#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৪
প্রেম নেওয়াজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। গলায় গিটারের একটা লকেট পড়ল। হাতে সে ঘড়ি পড়ে না। ওই যে সময় দেখার সময় নেই বলেই। অদ্ভুত ঋষি বাবাদের মতো কতগুলো ব্রেসলাইট হাতে দিলো। চুলগুলোতে তার চিরুনী চালানো লাগে না। সব সময় হাত বুলিয়ে ঠিক করে নেয়। তাতেই তো তাকে দেখতে মেয়েদের প্রেম প্রেম একটা ভাব চলে আসে। কিন্তু ওই মেয়ে মানুষ? ইয়াক! যত দূরে থাকা যায় বাবা। মানুষ ভাবে প্রেম বোধহয় বখাটে। তবে তাকে ভালো করে যারা চেনে-জানে তারা বলতে পারবে মেয়ে মানুষের সঙ্গে তার কী পরিমান এলার্জি। আর গায়ে পড়া মেয়ে হলে তো কথাই নেই। যেদিন ওমন মেয়েদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ওইদিন বাসায় এসে একসঙ্গে তিনটে এলাটন খেতে হয়। মানুষের ইলিশ,চিংড়ি, বেগুনে এলার্জি এই জনাবের মেয়ে মানুষে। গায়ে পড়া মেয়েদের প্রেম নিজের তরিকায় ঠিক করে। ওদের সঙ্গে পিরিতের আলাপ জমে না ঠিক। তবে দুষ্টু আলাপের মাধ্যমে অন্তত এদেরকে নিজের থেকে মেপে মেপে দশ হাত দূরে তো রাখা যায়। প্রেমের কানের নিচ বরাবর ঘাড়ের কাছে একটা ছুরির ট্যাটু আছে। সে ট্যাটুটা ভালো করে দেখে খালি গায়েই সাদা রঙের প্যান্টটা পড়ে বিছানায় বসে পড়ে। তার এন্টিক জিনিসের প্রতি আর্কষন কাজ করে। ঘরটা সেসব জিনিস দিয়েই সাজানো। সঙ্গে পুরো ঘর জুড়ে তো প্রেমের তোলা অহরহ ছবি তো আছেই। সারাবছর এদিক-ওদিক ঘুরে ছবি তুলতেই থাকে। শেষবার সুইজারল্যান্ড গিয়ে ৬ মাস থাকা হয়েছে। শেষে দাদু হার্ট এর্টাকের নাটক করে বাড়ি আনিয়েছে তাকে। তবে এই কাঠের বাড়ি আর তার ডেকোরেশন দাদুভাইয়ের নাকি ভাল্লাগে না। দাদুভাই বলে এটা তো বাড়ি নয় একেবারে চিড়িয়াখানা। দাদুভাই ছাড়া প্রেমের আপন বলতে কেউ নেই। প্রেম আপন করতেও চায় না কাউকে। মানুষ বিশ্বাসঘাতক। জন্ম দেওয়া মায়েরা যেখানে সন্তান ছেড়ে দেয় সেখানে দুনিয়ায় নিজের খেয়ে অন্য কাউকে বিশ্বাস করাও মুশকিল। নিজের মতো আছে এই তো বেশ চলছে দিন কাল। আর কী লাগে? প্রেম গিটারটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে সিগারেট ধরায়। পাশেই টেবিলের ওপর কাঁচের গ্লাসটা ছিল। তাতে মদ ঢালা। প্রেম হাতের সিগারেটটা গ্লাসের মধ্যে ফেলে গিটারটা এবার আরো শক্ত করে কোলে নিয়ে নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘প্রেম ভালোবাসা তোর জন্য না প্রেম। প্রেমে পরবি তো মরবি। ওপথে যাওয়ার রাস্তাটা তো আছে তবে ফেরার পথ নেই। প্রেমেরা ভালোবাসার জন্য তৈরি হয়নি। তারা ধ্বংস, ধ্বংস থেকে প্রেম সৃষ্টি হয়না।’
প্রেম গিটার টুংটাং করে বাজালো। সুরে সুর মিলিয়ে গান ধরল, ~প্রেম আমার ওওওওও প্রেম আমার~
–
হেতিজা নেওয়াজ ভাত খাওয়া থেকে সব কিছুই বন্ধ করে দিয়েছেন। একে তো ছেলের জন্য এতগুলো মেয়ে দেখল তার মধ্য থেকে একটাও পছন্দ হয়নি। উল্টো নাকে একটা ব্রণ উঠেছে। কী যে ব্যথা। মুখে কিছু উঠলে হেতিজা সেটাকে যতক্ষণ পারে খোঁচাতে থাকে। কেন খোঁচায় নিজেও জানে না। আবার সে এটাও জানে এই খোঁচাখোঁচি করতে গিয়ে দাগটা যে বসে যাবে। তখন সে ডিপ্রেশনে চলে যাবে। কিন্তু তাতে কী আপাতত খুঁচিয়ে তো আরাম আরামই লাগছে। প্রেমা মায়ের ঘরে ঢুকতেই হেতিজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রত্যুষ আসেনি?’
‘না আসেনি।’
হেতিজা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ‘ইশ কী ঘোড়ার ডিমের চাকরি। বিয়ে দিলে যদি এত রাত পর্যন্ত ডিউটি করতে হয় তবে কী বউ টিকবে? আর আমারও কী নাতি-নাতনির মুখ দেখার সৌভাগ্য হবে কখনো?’
প্রেমা দাঁত কেলিয়ে বলল,’কেন মা আমি আছি না? আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও তোমার স্বপ্ন পূরণ করে দেব।’
‘ছি কিসব কথাবার্তা। ঝাঁটা দিয়া বারি মারব সর সামনে থেকে।’
প্রেমা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, ‘গেলাম প্রেম ভাইয়ার কাছে।’
হেতিজা হাঁফ ছেড়ে বললেন, ‘যা খালি। আমি তো মুখে বললাম প্রেম দেবেনি একটা বারি তখন খুশি হব।’
প্রেমা মনে মনে আরেকবার মুখ ভেংচি কেটে বলল, ‘আল্লাহ জানে এটা আমার টোকানো মা নাকি আমি নিজেই টোকানো?’
_
রাতের খাবার খেয়ে সিদ্দিক নেওয়াজ রুমে বসতেই তার বাম হাত, কালুর বাপ ওরফে মোখলেস হোসেন বদরুদ্দোজা, এসে হাজির হলো। এই বুড়োটা লুঙ্গি গায়ে পুরো অলি-গলি চক্কর দিয়ে বেড়ায়। একেবারে সিদ্দিক নেওয়াজের খাস লোক বলা চলে। কোন বাড়িতে কী খবর চলছে, তা ওই বাড়িতে ঘটার আগেই কালুর বাপের কানে পৌঁছে যায়।
লোকটা চিকনচাকন, মুখে দাড়ি নেই—এই বয়সেও একেবারে ক্লিন শেভড। গায়ের রঙ কালোমতো। সারাদিন পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রাখেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হলে অবশ্যই একটা ছাতা খুলে ধরা চাই, নইলে পানের পিক ছুড়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকেই “পিকবিলাশ” করিয়ে দেবেন। কালুর বাপের ঘিন্নি মরেছে দশ-বারো বছর আগে, কিংবা তারও বেশি। ঠিক মনে নেই। কিন্তু পৃথিবীর সব সুন্দরীকেই সে মৃত বউ নার্গিসের চোখে দেখে। তাকে এত ভালোবাসত যে আজও লুঙ্গি পরে পথে-ঘাটে নার্গিসের গানে কষ্টের মাজা ঢুলানো নাচ করে বেড়ায়। এই তো কিছুদিন আগে সিদ্দিক কালুর বাপকে হুকুম দিয়েছে, প্রেমের ওপর নজর রাখতে। নাতিকে যদি একবার হাতে-নাতে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কট দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেবে। সিদ্দিক নাতিকে দেখিয়ে দেবে। সে যদি ডালে চলে, তাহলে দাদুও চলে পাতায়। কালুর বাপ ঠিক করেছে, আগামীকাল ভার্সিটিতে যাবে। এবার হাতে-নাতে নেওয়াজ বাড়ির ছেলেকে না ধরতে পারলে, সে নিজেই নার্গিসের গানে নাচা ছেড়ে দেবে। হুহ!
–
সারারাত তৃষার ঘুম আসেনি। বারবার ওইযে ওই গলিতে যেই ছেলেটি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল তাকেই মনে পড়ছে। তৃষা ভেবেছিল ওই হিন্দি গানটা হয়তো তার মনে বেজে উঠেছে। কিন্তু বাজল পাশ দিয়ে যাওয়া ব্যক্তির ফোনে। এমন রিংটোন কেউ ব্যবহার করে? তবে প্রত্যুষ ওই লোকের সামনে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে তৃষাকে টুপ করে ছেড়ে দিয়েছিল। ওমনেই সে ও মাগো বলে চিৎকার করে উঠে। যা লেগেছে না মাইরি! জখমটা ব্যথা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সুন্দর ছেলেটা তাকে বাঁচিয়েছিল—ভাবলেই ব্যথা কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল। রাতে শিমলা মলম লাগিয়ে দিয়েছিল, তবু পরদিন ভার্সিটিতে এসে তৃষা আধোঘুমে ক্লাস কাটাল। তবে আজকে একটা মানুষকে সে কোথাও দেখেনি। ওই হাইব্রিড করলাটা কী মরে টরে গেল নাকি? অভিশাপ লেগে গেল না তো? ক্লাস শেষে বের হতেই অঙ্কুুরের সঙ্গে দেখা হতেই সে বলল, ‘আরে ভাবী আপনি?’
তৃষা ভ্রু কুঁচকে বলল,’ভাবী?’
অঙ্কুর ছাড়বার পাত্র নয়, ‘আরে ভাবী নয় তো কী? আপনার যার সাথে বিয়ে হবে সে তো ছেলে মানুষই হবে? মেয়েকে তো আর বিয়ে করছেন না? তাই সেই হিসেবে আপনার স্বামী তো আমার ভাই। আর আপনি ভাবী।’
‘কিন্তু ছেলেকে বিয়ে না করে যদি তার নানাকে বিয়ে করি? তখন তো নানি হব? তাই না জেনে অগ্রিম দুই লাইন বেশি বলবেন না। যেমন বস যেমন তার চামচিকা। দুটোই পুষ্টি ছাড়া সবজি।’
বেচারা আলাভোলা অঙ্কুরটার মাথার ওপর দিয়ে গেল সব। এসেছিল এই মেয়ের সঙ্গে একটু সম্পর্ক ভালো করতে উল্টো কথা শুনিয়ে চলে গেল। এই প্রেম ভাইয়ের জন্য সব মেয়েরা তাকে এমন অবহেলা করে। প্রেম, ভালেবাসা হচ্ছে অক্সিজেনের মতো। ওইসব না করলে যে একটা প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষের শ্বাসকষ্ট হয় তা ওই প্রেমহীন প্রেম ভাই কেমন করে বুঝবে? ওনার নাম করণটা যে কে করেছে? সামনে পেলে তীর্থযাত্রায় পাঠাত তাকে।
তৃষা চারপাশে প্রেমকে খুঁজতে খুঁজতে আর মনে মনে গালি দিতে দিতে গেইট থেকে বের হওয়ার জন্য এগিয়ে চলল। জীবনে কোনোদিন কাজ না করা মেয়েটিকে দিয়ে শেষে হলের কার না কার রুম সাফ করিয়েছে। ইশরে এত মোলায়েম হাতগুলো গেল। এই হাত তৈরি হয়েছে মেকআপ করার জন্য। ওইসব সাফ করার জন্য নাকি? মনে মনে আবার অভিশাপ দিল প্রেমকে, ‘দেখিস হাইব্রিড করলা তোর কপালে একটা তাড় ছিঁড়া, বানরের মতো দেখতে শাঁকচুন্নি বউ জুটবে।’
গেইটের কাছে আসতেই কে যেন পেছন থেকে শিস বাজিয়ে বলল, ‘এই যে টিউবলাইট। কাম হিয়ার।’
তৃষার সেই কণ্ঠ শুনে বুঝতে বাকি রইল না প্রেম ভাই যে তাকে ডাকছে। সে পেছন ফিরে একটা লম্বা সালাম দিয়ে বলল, ‘সিনিয়র ভাইয়া কিছু চাই আপনার? বান্দা হাজির।’
প্রেম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘এই তো চাকরানীর ফর্মে এসেছো। আর ওটা বান্দা নয় বান্দী হবে। ছেলে হতে গেলে কত কী লাগে? সবার তো আর সব চাইলেই হয় না।’
তৃষা আশপাশে থাকালো। এই লোকের লজ্জা নেই। জন্মের সময় মনে হয় তার চোখের নিচে কাগজ দেওয়া হয়নি। ছ্যাহ! তৃষা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই প্রেম বাইকের ওপর থেকে নেমে তার ওড়না ধরে টান দিতেই তৃষা ক্ষেপে বলল, ‘কোন হনুমান রে আমার ওড়না ধরে টানাটানি করিস?’ ভার্সিটির সবাই তখন অবাক। এত মানুষের সামনে এই মেয়ে প্রেমকে হনুমান বলল? এমন ডাইরেক্টলি? প্রেম চারপাশে একবার তাকাতেই তৃষা পেছন ফিরে বলল, ‘ওহ আচ্ছা আপনি ছিলেন সিনিয়র ভাইয়া? আমি ভাবলাম কে না কে? মাইন্ড করবেন না। যাই হোক আমার ওড়না পছন্দ হয়েছে? আপনি আপনার ঠিকানাটা দিয়েন জামা-সেলোয়ারটাও পাঠিয়ে দেব। সব জিনিস তো আবার সবাই চাইতে পারে না মুখে। থাক আমি না হয় বুঝেই নিলাম।’ বলেই মুখটা বাঁকাল তৃষা। প্রেম তা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,’এই যে মুখটা বাঁকালে? আমার না জুনিয়র তোমার প্রতি একটুও রাগ করতে মন চাইছে না।’
তৃষা চোখ দু’টো সরু করে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’
‘কারণ প্রতিবন্ধীদের মুখ তো বাঁকাই হয়। ওদের ওপর রাগ করলে আল্লাহ পাপ দিবে।’
তৃষার মেজাজ তখন আরোও খারাপ। সে শিমলা টেনে কাছে এনে বলল, ‘শালী ফায়ার সার্ভিসকে কল দে। গায়ে আমার আগুন ধরছে।’
প্রেম বাঁকা হেসে চোখে রোদচশমা লাগিয়ে অঙ্কুরকে বলল, ‘শালা খাটি ঘিয়ের ডিব্বা আন। আগুনে একটু ঘি ঢালি।’
তৃষা মুখ বাঁকিয়ে যেতেই পেছন থেকে আবারও প্রেমের ডাক হলো, ‘সেদিনের চুমুটা কিন্তু পাওনা জুনিয়র।’
তৃষা মনে মনে তেতে উঠল। এই খচ্চর লোক এখনো সেই কথা ভুলেনি। কতবড় জোচ্চুর ভাবা যায়? তৃষা কী করবে না করবে ভাবতে ভাবতে গাছের কোণে খেলতে থাকা ছোট্ট কুকুরছানা গুলোকে দেখে। মাথায় তার বুদ্ধি চলে আসে। সে মনে মনে বলে উঠে, ‘কুকুরের আম্মাজান মনে হয় লাঞ্চ করতে গিয়েছে। যাই এই সুযোগে ছানা-পোনাদের সঙ্গে মিট করে আসা যাক।’
প্রেম আবার বলে উঠল, ‘কী হয়েছে দেও চুমুটা।’
সে মায়াভরা ভঙ্গিতে বলল, ‘প্রেম ভাইয়া আপনি প্লিজ চোখ বন্ধ করেন। আমার না হেব্বি লজ্জা। লজ্জায় মুখ পাতলা ঝলের মতো হয়ে যায়।’
‘সরাসরি বললেই তো পারো ডায়রিয়া রোগীর ইয়ের মতোই কালারটা হয়।’
‘ইশ কী যে বলেন আপনি? লজ্জা করছে। চোখ বন্ধ করুন। আজকে আর বাঁধা আসবে না। আমি পারফিউম মেখে এসেছে। লিকুইডের গন্ধ আর গায়ে নেই।’
তৃষা এগিয়ে আসতেই প্রেম অবাক হয়। ততক্ষণে এদিকটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে। মানুষ বলতে শিমলা আর অঙ্কুর সহ কিছু মানুষ আছে। তৃষা যত এগিয়ে আসে ততই প্রেম টাসকি খায়। এই মেয়ের নাকি লজ্জা আছে? এই তার লজ্জার নমুনা? সুযোগ পেয়ে প্রেমের ঠোঁট খাওয়ার ধান্দা? এটা কী রাস্তার পাশে বিক্রি করা বেলপুরী পেয়েছে নাকি? একটু না হয় বলছে সে, তাই বলে প্রতিবাধ করার বদলে চলে আসবে? এখন চুমু খেতে না দিলে তো ইজ্জত বলতে সবার সামনে কিছু থাকবে না। প্রেম খোদার নাম নিয়ে দোয়া ইউনূস পড়তে পড়তে চোখটা বন্ধ করতেই বলল, ‘যা করার জলদি করো। কই হলো?’
‘একটু ওয়েট। সুন্দর করে হেঁটে আসতে হবে না?’
‘জলদি আয় বাল। এমনিতেও গান্ধীপোকার চুমুর প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। না দিতে চাইলে নেই। জোর কিসের? প্রেম ছোটদের সঙ্গে জোর করে না।’
‘আরে না না। চুমু তো দেবই। চোখটা বন্ধ রাখুন না।’
প্রেম তাই করে। তবে হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল কেমন জানি ভেজা ভেজা একটা ফিল পাচ্ছে গালে। চুমু তো ঠোঁটে দেওয়ার কথা ছিল? গালে দিচ্ছে কেন? কিন্তু চুমু কম চাটাচাটি বেশি লাগছে। প্রেম কী ললিপপ নাকি? প্রেম রাগে চোখ খুলতেই দেখল তৃষা তার গালের সামনে ওই কুকুর ছানাটিকে ধরে রেখেছে। সেই ছানা আবার খাবার ভেবে প্রেমের গালে জিহ্বা ছুঁয়ে দিচ্ছে। এহেন দৃশ্য দেখেই তো প্রেমের গা গুলিয়ে আসে। সে রিয়েকশন দেওয়ার আগেই অঙ্কুর ঠোঁট চেপে এসে গান ধরল,
~’আহা একি ছোঁয়া, নিশিদিন। শিহরণে কাটে এ বেলা।~
চলবে?
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৫
বড় বটগাছটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে তৃষাকে। আজকে না জানি তার কপালে কী লেখা আছে। ভার্সিটি আসতে না আসতেই একটা মগা ছেলের সঙ্গে শত্রুতা বেঁধে গেল। গাছের সঙ্গে সে একা বাধা অবস্থায় নেই বরং অংকুরকেও বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রেম তাকে লুঙ্গি পড়িয়ে নিচে পিঁপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তাও যে-সে পিঁপড়া নয়। একেবারে বিষ পিঁপড়া। বেচারার সমানে চুলকাচ্ছে। কিন্তু সে চুলকাতেও পারছে না। হাত বেঁধে রাখা। এত বড় শাস্তি তো ইংরেজরাও সিরাজুদ্দৌলাকে দেয়নি। অংকুর কাঁদো কাঁদো করে বলল, ‘ভাই পিঁপড়া সিরিয়াস জায়গায় কামড়েছে, ইয়ে মানে যদি একটু চুলকে দিতেন।’
এতক্ষণ তৃষা চুপই ছিল। কিন্তু অংকুরের কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘কই দেখি।’
সঙ্গে সঙ্গে অংকুর বলে উঠল, ‘নাউজুবিল্লাহ পুরুষ বলে কী আমার কোনো পুরুষত্ব নেই? দেখুন এসব আমার বউয়ের জন্য তুলে রাখা। কাউকে দেখাতে পারব না। কিন্তু আমার সঙ্গে প্রেম করলে অন্য বিষয়। দেখতে হলে করতে হবে। মানে প্রেম।’
তৃষা মুখ ভেংচি কেটে বলল, ‘আসছে আমার পুদিনার চাটনি। আমি ওই প্রেম-টেম করি না। এক্কেরে ভালোবাসি।’
প্রেম সঙ্গে সঙ্গে তৃষাকে একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘ওকে তো পিঁপড়ার কামড় খাইয়েছি। তোমার বুঝি সাপের কামড় চাই? এখন বলো তোমাকে কোন স্তরের শাস্তি দেব?’
তৃষা গলা উঁচু করে, নির্ভীক ভঙ্গিতে বলল,’দেন যেটা মন চায় দেন।’
প্রেম কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘ লিপ ফিলার করবে?’
‘টাকা দেন করি।’
‘ ওকে ঠিক আছে।’ বলেই প্রেম পকেট থেকে একটা সিসি বের করল। একটু আগেই একটা ছেলেকে দিয়ে সিসিটা আনিয়েছে। তৃষা প্রেমকে বলল, ‘এই প্রেম ভাই এখানে অনেক গরম। ঘামিয়ে যাচ্ছি। একটু বাতাসের ব্যবস্থা করেন।’
‘আমার আন্ডা করব তোর জন্য শালী। বেশি কথা বলিস তুই।’
‘এই আন্ডাটা আমায় সিদ্ধ করে দিয়েন। বুঝেনই তো ডাইটে আছি।’
প্রেম ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি। খাসি একটা।’
তৃষা তির্যক হাসি দিয়ে বলল, ‘খাসি চিনেন? ইয়ে কেটে ফেলা ছাগলকে খাসি বলে। এখন বলুন এখানে খাসি কে? আপনি নাকি আমি?’
‘আমি মানে? আমি কোনো খাসি না।’
‘ওমা তাই নাকি?’ তৃষা পাশে বাঁধা অংকুরকে ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এত বড় ছেলের খৎনা করা হয়নি। কী লজ্জার বিষয় বলুন তো।’ তৃষা ফের প্রেমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ চিন্তা নেই মাইরি। ওই সামনের গাছটায় একটা খৎনার বিজ্ঞাপন দেওয়া। আমি আপনার হয়ে কথা বলে আসব। একেবারে জব্বর সার্ভিস দেবে।’
‘তুই আগে সার্ভিস নে ট্যাবলেট। আর আমি কী করেছি, কী করিনি সেটা জানতে হবে না তোকে? যেদিন ধরব না সেদিন বুঝবি কে খাসি আর কে পাঠা।’
‘তেল মেখে আসব গায়ে। ধরতে গেলেই বাইং মাছের মতো ফুরুৎ।’ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল।
‘ছাই দিয়ে নেব। ফসকাবে না।’
তৃষা চুপসে যায়। তার আর এখানে ভালো লাগছে না। ওদিকে শিমলাটা সেই কখন থেকে প্রেমকে রিকুয়েষ্ট করছে তৃষাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। প্রেম চোখ গরম করে জানিয়ে দিয়েছে আরেকবার মুখ থেকে সাউন্ড বের হলে তাকেও নাকি বাঁধবে। তাই ভয়ে মেয়েটি আপাতত চুপসে আছে।
‘এই ভাই, ও মোর সিনিয়র ভাইয়া ঠ্যাং ব্যথা হয়ে গেছে তো। এবার ছাড়ুন।’
‘ধরলাম কই?’
প্রেম ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তৃষার সামনে এসে সিসিটা ধরতেই তৃষা বলল, ‘এটা কী?’
‘তোমার বাল।’ প্রেম গম্ভীর গলায় জবাব দিল।
‘আর প্রেম ভাই একটা হেব্বি মাল।
‘তোমায় থাপড়িয়ে গাল করে দেব লাল।’
তৃষা ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচি কাটতে যাবে তার আগেই প্রেম সিসি খুলে সেখান থেকে মধু বের করে বলল, ‘মধু খা শালী। তারপর যদি মুখের ভাষা মধুময় হয়। সিনিয়রদের সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তা তো শিখিসনি। ‘
‘আপনিও তো জুনিয়রদের সঙ্গে ভালো করে কথা বলেন না। তাদেরকে ভালোবাসেন না।’
‘হলের রুমে দেখা করো ট্যাবলেট। ভালোবাসা দেবনি, ঝোলা ভর্তি করে নিও।’
‘যাব না। আপনি কাজ করান খালি।’
‘আর করাব না। জাস্ট অংকুরের সাত মাস না ধোঁয়া জাঙ্গিয়াটা একবার ধুয়ে দিলেই হবে।’
সে কথা শুনে অংকুর ফের বলে উঠল, ‘ভাই এসব না বলে মেরে ফেললেই তো পারেন আমায়।’
প্রেম সেই কথার পাত্তা দিল না। তৃষাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তৃষা বলল, ‘সমস্যা নেই আমিও আপনাকে সেই জাঙ্গিয়া ধোঁয়া পানি যদি চিপরে শরবত করে না খাইয়েছি তবে আমার নামও তৃষা নুজায়াত নয়।’
প্রেম এগিয়ে এসে জোর করে তৃষার ঠোঁট সহ ঠোঁটের আশপাশে মধু লাগিয়ে দিয়ে পকেট থেকে আরেকটা বাক্স বের করল। তৃষা সেখানে তাকাতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠল। এমা মৌমাছি? এই লোক তাকে শেষ পর্যন্ত মৌমাছির কামড় খাওয়াবে?
‘এই ভাই দেখেন। ছোট মানুষ তো, একটু না হয় ভুল হয়েছে। তাই বলে মৌমাছির চুমু চাই না। প্লিজ আপনার ইয়ে মানে পা ধরি এই যাত্রায় ছেড়ে দেন।’
প্রেম বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়ে ইয়ে ছাড়া কথা বলতে পারো না? খাটাশ মেয়ে।’
‘সরি সরি,ক্ষমা করে দেন। চুমু খেতে চাই না।’
‘চুমু তো তোমায় খেতেই হবে সোনা। কারণ এখন যে তোমায় চুমু খাওয়ানোর ভীষণ ফিল পাচ্ছে।’
–
যুবরাজ চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। পিস্তলটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে সামনে বসে থাকা তৃষার মা-বাবাকে বলল,’জলদি বলুন আপনার মেয়ে কোথায় গিয়েছে? নইলে কিন্তু মাথা উড়িয়ে দিব।’
তৈমুর তখনো ফোনে গেমস খেলছে। সে যে কিডন্যাপ হয়েছে সে খেয়াল কী তার আছে? যুবরাজ রাফসানকে বলল, ‘এই শালার ফোনটা নে তো। কিডন্যাপ করেও দাম পেলাম না। মন চাইছে ফোনটা ওর পেছন দিয়ে ঢুকাই।’
‘ভাই পরে কিন্তু অপারেশনের খরচা আপনাকেই বহন করতে হবে।’
‘হ্যাঁ তাও ঠিক।’ হঠাৎ তৃষার মা চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এই কোনো সবজি আছে? এখন আমার সবজির শরবত খাওয়ার সময়। ডাইটে আছি তো।’
যুবরাজের খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘শরবত নয় আপনাকে হিশু করে দেওয়া সুইমিং পুলের পানি গুলিয়ে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে।’ তবে সে বলল না। হবু শশুর-শাশুড়ি হয় তো। যুবরাজ তৃষার বাবাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে বলে উঠল, ‘এই বাবা এই কিডন্যাপ করে কোথায় নিয়ে এসেছো? কী গরম এখানে? এত টাকা কামিয়ে কী লাভ যদি জনগণের জন্য একটা এসি না লাগাতে পারো? এভাবে কেউ কিডন্যাপ করে? একটা টিভিও নেই। এখন আমি খবর দেখব কী করে? সন্ধ্যা সাতটার খবর শুরু হতে চলল।’
লোকটিকে থামিয়ে তৃষার মা আবার বলে উঠল, ‘ এই বুড়া চুপ থাকো। আমার এখন জি বাংলার নাটক দেখতে হবে। গতকালের পর্বে দেখলাম রাধা ছাদ থেকে পড়ে যাচ্ছিল। এখনো আকাশেই ঝুলে আছে নাকি রিক লন্ডন থেকে এসে তাকে ক্যাচ করেছে সেটা দেখতে হবে না?’
মাকে থামিয়ে আবার তৈমুর চুপ যায় নাকি? সেও ফোনে ফ্রি-ফায়ার খেলতেই হবে, তারও ফোন চাই বলে আন্দোলন শুরু করল। শেষে যুবরাজের মাথা পুনরায় গরম গেল। কেমন জানি চক্কর চক্কর দিচ্ছে। সে রাফসানকে দ্রুত বলল, ‘গবেট এদের বিদায় করে বাড়ি পাঠিয়ে দে। এদের কিডন্যাপ করে আমি নিজেই এখন পাগলপ্রায়।’
রাফসান মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘আগেই বলেছিলাম এই পাগলের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক কইরেন না। শুনলেন তো না। এখন ভুগতে থাকেন। আবার তো বিয়ে করতে চান আরেক পাগলকে। ছ্যাহ!
–
অন্ধকার কক্ষটির অস্তিত্ব মৃত্যুর অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসার সংকেত জানান দিচ্ছে। আলো এখানে ঢোকে না, ঢুকতেও চায় না। ভারি, কালচে পর্দা জানালাকে গিলে খেয়েছে। বাতাসে জমাট বাঁধা রক্তের গন্ধ। কেমন যেন শ্বাসরুদ্ধকর সব। দেয়ালজুড়ে ঝুলছে বিকৃত সব প্রতিচ্ছবি। কোথাও চোখ উপড়ে ফেলা মুখ, কোথাও ভস্মীভূত অঙ্গ, আবার কোথাও হাহাকার মিশে থাকা অস্পষ্ট মানুষের চেহারা। ছবিগুলো যেন আর ছবি নয়, একেবারে মৃত আত্মাদের বন্দি আর্তনাদ। এক কোণে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে ছুরি, করাত, ও নানা রকম অচেনা যন্ত্র। প্রত্যেকটির ধারকণা এখনও কারও চামড়ার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। ধাতব গায়ে শুকনো দাগ, কিন্তু সেই দাগ থেকে উঠে আসে ধোঁয়া-মেশানো কাঁচা রক্তের গন্ধ।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি অপেক্ষা করছে দেয়ালের গায়ে গায়ে। সারি সারি পুতুল। যাদের মাথা জোর করে নেড়া করে ফেলা হয়েছে। শূন্য কাঁচের চোখগুলো স্থির তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে। অথচ চোখের ভিতর নেই কোনো প্রাণ। কিছু পুতুলের গলায় কাটা চিহ্ন, কিছুতে কালি, সেলাই করা, কিছু আবার হেসে আছে ভাঙা দাঁতের মতো বিকৃত এক ভঙ্গিতে। কালো হুডি পড়া লোকটার মুখে একটা কালো মাস্ক। সে ঘরে ঢুকতেই হাতের ব্যাগটা থেকে একটা নতুন পুতুল বের করল। টেবিলের ওপর থেকে একটা চাকু তুলে ইচ্ছে মতো আঘাত করতে থাকল পুতুলের চোখের ওপর। যতক্ষণ না মনের শান্তি মিটল ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত। স্বাদ মেটার পর সেই বিকৃত পুতুলটিকে আরো বিকৃত করতে কেঁচি দিয়ে সব চুল কেটে একেবারে নেড়া করে দিল। তারপর
কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পুতুলটির দিকে। ঠোঁটের কোণ বেঁকে যায়। পরক্ষণেই ভেসে ওঠে এক বিকট হাসি। যা মানুষের নয়, পশুরও নয়। যেন অর্ধেক মৃত, অর্ধেক জীবিত কোনো দুঃস্বপ্নের গলা ফেটে বেরিয়ে আসা আওয়াজ। হাসির প্রতিধ্বনি দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই মনে হয়, সারি সারি নেড়া মাথার পুতুলরা কেঁপে উঠল, আর তাদের শূন্য চোখে লেগে গেল মৃত্যুর আতঙ্ক। লোকটি এবার পুতুলটিকে জড়িয়ে ধরে তার গন্ধ শুকলো। তারপর বলল, ‘তোমার জন্য নতুন চুল চাই তো? তোমার জন্য চুল এনে দিব। তুমি রাগ করো না প্লিজ।’ বলেই সে পুনরায় আগের মতো হাসল। এবারের হাসির শব্দ আগের থেকেও শতগুণ বেশি ভয়ংকর মনে হলো।
চলবে?
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষ্ণা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৬+৭
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১১+১২
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৮+৯+১০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২+৩
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৩+১৪
-
প্রেমতৃষা গল্পের লিংক
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৭+১৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৯+২০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৫+১৬