পারসোনাল_নোটিফিকেশন।
পর্ব- চার (০৪)
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম,
❝ মা আমি মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে ভাবির ঘরে ঢোকার পরে ঘরের দরজা বন্ধ করেছিলাম। ভয় হচ্ছিল যে, তুমি বাবা ভাইয়া কেউ যদি দেখে ফেলো বা হঠাৎ চলে আসো তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাই দরজা বন্ধ করে ভাবির বিছানার কাছে গিয়ে তাকে ডেকেছিলাম। তুমি তো বাবার সাথে অন্য ঘরে ঘুমাও৷ তাহলে বন্ধ দরজা দিয়ে তুমি ঘরের ভেতর ঢুকলে কীভাবে? নাকি তুমি আমার আগে থেকেই ভাবির ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলে? ❞
আমার কথা শুনে মায়ের চোখমুখ শুকিয়ে যায়। কি উত্তর দেবেন খুঁজে পান না৷ আমি বললাম,
“ ভাবিকে কি তুমি খুন করেছো মা? ”
মায়ের মুখটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তিনি আমার এমন প্রশ্নের ভয়ই পাচ্ছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি ঘরে প্রবেশের সময় দরজা বন্ধ করেছি। যেহেতু ভাবি একটা আপত্তিকর প্যাকেট আমার কাছে রেখেছিলেন তাই খানিকটা সতর্কতা হিসেবে দরজা বন্ধ করি। সুতরাং শুধু মা কেন, ঘরের মধ্যে আগে থেকে না থাকলে কেউই সেখানে আসার কথা নয়।
কিন্তু ভাবির বিছানার কাছে দাঁড়ানো অবস্থায় পিছন থেকে মা যখন ডাক দেন তখন দরজা খোলা ছিল। এবং মা দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। যার একটাই অর্থ, মা ঘরের মধ্যে আগেই ছিল। আমি ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে ডাকার সময় সাবধানে তিনি দরজা খুলে এমন একটা ভাব করেছেন যেন বোঝা যায় তিনি বাহির থেকে এসেছেন।
মা’কে চুপ থাকতে দেখে আমি আবার বললাম,
“ এখন চুপ করে থাকার সময় নয় মা৷ তুমি আর ভাইয়া মিলে আমাকেই বারবার দোষারোপ করছো। ফাঁসাতে চাইছো৷ কিন্তু কেন? ”
আমার প্রশ্নের জবাব মা দিতে পারলেন না৷ কিছু বলার আগেই সেখানে দুর্জয়কে কোলে নিয়ে মেজো ভাই চলে আসেন। আমি আর প্রশ্ন করি না। দুর্জয়কে কোলে নিয়ে মা সেখান থেকে চলে গেলেন।
ভাবিকে বিছানা থেকে নামাতে চাইলে ভাবির মামা সবাইকে নিষেধ করেন। মামার নাম, তাহের শেখ। মামা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ কেউ লাশে হাত দেবেন না। আমি থানায় খবর দিয়েছি। যেকোনো সময় পুলিশ চলে আসবে৷ লাশের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে হার্ট অ্যাটাক করে নাই। তাকে ইচ্ছে করে মারা হয়েছে, মানে কেউ নিশ্চয়ই তাকে খুন করেছে। ”
তাহের মামার কথা শুনে বাবা লজ্জা পেলেন। লজ্জিত আচরণে বাবা বললেন,
“ বেয়াই এইটা কি বলেন? আপনার ভাগ্নি কি আমার কাছে কম? আমার মেয়ে নেই, আমি তাকে নিজের মেয়ে বানিয়ে রেখেছিলাম। ”
মামা ইমোশনালে কাবু হলেন না। বরং তিনি বাবাকে আরেকটু খোঁচা দিয়ে বলেন, আপনি যদি মেয়ের মতো দেখেন তাহলে আমার আগে আপনার বিচার দাবি করা দরকার। মামার আগে তো বাবার টান অনেক বেশি হয়।
পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত আমি ড্রইং রুমে সোফায় বসে ছিলাম। চারিদিকে তখন ফজরের আজান শুরু হয়েছে। ঘটনার বিস্তারিত জানতে চায় পুলিশ। আমি যা জানি সবকিছু বললাম। মা-বাবা ভাইয়া ডাক্তার সবাইকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞেস করা হয়।
তারপর পুলিশ লাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করে। পর্যবেক্ষণ শেষে লাশ নিয়ে যাবার প্রস্তুতি শুরু হয়। আর এসআই বিমল মিত্র স্যার আমার কাছে এসে আমার রুমে যান।
আমাকে বলেন, লজ্জার কিছু নাই। যতটুকু জিজ্ঞেস করবো ততটুকু উত্তর দেবে। তোমার ভাবির সঙ্গে কি তোমার কোনো অবৈধ সম্পর্ক ছিল?
আমি বেশ বিরক্ত হয়ে বললাম, আজেবাজে কথা বলবেন না স্যার। অবৈধ সম্পর্ক কিসের? আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম। তিনিও সবসময় আমার যাবতীয় কাজকর্ম করে দিতেন। তারমানে এই নয় যে খারাপ সম্পর্ক থাকবে।
বিমল মিত্র স্যার বলেন, তোমার মা ভাইয়া সবাই বলছে সম্পর্ক ছিল। গভীর সম্পর্ক। এতটাই গভীর যে লুকিয়ে লুকিয়ে প্যাকেট নিয়ে আসো৷ আবার কাজ শেষে প্যাকেটের কোনো অস্তিত্ব নাই। কি করছো সেই প্যাকেট?
বুঝলাম ভাইয়া মা তারা সবকিছুই বলে দিয়েছেন। ভাইয়া আমার হাতে প্যাকেট দেখেছিলেন। কেন যে তখন সেটা খুলতে গেলাম। লজ্জার সীমা রইল না। আমি তখন সবই সত্যি বলে দিলাম। কিন্তু স্যারের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিলো তিনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন নাই।
তিনি বলেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে মৃত্যুর আগে শারীরিক কিছু ঘটছে কিনা। আপনি আপাতত বাড়িতেই থাকবেন। শুনেছি খুলনায় মেসে থেকে পড়াশোনা করেন। কিন্তু আমরা না বলা পর্যন্ত গ্রাম থেকে কোথাও যাবেন না।
পুলিশ চলে গেল৷ সকালের আলো ফুটতেই বাড়ির আশেপাশের সবাই এসে জড়ো হতে লাগলেন। মা ও ভাইয়াকে সারাক্ষণ একসঙ্গে পরামর্শ করতে দেখলাম। সময় পেলেই তারা একজায়গায় গিয়ে কি সব নিয়ে যেন আলোচনা করে।
পোস্টমর্টেম শেষে ভাবিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয় বিকাল পাঁচটায়। তার আগেই বড়ো ভাইয়ার কবরের পাশেই ভাবির জন্য কবর খোঁড়া হয়। কথা ছিল লাশ নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত গোসল করিয়ে জানাজা পড়ে দাফন করা হবে।
শীতের মৌসুমে সূর্য তাড়াতাড়ি বিদায় নেয়। সাড়ে পাঁচটার দিকে মাগরিবের আজান হলো। নামাজের আগে ভাবিকে দাফ করা সম্ভব হলো না। মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে সবাই জানাজায় আসে। এরপর জানাজা পড়ে কবরে রেখে সবকিছু ঠিকঠাক করতে রাত আটটা বেজে যায়।
ভাবিকে কবরে রেখে ঘরের সামনে এসে দেখি পুলিশ বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। এসআই বিমল মিত্র স্যার আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলেন,
“ আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। জরুরি কথা আছে। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। ”
আমার সঙ্গে জরুরি কথা। আমি এমনকিছু জানি না যেটা পুলিশের কাছে জরুরি মনে হবে। টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধুয়ে সামনে আসি৷ উঠোনে অনেক চেয়ার পেতে রাখা ছিল। সারাদিন নানা আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা ছিল বলে বাজার থেকে বাবা কিছু চেয়ার আনিয়েছিলেন। সেই চেয়ারেই আমরা বসলাম।
বিমল মিত্র স্যার বললেন, দেখুন বর্তমান যুগে সবকিছু খুবই আপডেট। হাতের মুঠোয় থাকলে কোনোকিছুই গোপন করা যায় না। আপনারা যদি অন্যায় করেন সেটা স্বীকার করবেন তাহলে শাস্তি কমে যাবে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি যে বাধ্যতামূলক ভাবে জবাব দিতে হবে। তবুও আমি বললাম, আমি আপনার কাছে পুরোপুরি সত্যি কথা বলেছি।
বিমল মিত্র স্যার তখন বলেন, মিথ্যা বলেছেন। তখন আপনি বলেছিলেন ক-ন-ড-ম এর প্যাকেট আপনার ভাবি দিয়েছে। কিন্তু আমরা আপনাদের বাজারের দোকানে গিয়ে খবর নিয়েছি, ওগুলো আপনি নিজেই কিনেছেন।
সত্যি সত্যি যদি তাই হয়, তবে মিথ্যা বললেন কেন?
এই কথা আমার হজম করার মতো নয়। ঘটনার দিন আমি বাড়ি ফেরার সময় ফার্মেসীতে গিয়েছিলাম কিন্তু এসব কেনার জন্য নয়।
আমাদের কাছে সাক্ষী আছে। সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ লোডশেডিং ছিল বলে সিসিটিভি ফুটেজ কালেক্ট করতে পারিনি। নাহলে তো এখনই প্রমাণ দিতাম। শান্ত কণ্ঠে জবাব দেন বিমল মিত্র।
আমি বললাম, স্যার আমার কথা বিশ্বাস করুন। আমি সত্যি এগুলো কিনে আনিনি।
“ তাহলে গভীর রাতে ভাবির সঙ্গে কি ছিল? তোমার মা তো তোমাকে হাতেনাতে ধরেছে তাই না? ”
ভাবি জরুরি কথা বলবে বলছিল। নাহলে আমি কখনো ভাবির ঘরে যেতাম না। তাছাড়া সন্দেহ হচ্ছিল। কল দিয়ে পাইনি।
এসআই বিমল মিত্র স্যার বিরক্ত হয়ে যান। আমি তাকে বলি, স্যার আমার আগে ভাবির ঘরে আরেকজন ছিলেন। আমার মা।
মায়ের রাতে বাতি বন্ধ করে ব্যাপারটা স্যারকে সব ভালো করে বললাম। সবটা শুনে স্যার মা’কে ডেকে নিয়ে আসেন। মা এসে দাঁড়ায়। রাতের কাহিনি নিয়ে স্যার মাকে প্রশ্ন শুরু করে। মায়ের আমতাআমতা ভাবভঙ্গি দেখে স্যার সন্দেহ করে।
রাগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, আপনি আমাদের সঙ্গে থানায় চলুন। আপনার মধ্যে ঝামেলা আছে। নাহলে আপনার ছোট ছেলে যাবার আগে আপনি সেখানে কি করছিলেন৷
মা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি মাকে সাহস দিয়ে আস্বস্ত করে বললাম, মা সত্যিটা বললে ওনারা বেশি হয়রানির শিকার হবেন না। কিছু জানলে সেটা সবাইকে জানাও।
এসআই স্যার তাচ্ছিল্য করে বলেন, থানায় নিয়ে কোর্ট থেকে তিনদিনের রিমান্ড চেয়ে পেটের মধ্যের সব কথা সুরসুর করে বের করবো। তখন সেখানে আর চুপচাপ বসে থাকতে পারবে না।
মা তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “ আমি আগে সেখানে যাইনি রিশাত। আমি অন্ধকারে আমাদের ঘর থেকে বের হইছিলাম তোর বাবার জন্য ডাইনিং টেবিল থেকে পানি নিতে। হঠাৎ দেখলাম বউমার ঘর থেকে কেউ মনে হয় বের হচ্ছে। কিন্তু হালকা সেই আলোতেও বুঝতে পেরেছিলাম ওটা তোর মেজো ভাই নিলয়। আমাকে দেখে হনহনিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি কৌতূহল নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। এতো রাতে বউমার ঘর থেকে নিলয় বের হলো, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগে নাই। তাই ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখি রিশাত তুই দাঁড়িয়ে আছিস৷
আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাই। এসআই স্যার তখন বলেন, তারমানে আপনার মেজো ছেলেটা বড়ো বউয়ের ঘরে গেছিলো। ছোটো ছেলে যখন খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তখন মেজো ছেলেটা খুব সাবধানে পিছন থেকে এসে দরজা খুলে বের হয়ে যায়।
সেই মুহূর্তে বিমল মিত্র স্যারের নাম্বারে কল আসে। তিনি কলটা রিসিভ করেন। ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে তিনি চমকে উঠেন। তারপর চোখ মুখ কুঁচকে মোবাইলের ওপ্রান্তে থাকা লোকটার কাছে প্রশ্ন করে বলেন,
❝ প্রেগন্যান্ট? আপনি কি শিওর ডাক্তার? ❞
স্যারের কথা শুনে আমি ও মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
.
চলবে…
প্রিয় পাঠক পাঠিকা,
পড়া শেষে অবশ্যই নিজের মতামত জানিয়ে কমেন্ট করবেন। সাজু ভাইকে পুরোপুরি মাঠে নামাতে পারছি না। চারিদিকে যে ঠান্ডা, তিনি দুদিন পর আসুক।
আপনাদের রিয়্যাক্ট ও দু এক লাইনের একেকটা কমেন্টই আমাদের ভালো লাগার উৎস। আশা করি সেটুকু অন্তত দিবেন।
পোস্টে রিচ বেশি হলে লেখার আগ্রহ বেশি হয়।
লেখা-
মো: সাইফুল ইসলাম (সজীব)
Share On:
TAGS: পারসোনাল নোটিফিকেশন, সাইফুল ইসলাম (সজীব)
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস গল্পের লিংক
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ২
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৭(শেষ)
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৩
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ৩
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৪
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ১
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ২
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ১
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৫