–“যেদিন প্রথম নিবিড় ভাইয়ের শক্ত হাতের চড় আমার দাঁত নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেদিনই বুঝেছিলাম ভাইয়া বড়োসড়ো কিছু হবে জীবনে। এইযে, দ্যাখ.. আজ ভাই নাকি লেফটেন্যান্ট!”
–“তোর দাঁত ঠিক ছিল তো?”
–“থাকবে না কেন, আমার আব্বা দাঁতের ডাক্তার। শুনিসনি কখনো, যেই ঘরে যেই ডাক্তার থাকে সেই ঘরে সেই রোগ হয় না।”
মৌনো আপনমনে এলোমেলো করে কী বলল নিজেও বুঝল না। সে তখনো বাইরে ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। ছেলেটার নাম আশিক। সে অবশ্য সব মেয়েরই আশিক। সহজ ভাষায় বললে মেয়ে দেখলেই তার প্রেম প্রেম পায়। যেদিন চরিত্র সম্পর্কে শুনেছিল সেদিন থেকেই এই ছেলের থেকে মৌনোর মন উঠে গেছে। হাফসা বলল,
–“তোর ভাইয়ের সাথে প্রেম করিয়ে দে। আমি চিঠি লিখব, পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তোর।”
–“ভাই তো চাকরিসূত্রে অন্য জেলাতে, কবে আসে ঠিক নেই। তবে আমি বলব তার থেকে তোর দূরে থাকা ভালো।”
–“ওমা, কিন্তু কেন?”
–“এর মেজাজের পারদ ওঠানামা করে সবসময়। অতীতে বেশ খারাপ অভিজ্ঞতা আছে বলেই বলছি, ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়।”
–“চড়ের বিষয়টা?”
মৌনো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
–“চড় বাদ দে। এছাড়াও ব্যবহার, আচরণ খুব নিকৃষ্ট। আবার শুনেছি আন্টি ওনার জন্য পাত্রী পছন্দ করেছে। এবার ফিরলেই বিয়ে।”
হাফসার মনটা ভেঙে মুহূর্তেই খানখান হয়ে গেল। মৌনো দ্রুত হাতে ব্যাগ গুছাল, তার তাড়া আছে।
–“এত দ্রুত চলে যাচ্ছিস কেন? আমি আরও ভাবলাম তোকে নিয়ে শেরচত্ত্বরের দিকে যাব ফুচকা খেতে।”
–“আজ সময় নেই রে, সম্ভবত বড়ো আপাকে দেখতে আসবে। আম্মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছেন।”
হাফসার অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠল,
–“এই, খবরদার বলবি না তোর বোনের সাথে নিবিড় সাহেবের..”
–“ধ্যাত! আমাদের বোনেদের নিবিড় ভাইয়ার আম্মা পছন্দ করেন না। তাই এ বাড়িতে সম্বন্ধ কখনোই সম্ভব না, আসি।”
মৌনো হাফসাকে রেখেই বাস স্ট্যান্ডের দিকে চলে গেল। আজকাল সে এই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতে ভয় পায়। তার জীবনে এক বখাটের কালো ছায়া পড়েছে। ছেলেটার নাম সিফাত। বেলতুলিতে কুখ্যাত সে। মৌনো এদিক সেদিক তাকাল না। চুপ করে বাসে উঠে গেল। সৌভাগ্যবশত আজ এক ভদ্রমহিলার সাথে সিট পেয়েছে। কিন্তু এখানেও বিপত্তি। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ পরপর জানালা দিয়ে মুখ বের করে ওয়াক ওয়াক করে বমি করছেন। মৌনো নাকে রুমাল চেপে অন্যদিকে ফিরে আছে। বড়ো আপা রিমঝিমেরও এই বমির অভ্যেস আছে, সে বাসে উঠতে পারে না। বমিই সই, অন্তত কোনো বখাটে তো আর তার পাশে নেই। এক বখাটে তার জীবন যা জাহা(১)ন্নাম করে রেখেছে।
পাঁচ টাকার ভাড়ায় গন্তব্যে আসতে বেশি সময় লাগল না। আজ রাস্তা-ঘাট বেশ ফাঁকা। মৌনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গলিতে ঢুকে গেল। গলি থেকে দশ মিনিটের পথেই তাদের বাড়ি। রিমঝিম কতবার তার বাটন ফোনটা মৌনোকে গছিয়ে দিতে চেয়েছিল, আল্লাহ না করুক যদি রাস্তা-ঘাটে কোনো বিপদ হয়? কিন্তু মৌনো নিতে চায় না। হাফসাও একটা মোবাইল চালাত, কিন্তু সেটা কোনো ভাবে চুরি হয়ে গেছে। সেই থেকে তার মনের মাঝেও একই ভয় চেপে আছে।
হাঁটতে হাঁটতে অদূরে দেখল এক টয়োটা কোরোলা এক্সআই গাড়িটি দাঁড় করানো। গাড়িটির পাশে লম্বাটে করে এক যুবক দাঁড়ানো। কিছুদূর যেতেই মৌনো অবাক হলো। এটা যে নিবিড়, লেফটেন্যান্ট নিবিড় ইশতিয়াক। উজ্জ্বল শ্যাম মুখে দুপুরের তপ্ত রোদ এসে পড়েছে। আগে ভাবত আর্মিরা এতটা লম্বা কেমন করে হয়? কে জানত নিবিড়ের মতো লম্বাটে মানুষটাও আর্মির একজন সদস্য হয়ে যাবে?
নিবিড় বিরক্ত মুখ করে দাঁড়ানো। গাড়ির ইঞ্জিনে কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার বুঝতে বাকি নেই গাড়ি খারাপ করেছে, এজন্যই মাঝপথে এভাবে দাঁড়িয়ে। নয়তো মৌনোদের বাড়ি থেকে আরও কিছুটা ভেতরে তাদের বাসা। অবশ্য তাদের বাড়ি থেকে নিবিড়দের বাড়ি দেখা যায়।
নিবিড় ঠিক কতদিন পরে এসেছে তার হিসাব মৌনোর জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে সে চাচ্ছে না নিবিড়ের সাথে এই ভরদুপুরে তার দেখা হোক। নিবিড়ের গা জ্বালানো কোনো কথা শুনুক আর বাড়ি ফিরুক জঘন্য মেজাজ নিয়ে। এই ভদ্রলোককে সে দারুণ অপছন্দ করে কিনা। সবই অতীতের বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতার ফল। সহজ ভাষায় বললে, নিবিড়ও তাকে অপছন্দ করে। অপছন্দের কারণটা না জানলেও তার অহং আর রাগের খপ্পরে পড়ে মৌনো এরপর থেকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। ট্রেনিং এ চলে যাওয়ার পর যখনই নিবিড় বাড়িতে আসত, মৌনোও চতুরতার সাথে গা বাঁচিয়ে চলত। কী দরকার মুখোমুখি পড়ে খামাখা অপমানিত হওয়ার? এইযে, গত বছর ঈদের কথা। নিবিড় এসেছে ঈদের পরেরদিন। তার ডিউটির জন্য ঈদ, চাঁদরাত কিছুই আর আগের মতো নেই, তবুও ছুটি পেয়েছিল। মৌনো বেরিয়েছিল তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের মাঠে যাওয়ার উদ্দেশে। সেই মাঠে এলাকার ছেলে-পেলেরা চটপটির স্টল দিয়েছে। বৃষ্টির কারণে ঈদের দিন না বেরুতে পারলেও পরেরদিন আকাশ মেঘলা ছিল। সালামীর টাকা দিয়ে চটপটি খাবার চাইতে আনন্দের আর কি হতে পারে? রিমঝিম ঘরকুনো মেয়ে, সে সহসা বের হয় না। তবে তাকে বলেছিল তার জন্যে নিয়ে আসতে।
কিন্তু সেদিন কাকতালীয়ভাবে নিবিড়ের সাথে তার দেখা। নিবিড়ের নাক কেমন ফুঁসছিল বরাবরের মতো। মৌনো সালাম দিতেই পাষাণ মানুষটা সালামের উত্তর দিল না। উলটো কাঠ কাঠ গলায় বলল,
–“এই সকাল বেলা সেজেগুজে বাইরে কোথায় যাচ্ছিস?”
মৌনো বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না।
–“চটপটি খেতে।”
নিবিড়ের রাগ যেন তড়তড় করে বেড়ে গেল। আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট ছিল মমতাজের গান। সেই চটপটির স্টল থেকে সাউন্ডবক্সে মমতাজের বিচ্ছিরি এক গান ভেসে আসছে,
“আমি নষ্ট মনে নষ্ট চোখে
দেখি তোমাকে
মন আমার কি চায়
বুঝাই কেমনে।”
–“এসব ফাতরা গুলার স্টলে তুই একা মেয়ে মানুষ যাবি? কাণ্ড-জ্ঞান নেই তোর?”
মৌনো চুপসে যায়। নিবিড় তৎক্ষণাৎ তাকে অপমান করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সেদিন মৌনোর সারাটা দিন খারাপ গেছে। তার বাবা অর্থাৎ রিয়াজ সাহেবের সেদিন দাওয়াত ছিল। মৌনো তার পাঞ্জাবি আয়রন করতে গিয়ে পাঞ্জাবি পুড়ে ফেলেছে, কাপড় ধুঁতে গিয়ে কলের সাথে মাথায় বারি খেয়েছে, ছোটো বোন এশার জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছে।
*****
মৌনো ব্যাগ দিয়ে মুখ লুকিয়ে নিবিড়কে অতিক্রম করতে নিচ্ছিল ওমনি রাস্তার ওপাশ থেকে নিবিড় ডেকে উঠল,
–“মৌনো?”
ব্যাস! যা হওয়ার হয়ে গেল। মৌনো বিরস মুখে পিছে ফিরল। এগিয়ে গিয়ে স্বভাবসুলভ সালাম দিল।
–“আমাকে দেখে পালাচ্ছিলি?”
মৌনো অস্বীকার করল,
–“তাড়া আছে বাড়িতে, তাই আপনাকে দেখিনি।”
নিবিড়ের মুখের ভঙ্গির এক চিমটিও পরিবর্তন হলো না। তার হঠাৎ চোখ পড়ল মৌনোর ব্যাগে থাকা পানির বোতলে। অনুমতিহীন সে বোতলটা নিয়ে যতটুকু পানি ছিল সবটা খতম করে খালি বোতল ফিরিয়ে দিল। এতক্ষণে মনে হচ্ছে সে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। মৌনো ভেবেছিল নিবিড় প্রতিবারের মতো এবারও তার কোনো দোষ বের করে বাজে কথা বলবে। কিন্তু নিবিড়ের মধ্যে এরকম কিছুই লক্ষ্য করা গেল না।
–“বাড়ি যা, কামরুল গেছে ম্যাকানিক আনতে। ম্যাকানিক আসা অবধি এই ননসেন্সটাকে নিয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”
মৌনো সুযোগ পেয়ে দ্রুত বাড়ি চলে আসল, তার বুকটা কেমন ভয়ে এখনো ধুকপুক করছে। নিবিড় ভাইয়ের সম্মুখে দাঁড়ানো মানে বুকের কলিজা হাতে নিয়ে দাঁড়ানো। ভেবেছিল বাড়িতে এসে ফ্যানের নিচে আয়েশ করে বসবে। কিন্তু এসে দেখে কারেন্ট নেই। শুরু হয়ে গেল তার খারাপ দিনের সূচনা। যা নিবিড়ের সাথে দেখা হলে প্রতিবারই হয়। ছোটো ভাই-বোন জুনায়েদ, এশা দুজনেই স্কুলে। আম্মা রান্নাঘরে, রিমঝিম বারান্দায় বসা, রিয়াজ সাহেব চেম্বারে।
মৌনো বাড়িতে ফিরলে সবার আগে ফ্রিজ খুলে। কিন্তু আজ খোঁজার আগেই খাবার টেবিলে সরবত দেখতে পেল। পাত্রপক্ষ আসবে বিধায় আম্মা অর্থাৎ রাজিয়া শেখ শুকনো খাবারের পাশাপাশি জগে ট্যাঙের সরবত বানিয়ে রেখেছেন। যদি মেহমানরা রওনা দেয় তখনই ঝটপট নুডুলস, পায়েশ, সেমাই এসব করবেন। তাহলে খাবার গরম থাকবে, পরিবেশনও সহজ হবে।
কিন্তু দেখা গেল কিছু কারণবশত আজ পাত্রপক্ষ আসল না। রিয়াজ সাহেব কল দিয়ে জানালেন তারা আগামীকাল আসবে। আম্মার আর রান্না করা লাগল না, ভাগ্যিস আগে আগে রেঁধে রাখেননি। নয়তো কতকগুলা খাবার নষ্ট হতো।
সন্ধ্যার পরপর নিবিড়দের বাড়ি থেকে মিষ্টি আসে। সোফিয়া খানম অর্থাৎ নিবিড়ের মা নিজে কাজের লোক দিয়ে পাঠিয়েছেন। মৌনোর মা কারণ জানতে চাইলে কাজের ছেলে কামরুল বলল,
–“নিবিড় ভাইয়ে আইছে, আজকা রত্না আপারে দেখে আসছে। বিয়ে মোটামুটি পাক্কা খালাম্মা।”
রাজিয়া শেখ যেন পছন্দ করলেন না এই খবর। দুই বাড়িতে ছেলে-মেয়ে নিয়ে রেশারেশি চলছে। কে কার আগে ছেলে/মেয়েকে বিয়ে দিবে সেই নিয়ে নীরব যুদ্ধ চলছে। রাজিয়াও কিছু মিষ্টি কামরুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“আগামীকাল রিমঝিমকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। ভাবীকে জানিয়ে দিস, ছেলে বিসিএস ক্যাডার।”
কামরুল ঘাড় কাত করে চলে যায়। পরেরদিন নিবিড়ের সাথে আবারও মৌনোর অনাকাঙ্খিত দেখা হয়ে গেল। সে পথ আটকে ভ্রু অসম্ভব কুঁচকে বলল,
–“শুনলাম, তোর নাকি বিয়ে?”
চলবে~~~
বেলতুলি – [০১]
লাবিবা ওয়াহিদ
বিঃদ্রঃ গল্পটি যারা পড়বেন, সবাই সাড়া দিবেন। আপনাদের রেসপন্সের ওপর পরবর্তী পর্ব নির্ভর করছে। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর নজরে দেখবেন। যেহেতু প্রথম পর্ব, অনেককিছুই ধোঁয়াশা। গল্পটি বেশ ঝাঁঝালো হবে সম্ভবত, টক্কর-চক্কর টাইপ। সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করুন, চেষ্টা করব রিপ্লাই করার।❤️
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ১৭
-
বেলতুলি পর্ব ১৪
-
বেলতুলি পর্ব ১১
-
বেলতুলি পর্ব ১০
-
বেলতুলি গল্পের লিংক
-
বেলতুলি পর্ব ৬
-
বেলতুলি পর্ব ৪
-
বেলতুলি পর্ব ১৬
-
বেলতুলি পর্ব ৩
-
বেলতুলি পর্ব ৮