বেলতুলি – [০৭]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
নিবিড়ের হাতে একটা চিঠি। কালো শার্টে জুতোর ময়লার ছাপ পড়েছে। সে গরম চোখে মৌনোর মুখ থুবড়ে পড়া দেখল। এশা পাশেই খিটখিট করে হাসছে। গলা উঁচিয়ে বলছে,
–“এবার তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না আপু।”
মৌনোর পা ছিলে গেছে। সে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু কিছু বলার সাহস পেল না। পরপর কঠোর কণ্ঠস্বর কানে বিঁধল।
–“খুব সাহস বেড়েছে তোর তাই না?”
মৌনো গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। মিনমিন করে নিবিড়কে সরি বলতে যাবে কিন্তু দেখা গেল জুতোর ছাপ নিয়েই নিবিড় চলে যাচ্ছে। মৌনো বোকা বনে গেল, পরপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আমরা যেই বিষয় নিয়ে চরম ভয়ে থাকি, পরমুহূর্তে দেখা যায় ভয়ের কিছুই হয় না। এবারও তাই হলো। মাঝখান দিয়ে মৌনো খামাখা পা ছিলে একাকার করে ফেলল। মৌনো আর খেলাতে ফিরল না। আড়চোখে মাঠে তাকাতেই দেখল সবাই ওদের দিকেই চেয়ে। মৌনোর মাথায় হুট করেই কিছু একটা খেলে গেল। আচ্ছা, এখানে এত মানুষ বলেই কি মৌনো ছাড় পেল?
মাগরিবের আযান পড়তেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় সবাই। এশা আবার পালাতে নিলে এবার আর ছাড় পেল না। মৌনো একদম তার কান ধরে থাকল। এশা সবার জুতো ফেরত দিয়ে এসে মৌনোর জুতোগুলোও তার পায়ের কাছে দিল।
মৌনো ভেবেছিল সে ছাড় পেয়ে গিয়েছে, কিন্তু সে গুড়ে বালি। আযান শেষেই কামরুল এলো, হাতে নিবিড়ের সেই শার্ট। এখনো জুতোর ছাপ স্পষ্ট। কামরুল বলল,
–“ভাই কইছে দশ মিনিটের মধ্যে এইটা ধুঁইয়া দিতে অইব। যদি না পারেন ভাই আরও শাস্তি দিব।”
মৌনো দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল, কামরুল নিজেও। কামরুল বলল,
–“এহন ছয়টা আঁটত্রিশ বাজে আপা, ছয়টা আটচল্লিশে সময় শেষ। ভাইয়ের সময়ে আবার খুব হিসাব।”
–“মানে কি! এত কম সময়ে।”
–“তা তো কইতে পারুম না। এক মিনিট কিন্তু শ্যাষ আপা, এহন ঊনচল্লিশ বাজতেছে।”
মৌনো আর তর্ক করল না, সে ছুটল শার্ট নিয়ে বাথরুমে। রাজিয়া শেখ জানালায় দাঁড়িয়ে দেখেছেন কিভাবে মেয়ে নিবিড়ের গায়ে জুতো ছুঁড়েছে। কি অসম্মানজনক দৃশ্য! মেয়ে বাড়ি আসার পর থেকেই বকাঝকা শুরু করেছেন। এখন শার্ট নিয়ে আসায় তার রাগ আরও বেড়েছে। মেয়ে ভার্সিটিতে পড়ছে তাও আক্কেলজ্ঞান হলো না। কতগুলা মানুষের সামনে.. ছি ছি! এমনিতেই সোফিয়া খানম দেখতে পারেন না মৌনোকে। এই খবর তার কান অবধি পৌঁছালে কিসব বলবেন কে জানে?
তিনি মেয়েকে তাড়া দিলেন,
–“দ্রুত কর। নয়তো আজ তোর ভাত বন্ধ।”
মৌনো বাথরুমে কাপড় ধুঁতে ধুঁতে চেঁচাল,
–“ভাত এমনিতেই খাই না মা। অন্যকিছু থাকলে বলো।”
কিন্তু দেখা গেল বাথরুম থেকে বের হতে হতে তার দুই মিনিট দেরী হয়েছে। মৌনো বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে অবাক হলো। নিবিড় তাদেরই বৈঠকঘরে বসে আছে। হাতে তার টিভির রিমোট। নিবিড় মৌনোর দিকে তাকিয়ে বলল,
–“দুই মিনিট লেট!”
মৌনো বলল,
–“কাপড় ধোঁয়া কি মুখের কথা? দাগ ওঠাতে সময় তো লাগবেই।”
–“নিজে এত বড়ো একটা ব্লান্ডার ঘটিয়ে আমার সাথেই তর্ক? দেখি তোর কোন মহা কাজটা সেরেছিস। দে দেখি আমাকে শার্ট।”
মৌনো এগিয়ে দিতেই নিবিড়ের কপাল কুঁচকে উঠল বিরক্তিতে। পানিটা অবধি ঝাড় দেয়নি। এখনো কেমন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। নিবিড় বিড়বিড় করে বলল,
–“নির্বোধ।”
নিবিড় মৌনোর দিকে শার্ট ঝেড়ে দাগ পরখ করল। এখনো ঝাপসা বোঝা যায়। মৌনোর দিকে আবারও শার্টটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
–“মুখ চলে অথচ হাত চলে না। আবার গিয়ে ধুঁয়ে আন। কি বেগুন মানুষজন।”
মৌনো অবাক হলো। সে ভালো করে দেখেছে দাগ গিয়েছে। নিবিড়লে কিছু বলতে নিলে নিবিড় কাঠ কাঠ গলায় বলল,
–“তুই এখন বড়ো হয়েছিস, মেয়ে মানুষ। চাইলেও হাত তুলতে পারব না। নয়তো আজ যা অসম্মানটা করলি এলাকায়, ইচ্ছে তো করছিল আছাড় দেই ধরে। আমি সত্যিই খুব রেগে আছি, দয়া করে এমন কিছু বলবি না যাতে করে পরে আমার রিগ্রেট হয়। গো!”
মৌনো নিবিড়ের দিকে তাকাল। নিবিড়ের কপালের রগ ফুলে আছে। মৌনোর আর সাহস হলো না কিছু বলার। তবে সে আগে রান্নাঘরে গেল।
–“নিবিড় ভাই কেন এসেছে মা?”
রাজিয়া চা করতে ব্যস্ত। নিজের মেয়ের এত বড়ো বেয়াদবির জন্য একটু আপ্যায়ন তো করতেই হয়। রাজিয়া মেয়ের দিকে কিড়মিড় চোখে তাকালেন।
–“তুই কিছু করার বাকি রেখেছিস?”
জুনায়েদ আসল তখন। সবকিছু থেকে অজানা জুনায়েদ বলল,
–“চা হয়নি মা? ভাইয়াকে চা না দিয়ে তো বলতেও পারছি না আমার সমস্যাটা।”
মৌনো বুঝল তার মা নিবিড়কে ডাকেনি। মূলত ডাকটা দিয়েছে জুনায়েদ। মৌনো জুনায়েদের দিকে সন্দেহের নজরে তাকাল। জুনায়েদ মৌনোর সাথে নজর মেলালো না। এবার মৌনো বুঝে গেল জুনায়েদও কিছু একটা গড়মিল করেছে যা রাজিয়া জানেন না। মৌনো সন্দেহজনক গলায় বলল,
–“কেন ডেকেছিস?”
–“একটা সাবজেক্টে সমস্যা।”
মৌনো দাঁড়াল না, সে ছুটল বাথরুমে। আরও দুইবার ধুইয়ে নিবিড় ক্ষান্ত হলো, কিন্তু রাগ একবিন্দু কমেনি। সে চা শেষ করে ভেজা শার্ট আবারও মৌনোর মুখে ছুঁড়ে চলে গেল। মৌনো অবাক হয়ে বলল,
–“আপনার শার্ট!”
–“শুকিয়ে, আয়রন করে পাঠাবি। একদম নতুনের মতো চকচক করে যেন।”
অগত্যা মৌনো বারান্দায় শুকাতে দিল। এরপর আবার গেল জুনায়েদের ঘরে। জুনায়েদ বোনকে দেখে সোজা হয়ে বসল। মৌনো ভ্রু নাচিয়ে বলল,
–“মাকে তুই যা-তা বুঝ দিতে পারলেও আমাকে পারবি না। সত্যি করে বল নিবিড় ভাইকে কেন ডেকেছিস।”
জুনায়েদ হালকা শুকনো ঢোঁক গিলল। অস্বীকার করতে চাইল, কিন্তু মৌনো ধমক দিল। জুনায়েদ দমে গেল। মিনমিন করে বলল,
–“আমি আজকে সিগারেটে ফুঁক দিয়েছিলাম, ওই আর কি বন্ধুরা.. কিন্তু নিবিড় ভাই দেখে ফেলেছে। হাত-পা ধরেছি যাতে আব্বাকে না বলে। আব্বা জানলে আবারও আমাকে রুমে আটকে চোর মারার মোটা লাঠি দিয়ে পিটাবে।”
রিয়াজ সাহেব কি মা(১)রবে, মৌনো নিজেই দুই ঘা দিয়ে বসল জুনায়েদকে।
–“আহাম্মক! বয়স কত তোর? সবে এইটে পড়িস। আব্বা বলার আগে আমি তোরে ওই লাঠি দিয়ে পিটাব! এত্ত সাহস বেড়েছে তোর!”
–“আপা, আমাকে মা(১)রো, কাটো যাই করো। কিন্তু ধীরে বলো। আম্মা জানলে আমাকে জেলেই ভরে দিবে।”
–“ছি! বিন্দুমাত্র লজ্জা-শরম নেই, বেয়াদব! তুই যা করেছিস তার জন্য মাফ না চেয়ে বলছিস আম্মা না জানুক! আ..”
–“আচ্ছা আপা, আমি আর ছুঁয়েও দেখব না। প্লিজ চুপ করো।”
মৌনো থামল না, কতক্ষণ বকাঝকা করে বেরিয়ে গেল। নিজের শান্তি নেই, ভাই এসেছে আবার নতুন বিপদ নিয়ে। এই বয়সে কেউ ধুমপান করে? নির্ঘাত কোনো খারাপ সঙ্গের পাল্লায় পড়েছে।
ভোর সকালে বাড়িতে কলিংবেল দিয়েছে। আগেই উঠেছে রিমঝিম, মা ভেতরে রুটি বেলছে। রিমঝিমই তাই দরজা খুলল। দরজা খুলতেই প্রণভকে দেখল বাজারের ব্যাগ আরেক হাতে দুটো ইলিশ। রিমঝিম অস্ফুট স্বরে বলল,
–“আপনি..”
–“হুঁ, কাউকে পাইনি। আমিই নিয়ে এলাম। আশা করছি ঘুমে ডিস্টার্ব করিনি। কিছু সবজিও এনেছি, গতকাল রাতে রিয়াজ চাচার সাথে দেখা হয়ে গেছিল।”
–“আরে না, না। আমরা আগেই উঠে গিয়েছি। দিন দিন ব্যাগ দিন।”
প্রণভ দিল না। বলল,
–“আমাকে দেখিয়ে দিন কোথায় রাখতে হবে।”
ছেলে কণ্ঠ শুনে রাজিয়া শেখ রুটি বানানো ছেড়ে এলেন। এসে দেখলেন প্রণভ এসেছে। প্রণভকে দেখে তিনি নরম হলেন। ছেলেটাকে তিনি বড্ড স্নেহ করেন। শুনেছেন ছেলেটার চাকরি চলে গেছে কিছু মাস আগে। শুনে কি যে খারাপ লেগেছে। প্রণভ রাজিয়া শেখকে দেখতেই সালাম দিল।
–“আন্টি কোথায় রাখব এগুলো।”
–“ভেতরে এসো বাবা।”
প্রণভ কথা মতো তাই করল। ভেতরে এসে ব্যাগ আর মাছ জায়গা মতো রাখতেই রাজিয়া শেখ বললেন,
–“বসো বাবা, চা করে দিই।”
প্রণভ বসতে চাইলো না, তবে রাজিয়া শেখের জোরাজুরিতে না বসে পারল না। রিমঝিম ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বলল,
–“ফজু নানু কেমন আছেন?”
–“জি, ভালো। গতকাল রাতেই বাড়ি নিয়ে এসেছি। তার নাকি বাড়ি ছাড়া ভালো লাগে না।”
–“যাক ভালো করেছেন, আমি সময় পেলে যাব নাহয়।”
–“আপনার শিফট কখন থেকে?”
–“এইতো নয়টা থেকে। আপনি কিন্তু নাস্তা করে যাবেন।”
এর মাঝে রিয়াজ সাহেব বেরিয়ে এলেন। প্রণভকে দেখে খুশি হলেন। দুজন হাসি-মুখে কুশল বিনয় করল। রিমঝিম ততক্ষণে মাকে সাহায্য করে।
মৌনো ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় যেতেই তার মাথায় আকাশটা ভেঙে পড়ল বোধ হয়। বারান্দায় নিবিড়ের শার্টটা নেই।
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~
[যারা পড়ছেন রেসপন্স করবেন গাইজ]
বিঃদ্রঃ আগামী পরশু থেকে মিড পরীক্ষা, দোয়া করেন। কিছুদিন অনিয়ম হতে পারে, এ নিয়ে কেউ রাগ করবেন না প্রিয় পাঠকরা। পরীক্ষা শেষ হলে আবারও ইনশাআল্লাহ নিয়মিত হতে পারব। এছাড়া এক, দুই দিন গ্যাপ হতে পারে।
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ১১
-
বেলতুলি পর্ব ৬
-
বেলতুলি পর্ব ১৪
-
বেলতুলি গল্পের লিংক
-
বেলতুলি পর্ব ১৮
-
বেলতুলি পর্ব ৩
-
বেলতুলি পর্ব ৮
-
বেলতুলি পর্ব ৪
-
বেলতুলি পর্ব ৫
-
বেলতুলি পর্ব ১৭