bhooter golpo

কাপালিক—-(গোবিন্দ মন্ডল)


কাপালিক

✍️ গোবিন্দ মন্ডল
—–

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস।
হাড়-কাঁপানো শীতে কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম চড়িদা। গা ছমছমে নিঃস্তব্ধতা আর সন্ধ্যার পর মেয়েদের চাপা কান্নার মতো হাওয়া বয়ে যায়।
এই গ্রামের পাশেই এক পোড়োবাড়ি—লোকেরা একে বলে চণ্ডীমুণ্ডের মন্দির, কেউ কেউ বলে কপালভবন।

এই পোড়োবাড়ি সম্পর্কে স্থানীয়দের বিশ্বাস, সেখানে এক কাপালিক বসবাস করত বছর ষাটেক আগে। সে ছিল তন্ত্রসাধক, তার শক্তি নাকি এমন ছিল যে চোখে চোখ রাখলেই মানুষের প্রাণ বেরিয়ে যেত। নাম ছিল ভৈরবনাথ।

এই পাহাড়ি গ্রামে নতুন সরকারি ডাক্তার পোস্টিং পেয়েছেন একজন যুবক চিকিৎসক, নাম ডা. শ্রীধর সেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য পাশ করে বেরোনো, শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের মানুষ। রোগীদের সেবা করতে ও প্রকৃতির কাছে থাকতে চাওয়া তাঁর ছোটবেলার স্বপ্ন। চড়িদায় পোস্টিং পাওয়ার খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরা কিছুটা ভয় পেয়েছিল, কিন্তু শ্রীধর জেদের বশেই চলে এসেছিলেন।

স্টেশন থেকে জীপে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যখন তিনি চড়িদার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছলেন, তখন প্রায় সন্ধে।
গ্রামের প্রাইমারি হেলথ সেন্টারটি ছোট, তবে পরিষ্কার। তাঁর থাকার জন্য একটি সাদামাটা ঘর বরাদ্দ হয়েছে। জানালার পাশে একটা পুরোনো কাঠের টেবিল, দেওয়ালে কুয়াশায় আবছা হয়ে যাওয়া একটি কালীমূর্তি, আর এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ভাঙা আয়না।

প্রথম রাতে শুয়ে পড়লেন কিছু না ভেবেই। তবে ঘুম আসতে দেরি হয়নি। যাত্রার ক্লান্তিতে চোখের পাতাই যেন হঠাৎ নেমে এসেছিল।

কিন্তু সেই রাতেই তিনি প্রথম দেখলেন তাকে,

শ্রীধর মনে মনে বলল, এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি?

ঘরের মধ্যে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। ধাপে ধাপে তার পায়ের শব্দ। কুয়াশায় ভরা জানালা খুলে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে, আর তার সামনেই একটা মুণ্ডহীন দেহ দাঁড়িয়ে আছে! কাঁধে কাটা কপালের মালা, ছিন্ন মাথা হাতে ঝুলে আছে।

তার মুখ নেই, কিন্তু সে কথা বলে—
“আমার মুণ্ড ফেরাও… সপ্তম বলি পূর্ণ করো… আমি ফিরে আসব…”

শ্রীধর হঠাৎ চিৎকার করে উঠে বসে পড়লেন বিছানায়। গলা শুকিয়ে কাঠ, কপালে ঘাম।

ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৩টে। বাইরে নিঃশব্দ, কুকুরও ডাকছে না। শুধু বাতাসে যেন অদ্ভুত কিছুর গন্ধ, পচা রক্তের গন্ধ।

ভোরবেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পুরনো কর্মচারী রঘুনাথ মাইতি এসে চা নিয়ে ঢুকলেন। মুখে তার আতঙ্কের ছাপ—

— “ডাক্তারবাবু, গতকালই আপনাকে বলতে ভুলে গেছিলাম, এই ঘরটা… মানে, এখানে আগে একজন ডাক্তার ছিল, কিন্তু একদিন হঠাৎ উধাও। কেউ খুঁজেও পায়নি। আপনার তো কিছু হল না গতরাতে?”

শ্রীধর একটু হেসে বললেন,
— “একটু দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। আর কিছু না।”

কিন্তু তার চোখ বলছিল অন্য কথা। সেই চোখে কুয়াশার ভিতর লুকোনো আতঙ্ক ধরা পড়ে যাচ্ছিল।

দিন গড়াতেই শ্রীধর নিজের খাতা খুলে লিখতে শুরু করলেন—
“চড়িদার অদ্ভুত লোকবিশ্বাস ও মানসিক চিকিৎসার সম্ভাবনা।”

তার লক্ষ্য ছিল—গ্রামের লোকদের অন্ধবিশ্বাস দূর করে আধুনিক চিকিৎসার প্রচলন। কিন্তু তিনি জানতেন না, যে পৃথিবীটা তার সামনে খুলতে চলেছে, সেটা চিকিৎসা বা যুক্তিবোধ দিয়ে বোঝা যাবে না।

কারণ, রাত পোহালেই তাকে যেতে হবে সেই পোড়োবাড়ির দিকে। তার মাথার ভিতর বারবার বাজছিল সেই কণ্ঠস্বর— “সপ্তম বলি…”
সকালটা ছিল অসম্ভব শান্ত, যেন কিছু ঘটার আগমনী সুর বয়ে চলেছে।
ডা. শ্রীধর সকালে কিছু রোগী দেখে চেম্বারে বসেছিলেন। তখনই রঘুনাথের কাছ থেকে শোনেন—
“আপনি যেদিকে হাঁটতে বলছেন, ওটাই চণ্ডীমুণ্ডের পোড়োবাড়ি। আগে ওখানে নাকি এক তান্ত্রিক কাপালিক থাকত। অনেক গুজব আছে, কিন্তু আপনার মত লোক এসব শুনে হাসবেন।”

শ্রীধর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
— “গুজব আর বাস্তবের মাঝের দেওয়াটাই তো সবচেয়ে মজার, রঘুনাথদা। আমার তো মনে হয়, ওটা চোখে দেখে বুঝে নেওয়া দরকার।”

রঘুনাথ থমকে গেলেন।
— “আপনি ওদিকে যাবেন, একা? ডাক্তারবাবু, যারা গিয়েছে, তারা কেউ ফেরেনি…”

শ্রীধর মৃদু হেসে বললেন,
— “আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, বিজ্ঞান ছাড়া। আজ বিকেলে যাব, একটু জায়গাটা ঘুরে দেখে আসি।”

ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টা, হাতের একটা ছোট টর্চ আর নোটবুক নিয়ে শ্রীধর বেরিয়ে পড়লেন জঙ্গলের পথ ধরে।
গাছগুলো কেমন যেন কুঁকড়ে আছে, লতাপাতা মাটির বুক চুঁইয়ে যেন কিছু লুকিয়ে রাখছে।

প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর, এক জায়গায় এসে আচমকা ঠাণ্ডা হাওয়া লাগল শ্রীধরের শরীরে।
ঘাম জমাট বেঁধে গেল। গা শিরশির করে উঠল।
সামনে এক পোড়োবাড়ি—দেওয়াল ভাঙা, ছাদ নেই, কিন্তু ভিতরে যেন কিছু দাঁড়িয়ে আছে।

মনে হল, দেওয়ালের গায়ে রক্তে আঁকা কিছু মন্ত্র—
“ওঁ ক্রীং কালী কালী কাপালিন্যৈ নমঃ…”

হঠাৎ একটা শব্দ!
চ্যাঁচ্…চ্যাঁচ্… চ্যাঁআঁ…

মাটির ভেতর থেকে যেন কেউ হাঁসছে। মাটি ফেটে না গেলেও শব্দ উঠছে মাটির নিচ থেকে।
শ্রীধর টর্চ ফেললেন সামনের দেয়ালে। সেখানে আঁকা একটা চিত্র—এক কাপালিক, হাতে খাঁড়া, সামনে ছিন্নমুণ্ড মানবদেহ, আর তার পাশে আগুন।

দেয়ালের পাশে একটি আয়না ছিল, কালো হয়ে গিয়েছে।
তবে তাতে হঠাৎই নিজেকে দেখতে পেলেন শ্রীধর…

কিন্তু… সেখানে তাঁর নিজের মুখ নেই!

ভয় পেয়ে তিনি পিছিয়ে আসতেই একটা আওয়াজ শুনতে পেলেন—
“অমৃত চাই… বলি চাই… সপ্তম বলি!”

মাটি একটু নরম লাগছে এখানে। পায়ে চাপ দিলে বসে যাচ্ছে।
তবে আর দাঁড়ানোর সুযোগ নেই, আচমকা পেছন থেকে হাওয়ার ঘূর্ণি, ঠাণ্ডা একটা হাত তার কাঁধে পড়ল।

তিনি পিছনে ফিরলেন, সামনে দাঁড়িয়ে আছে—একটি ছায়ামূর্তি। মাথা নেই। কাঁধ থেকে ঝুলছে কপালের মালা। হাতে পুরনো এক খাঁড়া।

শ্রীধর দৌড়ে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেলেন একটা পুরনো পাথরে। মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারালেন।

রাত ৯টা। রঘুনাথ বাবু একা একা টর্চ নিয়ে খোঁজ করতে গিয়েছিলেন।
একটা গাছের তলায় পড়ে থাকা ডাক্তার শ্রীধরের গায়ে মাটি লেগে আছে, মুখ ফ্যাকাসে।

বুকে আঁকা এক লাল রঙের লেখা—
“তুমি সপ্তম বলি… তন্ত্র পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে।”

রঘুনাথবাবু কাঁপতে কাঁপতে যখন শ্রীধরকে ফিরিয়ে আনেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, তখন রাত প্রায় ১০টা। তাঁর শরীর জমে গেছে ঠাণ্ডায়, মুখে কথা নেই। তবে চোখ খোলা, স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে।

ডাক্তারের পরামর্শে গ্রামের লোকজন এক তান্ত্রিক ওঝা ডেকে আনতে চায়, কিন্তু রঘুনাথ কাউকে কিছু বলতে দেন না।
তাঁর মনে হচ্ছিল, এসব ডাকছোড়া করলেই খারাপ কিছু হবে।
সে রাতে শ্রীধর নিঃশব্দে বিছানায় পড়ে রইলেন।

ভোররাতে, ঠিক তখনই ঘরের মধ্যে ঘটে গেল অদ্ভুত কিছু।
জানালার ফাঁক দিয়ে হিমেল বাতাস ঢুকল ঘরে। একটা পুরনো খাঁচা জানালার পাশে ঝুলে পড়ে যায়—
আর সেই খাঁচার পেছন থেকে পড়ে বেরিয়ে আসে এক জীর্ণ খাতা।

চামড়ার বাঁধাই, কালচে হলুদ পৃষ্ঠা, পেছনে লেখা এক নাম—
“ভৈরবনাথ যোগী – চণ্ডীসাধনা ও মহাতন্ত্র কৌশল”

ঘুম ভেঙে গিয়েছিল শ্রীধরের। কুয়াশায় ঢাকা চোখে সেই বইটা তুলে নিয়েছিলেন। প্রথম পাতায় লেখা—
“এই পুস্তকে লুকিয়ে আছে আমার পুনর্জন্মের কৌশল। যেই পড়বে, সেই হবে আমার বাহক… সপ্তম বলি আমার শেষ রক্তপিপাসা…”

শ্রীধরের হাত কেঁপে উঠল। মাথার মধ্যে যেন ঘুরছিল সেদিনের পোড়োবাড়ির স্মৃতি, সেই মুণ্ডহীন ছায়া, সেই ফিসফিসানি—
“আমার মুণ্ড ফেরাও…”

নোটবুকটি ছিল তিন ভাগে বিভক্ত—

১. সাধনার ইতিহাস – যেখানে লেখা আছে কিভাবে মৃতদেহের মাথা ব্যবহার করে কাপালিক শক্তি অর্জন করত।
২. নরবলি তালিকা – ছয়টি নামের পাশে লেখা মৃতের তারিখ এবং “সিদ্ধ” চিহ্ন।
৩. সপ্তম বলির শর্ত –
“যে হবে যুক্তিবাদী, অসাধ্যকে অস্বীকার করে… তাকেই গ্রহণ করিব। কারণ, তার শরীরেই আমার চেতনা জন্ম নেবে। কপালের মালা সম্পূর্ণ হোক।”

তালিকার ছয় নম্বরে লেখা ছিল—
“ডা. বিনয় ভট্টাচার্য – ১৯৬১ – নিখোঁজ”
আর ঠিক তার নিচে লেখা—
“ডা. শ্রীধর সেন – অপেক্ষমান”

শরীর জুড়ে কাঁপুনি ধরে গেল। তিনি বইটা ছুঁড়ে ফেললেন দেওয়ালে, কিন্তু হঠাৎ বাতি নিভে গেল।
আয়নায় দেখা গেল তাঁর প্রতিবিম্বটা হাসছে… অথচ তিনি নিজে কাঁদছেন।

পরদিন সকালে রঘুনাথবাবুকে সব বললেন শ্রীধর, রঘুনাথবাবু এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে জানালেন—
“এই ঘরেই একদিন থাকত ডা. বিনয় ভট্টাচার্য । একদিন ঠিক এই নোটবুক সে আমাকেও দেখিয়েছিল। তারপর একদিন সকালে দেখা যায়, বিছানায় পড়ে আছে কপালের মালা আর রক্ত।”

— “আপনি যদি এবার না পালান ডাক্তারবাবু, তাহলে আপনি সত্যিই সপ্তম বলি হবেন।”

শ্রীধর নিঃশব্দে জানালার দিকে তাকালেন। মনে পড়ল বইয়ের শেষ বাক্যটি—
“আমার ফিরে আসা নির্ভর করে তার উপর, যে আমাকে বিশ্বাস করবে না…”

শ্রীধর রাতে ঘুমোতে পারছিলেন না। বারবারই মনে পড়ছিল সেই খাতা… সেই ছায়া… সেই হাসি।
তাঁর যুক্তিবাদী মন বলছিল, সবটাই বিভ্রম। কিন্তু শরীর বলছিল অন্য কথা।

সকালে ঘুম ভেঙে দেখা গেল, ডান কাঁধে পুড়ে যাওয়া দাগের মতো কিছু একটা!
দাগটা গোলাকার, মাঝখানে ত্রিকোণ। যেন কেউ তপ্ত কোনো শিলমোহর গেঁথে দিয়েছে ঘুমের মধ্যে।

তিনি চমকে উঠলেন, নিজের ডাক্তারি জ্ঞান অনুযায়ী খোঁজ করলেন এমন কোন রোগ আছে কি না। কিন্তু না, এমন দাগ কোনও রোগের কারণে হয় না।

রঘুনাথবাবুকে দেখানোর পর তিনি চুপ করে গেলেন। চোখ বড় বড় করে তাকালেন।

— “ডাক্তারবাবু, এই দাগ… এই দাগ আমি আগেও দেখেছি…”

শ্রীধর প্রশ্ন করল !
— “কোথায়?”

রঘুনাথবাবু বললেন,
— “ডা. বিনয়ের শরীরেও ছিল। আর এক বৃদ্ধ সাধকের শরীরেও, যাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়নি—শুধু এই দাগ আর কপালের মালা পাওয়া গিয়েছিল এক শ্মশানে।”

রঘুনাথ নিজের পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে বের করলেন একটি বিবর্ণ ছবি—১৯৫৭ সালের চড়িদা স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
ছবিতে ডাক্তার বিনয় ভট্টাচার্য , তাঁর পাশে এক অল্প বয়সি স্বাস্থ্য সহকারী, এবং কোণার পাশে এক গম্ভীর চেহারার বৃদ্ধ, মাথায় জটা, চোখে আতঙ্ক।

তার গায়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সেই একই দাগ।

ছবির পেছনে লেখা—
“ভৈরবনাথ – কাপালিক সাধক – ১৯৫৬”

শ্রীধর ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে গেলেন, এই নামটা তো ছিল সেই খাতাতেও! যার সাধনায় বলি দিতে হত সাতজন যুক্তিবাদীকে।
যাদের মধ্যে একজন তিনি নিজেই।

সেই রাত থেকে একের পর এক অলৌকিক ঘটনা শুরু হল।
টেবিলের উপর রাখা ওষুধের শিশি নিজে থেকে ভেঙে পড়ে, বিছানার নিচ থেকে শোনা যায় কান্নার শব্দ, আয়নায় নিজেকে দেখা যায় না, খাতার পৃষ্ঠাগুলি প্রতিদিন রাত বারোটায় বদলে যায়‌। নতুন নাম, নতুন ভবিষ্যদ্বাণী লেখা থাকে।

এক রাতে খাতার এক পৃষ্ঠায় লেখা ছিল—
“তুমি এখনো পালিয়ে যেতে পারো। কিন্তু পালালে আমি আসব অন্য কারো মাধ্যমে।”

শ্রীধর কাঁপা হাতে পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ফেলতে গেলেন, কিন্তু পাতা ছিঁড়ে বের হতেই একদম নিচে লেখা আরেকটি বাক্য ভেসে উঠল লাল রঙে—
“পালাতে পারবে না… দাগ যার, আত্মা তার বাহক।”

শ্রীধরের যুক্তিবাদ আর বাস্তববোধ নড়ে যাচ্ছে। প্রতিরাতে তার মনে হতে লাগল, কেউ যেন তার শরীরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কথা বলছে মাথার মধ্যে—
“আমি ভৈরবনাথ… আমি বেঁচে আছি… তুই শুধু আমার শরীর। আমি ফিরে আসব তোকে নিয়েই…”

সাল ১৯৭১, ডিসেম্বরের ২১ তারিখ।
রাত ঠিক ১১টা। চাঁদ আকাশে স্পষ্ট, কিন্তু কুয়াশায় ঢেকে গেছে তার আলো।
শ্রীধর জানতেন—আর পালানোর সময় নেই।
যা ঘটছে, তা আর বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শেষবারের মতো যাবেন চণ্ডীমুণ্ডের পোড়োবাড়ির ভেতরে, খুঁজে বার করবেন রহস্যের মূল।

রঘুনাথবাবু অনেক অনুরোধ করেছিলেন—
“ডাক্তারবাবু, ওখানে যা আছে সেটা মানুষ নয়। ফিরে আসবেন না আপনি। দয়া করে যাবেন না…”

শ্রীধর চুপ করে টর্চ তুলে নিলেন। চোখে ছিল একটা অদ্ভুত দৃষ্টির স্থিরতা, একসঙ্গে ভয়, কৌতূহল আর গ্রহণযোগ্যতা মিশেল।

জঙ্গলের গা ঘেঁষা পথ ধরে পোড়োবাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। এবার আর কিছু আটকাতে পারল না।

তবে আজ বাড়িটা আগের চেয়ে আলাদা লাগছিল।
দেয়ালের গায়ে ছায়ারা যেন নড়ছে।
মাটি যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলেন—
এক কোণায় আগের সেই আয়না। তার পাশে ধুলো ঢাকা এক পাথরের বেদি।

আর তার উপর বসে আছে এক হাড্ডিসার শিশু মূর্তি, যার গা ছমছমে… মাথায় কপালের মালা।

মাটির মাঝখানে একটা চিহ্ন ছিল—একই সেই জন্মদাগের মতো ত্রিকোণ চিহ্ন, যা তাঁর কাঁধে ফুটে উঠেছিল।

তিনি হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল মাটি।

পাথরের দাগ স্পর্শ করতেই খুলে গেল মাটির একটি আস্তরন।
নিচে অন্ধকার গহ্বর, পাথরের সিঁড়ি… যেন মৃতের গর্ভে প্রবেশ।

টর্চ জ্বালিয়ে শ্রীধর নামতে শুরু করলেন।

প্রায় কুড়ি ধাপ নামার পর তিনি পৌঁছলেন এক পাথরের গুহার মধ্যে।
ঘরের চারদিকে প্রদীপের মত কিছু বসানো, কিন্তু সেগুলো জ্বলছে!
কেউ যেন এই জায়গাটাকে এখনও জীবিত রেখেছে।

ঘরের চার কোণায় ছয়টি মাথা সাজানো—
প্রতিটা মাথা মাটি আর তেলের মধ্যে সংরক্ষিত। চোখ বন্ধ, কিন্তু মুখে এক অপার্থিব শান্তি।

সবার নিচে একটা পাথরের ফলক—
“সিদ্ধ ছয় বলি। সপ্তম অপেক্ষমান। পূর্ণ চক্র হলে জন্ম হবে পুনরায়। চণ্ডীর আদেশে, কপালের মালা সম্পূর্ণ হবে।”

ঘরের এক কোণায় একটা ধুলো ঢাকা কাপড়ে মোড়া কিছু ছিল।
শ্রীধর ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে কাপড়টা খুলে দেখলেন—
একটা দেহ। মুণ্ডহীন। গায়ে ঠিক তাঁর মতোই সেই জন্মদাগ।

ঠিক তখনই টর্চ নিভে গেল, পেছন থেকে একটা ফিসফিস—
“তুই শেষ বলি…
তোর শরীরেই আমি ফিরব…
মাথা আমাকে দাও…
কাপালিক আবার জন্ম নেবে…”

আলো নিভে গেলে মানুষের চোখ বাঁচতে চায়। কিন্তু সেই অন্ধকারে শ্রীধর দেখতে পেল—
একটি ছায়া তার দিকেই এগিয়ে আসছে… হাতে রক্তমাখা খাঁড়া… মুখহীন ছায়া মাথা চায়।

শ্রীধর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন সেই মুণ্ডহীন দেহটার উপর।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে সেই দেহটা উঠলো… ধীরে ধীরে নিজের খালি ঘাড়ের জায়গায় বসাতে চাইলো শ্রীধরের মাথা!

চিৎকার… আলো… নিস্তব্ধতা

একটা প্রাণপণ চিৎকারে চারদিক কেঁপে উঠল।
তারপর নিস্তব্ধতা।

চড়িদার আকাশে ভোরের আলো ফুটলেও, সেই আলো পৌঁছোয়নি চণ্ডীমুণ্ডের পোড়োবাড়িতে।

রঘুনাথবাবু সারা রাত না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
শ্রীধরের ফেরার কোনও খবর নেই।
চোখে কান্না আর হতাশার জল—
“আরও একটা প্রাণ গেল… আরও একটা…”

তিনি একজন বুনো মোষচালক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলেন জঙ্গলের দিকে।
কাঁপা হাতে টর্চ হাতে নিয়ে পৌঁছলেন পোড়োবাড়ির সামনে।

বাড়ির দরজা খোলা। ভিতরে নিস্তব্ধতা।

মাটি ফাটানো সেই আস্তরন এখনও খোলা। ভিতরে নেমে গেলেন রঘুনাথ।
প্রথম ধাপে নামতেই তাঁর পা পিছলে গেল রক্তে।

নিচে গিয়ে যা দেখলেন, তা কোনও মানুষ সহ্য করতে পারে না—
ঘরের কেন্দ্রে শুয়ে আছে ডা. শ্রীধরের মৃতদেহ।
তাঁর মাথা নেই।
গলার উপর বয়ে গেছে ছিন্ন দাগ।
আর ঠিক তার চারপাশে সাতটি মাথার পূর্ণ কপালের মালা, রক্তে রঞ্জিত।

ঘরের দেওয়ালে নতুন করে লেখা এক লাইন—
“বলিপূর্ণ। আমি জন্মেছি। ভৈরবনাথ ফিরে এসেছে। কাপালিক অমর।”

গল্প এখানেই শেষ নয়–
রঘুনাথ দৌড়ে পালিয়ে এলেন। সেই রাতের পর, চড়িদার স্বাস্থ্যকেন্দ্র চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গুজব—
পাহাড়ের মধ্যে কারা যেন দেখা যাচ্ছে সাদা ধুতি পরা একজন মানুষকে…
কাঁধে ঝোলানো কপালের মালা, হাতে খাঁড়া, আর সেই চিরপরিচিত ত্রিকোণ জন্মদাগ।

দেখতে দেখতে প্রায় ১ বছর কেটে গিয়েছে,
কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে এক নতুন ডাক্তার যোগদান করলেন।

নাম—ডা. শ্রীধর সান্যাল।
বয়স, চেহারা একেবারে মিল রয়েছে চড়িদার সেই নিখোঁজ ডা. শ্রীধরের সঙ্গে।

কিন্তু কেউ জানে না, রাতে তিনি ঘুমোবার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বলেন—
“তোর দেহে আমি জন্মেছি…
আমি ভৈরবনাথ… আমি কাপালিক…
এবার অষ্টম বলির খোঁজ শুরু হোক…”

__

ভৌতিকগল্প #HorrorStory #BengaliStory #গোবিন্দমন্ডল #ভূতেরগল্প

Share On:



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 


0 Responses

Leave a Reply