নির্লজ্জ_ভালোবাসা
লেখিকাসুমিচোধুরী
পর্ব ৫৮ (বোনাস পর্ব)
(❌কঠোর ভাবে কপি করা নিষিদ্ধ❌)
সবকিছু এক মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর মানুষের কোলাহল সবই যেন আরশির চারপাশ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। রাস্তার তপ্ত পিচের ওপর আরশির নিথর দেহটা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। হাজারো মানুষের ভিড়ে সবার চোখেই আতঙ্ক। কিন্তু আরশির নিস্তেজ চোখের কোণ দিয়ে তখনও এক ফোঁটা জল চিকচিক করছে। সেই অশ্রুবিন্দু দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কতটা পাহাড়সম অভিমান আর আফসোস নিয়ে মেয়েটা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
শান্ত চৌধুরী আর মিনহা চৌধুরী পাগলের মতো ভিড় ঠেলে দৌড়ে এসে আরশিকে জড়িয়ে ধরলেন। আরশির মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে শান্ত চৌধুরী উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বললেন।
“আরে ভাই আপনারা দাঁড়িয়ে দেখছেন কেন? কেউ ইমার্জেন্সি অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। আমার মেয়েটার নিশ্বাস আটকে আসছে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। কেউ সাহায্য করুন।”
উপস্থিত মানুষেরা ততক্ষণে দ্রুত ফোন বের করে অ্যাম্বুলেন্সে কল দিল। অল্প সময়ের মধ্যেই সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চলে এলো সাথে এলেন ইমার্জেন্সি ডাক্তার। ডাক্তার গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত আরশির পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসলেন। তিনি নাড়ি পরীক্ষা করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস চেক করে গভীর উদ্বেগের সাথে নার্সের উদ্দেশ্যে বললেন।
“দ্রুত স্ট্রেচার বের করুন। পালস খুব স্লো আর নিশ্বাস একদমই ক্ষীণ হয়ে আসছে। কুইক আমাদের হাতে একদম সময় নেই।”
রক্তাক্ত আরশিকে খুব সাবধানে স্ট্রেচারে তুলে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে নেওয়া হলো। মিনহা চৌধুরী কান্নায় ভেঙে পড়ে আরশির একটা হাত শক্ত করে ধরে আছেন যেন ছাড়লেই সে চিরতরে হারিয়ে যাবে। শান্ত চৌধুরী আর মিনহা চৌধুরীও দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে উঠে বসলেন। সাইরেনের সেই তীক্ষ্ণ শব্দ হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটল। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে আরশির সেই আধবোজা চোখের পাতায় তখনও লেগে ছিল এক অপূর্ণ ভালোবাসার আকুতি।
খান বাড়ির নিস্তব্ধ দুপুরের নীরবতা ভেঙে হঠাতই ল্যান্ড ফোনটা তীব্র শব্দে বেজে উঠল। আনোয়ার খান তখন ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন আর বাড়ির বাকি সবাই যে যার মতো কাজে ব্যস্ত ছিল। ফোনের কর্কশ আওয়াজে তিনি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে রিসিভারটা কানে তুললেন। কিন্তু ওপাশ থেকে আসা খবরটা শোনার সাথে সাথেই যেন তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তার শরীর অসাড় হয়ে এল আর হাত থেকে রিসিভারটা খসে মেঝেতে পড়ে গেল। আনোয়ার খান বুক ফাটানো এক আর্তনাদ করে উঠলেন।
“ও আল্লাহহহহহহহহহ। আমার মেয়ে আমার আরশি মা।”
আনোয়ার খানের সেই হাহাকার মেশানো চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে ছিল দৌড়ে ছুটে এল। রৌশনি খান সব কাজ ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আনোয়ার খানকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“কী হয়েছে আপনার? ওভাবে চিৎকার দিলেন কেন? কী হয়েছে আমাদের মেয়ের?”
আনোয়ার খান তখনো কাঁপছেন। তার চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে আর গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তিনি কোনোমতে তোতলামি করে বললেন।
“আ আ আরশির এক্সিডেন্ট হয়েছে। ওকে ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে অবস্থা নাকি খুব খারাপ।”
শেষ কথাটুকু শোনামাত্র যেন পুরো খান বাড়িতে বজ্রপাত হলো। রৌশনি খান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তার পৃথিবীটা চোখের সামনে দুলে উঠল। তিনি ‘মা গো’ বলে এক চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লেন। আশিক খান পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে বললেন।
“ভাইয়া এখন এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাদের এখনই হাসপাতালে যেতে হবে। চলো সবাই।”
তুরা আর আরফা দৌড়ে এসে রৌশনি খানকে দুই পাশ থেকে ধরে কোনোমতে টেনে তুলল। বাড়ির সবাই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দিশেহারা অবস্থায় দ্রুত বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হতেই ভেতরে কান্নার এক রোল পড়ে গেল। তুরা আরফা আর তিথি কারোর চোখেই আর জল বাঁধ মানছে না। তাদের আদরের আরশি এভাবে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এই ধকল তারা সইতে পারছে না। রৌশনি খান পাথর হয়ে জানালার ওপারে তাকিয়ে আছেন। তার স্তব্ধতা যেন আকাশের মেঘের চেয়েও ভারী হয়ে উঠেছে।
খবরটা রৌদ্র আর আয়ানের অফিসে পৌঁছাতেও দেরি হলো না। তারা দুজন তখন একটা জরুরি ব্যবসায়িক ফাইল নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন ছিল। ঠিক তখনই রৌদ্রের ফোনটা ঝংকার দিয়ে বেজে উঠল। রৌদ্র স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই ফোনটা কানে ধরল। কিন্তু ওপাশ থেকে শান্ত চৌধুরীর সেই কান্নামাখা ভাঙা কণ্ঠস্বর শোনার পর রৌদ্রের পুরো শরীর যেন পাথরের মতো জমে গেল। তার হাত থেকে ফোনটা আর্তনাদ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। আয়ান রৌদ্রের ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেল। সে ফাইলটা রেখে দ্রুত এগিয়ে এসে বলল।
“কী হয়েছে ভাইয়া? অমন করছ কেন? বাসায় সব ঠিক আছে তো?”
রৌদ্রের গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। সে কোনোমতে কম্পিত স্বরে বিড়বিড় করে বললেন।
“আ আরশি আরশির ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়েছে আয়ান।”
আয়ান মুহূর্তের মধ্যে নিজের চেয়ার ছেড়ে ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
“কীহহহহহ! কী বলছ এসব ভাইয়া?”
রৌদ্র আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না। শরীরের ব্লেজারটা খুলে সোফায় ছুঁড়ে ফেলে সে ঝড়ের বেগে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। পার্কিং লটে গিয়ে নিজের গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে পাগলের মতো ফুল স্পিডে ড্রাইভ করতে লাগল। তার পেছনেই আয়ানও নিজের গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটল। তাদের বুকটা তখন অজানা কোনো আশঙ্কায় ঢিপঢিপ করছে।
এক এক করে দুই পরিবারের সবাই হাসপাতালে এসে জড়ো হলো। আরশিকে ততক্ষণে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হয়েছে। বাইরে লাল বাতিটা জ্বলছে যা এক অশুভ সংকেত দিচ্ছে। আরশির অবস্থা এতটাই সংকটাপন্ন যে তাকে কৃত্রিম অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। রৌদ্র আর আয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে করিডোরে ঢুকে সবটা শুনল। খবরটা শোনার পর তাদের দুজনেরও যেন মেরুদণ্ড ভেঙে গেল তারা দুজনেই দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে নিস্তেজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রৌশনি খান এতক্ষণ পাথর হয়ে থাকলেও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তার কান্নায় হাসপাতালের ভারী বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। আনোয়ার খানও মেয়ের কথা ভেবে অঝোরে কাঁদছেন।
পুরো পরিবারের কান্না আর হাহাকারের মাঝখানে তুরা হঠাৎ খেয়াল করল সবাই এখানে উপস্থিত থাকলেও একজন মানুষ নেই। তুরা চোখের জল মুছতে মুছতে ভাঙা গলায় শান্ত চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলল।
“আঙ্কেল শিহাব ভাইয়া কোথায়? সবাইকে দেখছি কিন্তু ভাইয়াকে তো দেখছি না। ভাইয়া কি এখনো খবরটা পায়নি?”
তুরার প্রশ্ন শুনে শান্ত চৌধুরী যেন ফেটে পড়লেন। তিনি ক্ষোভ আর হাহাকারে চেঁচিয়ে বললেন।
“জানতে হবে না ওকে। ও না আসলেই আমি খুশি। ও তার কাজ আর তার ইগো আর তার দুনিয়া নিয়েই পড়ে থাকুক। আমার মেয়েটা যখন ওর জন্য মরতে বসেছে তখনও ও হয়তো কোনো মিটিংয়ে টাকা গুনছে। খবরদার ওকে কেউ খবর দিবি না।”
শান্ত চৌধুরীর এই রুদ্রমূর্তি আর ঘৃণাভরা কথাগুলো কান্নার রোলে চাপা পড়ে গেলেও তুরা হতভম্ব হয়ে গেল। আরশি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আর তার স্বামী জানবে না এটা তুরা মেনে নিতে পারছে না। সে সবার আড়ালে একটু সাইডে সরে এল। বিয়ের আগে থেকেই শিহাবের নাম্বার তার কাছে সেভ করা ছিল। সে কাঁপাকাঁপা হাতে সেই নাম্বারে ডায়াল করল।
এদিকে শহরের অন্য প্রান্তে একটা বিলাসবহুল কনফারেন্স রুমে শিহাব তখন খুব বড় একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ে ব্যস্ত। তার সামনে বিদেশি বড় বড় সব ক্লায়েন্ট বসে আছে। পুরো রুমে পিনপতন নীরবতা। শুধু প্রজেক্টরের আলো আর শিহাবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে শিহাবের ফোনটা ভাইব্রেট করে বেজে উঠল। শিহাব একবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল অচেনা নাম্বার। সে ভ্রু কুঁচকে কলটা কেটে দিয়ে আবার প্রেজেন্টেশন শুরু করল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই ফোনটা আবার বেজে উঠল। শিহাব এবারও গুরুত্ব দিল না কারণ এই প্রজেক্টটা তার ক্যারিয়ারের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ফোনটা থামার নামই নেই এবার যেন বেহায়ার মতো বারবার বাজতে শুরু করল।
টানা কয়েকবার ফোনের রিংটোন বাজতে দেখে একজন ক্লায়েন্ট একটু বিরক্ত হয়েই বললেন।
“মিস্টার শিহাব আই থিঙ্ক ইউ শুড পিক আপ দ্য কল। ইটস বিন রিংগিং কন্টিনিউয়াসলি। কোনো ইমার্জেন্সি হতে পারে।”
শিহাব সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিল। সে ভেবেছিল কেউ হয়তো বারবার ভুল নাম্বারে কল দিচ্ছে। সে কলটা রিসিভ করে কঠোর গলায় বলল।
“হ্যালো কে বলছেন? আমি একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ে আছি বারবার ডিস্টার্ব করছেন কেন সমস্যা কি?”
ওপাশ থেকে তুরার ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ কানে আসতেই শিহাবের গলার স্বর কিছুটা নরম হয়ে গেল। তুরা কোনোমতে শ্বাস টেনে আর্তনাদ করে বলল।
“শিহাব ভাইয়া আমি তুরা বলছি। আপনি এখনো মিটিং করছেন? এদিকে আরশি আপু যে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আরশির খুব বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে শিহাব ভা ভা ভাইয়া। ও এখন অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তাররা বলছে ওর বাঁচার আশা খুবই কম।”
তুরার কথাগুলো শোনার সাথে সাথে শিহাবের হাতের কলমটা মেঝেতে পড়ে গেল। তার মস্তিষ্কে যেন হাজার হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেল। পুরো কনফারেন্স রুমটা তার চোখের সামনে ঘুরতে শুরু করল।
শিহাবের হাত থেকে দামী ফোনটা নিথর হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। ওপাশে তুরার কান্নার আওয়াজ তখনও আসছে কিন্তু শিহাবের কানে তখন কেবল শ্মশানের নীরবতা। ক্লায়েন্টরা তার অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“মিস্টার শিহাব। ইজ এভরিথিং ওকে? এনি প্রবলেম?”
শিহাবের ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। সে কোনোমতে বিড়বিড় করে বলল।
“আ… আ… আরশি?”
পরক্ষণেই শিহাবের মনে হলো তার বুকের পাজরগুলো কেউ একজন হাতুড়ি দিয়ে পিষে ফেলছে। কলিজাটা যেন জ্যান্ত ছিঁড়ে বের করে নিচ্ছে কেউ। সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না। ল্যাপটপ, ফাইল, ক্লায়েন্ট—সবকিছু তুচ্ছ করে সে পাগলের মতো দৌড়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসে স্টার্ট দিয়েই সে উন্মাদের মতো গতি বাড়িয়ে দিল। কিন্তু খানিক পথ যেতেই তার ভাগ্য যেন তার সাথে নিষ্ঠুর পরিহাস করল। রাস্তায় মাইলের পর মাইল জ্যাম। গাড়ির চাকা নড়ার কোনো নামই নেই।
শিহাবের মনে হচ্ছিল সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। সে গাড়ি ওখানেই ফেলে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ট্রাফিক জ্যামের মাঝ দিয়েই সে উন্মাদের মতো দৌড়াতে শুরু করল হাসপাতালের দিকে। পিচঢালা তপ্ত রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তার দম ফেটে যাচ্ছে কিন্তু থামার নাম নেই। তার মনে হচ্ছিল সে যত দেরি করছে আরশি তত দূরে সরে যাচ্ছে।
শিহাব যখন ঘামাক্ত শরীরে হাসপাতালের করিডোরে ঢুকল তখন দেখল পুরো পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়েছে। শিহাবকে দেখে তুরা ডুকরে কেঁদে উঠল। সে আঙুল দিয়ে অপারেশন থিয়েটারের বন্ধ দরজাটা দেখিয়ে বলল।
“শি… শি… শিহাব ভাইয়া। আপু ওই ঘরে। আপু আমাদের কারোর সাথে কথা বলছে না। আপু আর চোখ মেলে তাকাচ্ছে না।”
তুরার কথা শুনে শিহাবের মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে উঠল। সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওটির দরজার সামনে গিয়ে আছড়ে পড়ল। পাগলের মতো দরজায় লাথি মারতে মারতে চিৎকার করতে লাগল। আয়ান আর রৌদ্র দৌড়ে এসে শিহাবকে জাপটে ধরল কিন্তু শিহাব তখন জানোয়ারের মতো শক্তি দিয়ে তাদের সরাবার চেষ্টা করছে। সে গলার রগ ফুলিয়ে চিল্লাহতে লাগল।
“ছেড়ে দে আমাকে! ডাক্তারের বাচ্চারা তোরা আমার আরশিকে এই ঘরের ভেতর কেন নিয়ে গেছিস? এখানে তো ধারালো ছুরি দিয়ে মানুষের শরীর কাটে! তোরা কি দেখছিস না আরশির কত কষ্ট হচ্ছে? ওর শরীরটা তো এমনিতেই ছোট। এত ছুরি কাঁচির আঘাত ও সইতে পারবে না! রৌদ্র আয়ান ছেড়ে দে বলছি আমাকে।”
শিহাব নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মেঝের ওপর ধস্তাধস্তি শুরু করল। তার দুই চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। সে আয়ান আর রৌদ্রের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার কাকুতি মিনতি করে বলল।
“তোদের পায়ে ধরি। আমাকে একবার ভেতরে যেতে দে। আরশি ভেতরে একা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমাকে যেতে দে। তোরা না ছাড়লে আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো! আল্লাহ্র দোহাই লাগে আমাকে ওর কাছে যেতে দে।”
রৌদ্রের চোখদুটোও কান্নায় লাল হয়ে আছে। সে শিহাবকে শক্ত করে জাপটে ধরে আর্তনাদ করে বলল।
“শিহাব শান্ত হ! আরশিকে ওইটার ভেতরে নিয়ে গেছে ওকে বাঁচানোর জন্য। তুই এভাবে পাগলামি করিস না। আমার বোনের কিছু হবে না। আরশি ফিরে আসবে আমাদের মাঝে।”
কিন্তু শিহাবের কানে তখন কোনো যুক্তি পৌঁছাচ্ছে না। সে উন্মাদের মতো দরজার ওপর আছড়ে পড়ছে আর ভেতরের ডাক্তারদের উদ্দেশ্য করে কুৎসিত ভাষায় চিৎকার করছে।
“এই মাদারচু*দের ডাক্তার! আরশির যদি সামান্যতম কষ্ট হয় তোদের আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব! যদি ওর গায়ে একটা আঁচড় লাগে তবে তোর কবর আমি নিজের হাতে খুঁড়ব! খবরদার বলছি আমার আরশিকে তোরা কষ্ট দিস না।”
শিহাবের এই রুদ্রমূর্তি দেখে হাসপাতালের করিডোরে এক থমথমে পরিবেশ তৈরি হলো। শান্ত চৌধুরী এক কোণে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে শিহাবের এই পাগলামি দেখছেন। তার মনে বিষণ্ণ এক প্রশ্ন জাগল। মানুষ কি হারিয়ে গেলেই কেবল সবার কাছে এত দামী হয়ে যায়? যে ছেলেটা আজ সকালে প্রচণ্ড ঘৃণা আর রাগ নিয়ে মেয়েটাকে মারল আর কটু কথা শোনাল। সেই ছেলেই এখন আরশির জন্য পাগলামি করছে। মানুষের গুরুত্ব কি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েই বুঝতে হয়?
হঠাৎ অপারেশন থিয়েটারের সেই অভিশপ্ত লাল বাতিটা নিভে গেল। দরজা খোলার শব্দ হতেই রৌদ্র আর আয়ান শিহাবকে আরও জোরে চেপে ধরল যাতে সে উত্তেজনায় ডাক্তারকে আক্রমণ করতে না পারে। ডাক্তার ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন। তার মুখটা মাস্ক দিয়ে ঢাকা থাকলেও চোখদুটো ভীষণ ক্লান্ত আর করুণ দেখাচ্ছে। মাস্কটা খুলতেই দেখা গেল তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আরিফুল খান বুক দুরুদুরু অবস্থায় সবার আগে ডাক্তারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
“ডাক্তার। আমার আরশি মা ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয়নি তো?”
ডাক্তার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি শুধু মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ডাক্তারকে এভাবে নিরব থাকতে দেখে করিডোরের সবার কলিজা যেন মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। রৌশনি খান এক বিকট চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।শিহাব তখন বাঘের মতো গর্জে উঠে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল।
“এই ডাক্তার! তুই কথা বলছিস না কেন? বল আমার আরশির সাথে কী করেছিস তুই? কথা বলছিস না কেন? কথা বল! নাহলে খোদার কসম আমি তোকে এখানেই খুন করে ফেলবো।”
ডাক্তার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অত্যন্ত নিচু স্বরে বললেন।
রানিং….!
Share On:
TAGS: নির্লজ্জ ভালোবাসা, সুমি চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৯
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৯
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫০
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১০
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩২
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৪
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫১
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩০
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২