নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
পর্ব_২০
আতিয়া_আদিবা
প্রাতঃকালীন রৌদ্রের প্রখরতা তখনো গজনবী এস্টেটের সুউচ্চ তোরণগুলোকে স্পর্শ করতে পারেনি। কুয়াশার পাতলা চাদর সরিয়ে ভোরের আলো যখন অন্দরমহলের বারান্দায় এসে পড়ল, তখন সেই স্নিগ্ধতার মাঝেও এক অদ্ভুত গুমোট ভাব বিরাজ করছিল। গজনবী অন্দরমহলের প্রতিটি ইট যেন গতরাতের সেই প্রলয়ঙ্করী মাহফিলের সাক্ষ্য বহন করছে।
জমিদার সিকান্দার গজনবী তাঁর খাস কামরায় আসীন। তাঁর সম্মুখে রাখা রুপোর থালায় সাজানো বিবিধ ফল আর তামাকের পাত্র। কিন্তু আহারের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বরং চোখের মনিতে এক ধরনের আরক্ত আভা, যা অনিদ্রা আর ক্রোধের এক বিচিত্র সংমিশ্রণ।
হাতে থাকা হুক্কার নলে তিনি ঘন ঘন টান দিচ্ছেন, আর সেই ধোঁয়া কক্ষের ভারী পর্দার ভাঁজে ভাঁজে গিয়ে মিশে যাচ্ছে ক্ষণিকের মাঝেই।
তৎক্ষনাৎ দাউদ এসে কুর্নিশ জানাল জমিদার সিকান্দার গজনবী-কে।
- হুজুর, বাঈজী সিমরান অন্দরমহলের তোরণদ্বারে উপস্থিত। আপনার আদেশানুসারে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে।
সিকান্দার গজনবী কোনো কথা বললেন না। কেবল হাতের ইশারায় ভেতর আসার অনুমতি দিলেন। তাঁর গম্ভীর মুখমণ্ডল দেখে অভিজ্ঞ দাউদও এক প্রকার তটস্থ হয়ে পিছিয়ে গেল।
কক্ষতলে নূপুরের অতি মৃদু শব্দ ধ্বনিত হল। সিমরান প্রবেশ করল। রাতের সেই উগ্র রক্তিম সাজ আজ আর নেই। তার পরিবর্তে পরনে একটি হালকা রঙের রেশমী পোশাক।
মাথায় ঘোমটা টেনে সে অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে সিকান্দারের সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে আজ ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। চিরচেনা সেই ধূর্ত চাহনিও আজ নিমজ্জিত।
সিকান্দার গজনবী হুক্কার নলটি সরিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর কক্ষের নিস্তব্ধতাকে চিরে দিয়ে গম্ভীর নাদে বেজে উঠল।
- বলুন সিমরান, যে অধিকার আমি স্বয়ং নিজ হাতে আপনাকে উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলাম, যে পদের মর্যাদা রক্ষার ভার ছিল আপনার স্কন্ধে।তা ফিরিয়ে দেওয়ার ধৃষ্টতা আপনি কোথা থেকে পেলেন? বাঈজী মহলের উস্তাদনী পদটি কি আপনার কাছে কোনো মূল্যহীন তামাশা ছিল, যা আপনি পুনরায় বিলকিস বানুর চরণে নিবেদন করে দিলেন?
সিমরানের বুক কেঁপে উঠল। সে জানত, জমিদারের এই প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে। সে অতি সন্তর্পণে মাথা নিচু করে বলল,
- হুজুর, অপরাধ নেবেন না। আপনার দেওয়া প্রতিটি দান আমার নিকট শিরোধার্য। তবে আমি ভাবিনি যে…
- আপনি ভাবেননি!
সিকান্দার গজনবী গর্জে উঠলেন। তাঁর গলার শিরাগুলো ফুলে উঠল।
- আপনি আমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হেমাঙ্গিনীর দম্ভ আপনি চূর্ণ করবেন। অথচ আমি কী দেখলাম? গোটা মাহফিলের সামনে আপনি পরাজিত হলেন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন!
সিমরান এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। জমিদারের এই রুদ্রমূর্তি দেখে তার ভেতরে এক নিদারুণ ভয়ের সঞ্চার হল। তবুও সে তার তূণের শেষ বাণটি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হল। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সহসা সিকান্দার গজনবীর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল।
- হুজুর, আমায় ক্ষমা করুন! এই অভাগী আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেনি, সেজন্য আপনি যা শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেব।
সিমরানের দুই চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এল। সে অত্যন্ত নাটকীয়তার সাথে জমিদারের পা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,
- হুজুর, আমি বিলকিস বানু আর হেমাঙ্গিনীর কুটিল চক্রান্তের কাছে হেরে গেছি। হেমাঙ্গিনী আমায় শর্ত দিয়েছিল, সে যদি মাহফিলে অতিথিদের বিমোহিত করতে পারে, তবে আমায় উস্তাদনীর পদ ত্যাগ করতে হবে। আমি আমার শিল্পীসত্তার দম্ভে সেই শর্ত মেনে নিয়েছিলাম। হুজুর, আমার পরাজয় যতটা না শিল্পের কাছে, তার চেয়ে বেশি ছিল ভাগ্যের কাছে। আমি আপনার মনের আশা পূর্ণ করতে পারিনি বলে আজ নিজের জীবনের ওপর ধিক্কার আসছে।
সিমরানের এই অতর্কিত আত্মসমর্পণ আর কান্নায় সিকান্দার গজনবীর ক্রোধের বহ্নিশিখা সামান্য স্তিমিত হয়ে এল। পুরুষের হৃদয় জমাট বাঁধা মোমের ন্যায় কঠিন। নারীর এক বিন্দু অশ্রুশিখাই তা গলিয়ে দিতে যথেষ্ট। এক্ষেত্রেও বিপরীত ঘটল না।
তাছাড়া সিমরানের রূপ আর তার লাস্যময়ী সান্নিধ্য সিকান্দার গজনবীর অত্যন্ত পছন্দের। গত কয়েক দিনেই এই নারী তাঁর একঘেয়ে জীবনে এক নতুন মাদকতার সৃষ্টি করেছে।
সিকান্দার বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিমরানের বাহু ধরে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করলেন।
- উঠুন, বাঈজী সাহেবা। অন্দরমহলে এসে এভাবে বিলাপ করা আপনাকে মানায় না।
সিমরান উঠল না। সে মুখ তুলে অশ্রুসিক্ত চোখে জমিদারের দিকে তাকাল। তার চোখের সেই করুণ আরতি সিকান্দারের হৃদয়ে এক ধরনের অপরাধবোধের জন্ম দিল। বিষয়টি বুঝতে পেরে সুযোগসন্ধানী সিমরান তার পরবর্তী চালের দিকে অগ্রসর হল। নিমজ্জিত গলায় বলল,
- আমি আর ওই বাঈজী মহলে ফিরে যেতে পারব না হুজুর।
তার স্বরে এবার এক মায়াবী আকুতির রেশ।
সিকান্দার কুঞ্চিত ভ্রুঁ সমেত শুধালো,
- একথা কেন বলছেন?
সিমরান ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল,
- বাঈজী মহলের প্রতিটি কোণা এখন আমায় উপহাস করছে। বিলকিস বানুর সেই তাচ্ছিল্যভরা ক্ষমা আর হেমাঙ্গিনীর উদ্ধত হাসি, কোনোটাই আমি সহ্য করতে পারছি না। তারা আমায় দয়া করে থাকতে দিয়েছে, হুজুর। আমি কি আপনার এই বিশাল গজনবী এস্টেটে কেবলমাত্র একজন দয়ার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকব?
সিকান্দার গজনবী এবার তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আসনে বসালেন। সিমরান তাঁর গায়ের খুব কাছে ঘেঁষে বসল। তার শরীর থেকে নিঃসৃত দামী আতরের সুবাস জমিদারের মস্তিষ্কে এক অদ্ভুত ঘোর তৈরি করল। সিমরান জমিদারের হাতের ওপর নিজের কোমল হাতটি রাখল।
- হুজুর, আমার একটি নিবেদন আছে। আপনি কি এই তুচ্ছ বাঈজীকে আপনার ব্যক্তিগত নর্তকী হিসেবে অন্দরমহলে স্থান দেবেন না? আমি আর ওই কোলাহলপূর্ণ বাঈজী মহলের অংশ হতে চাই না। আমি আপনার ছায়ায়, আপনার একান্ত সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। আমি আপনার ব্যক্তিগত অন্দরমহলেই থেকে যেতে চাই।
সিমরানের এই প্রস্তাবটি ছিল অত্যন্ত সুকৌশলী। সে জানত, বাঈজী মহলে ফিরে যাওয়া মানেই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু যদি সে অন্দরমহলে স্থান পায়, তবে জমিদারের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় হবে এবং সুযোগ বুঝে সে হেমাঙ্গিনীকে ধ্বংস করার নীল নকশা তৈরি করতে পারবে।
সিকান্দার গজনবী কয়েক মুহূর্ত গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলেন। প্রস্তাবটি তার নিকট লোভনীয় ঠেকল। তবে এর সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিণাম বিশাল। জমিদারবাড়ির অন্দরমহলে একজন বাঈজীকে স্থায়ীভাবে রাখা মানে হচ্ছে কুলীন প্রথার মূলে আঘাত করা। তাছাড়া ব্রিটিশ সাহেবদের সাথে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে তিনি কোনো নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন না।
সিকান্দার সিমরানের থুতনিটি আলতো করে উঁচিয়ে ধরলেন। তাঁর চোখে এখন আর ক্রোধের লেশমাত্র নেই। তার বদলে এক ধরনের মুগ্ধতা বিরাজমান। তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন,
- আপনার এই আকুলতা আমার মন স্পর্শ করেছে, সিমরান। কিন্তু আপনি যা চাইছেন তা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।
সিকান্দার গজনবী একটু থামলেন, তারপর ধীর স্বরে বললেন,
- আমি এখন আমার বড়পুত্র তাইমুরের বিবাহ নিয়ে বড়ই চিন্তিত। তাইমুরের বিবাহ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে দিন, বাঈজী সাহেবা। তারপর আমি অবশ্যই আপনার এই নিবেদনটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করব।
সিমরানের মন এক নিমেষে তেতো হয়ে গেল। তবুও সে ভেতরের তিক্ততা গোপন করে পুনরায় সেই লাস্যময়ী ভাবটি ফুটিয়ে তুলল। বলল,
- হুজুর, আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য। এ অধমের সাধ্য কি যে আপনার কথার ওপর কোনো কথা বলবার! তবে আমাদের ভাবি জমিদার হুজুর তাইমুর গজনবীর বিবাহ-বাসরে কি এই অধমের খিদমত করার কোনো অবকাশ নেই? আমার একমাত্র বাসনা, আপনার শান-শওকত আর বংশের মর্যাদা যেন বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ না হয়!
সিকান্দার গজনবী মৃদু হাসলেন। তিনি সিমরানের সাথে গভীর চুম্বনে লিপ্ত হলেন। বললেন,
- নিশ্চয়ই পারবেন। তবে আপাতত আপনি বাঈজী মহলে ফিরে যান। হেমাঙ্গিনীর ওপর নজর রাখুন।তাইমুরের বিয়ের পরেই আপনার জন্য সন্তুষ্টিজনক বন্দোবস্ত আমি করব। কথা দিলাম।
সিমরান কুর্নিশ জানিয়ে বিদায় নিল। কক্ষ হতে বের হওয়ার সময় তার ওষ্ঠে এক কুটিল হাসির রেখা ফুটে উঠল। এক নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে সে আজ পা বাড়াল বাইজী মহলের দিকে।
প্রতিটি খিলানে, অলিন্দে এবং মার্বেল পাথরের থামে হীরা-কাঁচের তৈরি মোমের ঝাড়লণ্ঠনগুলো থেকে বিচ্ছুরিত আলো এক মোহনীয় পরিবেশ তৈরি করেছে আজ গজনবী এস্টেটের সুবিশাল হলঘরে। আজ মাহফিল বসে নি। তবে আজ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বহু প্রতীক্ষিত ‘নক্ষত্র-সভা’।
পনেরোজন অতি ধনাঢ্য মহাজন ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তাদের পরমাসুন্দরী কন্যাদের নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন উক্ত সভায়। এই সভার আড়ালে যে এক কঠিন রাজনৈতিক ও বংশীয় সন্ধি লুকানো আছে, তা উপস্থিত সকলের জানা।
বিশাল হলের পারস্য গালিচায় আজ আভিজাত্যের এক অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছে। চারদিকে অগুরু, চন্দন আর আতরের ঘ্রাণে নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। আমন্ত্রিত মহাজন এবং ব্যবসায়ীরা সুসজ্জিত হয়ে আভিজাত্যের দম্ভ নিয়ে আসীন।
তাদের কন্যারা একেকজন যেন শরতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। কারো পরনে বেনারসী কিমখাব, কারো অঙ্গে সূক্ষ্ম মসলিনের অলঙ্কৃত কাজ। উচ্চবংশীয় এই ললনাদের প্রতিটি মুদ্রায়, বসার ভঙ্গিতে আর পরিশীলিত হাসিতে এক ধরনের শীতল দম্ভ বিদ্যমান। তারা জ্ঞাত, তাদের মাঝেই একজনকে বেছে নেওয়া হবে গজনবী বংশের ভাবী সম্রাজ্ঞী হিসেবে।
হলঘরের সেই মাসনদে আসীন জমিদার সিকান্দার গজনবী। কিছুদূরেই আরেকটি মাসনদে আসীন নবাব তাইমুর গজনবী।
পনেরোজন কন্যা আজ নিজেদের সর্বস্ব উজার করে তাইমুরের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কেউ অতি সূক্ষ্ম চটুলতায় পাশের জনের সাথে এমনভাবে কথা বলছে যাতে তাইমুর তার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বাধ্য হন। কেউ বা তার পানের পাত্র এগিয়ে দেওয়ার জন্য এমনভাবে ঝুঁকছে যেন তার হাতের চুড়ির ঝঙ্কার তাইমুরের কানে এক বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেয়।
সুলতানা নামের এক অতি রূপবতী কন্যা, যার পিতা এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় তুলা ব্যবসায়ী,
সে সুযোগ পেলেই তুচ্ছ বিষয়ে কথা বলে তাইমুরের ঠোঁটে হাসির রেখা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
আবার রুহানা নামের আরেকজন, তার সুনিপুণ হাতে বোনা একটি রুমাল তাইমুরের আসনের পাশে এমনভাবে রেখেছে যেন জমিদারপুত্রের নজর সেদিকে পড়ে।
কিন্তু তাইমুর আজ এক পাথরের মূর্তির ন্যায় স্থির। তার ভেতরে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা কাজ করছে। এই সাজানো আভিজাত্য, গালে ঝুলিয়ে রাখা কৃত্রিম হাসি তার নিকট অসহ্য বলে মনে হচ্ছে।
তৎক্ষণাৎ দাউদের ঘোষণা শোনা গেল।
- গজনবী বংশের ঐতিহ্য রক্ষার্থে এবং আজকের এই নক্ষত্র-সভাকে আলোকিত করতে মঞ্চে আসছেন বাঈজী হেমাঙ্গিনী!
সঙ্গে সঙ্গে তাইমুর আড়চোখে পিতার পানে চাইলেন।
জমিদার সিকান্দার গজনবীর চোখে তখন এক ধূর্ত তৃপ্তি। তিনি জানেন, এই পনেরোজন রূপসীর মাঝে তাইমুরকে বসিয়ে দিয়ে তিনি হেমাঙ্গিনীকে এক চূড়ান্ত যন্ত্রণার মুখে ঠেলে দিয়েছেন। তার এই উদ্দেশ্য বুঝতে সময় লাগল না তাইমুর গজনবী-র।
হলঘরের এক কোণ থেকে সারেঙ্গীর বিষাদমাখা সুর ভেসে এল। হেমাঙ্গিনী মঞ্চে প্রবেশ করল। আজ তার সেই চিরচেনা নীল বসন নেই। জমিদারের নির্দেশে তার পরনে আজ আগুনের মতো জ্বলজ্বলে এক উগ্র পোশাক। চড়া প্রসাধন আর ভারী গয়নায় তার সহজাত স্নিগ্ধতা ঢাকা পড়েছে। সে মঞ্চে দাঁড়াতেই তার নজর সরাসরি গিয়ে আছড়ে পড়ল তাইমুরের ওপর।
তাইমুরের চারপাশ ঘিরে পনেরোজন ললনা। কেউ তার খুব কাছে ঘেঁষে বসেছে। কেউবা তাকে স্পর্শ করবার চেষ্টায় মগ্ন। কেউ তার চোখের দিকে তাকিয়ে মোহময়ী হাসি ছড়াচ্ছে। হেমাঙ্গিনীর হৃদয়ে যেন সহস্র বিচ্ছু একসাথে দংশন করল।
যাকে সে এই নগণ্য জীবনের একমাত্র ‘আরাধ্য’ মেনেছে, সেই জমিদারপুত্র আজ অন্য সাধারণ ললনাদের হাস্যালাপের কেন্দ্রবিন্দু হতে দেখা তার কাছে বিষবৎ। যাকে সে হৃদয়ের মণিকোঠায় গোপনে পূজা করেছে, তাকে আজ পরনারীর ভিড়ে দেখা তার পক্ষে মরণাধিক যন্ত্রণার।
তবুও হেমাঙ্গিনী থেমে রইল না। শুরু হলো তার নৃত্য। তবলার দপদপ শব্দ আর ঘুঙুরের রিনঝিন আওয়াজে হলঘর মুখরিত হয়ে উঠল। হেমাঙ্গিনী যখন মঞ্চে প্রথম মুদ্রাটি ধরল, তখন তাইমুরের চোখেমুখে এক তীব্র আর্তি ফুটে উঠল। তিনি হেমাঙ্গিনীর চোখের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন বলছেন,
- হেমাঙ্গিনী, এই আতর আর অলঙ্কারের তীব্র গন্ধে আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে! এই ললনাগণ তাদের রূপের মায়াজালে আমায় চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। আমি এই মিথ্যে আড়ম্বর আর এক মুহূর্তও তিষ্ঠাতে পারছি না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন! আমি আপনার ওই হৃদয়ের গহীনে আশ্রিত হয়ে থাকতে চাই!
তাইমুরের এই অস্থিরতা হেমাঙ্গিনী দৃঢ়ভাবে অনুভব করল। সুলতানা তখন তাইমুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বলে খিলখিল করে হেসে উঠল।
সেই হাসিটি হেমাঙ্গিনীর কানে গরম সিসার মতো বিঁধল। কিন্তু সে বিচলিত হলো না। সে ঘুরতে ঘুরতে একদম মঞ্চের কিনারায় চলে এল, যেখানে তাইমুর আসীন। তার চোখের মণি স্থির হলো তাইমুরের ওপর।
হেমাঙ্গিনীর সেই তীক্ষ্ণ চাহনি তাইমুরকে এক নিঃশব্দ বার্তা পৌঁছে দিল। যেন সে ইশারায় বলল,
- ধৈর্য ধরুন হুজুর। আপনি এই অতি রূপসীদের ভিড়ে নিজের গাম্ভীর্য হারাবেন না। এই সভা শুধু আভিজাত্য নয় বরং বংশীয় সম্মানের অংশ।
কোনোভাবেই যেন আপনার সম্মান ধূলিসাৎ না হয়। আমি আপনার অন্তরের কুটিরে আছি তো!
হেমাঙ্গিনীর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিটি ছিল অতি নাটকীয়। সে নৃত্যের তালের মাঝেই তার হাতের একটি মুদ্রায় তাইমুরকে বোঝাল যে, তিনি যেন এই পরিস্থিতি শান্তভাবে সামলান।
তাইমুরও হেমাঙ্গিনীর মায়াবী শাসনের কাছে নতি স্বীকার করলেন। তার মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটি শিথিল হলো। তিনি লম্বা একটি শ্বাস নিয়ে পুনরায় পিঠ সোজা করে বসলেন।
তবে হেমাঙ্গিনীর এই বিশেষ অঙ্গভঙ্গি চতুর সুলতানার দৃষ্টি এড়ালো না। তার মনে ঈর্ষা ও সন্দেহ দানা বাঁধল।
চলবে…
Share On:
TAGS: আতিয়া আদিবা, নিষিদ্ধ রংমহল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১০
-
নিষিদ্ধ রংমহল গল্পের লিংক
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৪
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৯
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৮
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ২১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৬
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৫