উড়ালমেঘেরভেলায়
লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক
পর্ব_১৯
[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]
এয়ার কমোডার মাহফুজুর রহমান শেখ। শেষবার তার সাথে আভিয়ানের কথা হয়েছিল গতকাল রাতে। এমন ভরদুপুরে আবারও তার কল পেয়ে যারপরনাই বিরক্ত হলো আভিয়ান। কল রিসিভ করে প্রথমে সালাম দিয়ে বললো, “জি, স্যার বলুন।”
পৌঢ় বয়সী মাহফুজুর রহমান। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে তার চাকরির বয়স দীর্ঘ পঁচিশ বছর। এই দীর্ঘ চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতায় কোনো মিশনে তিনি বাধাগ্রস্ত হননি। তবে এবার হয়েছেন। শুধুমাত্র তার টিমের একজন অফিসারের গাফিলতির জন্য। একারণেই আভিয়ানকে তিনি এই সিক্রেট মিশনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। যেকারণে আভিয়ানকে সিলেটে আসতে হয়েছে। সাথে হিয়া আর তাফসিরকেও।
“কাজটা কী হয়েছে লেফটেন্যান্ট?”
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মাহফুজুর রহমানের চিন্তিত কন্ঠস্বর শোনা গেল। আভিয়ান বুঝলো, তার অথোরিটি বিষয়টা নিয়ে খুব চিন্তিত রয়েছে। যেহেতু, বিষয়টা খুবই সেনসেটিভ। অবশ্য চিন্তিত হওয়ার-ই কথা। জিনিসগুলো অথোরিটি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই নিশ্চিন্ত হয়ে চিন্তামুক্ত থাকা যাচ্ছে না। আভিয়ান জবাব দিলো, “এখনো পর্যন্ত হয়নি স্যার। বুঝতেই পারছেন, সিক্রেট মিশনে এসেছি তা-ও আনপ্রফেশনালি। প্রফেশনালি হলে, যখন-তখন ইমিডিয়েট অ্যাকশন নেওয়া যেতো। কিন্তু, এমন সিচুয়েশনে সেটা করলে আমার কলিগদের লাইফ রিস্ক তৈরি হয়ে যাবে। আর সেটা আমি কোনোভাবেই হতে দিতে পারি না।”
মাহফুজুর রহমান বললেন, “আমি জানি, তুমি কারো লাইফ রিস্কের ওপর দিয়ে যেয়ে মিশন কমপ্লিট করবে না। উপরন্তু, আমিই তোমার লাইফ রিস্ক জেনেও তোমাকে সেখানে পাঠিয়েছি। এটুকু তো ভালোভাবেই জানি, একমাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ দক্ষভাবে এই কাজটা হ্যান্ডেল করতে পারবে না। তোমাকেই এই জটিল কাজটার জন্য ভরসা করতে পেরেছি আমরা। এজন্যই তোমাকেই মেইন লিড দিয়ে সেখানে পাঠানো। তবে আমাদের উচিত ছিল, আরো কয়েকজনকে সাথে পাঠানো। এখন ভুলটা উপলব্ধি করতে পারছি।”
আভিয়ান বাঁধা দিয়ে বললো, “নো স্যার! এটা ফিল্ড ওয়ার্ক। রিস্কও আছে প্রচুর। বেশি সমাগম হলে পরবর্তীতে প্রতিপক্ষরা আগেই আমাদের ওপরে সন্দেহ করে সতর্ক হয়ে যেতে পারে। আর আমি চাই না, সেটা হোক। তবে, এখানকার আনপ্রফেশনাল গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করেছি আপনার নির্দেশ মোতাবেক। তারা আমাকে অল ডিটেইলস জানিয়ে দিয়েছি। আজ রাতেই কাজটা করা বাকি। সন্ধ্যায় রওয়ানা হবো।”
মাহফুজুর রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তিনি জানেন, এই কাজে অনেক বড় রিস্ক। এমনকি, তার অফিসাররা ফিরে আসবে কিনা, সে বিষয়েও তিনি সন্দিহান। তবে কিছু করার নেই। আজ হয় এসপার-ওসপার কিছু একটা হয়েই যাবে। এয়ার ফোর্সের বেশকিছু সেনসেটিভ ডকুমেন্টস লিক হয়েছে। সেগুলো চুরি করে নিয়ে সিলেটে ঘাপটি মেরে আছে আততায়ীরা। এয়ার ফোর্সের বাইরে এখনো এই দুর্ঘটনার খবর লিক হয়নি। বরং, অথোরিটি-ই বোর্ড মিটিং ডেকে শলাপরামর্শ করে লিক হতে দেয়নি। তারা পরিকল্পনা করেছিল, তাদের হাতেগোনা কয়েকজন বিশ্বস্ত অফিসারকে পাঠিয়ে ডকুমেন্টস গুলো ফেরত আনার ব্যবস্থা করবে যেভাবেই হোক। তবে, বেশি লোকও তারা পাঠায়নি এই কাজের জন্য। বেশি লোক মানেই নিউজ লিক হওয়ার সম্ভবনা বেশি। মাহফুজুর রহমান মিয়মান স্বরে বললেন, “বেস্ট অফ লাক লেফটেন্যান্ট। নিজেদের খেয়াল রেখো। আমরা আমাদের চৌকস অফিসারদের হারাতে চাই না। তোমাদের মতো অফিসার সহস্র বছরে একবার জন্ম নেয়। আই হোপ, তোমরা কাজটা করে অক্ষতভাবে ফিরে আসতে পারবে।”
“ইন শা আল্লাহ, স্যার।”
আভিয়ান নিজেও ভালোভাবেই জানে, এবারের মিশনে সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে লাইফ রিস্ক, নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট। বেঁচে থাকার সম্ভববা শুধুমাত্র অন পার্সেন্ট। তবু আভিয়ানের দৃঢ়তা সামান্য একফোঁটাও ভাঙেনি। আত্মবিশ্বাস কমে যায়নি। তবে একবার পরিবার, রানিয়ার চেহারা ভেসে উঠে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আভিয়ান কমোডার স্যারের সাথে কথা বলা শেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করে গ্রুপে টেক্সট করে রাখলো— “বি রেডি গাইস।”
.
.
দুপুরের খাবার খাওয়ার পরপরই রানিয়াকে তৈরি হয়ে থাকতে বলেছে আভিয়ান। রানিয়া ভেবেছিল, আভিয়ান হয়তো নিছক মজা করছে৷ কিন্তু এই লোক তো দেখি অনেক বেশি সিরিয়াস৷ জেদ যখন ধরেছে, রানিয়াকে হসপিটালে নিয়ে যাবে; তার মানে নিয়ে যাবেই। রানিয়া তৈরিই ছিলো। ইদানীং ও ঢিলেঢালা গাউন পরা শুরু করেছে। এসব পোশাক পরলে পেট হালকা বড় হলেও বোঝা যাবে না। যদিও এখনো তেমনভাবে বোঝা যাচ্ছে না। তবু ও সেফটির জন্যই পরা শুরু করেছে। আভিয়ান বাইরে থেকে তাড়া দিচ্ছিলো। রানিয়া অসুস্থ বলে বাজারের মোড় থেকে একজন রিকশাওয়ালা মামাকে ডেকে এনেছে মামাতো ভাইকে পাঠিয়ে। সাধারণত, এই গ্রামাঞ্চলে রিকশা পাওয়া যায় হাতেগোনা দু-একটা। তারওপর রিকশাওয়ালা মামা কতক্ষণ যাবত তাড়া দিচ্ছেন দ্রুত আসার জন্য। রানিয়া মাথায় ওড়নাটা ভালোভাবে টেনে দিয়েই পার্স আর ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে দৌড়ে বের হলো কাঠের দোতলা থেকে।
আভিয়ান ওকে আসতে দেখে সামনে হাঁটা দিলো। তাফসির আর হিয়া ভেতরে আভিয়ানের মায়ের সাথে ছিল। যাওয়ার সময়ে ওদেরকে ডেকে নিয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে কি যেন বললো আভিয়ান। রানিয়া দূরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে ঠিকমতো শুনতে পেল না।
.
.
রাধানগরের পাশেই একটি নামকরা হাসপাতাল। যানবাহনে যেতে প্রায় আধা ঘণ্টার মতো সময় লাগে। রিকশা রাধানগর পেরিয়ে সেদিকেই যাচ্ছে। এখনো পঁচিশ মিনিটের মতো লাগবে। রানিয়া চুপচাপ বসে ছিল রিকশায়। কি করবে বুঝতে না পেরে অনবরত হাত কচলাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে আড়চোখে আভিয়ানকে দেখছে ও। লোকটাকে দেখে কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে। ঠোঁট চেপে কি যেন ভাবছে। কোনোকিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে নাকি? কপালে পরপর দু’টো ভাঁজ পরেছে সুক্ষ্মভাবে। রানিয়া অনেকক্ষণ যাবত-ই খেয়াল করছে৷ তবে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছে না। তখনই নিরবতা ভেঙে আভিয়ান-ই বলে উঠলো, “তোমার সাথে কিছু কথা ছিল রানিয়া, বলবো?”
রানিয়া দ্বিধান্বিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো— “এখন?”
“হ্যাঁ, এখনই। হাতে সময় খুব কম। তাই এখনই বলতে হবে।”
রানিয়া ভ্রু কুঁচকে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো, “হাতে সময় খুব কম মানে? বুঝিনি।”
“বুঝতে হবে না। তেমন কিছু নয়। যেই কথা বলছিলাম—”
আভিয়ান কথা ঘুরিয়ে ফেললেও রানিয়া ঠিকই বুঝতে পারলো, এমন কিছু আছে; যা নিয়ে আভিয়ান খুব বেশি চিন্তিত এবং রানিয়াকে বলতেও চাইছে না। রানিয়া একবার ভাবলো জোরাজুরি করবে। পরে আবার ভেবে দেখলো, জোরাজুরি করে বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হয় না। আভিয়ান জোর মেনে নেওয়ার মতো ছেলে নয়। সুতরাং, রানিয়া চুপ-ই থাকলো। আভিয়ান বলতে লাগলো, “তো তোমাকে আমি কিছু কথা বলতে চাচ্ছি এই মুহুর্তে। বলি?”
“জি বলুন।”
রানিয়ার মনে মনে শঙ্কা হলো। আভিয়ানের কি আবার মত ঘুরে গেল? ডিভোর্সের কথা বলবে নাকি? রানিয়ার ভাবনাকে থামিয়ে দিয়ে আভিয়ান বলতে লাগলো, “জানো রানিয়া, তোমার সাথে ওইদিন রাতটা আমি কেন কাটিয়েছিলাম?”
“কেন?”
“তোমাকে নিজের প্রতি দুর্বল করার জন্য।”
“জি?”
আভিয়ানের সহজ স্বীকারোক্তি।
রানিয়া যেন ঠিক বুঝেও বুঝে উঠতে পারলো না। বিস্মিত নয়নে আভিয়ানের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। আভিয়ান একদম স্বাভাবিক। সামনের পিচ ঢালা স্বচ্ছ পথের দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলো, “শুরু থেকেই ডিভোর্সের কথা তুমি বলে গিয়েছো রানিয়া। আমি তোমাকে শুরুতে ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছো, থামানোর জন্য অনেককিছু বলেছি। কিন্তু তুমি দিন দিন ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছিলে৷ কেন, তা আমার জানার বাইরে৷ তবে তোমাকে থামানো খুব জরুরি ছিল। এজন্যই আমি পেন্ডিংয়ে থাকা ছুটি নিয়ে হঠাৎই ঢাকায় এসেছিলাম তোমার সাথে দেখা করতে। কিন্তু তোমার বেপরোয়া আচার-আচরণ আমাকে রাগিয়ে দিলো। রাগের চাইতেও বেশি, আমার মনের মধ্যে একটা বাজে আশংকা তৈরি করলো। সেটা থেকেই আমার জেদ বাড়লো। তোমাকে নিজের করে রাখার জেদ। আমি মানুষের সাইকোলজি ভালো বুঝি। স্পেশালি, তোমার। এজন্যই একথাও ভালোভাবে বুঝেছিলাম, কিভাবে তোমাকে আটকানো যায়। তাই ওই রাতে. . . যাইহোক, এরপর সকালে তোমাকে ডিভোর্সের কথাও বলেছিলাম। কেন জানো?”
“কেন?”
রানিয়া এতোক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে আভিয়ানের কথাগুলো শুনছিল। এবারও সেভাবেই প্রশ্নটা করলো। আভিয়ান এবার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে জবাব দিলো, “যাতে তুমি বুঝতে পারো, বিনা কারণে বারবার ডিভোর্সের কথা তুলে একটা সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইলে বিপরীত পাশের মানুষটার কেমন লাগে। অ্যান্ড আই হোপ, আমি তোমাকে বোঝাতে পেরেছি।”
রানিয়া ছলছল চোখে আভিয়ানের দিকে তাকালো এবার। আভিয়ানকে প্রশ্ন করলো— “তারমানে আপনি আমাকে কখনোই ডিভোর্স দিতেন না?”
“নাহ।”
আভিয়ান এককথায় জবাব দিলো। রানিয়া ওর হাতের বাহুতে একটা জোরসে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে বললো, “তাহলে ডিভোর্সের কথা বলেছিলেন কেন?”
“ডিভোর্সের কথা শুরুতে তুমি তুলেছিলে৷ মানুষ যে হাসবেন্ডের কাছ থেকে দূরে থেকে এতোটা ডেস্পারেট হতে পারে, সেটা তোমাকে না দেখলে বুঝতাম না৷ তোমার পাখনা গজিয়েছিল, সেটা কেটে ফেলা জরুরি ছিল। নাহলে অ্যাক্সিডেন্টাল কিছু ঘটে যেতে পারতো। তুমি যেভাবে আমাকে আঘাত করেছিলে ডিভোর্সের কথা বলে, আমিও সেভাবেই তোমাকে সেই আঘাতের জাস্ট অন পার্সেন্ট ফিরিয়ে দিয়েছিলাম৷ এর বেশি কিছু না।”
“তাহলে সেদিন রাতে কেন কাছে আসলেন?”
“তোমাকে দুর্বল করার জন্য।”
“কিন্তু কেন?”
“হারিয়ে ফেলার ভয়ে।”
“কাকে?”
“তোমাকে। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে দুর্বল করেছিলাম। যাতে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আর কখনো মাথায়ও না আনো।”
“আপনার কেন আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে?”
“কারণ তোমাকে ভালোবাসি ড্যাম ইট! ভালোবেসে ফেঁসে গিয়েছি, এখন আর সরে আসার তো কোনো উপায় নেই, তাই। আমার মাথা খারাপ করে ছেড়েছো তুমি!”
আভিয়ান দাঁতে দাঁত পিষে কথাটা বলতেই রানিয়ার চোখ থেকে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পরলো। আভিয়ান ভালোবাসে! ওকে! এই কথাটা যেন স্বপ্নের মতো। এতোদিন কি এই কথাটা শোনার জন্যই রানিয়া চাতক পাখির মতো অপেক্ষমান ছিল? বোধহয়! একারণেই কথাটা শোনামাত্র চোখের কোল বেয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পরলো৷ তবে ওর মনে হঠাৎ একটা প্রশ্ন উদীয়মান হলো। ও আভিয়ানের মুখ টেনে ধরে পাশ ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “ভালোবাসেন? কবে থেকে?”
আভিয়ান ওর চোখে চোখ রেখে বললো, “জানিনা রানিয়া। সত্যিই জানিনা। শুধু জানি, তোমাকে আমি ভালোবাসি। তিন কবুল বলার পরে লাইফ পার্টনারের প্রতি যেই অনুভূতির সৃষ্টি হয়, সেটাকেই ভালোবাসা বলে। হয় তখন থেকে, নাহয় তারও আগে থেকে। কারণ, যেই আমার কখনো বিয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল না; সেই আমি পরিবারের কাছ থেকে তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পেয়েও নাকচ করিনি। হ্যাঁ হয়তো কাজের প্রয়োজনে তোমার থেকে দূরে ছিলাম। তবে তোমার খোঁজ-খবর প্রতিটা মুহূর্তেই আমার কানে আসতো। তোমার মন-মস্তিষ্ক দূর থেকেই পড়তে পারতাম। এজন্যই তো তোমার মনে আমার যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেটা উপলব্ধি করেই ইমিডিয়েটলি চট্টগ্রাম থেকে চলে গিয়েছিলাম ঢাকায়।”
রানিয়া স্তব্ধ। আপাতত ও বাকহারা। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। আভিয়ান ওকে শান্ত করলো। বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, “আই লাভ ইউ সুইটহার্ট। রিকশাওয়ালা মামা না থাকলে আরো কিছু বলতাম।”
কথাটা বলে আভিয়ান রানিয়ার কপালে একটা চুমু খেল। রানিয়া লজ্জায় সিটকে গেল আভিয়ানেের বুকের ভেতরে। ওর এবার সত্যিই মনে হলো, আভিয়ানকে বাচ্চার কথা জানিয়ে দেওয়া উচিত। তবে আবার মনে পরলো, এখন তো হসপিটালে যাচ্ছেই। সেখানে ইচ্ছা করেই রানিয়া চেকআপ করাবে। এতোদিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলেও এখন আর চেক-আপ করাতে ওর কোনো অসুবিধা নেই। চেক-আপ করালে তো এমনিই জানা যাবে। আভিয়ানও জানতে পারবে তখন। তখনই সারপ্রাইজটা পেয়ে যাবে ও। রানিয়া একথা মনে করে চুপ করে রইলো। তবে আসন্ন খুশির জন্য মনে মনে উত্তেজিত হলো খুব। আভিয়ান খবরটা শুনলে কি রিয়্যাকশন দেবে — সেটা কল্পনা করে নিলো।
.
.
হসপিটালের করিডোরে বসে আছে আভিয়ান। রানিয়া কেবিনের ভেতরে আছে। আভিয়ান মূলত এখানে এসেছেই রানিয়ার অধিকাংশ সময় শরীর দুর্বল থাকে— এই বিষয় নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য। সামনে বিয়ের অনুষ্ঠান। তখন যদি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে রানিয়া! এই ভয় থেকেই এখানে আসা।
তবে ডাক্তার ম্যাডাম রানিয়াকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেলেছেন। তিনি মূলত গাইনী ডাক্তার-ই। তিনি আভিয়ানকে বলে ভেতরে রানিয়াকে চেকআপ করাতে নিয়ে গিয়েছেন। আভিয়ান নানান বিষয় নিয়ে চিন্তিত। একদিকে মিশন ইনকমপ্লিট, অপরদিকে রানিয়ার অসুস্থতা। এসব নিয়েই বসে থেকে ভাবছিল ও। তখনই কেবিনের দরজা খুলে গেল। আভিয়ান ডাক্তারকে বের হতে দেখে উঠে দাঁড়ালো। ডাক্তারের মুখে মৃদু হাসি দেখে কিছুই বুঝতে পারলো না ও। ডাক্তার ওকে ইশারা করে বললেন, “আপনি একটু ভেতরে আসুন প্লিজ।”
আভিয়ান তার সাথে ভেতরে যেতেই রানিয়ার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে ডাক্তার বললেন, “আপনারা এতোদিনেও বুঝতে পারেননি?”
আভিয়ান উদ্বিগ্ন স্বরে পাল্টা বললো, “কী বুঝতে পারিনি? আমার ওয়াইফের কী হয়েছে ডাক্তার? সিরিয়াস কিছু?”
“না না। সিরিয়াস কিছু নয়। আপনি বিচলিত হবেন না।”
“তাহলে?”
ডাক্তার মৃদু হেঁসে বললেন,
“কংগ্রাচুলেশনস! আপনি বাবা হতে চলেছেন!”
আভিয়ান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কথাটা শোনামাত্র। তারপর হঠাৎ ডাক্তারকে পাশ কাটিয়ে বেডে রানিয়ার কাছে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো, “আ—আমি বাবা হতে চলেছি?”
“জি।”
আভিয়ানকে ডাক্তার আবারও নিশ্চিন্ত করলেন। আভিয়ান রানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ঠোঁট চেপে। চোখে-মুখে খুশির ঝলক। খুশিতে কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। ডাক্তার বাইরে চলে যেতেই রানিয়াকে টেনে জড়িয়ে ধরলো আভিয়ান। ওর সমস্ত মুখে চুমু খেতে লাগলো অজস্র। চুমু খেতে খেতে বললো, “আমাদের বেবি আসছে রানিয়া। শুনেছো তুমি!”
রানিয়া স্বাভাবিক গলায় বললো, “আগে থেকেই জানতাম আমি।”
আভিয়ান হঠাৎ চুমু থামালো৷ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ভ্রু কুঁচকে রানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি আগে থেকে জানতে মানে? আমাকে আগে বলোনি কেন?”
আভিয়ানের এমন প্রশ্নে ভয় পেল রানিয়া। আফসোস হলো, আভিয়ানকে একথা বলার জন্য যে, ও আগে থেকেই জানে। রানিয়া অপ্রস্তুত হয়ে কোনো জবাব দেবে, তার আগেই আভিয়ানের ফোনের রিং বেজে উঠলো। আভিয়ান ফোন বের করে কল রিসিভ করে কানে নিতেই ফোনের ওপাশ থেকে তাফসিরের কন্ঠস্বর শোনা গেল, “স্যার, আপনাকে ইমিডিয়েট আসতে হচ্ছে। গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি, ওরা শহর ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করছে। আজ ধরতে না পারলে আর কখনো ডকুমেন্টস আমাদের হাতে আসবে না স্যার। ইমিডিয়েট আসুন আপনি!”
তাফসিরের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর শুনে আভিয়ান শান্ত স্বরে বললো, “আ’ম কামিং সুন। ওয়েপনগুলো নিয়ে বেরিয়ে পরো। আর আমার আম্মাকে হসপিটালে পাঠিয়ে দাও। বলো, তার বৌমা এখানে আছে। ওকে যেন এসে নিয়ে যান।”
“ওকে স্যার।”
আভিয়ান কল কেটে দিয়ে পিছু ফিরলো। রানিয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। আচনক ওর পেটের কাছে মুখ এগিয়ে পেটের মাঝ বরাবর একটা চুমু খেয়ে বললো, “সোনা আমার, তোমার পাপা একটা হাই-রিস্ক মিশনে যাচ্ছে। বেঁচে থাকলে ইন শা আল্লাহ তোমার সাথে আবারও দেখা হবে শীঘ্রই। আর যদি না হয়. . .”
আভিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বললো, “এখন আমি আসি সোনা বাচ্চা আমার। আল্লাহ হাফেজ।”
আভিয়ান খুব আদর মাখা গলায় কথাগুলো বলে রানিয়াকে একবার তীক্ষ্ণ নজরে কটমট চোখে দেখে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে নার্সদের বলে গেল, ওকে দেখে রাখতে। কিছুক্ষণ বাদেই তার আম্মা এসে ওকে নিয়ে যাবের। রানিয়া কয়েকবার পেছন থেকে চেঁচিয়ে আভিয়ানকে ডাকলো। তবুও আভিয়ান একবারের জন্যও পিছু ফিরে তাকালো না৷ রানিয়া ছলছল চোখে আভিয়ানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো। এতোটুকু তো ও বুঝেই গেছে, আভিয়ান কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাচ্ছে। যেখান থেকে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। রানিয়া পেটে হাত রেখে শঙ্কিত হলো। ওর চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে এলো ক্রমশ। তবে কি ওর বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই এতিম হয়ে যাবে!
চলবে চলবে
🔹 ইয়াহু! ফাইনালি অসুস্থতা নিয়েও একটা বড় পর্ব লিখতে সক্ষম হলাম। সবাই এবার বেশি বেশি ভালোবাসুন তো আমাকে!
Share On:
TAGS: উড়াল মেঘের ভেলায়, ঝিলিক মল্লিক
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৯
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৫
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৮
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৭
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৭
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৪
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৮