#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৬
পুরান ঢাকার একটা চোরাই ক্লাব ঘর। চোরাই বলার যথেষ্ট একটা কারণ আছে। কারণ এখানে অবৈধভাবে রাতের বেলা পার্টি করা হয়। ভয়ানক সব নেশা করে মানুষেরা। মেয়ে মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো এখানে একেবারে সাধারণ বিষয় বলেই বিবেচনা করা হয়। তবে আজকের বিষয়টি আলাদা কারণ আজকে এই ক্লাবের অন্যতম কাস্টমার প্রেম নেওয়াজের আটাইশতম জন্মদিন। প্রতিবার জন্মদিনে সে নাইটক্লাব পুরোটা ভাড়া করে নেয়। সবার জন্য সব কিছু ফ্রি করে দেয়। তবে এখনো সে এসে উপস্থিত হয়নি। প্রেমের বার্থডে কেক দিয়ে নয় বরং মদ দিয়ে উদযাপন করা হয়। নামি-দামি সব ব্রেন্ড।
হঠাৎ বাইরে শব্দ হয়। গরগর শব্দগুলো যেন রাস্তা শাসন করে বেড়াচ্ছে। ক্লাবে যেই মেয়েটা ম্যানেজারের পদে আছে তার বয়সই বা কত? অতীত তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তবে যাই হোক সে মন-প্রাণ দিয়ে যেই মানুষটার জন্য সবসময় অপেক্ষা করে থাকে সে হচ্ছে প্রেম নেওয়াজ। তার প্রেম। মেয়েটির নাম ইরিন। মেয়েটি এমন কোনো নেশা নেই করেনি, এমন কোনো বাজে কাজ নেই যা তার করা বাকি। প্রেম আর তার মধ্যে এসব দিক থেকে মিলের অভাব নেই। সে জানে প্রেম একদিন তার হবেই। কোনো না কোনো ভাবে। নইলে কী এত এত মেয়ে থাকতে প্রেম বারবার তার কাছে আসে?
ইরিন বাইরে বের হওয়ার আগেই দেখল এক দল মানুষ প্রেমকে ঘিরে রেখেছে। সে ভিড়ের মাঝ থেকে এক ঝলক প্রেমকে দেখল, কালো চামড়ার জ্যাকেট, কনুইতে ধাতব গার্ড, হাতে শক্ত গ্লাভস। মুখে হেলমেট, কিন্তু ভেতর থেকে চোখের ধারালো দৃষ্টি বেরিয়ে আসছে ভিজারের ফাঁক দিয়ে। প্রেমের পাশের বাইকে অংকুর আছে। ওরা বাইক রাইড থেকে যে মাত্র ফিরেছে তা বুঝতে বাকি রইল না ইরিনের। প্রেম ধীরে হেলমেটের লক খুলে মাথা থেকে টেনে নামাল। ভেতর থেকে ঘামে ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে পড়ল কপালে, মুখে সেই শীতল বেপরোয়া দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে একচিলতে বাঁকা হাসি। চারপাশের মেয়েরা মুহূর্তেই কেমন যেন বদলে গেল। প্রেমকে দেখে তাদের চোখের দৃষ্টি যেন হিপনোটাইজড। দু-একজন ফিসফিস করে নামটা বলল, “প্রেম নেওয়াজ… চলে এসেছে।”
মেয়েদের কেউ ঠোঁটে লিপস্টিক ছড়িয়ে ফিসফিস করে হাসল, কেউ আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে লাগল। কারও চোখে বিস্ময়, কারও চোখে কামনা। হয়তো প্রেমকে একটু ভালো করে দেখার, তার ভারী নিঃশ্বাসের পতনে নিজের ধ্বংস ডেকে আনার। প্রেম আর দেরি করল না। বাইক থেকে নামতেই ভারী বুটের শব্দ মাটিতে বাজল টক…টক শব্দ…। সে ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে বাইকের চাবি এক ঝটকায় ছুঁড়ে মারল অংকুরের দিকে। অংকুর হকচকিয়ে গেল, কিন্তু মুহূর্তেই চাবি ধরে ফেলল। চাবিটা পকেটে রেখে সেও নেমে পড়ল। দুই ধারের মানুষকে তখন সিকিউরিটি আঁটকে রেখেছে। প্রেম নেওয়াজের ভেতরে ঢোকার জন্য তো যথেষ্ট জায়গা দরকার? তাই না? ভেতরে ঢোকার আগে প্রেম আর পেছনে তাকাল না। ভিড়ের মাঝ দিয়ে মাথা উঁচু করে ঢুকে গেল ভেতরে।
প্রেম ক্লাবে ঢুকতেই পার্টি শুরু হলো। স্কটল্যান্ড থেকে আনা হুইস্কির বোতলে সবাই ডুবে গেল। তবে প্রেমের গান ছাড়া তো এই পার্টি অসম্পূর্ণ! সে গান গাইতে স্টেজে উঠল মাঝরাতের দিকে। সেখানে উঠতে যাবে তার আগেই একটা মাঝ বয়সী ছেলে তাকে আচমকা ধাক্কা দিলো। প্রেম কিছু বলল না। নেশা করেছে, হুঁশ হারিয়েছে, ধাক্কা লাগা কোনো বড় বিষয় নয়। তবে মাথাটা গরম হলো তখন যখন ওই ছেলেটি বলে উঠল, ‘শালা তোর মা কী তরে অন্ধ পয়দা করছে? এখনই তো মদের গ্লাসটা পড়ত।’ ব্যাস এই টুকু শুনেই প্রেমের মাথা বিগড়ে যায়। টেবিলের ওপর সিরিঞ্জ রাখা ছিল। তাতে ড্রাগস ছিল। প্রেম এক মুহূর্ত ভাবল না সে কী করছে, কোনটা ভুল,কোনটা সঠিক। মুহূর্তেই একসঙ্গে তিনটে সিরিঞ্জ এক সঙ্গে তুলে গেঁথে দিল ছেলেটার গলার রগ বরাবর। ক্লাবের সবাই এক লহমায় থেমে গেল। ছেলেটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জবাই করা মুরগির মতো কিছুক্ষণ ছটফট করে সেখানেই স্থির হয়ে গেল। সবাই তখন আতংকে চুপসে আছে। প্রেম অংকুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওর ব্যবস্থা কর।’
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে ধমকে বলল, ‘শালারা সার্কাস দেখো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? নাচোস না কেন? নাচ সব। ফূর্তি কর।’
সবাই সেই ধমকে এক মুহূর্ত স্থির থেকে পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেল। ইরিন এসে প্রেমের কাঁধে হাত রাখতেই প্রেম একবার সেই হাতের দিকে তাকালো বাঁকা চোখে। তারপর ইরিনকে বলল, ‘হাত সরাও। মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া যে নিতে পারি না তা তো জানোই?’
ইরিন হাত সরিয়ে মন খারাপ করল। তারপর বলল, ‘গান গাইবে না?’
‘গানের আর মুড নেই।’
‘ তো কিসের মুড আছে?’
সেই কথার জবাব দিল না প্রেম। তারপর চুপ থেকে পুনরায় বাঁকা হেসে বলল, ‘উপরে চলো। দেখাচ্ছি কিসের মুড আছে।’
–
সকালে সিদ্দিক নেওয়াজ প্রেমের রুমে আসে। ঘরে মদ, সিগারেটের গন্ধ। জানালা গুলো আটকানো, পর্দা দেওয়া। প্রেমের আলো পছন্দ না। তবে কালো রঙ অনেক পছন্দ, পছন্দ অন্ধকার। তাই তো বাড়ির চারপাশে তার এত এত গাছপালা। যাতে করে ছায়া ঘিরে রাখে তার কাঠের বাড়িটিকে। প্রেম কুকুর বেশ পছন্দ করে। তার যেই পোষা কুকুরটা আছে ওর নাম লুফি। কত্ত বড় আর রোমশ একটা কুকুর। প্রেমের ঘরে সে অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দেয় না। একবার নতুন কাজের লোকটাকে কামড়ে দিয়েছিল। তারপর তো মানুষ ওর ঘরে আসতেও চায় না। সিদ্দিক উপর হয়ে শুয়ে থাকা প্রেমের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। মুখলেসকে জিজ্ঞেস করে, ‘ও ফিরেছে কখন জানো?’
‘গার্ড কইল তো সাতটার দিকে।’
সিদ্দিক বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে লুফির দিকে তাকালো। কুকুরটা প্রেমের পাশেই বসে আছে। দেখছে তার মালিককে। বিপদের গন্ধ পেলেই হামলে পড়বে, মনে মনে হয়তো তাই ভাবছে। সিদ্দিক আফসোস ভরা কণ্ঠে মোখলেসকে বলল, ‘আমি ওকে মানুষ করতে পারি নি কালুর বাপ। ওকে আমি যথেষ্ট ভালোবাসা দিতে পারি নি। তবে তুমি তো জানো আমি চেষ্টা করেছি? তবুও ব্যর্থ কেন হলাম?’
সিদ্দিক রুম থেকে চলে যাওয়ার পর প্রেম এপাশ ফিরে। ঘুমিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার ঘুম অনেক পাতলা। রুমে ঢুকতেই টের পায় সে। ঘুমটা ভেঙে যায়। সে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফোনের দিকে তাকায়। ভালোই তো সময় হয়েছে। ধোঁয়া ছেড়ে লুফির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাম লুফি বেবি। তোমার খিদে পেয়েছে তাই না? চলো তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করি।’
–
ভার্সিটি যাওয়ার পর আজ কেমন যেন ভালো লাগছিল না। ওই তৃষার ক্লাসেও লোক পাঠিয়েছিল প্রেম। সে আজ আসেনি। আসতে না আসতেই ফাঁকি বাজি শুরু? শালীকে আরো দুটো কামড় খাওয়ানো উচিত ছিল। এতক্ষণে হয়তো মুখটা ফুলে আলু আর ঠোটটা ফুলে কদুর মতো হয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে তাতে প্রেমের কী? বেশি বেয়াদব ওই মেয়ে। ছুটির সময় শিমলা বের হতেই প্রেম অংকুরকে পাঠালো তার কাছে। জিজ্ঞেস করতে ওর বেয়াদব বান্ধবীটা বাসা থেকে প্রেমকে সালাম দিয়ে যায় নি কেন? অংকুর সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ভাই যা শুরু করছেন। ওই মেয়ে মরলেও তো বলবেন, কবর থেকে উঠে এসে সালাম কেন দিলো না?’ প্রেম সেই কথা শুনে অংকুরের দিকে তাকাতেই সে চুপসে সরাসরি শিমলার পথ রুখে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল তোমার বান্ধবী কই? শিমলা চোখের কালো রঙের বঙ্গবন্ধুর মতো দেখতে চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘সে বাসায়। ওর মুখ ফুলে বাংলাদেশের মানচিত্র হয়ে গেছে। তাই আসেনি।’
‘তো তুমি এলে কেন? রোদে পুড়ে তোমার উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়েও তো যেতে পারে?’
‘সমস্যা নেই গ্লো এন্ড লাভলি ব্যবহার করি।’
‘ওইটা দিলে সুন্দর হওয়া যায়?’
‘যায় তো। আপনার মতো কাকও ময়ূর হয়ে যাবে।’
‘তুমি যেহেতু আমার কথা বলেছো তাহলে সেটাকে কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই ধরে নেব।’
শিমলা মুচকি হাসল। তা দেখে অংকুর বলল,’ওমাগো এভাবে হেসো না মেয়ে,আমার সুগার লেভেল বেড়ে যাবে।’
শিমলা মুচকি হাসল। আর সেটা দেখে অংকুর থামতে না পেরে বলে উঠল, ‘ইশ আবার হাসে। এভাবে হাসলে তো রাতে আমার ঘুমই আসবে না।’
ঠিক তখনই শিমলার হাঁচি এসে পড়ল। সরাসরি অংকুরের মুখে ছিটকে গেল হাঁচি। ‘সরি সরি। হঠাৎ করে চলে এসেছে।’
অংকুর কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। মনে মনে ভাবল, “এভাবে একদিন আমাদের মাঝে ভালোবাসা চলে আসবে, বিয়ে চলে আসবে, ঘরভর্তি বাচ্চাও চলে আসবে। শিমলা মেয়েটা হুটহাট হাঁচি দেয়, আর না জানি কী কী দেবে… তাতে কী! ভালোবাসায় এমন দুই-চারটে দেওয়া-নেওয়া চলতেই থাকে। শিমলা যদি হাঁচি দেয়, আমি তাকে ভালোবাসা দেব, আদর দেব, ডজন ডজন বাচ্চাও দেব।”
স্বপ্নমগ্ন অংকুরকে ভাঙিয়ে দিল হঠাৎ প্রেম ভাইয়ের ফোন। একটু ধৈর্যও নেই লোকটার। এভাবে চললে তো তার বিয়ের এক মাস পরেই শোনা যাবে নেওয়াজ বংশের উত্তরাধিকার চলে আসছে!
ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে প্রেমের গম্ভীর স্বর ভেসে এলো, ‘তৃষার খবর কী? কি বলল শিমলা?’
‘শিমলা তো কিছু বলল না, কিন্তু আমি যে তাকে অনেক কিছু বলতে চাই।’
‘কী বলতে চাস?’
‘ বলতে চাই, ওগো শিমলা তুমি কি আমার জীবনের ডাটা হবে? যাকে ছাড়া আমার জীবন চলেই না।’
প্রেম হাঁ হলো না। উল্টো গম্ভীর গলায় বলল, ‘কিন্তু তুই তো ওয়াইফাই ইউজার।’
‘ওই একটা হলেই তো হলো। হুহ!’
–
তৃষা অনেক কষ্টে মেডিসিন খেয়ে ঠোঁটের ফোলা কমিয়েছে। জীবনটা তার বেদনা। এমন হারে দজ্জাল ছেলে তো কোনোদিন সে দেখেনি। খবিশের ঘরে একটা তাড়ছিঁড়া আসবে। থুথু দিয়ে গরুরমাংস রান্না করে খাওয়াবে এই বলে রাখছে তৃষা। তৃষার সব টাকা পয়সা শেষ হয়ে যাচ্ছে। একটা কাজ তো খুঁজতেই হবে। এভাবে চললে হবে না। ওদিকে শিমলার মা কাল রাতে শিমলাকে পাশের ঘরে নিয়ে ফিসফিস করে বলছিল, ‘কিরে তো বন্ধু আর কতদিন এখানে থাকবে? সত্যি করে বল তো এই মেয়ে কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে এখানে আসেনি তো?’
সেইসব কথা তৃষার একটু ভালো লাগেনি। সে গুগল ম্যাপ খুলে রাস্তায় বের হয়। কিন্তু সে তো ভুলেই গেছে তার ফোনে ডাটা নেই। এভাবে কী চলে? বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা জিমের সামনে গিয়ে চোখ থমকে যায়। এখানে হিসাব রক্ষকের জন্য একটা মেয়ে নেওয়া হবে। যেই আমার জিম। এখানে আর কত ইনকাম হয়? এই হিসাব তৃষা ক্যালকুলেটর ছাড়াই হিসাব করে বের করতে পারবে। তৃষা বুক ফুলিয়ে জিমে যেতেই তার এবার আত্মা বের হওয়ার উপক্রম। উপক্রম হবে না। জিমে দেখি হ্যান্ডসামদের বাহার। এক একজনের কী বডি! উফ এসব দেখলেই তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে যায়। এই ছোট্ট হৃদয়টাকে আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে। যাকে দেখে তাকেই জায়গা দিয়ে দেয়। একটার পর একটা কন্টিনিউ টেন্সের মতো চলছে তো চলছেই। ব্যাগ থেকে জলদি আয়নাটা বের করে মুখটা দেখে। মেকআপ সব ঠিক আছে তো? হঠাৎ তার চোখ যায় একটা লোকের দিকে। আরে এটা সেই দিনের ওই হিরো না? যে তাকে কুকুরের হাত থেকে বাঁচাতে এসেছিল? মাইরি কী হট লাগছে। এই ছেলে তো পুরোই চকলেট বয়। এই ছেকেটার সঙ্গে এই নিয়ে ২য় বার দেখা হলো। আল্লাহ মনে হয় প্রেমের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রত্যুষের শরীর এখন পুরো ভিজে গেছে ঘামে। কপাল থেকে নেমে আসা ফোঁটা চোখে পড়ছে, সে হাতের পশ্চাৎভাগ দিয়ে মুছেও আবার ভিজে উঠছে। গলা ও বুক জুড়ে ঘামের রেখা, টিশার্টের ভেতরটা এমন ভিজে গেছে যে গায়ে আঁকড়ে লেগে আছে। সে গাঢ় নীল রঙের স্লিভলেস টিশার্ট পরেছে, যেটায় ঘাম জমে রঙ আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। বাইসেপস আর ট্রাইসেপস ফুলে উঠেছে টান টান, পেশিগুলো ঘামের ঝিলিক নিয়ে একেবারে স্পষ্ট। কালো ট্র্যাক প্যান্ট পরে আছে, পাশে সরু ধূসর লাইন টানা। কব্জিতে কালো জিম-গ্লাভস, যেটা ভিজে গেছে, রঙ প্রায় চকচক করছে। গলায় একটা সাদা টাওয়েল ঝোলানো, সেটাও ভিজে ভারি হয়ে গেছে। কানে ছোট ইয়ারবাডস ঢোকানো, কিন্তু এখন গান শোনার চেয়ে তার নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দই বেশি শোনা যাচ্ছে। তৃষা প্রত্যুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য সুন্দর করে ফিটফাট হয়ে এগিয়ে যেতেই পাশ থেকে একটা দানব লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে একেবারে প্রত্যুষের পেছনে এসে ধপ করে পড়ল। জিহ্বার একেবারে কাছেই গালি চলে এসেছিল। ‘ভোটকার বাচ্চা ভোটকা, তুই এই পেট নিয়া জিমে কেন আসছোত? অভিশাপ দিলাম চিকন তো হইতেই পারবি না। উল্টো ব্লাস্ট হয়ে মরবি।’ তবে সামনে হ্যান্ডসাম ছেলে আছে। এসব শুনলে পটার আগেই পালাবে। কী এমন ধপাস করে পড়ল তা দেখার জন্য সে পেছন ফিরতেই দেখল সেই দিনের সেই তৃষা মেয়েটা পড়ে আছে। সে ভ্রু কুঁচকে তৃষাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আরে তুমি? এভাবে ফ্লোরে পড়ে আছো যে?’
‘তৃষা জলদি কপালের সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে বলল, ‘আরে দেখছেন না মশাই,এখানে শুয়ে শুয়ে জিম করছি।’
‘এটা কোন ধরনের জিম?’
তৃষা তখনো সেইভাবেই পড়ে আছে। লজ্জা লাগছে তার। কী কেলো হয়ে গেল। সে কোনো মতো ম্যানেজ করে বলল, ‘ইয়ে মানে এটা চিৎপটাং জিম।’
চলবে?
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৭
প্রেম বাসায় এসে গোসল সেরে নিল। ভেজা চুলের ডগা থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। সুঠাম দেহের সঙ্গে কালো রঙের টাওয়ালটা কেমন করে জড়িয়ে আছে! এই প্রেমকে দেখে কার না প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করবে?
আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চোখ গেল বুকের দিকে। ডান পাশের বুকের ওপর একটি হৃদপিণ্ডের অসম্পূর্ণ ট্যাটু। অথচ হৃদপিণ্ড তো থাকে বাম পাশে। তবে প্রেম কেন ডান পাশে ট্যাটু করালো? সে কি বোঝাতে চাইছে অন্ধকারের ছায়াদের হৃদপিণ্ড ডান পাশে থাকে?
প্রেমের বয়স তখন ২১। সেই সময়ই এই ট্যাটু করিয়েছিল। আর এই ট্যাটু করিয়েছিল ওই নাইটক্লাবের ইরিন নামের মেয়েটির কাছ থেকেই। ইরিনের বয়স তখন আঠারো। ক্লাবে তাকে জোর করে আনা হয়েছিল। কিন্তু তার ট্যাটু করার হাত ছিল দারুণ। যদিও সবকিছুই তখন ইরিনের জন্য নতুন ছিল, তবুও সেই দিন প্রেম হঠাৎ কী ভেবে এই ট্যাটুর সিদ্ধান্ত নিল তা সে নিজেই ভালো বলতে পারবে। জন্মদিন প্রেমের কাছে অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়। আসলে নিজের জন্মকেই সে অভিশাপ বলে মনে করে। তাই জন্মদিনের দিন বাসায় থাকে না সে। প্রচুর নেশা করে, বাইক রাইড করে, আর প্রতি বছর ক্লাবে একটা পার্টি দেয়। আসলে অন্যদের আনন্দ দেওয়ার আড়ালে সে যেন বলতে চায়, কারো সুখ অন্যের দুঃখের কারণও হতে পারে।
নেশাখোরদের জীবনে সুখ বলে কিছু থাকে না। অথচ যারা আজ নেশার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, তারাও একদিন সুস্থ মানুষ ছিল। তারাও হাসতো, স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু জীবনের একেকটা অতীত, দুঃখ আর যন্ত্রণা মানুষকে খারাপ করে দেয়। কেউ দুঃখ ভুলতে নেশার দারস্থ হয়, কেউ ভালোবাসায় ছলনার শিকার হয়ে, কেউ পারিবারিক চাপে, কেউ বা পরীক্ষায় ব্যর্থতার আক্ষেপে নেশাকে বেছে নেয়। অথচ নেশা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক বন্ধু, ক্ষণিকের সুখের বদলে কেড়ে নেয় পুরো জীবনটাকে।
প্রতি জন্মদিনে প্রেম আসে ইরিনের কাছে— শুধু এই ট্যাটুটাকে ভরাট করার জন্য। বাকি সময়ে সে আর ইরিনের কাছে যায় না। প্রেমের জীবনে কোনো সঙ্গী নেই, সে নারী কিংবা সংসার কিছুই চায় না। প্রেম মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তার মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি জন্মাতে পারে না। ভালোবাসাকে সে ঘৃণা করে। ইরিনের সঙ্গে একসময় বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু যখন প্রেম বুঝল ইরিন তাকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করেছে, তখন ধীরে ধীরে সরে যায়। এখনো প্রতিবছর শুধু ট্যাটুর জন্যই যায় সেখানে। উপরের রুমটায় বসেই ইরিন ট্যাটু ভরাট করে। প্রেমও ভরাট করিয়েই চলে আসে। হয়তো যেদিন ট্যাটুটি পুরোপুরি শেষ হবে, সেদিন থেকে আর কোনোদিন ইরিনের কাছে ফিরবে না।
প্রেম সাদা রঙের শার্ট পরে বাগানে গেল। নিজের হাতে গড়া ফুলের বাগান। গাছভর্তি নানা রঙের ফুল। দেখলেই মনে শান্তি নামে। তবে সবচেয়ে প্রিয় তার লাল গোলাপ। অনেকগুলো গাছ আছে। সে কয়েকটা গোলাপ কেটে ঘরে নিয়ে গেল, ফুলদানিতে পানি ভরে তাতে সাজিয়ে রাখবে। ফুলগুলো রেখে প্রেম গেল কিচেনে। ফ্রিজ থেকে বিফ বের করে যত্ন করে কাটতে শুরু করল। বড় একটা হাড়সহ মাংস। হাতে সদ্য কেনা ধারালো চাপাতি। কাটতে হবে তো! কিন্তু তবুও কেমন যেন চাপাতি চালাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাই ফোনে গান ছেড়ে দিল। গান ছাড়া কাজ করতে প্রেমের বোরিং লাগে।
ফোনে তখন বাজছে,
“প্রেম আমার… ওওও প্রেম আমার…”
সুরের সঙ্গে মিলিয়ে প্রেমও গুনগুন করে গাইছে। আর সেই সুরের ছন্দে মাংসে কোপ বসাচ্ছে চাপাতি দিয়ে। এটাই তো প্রেমের কাছে আসল ফিলিংস।
–
প্রত্যুষ সরাসরি এখান থেকে শাওয়ার নিয়েই তৈরি হয়। তারপর তৃষাকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে। এই মেয়ের নামটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে বারবার এর সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যুষ বিনয়ের সঙ্গে তৃষাকে জিজ্ঞেস করল, ‘নাম কী তোমার? বাসা কোথায়?’
‘তৃষা নুজায়াত। বাসা এই তো এদিকেই।’ তবে মনে মনে সে বলে উঠল, ‘বাসা যেখানেই হোক না আপাতত তোমার মনের মধ্যেই বানাতে চাই।’
প্রত্যুষ হেসে বলল, ‘এখানে কেন আসা? মানে জিম লাভার নাকি?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ একেবারে ছোটকাল থেকে। কিন্তু আমার মনের মতো কোনো জিম সেন্টার বাংলাদেশে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।’
‘কিন্তু ওই জিমটা কিন্তু আহামরি ছিল।’
‘আসলেই?’
‘হুম।’
‘ওহ আচ্ছা তাহলে বোধহয় আমার দেখতে একটু সমস্যা হয়েছে।’
প্রত্যুষ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ট্রেইনার আছে? মানে জিম ট্রেইনার?’
‘নেই তবে আপনি চাইলে হতে পারেন।’
প্রত্যুষ হাসল। তারপর বলল, ‘হতে পারতাম তবে আমার আরো অনেক কাজ আছে।’
‘আপনি কাজ কী করেন?’
‘মানুষ খুন।’
তৃষা চোখ বড় করল, ‘কী! মানুষ খুন?’
‘মানে যারা মানুষ খুন করে তাদের খুঁজে বের করি।’
তৃষা বলল, ‘ওমা পুলিশের লোক?’
‘না। ইন্টেলিজেন্স অফিসার।’
‘তার মানে তো আপনার মাথায় অনেক বেশি বুদ্ধি।’
‘বলা যায়।’
‘আপনার নামটাই তো জানলাম না।’
‘প্রত্যুষ দেওয়ান।’
এক মুহূর্তে প্রেমের নামটা মাথায় এলো তৃষার। আজকাল খালি প অক্ষরের নামের মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে। তবুও দেখো না কোথায় ওই প্রেম আর কোথায় এই প্রত্যুষ দেওয়ান। হঠাৎ ঠিক তৃষার সামনের সিটে বারবার দুজন ছেলে এসে বসল। এতক্ষণ দু’জনে পেছনে ছিল। প্রত্যুষ বিষয়টি লক্ষ করে। তবে সে কেবল একবার তাকিয়ে আবারও ফোনের দিকে তাকায়। এখানে সে এমনি এমনি আসেনি। তৃষা তো অজুহাত ছিল। একটা বিষয়ে তদন্তের জন্য আসা। তবে তদন্ত হবে কী করে? ক্রিমিনাল যে ডিল করতে এখনো এলো না। হঠাৎ তৃষা ফোনের অফ স্ক্রিনে দেখল ঠোঁটের লিপস্টিক কেমন যেন একা ফিকে হয়ে গেছে। সমস্যা একটাই। কিছু খেলেই লিপস্টিক পেটে চলে যায়। হোক তা অনেক দামী লিপস্টিক কিংবা ওয়াটার প্রুফ। এখন এই হ্যান্ডসামের সামনে তো আর লিপস্টিক লাগানো যাবে না। তাকে তো বোঝাতে হবে তৃষার ঠোঁট জন্ম থেকেই এমন। বিড়ি খাওয়াদের মতো নয় বরং জন্মের দিনই লিপস্টিক দেওয়া সহ পয়দা হয়েছিল। এখন খালি কালার চেঞ্জ হয়। সে প্রত্যুষকে বলল, ‘আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি। জাস্ট দুই মিনিট।’
‘হ্যাঁ সিউর।’
মেইল আর ফিমেল ওয়াশরুম পাশাপাশি। তবে ওয়াশরুমে তৃষা গেল না। গেল বেসিনের আয়নার সামনে। সে উঠে যেতেই ছেলে দু’টো উঠে গেল। যেতে যেতে বলল, ‘হাব্বে হালা কড়ক জিনিস একখান। এরে হাতছাড়া করি ক্যালা ক তো?’
‘হাঁচা কইচোস কাদের। তবে মাইয়া মনে হয় না পুরান ঢাকার।’
‘তাতে কী? জিনিস তো জব্বর।’
তারা উঠে ওয়াশরুমের দিকে যায়। প্রত্যুষ একটা মুচকি হাসি দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে তাঁদের পেছনে ওয়াশরুমের দিকে যায়। ছেলে দুটোর মধ্যকার একজন তৃষার পেছনে এসে দাঁড়াতেই তৃষা আয়নার দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে দৃষ্টি মেলায়। তার হয়তো বুঝতে বাকি নেই। ছেলে দু’টো তাকে দেখে বিশ্রী হাসি দেয়। সেই হাসি দেখে আস্তে করে ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়। সেখান থেকে কাটার বের করার আগেই দরজার সামনে প্রত্যুষ এসে দাঁড়ায়। ছেলেদুটোর উদ্দেশে বলে, ‘বলো কোন হাসপাতালে যেতে চাও? আর কেমন থেরাপি লাগবে?’
তৃষা ততক্ষণে আর কাটার বের করল না। তবে ভেবেছিল বিষয়টা শেষ হবে এখানেই। কিন্তু না, প্রত্যুষ কাদের নামক ছেলেটিকে বলল, ‘কোন হাসপাতালে যাবা বলো? সেখানকার সিট বুকিং দিতে হবে তো?’
ছেলেটার কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রত্যুষ তার গায়ে হাত তুলল। নাক বরাবর কয়েকটা ঘুষি দিতেই রক্ত বেরিয়ে এলো। পাশের ছেলেটার শক্তি হচ্ছে না প্রত্যুষের হাত থেকে তার বন্ধুকে রক্ষা করার। ওদিকে তৃষা তো কেবল হা হয়ে রইল। এত জেন্টলম্যান এই ছেলে? এই ছেলের মার দেওয়ার স্টাইল কী জোস! সে জানে কোথায় মারলে শত্রুকে সহজেই নাজেহাল করা যাবে। ছেলেগুলো দৌড়ে পালিয়ে যেতেই প্রত্যুষ নিজের কলার ঠিক করে বলল, ‘ধ্যাৎ সকালেই তো আয়রন করেছিলাম। যাক, ব্যাপার না। তৃষা তুমি ঠিক আছো?’
তৃষার তো কোনো পাত্তা নেই। সে হা করে প্রত্যুষকে দেখছে।
‘ঠিক আছো তৃষা? কথা বলছো না যে?’
তৃষা প্রত্যুষের দিকে ওইভাবেই তাকিয়ে রইল। এতদিনে মনের মতো ছেলে পেয়েছে। বউ হলে এর বউই হবে। কিন্তু পটাবে কেমন করে? হঠাৎ তৃষার মাথায় বুদ্ধি এলো। এই বুদ্ধি হলো ছেলে পটানোর বুদ্ধি নাম্বার এক। কাজে না লাগলে বাকি গুলোও ট্রাই করবে। তৃষা চোখ পিটপিট করে, কপালে হাত দিয়ে বলল, ‘ঠিক নেই আমি। আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো। মাথাটা ঘুরছে। ওমা গেলাম পড়ে। কেউ প্লিজ আমায় কোলে নিয়ে সাহায্য করুন।’ বলতে না বলতেই ধপাস করে প্রত্যুষের গায়ে হেলে পড়তে যাবে, তার আগেই প্রত্যুষের কল এলো। সে সাইড হতেই ধপাস করে আবারও তৃষা পড়ে গেল। তা দেখে প্রত্যুষ তার দিকে চেয়ে বলল, ‘এখানেও বুঝি চিৎপটাং জিম করছেন? নাকি এটা বাথরুম জিম?’
–
কালুর বাপ লুঙ্গি হা করে বিছানায় শুয়ে আছে। খালি গায়ে হাওয়া-বাতাস লাগলেই হবে নাকি? দেহ-মন, সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য হাওয়া-বাতাস গুরুত্বপূর্ণ। ইদানীং কালুর বাপের বিয়ে বিয়ে ফিলিংস পায়। করেই ফেলবে নাকি? তাছাড়া এলাকার মেয়েগুলোও তো বিশাল জ্বালায় তাকে। সুন্দর হয়েও পড়েছে বিপদে। ইশ, মাঝে মাঝে নিজেরই লজ্জা লজ্জা করে। বউ নার্গিসের স্মরণে তার একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে। গাইবে নাকি? দরজাটা তখন খোলাই ছিল, হঠাৎ সিদ্দিক নেওয়াজ আচমকা ঘরের মধ্যে ঢুকে কালুর বাপকে এই অবস্থায় দেখেই তো মাথাটা তার গোল গোল ঘুরতে শুরু করল। মোখলেস জলদি উঠে বসে লুঙ্গি ঠিক করতেই সিদ্দিক বলল, ‘ওই পঁচে যাওয়া জোঁকটাকে গ্যালারির ফটোর মতো প্রদর্শন না করলেই কী নয়? বুড়ো বয়সে ভিমরতি।’
‘যা দুষ্টু। ওদিকে নজর দিলেই কী নয়?’
‘কালুর বাপ!’
‘ক্ষমা করবেন, সবাইকে তো আজকাল নার্গিস মনে হয়, কাকে যে কী বলে ফেলি। তবে আপনি কিন্তু আমার বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে অপমান করছেন।’
‘ঠেঙ্গা করছি। যাও গিয়ে আমার নাতির জন্য খাসা মেয়ে খুঁজে আনো।’
হেতিজা, প্রেমার চোখে শশা লাগিয়ে রাখতে বলেছিল। প্রেমা সেই শশা খেয়ে বসে আছে। এই রূপচর্চা কত কঠিন কাজ। আর তার এইসবের দরকার কী? সে তো এমনিতেই ঝাক্কাস আছে। সেদিন কালো গাড়িটা নিয়ে প্রেম ভাই লেদার জ্যাকেট পরে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিল, তখন তো প্রেমা আরো একবার তার প্রেমে পড়ল। উফস, চোখের চশমা, আর বডিটা কী আকর্ষণীয়। দেখলেই মন চায় বউ হয়ে যেতে। রাতে এই এমন একটা পুরুষ তখন তার পাশে থাকবে ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। প্রেমার মা সেদিন প্রেমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যারে প্রেমা তোর কেমন ছেলে পছন্দ?’ প্রেমা ড্রাইভিং সিটে বসা প্রেমকে দেখে বলেছিল, ‘একটা ড্রাইভারকেই চাই। ওমন ছেলে হলেই হবে।’
রাত তখন দশটা বাজে। প্রেম ভাই ফিরবে আরো রাতে। আজকে সবাই ঘুমালে চুপিচুপি প্রেম ভাইয়ের রুমে যাবে প্রেমা। প্রেম ভাই কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারে না। সে গিয়ে প্রেম ভাইয়ের কোলবালিশ সরিয়ে, না হয় স্বান্তনা স্বরূপ তার কোলবালিশ হয়ে যাবে। কিন্তু প্রত্যুষ ভাই যেন এসব না জানে। ওই লোক প্রেম ভাইকে যে কেন এত অপছন্দ করে! মানে দু’জনের মধ্যে বনে না। বনবে কী করে? একজন ক্রিমিনাল, অন্যজন আইনের লোক। বাট ক্রিমিনাল হয়েছে তাতে কী? প্রেমার ওইসবই ভালো লাগে। রাগ করে প্রেম তাকে যখন ধমক দেয় তখন ডার্ক একটা ভাইব আসে। কিংবা কখনো যখন রাগের বশে একেবারে কাছে এসে শক্ত করে থুঁতনিটা চেপে ধরে, তখন তো লজ্জায় ব্যথা, যন্ত্রণা সব ভুলে যায়। কবে যে বিয়ে হবে। আচ্ছা, ওই ক্রিমিনালটার সঙ্গে তার বিয়ে হলে সে বাচ্চার নাম কী রাখবে? দু’জনের নামই তো প দিয়ে। আজকে ফেসবুক গ্রুপে একটা সাহায্য মূলক পোস্ট করতে হবে। দেখা যাক কে সুন্দর নাম সাজেস্ট করে। হঠাৎ হেতিজা রুমে ঢুকে বললেন, ‘হ্যারে প্রেমা তোর মন মতো একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে ঠিক করেছি।’
প্রেমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেলে কী করে?’
‘বাসের ড্রাইভার।’
‘কী?’
‘কী মানে আবার কী? তুই না সেদিন বললি ড্রাইভারের সঙ্গে বিয়ে করবি? ছেলে একটু কালো, আর খাটো কিন্তু ওর দুইটা বাস আছে। একটা সে নিজে চালায়, অন্যটা ভাড়া দেওয়া। দেখিস একদিন কোটিপতি হবি তোরা। অমিতাভ বচ্চনের সূর্যবংশম ছবিটা দেখিস নি? হীরা কেমন বাস চালিয়ে কোটিপতি হয়। তুই আর ওই ড্রাইভারও হবি একদিন।’
‘আম্মুউউউউউউউউ!’
–
প্রেম সকালে ভার্সিটি এসে দেখে আজকেও তৃষা আসেনি। কত বড় সাহস ওই মেয়ের! পরপর দুদিন সালাম দেয়নি প্রেমকে। ওর তো উচিত ছিল দুদিনের সালাম একেবারে বাসা থেকে খামে ভরে কুরিয়ার করার। করল কী? কত রিডিকিউলাস একজন মেয়ে। মন তো চায় ধরে চুলগুলো কেটে দিতে। শালীর ঘরের তাড়ছেঁড়া একটা। আসুক এইবার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দেবে।
সারাদিন এইসব বলে নিজেকে চুপ করিয়ে রাখলেও শেষে গিয়ে শিমলাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে অ্যাড্রেস নিয়ে বাসায় গিয়ে হাজির হয়। শিমলার বাবা-মা গিয়েছে দাওয়াতে। বাসা তখন পুরো ফাঁকা। শিমলা যে আগ বাড়িয়ে কল করে তৃষাকে সতর্কবার্তা দেবে তার উপায়ও নেই। থাকবে কেমন করে? অঙ্কুরের দায়িত্বে শিমলাকে রেখে গেছে প্রেম। ফোনটা কেড়ে নিয়েছে সে।
তৃষা তখন মুখে বেসন লাগিয়ে বসে আছে। ইশ আবার কখন না কখন প্রত্যুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! ফেসবুক আইডিও ছলে বলে কৌশলে নিয়েছে। এবার একটা নক দিলেই হয়। সে তো ব্যস্ত মানুষ। এখন দেওয়া যাবে না।
তৃষা মুখটা ধুয়ে বসতে যাবে রুমে, সঙ্গে সঙ্গে দরজায় কে যেন কলিং বেল প্রেস করল। “ধ্যাৎ! কোন ফাটা গোবিন্দ এমন সময় এলো? ওমা চোর নাকি?”
রান্নাঘর থেকে বটি হাতে আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো তৃষা। দরজা খুলতেই প্রেমকে দেখল।
প্রেম বলল,’ এই বালমার্কা বাসায় একটা লিফট লাগাতে পারো না? পাঁচ তলায় উঠতে গিয়ে পা ব্যথা হয়ে গেল।’
তৃষা চমকে জিজ্ঞেস করল, ‘ আপনি?’
প্রেম ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘না, তোমার ভাতার।’
তৃষা বিভ্রান্তে জিজ্ঞেস করল, ‘ প্রেম ভাইয়া, আপনি এখানে কী করে?’
প্রেম তৃষাকে ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকে পড়ল। পেছন ফিরে তৃষাকে দেখে বলল,’ গা এমন ভেজা কেন? খুব পরিশ্রমের কাজ করেছো মনে হচ্ছে? ঘরে কেউ আছে নাকি?’
তৃষা আতঙ্কে বলল, ‘ আপনি এখান থেকে যাবেন?’
প্রেম পাত্তা না দিয়ে সরাসরি বিছানায় গিয়ে বসে বসল। তারপর বলল,’ বিছানায় এসো।’
তৃষা ভয়ে বলল, ‘কেন, আপনি কী আমার ইজ্জত হরণ করতে চান নাকি? আইনের লোককে কল করব।’
প্রেম ব্যঙ্গ করল, ‘ তোর ইজ্জত আছে? তুই ভালোয় ভালোয় বিছানায় আসবি? আমি আসলে কিন্তু পড়ে বিছানা থেকে উঠার শক্তিও পাবি না বলে রাখছি।’
তৃষা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘ আরে আরে ভয় দেখাবেন না, আসছি তো।’
প্রেম তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, ‘ এই তো আমার ব্যাড বিচ।’
চলবে?
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষ্ণা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৫+১৬
-
প্রেমতৃষা গল্পের লিংক
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৮+৯+১০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৩+১৪
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১১+১২
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪+৫
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২+৩
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৭+১৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৯+২০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১