Golpo romantic golpo মেঘের ওপারে আলো গল্পের লিংক

মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৪১(সমাপ্ত)


মেঘেরওপারেআলো

শেষ_পর্ব

Tahmina_Akhter

মেঘালয়ের কথা শুনে আলো চমকে তাকায়। আলোর বুকটা হাহাকার করে উঠলো। তাকে যদি শুধু একটিবার “ভালোবাসি” বলে সে সবকিছু ভুলে তার ডাক্তার সাহেবের কাছে থেকে যাবে। কিন্তু, নিজ থেকে বলবে না। তার কি এমন দায় পরেছে তাকে মনের খবর জানানোর! সে কি জানে না আগ বাড়িয়ে ভালোবাসার কথা কেবল পুরুষ বলতে পারে? যেটা শুনতে চাইছে সেটা বলছে না। অন্যকথা ঠিকই বলে যাচ্ছে। মানুষটা তাকে আবারও ইনিয়েবিনিয়ে কথার জাদুতে আটকাতে চাইছে।
কিন্তু, সে তো দমে যাওয়ার পাত্রী নয়।

— ওমন ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে একটুআধটু আদর দেনাপাওনার মতো লেনদেন হয়।

কথাটি বলে আলো মেঘালয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। মেঘালয় তার শূন্যহাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো লাগেজ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ায়। ঠিক তখনি পেছন থেকে ভেসে এলো মেঘালয়ের বলা কিছু বাক্য।

—আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে তো তুমি? নিশুতি রাতে ঘুমের ঘোরে আমার বুকে এসে ঠাঁই নেয়া যে তোমার বদঅভ্যেস। সেই বদঅভ্যেস কাটিয়ে উঠতে পারবে? আমাকে তো তুমি ভালোবেসে চাইলে না। অন্তত তোমার বদঅভ্যেস হিসেবে না হয় তোমার মাঝে আমাকে ঠাঁই দিলে!

— ধীরে ধীরে আমার বদঅভ্যেস কেটে যাবে, ডাক্তার সাহেব।

আলো জবাব দিলো ঠিকই কি মেঘালয়ের দিকে ফিরেও তাকালো না। আলোর জবাবের মাঝে এক কিশোরী মেয়ের অভিমানী সুর খুঁজে পেলো মেঘালয়। আলোকে আবারও বলল,

— তুমি পারবে না?

— আমি খুব পারব।

— তুমি পারবে না, আলো।

— আপনি ভুল ভাবছেন আমার ব্যাপারে। কয়েকমাস ঘোরের মাঝে ছিলাম। কারো দেয়া করুণাকে আমি মায়া ভেবে নিজেকে বড্ড সুখী ভেবেছিলাম। ঘোর কেটে গেছে আজ। করুণা এবং মায়ার পার্থক্যে করতে শিখেছি আজ।

মেঘালয় অসহায়ের মত হাসতে শুরু করলো। মেঘালয়ের হাসিটা আলো দেখতে লাগল। কারণ, তার কাছে পৃথিবীর দশটা সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি দৃশ্য হলো তার ডাক্তার সাহেবের হাসি।

হুট করে আলোর মনে হতে লাগল, ” হোক না একটুখানি বেহায়া তাতে কি! লোকে যা বলার বলুক। মানুষটা তাকে নাইবা ভালোবাসুক। সে তো বাসে। মানুষটার হৃদয়ে ঠাঁই না মিলেছে তাতে কি, মানুষটার পায়ে ঠাঁই মিলুক৷ বিয়ের আগে তো ভাবতো চিকন চালের দুমুঠো, ভালো দুটো পোশাক থাকলে খুব ভালোভাবে দিনযাপন করা যায়। কিন্তু, মানুষটাকে মন দেয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে, না খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার চেয়েও অন্যভাবে বেঁচে থাকা যায়। সেই বেঁচে থাকার নাম ভালোবাসা।
একবার কি নিজের আত্মসম্মানকে বলিদান দিয়ে মানুষটার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করবে?

— তুমি যেতে চাও যাও। আমি কিন্তু রাত এগারোটায় তোমাদের বাসার গেটের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করব।

মেঘালয়ের কথা শুনে আলোর শূন্য হৃদয়ে হাহাকার কমে গেল। কারণ, ডাক্তার সাহেব যা বলে তাই করে। দেখা যাবে সত্যি রাতে গাড়ি নিয়ে তাদের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করবে। পরক্ষণেই আলোর মনে পরল ডাক্তার সাহেব তাকে অবিশ্বাস করেছে। তাকে জড়িয়ে মাশফি ভাইয়ার সঙ্গে যে নোংরা আলাপ হলো সেখানেও কেন ডাক্তার সাহেব চুপ করে ইনায়ার কথা শুনছিল? একবারও কি জোর গলায় বিশ্বাসের সুরে বলতে পারল না, “আমার আলো এমন নোংরা মন-মানসিকতার মেয়ে হতেই পারে না।”
আলো আর কিছু ভাবতে পারছে না ভালোবাসা এবং মান-অভিমানের দ্বন্দ্বে জড়াতে গিয়ে মনে হলো মান-অভিমানের বিজয় হওয়া জরুরি। ভালোবাসার কাছে ঠিক তখনি আত্মসমর্পণ করবে, যখন ভালোবাসা এসে নিজ থেকে ধরা দেবে।

আলো পেছনে ফিরে তাকালো না আর। তবে মেঘালয়কে উদ্দেশ্য করে বলে গেল,

— অভিনয় বাদ দিন ডাক্তার সাহেব। আমি জানি, আমার উপস্থিতি অনুপস্থিতিতে আপনার কিছুই যায় আসে না।

কথাটি বলে আলো অপেক্ষা করল না, বেরিয়ে গেল । পেছনে ফেলে গেল তার সাজানো-গোছানো সংসারটাকে। তাকে গোপনে ভালোবেসে যাওয়া তার ডাক্তার সাহেবকে৷

মেঘালয় এবার মৌনতা গ্রহণ করলো। আলো যে সাংঘাতিক রেগে আছে সে খুব ভালো করেই টের পাচ্ছে। আলোকে এখন হাজারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেও লাভ হবে না। কারণ নারীদের এই জেদি স্বভাব জন্মসূত্রে পাওয়া। কোনো এক হাদিস এসেছে, “তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে । পাঁজরের মধ্যে উপরের হাড্ডি সবচেয়ে বেশী বাঁকা, যদি তা সোজা করতে চাও ভেঙ্গে ফেলবে, ছেড়ে দিলেও তার বক্রতা যাবে না। অতএব নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও।”

আলো তাকে কষ্ট দিয়ে দূরে থাকুক তবে তালাকের মত একটা জঘন্য অপরাধে সে নিজেকে জড়াতে চাইছে না। আলোর রাগ এখন যেই পর্যায়ে আছে, সেই পর্যায়ে হুট করে পাগলিটা এমন সিদ্ধান্ত নিতেও পারে। বিয়ের সময় মনে হয়েছিল আলো যথেষ্ট বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে। পরিস্থিতির বিচার খুব সহজে করতে পারবে। কিন্তু, আজ মনে হচ্ছে আলো বুদ্ধিমতি হতেই পারে তবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে। লোকের সঙ্গে মেপে মেপে কথা বলার সময়। কিন্তু, সংসার, স্বামী সামলানোর মতো বুদ্ধি ওর মাথায় নেই। আছে কেবল অহেতুক রাগের, অবিশ্বাসের, অহংকারের এক বিশাল ভান্ডার।

আলো যখন নীচে নেমে এলো লাগেজ হাতে, তখন মাহরীন, ইনায়া, তানিয়ার বাবা-মা এবং সিতারা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। আলোর পরনে একটা হলদে রঙের বাটিকের থ্রী-পিছ। আলোর বাবার দেয়া। আলোর গহনাবিহীন শরীরটা দেখে যা বোঝার কথা তাই বুঝতে পারল উপস্থিত সবাই। মাহরীন লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল। যেই আলোকে স্বইচ্ছায় এই বাড়ির বউ বানিয়ে এনেছে, সেই আলোকে আজ তিনি নিজেই অপমান করেছেন। দোষটা তার ছেলের। পরের মেয়ের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তবে একটা কিন্তু আছে। প্রথমদিকে আলো এই বিয়ের জন্য রাজি হয়নি। পরে কিভাবে যেন রাজি হয়েছিল? কারণটা আজ অব্দি জানা হয়নি। এর পেছনে কি মেঘালয়ের হাত আছে?

মাহরীন বেলীফুলকে কোলে নিয়ে আলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে ঠিক, ওইসময় সিঁড়ির ওপর চোখ পরল। মেঘালয় হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। সে একাই ম্যানেজ করে নেবে। মাহরীনের ইচ্ছে করল, মেঘালয়ের কথা অগ্রাহ করে আলোর হাতটা ধরে বলতে,

“আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস আলো? দেখ আমার মাথা ঠিক ছিল না হুট করে এসব জানার পর। একজন মা হিসেবে, একজন শ্বাশুড়ি হিসেবে আমার রিয়েক্ট করা কি ভুল ছিল, বল? তুই তো কত কথা লুকিয়ে রেখেছিলি আমার কাছে! আমার সঙ্গে যদি ব্যাপারগুলো শেয়ার করতি তাহলে কি আজ এতকিছু হতো? “

সিতারা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে আলো বেরিয়ে গেল। কোনো কথা নেই, কিছু নেই। এক বিষাদ মুহূর্তের সময় আলো চলে গেল।
মাহরীনের ইচ্ছে করল মেঘালয়কে জিজ্ঞেস করতে, “কেন সে চুপচাপ বসে আছে?” জিজ্ঞেস করা হলো না। কারণ, ছেলের জীবনের অশান্তি তিনি নিজ হাতে ডেকে এনেছেন। ছেলের শুকনো মুখটা দেখে বড্ড লজ্জিতবোধ করছেন আজ।


সিএনজি থেকে নেমে বাসার সামনে ব্যাগ হাতে নিয়ে তালাবদ্ধ দরজার সামনে অপেক্ষা করছে আলো। সিতারা বেগম সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে এসে চাবি দিয়ে তালা খুলে দিলো। আলো ব্যাগটা নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করল। সোজা তার বাবার ঘরটায় গিয়ে প্রবেশ করল। বাবার খাটের ওপর বসল। আলোর হুট করে ভ্রম হলো। মনে হলো যেন তার বাবা এসে তার পাশে এসে বসেছে। পরনে সাদা লুঙ্গি, গায়ে সাদা গেঞ্জি। ডানহাতের দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট।

আলোর একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল তার বাবাকে, “চলে তো গেলে। লাভ কি হলো? বাপ ছাড়া বিবাহিত মেয়েদের দাম আছে নাকি শ্বশুরবাড়িতে? তুমি জানতে না এই বিষয়টা? আমার মতো অচল একটা মেয়েকে রেখে দুনিয়া ছাড়ার আগে তোমার একটিবার মনে হলো না, তোমাকে ছাড়া তোমার এই মেয়েটার পরিণতি কি হবে? আজ আমি চলে এলাম রাগ দেখিয়ে, তীব্র অভিমান নিয়ে। কই কেউ তো একবার বারণ করল না। কেউ একবার বলল না, যা হবার হয়ে গেছে। তুমি থেকে যাও৷ তারা কেউই বলল না। কেন বলেনি জানো? কারণ, তারা তো জানে আলোর আপন বলতে কেউ নেই। বাপ মরা মেয়ে। ঘরে সৎ মা আছে। সে এমনিতেই ফিরে আসবে। আদর সোহাগ খরচ করার আগে ফিরে আসবে। কারণ, একূল-অকূল হারানো মেয়েরা শ্বশুড়বাড়িতে মাটি কামড়ে পরে থাকে হাজারটা অপমান সহ্য করে।”

সিতারা বেগম কোনোরকম ভাত রান্না করল। ডিম ভাজি করল। চালনিতে পরে থাকা দুটো বেগুন কেটে মচমচে বেগুন ভাজা করলো। আলোর জন্য প্লেটে ভাত বেড়ে আফসার সাহেবের ঘরটায় এসে দেখলেন, আলো ফাক্যাসে দৃষ্টিজোড়া খোলা জানালার ওপর নিবদ্ধ ছিল। সিতারা বেগম আলোর পাশে বসল। আলো ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো সিতারা বেগমকে। সিতারা বেগম ভাতের প্লেট বিছানার ওপরে রেখে, আলোর গালে পরম মমতায় একহাত রাখলেন। কৃষ্ণবর্ণ এই মেয়েটাকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন। তবে এই মেয়ের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা পরিমাণ টের পেলেন আজ। যখন দেখলেন আলোর শাড়ীর আঁচলে লাল অগ্নিশিখা।

— সংসারে অনেক ঝড়ঝাপটা আসবে। রাগ অভিমান করবি,, ঠিক আছে। কিন্তু, সংসার ছেড়ে আসা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

ব্যস এতটুকু নরম আদরের অপেক্ষা বুঝি ছিল আলো। এরকম আদর জোড়ানো কথা তো কেবল তার বাবা বলত। আলো সিতারা বেগমের গলা জড়িয়ে উচ্চ শব্দে কেঁদে উঠল। সিতারা বেগমের চোখ ভিজে আসছে আলোর কান্নার শব্দে।

— আম্মা, ছোটকাল থেকে তোমাকে শুধু জ্বালিয়ে মারছি৷ বিয়ে দিয়েও আমার জ্বালা মাথা থেকে নামাতে পারলে না তোমরা। কিন্তু, আমি কি করব বলো? যেখানে আমার সম্মান নেই, ভালোবাসা নেই, সেখানে থাকতে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। তুমি তো জানো আমি কেমন?

সিতারা বেগম আলোর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

— কেন জামাই তোকে ভালোবাসে না?

— কি জানি আম্মা?

— দুজন মানুষ একঘরে থাকলে তো একে অপরের প্রতি অগাধ মায়া জন্মায়। ভালোবাসার চেয়েও কঠিন ব্যাপার হলো মায়া। তার মায়া কাটিয়ে তুই তাকে ছাড়া থাকতে পারবি?

আলো জবাব দিলো না। সিতারা বেগম আর প্রশ্ন করলেন না। কারণ, আলোর শ্বাশুড়ির মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখলেন আলোকে আটকানোর জন্য। আলোকে জোর করে দুমুঠো ভাত খাইয়ে দিলেন।

— আম্মা, সিলেট যাওয়ার জন্য একটা টিকিট কেটে রেখেছো না তুমি? আমার জন্য আরেকটা ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলো।

— সিলেট যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কেটে কি করবো?

— এই শহর ছেড়ে তোমার সঙ্গে চলে যাব।

আলোর কথা শুনে সিতারা বেগম ভীষণ অবাক হলেন।

— জামাইকে না জানিয়ে চলে যাবি?

— আজ তোমাদের জামাইয়ের ভালোবাসার পরীক্ষা করব আম্মা। সে যদি আজ রাত এগারোটায় ফিরে আসে, আমি তার হাত ধরে চলে যাব। আর যদি ফিরে না আসে…

সিতারা বেগম ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আলোর দিকে। আগের আলো আর এখনকার আলোর মাঝে বিস্তর ফারাক। তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আজ রাত দেড়টা ট্রেনে সিলেট যাওয়ার কথা ছিল তার। কারণ, বাসা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। নতুন কর্মীর নামে বাসা ট্রান্সফার হয়ে গেছে। কিন্তু, এখন আলোর হুট করে নেয়া ডিসিশন…

আলো মেঘালয়ের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত এগারোটা পেরিয়ে, এখন সময় রাত বারোটা দশ মিনিট। মেঘালয় ফিরে আসে না। আলোর চোখের জল টুপ করে গড়িয়ে পরল ঘাসের ওপর। চোখের পানি মুছে সিতারা বেগমকে কোনোমতে ফিসফিস করে বলল,

— আম্মা, চলো। সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ হলো।


“আমি তামান্না ইসলাম আলো। শক্ত ধাচের কঠিন মনের মেয়েটা কাউকে ভালোবেসে নরম মনের হয়ে গিয়েছিলাম। একজন মানুষকে কেবল ভালোবাসা বোকায় পরিণত করতে পারে। আমাকে বোকায় পরিণত করেছিল। আমি অন্ধের মতো ভালোবেসে গিয়েছিলাম আমার স্বামীকে। শুধুমাত্র তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার লোভে তার বাচ্চার মা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, কপালে ছিল না মা হবার সুখ! আমি জন্মের পর থেকে এক জন্মদাতা পিতার কাছে থেকে ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছিলাম। ভালোবাসার বড্ড কাঙাল ছিলাম। বিয়ের পর ডাক্তার সাহেবের ভালোবাসা আমাকে এতটা কাঙাল বানালো যে, তাকে ছাড়া নিজেকে কতটা অসহায়, কতটা অচল মনে করতাম? কিন্তু, একবারও ভেবে দেখেনি সে আমাকে আদৌ মেনে নিতে পেরেছে কি না? আমি ডাক্তার সাহেবের প্রতি আকাশসম বিশ্বাস জমিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম তার ভালোবাসায় আমার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু, একদিন প্রমাণ পেলাম তার কোথাও আমি ছিলাম না৷ যে রাতে আমি তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা। সেদিন সে এলো না! অথচ, আমি বিশ্বাস করেছিলাম সে ফিরে আসবে। আমার হাত থেকে ভারী ব্যাগটা একহাতে নিয়ে, অন্যহাত দিয়ে আমার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলবে, “চলো বাড়িতে যাই। “
সেদিন সে ফিরে এলো না। আমি আবারও প্রমাণ পেলাম, কালো মেয়েদের কেউ কখনো ভালোবাসাতে পারে না । চেনা শহর চট্টগ্রামকে সেদিন বড্ড অচেনা মনে হচ্ছিল। ট্রেনে উঠে সীটে বসার পর আমার বারবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমার মোবাইলে ডাক্তার সাহেবের কল আসবে। কিন্তু, তার কল এলো না। ট্রেন যখন চলতে শুরু করলো, তখন আমার যে কি হলো? মনে হচ্ছিল চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পরি। ফিরে যাই ডাক্তার সাহেবের কাছে। যুক্তি এবং আবেগের দোলাচলে যুক্তির জয় হলো সেদিন। মোবাইল ফোন সেদিন ফেলতে পারিনি। কারণ, আমার দুঃসময়ে একটা ফোনের বড্ড জরুরি ছিল তখন। তাই ফোন ফেলতে না পারলেও সীমটা খুলে সেদিন আমি চলন্ত ট্রেনের জানালার বাইরে ফেলে দিয়েছিলাম। তারপরের দিনগুলো বড্ড বিভীষিকাময় ছিল আমার। আমার সৎমায়ের বাবার বাড়ি সিলেটে আমাদের ঠাঁই হলো। বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে মা-মেয়ে সংসার টেনেটুনে চলতো। আমার ডাক্তারি পড়াশোনার টাকা মা জোগাড় করলেন আমার বাবার পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া জমিন বিক্রি করে। বাবা মরে যাওয়ার কয়েকদিন আগে নাকি আমার নামে এবং মায়ের নামে সম্পত্তি উইল করে রেখে যান৷

ধীরে ধীরে পথ চলতে চলতে অনেক পথ হেঁটে পাড় করে এসেছি পেছনে। আজ আমি একজন সফল ডাক্তার৷ সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের(Psychiatry) বিভাগের একজন ডাক্তার।

কথাগুলো বলে থেমে গেল আলো। আলোর মুখোমুখি চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল আলোকে,

— আপনি ভুলে গেছেন ডাক্তার সাহেবকে?

আলো মুচকি হাসে।
তার সামনে বসে থাকা মেয়েটার বয়স কত হবে? তেইশ কিংবা চব্বিশ? মেয়েটার গায়ের রঙ আমেরিকান গোত্রের। চুলগুলো সোনালী আঁশের মতো। কিন্তু, মেয়েটা বাংলাদেশী। মেয়েটাকে সে এতক্ষণ তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলছিল। আলো তার হাতের কফির মগটা টি-টেবিলের ওপরে রেখে বলল,

— তোমার কি মনে হয়?

— আমার তো মনে হয় আপনি তাকে এখনও ভুলতে পারেননি।

মেয়েটার কথা শুনে আলো স্ব শব্দে হেসে ফেলল আলো। মেয়েটা খানিকটা লজ্জা পেলো আলোর হাসি দেখে। মুখটা নামিয়ে ফেলল। আলো হাসি থামিয়ে মেয়েটা মুখের দিকে তাকালো। তার হাসি দেখে মেয়েটার যে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তাও বুঝতে পারল।

— যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে তাকে মনে রেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করার কি প্রয়োজন?

— কিন্তু, আমার তো মনে হচ্ছে আপনাদের দু’জনের না বলা ভালোবাসায় অগাধ ভালোবাসা ছিল।

ইরাবতী নামের মেয়েটার কথা শুনে আলো থমকে গেল। গত আটবছরে প্রায় বিশজনকে তার জীবনের গল্প বলা হয়েছে। ইরাবতী ছাড়া বাকি উনিশজন আলোকে এই ধরণের কথা বলেনি। উনিশজন বলেছে, আলো সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেখানে আত্মসম্মান বলি দিতে হবে সেখানে ভালোবাসাকে বড় করে দেখার মাঝে মহাত্ম্য কিছু নেই।

— আপনারা দু’জন প্রচন্ড জেদি ছিলেন। জেদ এবং ভালোবাসার দাঁড়িপাল্লায় মেপে আপনাদের জেদের বিজয় হয়েছে।

আলোর শরীর কাঁপছে। এত ছোট একটা মেয়ে কি করে সত্য কথাগুলো অনায়াসে বলে ফেলছে!

— ভালোবাসা যতটা যত্ন নিয়ে বুকে বয়ে বেড়াতে হয়। ঠিক ততটাই জাহির করতে হয়। ভালোবাসা গোপনে যতটা সুন্দর প্রকাশ্যে আর বেশী চমৎকার।

— আমি তো ডাক্তার সাহেবের জন্য অপেক্ষা করেছি, সে কেন ফিরে এলো না সেই রাতে?

আলোর প্রশ্ন শুনে ইরাবতী তার হাতে থাকা ডায়েরি বন্ধ করে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল,

— আমার দাদি বলে তিন কবুলের মাঝে নাকি অনেক শক্তি থাকে। সেই শক্তির জের ধরে অচেনা মানুষটার ওপরএক রাতেই অধিকার জন্মায়। আপনার তো ডাক্তার সাহেবের ওপর অধিকার ছিল। সেই অধিকার থেকেই না-হয় তাকে একটা কল করতেন। কৈফিয়ত চাইতেন। সে কেন এলো না সেদিন?

— যেখানে তাকে মুখ ফুটে “ভালোবাসি” বলিনি, সেখানে তার কাছে কল করে কৈফিয়ত চাওয়া হাস্যকর না?

— ভালোবাসার প্রধান ধর্ম হলো ধৈর্য ধরে ভালোবাসা জয় করা। আপনার ধৈর্য কম। তাই আপনার ভালোবাসার জয় হয়নি, ম্যাম।

— তারমানে, তুমি বলতে চাইছো সব আমার ভুল ছিল?

আলোর প্রশ্ন শুনে ইরাবতী মুচকি হাসে।

—অবশ্যই আপনার ভুল ছিল। আপনি যদি নিজেকে রুগীদের মনোরোগ চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিতেই পারেন। কিন্তু, নিজের মনের রোগের কারণ ধরতে আপনি ব্যর্থ। এখন আমি কয়েকটা কথা বলব। যদি আপনার মনে কষ্ট লেগে যায় তবুও আমি দুঃখিত বলব না। আপনার ডাক্তার সাহেব বরাবরই আপনাকে সম্মান দিয়েছে, ভালোবেসেছে,আপনার প্রতি সে মুগ্ধ ছিল, আপনার মিথ্যাগুলো লুকিয়ে রেখেছিল। আপনাদের প্রথমবার দেখা হওয়া, সেখানে আপনার মিথ্যা বলার ব্যাপারটাও কিন্তু ডাক্তার সাহেব লুকিয়ে রেখেছিলেন। তখনও যখন আপনাদের বিয়েও হয়নি। ডাক্তার সাহেবের আপনার প্রতি সম্মানের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ছিল, আপনার বিয়ের সাদা শাড়ির বদলে লাল শাড়ি কিনে দেয়ার ব্যাপারটা। দ্বিতীয় ব্যাপারটা ছিল আপনাকে হলুদের সাজে দেখে এপ্রিশিয়েট করা। তিনি সত্যি সত্যি আপনার ওপর মুগ্ধ হয়েছিলেন। আপনাকে তিনি কিভাবে ভালোবেসেছিলেন জানেন? আপনার অপূর্ণতা জেনেও আপনাকে ভালোবেসেছিলেম। আপনার জায়ের সঙ্গে যেই দূর্ঘটনা হলো সেটাও কিন্তু আপনি গোপন করেছিলেন। আপনি যদি তাকে আগে থেকেই অবহিত করতেন তাহলে এতকিছু হতোই না। তারপরও যা ঘটে গেছে সেই কারণেই হোক ডাক্তার সাহেব বারবার চেয়েছেন, আপনি যেন নিজের দিকটা ক্লিয়ার রাখুন। আপনি যে নির্দোষ সেটাও প্রমাণ করুন। কিন্তু, আপনি তো মহা বোকা। আপনি এই কথার উল্টো অর্থ বের করে বসে ছিলেন।
আপনি সেদিন তাকে কথার আঘাতে জর্জরিত করার জন্য কথাগুলো বলেছিলেন। তার মুখ থেকে “ভালোবাসি” শোনার জন্য তাকে আক্রমণ করেছিলেন। যেন একটিবার তার মুখ থেকে আপনি ভালোবাসা শব্দটা শুনতে পান। কিন্তু, আপনার ডাক্তার সাহেব আপনার মতো একই ক্যাটাগরির মানুষ। ভালোবাসা হৃদয়ে জমা রেখে হৃদয় ক্ষয় হয়ে যায় তবুও মুখ দিয়ে ভালোবাসি বের হবে না। কেউ আগ বাড়িয়ে ভালোবাসি বলে নিজেদের ইগোকে হার্ট করেননি। বলুন সেদিন আপনি মিথ্যা অভিযোগ করেননি তাকে?

ইরাবতীর করা শেষ প্রশ্নটির জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না আলোর। ডাক্তার সাহেব তাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল! কতটা ভালোবেসেছিল?

আলো হিসেব কষতে বসেছে। আলোর নীরবতা দেখে ইরাবতী ডায়েরির ভাজে কলম রেখে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আলোকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— আপনার সিলেট পালিয়ে আসার কারণ ছিল, আপনার অপরিপক্ক মন তখন চাইতো, আপনাকে পাগলের ন্যায় খুঁজতে খুঁজতে আপনার ডাক্তার সাহেব এই শহর অব্দি আসুক। কিন্তু, আপনার ডাক্তার সাহেব এলেন না। আপনি দিনের পর দিন তার অপেক্ষা করছেন। কিন্তু আপনি তার শহরে যাচ্ছেন না। যাকে ভালোবাসেন তাকে জানাতে এত গড়িমসি কেন? ভালোবাসার মানুষ দুজনের মাঝে একজন আগে কনফেস করলে দোষের কিছু নয়।

—- তুমি আসলে কে বলো তো? তোমাকে সাধারণ কেউ মনে হচ্ছে না।

আলো অবাকের রেষ কাটিয়ে প্রশ্ন করে ইরাবতীকে। ইরাবতী ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল,

— আমি কেউই নই। আমি একজন ভার্সিটির স্টুডেন্ট । জার্নালিজম বিভাগ থেকে পড়াশোনা করছি। সেদিন আপনার একটা সাক্ষাৎকার দেখার পর আমার অতি আপনজন আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে পরেছেন। কারণ, তিনি আপনাকে সিলেট শহরে দেখে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
কিন্তু, আপনার সঙ্গে দেখা করা যে অতি কঠিন একটা ব্যাপার সেটাও তিনি জানেন। তাই আমি এলাম আপনার ইন্টারভিউ নিতে।

ইরাবতীর কথা শুনে আলো বিস্ময়ের সুরে বলল,

— কি পরিচয় তার? আমাকে সিলেট শহরে দেখে অবাক হবে এমন কেউ তো নেই!

— নেই। তবে আপনার এই ইউনিক নাকফুলটার কারণে আপনাকে চিনতে পেরেছেন উনি। নয়তো, আপনাকে তিনি আসলেই চেনেন না।

ইরাবতীর কথা শোনার পর ডাক্তার সাহেবের বলা একটি কথা আলোর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, “তোমার এই নাকফুলটা নিয়ে ছোট একটা গল্প আছে। অন্য একদিন বলব৷ তবে এটুকু জেনে রেখো, আজ একজন ভদ্র মশাইয়ের সঙ্গে সেই লেভেলের তর্কাতর্কির পর, তোমার জন্য এই নাকফুল আমি কিনতে পেরেছি।”

আচ্ছা তাহলে ডাক্তার সাহেবের বলা মানুষটা আর কেউ নয় ইরাবতীর আপনজন কেউ। আলো উঠে এসে ইরাবতীর হাত ধরে বলল,

— তোমার সেই আপনজনের সঙ্গে আমার দেখা করাবে, ইরাবতী?

— অবশ্যই করবেন, ম্যাম। আমি অতি শীঘ্রই ফিরব তাকে নিয়ে।

কথাগুলো বলে ইরাবতী অপেক্ষা করলো না বেরিয়ে গেল আলোর বাড়ি থেকে। আলো অস্থির হয়ে দেয়ার ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত দশটা বাজতে চলল। আলো কিসের জন্য যেন অস্থিরতা বোধ করছে। হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে অতিদ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পরল তাতে। তারপর, একটা মোবাইল দোকানে গিয়ে দোকানীকে জিজ্ঞেস করল,

— সিম তোলা যাবে?

— যাবে।

বহুবছর আগে অনাদের স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফেলে দেয়া সীমের নাম্বার আবারও সচল হলো। আলো সীমটা মোবাইলে সেট করে অপেন করলো। ওয়াট’স এ্যাপে সেই নাম্বার দিয়ে অপেন করার পর টুং করে একটা মেসেজ ভেসে উঠল স্ক্রীণে। “ডাক্তার সাহেব” নামটা জ্বলজ্বল করছে স্ক্রীণের এককোনায়।

” তুমি বললে না, তোমার উপস্থিতি অনুপস্থিতিতে আমার কিছুই যায় আসে না। তুমি ভুল বলেছো। তোমার উপস্থিতি, অনুপস্থিতিতে আমার অনেক কিছুই যায় আসে। তোমার উপস্থিতি আমার জীবনে যেদিন হলো সেদিন এই আমিটা নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। অচেনা এই আমিটাকে আমার চিনতে বড্ড কষ্ট হতো। তোমার রিজেকশন আমাকে এতটা অবাক করেছিল যে আমি রিয়েক্ট করতে গিয়েও করতে পারিনি। তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি তুমি কি আমার যত্নে টের পাচ্ছো না? তোমার আমার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে যখন তুমি দুই হাত মেলে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে গুটিয়ে ফেলতে নিজেকে, আমি ঠিক সেই মুহূর্তে তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম। কি নেই তোমার? আমি যা চাই তোমার মাঝে সব আছে। তোমার সুন্দর দুটো কাজলকালো চোখ আছে। তোমার পাতলা গোলাপি রঙা ঠোঁটজোড়ায় আমার চরম আসক্তি আছে। চরম ব্যস্ততা কাটিয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে এসে তোমার গলায় আমার মুখ ডুবিয়ে রাখা হচ্ছে আমার ক্লান্তি কমানোর টনিক। মাঝে মাঝে গোসল শেষে যখন তুমি বারান্দার রোদে গিয়ে চুল শুকাতে ব্যস্ত থাকতে, আমি তোমাকে যখন জোর জড়িয়ে ধরতে চাইতাম, তখনি তুমি ছুটে পালাতে চাইতে আমার কাছ থেকে, ঠিক তখনি তোমার রেশম কালো চুলগুলো আমার ঘামে ভেজা শার্টের বোতামে আঁটকে যেত। তুমি ” উহ” শব্দ বলে থমকে যেতে। আমি হো হো করে হেসে ফেলতাম। তুমি রেগে তাকালে আমি হাসতে হাসতে বলতাম, “আমার দোষ নেই। আমার শার্টের বোতাম তোমাকে ছাড়তে চাইছে না, আমি কি করব বলো? কিশোরী বউটাকে “ভালোবাসি” বললে বিগড়ে যেতে পারে বলেই এতদিন বলতে চাইনি “ভালোবাসি বউ”। তবুও বলব আজ।
“তোমাকে আমি বড্ড ভালোবাসি, মিথ্যাবতী। তোমার মান-অভিমান, তোমার রাগ-ক্ষোভ, তোমার পূর্ণতা-অপূর্ণতা, তোমাকে জড়িয়ে থাকা সবকিছুকে আমি বড্ড ভালোবাসি৷ “

মেসেজ পড়তে পড়তে আলোর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখের জল টুপটুপ করে পরতে লাগল ফোনের স্ক্রীণে। দোকানী ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আলোর দিকে।

— আপা, সব ঠিকঠাক? কাঁদতেছেন কেন?

দোকানীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো আলো। চট করে চোখের জল মুছে ফেলল। সীমের দাম দিয়ে রিকশা ডেকে তড়িঘড়ি করে বাড়ির দিকে রওনা হলো। বাড়ির পোঁছে সবার আগে কল করলো ইরাবতীকে। ইরাবতী কল রিসিভ করার পর আলো অস্থির হয়ে বলল,

— ইরাবতী আমি আসলেই বোকা। আমার ডাক্তার সাহেব আমাকে সত্যি ভালোবেসেছিল। ১১/০৮/২০১৪ সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমাকে একটা মেসেজ দিয়েছিল জানো। মেসেজটি ঠিক সেদিনের যেদিন আমি তাকে ছেড়ে, তার শহর ছেড়ে সিলেট চলে এসেছিলাম। আমার মোবাইলে এমবি ছিল না বলে আমি সেদিন তার মেসেজ চেক করতে পারিনি। আচ্ছা সে কি আমার ওপর অভিমান করেছিল সেদি ? সেই অভিমান থেকেই কি সেদিন রাতে সে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেনি?

আলোর কথা শুনে ইরাবতী ভীষণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,

— আপনি আজই সেই মেসেজ পেলেন! সীম কোথায় পেলেন?

— সীম তুলেছি একটু আগে।

— এখন কি করবেন?

— আমি জানি না। আমি কিছু জানি না ইরাবতী। আমি নিজ হাতে আমার সব সুখকে ছাইয়ে পরিণত করেছি। আমি এখন কি করবো?

আলো বেসামাল হয়ে কাঁদতে শুরু করল। মোবাইলের এপ্রান্তে থাকা ইরাবতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— আপনি তার নাম্বার জানেন? থাকলে একটা কল করে দেখুন না?

ইরাবতীর কথা শুনে আলোর কান্না বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু, পরক্ষণেই ইরাবতীকে বলল,

— সে কি এখনো আমার আশায় বসে আছে? এতদিনে হয়তো অন্যকারো সঙ্গে ঘর বেঁধে বসে আছে!

— তাকে আপনি ছেড়ে এসেছেন। সে বিয়ে করলেও কি না করলেও কি। আমি রাখলাম। আপনি আসলেই একটা ভীতু প্রেমিকা। যে কিনা প্রেম করতে পারে তবে প্রেমিকা সাজতে তার যত আপত্তি!

ইরাবতী কল কেটে দিলো। আলো মোবাইল স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর, মেঘালয়ের নাম্বারে ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো….


“ওর সাথে আমার দেখা ছিল কো-ইন্সিডেন্স
বিচ্ছেদ ছিল ভাগ্যে
ও ঠিক ততটুকু দূরে সরে গেছে।
যতটুকু কাছে ছিল”

কথাটি শেষ করা মাত্রই করতালিতে মুখর হলো পুরো ড্রইংরুম জুড়ে। এমনসময়
মেঘালয়ের মোবাইলের রিংটোন স্বশব্দে বেজে উঠল। একটি আট বছরের ছোট বালিকা সোফার ওপর থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে বলল,

— হ্যালো, কে বলছেন?

— আমি, মিসেস মেঘালয় বলছি ।

— কে কল করেছে রে, বেলীফুল?

প্রশ্ন শুনে ছোট বালিকা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তার ছোট চাচ্চু মেঘালয় এদিকে আসছে। ছোট বালিকা হাসিমুখে মেঘালয়ের সামনে মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

— মিসেস মেঘালয় কল করেছে!

…..সমাপ্ত…..

[ আজ সবার রেসপন্স চাই। এরপর কি আর চাইব বলুন 😰। অবশেষে শেষ হলো “মেঘের ওপারে আলো” তবে ফেসবুকে। বই আসবে নয়া উদ্যোগ প্রকাশনী থেকে। যেখান থেকে শেষ হয়েছে বইতে সেখানে থেকে শুরু হবে। তবে গল্প একই থাকবে। তানিয়া এবং মাশফির ব্যাপারটা যেমন হুট করে ক্লাইম্যাক্সে এসেছে বইয়ে হুট করে আসবে না। ধীরে ধীরে ঘটনার বহিঃপ্রকাশ হবে। চেষ্টা থাকবে৷ গল্পের সকল ভুল-ত্রুটি, কিছু জটিল অংশ বাদ দিয়ে স্মুথলি লেখার। বই নিয়ে বিশদ আকারে পোস্ট করব ইনশাআল্লাহ। আলো এবং মেঘালয়ের পরিণয় নিয়ে আর তো কোনো আক্ষেপ নেই পাঠক? যারা বই কিনবেন তাদের জন্য সারপ্রাইজ আছে। আর যারা বই কিনবেন না তাদেরও আমি হতাশায় রাখিনি। এবার বলুন? পুরো গল্প শেষ করার পাঠ অনুভূতি?]

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply