১৮
সারাদিনের সমস্ত আয়োজন শেষে বাড়িটা যেন ঘুমিয়ে পড়লো। রাতের আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ, যেন আমার নতুন জীবনের সাক্ষী।
আমার হৃদয়টাও অবশেষে শান্ত হয়েছে, কিন্তু উত্তেজনা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি। আগামী দিনগুলো কিভাবে এগোবে কে জানে!
ফোনে টুং করে একটা মেসেজ আসলো। বাবরি চুলওয়ালার-
‘ঘুমিয়ে গেছেন মিস মীরা?’
মেসেজটা রিপ্লাই না করে ফোনটা রেখে দিলাম। আমার মনটা অসম্ভব রকমের শান্ত। জীবনটাকে হঠাৎ করেই খুব চমৎকার মনে হচ্ছে। খানিকটা ভয়, উত্তেজনা, মায়া আর এক রাশ ভালোলাগা আমাকে ঘিরে রেখেছে। এরকম সুন্দর মুহুর্ত কি আর কখনো জীবনে আসবে!
আবারও মেসেজের শব্দে আমার ভ্রম ভাংলো।
‘আজকের চাঁদটা একটু বেশিই সুন্দর। আপনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।’
আমি কী উত্তর দিবো ভেবে পেলাম না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিলাম। তার মেসেজটা পড়ে আরও একবার তাকাই চাঁদের দিকে। সত্যিই, এই জোৎস্না ভরা আকাশ আমাদের নতুন এক সম্পর্কের সাক্ষী হয়ে রইলো।
সকালবেলা নাস্তা সেরে আমার বোন, দুলাভাইরা যে যার বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। রাতে বড় আপা বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ‘সরি’ বলেছে আমাকে। আপা চলে যাওয়ার সময় আমিও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘সরি’। আপা হাসিমুখে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
সবাই বেরিয়ে যেতেই বাড়িটা সুনশান লাগে আমার। সবকিছু কেমন দ্রুত হয়ে গেলো! ভাবতে ভাবতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। হঠাৎ মনে হচ্ছে সবকিছু বোধহয় একটা স্বপ্নের অংশ ছিলো। আমি নিজের হাত তুলে চেয়ে দেখলাম, যেন সেই হাত ধরার অনুভূতি এখনও আমার আঙ্গুলে রয়ে গেছে!
.
একটা গোটা দিন তার সঙ্গে আমার দেখা নেই। না কোনো মেসেজ, না ফোনকল। ভেতরে ভেতরে কেমন ব্যকুল হয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছে সে আমার কতদিনের আপনজন! যেন যুগ যুগ ধরে আমরা একে অপরের সঙ্গে রোজ দেখা করি, রোজ গল্প করি!
রাত নামতে নামতে এই ব্যকুলতা আরও বাড়লো। মন পড়ে আছে অদৃশ্য অপেক্ষার অন্ধকারে। বারবার ভেবে ফেলি, কেন সে এখনো মেসেজ পাঠালো না?
মন খারাপ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। হাতগুলো অচেতনভাবে ফোনের দিকে চলে আসে, তারপর হঠাৎ নামিয়ে রাখি। না, কোনো মেসেজ নেই। এই শূন্যতা, এই নিঃশব্দ রাত, সব মিলিয়ে আমার অন্তরকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলছে।
হঠাৎ গেট খোলার আওয়াজ শুনে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। মনের কোণে কোথাও একটা তীব্র প্রত্যাশা, হয়তো সে এসেছে! কিন্তু না, এসেছে বাবা। আমার মন খারাপটা আরও খানিক রসদ পেয়ে তীব্র হলো।
এমনই দোলাচলে মুখ গোমড়া করে শুয়ে আছি। ঘড়িতে রাত এগারোটা। আমি কাৎ হয়ে শুয়ে থাকি, চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে বালিশে পড়লো। একবার না, বেশ কয়েকবার। কী অদ্ভুত, একটা মানুষের সঙ্গে কথা হয়নি বলে আমি কাঁদছি! কে হয় সে আমার?
.
হঠাৎ ফোনে মেসেজের শব্দ। কলিজাটা ধক করে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো তার নাম। মেসেজটা ওপেন করে দেখি তাতে লেখা, ‘একটু বাইরে আসতে পারবেন? বাসার সামনে অপেক্ষা করছি।’
আমার কী যে হলো জানিনা! ফোনটা হাতে নিয়ে ছুটে নিচে নেমে এলাম। যেন কারো অনুমতির পরোয়া করিনা, ঘড়িতে সময় কত দেখার প্রয়োজন নেই। পোশাক পালটে নিজেকে পরিপাটি করার তাগিদ নেই। মুহুর্তের মধ্যে দৌড়ে বাসার বাইরে চলে আসি।
তাকে দেখে আমার দেহ যেন প্রাণ ফিরে পায়। দূর থেকে এক পলক দেখেই আমি আরামে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এতক্ষণ ধরে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন অবশেষে নিভলো!
সে নিজেই এগিয়ে আসলো আমার দিকে। জায়গাটায় আলো নেই খুব একটা। দূর হতে একটা আলো এসে পড়েছে রাস্তার ওপর। সে ধীরপায়ে সামনে এসে স্মিত হেসে বললো, ‘মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে?’
‘গরম কখন হলো?’
‘কাল তো গরম রেখে গিয়েছিলাম।’
‘একদিন পরে এসে জিজ্ঞেস করছেন সেটা?’
‘সারাদিন এলাকার বাইরে ছিলাম। ব্যস্ততা ছিলো কাজের। এত রাতে বাইরে আসতে বললাম যে, কিছু মনে করেননি তো?’
‘না।’
‘আংকেল আন্টি দেখেছে?’
‘জানিনা। কেন আসতে বলেছেন?’
সে মাথা নিচু করে রাখলো কয়েক সেকেন্ড। বোধহয় উত্তরটা ঠিকঠাক সাজানো নেই। মাথা তুলে বললো, ‘দেখতে ইচ্ছে করছিলো আপনাকে।’
স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হৃদয়টা দ্রুত ধুকধুক করছে, বুকে মিষ্টি ব্যথা। মনে হলো, এই ছোট্ট কথাটাই আমার পুরো দিন, পুরো রাত, আমার সব ব্যাকুলতা, সব অস্থিরতা এক মুহূর্তে পূর্ণ করে দিয়েছে।
আমি অনুভূতি আড়াল করে সাধারণ গলায় বললাম, ‘বাসায় ঢুকলেই পারতেন।’
‘আংকেল আন্টির সামনে দিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়াটা কঠিন হতো।’
‘আমাকে একটা মেসেজ দিলেই ছাদে যেতাম বা নিচে আসতাম। কঠিন হওয়ার কিছু নেই।’
‘তাই?’
‘হুম। আমি এখন যাই?’
‘আরেকটু থাকুন..’
তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। আমার শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলো যেন। এই নির্জন রাতে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলছি, এমনটা আমার জীবনে কখনো হওয়ার কথাই ছিলো না। আমারও ইচ্ছে করছে তার সঙ্গে বসে গল্প করি। কোনো কথা না হোক, অন্তত চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে থাকুক সে। আড়াল হলেই যেন হৃদয়টা ছিঁড়ে টুকরো হয়ে যাবে!
এভাবেই চুপচাপ কতক্ষণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলাম, জানা নেই। একসময় আমি বললাম, যাই এখন?
‘আচ্ছা।’
‘যাচ্ছি।’
‘সরি, এত রাতে বাইরে আনার জন্য।’
‘ইটস ওকে।’
আমি আর পিছন ফিরে তাকাই নি একটিবারও। যেমন দৌড়ে বের হয়েছিলাম, তেমনই দ্রুত পদে বাসায় ফিরে আসি। বাবা মাকে নিজের রুমে দেখে স্বস্তি পাই। কিন্তু বুকের ভেতর একটা হৃদপিন্ড বলে কিছু আছে, সে এত জোরে দৌড়াচ্ছে কেন!
ভেবেছিলাম এক পলক দেখা হলেই পরম স্বস্তিতে ঘুম চলে আসবে। কিন্তু না, তাকে দেখে অস্থিরতাটা আরও তীব্র হলো। এখন মন খারাপ হচ্ছে এই ভেবে যে, কেন চলে গেলো সে! যদি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা জীবন পার করে দিতে পারতাম…
ফোনটা বেজে উঠলো। তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে রাখি। ওপাশ থেকে বাবরি চুলওয়ালার গলা শোনা গেলো, ‘হ্যালো মীরা..’
‘জি। বলুন?’
‘ঘুমাননি?’
‘না।’
‘রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।’
‘করেনি কখনো।’
‘রাত জাগার অভ্যাস আছে আপনার?’
‘হুম। মাঝেমাঝে জেগে থাকি।’
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আপনার সম্পর্কে কতকিছু জানার বাকি মিস মীরা….!’
আমি উত্তর দিলাম, ‘তা তো আমারও। আমি তো আপনার সম্বন্ধে কিছুই জানিনা। একদম কিচ্ছু না।’
‘এমন অজানা, অচেনা একটা ছেলেকে বিয়ে করতে কেমন লাগছে আপনার?’
মুখে কোনো উত্তর করলাম না। তবে মনেমনে বললাম, ‘অচেনা কই! শুধু কি তথ্য জানলেই মানুষ চেনা হয়ে যায়? আপনাকে তো আমার ভীষণ চেনা মনে হয়। এ জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষ। আপনি আশেপাশে থাকলেই মনে হয় সবকিছু ঠিক আছে। দূরে গেলেই শুন্যতায় মুষড়ে যাই। এটাকে কি কেউ পর বলে?’
এতকিছু মুখ ফুটে বলতে পারিনি। জানিনা কেন! তাকে নিয়ে বুকে জমিয়ে রাখা আবেগগুলোর ছিটেফোঁটাও আমি তাকে বুঝতে দিতে চাইনা। এর কারণ কি? তার হৃদয়ে আমার জন্য ব্যকুলতা তৈরি করা? হয়তো বা!
আমি তাকে আরও ভড়কে দিতে বললাম, ‘অচেনা একটা ছেলেকে বিয়ে করছি বলে আমার মাথায় রাজ্যের টেনশন। আপনি কি বোঝেন না?’
‘হুম, বুঝি। আস্তে আস্তে চিনিয়ে দিবো মীরা।’
‘আপনি যতবার মীরা শব্দটা উচ্চারণ করেন, ততবার…’
‘ততবার?’
‘কিছু না।’
‘বলুন?’
‘না, তেমন কিছু না। মনে হয় আমি আপনার অনেক পরিচিত।’
এই কথাটাও আমার মনের কথা নয়। মুখের কথা। মনের কথা হলো, যতবার আপনি আমাকে মীরা বলে সম্বোধন করেন, আমার ভেতর তুমুল উথাল পাথাল করে ওঠে। কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়! এই কথাটাও আমি মুখে বলতে পারবো না..
‘মীরা, আপনি আমার ভীষণ চেনা।’
‘কীভাবে? কতখানি?’
‘কীভাবে তা জানিনা। কিন্তু সবসময়ই মনে হয় আপনার সঙ্গেই আমার বিয়ে হবার কথা। আপনি ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ আসতেই পারেনা।’
আমি স্তব্ধ হয়ে শুনলাম। মনের ভেতর উথলে ওঠা এক রাজ্য সমান প্রশ্নকে সামলে নিলাম আমি।
সে বললো, ‘মনে আছে মীরা, ওইযে দাদুবাড়িতে দাদীর অন্ধকার ঘরে যেদিন আমাদের প্রথম আলাপ হলো?’
‘হ্যাঁ। আপনি অন্ধকারে বসে ছিলেন। আমি জানতাম না আপনি সেখানে ছিলেন।’
সে বললো, ‘সেদিন আপনি রুমে ঢোকার সময়ই টের পেয়েছিলাম। সাড়াশব্দ করিনি। আমি চেয়েছিলাম আপনি রুমে থাকুন। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই আপনার উপস্থিতি আমার ভালো লাগছিলো। এটার কি কোনো ব্যাখ্যা আছে?’
‘আপনি তো লোকটা সুবিধার না।’
‘না না প্লিজ আমাকে খারাপ ভাববেন না। আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলোনা। আমি শুধু আপনার উপস্থিতিতে আনন্দ পাচ্ছিলাম। আমার ভালো লাগছিলো। অনেক্ষণ পর যখন ফোনের আলো জ্বালালাম, ভান করলাম যে আপনাকে আমি দেখতে পাইনি। এরপর আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা হলো…’
আমি সেই দিনের স্মৃতিতে ঢুকে পড়লাম। আহা সেই রাত! সেই দাদুবাড়ি! কত শত আবেগময় স্মৃতি জমে আছে সেখানে। বাবরি চুলওয়ালার মনেও সেই একই অনুভূতি দোল দিয়ে গেছে, জানা ছিলোনা আমার!
বললাম, ‘সেদিনই কি প্রেমে পড়েছিলেন আমার?’
‘প্রেমে পড়েছি কিনা জানিনা। আপনাকে কখনো সেই চোখে দেখিনি। শুধু জানতাম আপনি আমার বিশেষ কেউ। বিয়েবাড়িতে আপনি আশেপাশে থাকলেই আমার ভালো লাগতো। কিন্তু কখনো আপনাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাধ্য কল্পনাও করিনি।’
আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘তাহলে তো বলা যায় আমাকে আপনার ভালোই লাগতো। সেটা আপনি যেই চোখেই দেখুন না কেন। যখন আপনি জানলেন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তখন খুশি হননি কেন?’
সে বিশাল বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘এটা তো আকাশ কুসুম কল্পনার মতো। আমার আছেটা কি মীরা? বাবা মা নেই, থাকার মতো জায়গা নেই। ক্যারিয়ার নেই, আয় রোজগার নেই। এলোমেলো ময়লা জামাকাপড় পরে থাকি। লাইফ নিয়ে প্রচণ্ড হতাশ একটা ছেলে আমি। আমি কোন সাহসে বা কিসের ভাবনায় আপনার মতো একটা রাজকন্যাকে বিয়ের সাহস করবো বলুন? এটা কি কোনোভাবে যায়? হয়তো দুনিয়ার আর দশটা ছেলে এতে খুশিই হতো। আমি তো সবার মতো নই। আমার বিবেক আমাকে খুশি হতে দেয় নি। নিজেকে মোটেও আপনার যোগ্য ভাবতে পারছিলাম না। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছিলো। এত হতাশা, এত ট্রমা, মেন্টালি বিধ্বস্ত একটা ছেলের জীবনে আপনার মতো ফুলকে আমি কোথায় রাখতাম?’
আমি চট করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কোথায় রাখবেন?’
‘এখন তো একটু সাহস হয়েছে। আশাকরি ফুলকে ফুলের মতোই সাজিয়ে রাখতে পারবো। বাগানটা হয়তো ছোট হবে, তবুও ফুলের একটা বাগান তো হবে। আগে তো এই বাগানটুকুও করার মতো অবস্থা ছিলোনা।’
‘ওহ আচ্ছা! তা, এতদিন পরে কেন মনে হয়েছে মীরাকে বিয়ে করা যায়? বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলা সেই কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। আপনার সঙ্গে আমার মাসখানেক দেখাও হয়নি। আপনি হুট করে একদিন এসে কেনই বা বললেন মীরা আমাকে বিয়ে করুন?’
সে শব্দ করে হাসলো। তার হাসির শব্দে তলিয়ে গেলো আমার জানার আকাঙ্খা। মুগ্ধ হয়ে তার হাসির শব্দটা আমি মস্তিষ্কে সেইভ করে রাখলাম। যদি মানুষের মাথায় সত্যিই রেকর্ড করার সিস্টেম চালু থাকতো, সারা রাত বারবার তার এই হাসির শব্দটাই আমি বাজিয়ে বাজিয়ে শুনতাম।
বাবরি চুলওয়ালা বললো, ‘এটা শুক্রবার রাতে বলবো।’
‘কেন? কি এমন গোপন কথা যেটা শুক্রবার রাতে বলতে হবে?’
‘ওই রাতটা আমাদের জন্য স্পেশাল একটা রাত। কিছু কথা তো ওই রাতের জন্য বাকি রাখতে হবে তাইনা? নয়তো সেদিন বলবোটা কি?’
আমি লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইলাম। পরক্ষণেই বললাম, ‘আচ্ছা, শুক্রবার রাতে কি আমাদেরকে আলাদা কথা বলতে দিবে? নাকি ফোনে কথা বলতে হবে?’
‘মানে?’
‘মানে, বলছি যে শুক্রবার রাতে আপনি কিভাবে কথা বলবেন?’
‘কিভাবে আবার? আপনার মুখের সামনে বসে বসে, আপনার দিকে চেয়ে চেয়ে বলবো।’
‘এটাই জিজ্ঞেস করছি। এটা কিভাবে সম্ভব হবে?’
সে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো, ‘মীরা, কেউ কি আপনাকে বলেছে যে বিয়ে পড়ানোর পর মুনযিরকে বাসা থেকে বের করে দিবো?’
‘না তো।’
‘তাহলে?’
‘আপনি তো আমাকে নিয়ে যাবেন না। আপনিই তো বলেছেন বিয়ের পরে আমাকে বাবার বাসাতেই থাকতে হবে?’
‘হ্যাঁ। তো?’
‘তো আমি যদি বাবার বাসায় থাকি, আর আপনি আপনার বাসায় বা অফিসে। কিভাবে আমাদের কথা হবে সামনাসামনি?’
আমার প্রশ্ন শুনে সে বোধহয় খুবই মজা পেলো। এমন উচ্চস্বরে হাসি শুরু করে দিলো যে ফোনটা কানে ধরে রাখতে পারলাম না। কয়েক ইঞ্চি দূরে সরিয়ে তার হাসি শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। অতঃপর তিনি হাসি সমাপ্ত করলেন!
এরপর বললো, ‘মীরা, ওইদিন আমাদের বিয়ের রাত। আমাদের বাসর রাত। সামনাসামনি কথা বলতে দিবেনা মানে?’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, শুক্রবার রাতে আমাদের বাসর রাত? আমি তো ভেবেছিলাম এটা কয়েক মাস পরে।
‘ধুর বোকা। আমি শুক্রবার বিয়ে করে কয়েক মাস অপেক্ষা করবো বাসর রাতের জন্য?’
বলেই আবারও উচ্চস্বরে হাসা আরম্ভ করে দিলো। আমি খানিকটা বিব্রত হয়ে বললাম, ‘এটা তো আমাকে কেউ বলে নি। আমি শুধু জানি বিয়ে হবে। এতটুকুই। এরপর কি হবে তা তো আমার জানার কথা নয়। যেহেতু কয়েক মাস পরে আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন…’
সে হাসতে হাসতে বললো, ‘উফফ মীরা, তুমি একটা পাগলী। ছোটখাটো না, বড়সড় ধরনের পাগলী। তুমি একটাবার ভাবলে না, আমি বিয়ে করে কিভাবে সুড়সুড় করে চলে আসবো? তাও তোমাকে ওখানে একা ফেলে? তোমাকে দূরে রেখে আমি একটা দিন পার করতে পারছি না মীরা, আমি সদ্য বিয়ে করা বউকে কিভাবে দূরে সরিয়ে রাখবো?’
লজ্জায়, আনন্দে, ভালোলাগায়, সুখের আবেশে আমি যেন পাগল প্রায় হয়ে যাচ্ছি! শুক্রবার থেকে এই মানুষটা আমার, একদম আমার হয়ে যাবে। আমি কল্পনাতেও ভাবিনি সেই রাতে আমরা মুখোমুখি বসে গল্প করতে পারবো! একটিবারের জন্যও আমার মনে এই কথাটা ভেসে আসেনি। শুক্রবার রাতে আমাদেরকে নিয়ে আর কেউই মাথা ঘামাবে না। আমরা দুজন নিজেদের মতো করে কথা বলবো, হাসবো, খুনসুটি করবো!
ভাবতে ভাবতেই আমার হৃদয় ভরে গেলো সীমাহীন সুখে। নিশ্চিতভাবে, ওই রাতে আমি এক পলক ঘুমাবো না। নিষ্পলক চোখে শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকবো। সে আমাকে যত নির্লজ্জ ভাবুক, তবুও তাকিয়ে থাকবো। যেই মানুষটা সবসময় আশেপাশে থাকুক চাইতাম আমি, সে ওই রাতটা সারা রাত আমার পাশে বসে থাকবে!
‘মীরা?’
‘হু।’
‘তোমাকে এখন থেকে তুমি বলি?’
‘আচ্ছা।’
‘শুনতে খারাপ লাগছে?’
‘না। অসুবিধা নেই।’
লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছি আমি। তার মুখে ‘তুমি’ শব্দটা শুনতে মিষ্টি লাগছে। অসম্ভব মিষ্টি। সে যদি দিনে একবার আমাকে ডাকে, ‘তুমি’ বলে। তাতেই আমার দিনটা সুন্দর হয়ে যাবে!
বাবরি চুলওয়ালা বললো, ‘তাহলে ভেবেছিলে আমি কবুল বলার পর মোনাজাত শেষ করে উঠে অফিসে চলে আসবো?’
আমি লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, ‘এই আলাপ বাদ দিন প্লিজ।’
‘কেন? তোমাকে রেখে আসলে তুমি মন খারাপ করবে না?’
‘প্লিজ… প্লিজ এটা বাদ থাকুক।’
‘ওওওওকেএএএ।’
সে আবারও হেসে উঠলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার হাসির শব্দ শুনলাম। সে এবার বললো, ‘মীরা, সিরিয়াস কুয়েশ্চন। আমরা শুক্রবার রাতে কোথায় থাকবো?’
‘আমি জানিনা। এই টপিকে আমি আর একটাও শব্দ করবো না।’
‘এবার সিরিয়াস আলাপ মীরা। আমার তো বাড়ি নাই, ঘর নাই। তোমাকে কোথায় এনে রাখবো? একটা বাসা ভাড়া নিয়ে নিবো?’
‘না। আগে আপনি নিজের সবকিছু গুছিয়ে নিন। আমি এখন কোথাও যাবো না। এখানেই থাকবো।’
‘তোমাদের বাড়িতে আমরা কোন রুমে ঘুমাবো মীরা? দোতলায় তোমার রুমে নাকি নীচতলায় আমাকে থাকতে দেয়া আমার রুমে?’
আমি লজ্জা পেয়ে ফোন নামিয়ে রাখলাম। সম্মুখে থাকা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে দেখি আমার মুখে হাসির বন্যা। চাইলেও মুখ বন্ধ রাখতে পারছি না। অনবরত হাসছি।
সে কল কেটে দিয়ে আবারও কল দিলো। আমি ফোনটা ইচ্ছে করেই দূরে সরিয়ে রাখলাম। রিসিভ করলাম না। সে পরপর কয়েকবার ফোন দিলো। আমি দুষ্টুমির ছলে ধরলাম না কল। রেখে দিলাম সাইলেন্ট মুডে। বালিশে মুখ গুজে আপনমনে হাসছি আর ভাবছি, এত খুশি লাগছে কেন আমার! আনন্দে বোধহয় পাগল হয়ে যাবো আমি।
মিনিট দশেক পরে বাবা আমার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। আমি বাবার রুমে এসে দেখি খাটের এক কোণায় বাবরি চুল বসে আছে! চমকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বাবাকে বললাম, ‘হ্যাঁ আব্বু বলো।’
‘দ্যাখ, মুনযির পাগলটার কাণ্ড দ্যাখ। এত রাতে হাতে করে টাকা নিয়ে এসেছে। তোর শপিংয়ের জন্য।’
আমি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালাম। শান্তশিষ্ট লক্ষী ছেলের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কে বলবে একটু আগেই এই ছেলেটা আমাকে রাজ্যের দুষ্টু দুষ্টু কথা বলছিলো!
বাবা বললেন, ‘মীরার মা, টাকা গুলো মীরাকে একটু দেখাও। কেনাকাটা যা করার তোমরাই তো করবা। দেখো কোনদিন যাওয়া যায়। তাড়াহুড়ার দরকার নাই।’
মা আমার হাতে এক বান্ডিল টাকা দিলেন। আমি টাকা গুলো আবার মাকে ফেরত দিয়ে দিলাম।
বাবরি চুলওয়ালা বললো, ‘আংকেল আপনারা রেস্ট নিন। আমি তাহলে আসি। মীরা একটু নিচে আসবেন, এক মিনিট?’
আমি আড়চোখে একবার বাবার দিকে, একবার মায়ের দিকে তাকাই। বাবা বললেন, ‘আচ্ছা যাও। কাল সকালে দেখা হবে। মীরা, গেট বন্ধ করে দিয়ে আয়।’
আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। সেও বের হয়ে এলো আমার সঙ্গে। নিচতলার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। সে আমার রুমের দিকে ইশারা করে বললো, ‘এই রুমে নাকি নিচে?’
‘চুপ।’
নিচে এসে দূরত্ব বজায় রেখে আলাদা আলাদা সোফায় বসলাম। বললাম, ‘বাসায় আসবেন বললেন না যে?’
‘আসতে তো চাইনি। আপনিই তো নিয়ে আসলেন।’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘আপনি না টাকা দিতে এসেছেন!’
‘ওটা তো অজুহাত। টাকাটা আগামীকাল দিবো ভেবেছিলাম। আপনি ফোন ধরছেন না দেখে ভাবলাম হয়তো রাগ করেছেন। এজন্য এখনই আসা।’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘পাগল আপনি! এত রাতে এভাবে কেউ আসে?’
‘রাত তো বেশী হয়নি। এখন বলুন, ফোন ধরছিলেন না কেন?’
‘এমনি।’
‘রাগ করেছেন?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘এটা বলার জন্য কেউ এত রাতে বাসায় আসে? এরকম আর করবেন না। এখন যান।’
‘এক্ষুনি?’
‘হুম।’
‘আরেকটু বসি..’
‘না স্যার। অলরেডি আমার মাথাটা গরম করে দিয়েছেন। দেরি করে গেট বন্ধ করলে আব্বু আম্মু কী না কী ভাবে!’
সে উঠে দাঁড়ালো। গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘শপিংয়ের টাকাটা কোথায় পেয়েছি জানতে চাইবেন না?’
‘না।’
‘ওটা আমার জমানো টাকা। ভাবিকে ধার দিয়েছিলাম। ভাবি ফেরত দিয়েছে।’
‘ওহ।’
‘খুব সামান্য টাকা। কষ্ট করে ম্যানেজ করে নিন।’
‘আমার এতটুকুও প্রত্যাশা ছিলো না। কামিজ পরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারতাম।’
সে হেসে ফেললো। গেটের কাছে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। কেউই কোনো কথা বলছি না। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। বাইরে যতই বলি, এখন যান। ভেতরে ভেতরে চাই, সে আরও খানিক্ষণ থাকুক।
কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আমি গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। খানিকটা দূরে গিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো আমাকে। আমার ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, আমাদের বোধহয় বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পর এভাবেই সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে! আমি মুচকি হাসলাম।
সে দূরে গিয়ে আবারও দৌড়ে কাছে এসে বললো, ‘ফোন দিলে রিসিভ করবেন।’
‘আচ্ছা করবো। এখন যান।’
‘আজকে যাচ্ছি। আর কয়েকটা দিন। তারপর ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেও যাবো না।’
আমি হেসে ফেললাম। সে কয়েক পা এগোয়, আবার থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকায়। আবারও কয়েক পা এগোয়, আবার থমকে দাঁড়ায়। এভাবে কতটা সময় বয়ে গেলো। আমি মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললাম, এবার যান।
আলো ছায়ার মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে আড়াল হয়ে গেলো সে। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবলাম, জীবন আমাকে এত বেশী করে দিচ্ছে কেন! এতকিছু তো আমি চাইনি। এত প্রেম, এত মায়া…
চলবে..
Share On:
TAGS: বাবরি চুলওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১০
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৩
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৬
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ১৭
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৫