১৩
তনয়কে বিদায় জানিয়ে আমি ও বাবরি চুলওয়ালা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হই। আমার মনে অদ্ভুত আনন্দ। জানিনা কেন! হয়তোবা বাবরিচুলের সামনে তার বন্ধুর নিকট সবচেয়ে আকাঙ্খিত হবার কারণে।
সে বললো, ‘মিস মীরা, আপনাকে একটা রিকশায় তুলে দেই। আপনি বাসায় চলে যান। আমি তনয়ের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ বসবো।’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমি নিজেই রিকশা নিতে পারবো। আপনি যান।’
‘মীরা..’
‘হুম।’
‘আপনাদেরকে সুন্দর মানিয়েছে।’
কথাটা শুনে আমার পিত্তি জ্বলে গেলো। সুন্দর মানিয়েছে! কিভাবে বললো সে কথাটা? অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘তাই?’
- ‘হ্যাঁ। আর আপনি যখন হাসছিলেন ওর সঙ্গে, আমার ভালো লাগছিলো দেখতে। সত্যি বলছি, ও আপনার জন্য পারফেক্ট একটা ছেলে।’
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘আপনি যখন বলছেন, তার মানে সে অবশ্যই পারফেক্ট। কিন্তু যে গুণগুলোর কারণে সে পারফেক্ট, এগুলো তো আপনার মধ্যেও ছিলো। তবুও আপনি কিন্তু রাজি হননি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনি আমাকে খুব অপছন্দ করেন।’
বাবরিচুল চমকে উঠে বললো, ‘না না। আপনাকে অপছন্দ করার দুঃসাহস আমার নেই। আমি নিজের অভাবেই পুড়ে মরি। শুধু একটা গুণের অভাব আমাকে পূর্ণতা দিতে পারেনি। যেটা ওর মধ্যে আছে। এই একটা জিনিসই ওকে আমার থেকে আলাদা করেছে।’
‘কি সেটা? টাকা পয়সা?’
‘হুম।’
‘টাকা পয়সা সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। ‘
‘কিন্তু মীরা, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। জানেন তো, মাথার ওপর বাবা নামক ছায়াটা না থাকলে বোঝা যায় জীবন কি জিনিস!’
‘দার্শনিক কথাবার্তা ঘরে বসে শুনতে হয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনতে ভালো লাগছে না। আমি রিকশা নিচ্ছি। আপনি যান।’
‘মীরা, আপনি যান আগে।’
বাবরিচুল একটা রিকশা ডাক দিলো। আমি উঠে বসলাম রিকশায়। এমন সময় তনয় দৌড়ে এসে বললো, ‘কতদিন অপেক্ষা করবো সেটা তো বললেন না?’
‘বেশিদিন অপেক্ষা করাবো না। যেদিন আমি প্রস্তুত হবো, মিস্টার বাবরি চুলওয়ালার কাছ থেকে আপনার নাম্বার চেয়ে নিবো।’
‘সেই দিন দ্রুতই আসুক। বন্ধু বাবরি, তুই সবসময় রেডি থাকিস। যেকোনো সময় মীরার কাছে তোর ডাক পড়তে পারে।’
আমি হেসে ফেললাম। তনয় রিকশাওয়ালাকে বললো, ‘মামা তুমি কই থাকো?’
‘এইতো দুই গল্লি পরেই মামা।’
‘মামী আছে নাকি বাসায়?’
‘হ আছে।’
তনয় পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে রিকশাওয়ালার হাতে দিয়ে বললো, ‘এইটা নাও মামা। মামীর জন্য কিছু কিনে নিয়া যাইও।’
রিকশাওয়ালা ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে বললো, ‘হ মামা। ধইন্যবাদ।’
‘আপনাকেও ধন্যবাদ মামা। ম্যাডামকে সাবধানে নিয়া যাইবা। বুচ্ছো?’
‘হ মামা বুচ্ছি।’
রিকশা চলতে আরম্ভ করলো। আমি একবারও পিছন ফিরে তাকালাম না। আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে করছিলো, এইমুহুর্তে বাবরিওয়ালার মুখটা কি হাসি হাসি? নাকি বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে তার মুখে? অবশ্য বিষাদে পড়ার কারণ দেখিনা। বিষাদময়ী তো কেবল আমি। আমিই বোকার মতো তার জীবনের ছায়া হতে চেয়েছিলাম। সে তো কভু ছিলোনা আমার!
বাসায় ফিরেই দরজা বন্ধ করে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকি। বুকের ভেতরটা কেমন জানি গুমোট লাগছে। পায়ের নিচের মেঝেটা যেন স্থির থাকতে চায় না। এক কোণ থেকে আরেক কোণে হেঁটে যাচ্ছি, আবার ফিরে আসছি। আয়নার সামনে এসে দাঁড়াই, আবার সরে যাই। আমার ভেতরে কী যে হচ্ছে, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।
একসময় বালিশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমি খানিকটা জেদের বশে তনয়ের সঙ্গে দেখা করেছি আজ। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো বাবরিচুলের সম্মুখে কারো থেকে ভীষণরকম প্রায়োরিটি পেতে। সেটা পেয়েছি। কিন্তু, মন ভরছে না। বাবরিচুলের মাঝে বিন্দুমাত্র ঈর্ষার ছায়াও নেই। তনয়কে অনেক সিরিয়াস মনে হলো। দেখা করাটা হিতের বিপরীত হয়ে যাবে না তো!
পরদিন ভার্সিটি থেকে বের হয়ে রিকশার অপেক্ষা করছি। কোথা থেকে একটা বাচ্চা এসে এক গুচ্ছ ফুল দিয়ে বললো, ‘আপু, এগুলো আপনার জন্য।’
‘আমার জন্য মানে?’
‘স্যার দিতে কইছে।’
‘কোন স্যার?’
‘স্যারের নাম জানিনা। সুন্দরমতন, লম্বা কইরা।’
‘চুল কেমন?’
‘খাড়া চুল। সুন্দর।’
আমি বোধহয় খুশি হওয়ার বদলে হতাশ হলাম। তনয় আমাকে ফুল পাঠিয়েছে। তারমানে আশেপাশেই আছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে খুঁজলাম, পেলাম না। ফুলগুলো নিয়ে চলে এলাম বাসায়।
শুক্রবার দুপুরবেলা বাবরিচুল একগাদা খাবার দাবার নিয়ে হাজির। খাবারগুলো মাকে দিয়ে বললো, ‘আন্টি, তনয় এগুলো আপনাদের জন্য পাঠিয়েছে। ওর মায়ের হাতের রান্না।’
আমি ভ্রু কুঁচকে বাবরি ওয়ালার দিকে তাকালাম। সে হেসে বললো, ‘আপনার জন্য পাঠায়নি, আংকেল আন্টির জন্য পাঠিয়েছে।’
‘যান তো এখান থেকে।’
বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে এলাম আমি। ছেলেটা কি পাগল! চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। যেকোনও মেয়েই হয়তো এরকম পাগলামি দেখলে খুশি হয়। সিনেম্যাটিক কাজ কারবার। কিন্তু আমার মোটেও খুশি লাগছে না। বরং অদ্ভুত এক অপ্রাপ্তি আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে। আমি যাকে চাইতাম, এই কাজগুলো যদি সে করতো; আজ আমি হতাম জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়ে!
জীবনটা এত বিচিত্র কেন!
খানিকক্ষণ পর দেখি বাবরিওয়ালা উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার সম্মুখে এসে সিরিয়াস মুখে জানতে চাইলাম, ‘তনয়ের সম্পর্কে কিছু বলুন তো আমাকে? ছেলেটা কেমন?’
সে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো, ‘ভালো। আপনার মতোই। চঞ্চল, হাসিখুশি, মিশুক।’
‘আমি চঞ্চল?’
‘হুম।’
‘এখনো?’
বাবরিচুল কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো, ‘উহু, এখন একটু কম। ব্যাপার কি মীরা? আপনার চঞ্চলতা কমে গেছে কেন?’
‘আমি আমাকে বদলে ফেলেছি।’
‘কিন্তু কেন!’
‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
‘মীরা, আপনি যেমন ছিলেন তেমনি থাকুন। ওভাবেই আপনাকে সবচেয়ে বেশী মানায়। প্লিজ, চেঞ্জ হবেন না।’
আমি প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম, ‘তনয়ের ব্যাপারে বলুন না কিছু?’
‘খুব আগ্রহী মনে হচ্ছে?’
‘আপনি তো সেটাই চান।’
হঠাৎ সে আমার চোখের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকালো। আমি ম্লানভাবে হাসলাম। সে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে। আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘কি হলো বলুন?’
দুজনে উঠানে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলাম। সে তনয়ের ব্যাপারে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিল আমাকে। আমি খানিকটা ইচ্ছেকৃতভাবেই অবাক হওয়ার ভান করে কথাগুলো শুনছিলাম।
এক পর্যায়ে সে বললো, ‘তনয়কে আপনার খুব মনে ধরেছে তাইনা?’
‘ছেলেটা তো মনে ধরার মতোই। আপনার বুঝি ঈর্ষা হয়?’
‘ঈর্ষা! কাকে? তনয়কে?’
‘হুম। হয় না?’
‘তা হবে কেন?’
‘মীরা দুনিয়াতে এক পিস ই আছে। আর তাকে অন্য কেউ পেয়ে যাচ্ছে।’
‘তাতে আমার ঈর্ষা কেন হবে? আমি তো কখনো মীরাকে পেতে চাইনি।’
আমি ভেতরে ভেতরে রেগে গেলাম। মুখে প্রকাশ করলাম না। তবে অসম্ভব বেদনা আমার গলা চেপে ধরলো। আমি তো জানি সে আমাকে কখনো চায়নি, তাই বলে সেটা মুখে বলতে হবে! হৃদয়টা একেবারে ছিঁড়ে গেলো আমার।
মাঝখানে দুটো দিন পেরিয়ে গেলো। বাবার গার্মেন্টসের জন্য জমি কেনা হয়েছে। একদিন মা গিয়ে জায়গাটা দেখেও এসেছে। বাবা কয়েকদিন ধরেই বারবার বলছিলেন, চল যাই। জায়গাটা দেখবি না?
আমিই কয়েকদিন যাবত আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। আজকে ভীষণ দমবন্ধ লাগছে। মনে হলো, একটু ফ্রেশ বাতাসের দরকার। বাবাকে জানালাম।
বাবা জানালেন তিনি আজ ব্যস্ত। আজকে নিয়ে যেতে পারবেন না।
আমি খানিকটা হতাশ হয়ে বললাম, ‘কাজ বাদ দিয়ে চলো না আব্বু। আমার দমবন্ধ লাগছে। একটু খোলা হাওয়ায় যাবো ভাবছিলাম।’
‘মুনযিরকে নিয়ে যা?’
‘ওনার সঙ্গে যাবো না।’
‘আরে যা। ঘুরে আয়, ভালো লাগবে।’
বাবা বাবরি চুলওয়ালাকে ডেকে গাড়ি বের করতে বললেন। পিছনের সিটে বসলাম আমি। পথে যেতে যেতে কয়েকবার লুকিং গ্লাসে আমাদের চোখাচোখি হলো।
সে হঠাৎ বললো, ‘তনয়ের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?’
‘না।’
‘দ্রুত ছেলেটাকে ফোন করুন। ও আপনার ফোনের আশায় সারাদিন বসে থাকে।’
‘তাই নাকি?’
পথে এক চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে চা নিয়ে আসলো। আমি চায়ের কাপ নিতে গিয়ে খানিকটা চা ছলকে আমার জামায় পড়ে যায়। বাবরি চুল ছুটে গিয়ে দোকান থেকে কয়েকটা টিস্যুপেপার এনে দিয়ে বললো, ‘গায়ে পড়েছে? পুড়ে গেছে কি? পানি ঢালবেন?’
‘না না। শুধু জামায় পড়েছে।’
সে দ্রুত কোথাও একটা ছুটে যায়। তারপর ফিরে আসে ভেজা রুমাল নিয়ে। বললো, ‘জ্বালাপোড়া করলে এটা লাগিয়ে রাখুন।’
চা শেষ করলাম আমরা। সে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে একটা ফার্মেসীর সামনে এসে গাড়ি থামায়। তারপর কিনে আনে একটা “বার্না” টাইপ মলম। যেটা পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে লাগাতে হয়। আমি বললাম, আপনি অযথাই এত ব্যস্ত হচ্ছেন। সেরকম কিছু হয়নি।
‘হয়তো এখন বুঝতে পারছেন না। পরে কিন্তু ফোসকা পড়ে যাবে। জ্বালাপোড়া করলে এটা ইউজ করুন। কমে যাবে।’
‘সামান্য গরম চা পড়েছে। তাও টগবগে গরম না। এত সামান্য গরমে কিছু হয় না।’
‘জ্বলছে না একটুও?’
‘মাঝেমাঝে মানুষকে দেখে অবাক লাগে। এরা বাইরের জ্বালাপোড়া দেখে অস্থির হয়ে যায়। অথচ ভেতরের জ্বালাপোড়ার খবর রাখে না।’
‘কি বললেন?’
গাড়ি ব্রেক করে সে আমার দিকে তাকালো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘দুনিয়ার সবাই বলে আমি নাকি অবুঝ। কিছু বুঝিনা। জানেন আপনার মতো অবুঝ বান্দা আমি আর দেখি নাই একটাও। কথা কি বোঝেন না? নাকি ভান ধরেন?’
‘মিস মীরা.. আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।’
‘আপনার এসব অভিনয় দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত।’
‘কিসের অভিনয়? সত্যি আমি বুঝতে পারছি না।’
‘ঢং বন্ধ করুন। গাড়ি স্টার্ট দিন।’
সে গাড়ি স্টার্ট দিলো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। অনেকদিন ধরে জমিয়ে রাখা ক্ষোভটা ঝাড়তে পেরে আমার ভীষণ হালকা লাগছে। জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে ফুরফুরে বাতাসে নিজেকে মেলে ধরলাম।
এরপর আর তেমন কোনো কথা হলো না আমাদের। লোকেশানে গিয়ে চুপচাপ পুরোটা জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এখন বেশ সতেজ অনুভূত হচ্ছে। মাঝেমাঝে সে আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছিলো কোথায় কী হবে।
ফেরার পথে কেউই কোনো কথা বললাম না। হঠাৎ বেজে উঠলো ওর ফোনটা। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তনয়। রিসিভ করবো?’
‘আপনার ইচ্ছা।’
‘রিসিভ করলেই আপনার কথা জিজ্ঞেস করবে।’
‘করুন। লাউডস্পিকার দিন।’
মুনযির গাড়ি থামিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে তনয়ের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘বন্ধু বাবরি, ও আসছে?’
‘হুম।’
‘কি পরে আসছে?’
সে এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘সবুজ জামা।’
‘টিয়া পাখির মতো লাগতেছে নিশ্চয়ই। ইশরে, আমি কেন থাকতে পারলাম না ওখানে! বন্ধু, ওরে আমার কথা বলছোস?’
‘হুম।’
‘কি কি বললি? বেশি করে বল। সে জানুক আমি তার দুঃখে কেমন দেবদাস হয়ে যাচ্ছি।’
‘বলবো।’
‘আচ্ছা শোন, ওকে কিন্তু বলিস দ্রুত আমাকে ফোন দিতে। আমাকে ভালো না লাগলে নাই। অন্তত ফোন করুক। আমি আর ওয়েট করতে পারতেছি না।’
‘আচ্ছা।’
‘প্লিজ দোস্ত। আমার জন্য এই কাজটা করে দে। ওকে একটু বুঝা।’
‘আচ্ছা।’
‘ভিডিও কল দিবো?’
‘পাগলামি করিস না। আমি বলবো। রাখি।’
কল কেটে দিয়ে একটা শ্বাস ফেলে সে বললো, ‘দেখলেন আমার বন্ধুর কি অবস্থা আপনার জন্য? আপনি সেদিন দেখা না করলে আজকে এই অবস্থা হতো না। আপনি ওকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। এখন যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নিন। কল দিন ওকে।’
আমি কী বলবো ভেবে পেলাম না। বাবরি চুলওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসে আমার খোলা চুল উড়ে এসে গাল ঢেকে দিলো। সে হঠাৎ বললো, ‘তনয়কে কি বলবো আপনার চুল উড়লে দেখতে ভালো লাগে?’
‘না।’
‘তনয় সারাক্ষণ আপনার ব্যাপারে এটা সেটা জানতে চায়। হাজারটা প্রশ্ন আপনাকে নিয়ে। মীরার কি পছন্দ, মীরার ভালো দিক কোনটা, মীরার খারাপ দিক কোনটা, মীরার পছন্দের খাবার কি, কালার, মীরা কি করতে ভালোবাসে, এরকম প্রশ্ন করতেই থাকে।’
আমি ঠোঁট উলটে বললাম, ‘এসবের উত্তর আপনি জানেন নাকি?’
‘পর্যবেক্ষণ করে যেটুকু জানি, সেটার উত্তর দেই।’
‘বাপ্রে! আপনি দেখি আমার ব্যাপারে পিএইচডি করে ফেলেছেন!’
সে চুপ করে রইলো। আমি বললাম,
‘আচ্ছা আপনি কি চান? আমি ওনার সঙ্গে কথা বলি?’
‘এটা পুরোটাই আপনার ব্যাপার।’
‘আপনার কোনো পরামর্শ আছে?’
‘না।’
আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটা ওদিকে অপেক্ষা করছে। আমি জানি প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষা কতটা বেদনার! কতটা কষ্টের। ওনাকে আর অপেক্ষায় রাখবো না আমি। ফোন করবো, কথা বলবো। তারপর বলে দিবো, আমি আমার মনটা অনেক আগেই অন্য কাউকে দিয়ে বসে আছি। আপনাকে নতুন করে আর দেয়া সম্ভব নয়।
বাসায় পৌঁছে গাড়ি থেকে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবরি চুলওয়ালা হঠাৎ এসে পাশে দাঁড়াতেই আমি বললাম, ‘ওনার নাম্বারটা আমাকে দিন।’
সে চমকে উঠে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। তারপর মৃদু হেসে বললো, ‘ টেক্সট করে দিবো?’
‘দিন।’
আর কথা হলোনা। আমি বাড়ির ভেতর দিকে পা বাড়ালাম। সে পেছন দিক থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো, ‘অভিনন্দন মিস মীরা। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা।’
আমি মনস্থির করেছি আজ রাতেই তনয়কে ফোন করবো। তাকে জানাবো “আমার পক্ষে সম্ভব নয়, ক্ষমা করবেন।” কিন্তু তনয়ের নাম্বার সহ বাবরিওয়ালার কোনো মেসেজ এলো না।
পরদিন সকালে বাবা নিচে ডাকলেন। গিয়ে দেখি বাবরি চুল আর অফিসের একজন কর্মকর্তা। আমাদের নতুন কোম্পানির যাত্রা আজ থেকেই শুরু হচ্ছে। বাবা অনেক উচ্ছ্বসিত। কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কাজও শুরু হবে খুব শিগগির। আপাতত প্ল্যানিং নিয়ে কাজ চলছে। বাবা এখনই দুজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে দিলেন। যাতে শুরু থেকেই একসঙ্গে পরিকল্পনা মাফিক কাজ করা যায়।
সবার সামনে বাবা বললেন, ‘নতুন কোম্পানির সিইওর দায়িত্ব মুনযিরকে দিলাম। আজ থেকে মুনযির আমার কোম্পানির সিইও।’
আমি হেসে বাবরি চুলকে বললাম, ‘কংগ্রাচুলেশনস। মিষ্টি এনে খাওয়ান।’
সে আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালো। আমি বুঝতে পারছি না এই দৃষ্টির মানে কী! তার চাহনি বড় রহস্যময়।
কিছুক্ষণ পর নিজের রুমে বসে আছি। এমন সময় দরজায় ঠকঠক শব্দ। আমি দরজা খুলে দেখি বাবরি চুলওয়ালা দাঁড়িয়ে। দুই হাতে দুইটা মিষ্টির প্যাকেট।
দুইটাই আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা আমার নতুন জবের জন্য। আর এটা আপনার নতুন জীবনের জন্য।’
আমি ঠোঁট বাঁকা করে হেসে দুইটা মিষ্টি তুলে নিতে যাচ্ছিলাম, সে প্যাকেট দুইটা টেবিলের ওপর রেখে বললো, ‘প্যাকেটের সবগুলোই আপনার জন্য। দুইটা বক্সই রেখে দিন।’
আমি বললাম, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ। রেখে যান। এনিওয়ে, তনয়ের নাম্বারটা তো দিলেন না।’
বাবরিচুল ধীরে ধীরে আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। তার দৃষ্টি এত গভীর যে আমি অপ্রস্তুত হয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললাম। চোখ মেলে দেখি, সে আরও কাছে! হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, আমি স্বাভাবিকভাবেই দু’পা পিছিয়ে গেলাম।
কিন্তু তাতেও দূরত্ব বাড়ল না। সে আবারও এক ধাপ এগিয়ে এলো। এবার আর পালানোর জায়গা রইল না। পিঠে দেয়ালের শক্ত স্পর্শ টের পেয়ে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার শরীর স্থির হলেও ভেতরের অস্থিরতা যেন মুহূর্তে মুহূর্তে বেড়ে যাচ্ছিল।
সে আমার চোখে চোখ রেখেই বললো, ‘আপনি তনয়কে ফোন দিবেন না।’
আমি অস্ফুটে বললাম, ‘কেন!’
‘আপনি তনয়ের হতে পারেন না। কারণ..’
‘কারণ?’
‘কারণ আপনি আমার। আই লাভ ইউ মীরা।’
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। যেন মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশের সবকিছু থেমে গেল। নিশ্বাস নিতে হবে এই কথাটাই ভুলে গেলাম আমি। জীবনের এতগুলো বছরের মধ্যে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য অনুভূতি!
ভেতরে ভেতরে এক অজানা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল। থরথর করে কেঁপে উঠল আমার ঠোঁট দুটো, অথচ কোনো শব্দ বের হলো না।
সে বললো, ‘আপনি তনয়ের হতে পারেন না কারণ আমি আপনাকে ডিজার্ভ করি। আপনি যদি কারো হতেই হয়, সেটা আমি।’
এমন সময় বাবার ডাক শোনা গেলো, ‘মুনযির..’
সে বললো, ‘নিচে যাচ্ছি। শুনুন মিস মীরা, আমি এখন আর সামান্য কর্মচারী নই। আমি একটা বড় কোম্পানির সিইও। আমার সমস্ত ইনসিকিউরিটি শেষ হয়ে গেছে। আপনি পাশে থাকলে আমি পুরো পৃথিবী জয় করতে পারবো। একদিন আমার নিজেরও এরকম কোম্পানি থাকবে মীরা। শুধু এইমুহুর্তে আপনি আমার থাকুন।’
সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আমি বোধহয় অবশ হয়ে পড়েছি। আমার হাত পা নাড়ানোর শক্তিটুকুও পাচ্ছি না। ধপ করে মেঝেতেই বসে পড়লাম আমি। কতক্ষণ এভাবে কেটে গেছে আমি জানিনা। হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দে আমি সংবিত ফিরে পেলাম।
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম বাবরি চুলওয়ালার মেসেজ। সে লিখেছে, ‘আমি তনয়কে জানিয়ে দিবো আপনি “না” বলে দিয়েছেন। ওকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। তনয়ের বদলে আপনি আমাকে নিয়ে ভাবুন। আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। আমি আপনাকে ভালো রাখতে পারবো মীরা। আপনি প্লিজ ভেবে দেখুন আমাকে কোনোভাবে ভালো লাগানো যায় কিনা?’
আমি ফোনটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। জানিনা কেন, এইমুহুর্তে আমার খুব হাসি পাচ্ছে।
চলবে..
(ইনশাআল্লাহ চার দিনের সফরে যাচ্ছি। পরবর্তী পর্ব পাবেন ৪/৫ দিন পর। দোয়ায় রাখবেন আমাকে। সুস্থভাবে ফিরে এসে ইনশাআল্লাহ আবার মীরাকে নিয়ে হাজির হবো।)
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৮
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৭
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুলওয়ালা গল্পের লিংক
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪