Golpo romantic golpo মেঘের ওপারে আলো গল্পের লিংক

মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৮


মেঘেরওপারেআলো

পর্ব_৩৮

Tahmina_Akhter

মাহরীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেঘালয়ের মোলায়েম দৃষ্টি আলোর দিকে তাক করা। সিতারা বেগম আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি তো খুব ভালো করেই জানেন আলো কেমন চরিত্রের! কিন্তু, আলোর মুখ থেকে তিনি জানতে চান প্রকৃত ঘটনার সারসংক্ষেপ। একজন অচেনা মেয়ে এসে আলোর চরিত্রের কাঁদামাটি ছুঁড়বে আর আলো তা গায়ে মেখে কাঁদবে। ব্যাপারটা যেন মানতে পারছেন না তিনি।

আলো সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শরীর কাঁপছে! শরীরের ভেতর কিছু হারানোর ভয়ে কেমন জানি অনুভব করছে! সিতারা বেগমের হাতটা ধরে টেনে অবুঝ কিশোরী ন্যায় বলল,

— আম্মা, চলো আমরা চলে যাই। আমার দমবন্ধ লাগছে।

সিতারা বেগম আলো ভীষণ অবাক হলো আলোর আচরণে। ইনায়ার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। অবশেষে আলোর পরাজয় দেখার সময় হয়ে গেছে। মাহরীনের অস্থির লাগছে। নিজ হাতে ছেলে দুটোর জীবন নষ্ট করেছেন কেবল আলোকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে এনে। মেঘালয় আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বিষ্ময়কর পরিস্থিতি তৈরি হলো। তার সামনে দাঁড়ানো এই আলোকে চিনতে ভারী অসুবিধা হচ্ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আলো ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছে কেন?

আলো অস্থির হয়ে তখনও সিতারাকে বারবার অনুরোধ করছে, এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু, আলো যখন বুঝতে পারল সিতারা মনে কি চলছে ঠিক তখনি একেবারে শান্ত হয়ে গেল। ডানহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে একাই চলে যাবে। তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। বেশ কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সে নির্ঘাত মৃত্যুবরণ করবে।

আলো সামনের দিকে পা বাড়াতেই ইনায়া উঠে এসে আলোর হাত ধরে আঁটকে ফেলল। আলো ভীষণ অবাক হলো ইনায়ার কান্ড দেখে। মেয়েটার সঙ্গে তার কোনোদিন দু’চারটে কথা হয়নি। তবুও এই মেয়ে তাকে শত্রু ভেবে বসে আছে। কারণ, কি?

— আমার হাত ছাড়ুন, ইনায়া।

আলোর কথা শুনে ইনায়া হাত ছেড়ে দেয়ার বদলে বরং আরও জোরে চেপে ধরল৷ ব্যাথায় আলোর চোখমুখ কুঁচকে গেল। মেঘালয় উঠে এসে ইনায়ার হাতটা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো। আঙুল উঁচু করে হুমকির সুরে ইনায়াকে বলল,

— ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিটস, ইনায়া। আমি আমার স্ত্রীর কাছে জবাব চেয়েছি। তুমি ইন্টারফেয়ার করা বন্ধ করো, প্লিজ।

— সুযোগ তো আপনি দিয়েছেন, ডাক্তার সাহেব। যেই কথাগুলো আপনি আমাকে চারদেয়ালের ভেতরে জিজ্ঞেস করতে পারতেন, সেই কথাগুলো আপনি সবার সামনে জিজ্ঞেস করেছেন!

আলোর মুখ থেকে এই কথা শুনে মেঘালয় চোখ বড় বড় তাকালো। আলো এই প্রথম তার সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলছে! ইনায়া আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আলো দুই কদম পিছিয়ে গেল। তারপর, মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

— আমি কখনোই আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি। আপনার মা যখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাড়িতে গেল। তখন আমার বাবা রাজি হলেও আমি রাজি ছিলাম না। পরবর্তীতে একদিন আপনার মা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। সেখানে তার হঠাৎ অসুস্থতা। হসপিটালে এডমিট করলেন উনাকে। ঠিক সেই ঘটনার জের ধরে পরদিন সকালে আপনি এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। আপনি আমাকে কনভিন্স করছিলেন। তারপর, আমি না পারতে আমার সমস্যা, আমার খুঁত সম্পর্কে আপনাকে জানিয়েছিলাম। আপনি সেদিন সব জেনেশুনে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন।

আলো থেমে গেল। কথাগুলো বলে সে হাঁপিয়ে ওঠেছে। মেঘালয় আলোর অবস্থা দেখে ধরতে গেলে আলো পেছনের দিকে সরে যায়। মেঘালয়ের হৃদয় হাহাকার করে উঠে। আলোর আত্মসম্মানে আজ আঘাতে লেগেছে আজ। মেঘালয় টের পেলো আলোর হৃদয় ভাঙার সুর।

— আমি জানতাম, আপনি হয়তো আমার খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে আপনার মা’কে জানিয়েছেন। এবং সবটা জেনেই আপনার মা আমাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু, বিধিবাম আমার কপাল! আপনিও সবটা গোপন রেখে আমাকে বিয়ে করলেন! কি ফয়দা হলো? সেই তো আমাকে অপদস্ত হতে হলো। অথচ, এই অপদস্ত হবার ভয়ে আমি আপনাকে সব জানিয়েছে। কিন্তু, আপনি সেই আমাকে অপদস্ত করার জন্য সকল আয়োজন নিজ হাতে করে রেখেছেন।

— আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার গোপনীয় ব্যাপার যে, এভাবে কখনো বেরিয়ে আসবে আমি কল্পনা করিনি। আমি তোমাকে মেনে নিয়েছি। তুমি আমার স্ত্রী আলো।

—- তোমাদের আজাইরায় কথাবার্তা সাইডে রাখো প্লিজ। কথা এড়িয়ে যাওয়ার কি দারুন ফন্দি আঁটতে পারো তুমি আলো?

ইনায়ার কথা শুনে আলো চোখ পাকিয়ে তাকালো। ইনায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আলো। মেঘালয় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। আলোর এমন রুপ সে কখনো দেখেনি। বিয়ের পর থেকে শান্ত-শিষ্ট, নরম হৃদয়ের মিষ্টি এক আলোকে দেখে সে অভ্যস্ত। আলো বুকের ওপর হাতদুটো ভাজ করে ইনায়াকে প্রশ্ন করল।

— কোন কথা এড়িয়ে যাচ্ছি আমি? আপনার নোংরা মন মানসিকতার কথার ফাঁদে আমাকে আপনি আঁটকে ফেলতে চাইছেন।

— হোয়াট ডু ইউ মিন! তুমি যা করেছো আমি তাই বলছি !

— আপনি আধো সত্য বলছেন। বাকিটা লুকিয়ে রেখেছেন।

ইনায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আলোর দিকে। মাহরীন, সিতারা এবং মেঘালয় আলো এবং ইনায়ার কথার আগামাথা খুঁজে পাচ্ছে না।

— আমি যা বলেছি সবটাই সত্যি। তুমি চালাকি করছো এখন আলো। অবশ্য গরীব ঘরের মেয়েরা দারুন চালাক হয়। কথার মায়াতে মানুষকে মায়াজালে আঁটকে ফেলতে পারে তারা। উদাহরণ হিসাবে তুমি নিজেই সাক্ষাৎ জলজ্যান্ত প্রমাণ।

ইনায়ার কথা শুনে আলোর একমুহূর্তের জন্য তানিয়ার কথা মনে পরল। বিয়ের পরদিন সকালে জাদুটোনার কথা টেনেছিল তানিয়া। আর আজ তার বোন ইনায়া বলছে কথার মায়াজাল!

— আপনাদের তুলনায় হয়তো আমাদের তেমন আহামরি কিছু নেই। কিন্তু, ততটাও গরীব আমরা নই যতটা আপনারা গরীব ভাবেন! আমি এবং আমার পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনেই আমাকে বউ করে আনা হয়েছে।

— ছলচাতুরী করেছো! ভালো মানুষ হবার ভান করেছো। তোমার শারীরিক খুঁত সম্পর্কে যদি মাহরীন আন্টি জানতেন তবে কি তুমি এই বাড়ির বউ হতে পারতে?

ইনায়ার ছেলেমানুষী কথা শুনে আলো মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— কখনোই না। আমি জানতাম ব্রামণ হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াতে নেই। আমি চাঁদের দিকে কখনো মাথা উচু করো তাকাইনি৷ কিন্তু, চাঁদ যে কখন আমার ঘরে এসে ঠাঁই নিলো!

আলোর কথা শুনে মেঘালয়ের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। ইনায়া আলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আলো এবং মেঘালয়ের মাঝে এখন ইনায়া দাঁড়িয়ে আছে।

— মাশফি ভাইয়ার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক?

— মাশফি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করুন।

— তোমার কাছে জানতে চাই। কারণ, তোমাদের মাঝে গড়ে ওঠা একটা কুৎসিত সম্পর্কের কারণে আমার আপু অভিমান করে চলে…

ইনায়া কথাখানি সম্পূর্ণ করতে পারল না। আলো হাত উঁচু করে থামতে ইশারা করল ইনায়াকে। ইনায়া চুপ করে গেল।

— আপনার আপু কোন কারণে মারা গেছে সেটাও আপনি জানেন! শুধু শুধু আমাকে তার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে অপবাদ দিচ্ছেন কেন?

— হোয়াট ডু ইউ মিন! আমি অপবাদ দিচ্ছি তোমাকে?

— অবশ্যই দিচ্ছেন। তানিয়া ভাবি হার্ট এ্যাটাকে মরেনি। মরেছে বিষপানে। যদিও তার বিষপান করার কারণও আমি নই। এম আই রাইট, ইনায়া?

আলোর কথা যেন বজ্র্যঘাতের ন্যায় পরল পুরো ড্রইংরুমে। মাহরীন, মেঘালয় এবং সিতারা বেগম অবাক হয়ে গেলেন। ইনায়া শুকনো দুটো ঢোক গিলল। তারপর আমতাআমতা করে বলল,

— মিথ্যা কথা বলছো কেন? আপু তোমাকে এবং মাশফি ভাইয়াকে একসঙ্গে দেখে সহ্য করতে পারেনি হার্ট অ্যাটাক করেছে। হসপিটালে সবাই ছিল। ডাক্তার, নার্স তারা কেন হার্ট এ্যাটাকের কথা বলেছে?

— আপনারা বড়লোক মানুষ টাকা দিয়ে অনেক কিছু করতে পারেন। মৃত মানুষের মৃত্যুর আসল কারণ লুকিয়ে রাখতে পারেন।

— আমার বোনের মৃত্যুর আসল কারণ লুকিয়ে রাখলে আমার ফয়দা কি?

ইনায়ার প্রশ্ন শুনে আলো জবাবে বলল,

— প্রথমে তার পোস্টমর্টেম আঁটকেছেন। তারপর, এখন আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন। অথচ আপনিও জানেন আমি কোনোভাবে মাশফি ভাইয়া এবং ভাবির মাঝে ইনভলভ নই। সেদিন তানিয়া ভাবি দুজন মানুষের সামনে বিষ খেয়েছিল। সেই দু’জনের মধ্যে আমি একজন এবং আরেকজন হচ্ছেন আপনি। ধস্তাধস্তি প্রায় অনেক হয়েছিল ভাবির সঙ্গে কিন্তু কাজ হয়নি। সে খেয়ে ফেলল বাগানের পোকা মারার ঔষুধ । মানুষটা চোখের সামনে থেকে নাই হয়ে গেল তুচ্ছ কারণে। আমি সেই ভয়ে আতংকিত হয়ে গেলাম সেদিন। আর আপনি আজ বলছেন, আমার মাশফি ভাইয়ার সঙ্গে… বাকি কথা উচ্চারণ করতে পারল না আলো।

— তুমি মিথ্যা বলছো, আলো।

ইনায়া আলোর কথা শুনে তোতলাতে শুরু করল।

— আমি একরত্তি মিথ্যা বলছি না। আপনি জানেন সত্য ঘটনা কি? আমি এতদিন ব্যাপারটা চেপে রেখেছিলাম। কারণ একজন মৃত মানুষের মৃত্যু নিয়ে কেউ উপহাস করুক আমি তা চাইনি। কিন্তু, আপনি আমার নীরবতাকে দূর্বলতা ভেবে আমাকে অপদস্ত করতে চাইলেন! কেন এমন করলেন? আপনার কি ক্ষতি করেছি আমি? আমার বাপ মরে গেছে! আমার সন্তান নেই! আমার কে আছে বলুন? কেন আমার প্রতি আপনার এত বিতৃষ্ণা প্রকাশ?

ইনায়া মাথা নীচু করে ফেলল। কারণ, আলো যা বলছে সব সত্যি। তানিয়া বিষপান করেছে। মৃত্যুর কারণ এটাই। ডাক্তারদের বেশ মোটা অংকের টাকা দেয়া হয়েছিল। বাচ্চাটা অতি সুকৌশলে সে ডেলিভারি করিয়েছে যাতে বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি না হয়। মাশফি তো তানিয়াকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আশেপাশে কি হচ্ছিল ধ্যান ছিল না তার। তানিয়াকে মৃত ঘোষণার পর মেঘালয় এবং মাহরীন পরের গাড়িতে এসে হসপিটালে উপস্থিত হয়। তারা বুঝতে পারল না আসলে তানিয়ার মৃত্যুর কারণ কি ছিল! তাদের যা বলা হয়েছে তাই তারা বিশ্বাস করেছে।

মাহরীন মাথা নীচু করে ফেলেছে। আলোর কথাগুলো শুনে মাথা নষ্ট হবার উপক্রম হলো। মেঘালয় ঠোঁটের এককোনা চেপে ধরে অস্থির ভঙ্গিতে ইনায়াকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল আলোর সামনে। আলো মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকালো না আর। তবুও মেঘালয় বেহায়ার মত আলোর মুখটা দু’হাতে তুলে ধরল।

—তুমি শুধু একবার বলো মাশফি ভাইয়ার সঙ্গে তোমার কি কথা হয়েছিল সেদিন? নয়তো, তানিয়া ভাবির মত মানুষ…. শুধু তুমি নিজের দিকটা ভেবে জবাব দাও আলো। তোমাকে সবাই ভুল ভাবছে।

—সবার মাঝে কি আপনিও আছেন, ডাক্তার সাহেব?

আলোর প্রশ্ন শুনে মেঘালয় স্তব্ধ হয়ে গেছে। “মেয়েটা কি বোকা? আরে বোকা মেয়ে তোমাকে আমি নিজের থেকেও বেশী বিশ্বাস করি। তুমি শুধু নিজের অবস্থান সম্পর্কে ক্লিয়ার করো। বাকিটা আমি সামলে ফেলব”

মেঘালয় কথাগুলো বলতে পারল না। মস্তিষ্কে উদয় হয়ে কন্ঠস্বরে আসার আগেই আলো মেঘালয়ের হাতদুটো সরিয়ে দিলো। তারপর, পেছনের দিকে সরে যেতে যেতে বলল,

–মনে আছে তো আপনার, বিয়ের আগে যেদিন আপনি আমায় কনভিন্স করতে গিয়েছিলেন সেদিন একটা কথা বলেছিলাম?

মেঘালয় মাথ নাড়িয়ে বলল,

— আলবাত মনে আছে! তুমি বলেছিলে , “কখনো যদি মনে হয় আপনি আমার প্রতি অবহেলা করছেন। আপনি আমাকে পছন্দ করছেন না। তাহলে আমি আপনার সঙ্গে সংসার করবো না। আপনার পথ আর পথ আলাদা হয়ে যাবে।”

কথাটি সম্পূর্ণ করার পর মেঘালয় আলোর কথা মানে বুঝতে পারল। আলোর হাত ধরতে গেলেই আলো পিছিয়ে যায়। মেঘালয় ছটফট করে আলোকে স্পর্শ করার জন্য৷ কিন্তু, আলোর পাষাণ হৃদয় যেন মেঘালয়ের হৃদয়ের অবস্থাটুকু বুঝতে পারল না।

চলমান….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply