বেলতুলি – [০৬]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
আজকের দিনটা মৌনোর খারাপ যাচ্ছে। একে তো আজ তার পরীক্ষা ভালো হয়নি। তার ওপর হাফসার আশিককে নিয়ে বাড়াবাড়ি তার একদম ভালো লাগছে না। মেয়ে সারাদিন আশিকের গুণগান করে চলে। মৌনো শুনতে চায় না বলে পরীক্ষার পর থেকে এখন অবধি তার সাথে কথা বলেনি। যখন বাড়ি যাওয়ার সময়ে হাফসার জন্য অপেক্ষা করছিল তখন দেখে অদূরে হাফসা আশিকের সাথে ফিরছে। কী আশ্চর্য!
বাসে বসে মৌনো ভাবল তার দিন খারাপের কারণ কি। তার হুট করেই মনে পড়ে গেল সকালের ঘটনা। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে রিকশার চাকায় তার ওড়না পেচিয়ে গিয়েছিল। নিবিড় বাজারের দিকেই ছিল, সে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে তখনই রিকশা থামিয়ে দেয়, এদিকে তার ওড়নার অর্ধেক চাকায় চলে গেছে। অথচ একাডেমিক বইয়ে এমন ডুবেছিল যে এই ভয়াবহ ব্যাপারটা মৌনো খেয়ালই করেনি।
নিবিড় এসেই কতক্ষণ মৌনোকে বকাঝকা করল। তার বকাঝকা কি আর ভালো মানুষের হবে? কথা-বার্তা সবসময়ই বলবে একদম গা-জ্বালানো। তার কানে বেশি বিঁধছে দুটো লাইন,
–“রাস্তা-ঘাটে যখন চলতেই পারিস না বের হোস কেন? তোদের মতো বেকুব মেয়েদের বের হওয়ার কী দরকার? অন্ধ কোথাকার!”
অপমানে তার মুখ থমথমে হয়ে গেছিল। আশেপাশের মানুষ কজন তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। একজন মধ্যবয়সী আঙ্কেলও হতাশ হয়ে বলেন,
–“কত যে বলি ওড়না সামলায় বসতে, এরা কথাই শুনে না।”
মূলত এটাই তার খারাপ দিনের সূচনা। মৌনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আকাশের পানে তাকাল। তীক্ষ্ণ রোদে ঠিকমতো চাইতে না পারায় চোখে জল জমে যায়। দ্রুত নিচের দিকে তাকাতেই আবারও জাবিরকে দেখল, এক দোকান থেকে চাঁদা তুলছে। দূর্ভাগ্যবশত এখানেই বাস থামিয়েছে যাত্রী ওঠানোর জন্য। কি মুসিবত! জাবিরের সঙ্গে তার দুই চ্যালা আছে। রিপন আর মঞ্জু। এদের সে বিচ্ছিরি বকা দেয়। এই তিনজন তার জীবন হারাম করে তুলেছে পুরো। ওরা দেখার আগেই মৌনো দ্রুত ওড়না দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে নেয়। সৌভাগ্যক্রমে ওরা এদিকে চাইলেও চিনতে পারেনি।
জাবির বিশ্রী গালি ছুঁড়ে দোকানির উদ্দেশে বলল,
–“তুই ট্যাকা দিবি নাকি এক রাইতেই তোর দুকান পুড়ামু?”
দোকানদার এবার আর ঝামেলা করতে চাইলেন না। চুপচাপ টাকা দিয়ে দিতেই রিপন বলল,
–“এই তো, সোজা কথা হুনলে তো আমগো জাবির ভাইয়ের মুখ খারাপ করোন লাগত না। হুদাই খাল কেটে কুমির ডেকে আনোস।”
মঞ্জু এদিকে না চেয়ে বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। বলল,
–“চলেন ভাই বাসে উঠে ভাবিরে খুঁজি।”
–“আরে নাহ, ভাবি তো এহন কলেজে থাকব।”
জাবির বলল,
–“দিলি তো রাগটা নইষ্ট কইরে। এর মইদ্যে মৌনোর নাম নিলে আমি কি রাগ করতে পারি?”
মঞ্জু হাসতে হাসতে বলল,
–“আমগো ভাই এক্কেবারে সিনেমার সাচ্চা প্রেমিক।”
মৌনোর ভয় কাটল বাস ছাড়ার পরপরই। জাবির যে ভয়াবহ মানুষ, তা তার জানার বাকি নেই। এই ছেলে খু(১)নও করার স্পর্ধা রাখে। নয়তো মৌনোর খুব ইচ্ছে করে কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু এতে যদি হিতে-বিপরীত হয়? মা বলেন, মেয়ে মানুষের সাহস যেখানে-সেখানে দেখাতে নেই। সেটা নিজের ওপরই চরম বিপদ ডেকে আনে। রাস্তা-ঘাটে বুদ্ধি মাথায় নিয়ে হাঁটতে হয়। রিমঝিমকে সে একবার বলেছিল জাবিরের কথা। রিমঝিম তাকে বলেছিল,
–“ঝামেলাকে যত এড়িয়ে চলা যায়। কখনো আগ বাড়িয়ে লাগতে যাবি না। এরা গুণ্ডা টাইপ। আজ একজনের পিছে ঘুরছে আবার কাল অন্যজনের পিছে। আজকের জন্য কাল নষ্ট করিস না।”
মৌনো বড়ো আপার ভক্ত। বড়ো আপা যা বলবে তাই হবে। তার তো ইচ্ছে করছে বাস থেকে নেমে রিকশা ধরে হাসপাতালের দিকে চলে যেতে। আপার হাত ধরে হাসপাতাল ঘুরে বেড়াতে, মানুষের দুঃখ শুনতে। কিন্তু টিউশনির কথা মনে পড়ায় তার সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না।
টিউশনিটা আর্থিক সমস্যায় পড়ে নেওয়া নয়। অনেকটা নিজের জন্যই। সে শখের কিছু কিনতে চাইলে বাবা-মায়ের কাছে চাইতে পারে না। তার কেমন বিব্রত অনুভব হয়। উলটো এখন সে টিউশনি নেওয়ার কারণে নিজের শখের পাশাপাশি বাকিদের টুকটাক উপহার দিতে পারে, এতেই তার দারুণ স্বস্তি হয়। এইতো, কিছুদিন আগে মেলা থেকে এশাকে একটা পুতুল আর জুবায়েরকে ফুটবল কিনে দিয়েছে। অথচ মা নিষেশ করেছিলেন ওদের যেন এসব কিছুই না কিনে দেওয়া হয়। মৌনো কিনে দেওয়ায় সে রাতে তার ভাত বন্ধ ছিল। জুবায়ের অবশ্য চুপিচুপি তার ভাগের গরম দুধ মৌনোর জন্য তুলে রেখেছিল। অথচ কে বলবে এই তিন ভাই-বোন রোজ ঝগড়া-ঝাটিতে লেগে থাকে?
বাড়ি ফিরে কোনো রকমে ভাতটা খেতে গিয়ে বিষম খেল। রাজিয়া শেখ বকাঝকা শুরু করলেন,
–“কতবার বলেছি অধৈর্য হয়ে খাবি না।”
এই বকার দোষটাও মৌনো নিবিড়কে দিল। শুনেছে পনেরো দিনের ছুটিতে এসেছে। এখনো পনেরো দিন শেষ হচ্ছে না কেন? কি আশ্চর্য!!
রিমঝিম লাঞ্চ ব্রেকে বাইরের দিকে যাচ্ছিল, তখনই তার হঠাৎ দেখা হয় প্রণভের সাথে। রিমঝিমকে এপ্রোন পরা দেখে অবাক হয়,
–“হাসপাতালে জয়েন করলে কবে?”
প্রণভ তাদের বেলতুলিরই। বয়স নিবিড়ের সমান সম্ভবত৷ রিমঝিম বিনয়ের সাথে বলল,
–“জি ভাইয়া, এক তারিখ থেকে। আপনি এখানে যে?”
–“নানুর হঠাৎই শরীর খারাপ হলো ভোরবেলায়। তখনই নিয়ে এসেছি। এখন ভালো আছে, আল্লাহ রহমত করেছে।”
রিমঝিম অবাক হলো,
–“ফজু নানু? কি হয়েছিল? কোন ওয়ার্ডে আছে?”
–“ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি যে কাজে যাচ্ছ যাও। আমি যাই নানুকে খাবার দিয়ে আসি।”
–“আমি আসব?”
–“না, ধন্যবাদ। তুমি যাও।”
রিমঝিম পিছুডাক দিল,
–“প্রণভ ভাইয়া, শুনুন।”
প্রণভ দাঁড়াল। পিছে ফিরে তাকাল,
–“বলো রিমঝিম।”
–“আব্বা অনেকদিন ইলিশ খেতে চাচ্ছে। বাসায় আগামীকাল পাঠিয়ে দিতে পারবেন? শুনেছি আপনারা বাজারে দুদিন যাবৎ ইলিশ উঠাচ্ছেন।”
প্রণভের বাবা বাজারে মাছ নিয়ে বসেন। মাছওয়ালা নামে তার ভীষণ নামডাক। মাছ তার ভীষণ পছন্দের। এজন্য একদিন তিনি বাজারে মাছ নিয়ে বসে গেলেন। সেই থেকে তার পুরো দমে মাছ ব্যবসা চলছে। সকালের সময়টা মাছ বিক্রি করেন আর দুপুরের পরপর ওনার চালের গোডাউন কিংবা অন্যান্য ব্যবসা দেখেন। মোটামুটি বেশ উচ্চবিত্তের তারা। কেউ এক কথায় বুঝবেই না মাছ বিক্রেতা কি করে বড়োলোক হতে পারে?
প্রণভ বলল,
–“আচ্ছা, আমি পাঠিয়ে দিব। আর কিছু প্রয়োজন?”
রিমঝিম ভাবল। এশা চিংড়ি মাছ খেতে খুব পছন্দ করে। তাই রিমঝিম বলল,
–“এক কেজি চিংড়ি মাছও।”
বিকালে মৌনো ভেবেছিল ঘুমিয়ে তার মন ভালো হবে। কিন্তু তখনই কারেন্ট চলে গেল। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যায়। যেই উঠে বসেছে এমন সময়ই এশা ছুটে এসে বলল,
–“আপু আপু, বাইরে জুতাচোর খেলা হবে। জ্যোতি আপু, ঋতু আপুরা তোমায় ডাকছে। চলো খেলতে।”
জুতাচোর? সপ্তাহখানেক খেলা হয় না। এই খেলা প্রায়ই খেলে তারা, তাদের বাড়ির পাশের মাঠেই। এখানে প্রায়ই ছেলেরা ক্রিকেট খেলে তবে মাঝেমধ্যে এলাকার মেয়েরাও এই মাঠ কব্জা করে নেয়। সম্ভবত আজও মাঠ মেয়েদের দখলে। মৌনো দেরী করল না। চোখ-মুখে পানি দিয়ে ওড়না নিয়েই চলে গেল।
খেলা খুব জমলো তাদের। মাঠে খেলতে আসা ছেলেরা ব্যাট বল নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে। তারা খেলতে চায়, তাদের নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ আছে। জ্যোতি হচ্ছে মেয়েদের গ্রুপের লিডার, এবার ইন্টারে পড়ছে। সে গলা উঁচিয়ে ধমকাল ওদের, কাঠ কাঠ গলায় জানিয়ে দিল খেলা শেষ না হওয়া অবধি কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। তার তেজি কণ্ঠের সাথে কেউ পারল না। সে এখানে ঝগড়াটে নামে পরিচিত কিনা!
মৌনো শুরুর দিকে ভয় পাচ্ছিল জাবিরকে নিয়ে। যদি জাবির চলে আসে? ওকে যে বিশ্বাস নেই। যেভাবে ইভটিজিং করে বেড়ায়। তবে সে যতদূর জানে এদিকটায় তার আসার বারণ আছে। খুব সম্ভবত আশেপাশের বাড়িওয়ালারা তাকে সতর্ক করেছে। তবে জাবির প্রায়ই বাড়ির পেছন দিকের রাস্তায় আসে, মৌনোর জন্যই। তবুও কোথাও না কোথাও ভয় থেকে যায়। কিন্তু খেলার মাঝে যেই ঢুকে গেল তখনই সে সবকিছু ভুলে বসেছে।
শেইনাও আজ খেলছে, সৌভাগ্যক্রমে মৌনোর দলে পড়েছে। শেইনা দারুণ ছুটতে পারে। নিঃসন্দেহে কয়েকবার স্কুলের প্রতিযোগিতায় দৌড় খেলায় জিতেছে। রত্না তাদের সাথে খেলছে না। সে বড়ো মানুষের মতো মহিলাদের সাথে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। কি প্রয়োজন খেলাধুলা করে অস্থির হওয়ার?
খেলার মাঝে দিয়ে বিপত্তি ঘটল এশাকে নিয়ে। সেও খেলবে। একপ্রকার জেদ চেপে বসেছে সে, খেলবেই। কিন্তু বড়োদের মাঝে সে খেলতে পারবে না। মৌনো খেলার মাঝে এশাকে বোঝাতে চাইল। এরপর ধমকাল। কিন্তু এশা স্বভাবতই ভীষণ জেদী। সে একদম কয়েক জুতো হাতে নিয়ে পালালো রাস্তার দিকে।
মৌনোও হাতে জুতা তুলে পেছন পেছন ছুটছে। সে রেগে এশার দিকে জুতো ছুঁড়ে মা(১)রতেই ভুলবশত সেই জুতো গিয়ে লাগল নিবিড়ের গায়ে। নিবিড় তখন সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিল। মৌনোও নিবিড়ের ভয়ে কিনা কে জানে, সে পিচঢালা রাস্তায় পা মচকে পড়ে গেল।
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে—
[যারা পড়ছেন রেসপন্স করবেন যেন বাকিদের ফিডেও গল্প পৌঁছায়।]
বিঃদ্রঃ আপনারা রোজ বলেন গল্প বড়ো করে দিই না কেন। আমি সত্যি বলতে রোজ এর বেশি লিখতে পারি না, আমার লেখা আসে না। তাই অনুরোধ রইলো এটুকু পড়ুন, আমি ধীরে ধীরে চেষ্টা করব পর্ব বড়ো করার, ঠিক আছে সুইট পাঠকরা? এখন সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করুন। কেমন লাগল আজকের ধামাকা? আমি আপনাদের মন্তব্য পড়তে অপেক্ষায় বসা।
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ১৬
-
বেলতুলি পর্ব ৮
-
বেলতুলি পর্ব ১০
-
বেলতুলি পর্ব ১৮
-
বেলতুলি পর্ব ১৭
-
বেলতুলি পর্ব ৯
-
বেলতুলি পর্ব ১১
-
বেলতুলি গল্পের লিংক
-
বেলতুলি পর্ব ১৪
-
বেলতুলি পর্ব ৫