বড়ভাইয়ার মৃত্যুর এক-বছর পর বিধবা ভাবির সঙ্গে মেজো ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হলো। ভাবির মা-বাবা ও আমার বাবা মা সবাই রাজি। আত্মীয় স্বজনরা বাকি যারা ছিলেন তাদের মধ্যেও কারো আপত্তি নেই।
শুধু আপত্তি করলেন ভাবি একা।
ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে বসে ভাবি সবাইকে বললেন তিনি মেজো ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারবেন না। বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে তিনি আমাকে বিয়ে করবেন। আর নাহলে ভাবি তার বাপের বাড়ি গিয়ে এভাবেই একা একা সারাজীবন কাটিয়ে দিবেন।
আমরা তিনভাই। বড়ো ভাই মৃত রাজিব মুন্সি, মেজো ভাই নিলয় মুন্সি ও আমি রিশাত মুন্সি।
মেজো ভাইয়াও আগে বিয়ে করেছিলেন। সাত মাস আগে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে মেজো ভাবি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। মেজো ভাবির মৃত্যুর পর তার সন্তানের সম্পুর্ণ দায়িত্ব বড়ভাবি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
দেখতে দেখতে সাত মাস পার হয়েছে। বড়ভাবিই এখনো মেজো ভাইয়ের সন্তানকে দেখাশোনা করছিলেন। একদিকে বড়ভাইয়া নেই, অপরদিকে নেই মেজো ভাবি। মাঝখানে সাত মাসের বাচ্চা দুর্জয়।
যেহেতু দুজনেই পূর্বে বিবাহিত এবং প্রত্যেকের সঙ্গী পৃথিবীতে নেই। তাই মা-বাবা সবাই চাচ্ছিলেন তাদের দু’জনের বিয়ে দিবেন। এতে একসঙ্গে সংসারও করবে আবার দুর্জয়ের মায়ের অভাবটা পুরণ হবে।
কিন্তু ভাবির সোজা কথা তিনি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবেন না।
ভাবিকে সবাই মিলে বোঝাতে শুরু করেন। তাকে বলা হয় আমি এখনো পড়াশোনা করছি। কিছুদিন পরই মাস্টার্স পরীক্ষা দেবো। তাছাড়া বয়সে ভাবি আমার চেয়ে কয়েক মাসের বড়ো। সবমিলিয়ে আমার সঙ্গে ভাবির বিয়ে প্রায় অসম্ভব।
ভাবি তখন সবার সামনে আমাকে জিজ্ঞেস করে বললেন, রিশাত আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি আছে? যদিও নতুন বিয়ে করে সংসার করার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে আমার নাই। যেহেতু সবাই চাচ্ছেন তাই আমি তোমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে জানালাম। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে সবার সামনে বলো। আর যদি রাজি না হও তাহলেও সমস্যা নেই, আমি আমার মা-বাবার কাছে চলে যাবো।
ভাবির কথার পরে সবাই আমার দিকে তাকায়। আমি কোন পক্ষে কথা বলবো নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। আমতাআমতা করতে করতে হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম, মা-বাবা রাজি হলে তোমাকে বিয়ে করতে আমারও আপত্তি নেই।
ব্যাস, আর রক্ষা হয় না।
ফুফু চিৎকার দিয়ে বলে, নির্লজ্জ পোলা। নিজের চেয়ে বয়সে বড়ো ভাবিরে বিয়ে করতে চাস ক্যান? তোরে কি বিধবা বিয়ে করার লাইগা শহরের মইদ্যে পড়াশোনা করতে পাঠাইছে?
ভাবি বললেন, ফুফু ওকে বকাবকি কইরেন না। এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করারও দরকার নাই। আমি আর রিশাত তো রাজি আছি। আপনারা যদি চান তাহলে বিয়ে দিয়েন। আর নাহলে যেভাবে সবকিছু আছে সেভাবেই থাকুক। তবে আমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে সমস্যা হলে আমি সংসারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাপের বাড়ি যেতে পারবো।
ঘটনা এই পর্যন্তই রইল। মেজো ভাই তো আমারে দেখলেই এমন ভাব করে আমি তার চরম শত্রু। যেই বাড়িটা ছিল ভালোবাসায় ভরপুর, সেই বাড়িটাই এমন হয়ে গেল যে প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সঙ্গে কথা বলা হচ্ছিল না।
আমি থাকতাম খুলনায় ম্যাসে। বাড়ি থেকে এমন পরিস্থিতিতে যেদিন খুলনা যাচ্ছি সেদিন ভাবি আমার কাছে এসে বলেছিলেন,
❝ এই বাড়িতে মনে হয় বেশিদিন থাকতে পারবো না। যদি চলে যাই তাহলে রাগারাগি কইরো না। ❞
আমি বলেছিলাম, কেন চলে যাবেন?
ভাবি বললেন, স্বেচ্ছায় যা পাওয়া গেল না তার জন্য জোরাজুরি হবার সম্ভবনা আছে। যদি কখনো কলঙ্কের দাগ লাগে তাহলে সবাই ভুল বুঝলেও তুমি ভুল বুইঝো না।
“ ভাবি আমি তোমার কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে খুলে বলো প্লিজ। ”
“ দরকার নাই। তুমি তো জানো তোমাদের চেয়ে আমার বাবার সম্পত্তি কোনো অংশে কম নাই। তবুও কেন এখানে আছি? কারণ সংসারটা আমার। তোমার ভাই যদি বেঁচে থাকত তাহলে কি চলে যেতাম? কিন্তু এখন যা শুরু হয়েছে তার শেষ কীভাবে হবে আমি জানি। দুর্জয়ের জন্য খারাপ লাগে। আল্লাহ আছেন তিনি হয়তো দেখবেন।
ভাবি আর কিছু বলেন নাই। একবার যেটা বলবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন সেটা আর তাকে দিয়ে বলানো অসম্ভব। একরাশ চিন্তা নিয়ে আমি খুলনায় গেলাম। এরপর বাড়ি ফিরলাম আটদিন পর।
দুপুরের খাবার খেয়ে ম্যাসে নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ ভাবির ফোন। কল রিসিভ করতেই ভাবি বলেন এক্ষুনি বাড়িতে আসো।
কেন, কি কারণে, কিছুই জানি না। মা-বাবার সঙ্গে বলে কোনো লাভ কবে না এটা জানতাম। কাজেই কাউকে কিছু না বলে বাড়ি রওনা দিলাম। সন্ধ্যার বেশ পরে বাড়িতে পৌছলাম। মা আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কারণ গতকালই তাকে বলেছিলাম সামনে পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষ হবার আগে আর বাড়ি যাওয়া সম্ভব না।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে নিজের ঘরে গেলাম। যেহেতু ডিসেম্বর মাস তাই গ্রামে কনকনে ঠান্ডা। ভাবি এসে আমার বিছানা ভালো করে ঠিক করে দিয়ে গেলেন। আমি কানে ইয়ারফুন গুঁজে মুভি দেখছিলাম। মেজো ভাই তখনও বাজার থেকে বাড়ি ফেরেনি। বাজারে আমার বাবার নিজ হাতে তৈরি বিরাট মুদিখানা দোকান আছে। আগে বড়ভাই ও মেজো ভাই বাবার সাথে দোকানে বসতেন। এখন বাবার সাথে মেজো ভাই বসেন।
প্রতিদিন দোকান শেষ করে বাড়ি ফিরতে মেজো ভাইয়ের এগারোটা পার হয়ে যায়। বাবা এশার নামাজ পড়ে আর দোকানে বসেন না। মসজিদ থেকে বের হয়ে সোজা বাড়িতে আসেন৷ রাত দশটার মধ্যে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়া বাবার দীর্ঘদিনের পুরাতন অভ্যাস। আজও তার ব্যাতিক্রম নয়।
আমার ঘরের দরজা খোলা ছিল। ভাবি তখন বলে গিয়েছিলেন দরজা যেন বন্ধ না করি। হঠাৎ দেখলাম ভাবি রুমে আসলেন। খাটের কাছে এসে আমার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বললেন,
“ এগুলো তোমার কাছে রাখো৷ দরজা বন্ধ করার দরকার নাই। দুর্জয় আর বাড়ির সবাই ঘুমালে আমি তোমার ঘরে আসবো। জরুরি কথা আছে। ঘুমিয়ে যাও সমস্যা নেই কিন্তু দরজা বন্ধ করো না। ”
ভাবি চলে যাবার পর আমি কৌতূহল মেটাতে তার দিয়ে যাওয়া প্যাকেটটা হাতের সামনে নিলাম। প্যাকেটটা ফার্মেসির কারণ প্যাকেটের উপর আমাদের বাজারের ফার্মেসির নাম লেখা।
ভিতরে কি আছে সেটা দেখার জন্য সেগুলো হাতে নিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ কপালে উঠে যাবার মতো অবস্থা।
দেখলাম সেখানে, এক প্যাকেট ক-ন-ড-ম ও একটা স্প্রে জাতীয় মেডিসিন। স্প্রে এর প্যাকেটের উপরের লেখা পড়ে বুঝতে পারলাম এটা মানুষের নাকের কাছে দিলে সেই মানুষটা কমপক্ষে দুই ঘন্টা অজ্ঞান থাকবে৷
কিন্তু এসব ভাবি আমার কাছে কেন দিয়ে গেল এটা কোনোভাবে মাথায় ঢুকছিল না।
ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিলাম যে কখন মেজো ভাই ঘরে এসেছেন আমি বুঝতেই পারিনি।
“ কিরে কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ বাড়িতে আসলি যে? কোনো সমস্যা হয়েছে? ”
মেজো ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি ভাইয়া আমার হাতে রাখা প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি সেগুলো কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে বললাম,
“ দুর্জয়কে দেখতে মন চাচ্ছিল। ”
“ ওহ্হ। দরজা খোলা রেখেছিস কেন? উঠে দরজা বন্ধ করে তারপর ঘুমা। ”
“ ঠিক আছে। ”
আমি ভাইয়ার পিছনে পিছনে দরজার কাছে এলাম ঠিকই কিন্তু দরজা বন্ধ করলাম না। যেহেতু ভাবি দরজা বন্ধ করতে নিষেধ করেছেন তাই দরজা খুলে রাখতে হবে। তাছাড়া সেবার বাড়ি থেকে যাবার সময় ভাবির রহস্যজনক কথাবার্তা, আবার আজকে হঠাৎ কল দিয়ে জরুরিভাবে আসতে বলা, এখন এই প্যাকেটের বিভিন্ন জিনিসপত্র। সবমিলিয়ে আমার কৌতূহল আকাশচুম্বী।
প্যাকেটটা বালিশের সাইডে রেখে আমি শুয়ে পড়লাম। শীতের রাতে কম্বলের নিচে গেলে ঘুম আসতে সময় লাগে না। তাছাড়া বরাবরই আমি রাত বারোটার মধ্যে ঘুমাতাম। মোবাইল হাতেই ছিল। ভাবি তার ঘর থেকে মেসেজ দিলেন।
লিখলেন,
“ প্যাকেটে কি আছে দেখেছো? ”
“ হুম। ”
“ কেন দিয়েছি জানো? ”
“ নাহ। ”
“ তুমি কি জানো তোমার মেজো ভাবি কীভাবে মারা গেছে? সরি কীভাবে তাকে খুন করা হয়েছে? ”
ভাবির মেসেজ পড়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সবাই জানি মেজো ভাবি দুর্জয়কে জন্ম দিয়ে সিজারের পরদিন পৃথিবী থেকে চলে গেছেন৷ কিন্তু বড় ভাবি হঠাৎ মৃত্যুকে খুন কেন বললেন?
আমার রিপ্লাই না পেয়ে ভাবি লিখলেন,
“ দুর্জয় ঘুমালে আমি এসে সব বলবো তোমাকে। আমরা দুজন মিলে আজ একজনকে হাতেনাতে ধরবো। তোমার দরজা খোলা আছে তো? ”
“ হ্যাঁ খোলা। কোলা রাখার দরকার ছিল না। তুমি আসার সময় কল দিলেই হতো। ”
“ না হতো না। তুমি একবার ঘুমালে তোমাকে আর হাজারবার কল দিয়েও পাওয়া যায় না। ”
“ মেজো ভাবি কি সত্যি খুন হয়েছে? ”
“ হ্যাঁ তাকে খুন করা হয়েছে। ধৈর্য হারিও না রিশাত। যে কথা অনেক আগে সবাইকে বলা দরকার ছিল সেটা তোমাকে অন্তত আজ বলবো। ”
“ ঠিক আছে কখন আসবে? ”
ভাবি আর মেসেজ সিন করেন নাই। আমি তিনটা মেসেজ করি কিন্তু উত্তর নাই।
কখন ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ কিছু একটার শব্দ শুনে জেগে উঠি৷ চারিদিকে তাকিয়ে দেখি সব অন্ধকার। কিন্তু আমার মুখের উপর মশারী। হঠাৎ কি মনে করে বালিশের সাইডে প্যাকেট চেক করতে গেলাম।
কিন্তু আশ্চর্য, প্যাকেট কোথাও নাই। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ভালো করে খুঁজে দেখলাম কিন্তু কোথাও প্যাকেট পেলাম না।
আমি তাড়াতাড়ি ভাবির নাম্বারে কল দিলাম। নাম্বারে কল গেল ঠিকই তবে রিসিভ হলো না। পরপর চারবার কল দিলাম নো রেসপন্স। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। ভাবি সম্পুর্ণ আমার বিপরীত। তাকে যত রাতেই কল দেই সে রিসিভ করে। হালকা মেসেজের শব্দেও তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
আমি তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালিয়ে ভাবির ঘরের সামনে যাই। দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। আমি মোবাইল বাতি অন করেই ভিতরে গেলাম। বিছানার কাছে গিয়ে ভাবি ভাবি বলে ডাকলাম কোনো শব্দ নেই। বাহিরে বিড়াল ডাকার শব্দ। গভীর রাতে বাগানে শিশির পরার শব্দও যেন ভয়ংকর।
ভাবির মুখে আলো দিলাম। কয়েকবার ডাকলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ পিছনে দরজায় শব্দ শুনে চমকে উঠি। তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে। মা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলেন,
“ তুই এখানে কি করছিস? ”
বললাম,
“ ভাবিকে একটু ডাকো তো। আমার কেমন যেন লাগছে। তুমি একটু ভাবির মাথায় হাত দিয়ে জোরে ডাক দাও। ”
মা আশ্চর্য হলেন। আমার কথামতো বউমা বউমা বলে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু ভাবির কোনো রেসপন্স নেই। ভাবি আর উঠলেন না। পাশের বাড়ির ডাক্তার চাচাকে ডাকা হলো। তিনি এসে ভাবিকে মৃত ঘোষণা দিলেন। আমি পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে ভাবির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ভাবি এভাবে হঠাৎ মরে গেল নাকি তাকে কেউ মেরে ফেলেছে? জানি না আমি। কিচ্ছু জানি না।
.
দ্বিতীয় পর্ব পোস্ট করা আছে। পেইজেই পাবেন।
.
চলবে…
গল্প- #পারসোনাল_নোটিফিকেশন।
পর্ব- এক (০১)
লেখা- মো: সাইফুল ইসলাম (সজীব)
Share On:
TAGS: পারসোনাল নোটিফিকেশন, সাইফুল ইসলাম (সজীব)
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ১
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৩
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৭(শেষ)
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ৩
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ২
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৬
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন পর্ব ৪
-
পারসোনাল নোটিফিকেশন গল্পের লিংক
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস গল্পের লিংক
-
বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ২