১৪.
Dark_Desire
ডার্ক_ডিজায়ার
দূর্বা_এহসান
রাত তখন প্রায় তিনটে। হাসপাতালের করিডোরে বাতি আধো-আলো। কাচের দেওয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে মনিটরের সবুজ আলো।টিপ টিপ শব্দে জীবন মাপা হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে।
আরবাজ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের নিচে ঘুমহীন ক্লান্তির ছায়া। ভেতরের রুমে অরু ঘুমিয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, গায়ে পাতলা চাদর। মনিটরে ওঠানামা করা লাইনটা যেন আরবাজের নিজের বুকের ওঠানামার মতো।যতক্ষণ ওটা চলছে, ততক্ষণ সে বাঁচবে।
“স্যার, আপনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন, একটু বিশ্রাম নিন।”
নার্সের কথায় আরবাজ মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, “না, ঠিক আছি আমি।”
তার চোখের নিচে গাঢ় কালচে দাগ। টানা কতদিন ঘুমায়নি। প্রতিটি ভোর সে এই রুমেই কাটিয়েছে। অরুর নিঃশ্বাস গুনে গুনে।সে চুপ করে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।অরুর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা।যখন তাকে প্রথম এই হাসপাতালে আনা হয়েছিল। রক্তে ভেজা শরীর, ভাঙা গলা, আর চোখের সেই ব্যাথাতুর শেষ দৃষ্টি।তখন ডাক্তার বলেছিল, “চ্যান্স কম, খুবই কম।”
কিন্তু আজ, আজ যেন বাতাসে অন্য এক গন্ধ।বাঁচার গন্ধ।আরবাজ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টির ফোঁটা কাচে টুপটাপ পড়ছে। বাইরে পুরো শহর ঘুমিয়ে, অথচ তার ভেতরে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা। মনে হচ্ছে কেউ তাকে ডাকছে।নরম, মৃদু কণ্ঠে।
“আরবাজ”
সে চমকে ঘুরে তাকায়।অরু কি ডেকেছে? নাকি তার নিজের কল্পনা?দৌড়ে বিছানার পাশে যায়।অরুর ঠোঁট নড়ছে, খুব আস্তে, প্রায় শোনা যায় না। মনিটরের আওয়াজও তখন যেন ধীর হয়ে আসে।
“অরু, শুনতে পাচ্ছিস?”
আরবাজ তার হাত ধরে।ঠোঁটের কাছে মুখ নিয়ে আসে।অরু চোখের পাতা মেলে, তীব্র আলোয় কুঁচকে যায় তার দৃষ্টি।মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দ। তারপর অরুর ঠোঁট নড়ে।আরবাজের বুকের ভেতর কেমন ধাক্কা লাগে। গলা শুকিয়ে যায়।সে কিছু বলে না। শুধু অরুর হাতটা বুকে টেনে নেয়।অরুর ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ টান। চোখের কোণে জমে থাকা জলটা আলোয় ঝিলমিল করে ওঠে।নিঃশব্দে ঘর ভরে যায় মনিটরের শব্দে।আরবাজ মাথা নিচু করে, অরুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
তখনই দরজা ঠেলে ঢোকে ডা. মেহরান। হাতে রিপোর্ট, চোখে অবাক চাহনি।
“রেসপন্স করছে!”
আরবাজ তাকায় না, সে জানে।তার আগে থেকেই সে অনুভব করেছিল।ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে করতে বলে,
“এটা মিরাকল ছাড়া কিছু না।”
আরবাজ ধীরে বলে ওঠে,
“না, এটা ভালোবাসা।”
ডা. মেহরান মৃদু হেসে চুপ করে যায়।
আরবাজ কল্পনা করে।অরু তার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বলছে ,
“আরবাজ”
“হুঁ?”
“তুই এখনো আমাকে ভালোবাসিস “
“সবসময়”
বাইরে বৃষ্টি থেমে যায়। জানালার ওপারে প্রথম সকালের আলো ঢুকে পড়ে ঘরে।অরুর মুখে ছায়া আর আলো মিশে যায়, ঠিক যেন জীবন নতুন করে লিখে নিচ্ছে তার নিজের কাহিনি। একফোঁটা জল তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অরুর হাতে।বাইরে আকাশে তখন মেঘ সরে যাচ্ছে, ভেতরে জীবনের আলো ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।
শহরের অলিগলি এক জায়গায় বাদ রাখেনি তরুকে খুঁজতে মৃন্ময়। সে এবং তার লোকজন চারদিক হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু প্রতিবার ফলাফল শূন্য।
ভোরের পাহাড় সবসময় একটু অন্যরকম।আকাশ তখন ধূসর। মেঘের পেটে সূর্যের আলো আটকে আছে।কুয়াশা যেন গাছের পাতায় নিঃশব্দে বসে আছে। বাতাসে শিশিরের গন্ধ, মাটির ভেতর থেকে উঠে আসা একরকম স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা। পাখির ডাক ভেসে আসে দূর থেকে।ছিন্ন, ভেজা, যেন ঘুম ভাঙার আগে পৃথিবী হালকা টানটান শ্বাস নিচ্ছে।
গাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কাগজ, কয়েকটা পুরনো ছবি, একটা নীল স্কার্ফ। স্কার্ফটার প্রান্তে ছোট একটা ছিদ্র। মৃন্ময় আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখে।তারপর সেটাকে গালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে।তরু এই স্কার্ফটা বছর কয়েক আগে এক বিকেলে পাহাড়ের চূড়ায় ফেলে রেখেছিল। হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল একটু দূরে। মৃন্ময় দৌড়ে গিয়ে সেটা ধরে এনেছিল। তখন তরু হেসে বলেছিল,
“তুমি সবসময় এমন করো কেন, সব কিছু বাঁচাতে চাও?”
মৃন্ময় কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল, “সব হারানোর আগে কিছু যদি বাঁচানো যায়, ক্ষতি কী?”
গাড়িতে ফিরে এসে সে ইঞ্জিন চালায় না সঙ্গে সঙ্গে। মাথা ড্যাশবোর্ডে ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে। বাইরে ভোরের আলো একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছে। মেঘের রং এখন ধূসর থেকে হালকা নীল। পাখিরা নড়ছে।তার হাতের আঙুলে রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে।কাল রাতের। গাড়ির ডোর খুলতে গিয়ে লোহার ধার লেগেছিল। এখন সেই রক্তটাও যেন তার যাত্রার অংশ হয়ে গেছে।সে জানে এই পথ শেষ নয়। আরও দূর যেতে হবে।তরু তাকে ডাকছে। সে শুনতে পাচ্ছে।
সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে মৃন্ময়ের গাড়ির ইঞ্জিন শব্দ করছে।ধীর, ভাঙা ছন্দে।রাতের পর সে এখনো থামেনি। চোখে ঘুম নেই, গায়ে ক্লান্তি, তবুও তার ভিতর শক্তি আছে।যেন কেউ অদৃশ্যভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আরেক প্রান্তে।ড্যাশবোর্ডে আটকানো একটা ছবি।তরুর।চুলে হালকা বাতাস, মুখে সেই শান্ত হাসি।
মৃন্ময় একবার চোখ তোলে, দেখে। ঠোঁট নাড়ে।
“পাখি, তুই কোথায়?”
শব্দটা হাওয়ায় মিশে যায়। কোনো জবাব আসে না।হেডলাইট নিভিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই.ভোরের আলোয় কুয়াশা কেটে যাওয়া শুরু করেছে। রাস্তা সরু, পাথুরে, একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে খাদ। নিচে মেঘের আস্তরণ, তার ভেতর ঝর্ণার শব্দ।
গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাস ছোঁয়। ঠান্ডা।হাওয়ায় কুয়াশার ফোঁটা গালে পড়ে জল হয়ে গড়িয়ে যায়।সে জানে না কতটা পথ গেছে। রাস্তা ক্রমেই বাঁক নিচ্ছে। কোথাও গাছের ছায়া, কোথাও খোলা ধূসর পাহাড়।এক জায়গায় রাস্তার ধারে কয়েকজন বসে আছে।গাড়ি ধীরে যায় তাদের পাশ দিয়ে।
কেউ একজন বলে উঠে,
“বাবা, ওই দিক দিয়ে যেও না, নিচে রাস্তা ভাঙা।”
মৃন্ময় শোনে না। হয়তো শোনে, তবুও যায়।গাড়ি এগিয়ে যায় আরও কিছুটা। রাস্তার ধারে এখন শিশিরে ভিজে।চাকা একবার পিছলে যায়।সে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে, গাড়ি সামলে নেয়।
তবু মনটা অদ্ভুত এক শূন্যতায় ভরে যাচ্ছে।যেন কিছু একটা ঘটবে, এই এখনই।একটা বাঁক। তারপর আরেকটা।
হঠাৎ রাস্তার এক পাশে কিছু চকচক করে ওঠে তরু ?
মৃন্ময় হঠাৎ ব্রেক চাপে। গাড়ি থামে, কুয়াশায় সেই জিনিসটা স্পষ্ট হয় না।সে নামবে কি না ভাবতে ভাবতেই বাতাসে ভেসে আসে একটা শব্দ।
“মৃন্ময়”
অতি পরিচিত কণ্ঠ।তরুর।হালকা, নরম, অথচ বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দেয়।মৃন্ময় জানে এটা কল্পনা, তবু বিশ্বাস করে।দরজা খুলে বাইরে তাকায়। কেউ নেই। শুধু কুয়াশা।আর বাতাসে পাতার শব্দ।সে আবার গাড়িতে ওঠে। এবার একটু জোরে চাপে অ্যাক্সেল।
ইঞ্জিন গর্জে ওঠে।গাড়ি সামনে ছুটে যায়।রাস্তাটা এখন খানিকটা নামের দিকে।দূরে সূর্যের প্রথম আলো পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে গেছে। মেঘগুলো রুপালি হয়ে উঠছে।মৃন্ময় গাড়ির ভিতরে হালকা ঘাম অনুভব করে।স্টিয়ারিংয়ে তার আঙুল সাদা হয়ে গেছে চাপে।
তবু তার চোখে একটাই দিক সামনে।তার মনে হচ্ছে সে তরুর কাছে কাছি চলে এসেছে।
“তরু, আমি যাচ্ছি তোর কাছে।”
গলার আওয়াজ কাঁপছে।রাস্তার বাঁকটা এবার অনেকটা সরু। একপাশে ধারে একটা পুরনো গার্ডরেল.জং ধরা, অর্ধেক ভাঙা।
মৃন্ময় গতি কমায় না।সে এক মুহূর্তের জন্য স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দেয় ডানদিকে।গাড়ি পাশের দিকে টান খায়।চাকা পিছলে যায় শিশিরে ভেজা মাটিতে।
এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বদলে যায়।গাড়ি রাস্তায় দুলে ওঠে।
হঠাৎ একটা পাথরে ধাক্কা খায় সামনের চাকা।গাড়ি একদম দিক হারিয়ে ঘুরে যায় বামদিকে, তারপর সরাসরি গার্ডরেলে।
“পাখি”
চিৎকার করে ওঠে মৃন্ময়।তারপর শুধু ধাতব শব্দ।গার্ডরেল ভেঙে যায় কাচের মতো।গাড়ি ভারি শরীর নিয়ে নিচের দিকে ছুটে যায়।খাদের গভীরে।এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড সময় যেন থেমে গেছে।হেডলাইটের আলো কুয়াশা কেটে নিচে পড়ছে, আর গাড়ি ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে।
ধপ!প্রথম ধাক্কা।তারপর আরেকটা।পাথরে ঠেকে জানালা চূর্ণ হয়ে যায়, কাচের টুকরো বাতাসে উড়ে মৃন্ময়ের গালে লাগে। রক্ত বের হয়, কিন্তু সে টের পায় না।তার চোখে শুধু এক দৃশ্য তরুর মুখ, হাসছে, ডাকছে, হাত বাড়াচ্ছে।
“পাখি,,”
শেষবার ফিসফিস করে সে।
চলবে,,,,,
Share On:
TAGS: ডার্ক ডিজায়ার, দূর্বা এহসান
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১৬
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১৭
-
ডার্ক সাইড অফ লাভ পর্ব – ২
-
ডার্ক সাইড অফ লাভ পর্ব ১
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৩(প্রথমাংশ + শেষাংশ)
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৭
-
ডার্ক সাইড অফ লাভ গল্পের লিংক
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১৩
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৮
-
ডার্ক ডিজায়ার গল্পের লিংক