বাবরি চুলওয়ালা সূচনা পর্ব
মিশু মনি
০১
একদিন ভরদুপুরে আব্বু কোথা থেকে এক বাবরি চুলওয়ালা ছেলেকে ধরে এনে বললো, এখন থেকে ও আমাদের বাড়িতে থাকবে!
আমি যারপরনাই অবাক! বাইরের একটা ছেলেকে বাসায় রাখা, যার মাথায় আবার কোঁকড়ানো লম্বা লম্বা চুল! একে তো এরকম নীতি বিরোধী কাজ আব্বুর সঙ্গে যায় না, তার ওপর ওই ছেলের চাহনি উদভ্রান্তের মতো! যেগুলোর কোনোটাই আব্বু পছন্দ করেন না। আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন।
ছোটভাই রোহানকে ডেকে বললাম, ‘ক্যাম্নে কি?’
রোহান ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আই ডোন্ট নো।’
এরপর মাকে গিয়ে ধরলাম ‘ও মা, আব্বু কোথাকার এক ছেলেকে নিয়ে এসেছে।’
‘কি জানি!’
ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে না পেরে আমি এদিক সেদিক পায়চারি করতে লাগলাম। দিনটা অতিবাহিত হয়ে রাত নামলো। সারাদিনে বারবার দেখা হওয়া সত্ত্বেও বাবরিচুল আমার দিকে একবারও তাকায়নি! আশেপাশে যে কোনো মেয়ে আছে সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপই নাই। সে মাথা নিচু করে বসে আছে, নিশ্চিন্ত মনে।
অবশেষে দাদাভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও দাদু, আব্বু কি ঘরজামাই নিয়ে আসলো নাকি?’
দাদুভাই ভ্রু কুঁচকে চশমার ওপর দিয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করলেন। আমি আরও ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করলাম –
‘না মানে কে উনি? আমাদের বাসায় থাকবে মানে কি?’
‘ওর নাম মুনযির। এখন থেকে রোহানকে পড়াবে। কিছুদিন থাকবে আমাদের এখানে।’
‘ওহ আচ্ছা! কিছুদিন। আমি তো ভাবলাম চিরদিন..’
দাদুভাই চোখ কপালে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলে দিলেন, ‘মুনযির যখন বাসায় থাকবে, তুমি রুম থেকে বের হবা না। এটা তোমার বাবারই আদেশ। ওর আশেপাশে তোমাকে দেখলে তোমার বাবা খুব রেগে যাবে।’
আমি বাঁকা ঠোঁটে হেসে বললাম, ‘এরকম আজব দেখতে একটা ছেলের আশেপাশে আমি কেন ঘুরবো? আমার রুচি কি এতই খারাপ নাকি?’
‘তা আমি খেয়াল করিনি ভেবেছো? বারবার উঁকিঝুঁকি মারছো যেন ছেলেমানুষ কোনোদিন চোখে দেখো নি?’
আমার ইগোতে খুব লাগলো কথাটা। অপরিচিত মানুষ হিসেবে সামান্য কৌতুহল থাকাটা দোষের কিছু না। এভাবে বলার কি আছে?
বললাম, ‘আজ আমি যুবতী বলে এত আজেবাজে কথা শুনতে হয়। ছোট্ট শিশু হলে এত বড় কথা দাদু বলতে পারতে?’
‘তুমি আসলেই ছোট্ট শিশু নও। বড় হয়েছো। বড়দের মতো চিন্তা করো।’
‘ওকে। বড়দের মতো বলছি। মণ্ডল সাহেবের মাথায় হঠাৎ কিসের ভূত চাপলো? হুট করে একটা বাইরের লোককে বাসায় জায়গা দেয়া… নাহ, মিলাতে পারছি না।’
‘বাইরের লোক’কে বাইরের লোকের জায়গাতেই থাকতে দাও দাদুভাই। ওকে নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা করা লাগবে না। তোমার বাপের এসব পছন্দ না।’
আমি বললাম, ‘তুমি না আমার বন্ধু? এই তোমার বন্ধুত্ব? বন্ধুর সঙ্গে কেউ এত রুডলি কথা বলে? যাইহোক, এবার বলো তো, ছেলেটা কি এতিম? থাকার জায়গা টায়গা নেই?’
‘এতিম না। টাকা পয়সার কষ্টে আছে। তোমার বাপের খুব বড় উপকার করেছে শুনলাম। সেজন্য নিজে বাসায় টেনে এনেছে।’
‘কি সেই মহান উপকার?’
‘আবারও বলছি এত কৌতুহল থাকা ভালো না। সময় হলে জানতে পারবা। খবরদার, ওর আশেপাশে যাইবা না। তোমার বাপ রেগে গেলে কিন্তু খবর আছে।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। আজকে দাদুভাইয়ের মন মেজাজ ভালো না। মন ভালো থাকলে আমার সঙ্গে মশকরায় মেতে উঠতো। ঝামেলা কিছু একটা হয়েছে বৈ কী! আমিই জানিনা কেবল!
রাতে খাবার টেবিলে আব্বু বললো, ‘মুনযির শুধু রাতে আমাদের বাড়িতে ঘুমাবে। আর সারাদিন শোরুমে সময় দিবে। সকালের দিকে রোহানকে পড়াবে।’
আমি কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পাইছো কোথায়?’
আব্বু চোখ কপালে তুলে তাকালো। তারপর পুনরায় ভাত খেতে খেতে বললো, ‘কুড়িয়ে পাইছি। খুশি?’
‘না। কিভাবে খুশি হই? আজীবন আমার ব্যাপারে একশো একটা নিষেধাজ্ঞা। অথচ নিজেই এখন বাইরের লোকদেরকে বাড়ির ভেতর জায়গা দিচ্ছো। ব্যাপারটা তোমার সঙ্গে যায় না মিস্টার মণ্ডল সাহেব।’
আব্বু খাওয়া থামিয়ে কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি সবার মুখের দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিলাম। দাদুভাই বিরক্ত হয়েছে আমার প্রশ্নে। আশ্চর্য, আমি ভুল কি বললাম?
বাকি খাবারটুকু আমার গলা দিয়ে নামতে চাইলো না। বড় হওয়ার পর থেকে আমার প্রতি প্রত্যেকের আচরণ অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে। এসব মেনে নেয়া আমার জন্য কতটা কঠিন কেউ যদি বুঝতো!
সেই ছোটবেলা থেকেই আব্বুর সঙ্গে সম্পর্কটা আমার একটু বেশীই খুনসুটিময় ছিলো। আব্বুর ছেলে নেই। তিন মেয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট। সে কারণে আদর আর আহ্লাদ দুটোই আমার বেলায় জুটেছে বেশী। সাধারণত বাপ মেয়ের সম্পর্ক এমন হয় না। ছোটবেলা থেকে যতটা না মায়ের সঙ্গে ঘেঁষে বড় হয়েছি, তারচেয়ে বেশী সময় থেকেছি আব্বুর সঙ্গে। আব্বুর একটা কাপড়ের শোরুম আছে। ক্লাস এইটে ওঠার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন আব্বুর সঙ্গে আমি শোরুমে বসে থাকতাম। আর রাজ্যের গল্প করতাম।
ছোট্ট থেকেই আব্বু তার মনের সব কথা আমাকে খুলে বলতো। আর আমিও তাই। আম্মুর চাইতে আব্বুর সঙ্গ আমার বেশী ভালো লাগতো। অথচ এইটে ওঠার পর থেকে অদ্ভুতভাবে পালটে যেতে লাগলো সবকিছু। আব্বু আমার জন্য দোকানে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। বাড়ির ডিশ সংযোগ কেটে দেয়া হলো। টেলিভিশনটা নষ্ট হয়ে গেলে ওভাবেই ফেলে রাখলো, আজ পর্যন্ত ঠিক করা হয় নি। সবাই আমার ব্যাপারে একটু বেশীই কঠোর।
একদিন চিৎকার করে জানতে চাইলাম, এর কারণ কি? কেন আমি আর দোকানে যেতে পারবো না?
আব্বু শান্ত গলায় বললেন, ‘তুমি বড় হয়েছো।’
বড় হলেই কি সবকিছু এভাবে বদলে যায়? বড় হলে কি মেয়ের সঙ্গে বাবার আচরণও বদলে যায় নাকি? জানিনা আমি। শুধু জেনেছিলাম, আমি দেখতে অতিরিক্ত সুন্দরী। সে কারণে আমাকে নিয়ে সবার অনেক চিন্তা।
সুন্দরী হোক বা বড় হওয়া হোক, এর কোনোটাই আমি চাইনি।
তবে, আরেকটু বড় হতে হতে আমি বুঝতে শিখলাম, আব্বুর একটা অদ্ভুত রকমের ভয় পুরুষ মানুষদের নিয়ে। আমার বড় দুই বোনকে খুবই ছোটবেলায় উনি বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তারাও বেশ সুন্দরী ছিলো। আমার বেলায় সেটা পারেননি কারণ আমি অনেক শিশুসুলভ ছিলাম। আমাকে সবাই অসম্ভব স্নেহ করতো। বিয়ে দিলে বিপদে পড়তাম, এটা প্রায়ই শুনি আমি।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, এখনো আব্বু মাঝেমাঝে নিজে আমাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যায়। সবসময় কড়া নজর। আমার মোবাইল, আমার ল্যাপটপ, সবকিছুর অ্যাকসেস আব্বুর কাছে। উনি কোনো পুরুষ মানুষকে আমার সঙ্গে কথা বলতে দেন না। প্রেম তো দূরের কথা, কারো সঙ্গে সৌজন্যতাসূচক আলাপ করাও নিষেধ। আব্বুর ভয়, পাছে কোনো বিপদে পড়ে তার মেয়ের জীবনে হুমকি নেমে আসে! আব্বু চায়, সারাজীবন আমাকে রাজকন্যার আসনে বসিয়ে রাখতে।
আব্বুর কথামতো বেশ কয়েকদিন বাবরিচুলের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হলো না। ছেলেটাও এ ব্যাপারে বেশ সপ্রতিভ। রোহান বলেছে, ছেলেটা সারাক্ষণ দৃষ্টি নত করে রাখে। কখনো ভুলবশত আমার রুমের দরজার দিকে তাকায়নি অব্দি!
পরে অবশ্য জেনেছি, আব্বুর দশ লক্ষ টাকার একটা গ্যাঞ্জাম হয়েছিলো। ওই বিপদে ঢাল হয়ে এসেছিলো বাবরিচুল। আব্বুকে এই হেল্প করার কারণেই আব্বুর হৃদয়ে বিশাল বড় জায়গা করে নিয়েছে সে। তাই একেবারে বাড়িতেই আশ্রয় দিয়ে নিয়ে আসা।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরছি, হঠাৎ রাস্তায় ওনার সঙ্গে দেখা। আমি এক পলক তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। বাবরিচুলের চুলগুলো আগের চাইতে সাইজে ছোট করে ছাঁটা হয়েছে। নিশ্চিত এটা আব্বুর কাজ। আব্বু ছেলেদের বড় চুল পছন্দ করেন না। তবে চুলগুলো এখনো আগের মতোই কোঁকড়ানো।
কাছাকাছি আসতেই ছেলেটা আমাকে সালাম জানালো। আমি হাসি ধরে রাখতে পারলাম না। আমার কি সালাম পাওয়ার বয়স হয়েছে নাকি? ফিক করে হেসে ফেললাম। ছেলেটা খানিক হকচকিয়ে গেলো।
রাত্রিবেলা রোহান এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপু, তুমি আজকে স্যারকে দেখে হেসেছো কেন? স্যার জানতে চেয়েছে।’
‘কোন স্যার?’
‘মুনযির স্যার।’
‘হেহ, ওই বাবরিচুলকে আবার স্যার ডাকতে হয়?’
‘উনি খুব ভালো পড়ায়।’
‘তাই নাকি? ব্রিলিয়ান্ট?’
‘অনেক ব্রিলিয়ান্ট। শুধু তাই না, খুবই ফ্রেন্ডলি। আমার লাইফটাই উনি চেঞ্জ করে দিয়েছে আপু।’
‘মাত্র কয়দিনেই তোর লাইফে কি এমন চেঞ্জ আসলো?’
‘তুই বুঝবি না। হি ইজ আ জেম। ওনার আশেপাশে বসে থাকলেও ভালো লাগে।’
‘হইছে হইছে। যা, সর সামনে থেকে। আসছে জেমের প্রশংসা করতে। যে আমার চেহারা, নাম রাখছে পেয়ারা।’
‘আমার স্যারকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলবা না আপু।’
‘ওকে। বললাম না। যা ভাগ।’
‘আপু, স্যারের প্রশ্নের উত্তরটা দাও।’
‘কিসের উত্তর?’
‘হাসছো কেন?’
‘তোর স্যারকে বলিস, ওনার চেহারাটাই কমেডিয়ানদের মতো। দিলদার টাইপের। এজন্য ওনাকে দেখলে হাসি পায়। এবার সর আমার সামনে থেকে।’
রোহান চলে গেলো। আমি খানিকক্ষণ হাসলাম। পরক্ষণেই মনে পড়লো, যদি সত্যি সত্যি এটা গিয়ে ওনাকে বলে দেয়? ছি ছি, ছেলেটা ব্যাপক বিব্রত বোধ করবে তো!
চলবে..
বাবরি চুলওয়ালা
মিশু মনি
Share On:
TAGS: বাবরি চুলওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৭
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৩
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৬
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১০