১৫
‘মীরা, আপনি খুব চুপচাপ!’
‘চুপ থাকলে সমস্যা কোথায়?’
‘আপনাকে চুপ থাকা মানায় না। চুপ দেখলে আমি হাজারটা অর্থ বানাতে শুরু করি।’
আমি তার দিকে তাকালাম। আবছা আলোতেও তার চোখদুটো অদ্ভুতভাবে স্পষ্ট দেখাচ্ছে।
জানতে চাইলাম, কি অর্থ বানান?
‘এই যে, আপনি ভাবছেন আমি ভুল করেছি। কিংবা আপনি ভাবছেন, সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে যাচ্ছে।’
আমি মাথা নাড়লাম, একটাও না।
সে একটু চমকালো, তাহলে?
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, ‘আমি ভাবছি, মানুষ কখন কাকে ভালোবাসে সেটা বোঝা এত কঠিন কেন! আচ্ছা বলুন তো আপনি আমাকে কবে থেকে ভালোবাসতে শুরু করলেন?’
লাজুক হাসলো সে। সামান্য শব্দ হলো। সেই হাসিটা আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। অথচ দেখার জন্য তীব্র আকাঙ্খা আমাকে ঘিরে ধরলো।
‘মীরা, এত তারাহুরো করছেন কেন? একটু সময় দিন না আমাকে। এখন যাইই বলবো, সব এলোমেলো লাগবে শুনতে।’
‘ও… ঠিক আছে। আমি যতদূর জানি, আপনি আমাকে সেভাবে পছন্দই করতেন না। এটা কবে থেকে শুরু হলো জানার জন্য বড্ড কৌতুহল হচ্ছে।’
‘পছন্দ করতাম না এটা ভুল কথা। আপনার জন্য আমার ভেতর যে মায়া, সেটা তো শুরু থেকেই আছে। অসহায় ছিলাম। সাহস ছিলো না। আপনি কি জানেন, আজকে আংকেলের সামনে কথা বলার সময় আমার হাত কাঁপছিলো?’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম, ‘আপনার! আপনাকে তো খুব কনফিডেন্ট দেখাচ্ছিলো।’
সে হেসে বললো, ‘দেখানো আর থাকা এক জিনিস না, মীরা। আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম। সত্যি বলতে, আমার মনে হচ্ছিল সবকিছু স্বপ্নের ভেতর ঘটে যাচ্ছে।’
বলেই সে শব্দ করে হাসলো। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
আকাশের রঙ ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে, অথচ আমাদের মাঝখানে সময়টা একদম স্থির হয়ে আছে। আমি ঘাসের ওপর বসে আছি, হাঁটু ভাঁজ করে। সে একটু সামনে ঝুঁকে, দু’হাতের আঙুলে ঘাস ছুঁয়ে দেখছে।
সে বললো, ‘আমি জীবনে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আজকের মতো ভয় কোনোদিন লাগেনি। কারণ আজ প্রথমবার কোনো সিদ্ধান্তে শুধু আমি একা নই, আপনিও জড়িত।’
আমার বুকের ভেতর কিছু একটা এসে স্রোতের মতো ধাক্কা দিলো। আমি টের পাই, এই লোকটার মাঝে আমি কতখানি ডুবে আছি! সে হারিয়ে গেলে আমিও বোধহয় অনেকদিন তাকে ভুলতে পারতাম না। চেষ্টা তো কম করিনি, অথচ এখনো সেই আগের মতো অনুভূতি। ঠিক যেন প্রেমে পড়ার প্রথম দিনটার মতো!
‘ঠান্ডা লাগছে মীরা?’
‘না।’
‘তাহলে হাত এমন করে রেখেছেন কেন?’
আমি উত্তর দিই না। কারণ উত্তর নেই আমার কাছে। আমার ভেতরে মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। এতকিছু লুকিয়ে রাখতে ভয়ংকর শক্তির দরকার। অত শক্তি পাচ্ছি না। আমি বোধহয় আবারও তার প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছি!
পরিস্থিতি বদলাতে বললাম, ‘আমার টেনশন হচ্ছে। হুট করে নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত কখনো ভালো হয় না।’
‘আমার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না?’
‘আস্থা রাখা, না রাখার বিষয় নয়। আপনি নিজে কতখানি শিওর আমার ব্যাপারে?’
‘শতভাগ।’
আমি এবার মুহুর্তের জন্য অন্যরকম এক আনন্দ অনুভব করি। সুখের জোয়ার এসে বুকের তীরে আছড়ে পড়ে।
হঠাৎ সে খুব নিচু গলায় বললো, ‘মীরা, একটা কথা বলবো?’
‘বলুন।’
‘আপনি যদি কখনো মনে করেন, এই সিদ্ধান্তটা ভুল। আমাকে আগে বলবেন। আমি চাই না আপনি চুপচাপ কষ্ট পান।’
এই প্রথম আমি অনুভব করলাম, হয়তো এই মানুষটার সঙ্গে আমি নিরাপদে দূর্বল হতে পারবো। আমার সমস্ত দূর্বলতা তার কাছে নিশ্চয়ই আনন্দের হবে। সুখের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
সন্ধ্যা শেষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মনে হলো, কিছু একটা মাত্র শুরু হলো। আমাদের জুঁটি, আমাদের প্রেম, আমাদের একে অপরের কাছাকাছি আসা..
হঠাৎ সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনার হাতটা কি একটু ধরতে পারি? জাস্ট দশ সেকেন্ডের জন্য।’
আমি শিহরিত হলাম। কী বলবো বুঝতে পারছি না। আকাশের দিকে তাকালাম। এই অদ্ভুত লোকটা আমাকে শেষ করে দিতে চায় নাকি!
সে বললো, সবকিছু হুটহাট হয়ে গেলো। কিছুই আয়োজন করতে পারলাম না আপনার জন্য। আজকের এই আকাশ, মাটি, ঘাস লতাপাতাকে সাক্ষী রেখে আপনাকে বলছি- আপনি আমার জীবনে বিশেষ একজন। সারাজীবন আপনাকে আমার লাগবে। কেন লাগবে, তা এইমুহুর্তে জানিনা। শুধু জানি, আপনাকে লাগবেই আমার। মীরা, উইল ইউ ম্যারি মি?
আমি চমকে উঠি আরও একবার। সে ফোনের টর্চ জ্বালালো। সেই আলোতে দেখতে পেলাম ঘাস দিয়ে পেঁচিয়ে বানানো একটা আংটি! আমি হাসতে ভুলে গেলাম। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
সে বললো, ‘উইল ইউ?’
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘বাবার সিদ্ধান্তের ওপর… ‘
‘নট বাবা, উইল ইউ?’
লাজুক হেসে চুপ করে রইলাম। ‘হ্যাঁ’ বলতে লজ্জায় মরে যাচ্ছি আমি। কীভাবে যে বোঝাই আমার ভেতর বইছে তুমুল ঝড়। বহু আকাঙ্খিত ব্যক্তিটাকে অকস্মাৎ পেয়ে যাওয়ার আনন্দে আমি পাগল হয়ে গেছি!
‘হাতটা একটু ধরি?’
আমার সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে যায়। মাথাটা ডান দিকে কাত করে সম্মতি জানালাম। সে আমার হাতটা তুলে নিলো। ফোনের টর্চের গোলাকার আলো আমাদের মাঝখানে যেন একটা আলাদা মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে। সেই আলোতেই হাতটা ধরে সে আমার আঙুলে একটা ঘাসের আংটি পরিয়ে দেয়। আগে বহু গল্প উপন্যাসে এমন পড়েছি। যেখানে নায়ক নায়িকার আঙুলে ঘাস দিয়ে বানানো রিং পরায়। আজকে নিজেও যেন কোনো কল্পরাজ্যে প্রবেশ করেছি..
এরপর দুজনে উঠে দাঁড়ালাম। আমি মুগ্ধতার রেশে ডুবে আছি। বুঝতে পারছি না কোনটা স্বপ্ন, কোনটা বাস্তব। সে আমার হাতটা ধরে রেখেছিলো দশ সেকেন্ডের জন্য। অথচ কয়েক মিনিট পরেও আমার শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক তরঙ্গ দৌড়ে বেড়াতে লাগলো।
পাশেই একটা রেস্তোরাঁয় এসে বসি আমরা। চারপাশে ঝলমলে আলো। এতক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকা মানুষটার মুখখানা তীব্র আলোয় দেখতে পেয়ে আমি যেন বারংবার চমকে উঠি। আজ থেকে এই মানুষটা আমার। একান্তই আমার!
আমার বাবরি চুলওয়ালা এখন শুধুই আমার।
তেমন কিছু খেতে পারলাম না। নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি। এই মীরা কখনো কারো সামনে এতটা দূর্বল হয়ে পড়বে, ভাবিনি কখনো। কিভাবে যেন নিজেকে কোনোমত টিকিয়ে রাখলাম। পরের মুহুর্ত গুলো কেটে গেলো খুব দ্রুত।
বাসায় ফিরে দ্রুত নিজের রুমে চলে আসি। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। গায়ের ওপর কাঁথা টেনে নেই। উফফ, অদ্ভুত একটা মানুষ। তার আশেপাশে গেলেই আজকাল এমন অস্থির লাগে কেন!
বোধহয় ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নিয়েছি। মায়ের ডাক শুনে ঘুম ভাংলো। এতক্ষণে আমার নার্ভাসনেস কেটে গিয়েছে। আবারও বাস্তবতায় ফিরে এসেছি আমি। পরক্ষণেই মনে পড়লো, আজ তার জন্মদিন। নিজের অনুভূতির ভেতরে এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিছু একটা তো করা দরকার তাকে স্পেশাল ফিল করানোর জন্য।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসি। মাথার ভেতর দ্রুত চিন্তাগুলো দৌড়াতে থাকে। কী করা যায়? কি করলে তার ভালো লাগবে?
এইমুহুর্তে দামী কিছু দেয়ার সুযোগ নেই। আবার সাদামাটা কিছু করলেও লজ্জা লাগবে। পায়চারি করতে থাকি..
হঠাৎ মনে হলো, তার কাছে একমাত্র আমিই স্পেশাল। আমার চাইতে স্পেশাল এইমুহুর্তে আর কিছু নেই! আমিই তার জন্মদিনের উপহার।
নিচে নামলাম। খাবার টেবিল থেকে পোলাও মাংসের ঘ্রাণ আসছে। পোলাওয়ের ওপর বেরেস্তার কড়া সুঘ্রাণ ক্ষিদেটা আরও বাড়িয়ে দিলো। আমাকে দেখে হাসলো বাবরিচুল। খুব সাধারণ হাসি, সবসময় যেভাবে হাসে। অথচ আজকের হাসি দেখে মনে হচ্ছে, এতক্ষণ সে আমাকেই খুঁজছিলো!
মা পায়েস রেঁধেছেন। ভেবেছিলাম মা হয়তো অখুশি। কারণ মা আয়মানের ব্যাপারে অনেক বলতেন। পায়েসের বাটি দেখে সেই ধারণা ভাংলো। মা নিজের হাতে বাবরি চুলওয়ালাকে পায়েস খাইয়ে দিলেন।
বাবা বললেন, ‘সামান্য কিছু খাবারের আয়োজন করেছি বাপ। এমন হুটহাট করে বললি, কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কালকে আমার দুই মেয়ে জামাই আসবে, তোর সঙ্গে দেখা করতে।’
‘কেন!’ বিস্মিত হয়ে বললো বাবরিচুল।
বাবা বললেন, ‘ আবার জিগায়। তোকে শুভেচ্ছা জানাতে আসবে। আমি আসতে বলেছি। তুই আমার কাছে খুব স্পেশাল। ফোন দিয়ে শুভেচ্ছা জানালে হবে? সামনাসামনি বলতে হবে। ভাবছি গ্রামের বাড়ির সবাইকে দাওয়াত করবো কিনা। সবাইকে ডেকে এনাউন্স করি।’
বাবরিচুল খাওয়া বন্ধ করে একবার আমার দিকে তাকালো, আর একবার বাকিদের দিকে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনো সমস্যা?’
‘এখন তো আমাদের কাজ গুছিয়ে নেয়ার সময়। এখন কি এত ঝামেলা করা ঠিক হবে?’
‘ঝামেলার কিছু নেই। একটা দিন সবাই মিলে একসঙ্গে কাটালাম এই আরকি। তুমি কি চাও না এরকম কিছু করি?’
বাবরি চুলওয়ালা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিলো, ‘আমি তো অনেকটা এতিমের মতো। ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে আসা এইমুহুর্তে আমার জন্য কঠিন। আমার তো বলার মতো কিছুই নাই, দেখানোরও কিছু নাই। পুরোপুরি শুন্য একটা ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিচ্ছেন, আপনি হয়তো খুশি কিন্তু আমার খারাপ লাগবে।’
বাবা ওর পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললেন, ‘ধুর ব্যাটা। তুই আমার ছেলের মতো। এভাবে ভাবছিস কেন বিষয়টাকে? সবাই তো জানে তোকে আমি মীরার জন্য পছন্দ করেছি। কেউই কিছু মনে করবে না।’
‘আংকেল, আমার আর্থিক অবস্থা শুধু খারাপই নয়, আমার কোনো অবস্থাই নাই। মানুষের সামনে আমি খুবই লজ্জিত হবো। আমার মনে হয় এ ধরনের আয়োজন না হলেই ভালো। অন্তত কিছু মাস পরে করলে হয় না?’
বাবা হেসে বললেন, ‘কোনো সমস্যা নাইরে বাপ। তুই নিশ্চিন্তে থাক।’
বাবরিচুল খেতে আরম্ভ করলো। এর মাঝে একবার সে আমার দিকে তাকায়। তার চোখে এক ধরনের শঙ্কা, যা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। এই অনুভূতির মানে আমি ধরতে পারলাম। এতটা হীনমন্যতা বোধ করতে হবে বলেই কি সে শুরুতে এই বিয়েতে রাজি হয়নি!
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষে আমি তাকে মৃদুস্বরে বললাম, ‘একটু ছাদে যাবেন?’
‘কেন!’
‘হাওয়া খেতে। আপনি যান, আমি একটু পরে আসছি।’
সে আমার দিকে তাকালো না। কেবল মুখ টিপে হাসলো। আমি যেন লজ্জায় মরে যাই মরে যাই অবস্থা। কিন্তু কীইবা করার আছে! তার এই সুন্দর দিনে সামান্য উইশটুকু তো করতে হবে। এদিকে সামান্য আয়োজনেই আমার হাত পা দ্রুত কাঁপতে লাগলো।
নিজের রুমে এসে হালকা সাজগোজ করলাম। জানি, এইমুহুর্তে ঠিকঠাক কিছুই পারবো না। তবুও..
ছাদের সিঁড়ি ভাংতে ভাংতে আমার পা দুটো যেন অবশ হয়ে আসছে। হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে উঠছি। ব্যাগে একটা লাল গোলাপ আর একটা ক্যান্ডেল ছাড়া কিছুই নেই। একটু আগে একজন স্টাফকে দিয়ে এগুলো আনিয়েছি। অথচ বুকের ভেতর তীব্র আলো নিয়ে উঠছি। এই আলো দিয়ে তার জীবন রাঙাবো…
ছাদে উঠতেই সে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ‘একটু চোখ বন্ধ করবেন?’
‘আপনি বললে শুধু চোখ না, নাকও বন্ধ করবো।’
লজ্জা পেয়ে হাসলাম আমি। সে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট মোমটা জ্বালালাম। বাতাসে শিখাটা কেঁপে উঠলো। ছোট্ট কাপের ভেতর মোমটা বসিয়ে দিলাম। তারপর ব্যাগ থেকে বের করলাম একটা লাল গোলাপ। একদম সাধারণ, কিন্তু টাটকা।
সব প্রস্তুত করে আমি কাঁপা গলায় বললাম, ‘এখন চোখ খুলতে পারেন।’
সে চোখ খুলতেই মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলো। মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। ছাদের অন্ধকারে সেই একটিমাত্র মোমের আলো, তার কাঁপা শিখা আর আমার হাতে ধরা গোলাপ, সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন হঠাৎ করে খুব ব্যক্তিগত হয়ে উঠলো।
আমি আরো একটু এগিয়ে গিয়ে গোলাপটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম, ‘আজ আপনার জন্মদিন। আপনি বলেছিলেন, এই দিনটা আপনাকে কেউ কখনো স্পেশাল ফিল করায়নি। আমি জানি না আমি কতটা পারবো… কিন্তু চেষ্টা করলাম। এরচেয়ে বেশী কিছু করার সাহস আমার ছিলো না। এরচেয়ে কম কিছু করার দুঃসাহসও নেই।’
সে কিছু বলছে না। শুধুু তাকিয়ে আছে – আমার দিকে। আমার হাতে ধরা মোমটার দিকে, গোলাপটার দিকে, তারপর আবার আমার দিকে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। সে কয়েক পা সামনে এগিয়ে আসলো। এতটা কাছাকাছি এর আগে কখনোই আসেনি সে। আমি যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেলাম! কাঁপছি রীতিমতো।
সে ফুল হাতে নিয়ে কোমল গলায় বললো, ‘ থ্যাঙ্কিউ মীরা। পুরো দুনিয়ার কাছে এটা সাধারণ একটা ফুল মাত্র। কিন্তু আমার কাছে এটা মহা মূল্যবান। আমার জীবনে পাওয়া ফার্স্ট গিফট এটা। তাও আপনার কাছ থেকে।’
‘আপনার জীবনে এরচেয়েও মূল্যবান উপহারটা আজকে আপনি পেয়েছেন?’
‘কি?’
‘আমাকে।’
সে লাজুকভাবে হাসলো। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘এটা তো সবকিছুর চাইতে মূল্যবান। মীরা, থ্যাঙ্কিউ। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।’
আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। । এই মুহূর্তে শব্দের কোনো দরকার নেই। তার চোখে যে কৃতজ্ঞতা, যে অবাক হয়ে পাওয়া সুখ, সেটার সামনে আমার বলা যেকোনো কথা ছোট হয়ে যাবে।
সে এখনো খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। এতটা কাছে যে আমি তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পাচ্ছি। বুকের ভেতরটা দমকা হাওয়ার মতো কেঁপে উঠছে। আমি তার এতটা কাছে। তবুও সে একচুলও সীমা পেরোলো না!
আমি মোমটা তার হাতে দিয়ে খানিকটা ব্যস্ত হয়ে চলে আসার জন্য পা বাড়াই। সে পেছন থেকে বললো, ‘আজকের দিনটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে মীরা। আপনি, আন্টির হাতের পায়েস, আংকেলের স্নেহ, সবকিছু আমার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। আসলেই আমি এতকিছুর যোগ্য কিনা জানিনা। কিন্তু কোনোদিন এর অমর্যাদা হতে দিবোনা মীরা। সারাজীবনে যা পাইনি, একদিনেই তা পেয়ে গেলাম।’
এই কথাটা শুনে বুকের ভেতরে জমে থাকা অনুভূতিগুলো টলমল করে উঠলো। আমি বললাম, ‘কেউ যদি কখনো না করে, তার মানে এই না যে আপনি পাওয়ার যোগ্য নন।’
‘আপনি এভাবে কথা বলবেন না মীরা। আমি অভ্যস্ত নই।’
‘অভ্যস্ত হয়ে যান।’
এই কথাটা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি কীভাবে বেরিয়ে এলো। লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম নিজেই। তাকিয়ে দেখি সে হেসে ফেললো, একদম শিশুর মতো।
আমি আর একমুহূর্তও দাঁড়ালাম না। চলে এলাম ঘরে। ভেবেছিলাম সারা রাত খুব ভালো ঘুম হবে। অথচ একবিন্দু ঘুমাতে পারলাম না। চোখ বুজলেই মোমের আলোয় তার কমলা রঙের হয়ে যাওয়া মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সম্মুখে। আমি তাকে না দেখে একটা মুহুর্তও থাকতে পারছি না। বারবার এপাশ ওপাশ করছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
কতবার যে ফোনের স্ক্রিন বের করে তাকিয়ে রইলাম। একটা টেক্সট আসতো যদি, অথবা একটা কল! আসলো না কিছুই। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে নিচে যাই, পানি খাওয়ার ছলে কিংবা শব্দ করে এক কাপ চা বানাই। শব্দ শুনে যদি সে আসে! কিন্তু যাওয়ার কথা ভাবলেই গা হিম হয়ে আসে। আরো অস্থির লাগে আমার। এভাবেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা..
পরদিন সকালে উঠে দেখি আপা দুলাভাই আসার আয়োজন চলছে। রান্নাবান্নার আয়োজনে আমিও যোগ দিলাম। হঠাৎ গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনে মা বললেন, ওরা এলো বোধহয়! যা তো গেটটা খুলে দিয়ে আয়।
গেট খুলে অবাক হয়ে দেখি তনয় দাঁড়িয়ে!
চলবে..
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৩
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৭
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৮
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুলওয়ালা গল্পের লিংক
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯