মেঘেরওপারেআলো
পর্ব_৩৬
Tahmina_Akhter
আলোর নীরবতা মেঘালয়কে তেমন বিচলিত করে না। আলোর নীরব ভালোবাসায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। আলোর ডানহাতের আঙুলের ভাঁজে মেঘালয়ের আঙুল গুঁজে রাখল। আলো তাকিয়ে রইল। সাদা পায়রার ন্যায় মেঘালয়ের হাতের আঙুলের ভাঁজে কালো পায়রার ন্যায় আলোর হাতটা বড্ড বেমানান লাগছে। আলো মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকালো। আলো আবিষ্কার করল মেঘালয়ের এক জোড়া চোখের মুগ্ধতায় আলোর অস্তিত্ব । মেঘালয়ের চোখের তাঁরায় আলোর ছায়া পরেছে।
— আগের মত বিরক্ত নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো না কেন, আলো? আমার ওপর থেকে তোমার বিরক্তি ফুরিয়ে গেছে?
মেঘালয়ের হাতের মুঠোয়ে বন্দি রাখা আলোর হাতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল। আলো মেঘালয়ের প্রশ্ন শুনে সত্যি সত্যি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেঘালয় আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— এই যে ঠিক এই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা আলোকে মাঝে মাঝে বড্ড মিস করি আমি।
আলোর বড্ড জানতে ইচ্ছে করল “মেঘালয় কেন বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকা আলোকে মিস করে?”
মেঘালয় অপেক্ষায় আছে আলো যদি একবার পাল্টা প্রশ্ন করে, তাহলে আলোকে জানিয়ে দেবে, “সে কতটা আলোকে ভালোবাসে! আলোর প্রেমে সে বিয়ের পরে নয় বরং বিয়ের আগেই প্রেমে পরেছিল। যেমন তেমন প্রেম নয় একেবারে কঠিন প্রেম যাকে বলে। বুকের মধ্যে ব্যাথা অনুভব হয় ঠিক তেমন প্রেমে পরেছে আলোর। ওই যে প্রথমদিন রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আলোর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হলো, ঠিক সেদিনই আলোর প্রেমে পরেছিল। আলোর কাছ থেকে পাওয়া বিরক্তি, এড়িয়ে যাওয়া এসবই তাকে আলোর প্রতি চুম্বকের মত আর্কষন করেছে। তারপর, তো দ্বিতীয়বার দেখা হলো কাব্যে ভাইয়ের বিয়েতে। সেখানেও তাকে দেখে বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। তৃতীয়বারের দেখায় মেঘালয়ের হৃদয়ের নড়বড়ে অবস্থা হলো। মনে হচ্ছিল তার এত শক্ত মজবুত হৃদয়ের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে এলোমেলো শাড়িতে দেখা আলোকে দেখে। এখনও সেই দৃশ্য মনে পরলে মেঘালয়ের হৃদয় প্রেমান্দোলন তোলে। ভীষণ ভয় পাওয়া একটা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আলোর আঙুলের ফাঁক দিয়ে খসে পরা এক একটা শাড়ির কুচি যেন মেঘালয়কে আলোর কাছে আরেকটু টেনে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
তার মা মাহরীন জানে যে, ছেলে মায়ের কথা রাখতে গিয়ে আলোকে বিয়ে করেছে। কিন্তু, মেঘালয় আর মেঘালয়ের সৃষ্টিকর্তা জানে আলোকে সে মন থেকে চেয়েছে তবে প্রকাশ্যে নয়। আলোর নামে তার হৃদয়ের ঠিকানা হারিয়েছে বহুদিন আগে। মেঘালয় মাঝেমধ্যে বড্ড অবাক হয় নিজেকে নিয়ে! এত সাদামাটা চেহারার আলোর মাঝে সে নিজেকে কতটা হারিয়ে ফেলেছে! “
আলো মেঘালয়কে পাল্টা প্রশ্ন করল না। আলোকে মনের কথা আজও বলা হলো না তার। মেঘালয়ের তেমন তাড়াহুড়ো নেই। আলোকে মনের কথা বলবে কোনো একদিন।
সময় পেরিয়ে গেছে আরও দেড়মাস। আলো আগের থেকে সুস্থ হয়েছে। মাশফির মেয়েটাকে ইনায়া এবং মাহরীন দেখাশোনা করছে। মাঝে একবার এসেছিলেন তানিয়ার মা। কিছুদিন থেকে ঢাকায় ফিরে গেছেন গতকাল। ইদানিং মাহরীনের শরীর খারাপ লাগছে। মাহরীন নামাজের শেষে দীর্ঘ মোনাজাতে কেবল তার তিন সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করে। মনের মধ্যে কু ডাকছে। মনে হচ্ছে সামনে আরও বড় ধরণের কোনো বিপদ আছে।
ইনায়া বেশ যত্ন করে তানিয়ার মেয়েটাকে। বাবুর নাম বেলীফুল। বাবুর নামটা মেঘালয় রেখেছে। যেদিন বাবুর নামকরণ হলো সেদিন আলোর কান্নায় বুক ভারি হয়ে আসে মেঘালয়ের। “বেলীফুল” নামটা যেন এক অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে গেছে তাদের জীবনীতে।
আলো বাবুকে কোলে নিতে চাইলে ইনায়া তেমন কোলে দিতে চায় না। তবে মাহরীন, মেঘালয় এবং মাশফির সামনে ইনায়া টু শব্দ করে না। হাসতে হাসতে আলোর কোলে বাবুকে তুলে দেয়। এক সপ্তাহ পর মাশফি এবং মাহরীনের ইন্ডিয়ায় যাওয়ার কথা। কিন্তু, মাহরীন যেতে চাইছে না। মেঘালয় এবং মাশফি প্রথমে তাদের মাকে বোঝাতে চায়। কিন্তু, যখন দেখল রাজি হচ্ছে না ঠিক তখনই দুইভাই মিলে মাকে বলল,
— আর কত খাটিয়া তুলব কাঁধে! তোমার চিকিৎসার সুযোগ আছে। আল্লাহ চাইলে সুস্থ হবে। এমন বাচ্চামো কান্ড ঘটানোর কারণ তো দেখছি না আমরা।
মাশফির কথা শুনে মাহরীন স্তব্ধ হয়ে যায়। মেঘালয় মাহরীনের পাশে বসল। মাহরীনের ডান হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল,
— মা, বুক ভারী হয়ে আছে এখনও। ভাইয়া তো স্ত্রীকে হারিয়েছে। আমি হারিয়েছি আমার বাচ্চাটাকে। এখন তোমাকে হারিয়ে ফেলতে চাই না।
মাহরীন চুপ করে আছে। মাশফি হাল ছেড়ে দিলো। ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। মেঘালয় মাশফির পেছনে পেছনে বের হয়ে গেলো। মাহরীন একা বসে রইল ঘরে। দূর থেকে এক নাম না জানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। মাহরীন তাসবীহ হাতে নিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করছে।
মেঘালয় যখন হসপিটালে থাকে আলো তখন নিজের ঘরে একলা বসে থাকে। সপ্তাহে দুয়েকবার ইতির সঙ্গে কথা হয় ফোনে। সিতারা বেগমের সঙ্গে দিনে একবার কথা হয়।
মাঝে মাঝে ওয়্যারড্রবের তৃতীয় ড্রয়ার খুলে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকে ন্যাপথলিন দিয়ে ভাজ করে রাখা ছোট কাঁথাগুলোর দিকে।
গত একমাসের দিনগুলো কেমন দীর্ঘতর মনে হচ্ছে। আলো নিজেকে শেষ কবে আয়নায় দেখেছে মনে পরছে না। তার শ্বাশুড়ি এবং ভাসুর চলে গেলে এই বিশাল বাড়িতে সে একা থাকবে। ইনায়া বেলীফুলকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে।
মাঝে মাঝে তার ভ্রম হয়। এই বুঝি মনে হয় পেটের মধ্যে নড়াচড়া টের পাচ্ছে। কোনো ছোট্ট শিশুর কান্না তার কানে বাজছে। অথচ, সে তো জানে এসবই ভুল ধারণা। আলো ইদানিং ভয় পায় একা থাকলে। হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে শুরু করে। বুক ধড়ফড় করে। শরীরে ঘামতে থাকে। প্রেশার বেড়ে যায়। মেডিক্যালের ভাষায় এই রোগের নাম “প্যানিক এ্যাটাক”। এই রোগের ঔষুধ হচ্ছে দৃঢ় মনোবল। অথচ, আলোর দৃঢ় মনোবল হারিয়ে গেছে সেই কবেই! যেদিন তার বাপ মরে গেল ঠিক সেদিন। শক্ত ধাঁচের মেয়েটা কেমন নরম হয়ে গেছে। এরপর, একবারে ভেঙেচুরে দিয়ে গেল তার সন্তানটি। কোলজুড়ে সন্তান এলো না ঠিকই শরীরে একটা ভয়ংকর রোগের বীজ বোপন করে দিয়ে গেছে। সামান্য থেকে সামান্য কিছু ঘটলে কেমন অস্থির লাগে!
মেঘালয় ফিরে এলো রাত দুটোর দিকে। আলো ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমন্ত আলোকে ডাক দিলো না মেঘালয়। পরনের কাপড়চোপড় বদলে নরমাল টিশার্ট এবং ট্রাউজার পর আলোর পাশে শুয়ে পরল।
আজ আকাশ ভরা তারায়, পূর্ণিমার চাঁদ তার নরম আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। জানালার গ্রিল গলিয়ে চাঁদের আলো যেন ঘরের প্রতিটি কোণকে সাদা পরতে মোড়ানো হচ্ছে।
বারান্দার দরজা হালকা খোলা, ফুরফুরে বাতাস এসে ঘরটিকে শীতল ও প্রাণবন্ত করে তুলছে। সবকিছু যেন থেমে আছে। শুধু বাতাসের তোড়ে চাঁদের আলো নাচছে। ঘরটা নিঃশব্দ, শীতল এবং শান্ত। মুহূর্তটি যেন সময়কে থামিয়ে দিয়েছে, প্রিয় মানুষের উপস্থিতি অনুভব করার জন্য।
চাঁদের আলোতে আলোর শ্যাম মুখখানার দিকে তাকিয়ে রইল মেঘালয়। কপাল জুড়ে লেপ্টে থাকা এলোমেলো চুলগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে আলোকে। ঘুমন্ত আলোর কুঁচকানো কপাল দেখে মেঘালয় হাত বাড়িয়ে আলতো করে চুলগুলো সরিয়ে দিলো।
রাত বাড়ছে। নিশাচর পাখির ডাক ভেসে আসছে। মেঘালয় ক্লান্তির কাছে হার মানল অবশেষে। ঘুমের রাজ্যে অতলে তলিয়ে গেল।
ফজরের আজান শুনে আজ ঘুম ভাঙল আলোর। কাঁধে কারো গরম শ্বাসের আভাস পেয়ে পাশ ফিরতেই টের পেলো মেঘালয়ের অস্তিত্বকে। ঘুমন্ত মেঘালয়ের মুখটা দেখার জন্য হুট করে আলোর মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠল! অথচ, এখন লাইট অন করল মানুষটা জেগে উঠবে। আলো নিজের মনের ইচ্ছাকে দমন করল। তবে, অন্য আরেকটা মনোবাসনা পূরণ করল৷ ঘুমন্ত মেঘালয়ের বুকের মধ্যে জায়গা করে নিলো। মেঘালয় ঘুমের ঘোরে আলোকে জড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আলো ফিসফিসিয়ে মেঘালয়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি, ডাক্তার সাহেব। প্রথমবার আপনাকে দেখে যতটুকু বিরক্ত হয়েছিলাম আজ ঠিক ততটুকুই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি! যেই আমি কখনো মিথ্যা বলিনি সেই আমি আপনার সামনে অর্নগল মিথ্যা বলেছিলাম সেদিন। অথচ, আপনার কাছে ধরা খেলাম খুব বাজভাবে। তারপর, তো আপনি আমার নামও দিলেন, মিথ্যাবতী! এটা কোনো নাম হলো! আদর করে মানুষ কত নাম ডাকে! আর আপনি কিনা আমায় মিথ্যাবতী নামে ডাকেন! ”
মেঘালয় তার মিথ্যাবতীর অভিযোগ শুনতে পেলো কিনা কে জানে? কিন্তু, সেদিন আলোর বেশ চমৎকার খুব ঘুম হলো। প্রিয় পুরুষের বুকের উষ্ণতায় আলো গুটিশুটি মেরে ঘুমের রাজ্যের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়।
আজ ঢাকা থেকে তানিয়ার বাবা-মা এসেছে। সিতারা বেগম এসেছে। পরিবারের অনেকে এসেছে। কারণ, মাহরীন এবং মাশফির দু’দিন পর ভারতের যাওয়ার ফ্লাইট। পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করার একটা বিশেষ কারনও আছে। মাহরীন খুব ভেবেচিন্তে একটা সিধান্ত নিয়েছে৷ এবার ইনায়া এবং মাশফি মেনে নিলেই হলো।
সকাল থেকেই আলো রান্নাঘরে রান্নাবান্নার কাজ সামলাচ্ছে। মেঘালয় হসপিটাল থেকে ফেরেনি এখনও। গতকাল রাতে থেকেই হসপিটালে ব্যস্ত। মাহরীন ছোট্ট বেলীফুলকে কোলে নিয়ে বসেছিল সোফায়। সিতারা বেগম সবেমাত্র বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছেন ঠিক ওইসময় আলোর চিৎকার শোনা যায়। মাহরীন, সিতারা বেগম হকচকিয়ে যায়। মাশফি, ইনায়া তাদের ঘর থেকে বের হয়ে আসে। মাহরীন বেলিফুলকে কোলে নিয়ে তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরের দিকে চললেন। গিয়ে যা দেখলেন তাতেই মাহরীনের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। আলোর শাড়ির আঁচলে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। মাহরীন “আলো” বলে চিৎকার করে উঠল। আলো মাহরীনের দিকে একবার ফিরে তাকালো। ততক্ষণে আলোর শরীরে আগুন স্পর্শ করে ফেলেছে। আলো নিজের শরীরে আগুনের তাপ অনুভব করছে। চোখের সামনে সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে। ধপাস করে রান্নাঘরের মেঝেতে পরে গেল আলো।
চলমান….
Share On:
TAGS: তাহমিনা আক্তার, মেঘের ওপারে আলো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১২
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২৯
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৮
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৯
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৫
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৩
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২২
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৪০
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২০
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১১