ভীর, কম্পিত কণ্ঠস্বর স্টুডিওর দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল— “আমি নিখুঁত চাই। প্রতিটি লোমকূপ, চোখের কোণের ওই সূক্ষ্ম রেখা, হাসির সেই অবাধ্য ভাঁজ—সবকিছু… ঠিক যেমনটা ছিল আমার জিন্নীয়ার। এক চুল এদিক-ওদিক হলে এই স্টুডিওসহ তোমাদের আমি শেষ করে দেব।”
নির্মাতারা যখন ধীরে ধীরে আবরণ উন্মোচন করল, জাভিয়ানের শ্বাস থমকে গেল। এটা স্রেফ কোনো সিলিকনের ডামি নয়; এটি এক জীবন্ত স্মৃতি।তান্বীর সেই স্নিগ্ধ চাহনি, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা সেই মায়াবী হাসি, আর পিঠ বেয়ে নেমে আসা সেই দীর্ঘ, রেশমি কালো চুলের রাশি। জাভিয়ান অপলক চেয়ে রইল; যেন কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে সে তার হারিয়ে যাওয়া স্বর্গকে আবার মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছে।
মেক্সিকোর এক ফার্মহাউসে আজ আলোর লেশমাত্র নেই। জানালার ওপার থেকে আসা নিওন আলোর এক চিলতে নীলচে আভা ঘরের মাঝখানে রাখা সেই মানবীমূর্তির ওপর এসে পড়েছে। ঘরের বাতাসে দামী তামাক আর তেকিলার উগ্র গন্ধের মাঝেও জাভিয়ান যেন এক অলীক সুবাস খুঁজে পাচ্ছে।
সে হাতে একটি রুপোলি চিরুনি নিয়ে অত্যন্ত ধীরলয়ে ম্যানিকুইনটির হাঁটু অবধি লম্বা চুলগুলো আঁচড়ে দিচ্ছে। তার ঠোঁটে এক অপার্থিব প্রশান্তির হাসি। সে কাঁপাকাঁপা হাতে মূর্তির শীতল গালে স্পর্শ করে বিড়বিড় করে উঠল— “ওরা ভেবেছিল তোমাকে আমার থেকে আলাদা করবে? কত বোকা ওরা! দেখ তান্বী… তুমি এখনো আমার নিশ্বাসের ঠিক এতটা কাছেই আছ।”
জাভিয়ান আলমারি থেকে বের করে আনল সেই কাঙ্ক্ষিত মেরুন রঙের শাড়ি। এই সেই শাড়ি, যা পরে প্রথমবার দেখার দিন জাভিয়ানের জগত উলটপালট হয়ে গিয়েছিল। শাড়িটা হাতে নিতেই জাভিয়ানের নাকে যেন তান্বীর শরীরের সেই ঘ্রাণ আছড়ে পড়ল। সে অতি সাবধানে, যেন কোনো জ্যান্ত মানুষকে সাজাচ্ছে, সেভাবে ম্যানিকুইনটিকে শাড়িটি পরাতে শুরু করল। প্রতিটি কুঁচি যত্ন করে ঠিক করে দিচ্ছে, প্রতিটি ভাঁজ করার সময় তার আঙুলগুলো পুতুলটির গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে এক গভীর তৃষ্ণায়।
সে ঘোর লাগা গলায় ফিসফিস করে বলল “জিন্নীয়া… আজ তোমাকে ঠিক সেই প্রথম দিনের মতো লাগছে। এই মেরুন রঙটা তোমার গায়ের সাথে মিশে যেন আগুনের মতো জ্বলছে। এই তো, কুঁচিটা একটু বেঁকে গেছে… দাঁড়াও, ঠিক করে দিচ্ছি।”
ঠিক সেই মুহূর্তে রায়হান ঘরে ঢুকল। দৃশ্যটি দেখে রায়হানের মেরুদণ্ড দিয়ে এক বরফশীতল স্রোত বয়ে গেল। তার হাতের ইনভেস্টিগেশন ফাইলটা যেন নিমিষেই পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠল। সে দেখল, জাভিয়ান তখন সেই নির্জীব মূর্তির হাতে মাথা রেখে আলতো করে চুমু খাচ্ছে।
রায়হান আর্তনাদ করে উঠল “স্যার! একি উন্মাদনা শুরু করেছেন আপনি? কার সাথে কথা বলছেন?”
জাভিয়ান শান্তভাবে মূর্তির চুলে হাত বুলাতে বুলাতে তর্জনী উঁচিয়ে ইশারা করল। “শশশ… আস্তে কথা বলো রায়হান। দেখছ না তান্বী মাত্র ড্রেসটা চেঞ্জ করল? ও খুব টায়ার্ড, একটু পরেই আমরা ডিনার করব।”
রায়হান আতঙ্কে শিউরে উঠে বলল— “স্যার, এটা স্রেফ একটা মূর্তি! আপনি কি ধ্বংস হয়ে যেতে চান?”
জাভিয়ান এক ঝটকায় রায়হানের দিকে তাকাল। সেই চোখে তখন কোনো মানুষের করুণা নেই, আছে এক হিংস্র খুনি নেশা। সে গর্জে উঠে বলল “মূর্তি? আরেকবার যদি ওকে মূর্তি বলেছ, তবে তোমার জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব রায়হান! ও আমার তান্বী। আমি ওর হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি, ও আমার সাথে কথা বলছে! ওর নিশ্বাসে এই ঘরটা জীবন্ত হয়ে আছে, আমি অনুভব করতে পারছি তুমি পাচ্ছ না?”
তারপর জাভিয়ান ম্যানিকুইনটিকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। তার এই ঘোর, এই ডিলিউশন (Delusion) এখন আর স্রেফ প্রেম নেই; এটি এখন একটি ভয়াবহ মানসিক রোগ ‘Obsessive Love Disorder’।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, জাভিয়ান এখন বাস্তব জগত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। যখন কোনো মানুষ কাউকে পাওয়ার জন্য নিজের সব ক্ষমতা—জাহাজ, হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনী—ব্যবহার করার পরও ব্যর্থ হয়, তখন তার মস্তিষ্ক এই ভয়াবহ ‘ডিফেন্স মেকানিজম’ তৈরি করে। এটি কোনো সাধারণ বিচ্ছেদ নয়, এটি ‘অবজেক্ট-ফিক্সেশন’। জাভিয়ানের কাছে তান্বী এখন কোনো মানুষ নয়, বরং একটি ‘অবজেক্ট’ বা ‘লক্ষ্য’, যাকে সে নিজের আয়ত্তে রাখতে যেকোনো বিভ্রমকেও সত্যি বলে বিশ্বাস করতে রাজি।
ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক ডার্ক কেস আছে, যেখানে মানুষ প্রিয়জনের মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে তাদের মোমের মূর্তি বানিয়ে বা তাদের দেহাবশেষ সংরক্ষণ করে ঘরে সাজিয়ে রাখে।
.
.
.
.
মেক্সিকো সিটির সেই নির্জন আর্ট স্টুডিও আর জাভিয়ানের উন্মাদের মতো আচরণের খবর মেইলস্ট্রোমের কাছে পৌঁছাল তার এক বিশ্বস্ত চরের মাধ্যমে। দ্বীপের অন্ধকার স্টাডি রুমে বসে মেইলস্ট্রোম যখন ল্যাপটপে সেই ফুটেজ আর তথ্যগুলো দেখছিল, তার ঠোঁটে এক পৈশাচিক আর তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল।সে গ্লাস ভর্তি মদ নিয়ে ভ্যালেরিয়াকে নিজের কাছে ডাকল।
মেক্সিকো সিটির সেই নিভৃত স্টুডিওতে কী ঘটেছিল, তা মেইলস্ট্রোমের চরেরা অত্যন্ত গোপনে ক্যামেরাবন্দি করতে সক্ষম হয়েছিল। দ্বীপের সুরক্ষিত স্টাডি রুমে বসে মেইলস্ট্রোম যখন সেই ফুটেজটি প্লে করল, তখন রুমের তাপমাত্রা যেন হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেল। মনিটরের নীলচে আভা মেইলস্ট্রোমের মুখে এক অশুভ ছায়া ফেলেছে।সেখানে দেখা যাচ্ছে, আধো-অন্ধকার স্টুডিওর মাঝখানে জাভিয়ান দাঁড়িয়ে। তার পরনের সাদা শার্টের কলার রক্তে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তদারকি করছে একদল কারিগরকে, যারা গভীর নিপুণতায় তৈরি করছে তান্বীর এক হুবহু সিলিকন প্রতিকৃতি। ফুটেজে দেখা গেল, জাভিয়ান হঠাৎ উন্মাদের মতো এক কারিগরের কলার চেপে ধরল।
জাভিয়ান চেরা গলায় গর্জে উঠে বললো “নিখুঁত চাই! ওর চোখের কোণের ওই তিলটা যদি এক চুল এদিক-ওদিক হয়, তবে তোমাদের হাত আমি জ্যান্ত কেটে ফেলব। ও আমার জিন্নীয়া… ওর হাসিতে যে মায়া ছিল, তা এই মূর্তির ঠোঁটে ফুটে উঠতে হবে!”
মেইলস্ট্রোম গ্লাসের সবটুকু মদ এক চুমুকে শেষ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যালেরিয়ার দিকে তাকাল। তার কণ্ঠে ফুটে উঠল এক পৈশাচিক বিদ্রূপ।”দেখেছিস ভ্যালেরিয়া? মেক্সিকোর সেই তথাকথিত বাঘ এখন একটা প্লাস্টিকের পুতুল নিয়ে খেলা করছে! ও নাকি তান্বীর ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য সিলিকন বানাচ্ছে। আর ওর ঘাড়ের দশা দেখো— নিজের চামড়া খুবলে ‘TANBI’ লিখেছে। পাগলামিরও একটা সীমা থাকে, কিন্তু জাভিয়ান তো সীমানা ছাড়িয়ে নরকে পা রেখেছে। ও এখন বাঘ নয়, ও এখন এক মগজহীন সাইকো!”
ভ্যালেরিয়া ফুটেজের দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো জমে রইল। জাভিয়ানের ওই দগদগে লাল ক্ষত আর ডিলিউশনাল চাহনি দেখে তার মেরুদণ্ড দিয়ে এক বরফশীতল স্রোত বয়ে গেল। “ব্রো, তুমি এটাকে উপহাস করছো? যে মানুষটা একটা প্রাণহীন মূর্তিকে জ্যান্ত ভেবে নিজের রক্ত দিয়ে পুজো করতে পারে, সে যখন জানবে জ্যান্ত তান্বী এখানে বন্দি, তখন সে কতটা নৃশংস হতে পারে ধারণা আছে?এই দ্বীপ পুরোটা ও জ্বালিয়ে দিবে।এটা ওর দুর্বলতা নয় ব্রো, এটা ওর এক সংহারী রূপের পূর্বাভাস। ও নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে শুধু তান্বীকে নিজের ভেতরে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।”
তারা কেউই জানত না যে দরজার ওপাশে অন্ধকার করিডোরে একটা ছায়ার মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তান্বী। সে আসলে মেইলস্ট্রোমের চোখ এড়িয়ে ভ্যালেরিয়াকে খুঁজতে এদিক-ওদিক যাচ্ছিল, কিন্তু কক্ষের ভেতর থেকে আসা জাভিয়ানের নামটা শুনেই সে স্তব্ধ হয়ে যায়। দরজার সূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে সে যা শুনলো, তা শোনার জন্য সে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না।
জাভিয়ানের সেই রক্তাক্ত ঘাড়… দগদগে লাল ক্ষত দিয়ে ফুটে ওঠা তার নামের প্রতিটি অক্ষরের কথা। জাভিয়ান সেই মূর্তির কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে কোনো অলৌকিক প্রার্থনায় মগ্নের মতো হয়ে থাকার কথা শুনে মুহূর্তেই তান্বীর পায়ের তলা থেকে পৃথিবীটা সরে গেল। সে নিজের দুহাতে মুখ চেপে ধরল যাতে তার ভেতরের গুমরে ওঠা আর্তনাদ দেয়ালে প্রতিধ্বনি না তোলে। সে দেয়াল ঘেঁষে ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়ল। তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে, কিন্তু তার হৃৎপিণ্ড যেন হাজারটা হাতুড়ির ঘা খাচ্ছে।
তান্বী (মনে মনে) বললো “জাভিয়ান… একি সর্বনাশা নেশায় মেতেছো তুমি? কেন নিজেকে এভাবে ছিঁড়ে তছনছ করে দিলে? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভুলে গেছো, আমার নিখোঁজের খবর শুনেও তোমার কোনো কিছু আসে যায়না। কিন্তু তুমি তো আমার জন্য নিজের শরীরটাকে এক জীবন্ত কবরস্থান বানিয়ে ফেললে! একটা জড় মূর্তিকে আমি ভেবে তুমি ডুকরে কাঁদছো? আমি তো এখানে জ্যান্ত ধুঁকছি জাভিয়ান… আমি এখানে!”
এতদিন তার মনে যে অভিযোগের পাহাড় ছিল, জাভিয়ানের এই আত্মঘাতী উন্মাদনার কথা শুনে তা এক নিমিষেই ধুলোয় মিশে গেল। তান্বী বুঝতে পারল, জাভিয়ান তাকে শুধু ভালোবাসা নয়, তাকে এক ভয়ংকর অসুখের মতো নিজের সত্তায় মিশিয়ে নিয়েছে। মেইলস্ট্রোমের পৈশাচিক হাসি আর জাভিয়ানের রক্তাক্ত আত্মসমর্পণের কথা— এই দুইয়ের মাঝে পড়ে তান্বীর মনে হলো তার বুকটা এখনই ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।
সেখানেই অন্ধকার মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে সে মনে মনে এক অটল প্রতিজ্ঞা করল— জাভিয়ান তাকে উদ্ধার করতে পারুক বা না পারুক, সে নিজে এবার এই নরক ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। জাভিয়ানের ওই রক্তাক্ত ঘাড়ে নিজের হাত না রাখা পর্যন্ত তার আত্মা শান্তি পাবে না।
.
.
.
রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে দ্বীপের রহস্যময় স্তব্ধতা যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছিল। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউগুলো যখন সৈকতের পাথরে আছড়ে পড়ছিল, সেই শব্দের চেয়েও ভয়াবহ এক আর্তনাদ তান্বীর বুকের ভেতর গুমরে মরছিল। জাভিয়ানের ওই রক্তাক্ত উন্মাদনার খবর শোনার পর থেকে তান্বীর স্নায়ুগুলো অবশ হয়ে আসছে। সে আর স্থির থাকতে পারল না; হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে টলমলে পায়ে ছুটে গেল ভ্যালেরিয়ার ঘরের দিকে।
ধপাস করে মেঝেতে পড়ে ভ্যালেরিয়ার পা দুটো জড়িয়ে ধরল তান্বী। তার চোখের লোনা জলে ভ্যালেরিয়ার দামী কার্পেট ভিজে একাকার। “আপা, আমি আপনার হাতে-পায়ে ধরছি, দয়া করুন!” তান্বীর কণ্ঠস্বর কান্নায় বুজে আসছিল, “আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করুন। ওই মানুষটা… ওই মানুষটা নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে আমার জন্য। সে তো পাগল হয়ে যাচ্ছে! আমাকে কোনোভাবে ঝড়তুফানের এই নরক থেকে বের করে জাভিয়ানের কাছে পৌঁছে দিন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
ভ্যালেরিয়া এক ঝটকায় তার পা সরিয়ে নিল। তার চোখের মণি দুটো তখন শীতল আর তাচ্ছিল্যে ভরা। ঘৃণা আর ঈর্ষার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ খেলা করছিল তার ঠোঁটের কোণে।
“হেল্প?” ভ্যালেরিয়া তীক্ষ্ণ স্বরে হেসে উঠল, “তুমি কি সত্যিই পাগল হয়েছো তান্বী?মেইলস্ট্রোম আমার পরিবার, আমার ভাই। আমি ওর সাথে বেইমানি করে তোমাকে পালাতে সাহায্য করব? আর তুমি কে? তুমি হলে আমার ‘লাভ রিভাল'(প্রেমের প্রতিদ্বন্দি) যে জাভিয়ানকে আমি বছরের পর বছর নিজের করে পাওয়ার আরাধনা করেছি, সেই জাভিয়ান আজ তোমার জন্য একটা প্রাণহীন মূর্তিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে! তার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে তোমার নাম। আমি কেন তোমাকে ওর কাছে পৌঁছে দেব? তুমি এখানে পচে মরলেই বরং আমার তৃপ্তি।”
ভ্যালেরিয়ার কর্কশ কথাগুলো তান্বীর বুকে তীরের মতো বিঁধছিল। সে বুঝতে পারল, ভ্যালেরিয়ার মনের ভেতর যে প্রত্যাখ্যাত প্রেম আর ঈর্ষার আগুন জ্বলছে, সেখানে দয়া পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তান্বী নিজের চোখের জল মুছে নিল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর তখন মিনতিতে থরথর করে কাঁপছে।
“ঠিক আছে আপা.. আপনি আমাকে সাহায্য করবেন না, জানি। কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা শেষ মিনতি।” তান্বী উদভ্রান্তের মতো ভ্যালেরিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই যে ঝড়তুফান লোকটা…,সে যেভাবে জাভিয়ানকে দেখছিল—ওই ফুটেজটা কি আমাকে একবার দেখানো যায়? আমি শুধু একটিবারের জন্য ওকে দেখতে চাই। ওই নামটা সে নিজের শরীরে কীভাবে লিখেছে… সে এখন কেমন আছে… শুধু একবার দেখতে দিন!”
তান্বীর এই বিধ্বস্ত রূপ, তার চোখের ওই অমানুষিক আর্তি দেখে ভ্যালেরিয়ার পাথুরে হৃদয়েও যেন কোথাও একটা সূক্ষ্ম ফাটল দেখা দিল। সে দীর্ঘক্ষণ তান্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। হয়তো জাভিয়ানের প্রতি এই সর্বনাশা ভালোবাসা দেখে সে নিজেই ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভ্যালেরিয়া চুপিচুপি বলল, “মেইলস্ট্রোম এখন আশেপাশে টহল দিচ্ছে। ও জানতে পারলে আমরা দুজনেই শেষ। ঠিক আছে, তোমাকে আমি দেখাব। দেখাব জাভিয়ান এখন কেমন উন্মাদের মতো আচরণ করছে। তবে এখন নয়… মাঝরাতে। যখন এই দ্বীপের প্রতিটি প্রাণ ধোঁকায় পড়ে ঘুমিয়ে থাকবে, তখন আমি তোমাকে নিয়ে যাব ওই সিসিটিভি আর ড্রোন ফুটেজের কন্ট্রোল রুমে।”
তান্বী শুধু নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তার প্রতিটি নিশ্বাস যেন এক একটি দীর্ঘ শতাব্দী হয়ে কাটছিল। জানালার বাইরে অন্ধকার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে শুধু একথাই বিড়বিড় করছিল— “জাভিয়ান, আর একটু ধৈর্য ধরো। আমি আসবো খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে। তোমার ওই রক্তাক্ত ঘাড়ের ক্ষতটা যতক্ষণ না আমি নিজের হাত দিয়ে মুছে দিচ্ছি, ততক্ষণ আমার মরণও হবে না।”
.
.
.
মাঝরাত। নিঝুম দ্বীপের বুকে তখন কেবল প্রশান্ত মহাসাগরের আদিম গর্জন শোনা যাচ্ছে। চারিদিকে নোনা বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর অরণ্যের রহস্যময় নিস্তব্ধতা। ভ্যালেরিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে তান্বীকে নিয়ে সিসিটিভি কন্ট্রোল রুমের দিকে পা বাড়াল। মেইলস্ট্রোম তখন ঘুমে আচ্ছন্ন—অন্তত তারা তেমনটাই ভেবেছিল।
ভারী ইস্পাতের দরজাটা যখন নিঃশব্দে খুলে গেল, কন্ট্রোল রুমের ডজন খানেক মনিটরের নীলচে আভা তান্বীর পাংশুটে মুখে আছড়ে পড়ল। ভ্যালেরিয়া কিবোর্ডে আঙুল চালিয়ে মেক্সিকো সিটির সেই অভিশপ্ত স্টুডিওর ফুটেজটি বড় স্ক্রিনে ওপেন করল।
স্ক্রিনে ফুটে উঠল এক নারকীয় দৃশ্য। আধো-অন্ধকার এক বিশাল আর্ট স্টুডিও যার মাঝখানে বেদির ওপর বসানো সেই সিলিকন মূর্তি—হুবহু তান্বীর আদলে গড়া এক বিষণ্ণ প্রতিচ্ছবি। জাভিয়ান সেই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাদা শার্টের কলার টাটকা রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। জাভিয়ান যখন মুখ তুলল, তান্বীর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। কানের নিচ থেকে ঘাড়ের হাড় অবধি দগদগে ক্ষতের ওপর খোদাই করা প্রতিটি অক্ষর— ‘T A N B I’ মনে হচ্ছে কেউ যেন কাঁচা চামড়া খুবলে ঘৃণা আর প্রেমের এক রক্তাক্ত মহাকাব্য লিখেছে।
ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, জাভিয়ান কাঁপাকাঁপা হাতে মূর্তির গাল স্পর্শ করছে আর বিড়বিড় করে বলছে, “জিন্নীয়া, আর অল্প কটা দিন… আমি আসছি।”
দৃশ্যটি দেখা মাত্রই তান্বী দুহাতে মুখ চেপে ধরল। তার বুকের পাঁজর যেন মটমট করে ভেঙে যাচ্ছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না; মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তার ওই কান্নার শব্দ যেন কন্ট্রোল রুমের শীতল দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছিল।
ভ্যালেরিয়া কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তান্বীর বিধ্বস্ত অবস্থার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তার ঠোঁটে এক বিষাক্ত হাসি ফুটে উঠল।”আরে! তুমি কাঁদছো কেন তান্বী? তুমি না বলেছিলে জাভিয়ান ক্যারেক্টারলেস?ও নাকি অগণিত মেয়ের সাথে রাত কাটায়, মেয়েদের শেয়ার করে—তবে এখন ওর এই দশা দেখে তোমার বুক ফাটছে কেন? ওর এই বীভৎস পাগলামি দেখে তো তোমার তৃপ্তি হওয়ার কথা যে লোকটা তিলে তিলে মরছে!”
তান্বী কান্নার তোড়ে কথা বলতে পারছিল না। সে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল যেখানে জাভিয়ান তখন সেই মূর্তির কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে এক অপার্থিব প্রার্থনায় মগ্ন। তান্বী হেঁচকি তুলে মাথা উঁচু করল। তার চোখের চাহনিতে তখন কোনো দ্বিধা নেই, কোনো ঘৃণা নেই।
তান্বী ভাঙা গলায় আর্তনাদ করে বললো “হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম ও খারাপ অনেক খারপ! আমি ভেবেছিলাম ও ক্যারেক্টারলেস! কিন্তু আপা… আমি ওকে ভালোবাসি! আই লাভ হিম ভেরি মাচ! কখন ভালোবেসে ফেলেছিলাম নিজেও জানিনা। আর আমি জানতাম না ও আমাকে পাওয়ার জন্য নিজের শরীরটাকে এভাবে কসাইয়ের মতো কাটবে। আমি ওর ওই রক্ত মাখা ঘাড়টা একবার নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখতে চাই আপু। ও ক্যারেক্টারলেস হোক বা সাইকো—ও তো আমারই হাজবেন্ড!”
ভ্যালেরিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল। তান্বীর এই সপাটে স্বীকারোক্তি যেন তাকে এক মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ করে দিল। সে বুঝতে পারল, জাভিয়ান আর তান্বীর এই সম্পর্ক এখন আর কোনো মাফিয়া-বন্দি গেম নেই; এটি এক ভয়াবহ আত্মঘাতী প্রেমে রূপ নিয়েছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় একটি ভারী শব্দ হলো। ভ্যালেরিয়া আর তান্বী দুজনেই শিউরে উঠে দরজার দিকে তাকাল। ভারী লোহার দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। চৌকাঠে দীর্ঘদেহী মেইলস্ট্রোম দাঁড়িয়ে। তার চোখে কোনো ক্রোধ নেই, আছে এক বরফশীতল শূন্যতা যা অন্ধকারের চেয়েও বেশি ভয়ংকর। সে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল। প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দ তান্বীর হৃদপিণ্ডে হাতুড়ির ঘা দিচ্ছিল।
মেইলস্ট্রোম তান্বীর একদম সামনে এসে দাঁড়াল।
মেইলস্ট্রোম যখন তান্বীর মুখ থেকে ওই অমোঘ স্বীকারোক্তি “আই লাভ হিম”—শুনল, তার ভেতরের ধূর্ত শিকারিটা মুহূর্তেই হিংস্র হয়ে উঠল। সে এতক্ষণ জাভিয়ানের উন্মাদনা দেখে তাকে তাচ্ছিল্য করছিল, কিন্তু তান্বীর এই অবিচল ভালোবাসা তার অহংকারে সজোরে আঘাত করল।
সে তান্বীর চিবুকটা এত জোরে চেপে ধরল যে তান্বীর মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল। মেইলস্ট্রোমের চোখে তখন কোনো করুণা নেই, আছে এক পৈশাচিক জিঘাংসা।
মেইলস্ট্রোম দাঁতে দাঁত চেপে বললো “ভালোবাসো? তার মানে আমার এতদিনের চেষ্টা, এই বিলাসিতা, এই নিরাপত্তা—সবই তোমার ওই সাইকো জাভিয়ানের রক্তমাখা ঘাড়ের কাছে হেরে গেল? খুব ভালো সোলফ্লেম, তুমি নিজেই নিজের ধ্বংসের রাস্তা বেছে নিলে।”
সে তান্বীকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে কন্ট্রোল রুমের বড় স্ক্রিনের সামনে নিয়ে এল। সেখানে জাভিয়ানের সেই রক্তাক্ত মূর্তি-বিলাসের দৃশ্য তখনও স্থির হয়ে আছে। “তুমি হয়তো ভাবছো তোমার এই ভালোবাসা ওকে বাঁচিয়ে দেবে? ভুল করছো। তোমার এই এক একটা ভালোবাসার শব্দ জাভিয়ানের কফিনে এক একটা পেরেক ঠুকছে। জাভিয়ান এখন অলরেডি এই দ্বীপের উপকূলে পৌঁছে গেছে। আমি ওকে আটকাইনি, কারণ আমি চেয়েছিলাম ও আসুক। ওকে জ্যান্ত কবরে পাঠানোর এর চেয়ে বড় সুযোগ আর হবে না।”
তান্বী কান্নায় ভেঙে পড়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। আর্তনাদ করে বলল, “দয়া করুন… ওকে মারবেন না।আপনি যা চান আমি তাই করব!”
মেইলস্ট্রোম তখন বললো “গুড। তবে শর্ত একটাই। জাভিয়ান যখন তোমার সামনে আসবে, তুমি ওকে বলবে যে তুমি স্বেচ্ছায় আমার কাছে এসেছো। তুমি ওকে বলবে যে ওর মতো বিকৃত মস্তিস্কের আর ক্যারেক্টারলেস লোকের সাথে থাকা তোমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি ওকে ঘৃণা করো—এই মিথ্যেটা যদি তোমার মুখ দিয়ে না বের হয়, তবে আমি এক মুহূর্ত দেরি করব না। ওর হৃদপিণ্ড আমি ছিঁড়ে ফেলব।”
মেইলস্ট্রোম ভ্যালেরিয়াকে ইশারা করল তান্বীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তান্বী যখন রুম থেকে বের হচ্ছিল, সে শেষবারের মতো স্ক্রিনে জাভিয়ানের সেই ফ্যাকাশে চেহারার দিকে তাকাল। তার ভেতরে তখন রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। সে মনে মনে শুধু বলল— “ক্ষমা করো জাভিয়ান, তোমাকে বাঁচানোর জন্য আমাকে তোমার চোখের সামনে নিজের আত্মাকে খুন করতে হবে।”
.
.
.
দ্বীপের আকাশে তখন ভোরের প্রথম আলো ফুটতে শুরু করেছে, কিন্তু সেই আলোয় কোনো প্রশান্তি নেই; বরং তা এক আসন্ন ধ্বংসের পূর্বাভাস নিয়ে আসছে। মেইলস্ট্রোম তার রেইনকোটের কলারটা ঠিক করে নিয়ে তান্বীর দিকে এক স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। তার হাতে থাকা ওয়াকি-টকিতে তখন উপকূল রক্ষা বাহিনীর সংকেত ভেসে আসছে।
মেইলস্ট্রোম এক অমানুষিক শান্ত গলায় বললঝ “শোনো তান্বী, তোমার জাভিয়ান এখন অলরেডি এই দ্বীপের উপকূলে পৌঁছে গেছে। হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওর পা এই মাটিতে পড়বে। ও ভেবেছে মেইলস্ট্রোমের সাম্রাজ্যে ও বীরের মতো ঢুকবে, কিন্তু ও জানে না আমি নিজেই ওকে এই পর্যন্ত আসার পথ করে দিয়েছি। আমি চেয়েছিলাম ও আসুক—একদম আমার হাতের নাগালে।”
সে তান্বীর কাছে আরও এক ধাপ এগিয়ে এল। তার কণ্ঠস্বর এখন সাপের হিসহিসের মতো তীক্ষ্ণ।”মনে রেখো, নাটকটা ঠিক সেভাবেই হবে যেভাবে আমি স্ক্রিপ্ট লিখেছি। তুমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। ওর ওই রক্তাক্ত ঘাড় আর পাগলামি দেখে তোমার ভেতরটা ছিঁড়ে গেলেও তুমি চোখে এক ফোঁটা পানি আনতে পারবে না। তুমি সপাটে ওর মুখে বলবে যে তুমি ওকে ঘৃণা করো! তুমি বলবে—ওর মতো একটা সাইকো আর পিশাচের চেয়ে আমার মতো ক্ষমতাবান মানুষের ছায়ায় থাকা অনেক বেশি নিরাপদ। তুমি আমার কাছে স্বেচ্ছায় থাকতে চাও—এই কথাটা যেন ওর কানে তপ্ত সিসার মতো লাগে।”
তান্বী থরথর করে কাঁপছিল। তার ঠোঁট দুটো নীল হয়ে গেছে আতঙ্কে। মেইলস্ট্রোম তার পকেট থেকে একটা ছোট্ট রিমোট বের করে দেখাল। “যদি তোমার গলায় সামান্যতম কাঁপুনি আমি দেখি, তবে আমার স্নাইপারের ট্রিগার এক সেকেন্ডও দেরি করবে না। জাভিয়ানকে যদি জ্যান্ত ফেরত পাঠাতে চাও, তবে আজ ওর হৃদয়টা তোমাকে পাথর দিয়ে থেঁতলে দিতে হবে। ও যেন এই দ্বীপ থেকে তোমার ভালোবাসা নয়, বরং চরম ঘৃণা নিয়ে ফিরে যায়। তুমি কি পারবে নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে তাকে মানসিকভাবে খুন করতে?আমি জাভিয়ানের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী তান্বী। ও খেলে পেশিশক্তি দিয়ে, আর আমি খেলি মানুষের ভাগ্য নিয়ে।”
তান্বী কোনো উত্তর দিতে পারল না, শুধু অঝোরে জল ঝরছে তার চোখ দিয়ে। সে বুঝতে পারছে, জাভিয়ান তার জন্য নরক পার হয়ে এসেছে, অথচ তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে বিষাক্ত এক মিথ্যে দিয়ে।
মেইলস্ট্রোম ভ্যালেরিয়ার দিকে তাকিয়ে আদেশ দিল, “যা,ওকে তৈরি কর। জাভিয়ানের জাহাজ ভিড়ছে। আমি চাই জাভিয়ান যখন ওর সামনে দাঁড়াবে, তখন যেন সে এক অন্য তান্বীকে দেখে যে তান্বী এখন মেইলস্ট্রোমের অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।”
মেইলস্ট্রোম রুম থেকে বের হওয়ার আগে শেষবারের মতো ফিরে তাকাল।”মনে রেখো তান্বী, তোমার এক ফোঁটা ভালোবাসা জাভিয়ানের মৃত্যু নিশ্চিত করবে। যদি ওকে জ্যান্ত ফেরত পাঠাতে চাও, তবে আজ তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর অভিনয়টা করতে হবে।”
চলবে………
(প্রিয় পাঠকগণ! পরের পর্ব পেতে অবশ্যই রেসপন্স করবেন আগের পর্বে যেভাবে রিয়েক্ট দিয়েছেন কারন আমি আমার কথা রেখেছি আপনাদের রিয়েক্টের ওপর ভিত্তি করে গল্প দিয়েছি আর হ্যাঁ নাইস নেক্সট কমেন্ট করবেন না প্লিজ অবশ্যই দুই এক লাইনের গঠনমুলক কমেন্ট করবেন এতে পর্ব রিচ পায়)
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১০
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৯
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৮
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২৩
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৩
-
ডিজায়ার আনলিশড গল্পের লিংক
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১২