#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১৩
চোখে সূর্যের আলো পড়তেই ঘুমটা তখন হালকা হয়ে আসে তৃষার। সে উঠে বসতেই দেখল ৯ টা বাজে বেলা। হায় আল্লাহ প্রথম দিনেই এত লেট? তৃষার স্পষ্ট মনে আছে ভোরের দিকে তার ঘুম ভেঙেছিল। তখন সে উঠে ওই জঙ্গলের দিকটায় যায়। হঠাৎ কেউ একজন তাকে পেছন থেকে চেপে ধরে। ব্যাস তারপর কী হয়েছিল মনে নেই। তৃষা তখনো চোখে ঝাপসা দেখছে। উঠে বসতেই একজন মহিলা নক করে রুমে ঢুকে বলল, ‘আপা আপনার ঘুম কি ভাঙছে? এই বাড়ির মানুষ সকালে একলগে খাওয়ান খায় । আপনারে বড় মেডাম ডাক পারে।’
তৃষা কাজের মহিলা জুনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসছি। জাস্ট পাঁচ মিনিট।’
‘আইচ্ছা।’
তৃষার মাথাটা এখনো ঘুরাচ্ছে। সে বারান্দায় গিয়ে ডানপাশের সেই জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে জলদি ভেতরে ঢুকে পড়ল। স্বপ্ন নাকি সত্য কি দেখেছে এখন নিজেরই মনে পড়ছে না। নাস্তার টেবিলে এসে বসতেই হেতিজা হেসে বলল, ‘শরীর অসুস্থ নাকি?’
‘না। তবে কেমন যেন একটা লাগছে।’
‘নাস্তা করে নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তৃষা টেবিলে প্রত্যুষকে খুঁজল। অথচ পেল না। এখন মুখ ফুটে জিজ্ঞেস তো করতে পারে না হবু শাশুড়ীকে, ‘ওগো মা শুনছেন আপনার ডাউনলোড করা ওই হ্যান্ডসামটা সকাল সকাল তার চাঁদমুখ খানার দর্শন না দিয়েই কম্মে গেল?’
প্রেমা এসে বসতেই তৃষা বলল, ‘আজ থেকে পড়ালেখা শুরু করতে হবে কিন্তু।’ সেই কথায় প্রেমা বিশেষ খুশি হতে পারল কিনা বলা দায়। সে ফোন এনে গ্লাসের সঙ্গে হেলান দিয়ে ফোনটা রেখে কোরিয়ান ড্রামা ছাড়ল। তৃষা ভেতর ভেতর তা দেখে বলল, ‘খাওয়ার টেবিলেও ফোন এনে এই ড্রামা দেখা?’ তবুও সে মুখে হাসি বজায় রেখে বলল, ‘তো কী ড্রামা আজকাল দেখা হচ্ছে?’
‘লাভলি রানার। নায়কটাকে আমার যা লাগে না। তবে যতই সুন্দর হোক না কেন কই সে আর কই প্রেম ভাই।’
শেষের কথাটা একটু ধীরেই বলল প্রেমা। তৃষা তাতে বিশেষ পাত্তা দিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচতলার ঘর থেকে সিদ্দিক নেওয়াজ এসে টেবিলে বসতেই হেতিজা তৃষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তৃষা তখনো বুঝতে পারছেন না এই লোকের পদবী দেওয়ান না হয়ে নেওয়াজ কেন হয়েছে। সিদ্দিক একবার চারিদিকে তাকিয়ে মোখলেসকে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রেম কোথায়? আজকে শুক্রবার। সে কী ভুলে গেছে শুত্রুবার যে সবাই একসঙ্গে মিলে খাবার খাই আমরা? আর এই হেতিজা! প্রত্যুষ কোথায়?’
হেতিজা বাবার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘বাবা সে ভোরে বের হয়েছিল শুনলাম। রুমে আছে। ফ্রেশ হয়েই নিচে নামবে।’
‘যাও কালুর বাপ প্রেমকে নিয়ে আসো।’
তৃষা ভ্রু কুঁচকে সিদ্দিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এমা উনি এই বয়সে প্রেম ভালোবাসাকে ডেকে আনতে বলছে কেন? আচ্ছা ডাকুক। ভালোবাসার তো বয়স হয়না।’
মোখলেস যাওয়ার জন্য দরজার সামনে যেতেই চোখ আঁটকে গেল এদিকটায় এগিয়ে আসা পুরুষের দিকে। মোখলেসের মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, ‘আরে আপনার জন্যই অপেক্ষা করতাছে সবাই।’
প্রেম একটা মুচকি হাসি নিয়ে বলল, ‘চলো তাহলে। অনেক ক্ষুধা পেয়েছে।’
প্রেমের পড়নে সাদা একটা প্যান্ট। আজকে আর গলায় কোনো লকেট নেই। কেবল হাতে একটা রোলেক্সের ঘড়ি। হালকা নীল রঙের শার্টে তাকে ওই আকাশের মতোই অপূর্ব লাগছে। গায়ের রঙটার সঙ্গে জামার রঙটা যে কি দারুণ মানিয়েছে। সানগ্লাসটা চোখেই ছিল ভেতরে যাওয়ার সময় খুলেছে। প্রেম ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ের সেই রোজা ব্রেন্ডের পারফিউমের গন্ধটা ছড়ায়। তৃষা খাবারটা মাত্র মুখে তুলেছিল। ওমা প্রেমকে দেখতে পেয়ে নাক-মুখে সেই খাবার নিমিষেই উঠে গেল। প্রেমা তাকে পানি এগিয়ে দিবে নাকি প্রেমকে দেখবে নিজেই বুঝতে পারছে না। তবুও পানি এগিয়ে দিলো। তৃষার মাথা তখনো কাজ করছে না। সে তৃষাকে দেখেও না দেখার একটা ভঙ্গিমা করে একেবারে তৃষার পাশের চেয়ারে বসে জুনুকে বলল, ‘ পাউরুটিগুলো মাখন দিয়ে টোস্ট করেছো তো?’
‘জ্বী।’
‘আর স্ট্রোবেরি এবং চকলেট? শুনো সকাল সকালই এত গরম পড়েছে আজ। কোল্ড কফি দিবে সঙ্গে।’
‘আর কিছু?’
‘ডিম হাফ বয়েল। পুরো সিদ্ধ ডিম যেন না হয়।’
তৃষা নিজের নাস্তার দিকে তাকায়। সে সকাল সকাল পরোটার সঙ্গে চা আর সবজি খাচ্ছে। ডিম ভাজিও আছে। আর প্রেমকে দেখো কি সব বড়লোকি খাবার খাচ্ছে। কিন্তু কথা সেটা নয়। তৃষা নেশা তো করেনি তবে চোখের সামনে প্রেমকে কেন দেখছে। আর এই ছোকরাকে আজ একটু বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে না? এ কোথায় এসে পড়ল? মাথার ব্যথাটা দ্বিগুণ হয়ে গেল। তৃষা হাবার মতো চায়ে চুমুক দিতেই সিঁড়ি বেয়ে প্রত্যুষ নেমে আসে। কালো একটা ব্লেজার পড়া। ভেতরে সাদা শার্ট। গলায় টাই। একেবারে খাঁটি জেন্টেলম্যান যাকে বলে। তৃষার তো এবার মাথাটা ঘুরে যাওয়ার পালা। গায়ের পারফিউমটা মাথা হ্যাং করে দিচ্ছে। প্রত্যুষ মুচকি হেসে তৃষার পাশের সিটটায় বসল। তৃষার বামে প্রেম আর ডানে প্রত্যুষ। একজন একটু কম সুদর্শন হলে পারত না? শ্বাসকষ্ট উঠে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে এই কেউ এম্বুলেন্সের খবর দে নয়তো, নয়তো কিছু একটা কর। এভাবে আর কতদিন অবিবাহিত হয়ে বাঁচব? যৌবন তো চলে যাচ্ছে সুপুরুষ দেখতে দেখতেই।
–
সন্ধ্যার দিকে প্রেমাকে পড়াতে বসে তৃষা জানতে পারল আসলে এই বাড়ির ছেলে হচ্ছে প্রেম নেওয়াজ। আর প্রত্যুষ তো দেওয়ান বাড়ির ছেলে। তবে এখানেই মানুষ হওয়া। তৃষা এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। প্রত্যুষ আর সে এক বাড়িতে আছে সেই খুশিতে লুঙ্গি ডান্স করবে নাকি প্রেমের বাড়িতে তাকে থাকতে হবে এই ভেবে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলে থাকবে? এই প্রেম নেওয়াজের জন্য কোথাও শান্তি নেই। তৃষা প্রেমাকে ওদিকের জঙ্গলটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। সেধে সেধে জিজ্ঞেস করাটা কেমন যেন হয়ে যাবে না? এত ছোটলোক নাকি সে? পড়া শেষ হতেই তৃষা নিজের রুমের বারান্দায় গিয়ে আবারও উঁকি ঝুঁকি মারল জঙ্গলটার দিকে। আচ্ছা ওইখানে কে থাকে? আর সকাল সকাল প্রেম নেওয়াজ এমন জামাই সেজে বাইরে থেকে কেন এলো? গেটের দিকে চোখ যেতেই দেখল প্রত্যুষ গাড়ি বের করে কোথাও একটা যাচ্ছে। ইশ একবার যদি তার দিকে তাকাতো। তৃষা মনে মনে গেয়ে উঠল,
~আমার দিকে চাইয়া দেখেন বয়স কত অল্প
সারারাত জেগে আমরা করব অনেক গল্প।~
দুই লাইন গেয়েই তৃষা থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আব্বে শালা রাত জেগে গল্প কেন করব। করার মতো তো বহুত কাজ আছে। বংশবিস্তার রেখে গল্প? টু মাচ ফকিরা কাজকারবার।’
তৃষা ভালো করে সন্ধ্যা নামতেই তিরিং বিরিং করে চোরের মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আজ তো ওই জঙ্গলে যাবেই যাবে সে। ওইখানে কেমন ফাঁকা স্পেস আছে দেখে আসতে হবে না? নইলে পরের বার প্রত্যুষ জানেমানকে নিয়ে জঙ্গলে মঙ্গল করবে কেমন করে? তৃষা সুন্দর ভাবে তৈরি হয়ে গায়ে একেবারে পারফিউম মেরে জঙ্গলের দিকে হাঁটা ধরল। এইবার ফোনটা সাথেই ছিল। সেখানে যেতে সময় লাগেনি। তবে তৃষা এখনো বুঝতে পারছে না ভোরে কি সে সত্যি এখানে এসেছিল নাকি সবটা ভ্রম। আর যদি সত্যি হয়? তাহলে কে তাকে রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে? ওমা আশিক জ্বীন নয় তো? এমনিতেই তৃষা একটু সুন্দর মানুষ। একদিকে মানুষ তাকে বিরক্ত করে অন্যদিকে ভূতে। কি ননসেন্স বিষয়!
তৃষা জঙ্গল পেরিয়ে শেষে গিয়ে দেখল একটা কাঠের বাড়ি। নিচের দিকে তার আবার থাইগ্লাস দেওয়া পুরোটা। একটা বাতি জ্বলছে। নইলে তো অন্ধকারের গুদাম হয়ে যেত এই জায়গাটা। তৃষার কেন জানি বাড়িটার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হলো। আচ্ছা সে রিলসে দেখেছে এমন পরিত্যক্ত বাড়িতে অনেক টাকা-পয়সা পাওয়া যায়। খুঁজে দেখবে নাকি? তৃষা থাইগ্লাসের সামনে গিয়ে খোলার চেষ্টা করতেই সেটা খুলে গেল। সে কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরের সব ফার্নিচার কালো রঙের। অদ্ভুত সব এন্টিকের জিনিসপত্র। তৃষা পানির শব্দ পেল। সেই সঙ্গে আরো বেশ কিছু শব্দ কানে এলো তার। আরেকটু সামনে যেতেই একটা ওপেন কিচেন দেখল। একটা লোক কিচেনে কি সব করছে। পেছন থেকে কেবল পিঠময় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। লম্বাচওড়া কাঁধ। পেশীগুলো কি নিখুঁত আর সুঠাম। কালো রঙের একটা ট্রাউজার পড়া। বুকটা নগ্ন। পিঠে উইংড স্ক্যাপুলা দেখা যাচ্ছে। কাঁধের কাছে, পিঠেরহাড়ের উপর থেকে স্পাইন পর্যন্ত উঁচু এবং আলতো সরে থাকা হাড়ের ছাপগুলো পিঠে ছোট্ট বাটারফ্লাইয়ের আকৃতি ধারণ করেছে। লোকটা মৃদু নড়তেই সেই ছাপগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। তৃষা আরেকটু কাছে যেতেই বুঝতে পায় লোকটা মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে। পরিচিত একটা পারফিউমের গন্ধ নাকে আসতেই সেই লোকটি এবার পেছন ফিরে তাকালো। মুহূর্তেই তৃষা জমে উঠল। ওমা এ তো দেখি প্রেম নেওয়াজ! প্রেম কেবল তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল, ‘প্রথমে ভার্সিটি, তারপর বাড়ির মধ্যে, এখন এখানেও। নেক্সট কোথায় যাবে? প্রেম নেওয়াজের বিছানায়?’
‘মুখ সামলে কথা বলুন।’
‘মুখ তো সামলেই রাখব। কিন্তু নিজেকে কতক্ষণ সামলাতে পারব জানা নেই।’
‘প্রেম ভা…ই!’ তৃষার চোখে স্পষ্ট ভয়।
প্রেম ছুড়িটা হাতে নিয়ে তুলে নিয়ে বলল, ‘এসে যখন পড়েছোই ছাড়ি কি করে?’ সে গুনগুনিয়ে ওঠে,
~ওয়ালকাম টু মাই ডার্কসাইড।~
চলবে
(সবাই রেসপন্স করবেন। পড়ে কেবল লুঙ্গি খুলে দৌড়ে চলে যাবেন না।)
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১৪
প্রেম একটু একটু করে এগিয়ে আসে তৃষার দিকে। তৃষা একটা ঢোক গিলে পেছানোর জন্য প্রস্তুত হতেই এক মুহূর্তে প্রেম তৃষার গলা চেপে ধরে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে আসে। প্রেমের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের পতন তৃষার শরীরে পড়তেই তৃষার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। গলাটা এই লোক এত জোরে চেপে ধরেছে। তৃষা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই প্রেম তার হাত দু’টো এক করে পেছনের দিকে নিয়ে জোরে করে চেপে ধরে। তৃষা রাগে তখন ফেটে একাকার। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। প্রেম তা দেখে বোধহয় আনন্দই পাচ্ছে। সে একবার তৃষার ঠোঁটের দিকে তাকায়। একেবারে কাছে এসে নমনীয় কণ্ঠে বলে, ‘এটা জাহান্নাম তৃষা। এখানে তোমায় স্বাগতম।’ বলেই তৃষাকে ছেড়ে দেয় প্রেম। ধাক্কাটা এতই জোরে ছিল যে নিজেকে সামলাতে তৃষার ভালোই কষ্ট হয়। কোনো মতে তৃষা নিজেকে সামলে উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘আপনি মানুষ নাকি জানোয়ার? আমার গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আমি কি এমন সর্বনাশ করেছি আপনার?’
‘আমার বাড়ির মধ্যে অনুমতি ব্যাথিত প্রবেশ নিষিদ্ধ। জবাব দাও কেন এসেছো জুনিয়র এখানে?’
‘আমি কি জানি আপনার এই পাগলখানায় আসা নরমাল মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ?’
প্রেম তৃষার দিকে এগিয়ে আসতেই তৃষা দুই কদম পিছিয়ে যায়। প্রেম তা দেখে থেমে গিয়ে বলল, ‘আরেকটা বাজে বকলে থাপড়ে মুখের জিওগ্রাফি বদলে দেব।’
‘বদলাতে আমিও অনেক কিছু জানি।’
‘আমার বাল জানো তুমি।’
‘মুখে লাগাম টানুন প্রেম ভাইয়া।’
‘তোর ভাইয়ার গুষ্টির তুষ্টি।’
‘আমি গেলাম। আর কখনো এই বালের বাড়িতে আসব না। এটা বাড়ি হলো? মনে হচ্ছে ভ্যাম্পায়ের বাড়িতে ভুল করে ঢুকে পড়েছি।’
‘তুমি ওই ভুল করে ঢুকতেই পারবা। বের হওয়ার ক্ষমতা নেই।’
‘যাচ্ছি।’
প্রেম পেছন থেকে তৃষার হাত ধরে পুনরায় তাকে নিজের কাছে টেনে আনে। এবার আর আঘাত নয়। চোখে চোখ রেখে মুখের ওপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নিজের ইচ্ছায় এসেছো যাবে আমার ইচ্ছায়।’
‘আমার লাগছে প্রেম ভাই।’
‘বার বার ভাইয়া বলে হৃদয়ের ক্ষত বাড়িয়ে দিও না সোনা।’
প্রেম তৃষাকে উল্টো ঘুরায়। তৃষার চুলগুলো একবার পেছন থেকে স্পর্শ করে মুখ গুঁজে দেয়। নিমিষেই তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে। তৃষার যেন একেবারে সহ্য হচ্ছে না। সে ছ্যাৎ করে উঠল, ‘আপনার ক্ষতের মধ্যে আমি লবণ চিপড়ে দিব।’
‘দেখ সোনা তুমি নিজেকে বেশি সুন্দরী আর সাহসী ভাবছ বোধহয়। প্রেম তোমাকে এখনো ধরেইনি। যেদিন ধরবে সেদিন আর ঘুম ভাঙবে না তোমার। তাই তর্ক আমার সঙ্গে করো না। মুখে মুখে তর্ক আমার একেবারে অপছন্দ। এসব অপছন্দের কাজ করে আমাকে রাগাও কেন বার বার? লুক, কত ভালো করেই তো কথা বলছি?’
‘আপনি ছাড়বেন?’
প্রেম আরো শক্ত করে তৃষাকে চেপে ধরে। ব্যথায় তৃষার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লে প্রেম সেই জল আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, ‘এখন তো এই বাড়ির চাকর তুমি। টাকা গিলছো, খাচ্ছো। খালি এসব করলেই কি হবে? প্রেম নেওয়াজকেও তো খুশি করতে হবে না?’
‘ছি কী নোংরা আপনি!’
‘এত পবিত্রতা দেখাবে না আমার সামনে। দুনিয়ায় এত পবিত্রতা থাকলে জনসংখ্যা আজ এত বাড়ত না।’
‘আপনার মতো মানুষদের জন্যই দেশের আজ এই অবস্থা।’
‘যেভাবে বলছো আমি মনে হয় আমার বিশ-পঁচিশটা বাচ্চা-কাচ্চা তোমায় ডোনেশন করেছি? তবে তুমি চাইলে একটা আপাতত করে দেখতে পারি। যদিও আমার সঙ্গে বিক্রিয়ায় যাওয়ার মতো ক্ষমতা, যোগ্যতা কোনোটাই তোমার মধ্যে নেই।’
‘আরে ভাই এখন ছাড়ুন তো। এমন চেপে ধরে যে দাগ বানিয়েছেন এখন মলমের খরচা কে দিবে? আপনার নানায়?’
‘না তোর নানা আছে না? ওইটাকে কবর থেকে তুলে এনে খরচার টাকা নিবি। তোর মতো প্রোডাক্টের ওপর তো একমাত্র ডেইট ওভার ফেনসিডিল খাওয়া পাবলিক ছাড়া কেউ ইনভেস্ট করবে না। আর আমার ভেতর এত কুতকুতানি নেই যে তোর পেছনে টাকা ঢালব। সুন্দরী হলে না হয় ভেবে দেখতাম।’
তৃষা মুখ ফুলিয়ে গালি দেয় প্রেমকে মনে মনে। এই লোকের মুখের কী ছিড়ি। একেবারে যেন লাগাম ছাড়া রেসের গরু! প্রেম তৃষাকে ছেড়ে দিতেই তৃষা বলল, ‘আপনি একদমই ভালো না প্রেম ভাই। কথা দিলাম আর কখনো আমায় এদিকটায় দেখবেন না। আপনি আমার ভার্সিটির সিনিয়র কেবল এই টুকুই জানি আমি। এছাড়া আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনাদের বাড়ির মেয়েকে পড়াই, এখানে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই টুকুই আমার পরিচয়।’ মুখে এটা বললেও মনে মনে তৃষা বলল, ‘দাঁড়া ব্যাটা শয়তান। আমার সঙ্গে সুযোগ পেয়ে আজ এমন করলি না? তোর ভাইয়ের বউ হয়ে যদি তোর উপর অত্যাচার না করি তবে আমিও তৃষা নুজায়াত না।’
‘আজকে রাতটা আমার ঘরেই থেকে যাও।’
‘মাথা আপনার শেষ। এই মাথা আর দেশের কোনো কাজে লাগবে না।’
‘মাথা কাজে না লাগুক। শরীরটা তো কারো না কারো কাজে লাগবে।’
‘কার?’
‘তোমার।’
‘আপনার শরীর দিয়ে আমি কি করব? নিজের শরীরটাই তো সামলাতে পারি না।’
‘আমারটা অনেক কাজের সোনা। এই শরীরটা দেখতে পাওয়াও কত নারীর স্বপ্ন জানো?
‘রুচি খারাপ হলে যায় হয় আর কী। অনেক প্যাচাল শুনেছি। যেই দাগ আপনি আজ বানালেন না? তা একদিন তিন ডাবল দিয়ে তৃষা উসুল করে ছাড়বে। আমি তৃষা। আমায় যেন-তেন ভাববেন না। আমি ওইসব মেয়ে না যে কেউ উঁচু গলায় কথা বললে চুপ করে থাকব। আমি তৃষা, আমার সঙ্গে গলা উঁচু করে কেউ কথা বললে আমি তার গলার রগটাই টেনে ছিঁড়ে আনি। মাইন্ড ইট।’
প্রেম তাকিয়ে বাঁকা হাসল। তারপর বলল, ‘আই লাইক ইট। গল্পে সাসপেন্স, থ্রিল না হলে নিরামিষ লাগে।’
প্রেম কাছে আসতেই এবার তৃষা দেয় এক দৌড়। তবে তাড়াহুড়োয় থাইগ্লাসটা দেখেনি। একটা বারি খেয়ে ধপাস করে পড়ে যায়। প্রেম তখনো ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রয়। যেন কিছু হলোই না। তৃষা সামলে উঠে দাঁড়াতেই প্রেম ফ্রিজ থেকে স্ট্রোবেরি বের করে সেটা চকলেটের সঙ্গে মাখিয়ে মুখে দিয়ে বলল, ‘পরের বার এলে পারফিউমটা বদলে আসবে। এটা পারফিউম কম এয়ারফ্রেশবার লাগছে বেশি। তবে শ্যাম্পুর গন্ধটা চলে।’
তৃষা কপালে হাত ঘষতে ঘষতে উঠে দাঁড়ালো। তারপর এক দৌড়ে বাইরে চলে গিয়ে বলল, ‘পরের বার এলে ডাস্টবিনের ময়লা নিয়ে আসব প্রেম ভাই আপনার জন্য।’
‘চিন্তা নেই সোনা। ওই ময়লা তো আমি তোমাকেই খাওয়াব। জলদি এনে ফেলো।”
‘শালা তোর জন্য ড্রেন থেকে শরবত তুলে আনব।’ আপন মনে বকতে বকতে তৃষা চলে গেল। এই তো এত করে বলল, আর জীবনেও বকাবকি, গালাগাল করবে না সে। ওই বিশেষ কথা কী তার মনে আছে? নাকি ব্রেনের সেই বিশেষ অংশটা ডিলিট হয়ে গেছে?
–
রাত নয়টা বাজে কেবল তখন। উঁচু উঁচু ভবনের ফাঁক গলে সেই আকাশ দেখা যায় টুকরো টুকরো করে, কোথাও অন্ধকার ঘন, কোথাও আবার বিদ্যুতের আলোয় ফিকে। নিয়ন সাইনবোর্ড, রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট আর দোকানের ঝলমলে আলো মিলে আকাশকে কেমন যেন চেপে রেখেছে। তবু মাঝেমাঝে ওপরে তাকালে দেখা যায়, অর্ধচন্দ্রটা ভেসে আছে। আলোটা ঝাপসা, কারণ ধোঁয়া আর ধুলার আবরণে তার দীপ্তি ম্লান হয়ে গেছে। খুব বেশি তারা দেখা যাচ্ছে না, যেগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলোও কেবল মিটমিটে বিন্দুর মতো। তবে এই আকাশেরও আলাদা একটা আকর্ষণ আছে। এই আকাশ যেন মানুষের ভিড়ের মাঝেও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। তার গভীর কালো রঙের ভেতর একটা কথা বারংবার ভেসে আসছে, “তুমি যতই হইচই করো, আমি আমার অসীমতাই ধরে রাখবো।” নেওয়াজ বাড়ির দোতলার ঘরে প্রেমা শুয়ে শুয়ে কোরিয়ান ড্রামা দেখছে। হঠাৎ মনে হলো রুমে কিছু একটা ঢুকেছে। ওমা কোরিয়ান নায়ক নাকি? গবলিন? ওর তো ক্ষমতা আছে হুট হাট সব জায়গায় যাওয়ার। প্রেমা নড়েচড়ে বসতেই শব্টা আবার হলো। এবার কেমন কেমন জানি একটা ভয় করছে। সে বারান্দার দিকে যায়। কই কিছু তো নেই। পেছনে ফিরতেই চিৎকার করে ওঠে। তবে শব্দ হওয়ার আগেই কেউ একজন তার মুখ চেপে ধরে। গালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘আমি তোমার মেহরাব গো।’
–
অন্ধকার রুমটার দেয়াল জুড়ে ছবি টাঙানো। টেবিলের ওপর কাগজপত্রের অভাব নেই। এখানে ওইসব নারীদের লিস্ট আছে যারা প্রতারক। আচ্ছা তাদের বেঁচে থেকে লাভ কি যারা একজনকে ভালোবেসে অন্যজনের এমন অনায়াসেই হয়ে যায়? লোকটি কালো হুডিটা গা থেকে খুলে ফেলল। মুখের মাস্কটা খুলে টেবিলের ওপর রেখেই এগিয়ে গেল শিকলের সঙ্গে বেঁধে রাখা নারীটির দিকে। নারীটি চুপসে আছে। ভয় আর আতঙ্ক তার ভেতর দানা বেঁধে আছে। লোকটি মেয়েটির সামনে বসেই তার চুল গুলো সুন্দর করে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কয় বছরের প্রেম ছিল?’
মেয়েটি চুপ করে রয়। ভয় তার ভেতরকার সব কথা গিলে ফেলেছে। লোকটির এই নিস্তব্ধতা একেবারেই পছন্দ হয়না। সে হাতের ছুরিটা মেয়েটির আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলল, ‘প্রশ্ন করলে কেউ যদি উত্তর না দেয় তখন আমার ভীষণ রাগ হয়।’
মেয়েটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি ভেচাং করে তার আঙুলটা কেটে নেয়। ঝর্ণার মতো রক্ত এসে তার মুখে ছিটকে পড়ে। পুরো ঘর কেঁপে উঠে মেয়েটির হাহাকারে, চিৎকারে। লোকটি উঠে দাঁড়ায়। পাশের ঘরে আলাদা একটা লোহার বিরাট খাঁচা আছে। তাতে হিংস্র একটা কুকুর বন্ধী। লোকটির আদরের কুকুর। সে ওই ঘরটায় গিয়ে আঙুলটা কুকুরটিকে দিতেই তা তৃপ্তি করে খেল সে। তা দেখে কেমন জানি শান্তিময় একটা হাসি ফুটে উঠল লোকটির মুখে। সে খাঁচার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘এবার কোন অংশটা খাবে বলোতো?’ বলেই সে আবার গান ধরল, ~প্রেম আমার ওওওও প্রেম আমার।~
চলবে
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষ্ণা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৭+১৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৭
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২+৩
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৬+৭
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৯+সারপ্রাইজ পর্ব
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৮+৯+১০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৯+২০
-
প্রেমতৃষা গল্পের লিংক
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২১+২২