ডিজায়ার_আনলিশড- (Desire Unleased)
✍️সাবিলা সাবি
সূচনা পর্ব.
📛 CONTENT WARNING | পাঠক সতর্কীকরণ 📛
এই গল্পটি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপযুক্ত। এতে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা সংবেদনশীল পাঠকদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।
🔻রেড ফ্ল্যাগ ও ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ চরিত্রসমূহ:প্রত্যেকটি চরিত্র নিজের মধ্যে ভয়াবহ রকমের রেড ফ্ল্যাগ বহন করে।এই গল্পে “ভালো মানুষ” নেই—এখানে সবাই নিজস্ব স্বার্থে চালিত, জটিল,এবংঅন্ধকারাচ্ছন্ন। ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ চরিত্রগুলো—যেমন মাফিয়া কিং, ঠান্ডা মাথার খুনি, এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতি-গ্রস্ত ব্যক্তি—সবচেয়ে বিপজ্জনক।
🖤রোমান্সের প্রকৃতি (BDSM):💥 BDSM বলতে এখানে যা বোঝানো হয়েছে:
🔗Bondage: ইচ্ছাকে শিকল পরানো—শরীর নয়, মনের দখল।
🧨Discipline: শাস্তির ভেতর পাওয়া প্রশ্রয়।
👑Dominance & Submission: একপক্ষ শাসন করে, অন্যপক্ষ আত্মসমর্পণ করে—স্বেচ্ছায় কিংবা আবেগের ভারে।
🔥Sadism & Masochism: যন্ত্রণার মাঝেই সুখ—ব্যথার মধ্যেই ঘনিষ্ঠতা।
💢এখানে Consent (সম্মতি) থাকবে, কিন্তু…
👉 কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হবে, কখনো জোরে আদায় করা হবে, 👉 কখনো প্রেম আর প্রতিরোধের সীমারেখা মিলেমিশে যাবে।
📌এই প্রেম কন্ট্রোলিং, প্যাশনেট, এবং ঝুঁকিপূর্ণ—যেখানে অধিকার চাওয়া মানেই কারও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া।
🔪খুন, হুম/কি, এবং সাইকোপ্যাথিক সহিংসতা: গল্পে রয়েছে হিং/স্রতা, র*ক্তপাত, প্রতিশোধ এবং মাফিয়া রাজনীতির ভয়ঙ্কর খেলা। কেউই নিরাপদ নয়। কেউই সম্পূর্ণ নির্দোষ নয়।আপনি যদি প্রেমে শুধু গোলাপের ঘ্রাণ খুঁজে বেড়ান, এই গল্প আপনার জন্য নয়। কিন্তু আপনি যদি ভালোবাসার মধ্যেও অন্ধকার, দখলদারিত্ব, এবং মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন খুঁজে পান—
🖤 তবে এই গল্প আপনাকেই উদ্দেশ্য করে লেখা।
🔞 এই গল্পটি শুরু করার মানেই হলো—আপনি নিজ দায়িত্বে এই বিপজ্জনক দুনিয়ায় প্রবেশ করছেন। Welcome to the dark.
.
.
.
.
মেক্সিকোর আকাশে ভোরের আলো যেন ধীরে ধীরে রং তুলির মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। আন্দিজ পর্বতের আড়াল থেকে লাজুকভাবে উঁকি দিচ্ছিল লালচে কমলা রঙের এক সূর্য।শহরের উপকণ্ঠে পাথরে মোড়ানো ছোট ছোট রাস্তা তখনও ঘুমিয়ে, কিন্তু আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল এক ঝাঁক সাদা ফিঙে পাখি।
দূরে গীর্জার ঘণ্টা একবার বেজে উঠল। সেই শব্দে কিছু জানালায় ধীরে ধীরে পর্দা সরে গেলো, কোনো এক ঘরের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা, তার হাতে মাটির কাপ আর কাপে ধোঁয়া উঠছে—কাফে দে ওল্লা, মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী দারচিনির কফি।
রাস্তার পাশে টাকোসের দোকান এখনো খোলেনি, কিন্তু পেছনে আগুন জ্বলে উঠছে। নীলচে আঁচে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে এক যুবক,তার পরনে সাধারণ সাদা শার্ট, গলার কাছে ঝুলে আছে একটা ছোট ক্রুশ। তার চোখে ঘুমের ছায়া, কিন্তু মুখে একরাশ স্বপ্ন।
সেই মুহূর্তে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল তাজা রুটির গন্ধ। শহরের নিচু গলিগুলোতে সূর্যের আলো পড়তে শুরু করেছে, ইটের দেয়ালে আঁকা রঙিন গ্রাফিতিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। এমন এক সকালে, মেক্সিকোর বুক চিরে শুরু হতে যাচ্ছে এক গল্প—ভালোবাসা, প্রতিশোধ আর রহস্যের…
.
.
.
.
নিশুতি রাতের শেষ প্রহর যেনো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল ‘ভিলা এসপেরাঞ্জার’ আকাশে। আর সেই সুবিশাল, মার্বেল পাথরে তৈরি দোতলা প্রাসাদের মতো বাড়ির এক রাজকীয় ঘরে বিশাল এক বিছানায় আধা গা ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী।
এক হাতে চোখ ঢেকে ঘুমোচ্ছে সে,সূর্যের আলো তার চিবুক ছুঁয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হালকা ঢেউখেলে পড়া কালচে বাদামী চুলগুলো এলোমেলোভাবে মুখের পাশে ছড়িয়ে পড়েছে। নিঃশ্বাসগুলো গভীর, ভারী—তাঁর ব্যস্ত জীবনের প্রতিটি দায়িত্ব আর মুখোশ যেন এই ঘুমেই একমাত্র স্থগিত।
ঘরটা যেনো বিলাসিতার সব সংজ্ঞা ছুঁয়ে গেছে—ছাদ থেকে ঝুলে থাকা স্ফটিক ঝাড়বাতি, দেওয়ালে আঁকা রেনেসাঁ যুগের শিল্প, অন্ধকারে হালকা উজ্জ্বল হয়ে থাকা স্বর্ণরঙা ফ্রেমে বন্দি তার পারিবারিক ইতিহাস। বিছানাটি ছিল রাজকীয় যা কালো স্যাটিনের চাদরে মোড়ানো, নরম ফেদারযুক্ত বালিশে ঘুমোচ্ছে সে। তার নিঃশ্বাস ভারী, ঘুম গভীর, যেন বাইরের পৃথিবীর কোন সাড়াশব্দই তার কানে পৌঁছায় না।
হঠাৎ ট্রিং… ট্রিং… ট্রিং…একটা শীতল আর কর্কশ ফোন রিং কেটে দেয় সেই নিস্তব্ধতা। ঘুমঘুম চোখে, এক হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে জাভিয়ান ফোনটা ধরল।
“হ্যালো জাভিয়ান স্পিকিং”
কণ্ঠটা ভারী, কিন্তু বিরক্ত। ফোনের ওপাশ থেকে কিছু একটা শোনার পর হঠাৎ সে চোখ পুরোপুরি খুলে ফেলল। দুটো ভুরু কুঁচকে গেল, ঘুমের আর রেশ রইল না তার বিন্দুমাত্র।
সে বিছানা থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো তার চকচকে ফর্সা মুখ, দীর্ঘ নাক আর কাঁচের মতো স্বচ্ছ ধুসর সোনালী চোখ রাগে লাল হয়ে উঠল। ফোনটা সে এমনভাবে ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারল যেন ওটা একটা বিস্ফোরক!
থ্যাঁত থ্যাঁত করে শব্দ করে ফোনটা গিয়ে দেয়ালে আঁচড়ে পড়ে ভেঙে গেলো। তার নিঃশ্বাস ছিল ভারী আর ফুসফুস যেন রাগে ফুলে উঠেছে। ওর গালদুটো লাল, চোখে আগুনের ঝিলিক।
“এই গেমটা কেউ খেললে, তাকে আমি শেষ করে ফেলবো,” জাভিয়ান ফিসফিসিয়ে বললো।
ভোরের রাগ আর চঞ্চলতাকে গিলে ফেলে জাভিয়ান এবার সোজা গেলো তার ব্যক্তিগত বাথরুমে। ভিলা এসপেরাঞ্জার এই অংশটা যেন বিলাসিতার শেষ সীমানা—মার্বেলের মেঝে, স্বচ্ছ কাচের ঝরনা ঘেরা শাওয়ার, দেয়ালের একপাশে সুবাসিত তোয়ালে ঝুলে আছে, আর অপর পাশে ডিজিটাল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
জাভিয়ান ধীরে ধীরে তার কালো স্যাটিনের নাইট সুটটি খুলে ফেললো।গা থেকে ঝরে পড়লো একরাশ রাতের ঘুম আর রাগের উত্তাপ। কাচঘেরা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়তেই মাথার ওপরে থেকে নেমে এলো উষ্ণ জলের ধারা,যেন তার গলার রুদ্ধস্বরে আটকে থাকা রাগ আর শঙ্কা ধুয়ে দিতে চায়। তার ছয় প্যাকের গাঁথা পেশিতে জল পড়ে চকচক করে উঠলো। শাওয়ারের মাঝেই চোখ বন্ধ করে সে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকলো, নিঃশ্বাস গুলো ভারী, কিন্তু মন ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে।
শাওয়ার শেষ করে দ্রুত তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে বেরিয়ে এলো। এরপর তার ক্লোজেটের দিকে পা বাড়ালো, যেটা দেখতে যেন ছোটখাটো একটা হাই-এন্ড ফ্যাশন হাউজ—গুচি, প্রাডা, আরমানির স্যুট সারি সারি ঝুলে আছে, প্রতিটা আলোর নিচে সাজানো।
আজকের দিনটা আলাদা। সে সময় নষ্ট না করে বেছে নিলো চারকোণা কাটা ধূসর রঙের এক আরমানি স্যুট, সঙ্গে কালো সিল্ক টাই আর হাতে রোলেক্স ঘড়ি। তার পোশাকের সাথে সাথে মুখেও ফিরে এলো সেই ধীর, নিয়ন্ত্রিত রাজকীয় অভিব্যক্তি। যেন কিছুক্ষণ আগের সেই উত্তপ্ত ছেলেটি আর নেই—এখন দাঁড়িয়ে আছে জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর ধনী বাবার একমাত্র পুত্র।
.
.
.
.
ভিলা এসপেরাঞ্জার বিশাল ডাইনিং রুমের মার্বেল পাথরের টেবিলে আজকের সকালের নাশতা সাজানো ছিলো অভিজাত কাচের প্লেটে। রোদ এসে পড়েছে সোনালী পর্দার ফাঁক দিয়ে। পুরো ঘর যেন জেগে উঠেছে রাজকীয় আলোয়। সামনে সাজানো অ্যাভোকাডো সালাদ, কুইনোয়া ব্রেড আর অরেঞ্জ জুস।
ডাইনিং টেবিলের এক প্রান্তে বসে আছেন জাভিয়ানের বাবা—সায়েম চৌধুরী, এক বাংলাদেশি ব্যবসায়িক আইকন, যিনি গত তিরিশ বছরে বাংলাদেশের সাথে সাথে মেক্সিকোতেই সাম্রাজ্য গড়েছেন। গলার গাম্ভীর্য আর চোখের রেশমি তীক্ষ্ণতা বোঝায়, তিনিই এই চৌধুরী সাম্রাজ্যের আসল চালক।
সায়েম চৌধুরীর পাশে বসা আছেন তার স্ত্রী—কার্লা এস্পেরান্তা চৌধুরী, এক সময়ের মেক্সিকোর বিখ্যাত সমাজসেবিকা। তার পরিপাটি হেয়ারবানে ধরা কোকো বাদামি চুল আর শান্ত চোখে এক অপূর্ব দৃষ্টি—মায়ের মতো কোমল, কিন্তু মেক্সিকান অভিজাত রমণীর মতো দৃঢ়তাও আছে।
ডানপাশে বসেছেন জাভিয়ানের চাচা—সাইফ চৌধুরী, যিনি পারিবারিক ব্যবসার ইউরোপিয়ান শাখা সামলান। গায়ে নীল লিনেন শার্ট, চোখে বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি।
তার পাশে বসে আছে চাচাতো বোন—লুসিয়া চৌধুরী। সে আজ হলুদ টপ আর ব্লু ডেনিমে এসেছে, ছোট ছোট ঝুলন্ত কানে দুল, হাতে ফোন নিয়ে ব্যস্ত টিকটকে। লুসিয়া মেক্সিকান দিকটায় বড় হয়েছে, কিন্তু চৌধুরী রক্তে তার আত্মবিশ্বাস টগবগ করে।
সবচেয়ে শেষে, চাচাতো ভাই—মার্কো রেয়েস চৌধুরী, যে সদ্যই লন্ডন থেকে ফিরেছে। তার চোখে গাঢ় রিমের চশমা, হাতে বই, আর গলায় হালকা সিল্কের স্কার্ফ। পড়াশোনায় তুখোড় হলেও আজকের সকালের উত্তেজনা তার চোখেও ধরা পড়েছে।
চাচা—সাইফ চৌধুরী কিছু বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সায়েম চৌধুরীই প্রথম বলে উঠলেন, “জাভি এখনো উঠলো না?”
মিসেসে কার্লা একটু বিরক্ত মুখে বললেন, “তুমি জানো না? ওর ঘুমের টাইম একেবারে বন্য জানোয়ারদের মত। কখন ঘুমোয়, কখন ওঠে, কোনো নিয়ম নেই!”
সায়েম চৌধুরী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নামতে দেখা গেল জাভিয়ানকে। চুল আধা ভেজা, স্যুট-বুটে একেবারে রাজপুত্রের মত সাজানো, এক হাতে হালকা দুলতে থাকা ওয়াইনের বোতল,আর অন্য হাতে কাঁচের গ্লাস—যেটাতে ধীরে ধীরে ও নিজেই ওয়াইন ঢালছে আর ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে গ্লাসে ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দিচ্ছে ওয়াইনের গ্লাসে।
ঘরের সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তবে কেউ অবাক হয়নি। কারণ এটা নতুন কিছু না।
চাচাতো বোন লুসিয়া চৌধুরী নিচু স্বরে ফিসফিস করলো, “মর্নিং শো অফ…এজ অলওয়েজ”
চাচাতো ভাই মার্কো রেয়েস চৌধুরী ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল, “ব্রাঞ্চ উইথ ড্রামা।”
জাভিয়ান সবাইকে এক নজর দেখে আবার হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে ওয়াইনের গ্লাসে আরেক চুমুক দিল।
ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে এসে বসলো জাভিয়ান। স্যুটের ভেতরের সাটিন শার্টের দুটো বোতাম খোলা, গলায় সোনার চিকন চেইনটা আলতো ঝুলছে। হাতে ডায়মন্ডের ব্রেসলেট। পায়ের ওপর পা তুলে বসে পড়লো। জাভিয়ান চোখেমুখে একরকম তাচ্ছিল্যের ছাপ নিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। সবাই নীরব। সেই মুহূর্তেই তার বাবা সায়েম চৌধুরী গর্জে উঠলেন—
“আর কতদিন এভাবে চলবে জাভি? বেপোরোয়া, বেয়াদবের মতো আচরণ! এবার তো একটু ডিসেন্ট হও। তোমার জন্য আজকাল কারো কাছে মুখ দেখাতে পারছিনা। সবার এক কথা আপনার ছেলে আপনার বিজনেস কেনো সামলাচ্ছে না”।
জাভিয়ান সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল—“তাহলে মুখ ঢেকে রাখুন মিস্টার চৌধুরী। কে বলেছে এই মুখ আপনাকে দেখাতে? আপনার মুখে এমন স্পেশাল কিছুই নেই যে কাউকে দেখাতেই হবে।”
তার ঠাণ্ডা জবাবে টেবিলের চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। মা মাথা নিচু করে রইলে, বোন কাঁটা চামচ নাড়তে লাগল অস্থির হাতে। কিন্তু জাভিয়ান? সে যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে ওয়াইনের গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে এক চুমুক খেল, ঠোঁটের কোণে একরকম বিদ্রুপের হাসি।
রুপালি ট্রেটা এবার সার্ভেন্টের হাতে।সে এসে নিখুঁতভাবে টেবিলে প্লেট নামিয়ে দিল যার ভেতরে ছিলো মেক্সিকান বিফ এনচিলাডা, ঝাল ঝাল টাকো, একপাশে লেবু দেওয়া সালসা,আর ধোঁয়া ওঠা স্প্যানিশ রাইস।কিন্তু জাভিয়ান চোখ রেখেছিল শুধু এক জায়গায়—সেখানে তার প্রিয় ম্যাঙ্গো লাইম জুসটা নেই।
জাভিয়ানের মা স্রেফ একবার চোখ তুলে বললেন, “জুসটা আজ দেইনি। তোমার শরীর ভালো যাচ্ছে না।”
জাভিয়ান কিছু না বলেই মাংস আর একটু ভাত তুলে মুখে দিল, তারপর আর না খেয়েই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াতে গেল।
“বসো। পাঁচ মিনিট। দয়া করে,” বাবা সায়েম চৌধুরীর গলা কঠিন হয়ে উঠল, “কিছু জরুরি কথা আছে।”
জাভিয়ান বসে পড়লো, তবে চেহারায় বিরক্তির রেখা স্পষ্ট। আঙুলে ধীরে ধীরে ঘুরছে সিগারেটের শেষ টুকরোটা, যেন সেই ঘূর্ণনের মধ্যেই আটকে আছে শত ঝড়ো ভাবনা।
সায়েম চৌধুরী গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“আমার এক পুরনো বন্ধু—পুরো বিশ্বের অন্যতম পাওয়ারফুল বিজনেস টাইকুন—তার সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির শেষ ধাপে পৌঁছেছি। কিন্তু একটাই শর্ত… তাঁর মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে হবে।”
এক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এলো টেবিল জুড়ে।
তারপর জাভিয়ানের ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল দৃঢ়, কাটা স্বর “সরি মিস্টার চৌধুরী। আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমি… আমি একজনকে ভালোবাসি।”
কথাটা যেন ঘরের ঠান্ডা বাতাসে ধাক্কা খেয়ে গিয়ে থেমে যায়। সায়েম চৌধুরী ধীরে ধীরে তার সামনে ঝুঁকে এলেন। তাঁর চোখে অভিজ্ঞতা আর অবিশ্বাসের ভার।
“ভালোবাসো?” তিনি তাচ্ছিল্যভরা স্বরে হেসে বললেন,
“তুমি, জাভিয়ান? ভালোবাসতে জানো? এই শব্দগুলো শুধু ঠোঁটের খেলা তোমার কাছে। মন বলতে কিছু আছে তোমার মধ্যে? আমি তা এখনও দেখিনি কখনোই। কিন্তু এবার আমি দেখতে চাই। যেহেতু মুখে বললে একজনকে ভালোবাসো। তাহলে সাত দিনের মধ্যে, হ্যাঁ—ঠিক সাত দিন—যাকে ভালোবাসো, তাকে আমার সামনে হাজির করো। তখন বুঝব, তুমি কল্পনার মানুষ, না বাস্তবের।”
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। জাভিয়ানের চোখে জ্বলে উঠল এক অভিমানি আগুন। ধোঁয়ার কুয়াশার ভিতর থেকে উঠে দাঁড়াল সে। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলল অ্যাশট্রেতে।
চোয়াল শক্ত করে, ঠান্ডা গলায় বলল “ঠিক আছে, বাবা। তাহলে চলুক গেম—তোমার শর্তে, তোমার নিয়মে। কিন্তু খেলাটা কে শেষ করে—তা দেখার সময় এসেছে।”
জাভিয়ান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে চেয়ারটা সরিয়ে দিল,বাবার চোখে সামনে আর এক মুহূর্ত থাকতে চাইছে না। বুকের ভেতরটা গর্জে উঠলেও ঠোঁটের কোণে ঠাণ্ডা তাচ্ছিল্য লেগে রইল।
পিছন ফিরে বলল, “আপনার খেলা যদি খেলতেই হয়, তাহলে আমি আমার নিয়মে খেলবো, মিস্টার চৌধুরী।”
তারপর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই ধীর পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল সে। চলনের ভঙ্গিতে ছিল এক ধরনের বিদ্রোহ, আর পেছনে রেখে গেল এক ঘন নীরবতা।
সায়েম চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। কপালের ভাঁজ আরও স্পষ্ট হলো। নিজের চেয়ারে ধসে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, “এই ছেলেটাকে নিয়েই কত স্বপ্ন ছিলো আমার… একমাত্র ছেলে। ভাবতাম ব্যবসার হাল ধরবে, একদিন ঘরে একটুখানি হাসি নিয়ে আসবে। একটা পরিবার… একটা নাতি-নাতনি… আমি চোখ বুজে যাওয়ার আগে ওদের মুখটা দেখবো…”
তার গলার স্বর কেঁপে উঠল। ঘরের বাতাসে তখন কেবলই সিগারেটের ছায়া, অতৃপ্ত আশা, আর এক বাবার চেপে রাখা অভিমানের ভার।
.
.
.
.
জাভিয়ান সারাদিন পর রাতে বাড়িতে ফিরেছে কোথাও থেকে। নিজের ঘরে পা ফেলতেই হাতঘড়ির দিকে একবার তাকাল। ১১টা ৪৫ বাজে। নিজের ড্রেসিংরুমে ঢুকে চোখ ধাঁধানো কালো স্যাটিন শার্ট আর সিল্কের স্যুট জ্যাকেট তুলে নিল। নিখুঁতভাবে চুলে জেল ছড়িয়ে আয়নার সামনে একবার দাঁড়াল—ঠোঁটে তীব্র এক উপহাসের রেখা।
হাতের ফোনটা তুলে ডায়াল করল “রায়হান, শুনছো? কালো ভিআইপি টেবিলটা tonight—exactly 12 AM sharp.আমার usual seat. কেউ যেন সেটা না নেয়। এবং yes, bring the blue-chip cards. High-stakes tonight.”
অন্যপ্রান্তে দ্রুত সম্মতিসূচক আওয়াজ, “জ্বি স্যার, already informed them. আপনার রুলস অনুযায়ী রেড ওয়াইন রেডি থাকবে, আর সিকিউরিটি ডাবল। ক্লাব ‘Eclipse’ আপনাকেই ওয়েলকাম করবে।”
ফোনটা কেটে দিয়ে জাভিয়ান ধীর পায়ে নিচে নামল। গ্যারেজে দাঁড়িয়ে থাকা পৃথিবীর অন্যতম দামি গাড়ি—Bugatti La Voiture Noire। কালো গাড়ির বডিতে যেন জোছনার আলো পড়ে চকচক করছে।
ড্রাইভারের দরকার হলো না। নিজেই দরজা খুলে বসে পড়ল, স্টার্ট দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে বুক পকেট থেকে ধীরে ধীরে বের করল একটি ম্যাচলাইট। ধাতব কভার ঘষে আগুন ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে থাকা সিগারেটটা জ্বালাল।য়আগুনের ছোট্ট ঝলক গাঢ় রাতকে যেন আরও গাঢ় করল।
গাড়ির ভেতরে জ্যাজ সংগীত বাজছে হালকা ভলিউমে। হেডলাইট জ্বালিয়ে সে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।চোখেমুখে অভিজাত বন্যতা, আর ঠোঁটে দুঃসাহসিক এক চিরন্তন প্রশ্ন—“এই শহর আমাকে থামাতে পারবে?”
.
.
.
.
সেই রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল মেক্সিকো সিটির এক নির্জন গলিতে। ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছিল এক কালো রঙের বুলেটপ্রুফ SUV। গাড়ির জানালায় টকটকে লাল একটি রশ্মি পড়ছিল, যেন ভিতরে আগুন জ্বলছে।
গাড়ি থামতেই দরজা খুলে নামলো একজন পুরুষ। লম্বা কোট, মাথায় হুড। এক হাতে মোটা চামড়ার গ্লাভস, আরেক হাতে ইলেকট্রনিক স্মোকিং ডিভাইস।
চারপাশের গার্ডরা সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। যেন তার চোখে চোখ পড়লে প্রাণ যাবে। এই সে— মেইলস্ট্রাম। যার নাম শুনলেই প্রতিপক্ষ শহর ছেড়ে পালায়।
মেক্সিকো সিটির এক গোপন আন্ডারওয়ার্ল্ড ক্লাব —“Inferno Room” সময়: রাত ১টা।
অন্ধকারে আলোকিত কাঁচের ফ্লোর। বেসবোলে বাজছে গা গরম করা বিট। লাল নীল আলোয় দুলছে পুরো ক্লাব। আর তার মধ্যখানে বসে আছে মেইলস্ট্রাম—সেই রহস্যময় মাফিয়ার ডন।
সে হাফ হাতা কালো সাটিন শার্ট পরে আছে, খুলে রাখা দুই-তিনটা বোতাম। চোখে কালো সানগ্লাস, মুখে হালকা স্টাবল। একহাতে হুইস্কির গ্লাস, আরেকহাতে ছোট্ট সোনালি লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালো।
সেক্রেটারি কানে মুখ এনে ধীরে ধীরে বললো “বস, কাল রাতের অ্যাকশনটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল… ছেলেটার খোঁজ নিচ্ছে ওরা।”
মেইলস্ট্রোম ঠাণ্ডা গলায় বললো “খোঁজ তো নেবেই। খোঁজটা যেন আর না নিতে পারে, সেই বন্দোবস্ত করো।”
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। আশেপাশের মানুষ এক মুহূর্তে থমকে গেলো—এ যেন নিজের রাজ্যে রাজা উঠে দাঁড়িয়েছে। সে হেঁটে গেল ক্লাবের গোপন লাল দরজার দিকে, যেটা সবার জন্য নয়।
একজন ক্লাব ওয়েটার ফিসফিস করে আরেকজনকে বলল: “এই লোকটা কে জানিস? কেউ জানে না আসলে। শুধু নামটা শুনেছি — মেইলস্ট্রোম।”
আরেকজন বললো “বলে রাখা ভালো, এই নাম মুখে আনার আগে দু’বার ভাবিস। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া সবাই পারে না।”
দরজার ওপাশে ছিল প্রাইভেট গেম রুম। এক টেবিলে চলছে ব্ল্যাকজ্যাক, আরেকটায় রুলেট। মেইলস্ট্রাম হালকা হাঁসলো।
মেইলস্ট্রাম নিজের মনে মনে বললো “সবাই ভাবে খেলার নিয়ম ঠিক আছে… কিন্তু খেলার আসল নিয়ম তো আমিই লিখি।” সে নিজের আসন গ্রহণ করলো, পিছনে দাঁড়ানো দুজন সশস্ত্র বডিগার্ড। তার সামনে হুইস্কির গ্লাস। আঙুলে ঘুরছে রিং। একজন ধীর পায়ে কাছে এসে বললো,— “স্যার, আজকে ‘লর্ড রিকো’ ক্লাবে এসেছে। জানতে চেয়েছিলো আপনি থাকবেন কিনা।”
মেইলস্ট্রাম ঠোঁটে সিগার লাগিয়ে হালকা হেসে বলল—
“ওর সাহস আছে এখনো আমার ক্লাবে ঢোকে? দেহে পুরনো গুলির দাগ থাকলেও মস্তিষ্কে মনে রাখার ক্ষমতা নেই।”
হঠাৎ একজন সুন্দরী নারী এসে পাশে বসলো ।আর বললো, “আপনি কি সত্যিই মেইলস্ট্রাম? শুনেছি আপনি মানুষের মুখে আগুন ঢেলে দিতে পারেন…”
সে ধীরে ঘুরে তাকালো মেয়েটার দিকে আর সিগারেটের ধোঁয়া ছুঁড়ে দিয়ে বলল,”তুমি যা শুনেছো, তার চেয়েও খারাপ আমি। কিন্তু মুখে আগুন নয়… আমি আগে হৃদয় পোড়াই।”
ক্লাবের ভেতর তার আন্ডারবসরা জড়ো হতে শুরু করলো। একজন বললো, — “স্যার, কাল রাতে ‘লারচি বন্দর’-এর মাল আমাদের হাতে এসেছে। কিন্তু মাফিয়া কোড ভেঙে এক লোক কথা ফাঁস করেছে।”
মেইলস্ট্রাম চোখ না তুলেই বলল— “তাকে নদীতে ফেলে দাও। কথা বলা শিখলে জলে শ্বাস নেওয়া ভুলে যাবে।”
একটা বিশাল স্ক্রিনে ম্যাপ খুলে রাখা হলো, গোপন অস্ত্রচোরাচালান, ব্ল্যাক ফান্ড, আর রাজনৈতিক সংযোগের চিত্র।
মেইলস্ট্রোম বললো—”মেক্সিকো আজ আমার, কাল ল্যাটিন আমেরিকা, আর তারপর… গোটা পৃথিবী। কিন্তু আমি ছায়ায় থাকবো। আলোর মধ্যে নয়।”
.
.
.
.
অন্যদিকে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রফেসর মাহবুবের কক্ষ | সকাল ১১টা।
তান্বী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে প্রফেসর মাহবুবের টেবিলের সামনে। তার মুখে কোনো অনুশোচনা নেই, বরং একরকম অভিমানী স্পর্ধা ছড়িয়ে আছে চোখেমুখে। সে মেয়েটি যেন ঠিক গল্পের পাতা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা কোনো এক ভুবনমোহিনী। তীক্ষ্ণ আঁকা ভ্রু, মেঘডুবো চোখে একরকম রহস্য, আর সেই চোখ জুড়ে যেন এক জন্মের বিদ্রোহ লুকিয়ে আছে। কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া খোলা চুলগুলো একটু এলোমেলো, যেন হাওয়া ছুঁয়ে গেছে সদ্য। পরনে ঢিলেঢালা কুর্তি, কিন্তু তার চলাফেরায় যেকোনো কাঠামোর মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে।
প্রফেসর মাহবুব চশমা ঠিক করতে করতে বললেন “তান্বী, তুমি বুঝতে পারছো তো তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কতটা গুরুতর? পাঁচদিন আগে তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একজন লোকের গাড়ির কাঁচ ভেঙে দিয়েছো।
তান্বী ঠোঁট চেপে রাগ চাপিয়ে বললো ” কারণ ছিলো স্যার। ওই লোক আমার ফ্রেন্ডের ওপর গাড়ি চালিয়ে দিচ্ছিলো ইচ্ছা করে। আমি থামাতে চেয়েছিলাম… কিন্তু সে থামেনি।
প্রফেসর মাহবুব কঠিন গলায় বললেন “তাই বলে তুমি আইন হাতে তুলে নেবে? তুমি জানো সে কে ছিলো?
তান্বী চোখ সরিয়ে বললো “না, জানি না স্যার। তবু মানুষ আগে, পরিচয় পরে।
প্রফেসর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। “তান্বী, এটা কি তোমার কোনো অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে? যার গাড়ির কাচ ভেঙে দিলে, সেটা ছিলো একজন কুখ্যাত মাফিয়ার গাড়ি।”
তান্বী ঠোঁট চেপে এক মুহূর্ত চুপ থাকে, তারপর বলে,
“স্যার, সেদিন আমার ফ্রেন্ড মরে যেতো আমার চোখের সামনে,আমি কি তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম?”
প্রফেসরের চোখে বিরক্তির ছায়া। “এর আগেও এমন ঘটেছে, তুমিই তো কলেজে থাকাকালীন একটা মেয়ের চুল কেটে দিয়েছিলে?”
তান্বী হালকা গলায় উত্তর দেয়,”কারণ, স্যার, সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের চুল টেনে ধরেছিলো। আমি সহ্য করতে পারিনি।”
প্রফেসর এবার চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ান। “তোমার আচরণ খুব দুঃখজনক। কাল তোমার ভাইয়াকে পাঠাবে আমার অফিসে। আমি আর সহ্য করবো না, তোমার ব্যাবস্থা করতেই হবে।”
তান্বীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে। সে বুঝতে পারে ভাইয়াকে জানানো মানেই ঘরে এক যুদ্ধ বয়ে আনা। তার ভাই তো রাগে অগ্নি হয়ে যাবে, আবার হাতও তুলে বসতে পারে। কিন্তু তখনই সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয় — এলিনা আপাকে নিয়ে আসবে। বড় আপা বোঝাতে পারবে সিচুয়েশনটা, অন্তত ভাইয়ের রাগটা সামলাতে পারবে।
তান্বী রুম থেকে বেরিয়ে যায় গেলো। হোস্টেলের করিডোর দিয়ে হেঁটে চলেছে ধীর পায়ে। হঠাৎ সে মনে করতে থাকে সেই ঘটনার দিনটি।
ঢাকা শহরের গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলো ও আর ওর বান্ধবী স্নেহা। আচমকা সেই কালো SUV গাড়িটা স্নেহার দিকে ধেয়ে এসেছিল। এক মুহূর্তও চিন্তা না করে তান্বী পাশের ইট তুলে গাড়ির কাচে সজোরে আঘাত করেছিল। বিকট শব্দে কাচ ভেঙে পড়ে গিয়েছিল।
গাড়ি থেমে যায়।একজন রাগী ড্রাইভার নেমে এসে ঝগড়া শুরু করে তান্বীর সাথে। “এই মেয়ে কার গাড়িতে ইট মেরেছো বুঝতে পারছো?”
তান্বী ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, “আপনার মালিককে গিয়ে বলুন, আরেকবার যদি এভাবে গাড়ি চলে রাস্তাঘাটে, তাহলে গাড়িটা পুড়িয়ে দেবো একেবারে।”
ড্রাইভার তখন চিৎকার করে তেড়ে আসে, কিন্তু ঠিক তখনই গাড়ির ভেতর থেকে কেউ জানালা খুলে হালকা হাতের ইশারায় থামতে বললো। ইশারাটি মাত্র এক সেকেন্ডের, কিন্তু ড্রাইভার থেমে যায়, মুখ বন্ধ করে গাড়ির দরজা খুলে আবার ভেতরে ঢুকে পড়ে।
তান্বী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কে ছিলো সে?ড্রাইভারের ওপর এমন প্রভাব যার? তার চোখে তখন একঝলক ভয়, একঝলক কৌতূহল। আর আজ, সেই ঘটনার রেশ ধরেই তার বিচার চলছে।
.
.
.
.
রাতের আকাশে তারাভরা নীরবতা। মেক্সিকো সিটির ঝলমলে আলো যেন নিচে বইছে নদীর স্রোতের মতো। উঁচু ব্রিজের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাভিয়ান। ঠোঁটে ধরা সিগারেট নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে বাতাসে। তার চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা। যেন আকাশের মধ্যেই হারিয়ে আছে কিছু হিসেবের খাতা।
এই সময় পেছন থেকে নীরবে এসে দাঁড়ায় সেক্রেটারি রায়হান। তার কণ্ঠে জিজ্ঞাসার চেয়েও বেশি চিন্তা, রায়হান ধীরে ধীরে বললো “স্যার… বাড়ি যাবেন না?”
জাভিয়ান চোখ না সরিয়েই, ধোঁয়ার ওপর চোখ রেখে নিঃস্পৃহ গলায় বলে “একটা মেয়ে খুঁজে বের করো। সাত দিনের মধ্যে।”
রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ভেতরে অজস্র প্রশ্ন “হঠাৎ মেয়ে, স্যার?”
জাভিয়ান ঠোঁটে টেনে নেয় একধরনের বিদ্রুপমাখা হাসি। “মিস্টার চৌধুরী আবারও সেই পুরোনো খেলা শুরু করেছে। প্রতি বছরই কেউ না কেউ তার বিজনেস পার্টনারের মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়। এইবার আমি তাকে বলেছি… আমি একজনকে ভালোবাসি।”
রায়হান থমকে যায়, হঠাৎই কাশতে শুরু করে।
“কী?! আপনি… আপনি ভালোবাসেন?” একটু থেমে আবার বললো “মানে… রিয়েলি?”
জাভিয়ানের চোখে কোনো ভাঁজ নেই। শুধু ধোঁয়ার গন্ধ আছে। “মিথ্যে বলেছি, রায়হান। আমি কাউকে ভালোবাসি না। কিন্তু এখন সাত দিনের মধ্যে একটা মেয়েকে নিয়ে হাজির হতে হবে। মিস্টার চৌধুরীর সামনে।”
রায়হান ফিসফিস করে বললো “কিন্তু স্যার, আপনার তো মেয়েদের প্রতিই… ইন্টারেস্ট নেই…”
জাভিয়ান সানগ্লাস নামিয়ে কড়া চোখে তাকালো “যেভাবে বলছো, মনে হচ্ছে আমি ছেলেদের প্রতি ইন্টারেস্টেড? গে নাকি আমি?”
রায়হান চমকে ওঠলো “আরে না না না! আমি ওটা মিন করিনি! আমি বলতে চাচ্ছি… আপনি তো মেয়েদের ঘৃণা করেন…”
জাভিয়ান মাথা নাড়লো, এবার গলাটা তিক্ত হললো “হ্যাঁ, করি। কারণ ওরা সবাই গোল্ড ডিগার হয়। টাকা, স্ট্যাটাস, মিডিয়া ফোকাস—এই জিনিসগুলোই ওদের প্রেম। ওরা ভালোবাসে না, ওরা ডিল করে। আর আমি হিসেব নিয়ে কাউকে পাশে রাখি না।”
রায়হান হালকা হেসে জবাব দিল “তাহলে স্যার, সাত দিনের মিশন তো সোজা! ক্লাবে তো লাইন ধরে আছে মেয়ে। ডান থেকে বাম, চায়না থেকে স্পেন—আপনাকে দেখেই পাগল হয়ে যায়।”
জাভিয়ান মাথা নাড়ে, এবার গলা নিচু, কঠিন হয়ে উঠলো “এসব চতুর মেয়ে না। এমন একটা মেয়ে চাই… যে হবে সরল। একদম ইনোসেন্ট। যে আমার কথায় উঠবে আর বসবে। আমার জগতে ঢুকে পড়লেও প্রশ্ন করবে না। যে মিথ্যা বুঝবে না—আর সত্য বললেও ভয় পাবে।”
রায়হান ঠোঁটে চাপা হাসি চেপে বলে “এমন মেয়ে তো স্যার… শুধু বাংলাদেশে মধ্যেই পাওয়া যায়।”
চোখ ছোট করে কটাক্ষ করে বললো রায়হান। “সোজা বাংলায়, ‘মিস্টার অন্ধকারের’ জন্য একটা ‘মিস্টারিন ইনোসেন্স’ দরকার, তাই তো?”
জাভিয়ান হালকা বাঁকা হেসে বললো “হ্যাঁ। তাহলে বাংলাদেশেই খুঁজে দেখো রায়হান।” একটু থেমে আবার বললো “আজ থেকে সাত দিন সময়। আমি হারতে চাই না। বাবার শর্ত—আমার নিয়মে।”
রায়হান মনে মনে বলে উঠলো মাথা চুলকে “আহারে… কোন হতভাগা মেয়ের কপালটা পুড়বে এবার…!!”
.
.
.
.
রাত ১২টা, ধানমণ্ডির একটি পুরনো পোড়োবাড়িতে গোপন মাফিয়া বৈঠক বসেছে।
মেঘলা রাত। বিদ্যুৎ নেই আশেপাশে। ছাদের চুড়োয় একটি ছোট পাখি ডেকে উঠল, যেন অন্ধকারে কোনও আশঙ্কার সংকেত দিচ্ছে।
পুরনো পোড়োবাড়ির নিচতলার একটি ঘরে বসে আছে ফারহান রেহমান। বয়স ছাব্বিশ, মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করে বাঁধা, পরনে কালো শার্ট আর সিগারেটের ধোঁয়া ফুস করে ছাড়ছে সে। সামনে বসে আছে চারজন, তাদের মধ্যে একজন চরম গুরুত্বপূর্ণ –মেক্সিকোর “সান্তানো কার্টেল”-এর দক্ষিণ এশিয়া শাখার প্রধান, নাম রিকার্দো সান্টো।
রিকার্দো ঠান্ডা গলায় বললো “তুমি অনেকদিন ধরেই আমাদের হয়ে কাজ করছো, ফারহান। আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু এবার তোমাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
ফারহান চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, গম্ভীর হয়ে।
রিকার্দো চোখ টিপে বললো “তোমার বন্ধুর নাম হোসাইন,তাই না? সে এখন আমাদের পথে বাঁধা। ও পুলিশকে তথ্য দিয়েছে। তোমার কাজ—তাকে চুপ করানো।”
ফারহানের মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো ফারহানের চোখ টলমল করলো “আমি হোসাইনকে ছোটবেলা থেকে চিনি। সে আমার রক্তের ভাইয়ের মতোই, আমি কিছুতেই…”
রিকার্দো হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। ঠান্ডা হাসি মুখে।
রিকার্দো বললো “এটাই তো মাফিয়ার নিয়ম, ফারহান। ‘Feelings make you weak’. Either you shut him up, or we shut you down. এবং শুধু তুমি না, তোমার ছোট দুই বোন এলিনা আর তান্বী—তাকেও।”
এই নাম শোনামাত্রই ফারহানের চোখ জ্বলে ওঠে। সে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ফারহান তখন বললো “তান্বী আর এলিনার দিকে তাকালে আমি তোমাদের কাউকে ছাড়বো না ।”
রিকার্দো হেসে ওঠে। “তুমি আমাদের হুঁশিয়ারি দিচ্ছো, ফারহান? Don’t forget who gave you the seat.”
ফারহান থমকে যায়। বুঝে যায়, সে নিজেই একটি জাল বিস্তার করেছে যার ফাঁদে সে নিজেই জড়িয়ে গেছে। বন্ধুত্ব, বোন, পরিবার—সব একপাশে, আর অন্যদিকে জীবন রক্ষা আর শক্তি। ঘরটিতে মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে আসে।
অন্যদিকে তান্বী তখন নিজের ঘরে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে পড়ছে ফারহান কত কিছুর মধ্যেও তার জন্য সময় বের করে আর তাকে আদরে রাখে। আর এখন, সে জানেই না যে তার ভাই কী দুঃসহ সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে…
.
.
.
.
.
বৃষ্টি পড়ছিল একটানা। ধানমন্ডির এক নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল ফারহান রেহমান। তার মোবাইলের স্ক্রিনে বারবার ভেসে উঠছিল সেই মেসেজ “Tonight. No mercy. – R”
রিকার্ডোর আদেশ স্পষ্ট ছিল। হুসাইনকে আজ রাতেই শেষ করতে হবে। হুসাইন—যে একসময় তার স্কুলের বন্ধু ছিল, ভাইয়ের মতো। কিন্তু রিকার্ডো জানতে পেরেছে, হুসাইন গোপনে পুলিশের কাছে তথ্য পাচার করেছে। আর রিকার্ডো বিশ্বাসঘাতকদের বাঁচতে দেয় না।
ফারহান জানে, না মানলে তার নিজের জীবনের সাথে সাথে পরিবারের জীবন ও শেষ। তবু তার ভিতরে যুদ্ধ চলছে। সিগারেটটা শেষ করে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়
একটি পরিত্যক্ত গুদামঘর, ঢাকার উপকণ্ঠে।জোরে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। বাতাসে ভেসে আসছে ভেজা মাটির গন্ধ। গুদামঘরের ঝাপসা আলোতে ফারহানের ছায়া দীর্ঘ হয়ে পড়েছে মেঝেতে। তার হাতে একটি সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল। চোখেমুখে অস্থিরতা। সে বারবার ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে — রিকার্ডোর মেসেজ এখনো জ্বলজ্বল করছে “Make it look like a robbery. I want him gone before sunrise.”
একটা পেছনের দরজা দিয়ে হুসাইন ঢুকল। ছাতা ঝাঁকিয়ে রাখল একপাশে।”ফারহান? এত রাতে ডাকলি? কি হয়েছে?”
ফারহান কথা বলছে না। মাথা নিচু করে পেছনে ঘোরে।
হুসাইন এগিয়ে আসে। “সব ঠিক আছে তো ভাই? মুখটা এত থমথমে কেন?” ফারহান পেছনে ঘুরে তাকায়, চোখে জল চিকচিক করে। “তুই… তোকে পুলিশে তথ্য দেয়ার কী দরকার ছিল হুসাইন?” তার গলাটা কাঁপছে।
হুসাইন থমকে যায়।”তুই জানলি কিভাবে?”
“তুই যা করেছিস, তার শাস্তি তোরে দিতে বলছে… রিকার্ডো।”
হুসাইনের মুখের রঙ উবে যায়। “মানে… তুই কি আজকে…?”
হুসাইনের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ফারহান। তার মনে পড়ে সেই সব সময়—একসঙ্গে খেলাধুলা, সিনেমা দেখা, আর প্রথম সিগারেট শেয়ার করার স্মৃতি।
ফারহান আর কিছু না বলেই পকেট থেকে পিস্তল বের করে হুসাইনের কপালে ঠেকিয়ে দেয়। হুসাইন হতবাক, “ফারহান? এটা কিসের নাটক?” তার চোখে সন্দেহ, ভয়, আর বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া।
ফারহান বলে, “তুই জানিস আমি এটা চাইনি… কিন্তু তুই ভুল করেছিস হুসাইন… বড় ভুল।”
একটা গুলির শব্দ… তারপর সব নিস্তব্ধ।
রাস্তায় আবার বৃষ্টি শুরু হয়।ফারহান ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। পেছনে ফেলে যায় বন্ধুত্ব, স্মৃতি… আর রক্তে ভেজা অতীত।
চলবে……………
(আজকের প্রথম পর্ব নিয়ে আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন বা কোথাও বুজতে সমস্যা হলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন গল্পের টুইস্ট ছাড়া বাকি সব উত্তর দিবো আমি)
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৬
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১০
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৭
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২৩
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২২