#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৮
প্রেম হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আরে ট্যাবলেট জলদি বিছানায় আসো না। পা দু’টো যে তোমাদের লিফট ছাড়া বাড়ির পাঁচ তলায় উঠতে গিয়ে ব্যথা হয়ে গেল এখন টিপে দিবে না?’
হাসি মেশানো চটকদার কণ্ঠে বলল, ‘কেন আমি কী আপনার বউ নাকি? এত পা টেপানোর শখ তো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে টেপান না।’
প্রেম বাঁকা হেসে বলল, ‘কী টিপাবো সোনা?’
তৃষা খেলোয়াড়ি কণ্ঠে বলল, ‘আমার ইয়ে।’
প্রেম তৃষার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, ‘আসো টিপে দেই।’
‘এই লোক, আমি আমার গলার কথা বলেছি।’
‘তো আমিও তো সেটাই বললাম। আসো গলাটা টিপে দেই। দেশের জনসংখ্যা কমবে।’ প্রেম পুনরায় তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জামা বদলে এসো। ভেজা জামাতে আমাকে হ্যারেজ করছো? আমি নিয়ন্ত্রণ হারালে কী করব জানো তো?’
‘কী আর করবেন? শরীরটাও বলবেন টিপে দিতে। আপনি পারেন শুধু চেটেং চেটেং কথা বলতে। আর পারেন কোন বালডা? মুখটা খালি খারাপ করেন। এখন বিদায় হোন। আংকেল, আন্টি আসলে কী মনে করবে? রুমের মধ্যে আমি আর একটা ছেলে? একটা সুন্দরী মেয়ের ইজ্জত এভাবে নষ্ট করতে পারেন না প্রেম ভাইয়া,আপনি পারেন নাআআআআআ।’
‘এই ওয়াশরুমটা কই ট্যাবলেট?’
‘কী করতে যাবেন সেখানে?’
‘আয় আমার সাথে ভেতরে। দেখাই কী করতে যাব।’
‘না আমার লজ্জা করে।’
‘তোর লজ্জা আমি মুতে ফ্লাশ করি।’
তৃষা প্রেমকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দেয়। প্রেম ওয়াশরুমে ঢুকতেই তৃষা বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। আজকে এটাকে ওয়াশরুমে আঁটকে পুরো মহল্লার মানুষ ঢেকে চোর বলে গনধোলাই খাওয়ালে কেমন হবে? সেই, সেই।
‘প্রেম ভাই এত সময় লাগে নাকি?’
‘কেন শরবত খাওয়ার অনেক তাড়া নাকি? বোতল ভরে নিয়ে আসছি। ওয়েট কর।
‘ছ্যাহ মুখ দিয়ে একটা ভালো কথা বের হয়না?’
প্রেম ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই দেখল বাইরে দিয়ে দরজা লাগানো। প্রেমের তো তখন মেজাজ গরম হওয়ার পথে। সে ভেতর থেকে চেচিয়ে উঠল, ‘আরে ট্যাবলেট দরজা খুল।’
‘হিশু করার জন্য প্রেম নেওয়াজ আমার বাড়ি খুঁজে এখানে এসেছে। তাকে কী করে ছেড়ে দেই বলুন তো?প্রেম ভাই আপনি আর কোনোদিনও এই বাথরুম থেকে বের হতে পারবেন না। রাক্ষস বেডা।’
‘একবার বের হতে পারলে তৃষার বাচ্চা, প্রথম শিকারটা কিন্তু তুই হবি। শালী দরজা খুল।’
কী করবে না করবে ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দিতেই প্রেম এক ঝটকায় তৃষার গলা চেপে ধরল। তৃষার একেবারে দম বন্ধ হয়ে এলো। চোখ-মুখ উল্টে আসল। প্রেম কেবল এক ইঞ্চির দূরত্বে। তৃষার নিঃশ্বাসের শব্দ সে শুনতে পারছে। তবে তৃষার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আসতেই সে তৃষাকে ছেড়ে দিলো। তৃষা কাশতে কাশতে নিজেকে কোনোমতে সামলাতেই প্রেম তড়াক করে বলল, ‘জামা বদলে জলদি নিচে আসো।’
‘কে..ন?’
‘যাবো কোথাও একটা।’
‘যাব না আমি।’
‘শিমলা কিন্তু ভার্সিটিতে বন্দী। তুমি অন্তত চাও না তোমার বান্ধুবীর ইজ্জতটা নিলামে উঠুক? আচ্ছা যাওয়া লাগবে না। আমি কল দিয়ে অংকুরকে তার কাজটা সেরেই ফেলতে না হয় বলছি। কী বলো?’
‘এই না না,আমি আসছি। ওয়েট। তবে বলুন বাইরে নিয়ে গিয়ে কী করবেন?’
‘ফিজিওলজির চ্যাপ্টার পড়াবো। দু’দিন ভার্সিটি আসো নি। ক্লাস তো মিস হয়ে গেল? সিনিয়র হিসেবে তো আমার একটা দায়িত্ববোধ আছে তাই না বলো বাঁদরমুখি?’
–
যুবরাজের সামনে নির্বাচন। টানা চাপের এই সময়টায় তার যেন আর ভালো লাগছে না। একটু আগে সভা থেকে বের হয়ে রাফসানকে বলল, ‘এই গবেট তৃষার কোনো খোঁজ পেলে কী?’
রাফসান ধীর গলায় উত্তর দিল, ‘ভাই জাস্ট এতটুকু পেয়েছি যে তৃষা ম্যাডাম ঢাকায় গিয়েছেন।’
যুবরাজ বিরক্ত স্বরে বলল,’ঢাকা তো আর ফাঁকা নয় যে ঠিকানা না জেনেই ওকে পেয়ে যাব। জলদি খুঁজে বের করো। এভাবে আর ভালো লাগছে না। ইলেকশনের আগে একটা বিয়ে না করলেই নয়। বিয়ে-শাদি করে রিলাক্স হওয়ার একটা ব্যাপার আছে তো?’
রাফসান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,’ভাই বিয়ের আশা ছেড়ে দেন।’
‘মানে কী?’
‘ভাই দেশে কী আর মেয়ে নেই? ওই তৃষাকেই করতে হবে?’
যুবরাজ দৃঢ় কণ্ঠে জানাল, ‘হ্যাঁ করতে ওকেই হবে।’
রাফসান হেসে ফেলল,’তাহলে আপনার বউ গিয়ে আপনি খুঁজেন।’
যুবরাজ চোখ কুঁচকে তাকাল, ‘তো তুমি কী করবে?’
‘বাসর।
যুবরাজ অবাক হয়ে বলল,’কী কত বড় সাহস। ‘
‘আরে আমি বিয়ে করে বাসর করব বলেছি।’
‘ওহ এই ছিলো তোমার মনে?’
‘আরে ভাই আপনার তৃষাকে করব বলছি? নিজের জন্য কাউকে খুঁজে তাকে করব।’
যুবরাজ একটু শান্ত হয়ে হেসে বলল, ‘ওহ সেটা বলো।’
‘তো এতক্ষণ কী জাপানিটা বলছিলাম।’ রাফসান মনে মনে গর্জে উঠতেই যুবরাজ পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘বাসরটা তুমিই সাজাবে আমার।’
রাফসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল, ‘আগে তো খুঁজে বের করেন আপনার না হওয়া হারানো বউকে। মরার আগেই স্বর্গে যাওয়ার ধান্ধা। ছ্যাহ!’
–
সিদ্দিক নেওয়াজ বারান্দায় বসে আছেন। এই বারান্দায় বেশিরভাগ সময় কাটে তার। বারান্দা দিয়ে প্রেমের কাঠের বাড়ির চারপাশে অবস্থিত গাছপালা গুলো আবছা দেখা যায়। এই প্রেম ছাড়া তার যে আর কেউ নেই। প্রেম হারিয়ে গেলে এই বংশও হারিয়ে যাবে। সিদ্দিক নেওয়াজ তার বাবার ঘরে একাই ছেলে ছিল। বাকি চারজন ছিল মেয়ে। সেই সিদ্দিক নেওয়াজের ঘরেও এক ছেলে এক মেয়ে জন্ম নেয়। বড় ছেলে পরাগ নেওয়াজ, ছোট মেয়ে হেতিজা। পরাগের বিয়ে দেওয়া হয় তার পছন্দের মেয়ের সঙ্গেই। প্রেমের মায়ের নাম হিমিকা গুলজার। কত ভালোই না ছিল শুরু দিকে তাদের সম্পর্ক। তারপর একদিন সব ধ্বংস হলো। সেই ধ্বংস প্রেমের জীবনটা কে যে বরবাদ করল আজও ধ্বংসের অনলে জ্বলছে প্রেম। কী দোষ ছিল ছোট্ট ছেলেটার? বাবা-মায়ের ভালোবাসা তো তার তখন বড্ড দরকার ছিল। তবে দু’জনে স্বার্থপরতা শেষ করল তাকে। তারা আজ নেই। তবে প্রেমের ধ্বংস থামার নামই নেই। সিদ্দিক নেওয়াজের অনেক শখ নাতির সংসার দেখবেন, নাতবউ দেখবেন। এই বাড়িতে আবার বাচ্চাদের হইহট্টগোল শুনতে পাওয়া যাবে। প্রেম ব্যবসা সামলাবে। সব সুন্দর হবে। কী জানি কখনো এই শেষ ইচ্ছে গুলো পূরণ হবে কিনা? নাকি শেষ ইচ্ছে বুকে পুষে শেষ বিদায় নিতে হবে?
–
প্রত্যুষের শরীরটা কেমন যেন ম্যাচ ম্যাচ করছে। অফিসে এত্ত এত্ত কাজ। একজন কর্মী এসে তাকে চা দিয়ে গেল। এবার মনে হচ্ছে বিয়ে-শাদি করাটা কত গুরুত্বপূর্ণ। এইযে শরীর ব্যথা করছে। কাজ শেষে বাসায় ফিরলে তো নিশ্চয়ই রাতে বউ ব্যথার মলম লাগিয়ে মালিশ করে দিত। তারপর সেই মালিশ ধীরে ধীরে রূপ নিত হাজারটা চোখের নালিশে। ধ্যাৎ এই রোমান্টিকের ভূত ঘাড়ে কেন চাপছে হঠাৎ? কত কাজ বাকি? এখনো সেই খুনীর সম্পর্কে একটা ক্লু পাওয়া যায়নি। এভাবে চললে হবে? তাছাড়া কাল রাতে ক্লাবে প্রেম নেওয়াজ একটা খুন করেছে। ইচ্ছে তো করে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করাতে। তবে ভাই হয় তো। নানুভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে যায় প্রত্যুষ। বার বার বাঁচিয়ে দেয় প্রেমকে। কথায় আছে না? কেউ পাপ করে আর কেউ সাফ করে?
প্রত্যুষ একটা ফাইল হাতে তুলতেই সেখানে একটা নাম লক্ষ করে থমকে যায়। পাপন কাজী। এই পাপন নামটা সহ্য হয়না প্রত্যুষের। ফেলে আসা অতীত সে ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেনি বাবার সেই বিভীষিকাময় ফেলা আসা অধ্যায়। বাবা এমন না হলেও পারত। নেশা তার জীবনটাও কেড়ে নিলো আর মাকে করল বিধবা, সন্তানগুলো বড় হলো বাবাহীন।
–
এই শিমলা মেয়েটা এতবেশি কিউট কেন? একে ধরে বেঁধে সংসার করে ফেলা উচিত। এমন ভাবে কাউকে মনে ধরে বুঝি? শিমলা ভয়ে এখনো কাঁপছে। না জানি বাসায় গিয়ে ওই প্রেম তার বান্ধবীর সাথে কী থেকে কী করে ফেলে। এদিকে এই অংকুর তো সামনে এমন গুন্ডার মতো বসে আছে। না পারছে সে ভয়ে উঠতে না পারছে কিছু বলতে। ভয়ে কাঁপতে থাকা শিমলাকে দেখে অংকুর শেষ পর্যন্ত বলল,’ভয়ের কিছু নেই। আমি তো মানুষ, বাঘ নই।’
শিমলা কণ্ঠ কেঁপে উঠল, ‘পুরুষ মানুষ তো?’
‘তাতে কী হয়েছে? মানুষ তো?’ অংকুর চুপ থেকে প্রশ্ন করল, ‘ভালোবাসো কাউকে?’
‘বাসি না তো।’
অংকুরের মুখে হুট করেই হাসি ফুটল। ভেবেছিল শিমলা অন্য কাউকে ভালোবাসলে সেই ছেলেকে মারধোর করে তুলে এনে শিমলাকে বিয়ে করতে হবে। এখন দেখছি রাস্তা ক্লিয়ার।’
‘চোখে চশমা ছাড়া কিছুই দেখো না?’
‘ঝাপসা লাগে।’
‘তাহলে তোমার দু’টো চোখ হয়ে যাই? আমার চোখ দিয়ে না হয় তুমি জগৎ দেখলে। ব্যাপারটা মন্দ হয়না বলো?’
‘কী বুঝাতে চাইছেন ভাইয়া?’
‘না বুঝলে একটা লাল বেনারসি কারো গায়ে জলদি জড়িয়ে যাবে।’
‘বুঝলাম না।’
‘বোঝানোর জন্য অংকুর তো আছে।’অংকুর বলল।
‘আছে? কতটা কাছে শুনি?’
‘যতটা কাছে থাকলে হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনতে পাওয়া যায়।’
শিমলা মুচকি একটু হাসি দিয়ে চুপ করে যায়। অংকুর বাধ্য ছেলের মতো তাকিয়ে আছে তারই পানে। চোখের পলক পড়ছে না। তবে চোখ দুটো বলছে হাজারটা কথা। শিমলার কী সেই কথা শোনা উচিত হবে? তার অবাধ্য মনটা ভাবনায় ডুব দিলো।
–
সাদা রঙের একটা জর্জেটে কামিজ পড়ে রুম থেকে বের হয়েছিল তৃষা। প্রেম ভাই একবার তাকে দেখেই চোখ সরু করে বলল, ‘কেউ মরল টরল নাকি? নাকি আগেই ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাতে চাইছ আমার সঙ্গে গেলে সাদা কাপড়টাই পার্মানেন্ট হয়ে যাবে তোমার জন্য? এখন কবরে গিয়ে তো আর ড্রেস বদলাতে পারবে না।’
তৃষা মুখ ভেংচি কেটে কালো রঙের একটা জামা পড়ে আসে। এটা প্রেম ভাইয়ের মনে হয় পছন্দই হয়েছে। তাকে তো বেশির ভাগ কালো জিনিস ব্যবহার করতে দেখা যায়। কী একটা অবস্থা। তাই তো তৃষা বলে, যে কিনা নিজেই অন্ধকার সে কেমন করে আলোকে সহ্য করতে পারবে?
নিচে বাইকের কাছে যেতেই তৃষা দেখল সেখানে দু’টো হেলমেট আছে। বাপরে প্রেম ভাইয়ের বাইকে উঠবে সে? তৃষার ভয় ভয় করছে? বাইক এক্সিডেন্ট করে তাকে মারার ধান্ধা করছে না তো? দুনিয়ায় প্রেম ভাই এমন এক মহৎ ব্যক্তি যাকে তৃষা এক সেকেন্ডের জন্যও বিশ্বাস করতে ভয় পায়।
‘আপনি তো দু’টো হেলমেট এনেছেন দেখছি। পরিকল্পিত খুন তাই না?’
‘তোমায় খুন করতে প্রেম নেওয়াজের পরিকল্পনার দরকার নেই। এখন জলদি বাইকে উঠে বসো। বাইকে উঠতে তো পারো? এক্সপেক্ট করো না প্রেম তোমায় কোলে করে বাইকে বসাবে। আর দু’টো হেলমেট এনেছি কারণ রাস্তায় পুলিশ ধরলে তোমার জন্য তো আমি জরিমানা দিতে পারব না। লস প্রোজেক্টে প্রেম নেওয়াজ ইনভেস্ট করেনা।’
তৃষা মনে মনে ইচ্ছে মতো গালাগাল করতে থাকল। মুখ ভেংচি কেটে ইচ্ছে মতো মনে মনে খাশ বাংলায় গালি দিলো। মুখের এমন দশা দেখে প্রেম বলল, ‘এত গালি দিস না আম্মা, মুখেরও তো একটা বিশ্রাম আছে। তোর ওইটা তো মুখ না, আমার নানির আমলের ভাঙ্গা রেডিও। একবার শুরু হলে বাজতেই থাকে।’
তৃষা চুপ হয়ে যায়। মুখটা ছোট করতেই প্রেম বলল, ‘আবার কী হয়েছে?’
তৃষা তড়াক করে মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘ রাগ করেছি কিন্তু আমি।’
প্রেম ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তো আমি কী করবো?’
‘রাগ ভাঙ্গান সিনিয়র ভাইয়া।’
‘ ওয়েট জলদি বাইকে উঠে বসো। আজকে ইট ভাঙ্গার মেশিন দিয়ে তোমার রাগকে আমি ভাঙবো দাঁড়াও।’
তৃষা আর কথা না বাড়িয়ে বাইকে উঠে বসে। কই ভেবেছিল প্রত্যুষের বাইকে উঠে বসবে। এখন তো এই খবিশের বাইকে উঠে বসতে হচ্ছে। কোনদিন জানি বাথরুমের দরজা ভেঙে তৃষাকে হুমকি দিয়ে বাইরে নিয়ে যায়। তৃষা হেলমেট পড়তে গিয়ে চুলের সঙ্গে প্যাচ লাগিয়ে ফেলে। সেটা দেখে প্রেম চোখ রাঙিয়ে তাকে হেলমেট পড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
‘বলদি তোমার দাঁড়া এটাও হয় না। বালডা ছাড়া কিছুই পারো না দেখছি? ভাত রান্না করতে পারো? তোমার স্বামীর কপালে তো দেখছি অংকুরের দশ বছর আগের ফুটো জাঙ্গিয়ার থেকেও বেশি ছিদ্র আছে। মহাশয়ের দুঃখে আমাশয় হয়ে যাবে। ভাবলেই দুঃখ পাচ্ছে আমার। বেচারার বউ বাল ছাড়া কিছুই পারে না।’
‘হাঁস-মুরগি পারে ডিম কিন্তু বাল আবার কে পারে?’
‘কেন সোনা তুমি ওটা পারার জন্য তো আছোই।’
বাইকে উঠে বসতেই প্রেম বাইক চালু করার আগে হেলমেটটা মাথায় দিয়ে তৃষাকে বলল, ‘অনেক জোরে চালাবো। ভয় করলে শক্ত করে চেপে ধরবে বাঁদরমুখি। কারণ যদি উড়ে কোথাও চলে যাও তাহলে সেই আমাকেই বাইকের পেট্রোল খরচ করে তোমাকে খুঁজতে হবে।’
তৃষা মনে মনে সুধিয়ে উঠল, ‘শালা কোন লেভেলের কিপ্টে!’
প্রেম বাইক স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৃষা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আহ্ এত জোরে কেন? স্পিড কমান।’
‘প্রেম তো স্পিড কমাবে না সোনা। তোমার ভয় লাগছে তো তুমি শক্ত করে চেপে ধরো আমায়। তুমি কেন আমাকে স্পিড কমাতে বলছো? দিস ইজ নট ফেয়ার ময়নাপাখি।’
চলবে?
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৯
ফার্মিসীর সামনে বাইকটা থামাতেই আতঙ্কে তৃষার ভেতরটা কেঁপে উঠল। সে তো এই হাইব্রিড করলাকে ইহো জিন্দেগীতে ভয় পায় না। তবে দেখো এই মশাই তো প্লে- স্টোর থেকে একদিনেই তৃষাকে ভয় দেখানোর একেবারে কোর্স করে মাঠে নেমেছে লাঙ্গল চালাতে।লাঙ্গল তো টানা হয় এদের মতো বলদ গরু দিয়েই। নইলে কোন শাস্ত্র আবার গাভী গরুকে দিয়ে ওইসব করায়? যাই হোক কথায় কথায় নিজেকে গাভী গরু বলে কতবড় পাপ করল তৃষা। এখন শাস্তি স্বরূপ প্রত্যুষের বউ হয়ে গেলেই হয়েছে। ছেলে সরকারি চাকরি করে। বিয়ে হয়ে গেলে তৃষার ভালোই টাকা পায়সা হবে। তখন তো আর এত কষ্ট করে চাকরি খুঁজতে হবে না। তাছাড়া ওইসব চাকরি-ফাকরি তৃষার পোষায় না। সে তো কেবল শুয়ে-বসে থাকতে চায়। তার সামনে মানুষ খাবার সে দিয়ে যাবে। মুখে তুলে খাইয়ে দেবে আর সে বসে বসে খালি ফোন চালাবে। আর কী চাই এই জীবনে? তবে বিষয় এখন এসব নয়। কথা হচ্ছে প্রেম নেওয়াজ ফার্মেসীতে কেন গেছে? খুবই সন্দেহজনক। হায় খোদা মাইন্ড কয়লার মতো এমন ফকফকা হচ্ছে কেমনে করে? তৃষা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল। প্রেম ফিরে এলো একটা পানির বোতল নিয়ে। তৃষাকে ঔষধের পাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খাবে নাকি? এটা খেলে অনেক বড় বিপদের থেকে বাঁচতে পারবে।’
‘মা…মানে?’
‘মানে এটা এলার্জির ঔষধ। এটা খেলে চুল্কানি কমে। মেয়ে তুমি আমায় সুযোগ পেয়ে এত টার্চ করেছো যে সঙ্গে সঙ্গে এলার্জি শুরু হয়ে গেছে। আমার স্কিন কত সেনসিটিভ ধারণা আছে? দিলে তো এখন খরচা বাড়িয়ে।’
‘কত কিপ্টে আপনি। আমাদের ওইখানে কদুমিয়া নামক এক লোক থাকত। সবাই তাকে ডাকত কিপ্টে কদু বলে। আপনি ভাই তার থেকেও বেশি কিপ্টে।’
‘ওহ আর তুমি তো মহীয়সী, তো দাও এতটা পথ সঙ্গে করে এনেছি পেট্রোলের বিলটা দাও।’
‘না মানে।’
‘তোমার চেটাং চেটাং কথাবার্তা ওই ইয়ে আর মানেতেই যে আঁটকে যায় তা প্রেমের জানা আছে।’
‘দেখুন প্রেম ভাই এমন ভাবে বললে কিন্তু জিদের বশে কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে ফেলতে পারি।’
‘তুমি সোনা নতুনতো, তাই জানো না প্রেম নেওয়াজ যে জিদের ভাত কুত্তাকে খাওয়ায়। বি কেয়ারফুল।’
তৃষা চুপসে যায়। প্রেম একসঙ্গে তিনটে এলার্জির ঔষধ মুখে দিয়ে পানি খেয়ে খায়। তৃষা একবার তার কণ্ঠমণির দিকে তাকায়। পানির প্রতিটি ঢোকে ওই উঁচু জায়গাটা কেমন উপর-নীচ হচ্ছে। কেমন করে যেন এক মুহূর্তে তার শরীরের লোমকূপ গুলো নড়ে উঠে। একটা অদ্ভুত শিহরণ কাজ করে। এই অদ্ভুত শিহরণ কাজ করাটাও তো ভীষণ অদ্ভুত। এই খবিশ লোককে দেখে বরঞ্চ নেগেটিভ ফিলিংস ছাড়া ভেতর থেকে অন্য কিছু আসা ঠিক না। প্রেম পানি খাওয়া শেষ করে ভ্রু কুঁচকে তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পানি খাওয়ার সময়ও এত নজর দেওয়া লাগে? ছেলে মানুষ দেখো নি। অবশ্য ছেলে অনেক দেখেছো তবে প্রেম নেওয়াজের মতো বারুদ তো একপিসই। দেখবে কেমন করে?’
‘হয়েছে নিজের প্রশংসা আর করতে হবে না।’
‘প্রশংসা করলাম কই? ওইসব যেন-তেন মানুষের সামনে করলেও সম্মান খোয়া যাবে।’
তৃষা মুখটা ভেংচি দিতেই প্রেম ফের বলে উঠল, ‘শক্ত করে ধরতে বলেছি বলে এমন ভাবেই সুযোগ নিয়ে ধরেছো যে এখন শরীরে ভীষণ এলার্জি হচ্ছে। তিনটে ঔষধ খাওয়ার পরেও মনে হচ্ছে আরো দুটো খেয়ে পাঁচটা করি। ভাইরাস কোথাকার!’
‘প্রেম ভাই?’
‘কী?’
‘আমি আপনার বাইকটা চালাই?’
প্রেম এক মুহূর্তে বিচলিত হয়ে বলে, ‘আরে না লেগে যায় যদি? তখন আমার কী হবে ভেবে দেখেছো?’
তৃষা থমকে যায়। ওমা এই লোকের দেখি মন বলেও কিছু আছে। তৃষার কিছু হয়ে যাবে বলে দুশ্চিন্তাও করছে। তা দেখে তৃষা প্রেমকে বলল,’ আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম প্রেম ভাই। খারাপ ব্যবহারও করেছি। থাক আপনিই বরং বাইকটা চালালেন। আমি পিছনে বসব।’
তৃষা ইমোশনাল হতেই প্রেম তৃষাকে ধাক্কা মেরে বাইকের সঙ্গে থেকে সরিয়ে বলল, ‘আরে শালী সর। তুই হেলান দিয়ে আমার বাইকের সঙ্গে বসে তার গায়ে নোংরা লাগিয়ে দিচ্ছিস। আর তোর লাগলে আমার কী? আমি তো আমার বাইকের কথা বলেছি। তুই চালাতে গিয়ে যদি আমার বাইকের গায়ে লাগিয়ে দেস? তখন তো আমার বাইকটার কত লাগবে? ওর গায়ে আচর পড়লে তখন আমার কী হবে? সর, ঘেঁষবি না। ‘
তৃষার ভেতরটা চুরমার হয়ে গেল। মনে হলো কেউ হাতুড়ি দিয়ে ইমোশনকে একেবারে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। প্রেম বুকটা বাঁকিয়ে কেবল চোখে কালো সানগ্লাসটা পড়ে বলে।
‘আস্তে বসবা ভোটকি। তোমার ওজনে যেন আমার জানেমানের নিঃশ্বাস বন্ধ না হয়ে যায়।’
তৃষা কোনোমতে বাইকে উঠে সে বলে, ‘তোর জানেমানের হাওয়া একবার লিক করেছি না প্রেমের বাচ্চা? আবার করব। এবার সঙ্গে তোরটাও করব।’
পোস্তগোলা ব্রিজের সামনে বাইকটা পার্কিং করেছে প্রেম। সিগারেট ধরিয়ে ভ্রু কুচকে বলল, ‘দেবে নাকি একটা টান? আমি আবার দয়াশীল তো। কাউকে না দিয়ে কিছু খাই না। খোদার নামে দিয়েই ফেলো টান।
‘ওই যে দেখেন একটা কুত্তা বসে আছে ওর সঙ্গে শেয়ার করে খান।’
‘তুমিও তো একই গত্রের। ওর আর তোমার খাওয়া একই কথা।’
নদীর বক্ষে অস্তমান সূর্যের কমলা রশ্মি গলে গিয়ে ঝরে পড়ছে তখন। বিস্তীর্ণ জলে বিস্তার করছে অগ্নিদীপ্ত সোনালি আভা। স্রোতের বুক জুড়ে সেই আলো ঝিলমিল করছে একেবারে অগণন রত্নখচিত আয়নার মতে। বাতাসে ভেসে আসছে কাঁচা নদীর গন্ধ, কোথাও হ শৈবালের মৃদু সোঁদা সুবাস, আবার কোথাও দূরবর্তী মাঝিদের গর্জন। দূরে কোথাও আবার লঞ্চ, স্টিমারের হুইসেল বাজছে।
প্রেম সিগারেটে শেষবারের মতো একটা টান বসিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা বাতাসে ছেড়ে দিয়ে বলল,’ ফিজিওলজির কোনখান থেকে শুরু করি বলো তো?’
‘আমি বলেছি আপনাকে শুরু করতে?’
‘বলবে কেন? সব কথা বলতে হয় না। কিছু জিনিস নিজ থেকেই করতে হয়।’
‘ঢং। দেখুন আমি এখন বাসায় যাব। আর আমাকে আপনার ফিজিওলজি শেখাতে হবে না। ওইটার জন্য আমি একটা ভালো স্যার দেখে টিউশন নেব।’
‘পুরুষ মানুষের কাছ থেকে?’
‘তো কোনো সমস্যা?’
‘না আমার কেন সমস্যা হবে? জাহান্নামে যাও তুমি।’
‘সব সময় আপনি এমন করেন। সরি না বললে কিন্তু আমি রাগ করে ব্রিজের ওপর থেকে ঝাপ দেব বলে দিচ্ছি।’
‘সেটা তো আমি সরি বললেও তুমি ঝাপ দেবে না সোনা।’
–
রাত তখন এগারোটা বাজে। বিছানায় তখন শিমলা মরার মতো পড়ে নাক ডাকছে। তৃষা এপাশ-ওপাশ কিছুক্ষণ ফিরে ফোনটা হাতে নিল। প্রত্যুষকে একটা ম্যাসেজ দিলে সমস্যা কী? সে তো খুব বেশি সময় নষ্ট করবে না কিংবা জ্বালাতনও করবে না। আজ এমনিতেই মনটা কেমন জানি খারাপ। বাড়ির কথা মনে পড়ছে অনেক। তবে তৃষা তার বাবাকে ভালো করেই চেনে। সে কখনোই তৃষাকে খুঁজবে না। কখনোই না। তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কী একটা ভেবে প্রত্যুষকে ম্যাসেজ দিয়েই দেয়। কিছুক্ষণের মাথায় প্রত্যুষের রিপ্লাই পেয়ে তৃষার মন নেচে উঠে। প্রত্যুষ লেখে,
‘রাতজাগা পাখির দলে নাম লিখার ইচ্ছে জেগেছে? ঘুমানি যে?’
‘ঘুমটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। আমার চোখের পাতার সব ঘুম কে যে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।’
‘কল দেই?’
তৃষা মানা করল না। ‘আজ জানেন সবটা কেমন অন্ধকার লাগছে। আমি না আপনাকে কিছু বলতে চাই।’
”চাওয়ার মতো কথা কখনো বলা যায় না। বললে তা অন্য কারও কানে পৌঁছে যাবে।’
তৃষা কিছু একটা বলেও থমকে গেল। প্রত্যুষ ফের বলল, ‘কী যেন একটা বলে চাইছিলে?’
‘ থাক। কিছু কথা বললেও বোঝা যায় না।’
‘কিন্তু যদি আমি অনুভব করতে চাই?’
তৃষা সেই কথা শুনে মুচকি হাসল। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই প্রত্যুষ বলল, ‘এই তোমার সঙ্গে একটু পড়ে কথা বলি? একটা ইমারজেন্সি কেইস এসেছে।’
তৃষা কলটা রেখে দিলো। মনে মনে চোখটা বন্ধ করে একটা শান্তি নিয়ে প্রত্যুষের মুখশ্রী কল্পনা করার চেষ্টা করতেই ভাসল প্রেমের মুখটা। চোখ সরু করে লোকটা সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। ধ্যাৎ আজ রাতের ঘুমটা এবার গেল।
–
প্রেম এই রাতের বেলা তৈরি হচ্ছে। পরনে কালো রঙের একটা হুডি। মুখে কালো রঙের একটা মাস্ক পড়েছে। কেবল চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। তাতে কত মায়া জড়িয়ে। প্রেম একটু আগেই কাল একটা গোলাপ ছিঁড়েছিল গাছ থেকে। সেটা পকেটে রাখলে নষ্ট হবে। তাই রাখল তার BMW S1000RR এর ওপরে। এটাও প্রেমের পছন্দের একটা বাইক। কালো রঙ ছাড়া অন্য কিছু ভালো লাগেনা। তাই সবগুলো বাইকের রঙ কালো। মানুষের যেমন একটা শখ থাকে? তেমনই প্রেমের শখ বাইক কালেকশনের। যতগুলো বাইক তার আছে তাতে একটা শো-রুম তো অনায়াসেই দেওয়া যাবে। প্রেম হ্যালমেট পড়ে আর দেরি না করে এই রাতের বেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বাইকের শব্দেই সিদ্দিক নেওয়াজের ঘুৃমটা ভাঙল। সে উঠে বারান্দায় আসার আগেই প্রেম চলে গেছে। মুখটা কেমন যেন শুঁকিয়ে আসে সিদ্দিকের। সে কেবল বিরবির করে একবার বলে, ‘আজকে আবারও?’
চলবে?
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১০
রাতে একটা দুঃস্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে গেল। এমন ভয়ানক স্বপ্ন কখনো এর আগে আসেনি। তনিমা আফরোজ দোয়া পড়তে পড়তে ডাইনিং রুমে গেল। গ্লাসে জল ঢেলে খেয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। মেয়েটা তার কই সে কিছুই জানে না। কেন যে এমন করল? তৃষার বাবা তারিকুল ইসলাম ভেতর দিয়ে একটু অন্যরকম। দুনিয়ার সব কিছু সে সহ্য করতে পারবে তবে অসম্মান নয়। কত আদর – যত্ন দিয়ে তৃষাকে মানুষ করিয়েছেন। পড়ালেখা করিয়েছেন। কখনো কোনো কিছুতে বাঁধা দেয়নি। ওর সাথের যখন সবার বিয়ে গেল তখনো পড়িয়েছেন মেয়েকে। সেই মেয়ে পরিবারের কোন সম্মান রাখল? সব শেষ। সব কিছুই শেষ। বাড়ির মেয়ে যেদিন বাড়ির অসম্মান করে পালিয়ে গেল সেদিন রাতে তৃষার সব জিনিস, সব কিছুই বাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিলেন তরিকুল। মনে ব্যথা পেয়েছেন তো! তৃষাকে সেদিনই মনে মনে কবরে শুইয়ে দিয়েছিলেন সে। ওই মেয়ে তার জন্য মৃত। বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার যাওয়া থেকে শুরু করে কত আবদার রেখেছেন তার ফল তো পেলেনই। সবাই যখন বলত, ‘মেয়ে মানুষের এত নাচন-কুদন ভালা না। একটা বিয়া করাইয়া দাও সময় থাকতে থাকতে।’ তখন তরিকুল মেয়ের হয়ে সাফাই গেয়েছিলেন। তার ঢাল হয়ে ছিলেন। তৃষার একটাই সমস্যা যুবরাজ রাজনীতি করে আর সেই রাজনীতি তৃষার বড্ড অপছন্দ। আরে বিয়ে করে স্বামীকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিলেই তো হতো। রাজনীতি করে তো কী হয়েছে? ওই ছেলের কত ক্ষমতা সেই সম্পর্কে ধারণা আছে? ওইদিন যুবরাজ যখন জিম্মি করেছিল তাদের তখন লজ্জায় চোখে চোখ তুলে তাকানোর সাহস না পেয়ে পাগলের মতো সব কর্মকাণ্ড করেছে। পাগল ভাবুক। ওই প্রশ্নের তো জবাব নেই। তাই পাগল হয়েই হা হয় তার চোখে থাকুক। তনিমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এ-ই রাতটা শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটবে কখন?
–
সাইন্ড বক্সে তখন লো ভলিউমে একটা গান বাজছে। ‘প্রেম আমার ওওওওওও প্রেম আমার।’ সেই গানের সঙ্গে কে যেন শিস বাজাচ্ছে আর গুন-গুন করছে সেই বদ্ধ ঘরটিতে। কালো হুডি পড়া লোকটার মুখে এতক্ষণ ভয়ানক দেখতে যেই মুখোশটা ছিল সেটা সে খুলে টেবিলের ওপর রেখেছে। হাতে তার একটা লাল গোলাপ। মুখোশটা মুখের ওপর থেকে সরাতেই তার অতি সুদর্শন মুখখানার দর্শন পাওয়া গেল। যেই মেয়েটা ঘরের কোণে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে তার এই মুখশ্রী দেখে কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই সুন্দর চেহারার পেছনে লুকিয়ে আছে একটা ভয়াল রূপ। লোকটা তাকে জীবিত রেখেছে অবশ্য তবে এটাকে বেঁচে থাকা বলে না। আজকে দু’দিন হলো তার পেটে কিছু পড়েনি। এখন সামনে যা পাবে তাই সে অনায়াসে খেতে ফেলতে পারবে। এই সদর্শন পুরুষটা কত যত্ন নিয়ে সিগারেট দিয়ে তার শরীরের গোপনীয় স্থানগুলো ঝলসে দিতে একবার পরোয়া করেনি। মেয়েটি প্রশ্ন করেছিল বিধায় তার নিচের ঠোঁটটা কেটে ওই ঘরে বন্দী করে রাখা একটা হিংস্র কুকুরকে খাইয়েছে। লোকটা মুচকি হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এক পা দুই পা করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে চোখের সামনে থেকে চুলগুলো আলতো করে পরম যত্নে সরিয়ে দিয়ে হাতটা ছুঁয়ে বলে, ‘কী করে পারলে যার সঙ্গে সংসার করবে বলে কথা দিয়েছিলে তাকে চিরদিনের মতো ছেড়ে অন্য কারো বাসরে গা ভাসাতে?’ লোকটি মেয়েটির হাতের মেহেদীর দিকে ভালো করে চাইল। এই রঙ যে তার মস্তিষ্কের নিউরনে কারফিউ জারি করছে। ওই রঙ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। অসহ্যকর ঠেকছে। মেয়েটির আতঙ্ক তখন যেন আকাশচুম্বী। ভয় আর আতঙ্কের মিশ্র অনুভূতিতে সে স্তব্ধ। কেবল কাঁপছে তার শরীর। মেয়েটি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। ঠোঁটটা কাটার পর মুখ থেকে শুরু করে চোখ সব কিছুই ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তবুও সে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কেবল বোঝাতে চাইল, ‘আমায় মেরো না। আমার সংসার জীবনের ফুলটা এভাবে ছিঁড়ে ফেলো না। আমায় আমার স্বামীর কাছে ফিরতে দাও।’
লোকটি এবার আবার বলে উঠল, ‘অন্য কারো জন্য মেহেদী পড়তে পারবে না। কিছুতেই না।’ সে তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে চাকুটা বের করে মেয়েটি কিছু ভেবে উঠার আগেই একের পর এক আঘাত বসিয়ে দিলো তার হাতের তালুতে। ওপর দিকে। যেখানে যেখানে মেহেদীর রঙ ছিল সব ঢেকে দিলো। কখন যে গতি বেড়ে গেল, শক্তি বেড়ে গেল। হাতের চামড়া বেধ করে মাংশের আবরণ হা করে বেড়িয়ে এলো লোকটির সেদিকে খেয়াল নেই। খেয়াল সেই রগ কেটে যাওয়ার পর মেয়েটি সেই কখনই কাতরাতে কাতরাতে দম ছাড়ল। তাতেও যেন খুনির খুনের স্বাদ মিটল না। সে মৃত মেয়েটিকে শুইয়ে দিয়ে গলায় বড় ছুড়িটা ধরে কোপের পর কোপ বসিয়েই চলল। যতক্ষণ না আলাদা হয় ঠিক ততক্ষণে। গলার থেকে বেড়িয়ে আসা রক্তে সে রঞ্জিত। তার তো এই গন্ধটারই দরকার ছিল। সে ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়া রক্তগুলো হাতে মেখে আনন্দ লাভ করল। গালে-মুখে ছিটকে আসার পরও সেই রক্ত ইচ্ছে করে সে মুখে মাখল। নাকের কাছে নিয়ে চোখ বুজল। তবে একটা কাজ করা বাকি। খুনি উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে কেচিটা হাতে তুলে নিয়ে সেই গানের তাল মিলিয়ে গলার জোর বাড়িয়ে গাইল,
~তুমি ছাড়া আজ একা এমন, স্বপ্নের লাশঘর।
ভেঙে যাওয়া এই বুকের পাঁজর ধূ ধূ মরুপ্রান্তর।
তবুও প্রেম এসে, ভালোবেসে আজও দেখা দিয়ে যায়। যেই ছুঁতে যাই, আমি হাত বাড়াই, কেন দূরে সরে যায়? প্রেম আমার ওওওওও প্রেম আমার।’~
গান গাইতে গাইতে গোড়া থেকে চুলগুলো কেটে নিয়ে বলল, ‘এই চুলগুলো কোন পুতুলটার চুলে লাগাই বলোতো নবোঢ়া?’
–
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রানীবিদ্যা বিভাগের ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৃষা। আজ একটা প্রোগ্রাম আছে। কত মানুষ কত রং ঢং করে সেজে এসেছে। তৃষা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে শিমলার সঙ্গে তাদের সমালোচনা করছে। একটা মেয়ে একটু আগে সামনের গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। তাকে দেখে তৃষা শিমলাকে বলল, ‘দেখ দেখ মেয়েটা নিজেকে ডিপিকা ভাবছে। লাগছে তো হিরো আলমের বউ। খালি সাজলেই হয় না। সে ভাবছে তাকে কত সুন্দরই না লাগছে।’ বলেই দুজনের যে কী হাসি। পাশেই দু’টো ছেলে যাচ্ছিল তাকে দেখে শিমলা তৃষাকে বলল, ‘এই তৃষা! ওইটা তোর আর এইটা আমার।’
তৃষা মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘না না সব তুই রেখে দে। আমি ভালো হয়ে গেছি।’
‘সে কী রে? কেমন করে হলি?’
‘কারো দর্শন পেয়ে ভালো হয়ে গেছি রে। এখন ওই বান্দাকে পেলেই হয়েছে।’
তৃষা তার ওরনাটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছিল। হঠাৎ অনুভব করল কেউ তার ওরনায় পেছন থেকে হাত দিয়েছে। ওই শালা প্রেম নিশ্চয়ই? আজকে সে প্রেমকে এমন একটা ঘুষি দেবে না একেবারে বংশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে মাইরি। তৃষা গালি দেওয়ার জন্য পেছনে তাকাতেই দেখল একটা কালোমতো ছেলে তার ওরনাটা টেনে ধরেছে। তার সঙ্গে আরেকটা ছেলে আছে। তৃষা রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশের ছেলেটা বলল, ‘বেশি তেজ এখানে চলে না। আমাদের ভাই রাজনীতি করে। ছাত্রলীগ চেনো মেয়ে?’
‘ছাত্রলীগ নাকি ঘাতকলীগ তাতে আমার কী? রাজনীতির কোনো চ্যাপ্টারে বুঝি লেখা আছে মেয়ে দেখলেই ওরনা টেনে ধরতে হবে?’
‘না তবে তুমি চাইলে চ্যাপ্টার আমি নিজেই তৈরি করতে পারি।’
‘ওরনা ছাড়েন নইলে দুনিয়া ছাড়িয়ে দেব।’
ছেলে দু’টো হেসে উঠল। ততক্ষণে সেখানে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। সবাই কেবল দেখছে কোনোরকম সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। তৃষা একবার চারদিকে তাকালো। এটা কী সুটিং চলছে নাকি? মেজাজটা তার গরম হয়ে যায়। শিমলা কি করবে বুঝতে পারছে না। তৃষা ওরনাটা ছিনিয়ে নিতে যাবে তার আগেই ছেলেটা ওরনা ছেড়ে দিয়ে পাশের জনকে বলল, ‘আজকে রাতে আমার রুমে একেই পাঠাবি। তেজ কতখানি একটু মেপে দেখতে হবে না?’
তৃষা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটার কাঁধে কেউ একজন হাত রাখল। ছেলেটি পাশ ফিরে তাকাতেই আবিষ্কার করল প্রেম নেওয়াজকে। প্রেম সকলের সামনে তৃষার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ আরে হ্যাঁ নেতা সাহেব নাকি? এটাকে রুমে নিয়ে যাবেন? রুচি দেখছি আপনার মাটির নিচে চলে গেছে। ওর থেকে তো ওর সাথের টাই ভালো।’ শিমলা ভয়ে আরো চুপসে গেল। তৃষার তখন রাগ আর ঘৃণায় চোখ দিয়ে জল পড়ছে। দূর্বলতা আর ভয় সেই জলের উৎস নয় বরং রাগ সেই জলের উৎস। প্রেম সেই জল দেখে আরো হাসল। ছেলেটির কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘এমন তেজ মেপে দেখবা ভাই, যেন চিৎকার করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। মেয়ে মানুষের এত দেমাক কিসের? দিস ইজ অ্যাবসোলিউটলি ফাকিং রং।’
দু’জনের চোখ তখন একে ওপরের দৃষ্টি মিলেছে। একজনের চোখে উপহাস অন্য জনের চোখের জলে তীব্র ঘৃণা।
চলবে?
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষ্ণা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৬+৭
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৩+১৪
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২১+২২
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩০(বিবাহ স্পেশাল পর্ব)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪+৫
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৩+২৪
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২+৩
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৯+সারপ্রাইজ পর্ব
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৫+১৬