পারসোনাল_নোটিফিকেশন।
পর্ব- দুই (০২)
ভাবির মৃত্যুর খবর শুনে মা আমাকে হাত ধরে টেনে আমার ঘরে নিয়ে গেলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে বললেন,
“ ঘটনা কি হইছিল আমার কাছে বল। তোর বাবা তো পুলিশের কাছে খবর দিতে চাচ্ছে। সুস্থ মানুষ, হঠাৎ এভাবে মরে যাবে কেন? ”
আমি মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। ভাবির মৃত্যুর ধাক্কা আমাকে ভেতর থেকে কাবু করে দিয়েছে। এমনটা আমি কল্পনা করিনি। কিন্তু মায়ের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
মা’কে বললাম, “ আমি কিচ্ছু জানি না। ভাবি আমাকে বলেছিল জরুরি কথা আছে। এজন্যই গেছিলাম। ”
মা রাগের কণ্ঠে বললেন, জরুরি কথা শোনার সময় ছিল না? মাঝরাতে বিধবা ভাবির ঘরে এতবড় দেবর গেছে জানলে মানুষ কি আস্ত রাখবে?
আমি কিছু বললাম না। মেজো ভাই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার চোখ পড়তেই তিনি ভিতরে এসে দাঁড়ান।
মা বললেন, এখন কি করবি নিলয়? পুলিশ যদি আসে তাইলে তো রিশাতকে পুলিশ থানায় নিয়ে যাবে।
মেজো ভাই বললেন, পুলিশ চাইলেই কি সব হবে নাকি? আমরা যদি মামলা না করি, অভিযোগ না করি তাহলে তো পুলিশের কানেও যাবে না। কত মানুষই তো ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়।
ভাইয়ার যুক্তি খারাপ না। কিন্তু মনের মধ্যে আতঙ্কের উৎসটা সময়ের সাথে সাথে বেড়ে যাচ্ছে। বাহিরে দুর্জয়ের কান্নার শব্দ পেলাম। সাত মাসের বাচ্চাকে আমার বাবার মতো মানুষ বেশিক্ষণ রাখতে পারবেন না এটা স্বাভাবিক বিষয়। দুর্জয়কে শান্ত করার জন্য মা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মা চলে যাবার পর ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললেন, কাজটা ঠিক করলি না। এমন কি ঝামেলা হইছে যে তারে খু,ন করা লাগবে?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ভাইয়া আমার কাছে এরকম প্রশ্ন করতে পারে? আমি কেন ভাবিকে খু,ন করতে যাবো? বরং ভাবি এমনকিছু ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন যেগুলো সরাসরি মেজো ভাইয়ার দিকেই সন্দেহ বাড়ায়।
-আমি ভাইয়াকে বললাম, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? আমি ভাবিকে মারবো কেন? আমার সঙ্গে তো ভাবির কোনো শত্রুতা ছিল না। বরং এই বাড়ির সবার চেয়ে আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক।
-সেখানেই তো সমস্যা। বেশি ভালো সম্পর্ক দিয়েই খারাপ সম্পর্ক জন্ম নেয়। আমি রাতে তোর বিছানায় ক-ন-ড-মের প্যাকেট দেখছি।
কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ বাড়ি চলে আসলি। সঙ্গে ক-ন-ড-মের প্যাকেট। এগুলো যদি পাশাপাশি করা হয় তাহলে এর মিনিং কি দাঁড়ায়?
আমি মাথা নিচু করলাম। হঠাৎ কি উত্তর দেবো খুঁজে পেলাম না। আমাকে চুপচাপ দেখে ভাইয়া নিজেই আবার বললেন, প্যাকেট গুলো কোথায়? সেগুলো তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলতে হবে। আমরা পুলিশের কাছে না গেলেও তারা নিশ্চয়ই কিছু একটা ঝামেলা করবেন। তখন প্যাকেট দেখলে পুলিশ আরো বেশি সন্দেহ করবে তোরে৷
আমি আমতাআমতা করে বলি, প্যাকেট কোথায় আছে আমি জানি না। রাতে শোবার সময় বালিশের সাইডে রেখেছিলাম। ঘুম ভেঙে দেখি সেগুলো সেখানে নাই। পুরো বিছানায় খুঁজেছি কোথাও সেটা পাচ্ছি না।
-বন্ধ ঘরের মধ্যে কে নেবে? তুই ছাড়া তো এখানে আর কেউ থাকে না। প্যাকেট উড়ে গেছে?
- আমার দরজা খোলা ছিল। ভাবিই ঘুমানোর সময় বলেছিলেন দরজা খুলে রাখতে। তিনি মাঝরাতে আসবেন বলেছিলেন। রাতে তুমি আসার আগে ভাবিই প্যাকেট গুলো আমার কাছে নিয়ে এসেছিল।
মেজো ভাই আরো অবাক হয়ে বলেন, তোর ভাবি এগুলো দিছিল? সে এসব পাবে কোই? দেখ রিশাত আমার সঙ্গে মিথ্যা বলিস না।
-মিথ্যা কেন বলবো। আজব! আজকের যত ঘটনা সব ভাবি জানেন। তিনিই আমাকে কল দিয়ে দ্রুত বাড়িতে আসতে বলেছিল। রাতে খাবার পর বিছানা গুছিয়ে দরজা খুলে রাখতে বলেন।
-এসব কেন রেখেছে কিছু বলে নাই?
-নাহ। বলতে চেয়েছিলেন। বলছিলেন যে রাতে এসে সব বলবেন। কিন্তু তার আগেই তো মনে হয় তাকে খুন করা হয়েছে।
এটা বলে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। বাহিরে আশেপাশের দু একজনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। তার উপর ভিষণ ঠান্ডা। তবুও মৃত্যুর খবর জানলে মানুষ আসবে স্বাভাবিক। ডাক্তার চাচা বাড়ি আমাদের বাড়ির পাশেই। সম্ভবত তিনিই ঘরে গিয়ে বলার পর আশেপাশে জানাজানি হয়েছে। ভাবির বাড়িতে কল দিয়েছেন মেজো ভাই। দুটো গ্রাম পরেই ভাবিদের গ্রাম। তার মা-বাবাও নিশ্চয়ই যেকোনো সময় এসে উপস্থিত হবে।
ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি তুই কিছু না করিস। প্যাকেটের বিষয় কিছু না জানিস তাহলে পুলিশের কাছে এসব বলার কোনো দরকার নাই। তুই যে ওই ঘরে গেছিস সেটাও কাউকে স্বীকার করবি না। মা-বাবা আর তুই আমি ছাড়া তো সেটা কেউ জানে না। মায়ের কথা বলবো যে দুর্জয়ের কান্না শুনে মা গেছে আর ভাবিকে ডাকাডাকি করে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ডাক্তার ডেকেছি।
আমি তখন ভাইয়াকে বললাম, তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।
-কি কথা?
-মেজো ভাবি কীভাবে মারা গেছে?
লক্ষ্য করলাম প্রশ্ন শুনে ভাইয়ার মুখের ভাবভঙ্গি কিঞ্চিৎ হলেও পরিবর্তন হয়েছে।
কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
-কীভাবে মারা গেছে জানিস না? হাসপাতালেই তো মারা গেল। দুর্জয়ের জন্মের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলো, ডায়াবেটিস সমস্যা ছিল আগেই, তারমধ্যে আবার স্ট্রোক করছিল।
আমি নিচু কণ্ঠে বললাম, এখানে কি কোনো ঘাপলা ছিল ভাই? মানে ভাবির মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল? যেই ডাক্তার বাভির সিজার করছিল তিনি তো তোমার বন্ধু ছিলেন।
-এখানে ঘাপলা কীসের? সাত মাস আগে যিনি মারা গেছে তাকে নিয়ে তোর কৌতূহল কেন? বাড়িতে একটা মানুষ মারা গেছে, সেটা নিয়ে খবর নাই।
-ভাবি আমাকে মেসেজ দিয়ে বলেছিলেন মেজো ভাবি নাকি খুন হয়েছিল। সেই খুনের বিষয়ও ভাবি কথা বলতে চেয়েছিল। ভাবির কি হইছিল ভাইয়া?
আমার প্রশ্ন শুনে ভাইয়া থমকে যান। দরজার দিকে তাকিয়ে উঁকি দিলেন। তারপর আবার আমার দিকে ফিরে বললেন,
-আমি যা জানি সবই তো বললাম। হাসপাতালে নেয়ার পর থেকে তো ভাবি আর মা হাসপাতালে ছিলেন। আমি তো সারাদিন দোকানে ছিলাম। শুধু অপারেশন করার সময় হাসপাতালে যাই। তারপর দুর্জয়ের জন্ম হলে আবার চলে আসি৷
একটু থেমে আবার বলেন, যদি হাসপাতালের মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে সেটা ভাবি আর মা ভালো জানতে পারে। এমনকি মৃত্যুর খবরটাও তো আমি দোকানে বসে পেয়েছিলাম।
আমি কোনো হিসাব মেলাতে পারলাম না। সবকিছু যিনি জানতেন তিনি মারা গেছেন। মারা গেছেন বা মেরে ফেলা হয়েছে সেটাও নিশ্চিত না। বাহিরে কান্নার শব্দ ভেসে ওঠে। ভাবির মায়ের চিৎকার শুনে পাই।
-যা বললাম মনে রাকিস রিশাত।
এটা বলে ভাইয়া আমার ঘর থেকে বের হয়ে যান।
ভাবির মা-বাবা আত্মীয়রা আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে গগনবিদারী কান্না ওঠে। আমি গিয়ে ভাবির দেহের কাছাকাছি দাঁড়াই। একটা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ঘরভর্তি মানুষ।
আমার পকেটে মোবাইলটা কেঁপে উঠলো। মনে হয় কেউ মেসেজ করেছে। মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখি ভাবির মেসেঞ্জার থেকে মেসেজ এসেছে।
আশ্চর্য হয়ে তাকাই।
মেসেজ সিন করে দেখি সেখানে লেখা আছে,
❝ নেটওয়ার্ক খুব সমস্যা করছে। আমার করা সব মেসেজ তোমার আইডি থেকে ডিলিট করে দিও৷ এগুলো কাউকে বলো না। ❞
চারিদিকে কান্নার ঢেউ আর আমি তখন ভাবির বিছানায় তার মোবাইলটা খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমাকে ব্যস্ত দেখে মা বললেন,
-কি খুঁজছিস রিশাত?
-ভাবির মোবাইলটা কোই মা?
-তোর ভাবির মোবাইল তো আজ সকালে বাজারে পাঠিয়েছে ঠিক করার জন্য। মোবাইল তো মনে হয় এখনো বাজারে।
আমি আবারও গোলকধাঁধার মধ্যে পরলাম। ভাবির মোবাইল যদি বাজারে থাকে তাহলে তার আইডি দিয়ে মেসেজ করলো কীভাবে?
মনে পড়লো, দুপুরবেলায় ভাবি কল দিয়েছিল বাবার নাম্বার দিয়ে। আমাকে তখন বলেছিলেন যে তার মোবাইলে কি নাকি সমস্যা হয়েছে। মায়ের কাছে শোনার আগ পর্যন্ত কথাটা আমার মাথায় আসেনি।
— —————
আটত্রিশ মিনিটের ভয়েস রেকর্ড। এখনো পুরোটা শেষ হয়নি। এই পর্যন্ত শোনার পরে রেকর্ড বন্ধ করা হলো৷ চারিদিকে থমথমে পরিবেশ।
হাতে রাখা কফির কাপে চুমুক দিলেন সাজু ভাই।
কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা থানার এসআই বিমল মিত্রের দিকে তাকিয়ে সাজু ভাই বললেন,
“ রিশাতের লাশের ছবিগুলো আরেকবার দেখান তো ভাই। যেই ছেলেটা এতবড় কাহিনি নিজের মোবাইলে রেকর্ড করলো, সেই ছেলেটা কীভাবে আত্মহত্যা করতে পারে? ”
বিমল মিত্র বলেন, আমরা রিশাতকে সন্দেহ করেছিলাম। তার বিরুদ্ধে কতগুলো প্রমাণ ছিল। এজন্যই হয়তো নিজের নিশ্চিত ফাঁসি জেনেই আত্মহত্যা করেছে।
সাজু মুচকি হেসে বললো, রিশাত তো চাইলে পালিয়ে যেতে পারতো। সেই সুযোগ তার ছিল। ফাঁসি হওয়া কি এতটাই সহজ ভাই?
এসআই বিমল মিত্র বলেন, এই রেকর্ডের মধ্যে রিশাত যে বলেছে ক-ন-ড-ম এর প্যাকেট তাকে তার বড় ভাবি দিয়েছে। এটা মিথ্যা। ওই প্যাকেট রিশাত নিজেই তাদের বাজার থেকে কিনেছিল।
চলবে…
একটা অনুরোধ করি প্রিয় পাঠক পাঠিকা। যারা যারা এই পর্ব পড়বেন তারা সবাই একটু কষ্ট করে প্রথম পর্বে গিয়ে রিয়্যাক্ট ও কমেন্ট করবেন প্লিজ। আপনার একটা কমেন্ট আমার পেইজের সমস্যা সমাধানের মাধ্যম হয়ে থাকবে।
লেখা-
মো: সাইফুল ইসলাম (সজীব)
Share On:
TAGS: পারসোনাল নোটিফিকেশন, সাইফুল ইসলাম (সজীব)
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ২
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ১
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৩
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন গল্পের লিংক
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ১
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৫
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ৪
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৬
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস গল্পের লিংক
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ৩