ডিজায়ার_আনলিশড
✍️ #সাবিলা_সাবি
পর্ব -২৫
ভোরের আলো তখনও কুয়াশার চাদর সরাতে পারেনি। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউগুলো যখন দ্বীপে আছড়ে পড়ছিল, ঠিক তখনই দিগন্ত চিরে দেখা দিল সাতটি বিশালাকার যুদ্ধজাহাজ। সেই বহরের অগ্রভাগে থাকা প্রধান জাহাজটি যখন কূলে এসে ভিড়ল, দ্বীপের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। মেইলস্ট্রোম তান্বীকে নিয়ে সৈকতের বালুকাভূমিতে এসে দাঁড়াল। তার পরনে কালো ট্রেঞ্চকোট, ঠোঁটের কোণে এক পৈশাচিক জয়ের হাসি। তান্বীর পরনে একটি ধবধবে সাদা গাউন, যা ভোরের বাতাসে উড়ছে। কিন্তু তার চেহারাটা ফ্যাকাশে, নিষ্প্রাণ।
মেইলস্ট্রোম তার পাশে এসে নিচু স্বরে ফিসফিস করে উঠল। “অভিনয়টা যেন নিখুঁত হয় সোলফ্লেম। মনে রেখো, তোমার চোখের এক ফোঁটা জল জাভিয়ানের বুকের মাঝখানে আমার স্নাইপারের বুলেট ডেকে আনবে। ও যে ঘাড় খুবলে তোমার নাম লিখেছে, আমি সেই নামটা রক্ত দিয়ে ধুয়ে দেব। তুমি চাও তো ও বেঁচে ফিরুক? তবে আজ ওকে এমনভাবে মারো যেন ও আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে না পারে।”
তান্বী কোনো উত্তর দিল না। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে, যেখানে জাভিয়ানের বিশাল যুদ্ধজাহাজটি ভিড়ছে।হঠাৎ জাহাজের সাইরেন বেজে উঠল।
কুয়াশার চাদর ভেদ করে সমুদ্রের বুক চিরে এগিয়ে আসলো এক বিশাল বহর।জাভিয়ানের কমান্ডোদের নিয়ে সাতটি যুদ্ধজাহাজ আজ মেইলস্ট্রোমের সাম্রাজ্য ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু সবচেয়ে সামনের বড় জাহাজটির ডেকে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখলে আজ চেনা বড় দায়।
জাহাজ থেকে নেমে এল এক দীর্ঘদেহী ছায়া। কিন্তু এ কোন জাভিয়ান? মেক্সিকোর সেই শৌখিন, পরিপাটি ব্যাক্তি আজ এক বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ। চোখের নিচে রাতের পর রাত না ঘুমানোর কালচে দাগ, শেভ না করা মুখজুড়ে খসখসে দাড়ির রেখা, আর ফ্যাকাশে ঠোঁটের ওপর অবিন্যস্ত রোম। তার সাদা শার্টের বোতাম খোলা, বুকের কাছে ধুলোবালি মাখা। কিন্তু সবচেয়ে বীভৎস দেখাচ্ছিল তার ঘাড়ের সেই ক্ষতটা—যেখানে রক্তের অক্ষরে খোদাই করা ‘TANBI’ নামটা আজও দগদগে লাল হয়ে জ্বলছে।
সৈকতের বালুর ওপর মেইলস্ট্রোম দাঁড়িয়ে আছে, তার এক হাত তান্বীর হাত শক্ত করে ধরা। দূর থেকে জাহাজের ডেক থেকেই জাভিয়ানের চোখে পড়ল সেই দীর্ঘ পরিচিত চুল। সমুদ্রের বাতাসে উড়ছে তান্বীর রেশমি চুলগুলো।
জাহাজ তটে ভিড়তেই জাভিয়ান পাগলের মতো বালিতে লাফিয়ে নামল। তার পায়ে কোনো জুতো নেই, এলোমেলো চুলে বালু উড়ছে। জাভিয়ান বালিতে পা রেখেই স্তব্ধ হয়ে গেল। সামনেই তার সেই আকাঙ্ক্ষিত জিন্নীয়া। যাকে না পেয়ে সে গত কয়েকদিন সিলিকনের মূর্তিকে জড়িয়ে ধরে পাগল হয়ে দিন কাটিয়েছে, সেই তান্বী আজ তার চোখের সামনে। জাভিয়ানের দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত ঘোর; সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এটা বাস্তব। হারাতে হারাতে ফিরে পাওয়ার সেই তীব্র যন্ত্রণা আর আনন্দ তার চোখের কোণে চকচক করে উঠল।
জাভিয়ান ফিসফিস করে, রুদ্ধশ্বাসে বললো “জিন্নীয়া? তুমি… তুমি সত্যি এখানে আছো আমার সামনে দাঁড়িয়ে?”
জাভিয়ান তান্বীর ঠিক দুই হাত দূরত্বে এসে দাঁড়াল। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তার প্রিয় মুখটার দিকে। যাকে হারানোর শোকে সে নিজেকে তিল তিল করে শেষ করেছে, আজ তাকে ফিরে পেয়ে জাভিয়ান যেন কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। তার হাত দুটো কাঁপছে। সে একবার হাত বাড়িয়ে তান্বীর গাল ছুঁতে চাইল, কিন্তু মেইলস্ট্রোমের উপস্থিতিতে আবার হাত গুটিয়ে নিল।
জাভিয়ানকে এই হালে দেখে তান্বীর হৃদপিণ্ডটা যেন কেউ ছিঁড়ে ফেলল। যে মানুষটা সবসময় নিজের আভিজাত্য নিয়ে থাকত, সে আজ স্রেফ একটা কাঙালের মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে। তান্বীর খুব ইচ্ছে করছিল মেইলস্ট্রোমকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে জাভিয়ানের ওই রক্তাক্ত ঘাড়ে নিজের হাত রাখতে। কিন্তু তখনই তার চোখে পড়ল পাহাড়ের চূড়ায় থাকা সেই লুকায়িত স্নাইপারদের লাল লেজার ডট, যা জাভিয়ানের কপাল বরাবর স্থির হয়ে আছে ইচ্ছে করছিল বলতে— “তুমি এসে গেছো জাভিয়ান, এইতো আমি তোমার কাছেই আর তোমাকে নিজেকে কষ্ট দিতে হবে না।”
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই তান্বীর নজর গেল পাহাড়ের চূড়ায় থাকা ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। সেখানে মেইলস্ট্রোমের স্নাইপাররা তাদের রাইফেলের লাল লেজার ডট জাভিয়ানের কপাল আর বুক বরাবর স্থির করে রেখেছে। সামান্যতম আবেগ দেখালেই জাভিয়ানের শরীরটা বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
মেইলস্ট্রোম এক পৈশাচিক হাসি হেসে তান্বীর হাত আরও শক্ত করে ধরে বললো “কী হলো জাভিয়ান? নিজের স্ত্রীকে চিনতে পারছিস না? নাকি মূর্তির সাথে প্রেম করতে করতে জ্যান্ত মানুষকে ভুলে গেছিস? দেখ, তোর তান্বী আজ আমার বাহুবন্দি। ও তোর ওই বিধ্বস্ত পাগল চেহারাটা দেখে খুব ভয় পেয়েছে।”
জাভিয়ান মেইলস্ট্রোমের কথা শুনছে না। তার চোখ শুধু তান্বীর চোখের গভীরতা মাপছে। সে ভাবছে তান্বী হয়তো এখনই তাকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু তান্বীর মুখ তখন পাথরের মতো শক্ত। সে নিজের সবটুকু ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে জাভিয়ানকে বাঁচানোর জন্য মেইলস্ট্রোমের শেখানো সেই বিষাক্ত নাটক শুরু করার প্রস্তুতি নিল।
তান্বী নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিজের ভেতরকার হাহাকার চেপে ধরল। সে জাভিয়ানের দিকে অত্যন্ত শীতল আর নির্দয় দৃষ্টিতে তাকাল। তান্বী অত্যন্ত নির্দয় আর শীতল গলায় বললো “কেন এসেছেন এখানে? কে আপনাকে আসতে বলেছে এই বিধ্বস্ত পাগল বেশে?”
জাভিয়ান চমকে উঠল। তার চোখের সেই আনন্দ মুহূর্তেই এক গভীর হতাশায় রূপান্তরিত হলো।জাভিয়ান থমকে দাঁড়াল। তার ডিলিউশনাল মস্তিষ্ক এই বরফশীতল কণ্ঠ শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে টলমলে গলায় অস্ফুট স্বরে বলল— “জিন্নীয়া? আমি… আমি তো তোমাকে বাঁচাতে…”
তান্বী তখন বলে উঠলো “বাঁচাতে? নিজেকে দেখুন একবার আয়নায়।আপনি একটা বদ্ধ উন্মাদ! একটা প্লাস্টিকের পুতুলকে আপনি আমি ভেবে আদর করছেন?আপনি কি ভেবেছেন আমি আপনার ওই নোংরা চরিত্রের কথা জানি না? ৯৮ জন মেয়ের সাথে রাত কাটানো এক পিশাচের সাথে আমি ফিরব? কক্ষনো না!”
জাভিয়ানের সারা পৃথিবী যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার চোখের মণি কাঁপছে। তান্বী থামল না, বিষ ঢালার মতো করে বলে চলল—”আমি এখানে স্বেচ্ছায় আছি জাভিয়ান। আমার পাশে যে লোকটা দাড়িয়ে আছে সে আমাকে রানী বানিয়ে রেখেছে। উনি আপনার মতো উম্মাদ নয়, ওনার মধ্যে আভিজাত্য আছে। আমি ওনাকে পছন্দ করি! আমি আপনার ওই বীভৎস চেহারা আর ওই রক্তাক্ত নামটা ঘৃণা করছি! দয়া করে চলে যান এখান থেকে, আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন।”
জাভিয়ান স্তব্ধ হয়ে গেল। তার ঘাড়ের ক্ষতটা দপ দপ করে জ্বলছে, কিন্তু বুকের ভেতরের ক্ষতটা যেন তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি গভীর। সে বড় বড় চোখ করে তান্বীর দিকে তাকিয়ে রইল।
জাভিয়ান ফিসফিস করে বললো “তুমি… তুমি আমাকে ঘৃণা করো জিন্নীয়া?“
মেইলস্ট্রোম এক পৈশাচিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।”শুনলি তো জাভিয়ান? জ্যান্ত তান্বী এখন আমার। তুই তোর ওই প্লাস্টিকের পুতুলের কাছে মেক্সিকোতে ফিরে যা। ওটাই তোর যোগ্য সঙ্গি।”
সৈকতের তপ্ত বালির ওপর টানটান উত্তেজনা। মেইলস্ট্রোম যখন এক পৈশাচিক উল্লাসে তান্বীর কোমরে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে টেনে নিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই জাভিয়ানের ভেতরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরিটা ফেটে পড়ল। তান্বীর মুখে বলা সেই বিষাক্ত কথাগুলো জাভিয়ানের কান পর্যন্ত পৌঁছালেও, তার মস্তিষ্ক তা গ্রহণ করেনি। তার জিন্নীয়াকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে—এটা জাভিয়ানের ডিএনএ-তে নেই।
মেইলস্ট্রোমের হাতের আঙুল তান্বীর কোমর স্পর্শ করা মাত্রই জাভিয়ান এক অমানুষিক ক্ষিপ্রতায় এগিয়ে এল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাভিয়ান তার শার্টের আস্তিনে লুকিয়ে রাখা একটি ধারালো স্টিলের ‘ছুড়ি’ বের করে মেইলস্ট্রোমের কব্জিতে গেঁথে দিল।
জাভিয়ান এক ভয়ংকর, গুমরে ওঠা স্বরে বললো “তোর সাহস কী করে হয় আমার স্ত্রীকে ছোঁয়ার? এই হাত দিয়ে ওকে ছুঁয়েছিস না? আজ এই হাতটাই তোর শরীর থেকে আলাদা করব!”
মেইলস্ট্রোম যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। জাভিয়ান থামল না; সে মেইলস্ট্রোমের কলার ধরে এক ঝটকায় তাকে তান্বীর থেকে দূরে সরিয়ে দিল এবং সজোরে এক লাথি মারল মেইলস্ট্রোমের বুকে তারপর বললো “তান্বী কী বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না! কিন্তু তোর নোংরা হাত ওর গায়ে লাগবে—এটা দেখার জন্য জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী বেঁচে নেই!”
মেইলস্ট্রোম বালিতে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে চিৎকার করে আদেশ দিল “ফায়ার! ওদের সবাইকে শেষ করে দাও!”
মেইলস্ট্রোমের আদেশের সাথে সাথেই পাহাড়ের ওপর থেকে স্নাইপাররা গুলি শুরু করল। কিন্তু জাভিয়ান আগে থেকেই তৈরি ছিল। তার রণতরীগুলো থেকে কমান্ডোরা দ্রুত গতিতে বোট নিয়ে সৈকতে আছড়ে পড়ল। ‘ব্ল্যাক-স্কোয়াড’ তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে মেইলস্ট্রোমের রক্ষীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের আকাশ এখন বারুদের ধোঁয়ায় অন্ধকার।
জাভিয়ান মেইলস্ট্রোমের ওপর চড়াও হলো। দুজনের মধ্যে শুরু হলো এক মল্লযুদ্ধ। জাভিয়ান তার হাতের সেই রক্তাক্ত ছুড়ি দিয়ে মেইলস্ট্রোমের কাঁধে আঘাত করল, আর মেইলস্ট্রোম তার পকেট থেকে ড্যাগার বের করে জাভিয়ানের দিকে চালাল।
জাভিয়ান তখন বললো “তুই ভেবেছিস ও ঘৃণা করলে আমি ওকে তোর কাছে রেখে চলে যাব? ও আমার জীবন, ও আমার উম্মাদনা! ওকে আমি নরক থেকেও ছিনিয়ে আনব!”
চারপাশে লাশের স্তূপ জমছে। জাভিয়ানের লোকেরা মেইলস্ট্রোমের দুর্ভেদ্য স্নাইপার পোস্টগুলো গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে। বালির ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তের নদী।
তান্বী তখন মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাথর হয়ে গেছে। সে দেখল জাভিয়ান উন্মাদের মতো মেইলস্ট্রোমকে মারছে। জাভিয়ানের ঘাড়ের ক্ষতটা থেকে রক্ত চুঁইয়ে তার সাদা শার্ট ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু জাভিয়ানের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তার চোখে তখন শুধু প্রতিশোধের আগুন।
তান্বী চিৎকার করে বললো “জাভিয়ান! থামুন! আপনি মরে যাবেন! প্লিজ, ফিরে যান!”
জাভিয়ান মেইলস্ট্রোমের গলা টিপে ধরে বালিতে আছাড় মারল। তার মুখটা তান্বীর দিকে ফেরাল। তার চোখে তখন এক আদিম প্রেম আর জেদ। “মরে আমি তখনই গেছি জিন্নীয়া, যখন তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে ঘৃণা করো! কিন্তু এই শয়তানের কবলে তোমাকে রেখে আমি যমরাজকেও আমার আত্মা দেব না!”
মেইলস্ট্রোমের ব্যাকআপ ফোর্স তখন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল। পুরো সৈকত এখন এক জীবন্ত শ্মশান। রায়হান তার দলবল নিয়ে জাভিয়ানকে কভার দেওয়ার জন্য গোলার বৃষ্টি বইয়ে দিচ্ছে।
রণক্ষেত্র তখন এক বীভৎস শ্মশান। বাতাসে বারুদের কটু গন্ধ আর চারদিকে লুটিয়ে থাকা লাশের স্তূপের মাঝে জাভিয়ান দাঁড়িয়ে আছে এক রক্তাক্ত দানবের মতো। মেইলস্ট্রোমের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য সে যখন পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরল, ঠিক তখনই এক ঝড়ের বেগে তান্বী মাঝখানে এসে দাঁড়াল। মেইলস্ট্রোমকে আড়াল করে সে সজোরে জাভিয়ানের রক্তাক্ত বুকে এক ধাক্কা মারল।
জাভিয়ান প্রত্যাশা করেনি তার জিন্নীয়া তাকে এভাবে সরিয়ে দেবে। সে টলতে টলতে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। তার চোখে অসীম বিস্ময় আর গভীর হাহাকার।
তান্বী চিৎকার করে, চোখে জল কিন্তু কণ্ঠে বজ্রের কঠোরতা নিয়ে বললো “থামুন জাভিয়ান! অনেক হয়েছে, আর না! আপনি কী ভাবছেন? আপনি এখানে এসে রক্তারক্তি করলেই কি আমি আপনার সাথে হাসি মুখে চলে যাব?”
জাভিয়ান হাঁপাচ্ছিল। তার ঘাড়ের সেই ক্ষত থেকে তাজা রক্ত গড়িয়ে সাদা শার্টের বুক ভিজে গেছে। সে অস্ফুট স্বরে কাঁপা গলায় বলল “জিন্নীয়া? আমি… আমি তো তোমাকে নিতে এসেছি। দেখছো না এই শয়তানটা তোমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে রেখেছে এখানে?”
তান্বী কঠোর গলায় বললো “কেউ আমাকে বন্দি করেনি। যেদিন আপনি আমাকে এয়ারপোর্টে রেখে চলে গিয়েছিলেন, যেদিন আপনার চোখে আমি দেখেছি আমাদের সব সম্পর্ক শেষ—ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার ওপর আপনার সব অধিকার শেষ হয়ে গেছে! আপনি কে আমাকে উদ্ধার করার? আমি আপনার কেনা কোনো সম্পত্তি নই যে আপনি যখন খুশি আমাকে খাঁচায় ভরবেন আর যখন খুশি মুক্ত করবেন!”
জাভিয়ান পাথরের মতো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার হাতের পিস্তলটা ধীরে ধীরে নিচু হয়ে ঝুলে পড়ল। চারপাশের লড়াই তখন থমকে গেছে।
তান্বী আবার ও বললো “আমার নিজস্ব স্বাধীনতা আছে জাভিয়ান। আমি একজন রক্ত-মাংসের মানুষ, আপনার বানানো কোনো সিলিকন মূর্তি নই যে আপনার হুকুম মতো চলব। আমি সেই স্বাধীনতা থেকেই আজ আপনাকে বলছি—চলে যান এখান থেকে! আমি আপনার সাথে ফিরব না। আমি এই দ্বীপে ওনার সাথেই থাকব, কারণ অন্তত উনি আমাকে আপনার মতো মানসিক যন্ত্রণার নরকে ফেলে দেয়নি।”
পুরো সৈকতে তখন কবরের নিস্তব্ধতা। জাভিয়ানের ব্ল্যাক-স্কোয়াড আর মেইলস্ট্রোমের রক্ষীরাও বন্দুক নামিয়ে ফেলেছে। জাভিয়ান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তান্বীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার মস্তিষ্ক নিতে পারছে না যে, যার জন্য সে নিজের শরীর আর বিবেক বিসর্জন দিয়েছে, সেই জিন্নীয়া আজ তাকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।
জাভিয়ান ভাঙা গলায় “তুমি… তুমি সত্যি বলছো জিন্নীয়া? এই ঘৃণা কি সত্যি?”
তান্বী বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগ্নেয়গিরি চেপে রেখে বললো “হ্যাঁ, সত্যি! আপনার এই বীভৎস চেহারা, এই পাগলামি—এগুলো দেখে আমার ভালোবাসা জাগে না জাভিয়ান, আমার ঘৃণা জাগে! আপনি এখন স্রেফ একটা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ। যান এখান থেকে! আমার জীবন থেকে চিরতরে মুছে যান!”
তান্বী জানত, মেইলস্ট্রোমের স্নাইপাররা তখনো পাহাড়ের আড়াল থেকে জাভিয়ানের কপাল বরাবর লাল ডট স্থির করে রেখেছে। সে যদি এখন জাভিয়ানকে না তাড়ায়, তবে মেইলস্ট্রোম ওকে সেখানেই শেষ করে দেবে। জাভিয়ানের জীবন বাঁচাতে তান্বী আজ নিজের আত্মাকেই মিথ্যের জালে বলি দিল।
জাভিয়ান দীর্ঘ সময় তান্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ এক উন্মাদ হাসি হেসে উঠল সে। সেই হাসিতে কোনো আনন্দ ছিল না, ছিল এক নিঃস্ব মানুষের শেষ বিলাপ। সে ধীরে ধীরে পিছু হটতে লাগল তার বোটের দিকে। “ঠিক আছে জিন্নীয়া… অধিকার যখন শেষ, তখন এই জাভিয়ানও শেষ। তবে মনে রেখো, আমি ফিরে যাচ্ছি ঠিকই… কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে নয়, তোমাকে তোমার এই মিথ্যে স্বাধীনতার নরকে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি।”
জাভিয়ান তার পিস্তলটা বালির ওপর আছড়ে ফেলে দিল। টলতে টলতে সে বোটের দিকে এগিয়ে গেল। রায়হান দৌড়ে এসে তাকে ধরতে চাইলে জাভিয়ান তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল।
মেইলস্ট্রোম মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে এক পৈশাচিক জয়ের হাসি হাসল। সে জানত, তান্বী আজ জাভিয়ানকে স্রেফ তাড়িয়ে দেয়নি, বরং তাকে মানসিকভাবে হত্যা করে এক জীবন্ত লাশে পরিণত করেছে।
সমুদ্রের বুক চিরে জাভিয়ানের বিশালাকার যুদ্ধজাহাজটি যখন দ্বীপের উপকূল ছেড়ে অনেকখানি দূরে চলে এল, তখন হঠাৎ আকাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটি হেলিকপ্টারের প্রচণ্ড গুঞ্জন শোনা গেল। মাঝ আকাশেই জাহাজ থামানো হলো। জাভিয়ান ধীরপায়ে জাহাজের ডেক থেকে হেলিকপ্টারে গিয়ে উঠল। তার শরীরে সেই ধুলোবালি মাখা রক্তাক্ত শার্ট, চোখের নিচে অনিদ্রার কালো দাগ, আর ঘাড়ের সেই ‘TANBI’ ক্ষতটা রোদে দগদগে লাল হয়ে জ্বলছে।
হেলিকপ্টারটি যখন উচ্চতা বাড়াল, জাভিয়ান জানালার কাঁচ দিয়ে নিচে তাকিয়ে রইল। সমুদ্রের সৈকতে একটি বিন্দুর মতো তান্বীকে দেখা যাচ্ছে, যাকে মেইলস্ট্রোম বিজয়ী বেশে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের প্রাসাদের দিকে।
ঠিক তখনই এক বিকট শব্দে পুরো সমুদ্র এলাকা কেঁপে উঠল। নিচ থেকে আগুনের এক বিশাল কুণ্ডলী আকাশে আছড়ে পড়ল। জাভিয়ানের সেই বিশাল যুদ্ধজাহাজটি মুহূর্তের মধ্যে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে সমুদ্রের গর্ভে তলিয়ে যেতে লাগল।
রায়হান হেলিকপ্টারের ভেতরে বসে আঁতকে উঠল। সে আতঙ্কিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, “স্যার! আমাদের জাহাজ ব্লাস্ট হয়েছে! মেইলস্ট্রোম… ওই শয়তানটা জাহাজে বোমা ফিট করেছিল! ও আপনাকে মেরেই ফেলার জন্য এতো বড় কারসাজি করলো শেষমেশ!”
জাভিয়ান কোনো বিচলিত হলো না। সে অত্যন্ত শান্ত গলায় ললাটের ঘাম মুছে বলল, “আই নিউ ইট।”
রায়হান স্তব্ধ হয়ে জাভিয়ানের দিকে তাকাল। “জানতেন? মানে? কীভাবে সম্ভব স্যার?”
জাভিয়ান তার সেই শীতল, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি সমুদ্রের দিকে নিবদ্ধ রেখেই বলল, “মেইলস্ট্রোম যদি দাবার এক গুটি চালে, তবে আমি দুই পদক্ষেপ এগিয়ে থাকি রায়হান। ও ইচ্ছে করলে আমাকে সৈকতেই স্নাইপার দিয়ে মেরে ফেলতে পারত, কিন্তু ও তা করেনি। কারণ ও চেয়েছিল তান্বী যেন নিজ হাতে আমাকে মানসিকভাবে হত্যা করে। ও চেয়েছিল আমার পরাজয়টা যেন আমার ভালোবাসার মানুষের হাত দিয়েই হয়। আর যখন লড়াই চলছিল, তখনই ওর লোকেরা জাহাজের নিচে ‘হাই-পাওয়ারড আরডিএক্স (RDX)’থার্মোবারিক বোমা’ ফিট করে এসেছিল। ও ভেবেছে আমি জাহাজে পুড়ে ছাই হয়ে যাব।”
রায়হান হতবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে করুণ স্বরে বলল, “কিন্তু স্যার… মিস গজদন্তিনী এটা কী করলো? আপনি যার জন্য নিজের শরীর শেষ করলেন, যার জন্য মূর্তিকে নিয়ে পাগল হয়ে রইলেন—সে আপনাকে সবার সামনে ওভাবে অপমান করল? সে বলল সে আপনাকে ঘৃণা করে!”
জাভিয়ান হঠাৎ এক রহস্যময় আর ক্রুর হাসি হাসল। সেই হাসিতে কোনো কষ্ট নেই, বরং আছে এক অদ্ভুত তৃপ্তি। “ও কিছুই করেনি রায়হান। ও হচ্ছে আমার সেই অপদার্থ বউ! বড্ড বোকা আর বড্ড সরল। আর এই কারণেই সবাই ওকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। ও ভেবেছে মেইলস্ট্রোমের কথা মতো আমাকে ওসব জঘন্য কথা বললে আমি বিশ্বাস করে চলে যাব এবং আমার জীবন বেঁচে যাবে। ও আমায় বাঁচাতে চেয়েছিল রায়হান।”
রায়হান অবাক হয়ে বলল, “মানে? আপনি ওর কথা বিশ্বাস করেননি?”
জাভিয়ান হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে নিচে মেইলস্ট্রোমের সুরক্ষিত প্রাসাদের দিকে ইশারা করল। “ওর বলা প্রত্যেকটা শব্দের টোন আমি বুঝতে পারি রায়হান। ওর চোখের ভাষা পড়তে আমার এক সেকেন্ডও লাগে না। ওর মুখ ঘৃণা ঝরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওর চোখের প্রতিটি অশ্রুবিন্দু আমাকে মিনতি করছিল যেন আমি এখান থেকে চলে যাই। ও আমায় ভালোবেসেই আজ সবার সামনে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বোকা মেয়েটা জানেই না—ওর চেয়েও আমি ওকে অনেক বেশি চিনি।”
জাভিয়ানের চোখে তখন এক ধ্বংসাত্মক রূপ ফুটে উঠল। সে তার ঘাড়ের সেই ক্ষততে হাত দিয়ে জোরে একবার ঘষা দিল। “মেইলস্ট্রোম ভেবেছে ও জিতে গেছে? ও তান্বীকে দিয়ে আমাকে আঘাত দিয়ে আমার শেষ চিহ্নটুকু মুছে দিয়েছে? না! আজ তান্বীর ওই মিথ্যে ঘৃণা আমাকে আরও ভয়ংকর করে তুলল। এখন আমার হারাবার আর কিছুই নেই। মেইলস্ট্রোম এবার দেখবে, যখন জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীর ডিলিউশন আর রিয়ালিটি এক হয়ে যায়, তখন পৃথিবী কতটা রক্তাক্ত হয়। আমরা ফিরব রায়হান… তবে এবার জাভিয়ান হয়ে নয়, মেইলস্ট্রোমের আজরাইল হয়ে।”
.
.
.
প্রাসাদের বিশাল হলরুমে তখন এক থমথমে নীরবতা। মেইলস্ট্রোম হাতের ট্যাবলেটটা সজোরে দেয়ালে ছুড়ে মারল। স্ক্রিনটা চুরমার হয়ে দপ দপ করে নিভে গেল, কিন্তু জাভিয়ানের বেঁচে থাকার সেই দুঃসংবাদ মেইলস্ট্রোমের মাথায় হাতুড়ির মতো পিটছে। জাহাজের ধ্বংসস্তূপ থেকে আকাশপথে জাভিয়ানের এই পলায়ন প্রমাণ করে দিয়েছে যে—জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীকে ধ্বংস করা যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল, সে তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি দুর্ধর্ষ।
ভ্যালেরিয়া দরজার কাছে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখের জল এখন শুকিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠেছে। সে যখন শুনল মেইলস্ট্রোম জাভিয়ানের জাহাজে পারমাণবিক বোমা ফিট করেছিল, তখন তার ভাইয়ের প্রতি শেষ অবশিষ্ট মায়াটাও কর্পূরের মতো উড়ে গেল।
মেইলস্ট্রোম উন্মত্তের মতো অস্থির পায়চারি করতে করতে বললো “কীভাবে পারল ও? শয়তানটা কি যমরাজের সাথে চুক্তি করে এসেছে? ভ্যালেরিয়া, তুমি কি বুঝতে পারছো? ও এখন এক আহত বাঘের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক!”
ভ্যালেরিয়া গর্জনে করে বললো “তুমি কি জানোয়ার? তুমি জাভিয়ানকে ওভাবে মারতে চেয়েছিলে? তুমি জানতে আমি ওকে কতটা ভালোবাসি! তুমি শুধু ওকে দ্বীপ থেকে তাড়াতে চাওনি, তুমি চেয়েছিলে ও যেন সমুদ্রের মাঝখানে পুড়ে ছাই হয়ে যায়!”
মেইলস্ট্রোম বিরক্ত হয়ে বললো “ভ্যালেরিয়া, নিজের সেন্স ঠিক করো! ও বেঁচে আছে মানে আমাদের সবার বিপদ! ও ফিরে আসবে আবার ও!”
ভ্যালেরিয়া কোনো উত্তর দিল না। সে কোনো চিৎকার করল না, আগের মতো তর্কেও জড়াল না। তার এই আকস্মিক নিস্তব্ধতা যেন হাহাকারের চেয়েও বেশি ভয়ংকর। সে স্থির দৃষ্টিতে জানালার ওপাশে থাকা উত্তাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানল, মেইলস্ট্রোম আজ শুধু জাভিয়ানকে মারতে চায়নি, সে জাভিয়ানের প্রতি ভ্যালেরিয়ার যেটুকু দুর্বলতা ছিল, তাকেও অপমান করেছে।
মেইলস্ট্রোম ভেবেছিল জাভিয়ানকে নিঃশেষ করলে তান্বী তার হবে, আর ভ্যালেরিয়া শান্ত হবে। কিন্তু সে এক মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে।
ভ্যালেরিয়া মনে মনে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা করল। তার দৃষ্টি তখন প্রাসাদের ওই ঘরের দিকে, যেখানে তান্বীকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সে মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল—”ব্রো, তুমি ভেবেছিলে জাভিয়ানকে মেরে তুমি জিতবে। কিন্তু তুমি জাভিয়ানকে মারতে পারোনি, উল্টো আমার ভেতরের বোনটাকে আজ মেরে ফেলেছ। তুমি যদি আমার ভালোবাসাকে এভাবে আগুনে পোড়াতে পারো, তবে আমিও তোমার অহংকার এই দ্বীপ থেকে মুছে দেব। জাভিয়ান ফিরে আসবে কি না আমি জানি না, কিন্তু জাভিয়ানের তান্বীকে আমি এখান থেকে বের করেই ছাড়ব। যে তান্বীকে তুমি ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছো, সেই তান্বীই হবে তোমার পতনের কারণ।”
ভ্যালেরিয়া আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না। সে কোনো কথা না বলে ধীর পায়ে হলরুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত শান্ত, অথচ দৃঢ়। সে এখন আর মেইলস্ট্রোমের অনুগত বোন নয়; সে এখন এক আহত হৃদয়ের বিশ্বাসঘাতক, যে তার নিজের ভাইয়ের সাজানো বাগান তছনছ করে দেওয়ার শপথ নিয়েছে।
অন্যদিকে, তান্বী তখন নিজের ঘরের মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে জানালার কাঁচ দিয়ে দিগন্তের ওই ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখছিল। তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। সে জানে না জাভিয়ান এখন আকাশে, কিন্তু সে এক অদ্ভুত টান অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে জাভিয়ান তাকে এই অন্ধকারে একা রেখে কোথাও যেতে পারে না।
প্রাসাদের করিডোর দিয়ে ভ্যালেরিয়া যখন হেঁটে যাচ্ছিল, তার মুখে তখন এক বিষাক্ত হাসি। সে জানে, জাভিয়ান যখন ফিরবে, তখন সে একা আসবে না। আর সেইদিন ভ্যালেরিয়া নিজে প্রাসাদের সব গোপন দরজা খুলে দেবে জাভিয়ানের জন্য।
তান্বী তখনো জানত না যে সমুদ্রের বুকে কী ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। তার কাছে শুধু ছিল জাভিয়ানের চলে যাওয়ার বিষণ্ণতা।
দ্বীপের আকাশে আজ নিরেট অন্ধকার। তান্বী তার ঘরের জানালার পাশে মেঝেতে প্রাণহীন মূর্তির মতো বসে ছিল। জাভিয়ানকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে তার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেছে। সে ভাবছিল জাভিয়ান হয়তো এখন অভিমানে নীল হয়ে মাঝসমুদ্রে তার জাহাজে বসে আছে, কিংবা মেক্সিকোর পথে পা বাড়িয়েছে। সে জানত না, কয়েক ঘণ্টা আগে ওই শান্ত সমুদ্রের বুকে এক লেলিহান নরক নেমে এসেছিল।
হঠাৎ ঘরের ভারী কাঠের দরজাটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল। কোনো আলো ছাড়াই ছায়ার মতো ঘরে ঢুকল ভ্যালেরিয়া। তার পদশব্দে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। তান্বী মাথা তুলল না, শুধু অস্ফুট স্বরে বলল— “এখন আর কী নিতে এসেছেন আপা? যা ছিল সব তো কেড়ে নিয়েছেন। জাভিয়ান তো চলে গেছে।”
ভ্যালেরিয়া কোনো ভূমিকা করল না। সে তান্বীর একদম সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। অন্ধকারেও ভ্যালেরিয়ার চোখ দুটো প্রতিহিংসায় জ্বলজ্বল করছিল।
ভ্যালেরিয়া গম্ভীর আর চাপা গলায় বললো “মেইলস্ট্রোম ওকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল।মেইলস্ট্রোম জাভিয়ানের জাহাজে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।”
কথাটা শোনামাত্রই তান্বীর সারা শরীর পাথর হয়ে গেল। তার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। সে বড় বড় চোখ করে ভ্যালেরিয়ার দিকে তাকাল, যেন তার কথাগুলো হজম করতে সময় লাগছে।
তান্বী ফিসফিস করে, আতঙ্কে বললো “বিস্ফোরণ? মানে? জাভিয়ান… জাভিয়ানের জাহাজ…”
ভ্যালেরিয়া বললো “হ্যাঁ তান্বী। পুরো জাহাজটা এখন সমুদ্রের তলায় ছাই হয়ে গেছে। মেইলস্ট্রোম চেয়েছিল জাভিয়ান যেন কোনোদিন মেক্সিকোতে ফিরতে না পারে। ও তোমাকে বলেছিল জাভিয়ানকে তাড়িয়ে দিতে যাতে ও নিশ্চিন্তে ওকে মারতে পারে। ও তোমাকে ব্যবহার করেছে তান্বী।”
তান্বীর ভেতরটা যেন এক নিমিষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সে ভাবল, সে জাভিয়ানকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে বলল, অথচ সেই মিথ্যেই জাভিয়ানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল। এক অসহ্য যন্ত্রণায় সে ডুকরে কেঁদে উঠতে চাইল, কিন্তু ভ্যালেরিয়া শক্ত করে তান্বীর মুখ চেপে ধরল।”চুপ! একদম চিৎকার করবে না। মেইলস্ট্রোমের পাহারাদাররা বাইরেই আছে। আর শোনো সব এখানেই শেষ নয়। মেইলস্ট্রোম যা চেয়েছিল তা হয়নি। জাভিয়ান ওর চেয়েও চালাক। জাহাজটা বিস্ফোরিত হওয়ার ঠিক কয়েক মিনিট আগে ও হেলিকপ্টারে করে ওখান থেকে সরে গেছে। জাভিয়ান বেঁচে আছে তান্বী! ও মরেনি!”
তান্বীর চোখে মুহূর্তেই প্রাণের সঞ্চার হলো। হাহাকারের মাঝখানে এই খবরটা যেন মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়ল। সে ভ্যালেরিয়ার হাত দুটো খপ করে ধরে ফেলল। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।”সত্যি বলছো আপা? তুমি মিথ্যে বলছো না তো? ও… ও বেঁচে আছে?”
ভ্যালেরিয়া বললো “মেইলস্ট্রোমের রাডারে ওর হেলিকপ্টার ধরা পড়েছে। জাভিয়ান বেঁচে আছে এবং ও এখন আরও ভয়ংকর। মেইলস্ট্রোম আজ শুধু জাভিয়ানকে মারতে চায়নি তান্বী, সে আমাদের দুজনের আবেগ নিয়েই খেলেছে। আমি জাভিয়ানকে ভালোবাসতাম ঠিকই, কিন্তু আমার ভাই যে কাজ করেছে—তারপর ওর প্রতি আমার আমার আর কোনো মায়া নেই।”
ভ্যালেরিয়া তান্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা করল। তার কণ্ঠে তখন কোনো ঈর্ষা নেই, আছে কেবল বিদ্রোহের সুর। “মেইলস্ট্রোম ভেবেছে ও এই দ্বীপের একচ্ছত্র সম্রাট। কিন্তু ও জানে না, ওর দুর্গের দেয়াল ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ছে। আমি তোমাকে এখান থেকে বের করে দেব তান্বী।আমি আর ওর অনুগত বোন নই, আমি এখন ওর ধ্বংসের ছায়া।”
.
.
.
পরেরদিন রাতে দ্বীপের ওপর আজ মেঘলা আকাশ, চাঁদের আলোও যেন মেইলস্ট্রোমের পাপ ঢাকতে আজ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। প্রাসাদের ভেতর পাহারাদারদের কড়া পাহারা, কিন্তু তাদের কেউই জানত না যে ভেতরে ভেতরে মেইলস্ট্রোমের নিজের বোনই এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছে।
ভ্যালেরিয়া সব আয়োজন সেরে রেখেছিল। মাঝরাতে সে তান্বীর ঘরে ঢুকল। দুজনের মুখেই তখন বিশেষ ধরনের অক্সিজেন মাস্ক। ভ্যালেরিয়ার হাতে একটি ছোট ডিভাইস। ভ্যালেরিয়া ফিসফিস করে বললো “তান্বী, তৈরি হও। আমি এসি ভেন্টিলেশন দিয়ে পুরো প্রাসাদে একটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নিউরোটক্সিন গ্যাস ছড়িয়ে দিয়েছি। আগামী পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেইলস্ট্রোমের সব পাহারাদার গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে। আমাদের হাতে সময় খুব কম।”
প্রাসাদের ভেতরে তখন এক অদ্ভুত ছমছমে পরিবেশ। সিলিংয়ের ভেন্টিলেটর থেকে বের হওয়া সেই নীলচে বিষাক্ত গ্যাস পুরো করিডোরে কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে পাহারাদাররা একে একে ঢলে পড়ছে, যেন কোনো অদৃশ্য জাদুকর তাদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। ভ্যালেরিয়া আর তান্বী নিঃশব্দে ছাদের দিকে এগোচ্ছিল। তান্বীর চোখেমুখে আতঙ্ক, সে বারবার পেছনে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ করিডোরের বাঁক ঘুরতেই তাদের সামনে এসে দাঁড়াল মেইলস্ট্রোমের দুই ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। তারা মাক্স পরে থাকায় গ্যাসের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। তাদের হাতে চকচকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল।
রক্ষি তখন বললো “মিস ভ্যালেরিয়া! আপনি এখানে কী করছেন? আর এই মেয়েটিকে নিয়ে…”
কথা শেষ করার আগেই ভ্যালেরিয়া বিদ্যুতের গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তান্বী স্রেফ স্তব্ধ হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল। সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি যে এই শান্ত, সুন্দরী ভ্যালেরিয়া এত ভয়ংকর হতে পারে।
ভ্যালেরিয়া প্রথমে এক রক্ষীর রাইফেলের নলের ওপর লাথি মেরে সেটাকে নিচের দিকে নামিয়ে দিল এবং চোখের পলকে নিজের বুট থেকে একটা ছোট ড্যাগার বের করে তার কাঁধে গেঁথে দিল। অন্য রক্ষীটি গুলি চালাতে উদ্যত হতেই ভ্যালেরিয়া নিচু হয়ে এক ঘূর্ণি লাথি (Roundhouse kick) মারল তার পায়ে। রক্ষীটি ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়তেই ভ্যালেরিয়া তার মাথাটা দেওয়ালে সজোরে ঠুকে দিল।
পুরো লড়াইটা শেষ হতে সময় লাগল মাত্র তিরিশ সেকেন্ড। করিডোরে এখন দুই রক্ষী নিথর হয়ে পড়ে আছে। ভ্যালেরিয়া খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার অবিন্যস্ত চুলগুলো ঠিক করল, যেন সে কোনো লড়াই নয়, বরং একটা ছোটখাটো ব্যায়াম শেষ করল।
তান্বী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো “আপা আপনি… আপনি এভাবে লড়াই করতে পারেন? আমি তো ভাবতেও পারিনি আপনি এত শক্তি রাখেন!”
তান্বীর চোখে বিস্ময় আর মুগ্ধতা। সে দেখছিল ভ্যালেরিয়ার প্রতিটা মুভমেন্ট ছিল একদম নিখুঁত, কোনো পেশাদার খুনিও বোধহয় এতটা ক্ষিপ্র হতে পারত না।
ভ্যালেরিয়া ম্লান হেসে বললো “মেইলস্ট্রোমের বোন হতে গেলে শুধু আভিজাত্য থাকলে চলে না তান্বী, আত্মরক্ষার কৌশলটাও রক্তে থাকতে হয়। জাভিয়ানকে পেতে চাইলে তোকে শুধু সাহসী হলেই চলবে না, শিখতে হবে কীভাবে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। চল, সময় ফুরিয়ে আসছে!”
অবশেষে তারা ছাদের একদম কিনারে এসে দাঁড়াল। সামনেই সেই বিশাল সুইচ পাইপ, যা অন্ধকারের অতলে নেমে গেছে। নিচে সমুদ্রের গর্জনে কান পাতা দায়। বিশাল ওই উচ্চতা আর পাইপটার দিকে তাকাতেই তান্বীর মাথা ঘুরে উঠল। তার দীর্ঘদিনের পুরোনো ব্যাধি—এক্রোফোবিয়া (উচ্চতা ভীতি) তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।
তান্বী থরোথরো কাঁপা গলায় পিছিয়ে গিয়ে বললো “আপা, আমি পারব না! আমার খুব ভয় হচ্ছে… মাথা ঘুরছে! আমি এই উঁচুতে থেকে নিচে তাকাতে পারছি না!”
তান্বী দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। তার পা যেন অবশ হয়ে আসছে। ভ্যালেরিয়া তান্বীর সামনে এসে দাঁড়াল, তার চোখে তখন এক কঠোর কাঠিন্য। সে তান্বীর দুই কাঁধ শক্ত করে ধরল। “শোন তান্বী! জাভিয়ানের প্রতি তোর ভালোবাসা কি তোর এই সাধারণ একটা ফোবিয়ার চেয়েও কম? জাভিয়ান যদি তোকে ভালোবেসে নিজের শরীরটা কসাইয়ের মতো খুবলে তোর নাম লিখতে পারে, তোকে বাঁচাতে এতোকিছু করতে পারূ তবে তুই তার কাছে পৌঁছানোর জন্য সামান্য উচ্চতাকে জয় করতে পারবি না? আজ প্রমাণ কর কোনটার জোর বেশি—তোর ভালোবাসা নাকি তোর এই ফোবিয়া?”
ভ্যালেরিয়ার কথাগুলো চাবুকের মতো তান্বীর কানে বাজল। তান্বী চোখ বন্ধ করে জাভিয়ানের সেই রক্তাক্ত ঘাড় আর তার সেই আকুল দৃষ্টির কথা ভাবল।
ভ্যালেরিয়া পাইপটার সামনে দাঁড়িয়ে তান্বীর থরথর করে কাঁপতে থাকা হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিল। তান্বীর চোখে তখন ছাদ থেকে নিচে তাকানোর আতঙ্কে অন্ধকার নেমে আসছে।
ভ্যালেরিয়া অত্যন্ত শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললো “শোন তান্বী, নিচে তাকাবি না। যখন নিচে তাকাবি, তখন উচ্চতা তোকে গিলে খেতে চাইবে। তোর চোখ থাকবে শুধু আমার ওপর আর তোর এই হাত দুটোর ওপর। মনে রাখবি, এই পাইপটা এখন তোর আর জাভিয়ানের মাঝখানের একমাত্র সেতু।”
ভ্যালেরিয়া তান্বীকে পাইপ ধরার সঠিক কায়দা শিখিয়ে দিতে লাগল। “দুই হাত দিয়ে পাইপটা জাপ্টে ধরবি না, বরং হুকের মতো করে আটকে রাখবি। শরীরের সব ভার হাতের ওপর দিবি না, তোর পায়ের ওপর ভরসা রাখবি। পাইপের গায়ে পা দিয়ে চাপ দিবি আর হাত দিয়ে শুধু ব্যালেন্স করবি। প্রতিটা ইঞ্চিতে তুই যখন নিচে নামবি, মনে করবি তুই জাভিয়ানের বুকের আরও কাছে যাচ্ছিস।”
তান্বী কাঁপছিল। ভ্যালেরিয়া তখন তান্বীর কপালে নিজের কপাল ঠেকাল। “একবার ভাব তান্বী, জাভিয়ান যদি এখন এই নিচে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে থাকত, তুই কি ঝাঁপ দিতিস না? আজ ভাব ওই অন্ধকারের শেষে ও-ই দাঁড়িয়ে আছে। তোর এক্রোফোবিয়া বড় নাকি জাভিয়ানের প্রতি ওই পাগলামিটা বড়? আজ প্রমাণ কর যে তুই শুধু জাভিয়ানের ভালোবাসা’ নোস, তুই তার যোগ্য জীবনসঙ্গিনী।”
ভ্যালেরিয়ার কথাগুলো যেন তান্বীর কানে মন্ত্রের মতো কাজ করল। সে চোখ বন্ধ করে একবার জাভিয়ানের সেই বিধ্বস্ত চেহারার কথা ভাবল—যে জাভিয়ান তার জন্য নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে।
তান্বী দাঁতে দাঁত চেপে বললো “আমি পারব আপা। জাভিয়ানের জন্য আমি এই নরক থেকে নিচে ঝাঁপ দিতেও রাজি।”
তান্বী ভ্যালেরিয়ার শেখানো কায়দায় পাইপটা ধরল। যখন সে প্রথম পা বাড়াল, তার পৃথিবীটা দুলছিল। কিন্তু সে আর নিচে তাকাল না। সে মনে মনে জাভিয়ানের নাম জপতে জপতে নিচে নামতে শুরু করল। ভ্যালেরিয়া তার ঠিক ওপরে থেকে তাকে গাইড করতে লাগল।
অবশেষে তারা সেই নিচের ছাদটাতে পৌঁছাল। তান্বী যখন শক্ত জমিতে পা রাখল, তার বুকটা তখন হাপরের মতো ওঠানামা করছে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে তখন এক বিজয়ী হাসি। সে আজ তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়কে জয় করেছে শুধু একজনের জন্য।
ভ্যালেরিয়া তান্বীর পিঠ চাপড়ে বললো “সাবাস! এবার ওই তারটা ধরে স্লাইডিং করতে হবে। তৈরি তো?”
তান্বী মাথা নাড়ল। সে এখন আর সেই দুর্বল তান্বী নেই; ভালোবাসার টানে সে এখন যে কোনো অগ্নিপরীক্ষা দিতে প্রস্তুত।কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই। ভ্যালেরিয়া তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ছাদের এক কোণে, যেখানে একটি বিশালাকার লোহার আংটার সাথে মোটা স্টিলের ক্যাবল বা তার বাঁধা। এই তারটি অন্ধকার চিরে সোজা চলে গেছে কয়েকশ ফুট দূরে সমুদ্রের তীরে অবস্থিত সেই নির্জন ওয়াচ টাওয়ারে।
নিচে সমুদ্রের কালো জলরাশি পাগলের মতো গর্জন করছে। ছাদ থেকে টাওয়ারের ওই দূরত্ব দেখে তান্বীর বুকটা আবারও কেঁপে উঠল।
ভ্যালেরিয়া বললো “তৈরি হ তান্বী! এটাই আমাদের শেষ বাধা। এই স্লাইডিং হুকটা শক্ত করে ধর। আমি আগে নামব, তারপর তুই। মাঝপথে হাত ফসকালে কিন্তু সরাসরি সমুদ্রের পাথরে আছড়ে পড়বি।”
ভ্যালেরিয়া একটি মেটাল স্লাইডার তারে আটকে দিলো এবং এক মুহূর্তের দ্বিধা ছাড়াই ঝড়ের বেগে স্লাইড করে নিচে নেমে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে টাওয়ারে পৌঁছে ইশারায় তান্বীকে ডাকলো।
তান্বী তারের ওপর হুকটা রাখল। তার হাত দুটো ঘামছে, শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। নিচে তাকালে মনে হচ্ছে এক বিশাল অন্ধকার গহ্বর তাকে গিলে নিতে মুখিয়ে আছে। এক্রোফোবিয়া যেন তার শিরায় শিরায় বিষ ঢেলে দিচ্ছে।
তান্বী নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললো “আমি পারব না… আমি পারব না জাভিয়ান!”
ঠিক তখনই তার কানে বাজল ভ্যালেরিয়ার সেই কথা— “তোর ফোবিয়া তোর কাছে ইম্পর্ট্যান্ট নাকি জাভিয়ান?”
তান্বী চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ করল। সে কল্পনা করল জাভিয়ানের সেই ক্লান্ত মুখ, সেই না ঘুমানো চোখের কালিমা। যে মানুষটা তার জন্য পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করে আজ নিঃস্ব, তার কাছে পৌঁছাতে এইটুকু ঝুঁকি সে নিতে পারবে না?
তান্বী স্লাইডারটা দুই হাতে শক্ত করে জাপ্টে ধরল এবং ছাদের কিনার থেকে শূন্যে নিজেকে ছেড়ে দিল।
তান্বী চিৎকার করে উঠলো “আআআআআআ!”
বাতাসের ঝাপটায় তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল। তীব্র বেগে সে নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্টিলের তার আর হুকের ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সে মহাকাশ থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে। নিচে সমুদ্রের গর্জন আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে সে দিশেহারা, কিন্তু হাত দুটো ইস্পাতের মতো শক্ত করে ধরে রেখেছে।
ঠিক যখন সে টাওয়ারের কাছে পৌঁছাল, ভ্যালেরিয়া তাকে লুফে নিলো। দুজনই দড়াম করে টাওয়ারের কাঠের পাটাতনের ওপর পড়লো। তান্বীর চোখে তখন জয়ের অশ্রু। সে পেরেছে! সে তার ভয়কে কবর দিয়েছে।
কিন্তু এই আনন্দ স্থায়ী হলো না। ঠিক সেই মুহূর্তেই পুরো দ্বীপের সার্চলাইটগুলো জ্বলে উঠল। প্রাসাদের ভেতর থেকে মেইলস্ট্রোমের গগনবিদারী গর্জন ভেসে এল—
মেইলস্ট্রোম “ওদের ধর! কেউ যেন দ্বীপ থেকে বের হতে না পারে!”
ভ্যালেরিয়া তখন বললো “সর্বনাশ! মেইলস্ট্রোম জেগে গেছে! তান্বী, জলদি নিচে নাম! বোট রেডি আছে!”
তারা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল, আর পেছনে শোনা গেল মেইলস্ট্রোমের ব্যক্তিগত বাহিনীর ভারী বুটের শব্দ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি।
সার্চলাইটের তীব্র আলোয় যখন সমুদ্রের উপরিভাগ দিনের মতো ফর্সা হয়ে উঠল, তখনই শুরু হলো সেই বিভীষিকাময় ধাওয়া। ভ্যালেরিয়া স্পিডবোটের লিভার সর্বোচ্চ টেনে দিয়েছে, বোটটি ঢেউয়ের ওপর দিয়ে উম্মত্তের মতো লাফিয়ে এগোচ্ছে। পেছনে মেইলস্ট্রোমের তিনটি অত্যাধুনিক গানবোট আর মাথার ওপর একটি হেলিকপ্টার নরকের মতো গর্জন করছে।
মেইলস্ট্রোম হেলিকপ্টারের লাউডস্পিকারে গর্জন করে বললো “থামা বোট ভ্যালেরিয়া! শয়তানি বন্ধ কর! তোরা এই সমুদ্রের কোথাও লুকানোর জায়গা পাবি না!”
বুলেটের বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে পানির ওপর। তান্বী বোটের মেঝেতে শুয়ে মাথা নিচু করে আছে, তার কানে বাতাসের শোঁ শোঁ আর রাইফেলের গুলির আওয়াজ। মেইলস্ট্রোম নিজেই গানবোট থেকে গুলিবর্ষণ করছে, তার নিশানা ছিল বোটের ইঞ্জিন।
তান্বী আতঙ্কে চিৎকার করে বললো “আপা ওরা একদম কাছে চলে এসেছে! আর তো কোনো পথ নেই, এবার কী হবে?”
ভ্যালেরিয়া দাঁতে দাঁত চেপে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে এক নির্দিষ্ট স্থানাঙ্কের (Coordinates) দিকে এগোতে লাগল। তার চোখে কোনো ভয় নেই, আছে এক অকুতোভয় সংকল্প।
ভ্যালেরিয়া বললো “তান্বী! জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধান এখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আমি যখন বলব, তুই কোনো চিন্তা না করে শুধু আমার হাত ধরে সাগরে ঝাঁপ দিবি। মনে রাখবি, এই লোনা জলই আজ আমাদের বাঁচাবে!”
গানবোটগুলো তাদের বোটকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে। সার্চলাইটের আলোয় তাদের চারপাশটা এখন মরণফাঁদ। মেইলস্ট্রোম নিশ্চিত ছিল তারা এখন ধরা পড়বে।
ভ্যালেরিয়া বললো “এখন! ঝাঁপ দে তান্বী!”
বোটের গতি না কমিয়েই ভ্যালেরিয়া তান্বীর হাত শক্ত করে ধরল এবং দুজন একসাথে সমুদ্রের অতল কালো জলের বুকে ঝাঁপ দিল। পেছনে চালকহীন বোটটি তীব্র বেগে চলতে চলতে মেইলস্ট্রোমের একটি গানবোটের সাথে ধাক্কা খেয়ে বিশাল এক অগ্নিকাণ্ড ঘটাল।
মেইলস্ট্রোম চিৎকার করে উঠল, “না! ওদের পানি থেকে তোলো! ওরা যেন ডুবে না মরে!”
কিন্তু পানির নিচে তখন এক অন্য জগত। তান্বী যখন নোনা পানির চাপে দম হারিয়ে ফেলছিল, ঠিক তখনই ভ্যালেরিয়া তাকে টেনে সমুদ্রের গভীরে নিয়ে গেল। সেখানে অন্ধকারের মাঝে আবছা নীল আলো জ্বলছিল একটি ছোট সাবমেরিন (Mini-Sub) আগে থেকেই সেখানে সাইলেন্ট মোডে অপেক্ষা করছিল।
ভ্যালেরিয়া দ্রুত তান্বীকে নিয়ে সাবমেরিনের এয়ারলক হ্যাচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরটা ছিল শুকনো আর অদ্ভুতভাবে শান্ত। দরজা বন্ধ হতেই তান্বী বুক ভরে অক্সিজেন নিল আর মুখ দিয়ে পানি উগড়ে দিল।
তান্বী হাঁপাতে হাঁপাতে বললো “আমরা… আমরা কোথায়? ওরা আমাদের খুঁজে পাবে না?”
ভ্যালেরিয়া কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ চেপে সাবমেরিনটিকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে যেতে হাসল আর বললো “মেইলস্ট্রোম এখন ওপরের পানি তোলপাড় করবে, কিন্তু ও ভাবতেও পারবে না যে আমরা পানির নিচে দিয়ে ওর সীমানা পার হয়ে যাচ্ছি। এই সাবমেরিন রাডার-প্রুফ। মেইলস্ট্রোম এখন শুধু আমাদের লাশের খোঁজ করবে।”
তান্বী সাবমেরিনের কাঁচ দিয়ে সমুদ্রের ওপরের সেই হালকা হয়ে আসা সার্চলাইটের আলোগুলোর দিকে তাকাল। সে আজ তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা নিয়েছে। সে জানে না সামনে কী আছে, কিন্তু সে জানে এই অতল জলরাশি ভেদ করে সে এখন তার জাভিয়ানের কাছে যাচ্ছে।
চলবে…..
(পরবর্তী পর্ব পেতে অবশ্যই আগের পর্বের মতো রেসপন্স করবেন।)
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৮
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৭
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২১
-
আযদাহা সব পর্বের লিংক
-
ডিজায়ার আনলিশড গল্পের লিংক
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১২