১৪
এতদিন যাকে আমি বুঝতেই পারিনি, সে আজ এত স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো, পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত লাগছে।
হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো আমার- সে কেন এতদিন চুপ ছিলো? যখন আমাকে তনয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো, তখনই কি সে আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? নাকি আরও আগে থেকেই সে আমাকে পছন্দ করতো যেটা বলার সুযোগ ছিলো না। আজ সিইও হওয়ার পর হঠাৎ করেই সাহস জন্মেছে?
এরকম অজস্র প্রশ্ন মাথায় নিয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। তবে অস্থিরতার ভেতরেই বুকের ভেতর সীমাহীন আনন্দেরা ঢেউ খেলে যাচ্ছে। জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্খিত বস্তুটি পেয়ে গেলে যেমন আনন্দ হয়, তারচেয়েও বেশী আনন্দ। যতই সময় গড়াচ্ছে, আমি স্বাভাবিক হচ্ছি, ততটাই তীব্রতর হচ্ছে এই আনন্দের রেশ।
বাবা নিচে ডাকলেন। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে দুই/তিন জন লোক। কিছু একটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কাছে যেতেই বুঝলাম ব্যবসায়ীক আলোচনা। হঠাৎ মুনযির আসলো। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসলো সে। আমি শিউরে উঠলাম। নিজেকে খানিকটা আড়াল করতে বাবার পাশে এসে বসি।
বাবা আমার সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন। মাঝেমাঝে মা, কখনোবা বাবরিচুলের মতামত। অনেক্ষণ ধরে আমাদের এই আলোচনা চললো। পুরো আলোচনাটাই কমার্শিয়াল।
হঠাৎ বাবরিচুল বললো, ‘আংকেল..’
আমরা সবাই মনযোগী হয়ে তার দিকে তাকালাম। ধারণা করলাম, কোনো আইডিয়া দেবে।
কিন্তু, আমার পুরো চিন্তাভাবনার জগতকে চমকে দিয়ে সে বললো, ‘আমি মীরাকে বিয়ে করতে চাই।’
অজান্তেই আমার চোখ দুটো তুলনামূলক বড় আকার ধারণ করলো। আমি কোনোমত ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করলাম। আজকে তার হলো টা কী! একের পর এক বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটিয়েই যাচ্ছে!
বাবা হেসে বললেন, ‘ আলহামদুলিল্লাহ। এটা তো খুবই ভালো কথা। কই গো মীরার মা, এদিকে আসো।’
মা ছুটে আসলেন। বাবা আনন্দিত গলায় মাকে বললেন, ‘মুনযির রাজি হয়েছে। মীরাকে বিয়ে করবে ও।’
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বাবা মুনযিরের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। এই দৃশ্য দেখে আমার মুখটা লজ্জায় আগুন হয়ে গেলো। উঠতে ইচ্ছে করছিলো, ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো, তবুও শরীর নড়ছিলো না। মনে হচ্ছিলো, পা দুটো যেন মেঝেতে শিকড় গজিয়ে বসে গেছে।
মুনযির এবার আমার দিকে তাকায়। স্পষ্ট গলায় জানতে চায়, ‘মীরা, আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?’
আমি এবার লজ্জায় লাল থেকে নীল হতে শুরু করেছি। কিছু বলার আগেই বাবা বললেন, ‘ওর কোনো আপত্তি নেই। আমি যাকে বলবো, ও তাকেই বিয়ে করবে।’
‘ধন্যবাদ আংকেল। আপনাদের বিশ্বাসের মর্যাদা আমি রাখবো ইনশাআল্লাহ।’
তার কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা, ভদ্রতা আর দায়িত্ববোধ স্পষ্ট। বাবা মুনযিরের হাত চেপে ধরে বসে আছেন। মাঝেমাঝে আড়চোখে ঘরের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে আমি শিউরে উঠছি। ঘরের ভেতরটা যেন হঠাৎ করে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে।
একটু থেমে সে আবার বললো, ‘আংকেল… আমি কি মীরার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাদা করে কথা বলতে পারি?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও কথা বলো তোমরা।’
মুনযির হালকা হাসি নিয়ে বললো, ‘ আজকের দিনটা আমার জীবনের স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। আসলে আজ আমার জন্মদিন। আজকের এই দিনেই জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিলাম। মনে হচ্ছে, আজ থেকে জীবনটা অন্যদিকে মোড় নিলো। মীরার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই, আপনি যদি অনুমতি দেন।’
বাবা আদুরে ভঙ্গিতে ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘এই কথা আগে বলিস নাই কেন? তোর জন্মদিন আর তুই চুপচাপ!’
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মীরা মা, আমার বাবাটাকে নিয়ে বাইরে যা তো। একটু ঘুরে আয়।’
আমি আশ্চর্য হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালাম। যিনি কোনোদিন আমাকে কোনো পুরুষ লোকের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলা পছন্দ করতেন না, তিনি আমাকে বিনা কারণে তার সঙ্গে বাইরে যাওয়ার আদেশ করছেন! মায়ের মুখেও সম্মতির হাসি।
আমি যন্ত্রের মতো নিঃশব্দে উঠে নিজের রুমে এলাম। দরজা বন্ধ করেই বুকের ওপর হাত রাখলাম। হৃদয়টা যেন দৌড়াচ্ছে। এ কেমন অনুভূতি! পুরো শরীর জুড়ে বিচিত্র এক ছটফটানি অনুভূতি দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
রেডি হতে হতে আমার গা রীতিমতো কাঁপতে লাগলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম। এ কে! আজকের আমি কেমন অচেনা, কেমন নতুন! এতটা রক্তিম, এতটা লাজুক, এর আগে কখনোই হইনি আমি।
কোন জামাটা পরবো? আজকের দিনটা তার কাছে যতটা স্পেশাল, আমার কাছেও ততটাই। পোশাক বাছাই করতে পারছি না। দ্রুত হার্টবিট হচ্ছে!
ধপ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ি আমি। খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়েই থাকি। চোখ বুজলেই তার চেহারাটা চোখে ভেসে ওঠে। কেবলই মনে হচ্ছে সে আমাকে খুব শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরুক। এই সমস্ত অস্থিরতার অবসান বোধহয় তখনই ঘটবে!
অনেক সময় নিয়ে রেডি হলাম। এরপর একসঙ্গে বাইরে বের হলাম আমরা। একসাথে এর আগেও তো অনেক জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু আজ, সম্পূর্ণ নতুন এক সম্পর্কে পা রাখার ঠিক আগমুহূর্তে! এই অনুভূতি পুরোপুরি আলাদা। একেবারেই অন্যরকম।
বাসা থেকে বের হয়ে পথের ধারে দাঁড়ালাম। রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। আজকেই প্রথম একসঙ্গে রিকশায় উঠবো আমরা। আমি অস্থিরতায় ছটফট করতে করতে স্থির থাকার ভান করছি।
সে বললো, ‘আংকেল গাড়ি নিতে বলেছিলেন। আমি চাচ্ছি না। আপনার কোনো সমস্যা নেই তো?’
আমি দ্রুত উত্তর দিলাম, ‘না। ইটস ওকে। আজকে আপনার জন্মদিন, আগে জানাননি কেন?’
‘জানালে কি হতো?’
‘অন্তত উইশ করতে পারতাম।’
সে মিষ্টি করে হেসে বললো, ‘উইশ! এটা আমাকে কেউ কোনোদিন করেনি। আমার জন্মদিনে আমাকে হ্যাপি বাড্ডে বলার কেউ ছিলোনা মীরা। আপনি আমাকে উইশ করবেন এটা আমার কল্পনাতেও ছিলোনা। এনিওয়ে, এখন করুন?’
‘এভাবে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে?’
‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি উইশ করা যায় না?’
‘না। আমি খুবই বিব্রত। পুরো বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে।’
‘অদ্ভুত লাগার কিছু নেই। আমাকে খারাপ ভাববেন না। লোভীও ভাবার দরকার নেই। একটু সময় দিন, আমি নিজেকে ব্যাখ্যা করবো।’
‘আমি আপনাকে লোভী ভাববো কেন?’ আশ্চর্য!’
‘রাজ্য আর রাজকন্যা একসঙ্গে পেয়ে যাওয়ার লোভে আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি, এরকম মনে হচ্ছে না আপনার?’
‘না। আমি তো জানি আপনি সৎ।’
বাবরি চুলওয়ালা ফিক করে হেসে বললো, ‘ থ্যাংকস মীরা। আমার ওপর বিশ্বাস রাখার জন্য। আমি আসলে খুবই সরি আপনাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য।’
এমন সময় একটা রিকশা পেয়ে যাই। উঠে বসি রিকশায়। সে বসে আমার পাশে। আমি অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছি। অন্যদিকে মুখ করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার অদম্য চেষ্টা করে চলেছি আমি।
সে বললো, ‘আচ্ছা আপনার কি একবারও আমাকে খারাপ মনে হচ্ছে না? এটা কেমন ছেলে, যে নিজের বন্ধুর জন্য সুপারিশ করে এখন আবার নিজেই প্রস্তাব দিচ্ছে। এমন মনে হয়নি মীরা?’
আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম, ‘একবারও না। আমি কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করি না।’
‘খুব ভালো। বিয়েবাড়িতে যেদিন জানতে পারি আংকেল আমাকে জামাই বানাতে চান, আমি বিষয়টা একেবারেই মেনে নিতে পারিনি। এটা মেনে নেয়ার মতো নয় আসলেই। কিন্তু মীরা, যত সময় গড়িয়েছে, আমি আপনাকে তত বেশী.. কোন শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করবো বুঝতে পারছি না। আপনাকে একদিন বলেছিলাম না, আমি আপনাকে খুব স্নেহ করি? সত্যিই আপনি আমার অনেক আদরের। এরচেয়ে ভালো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিনা। যেটা দিয়ে বোঝাতে পারবো আপনাকে আমি কতটা ইয়ে করি।’
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ভালোবাসেন?’
সে খানিকটা চমকালো। হাতের ইশারা করে বললো, ‘ওইদিকে তাকান।’
‘কোনদিকে?’
‘যেদিকে ইচ্ছা।’
আমি অন্যদিকে তাকালাম। সে তৎক্ষনাৎ অস্থির স্বরে বলে উঠলো, ‘মীরা প্লিজ এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না। আমি শেষ হয়ে যাই।’
‘মানে!’
‘মানে বুঝতে হবে না। আপনি তাকালে আমার ভেতর কেমন একটা অনুভূতি হয়। আগুন ধরে যায় টাইপের অনুভূতি। এটাকে আমি ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারবো না।’
আমি মুখ টিপে হাসলাম। তারমানে এই পথের পথিক আমি একা নই। সেও একই রোগে আক্রান্ত! আমার ভেতর যে অস্থিরতা, এর রেশ তাকে ছুঁতে পেরেছে অবশেষে…
সন্ধ্যা নেমেছে। দিনের আলোটা যেন ক্লান্ত হয়ে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। আকাশের গায়ে হালকা কমলা আর বেগুনির মিশেল, ঠিক যেন অসম্পূর্ণ কোনো অনুভূতি, পুরোটা বলা হয়নি এখনো।
রিকশাটা চলেছে মসৃণ ছন্দে। রাস্তার শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা আজানের শেষ টান, দোকানগুলোর আলো জ্বলে ওঠা- সবকিছু মিলিয়ে একটা মোহনীয় সন্ধ্যা তৈরি হয়েছে।
আমার খোলা চুলের ফাঁক গলে বাতাস ঢুকে পড়ছে গাল ছুঁয়ে। দু’জনের মাঝখানে অদ্ভুত এক নীরবতা। এই নীরবতা অস্বস্তিকর না, কিছুটা ভারী। যেন বহুদিন জমে থাকা কথা গুলো বাতাসে ভাসছে, কিন্তু এখনো উচ্চারণের সাহস পায়নি।
হঠাৎ রিকশাটা খানিকটা দুলে উঠলে আমাদের কনুই দুটো একসঙ্গে লেগে যায়। এক মুহূর্তের স্পর্শ। অথচ বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে বললো, ‘মীরা, আপনি হয়তো ভাবছেন এরকম হুটহাট করে কেনই বা প্রপোজ করলাম। আমি নিজেও আশ্চর্য নিজের আচরণে। আমি তো এরকম মানুষ নই। হঠাৎ আমার কি হয়েছে জানিনা। আমার শুধু মনে হয়েছে আপনাকে আটকাতে হবে। তনয়ের পাগলামি সিরিয়াস লেভেলে চলে গেছে। আজকের মধ্যে আপনি ফোন না করলে সে আপনার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতো।’
আমি হেসে বললাম, ‘তনয় আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যেতো তাইনা? সেজন্যই তড়িঘড়ি করে..’
‘মীরা, আপনি যা ইচ্ছে ভাবুন। এইমুহুর্তে আমার নিজের কাছেই নিজেকে অবিশ্বাস্য লাগছে। আমি জানি আপনারাও অবাক হয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে আর কোনো পথ ছিলো না। তনয় সত্যিই আপনাকে নিয়ে যেতো। ওর সেই পাওয়ার আছে। আমি গতকালই নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। হ্যাঁ, আমি আপনাকে পছন্দ করি। এটাই আমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু এটা কিভাবে বলবো তা বুঝতে পারছিলাম না। আজকেই আংকেল আমাকে সিইও ঘোষণা দিয়েছেন। জানি, এটা অতটাও বড় বিষয় না আপনার জন্য। কিন্তু আপাতত, আমার কাছে এটা বিশাল কিছু। অন্তত একটা মেয়ের দায়িত্ব নেয়ার জন্য এটা যথেষ্ট। এটাই মূলত আমার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। আংকেলের পছন্দকে সম্মান জানাতে আপনি বিয়েতে রাজি হয়েছেন এটা আমি জানি। মীরা, প্লিজ আমাকেও একটু বিবেচনায় রাখুন। আমি ছেলেটা অতটাও অযোগ্য নই। একবার সুযোগ দিয়েই দেখুন।’
খানিকক্ষণ চুপ থেকে সে আবারও বললো, ‘আপনি তো আমাকে পছন্দ করেন না। সেদিন তো বললেনই, আপনি চাননি আমাদের বিয়ে হোক। তবুও নির্লজ্জের মতো আজকে আপনাকে এসব বললাম। আমি সরি, ভীষণ সরি। কিন্তু আমি আপনাকে হারাতে চাইনা মীরা।’
আমার খুব হাসি পেলো কথাগুলো শুনে। এই ভুল কি ভাঙিয়ে দিবো? তাকে কি বলে দিবো আমি আপনাকে কত তীব্রভাবে চাইতাম! না থাক। এখনই না। যতটা কেঁদেছি, প্রতি ফোঁটা চোখের জল উসুল করে তবেই বলবো।
মুখ টিপে হাসলাম আমি। তার এই গরীবিহাল দেখতে ভালো লাগছে। সে নিজেকে অযোগ্য ভাবছে এটা আমার জন্য সুখকর নয়। কারণ এভাবেই তাকে আমি ভালোবেসেছি। তবে ভাবতে ভালো লাগছে, সে নিজেকে আরো বেশী যোগ্য করার চেষ্টা করবে। এই অনুভূতি সুন্দর।
আমরা একটা খোলামেলা জায়গায় এসে রিকশা থেকে নামলাম। চারপাশ জুড়ে সুনসান নীরবতা। লোকজন খুব একটা নেই। যেন শহরটা ইচ্ছে করেই আমাদের জন্য একটু ফাঁকা হয়ে গেছে।
পায়ের নিচে বড় বড় ঘাস, কিছুটা ভেজা, কিছুটা নরম। সেই ঘাসের ওপরেই দু’জনে মুখোমুখি বসে পড়লাম।
দূর থেকে ভেসে আসছে কিছু আলো। হয়তো কোনো বাড়ির জানালা, চায়ের দোকান কিংবা হয়তো রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে। আবছা এই অন্ধকারেই আমরা মুখোমুখি বসে রইলাম।
মুহূর্ত বয়ে যায়। আমরা অনেক্ষণ কেউই কথা বললাম না। সে হয়তো এলোমেলো কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। আর আমি, শুধুই এই মুহুর্তটা উপভোগ করছি। কেননা আমার মাঝে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ নেই, কোনো দোলাচল নেই। আমি আছি ব্যাপক আনন্দে। তার এই বিদ্ভ্রান্তি, ছটফটানি, অদ্ভুত আচরণ, সবকিছুই আমার কাছে উপভোগ্যকর। সে চুপ থাকলেও আমার ভালো লাগে। কারণ কিছু অনুভূতিরা শব্দ চায় না, শুধু উপস্থিতি চায়।
‘মীরা।’
‘হুম।’
‘গরম চা পড়েছিলো যেখানে,সেখানে কি ফোস্কা পড়েছে?’
‘না।’
‘জ্বালাপোড়া আছে এখনো?’
‘না নেই।’
‘আর ভেতরের জ্বালাপোড়াটা?’
আমি মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিলাম, ‘ওটাও নেই।’ কিন্তু এটা বলা যাবে না। এটা বললেই সে বুঝে যাবে আমি তাকে কতটা পছন্দ করি। এটা বুঝতে দেয়া যাবে না।
তাই ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম, ‘ভেতরের জ্বালাপোড়া? বুঝলাম না।’
‘আপনার ভেতরে জ্বালাপোড়ার অনুভূতি, সেটা তো আপনিই বলেছিলেন। মানুষ শুধু বাইরেরটা দেখে, ভেতরেরটা দেখে না। ওটার কথা বলছি।’
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘বলেছিলাম নাকি?’
‘হ্যাঁ, বলেছেন। ভুলে গেছেন?’
‘না।’
‘তনয়কে কি আপনার খুব পছন্দ?’
‘কি ধারণা আপনার?’
‘আই থিংক, তনয়কে আপনার অনেক পছন্দ হয়েছে। তাই আপনি ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছেন। ওকে হয়তো বলতে পারছেন না।’
‘এটা একটু বেশী বেশী হয়ে গেলো না?’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কিছুই না। আমি অন্য একটা বিষয় নিয়ে মানসিকভাবে কষ্টে ছিলাম। তনয়কে আমার অতটাও পছন্দ নয়।’
‘সত্যি! তাহলে ওর নাম্বার চেয়েছিলেন কেন?’
‘কথা বলে দেখতে চেয়েছিলাম সে কেমন! ভালো লাগানো যায় কিনা।’
‘যাক বাঁচলাম।’
‘মানে!’
‘ভেবেছিলাম আপনি ওকে অনেক পছন্দ করেন। সেখানে আমি উলটো প্রপোজ করে বসলে আপনি হয়তো তনয়ের জন্য কষ্ট পাবেন। এখন ভালো লাগছে।’
আমি মনেমনে হাসলাম। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে তাকে সবটা বলে দেই। জোরগলায় বলি, না না না তনয়কে আমি একটুও চাইনি। তনয়কে আমার একদমই ভালো লাগেনি। আমার সমস্ত জ্বালা কেবল বাবরি চুলওয়ালার জন্য। কিন্তু না, আমি বলবো না। সমস্ত চোখের জল উসুল করে তারপর বলবো।
গাছের পাতায় হালকা বাতাস বয়ে যায়। দূরে কোথাও একটা পাখি ডেকে ওঠে, আবার থেমে যায়। সময়ের যেন কোনো তাড়া নেই, কোনো ব্যস্ততা নেই। আমিও আমার সমস্ত ব্যস্ততাকে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ভেতরে ভেতরে চাই, আজকের মুহুর্ত কখনো না ফুরাক। এই সন্ধ্যা অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকুক..
চলবে..
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৮
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১০
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৬
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৭
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪