প্রেমতৃষা
ইশরাতজাহানজেরিন
পর্ব_৪৬ (১ম অর্ধেক)
আদিত্য শাখাওয়াতের পাকস্থলী যেন গলাধঃকরণ করা বিষাক্ত পিত্ত ছুড়ে ফেলার জন্য অধীর হয়ে উঠল। শিরা–উপশিরা পর্যন্ত কেঁপে উঠছে তার, রক্তে বরফ জমে কঠিন হয়ে গেছে। বাতাসে এমন এক বিকট, পচনশীল মৃতদেহের গন্ধ, যা মানুষের নাসারন্ধ্র ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, নরকেও হয়তো এমন বিষাক্ত গন্ধের উদ্ভব হয়নি। এখানে টিকে থাকা মানে বমির আঁশটে ধোঁয়ায় আত্মা দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুর দিকে ধীরগতিতে হাঁটা। কিন্তু সবচেয়ে শিউরে ওঠার মতো প্রশ্নএই মেয়েলি মৃতদেহটি কার? মৃতদেহ কি আদৌ মৃত্যুর পর বিশ্রাম পেয়েছে? নাকি নিষ্ঠুর কোনও বিকৃত মস্তিষ্ক তাকে অকথ্য নিষ্ঠুরতায় ‘বাঁচিয়ে রাখার’ চেষ্টা চালিয়েছে? এই ভগ্নদেহ হয়তো অন্ত বছর খানেক আগে নিঃশ্বাসবিহীন হয়েছে। তা সত্ত্বেও কত্তো কৌশলে তাকে আবার জীবিতের ছদ্মবেশে হাজির করার নরপিশাচি পরীক্ষা চালানো হয়েছে! দেহটি অর্ধকঙ্কাল, আর বাকি অংশ অনেকখানি আলগা চামড়ার টুকরো দিয়ে কদর্যভাবে জোড়া লাগানো। প্রতিটি চামড়ার রঙ ভিন্ন, কখনো অতল অন্ধকারের মতো কালো, কখনো হিমের মতো বিবর্ণ সাদা। মৃত্যুদূতের কর্মশালার নমুনা! দেহের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রোপচারের সেলাইয়ের দাগ, যা দেখে মনে হচ্ছে কসাইখানার দক্ষ কসাইও বোধহয় লজ্জায় মাথা নত করত। মাথার একাংশে চুল, আর বাকি অংশ হাড়ের শুষ্ক রূপ। একটি ভয়ঙ্কর পরিত্যক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের মতো। সেই চুলও এক মানুষের মাথার নয়। বহু মানুষের মাথা থেকে ছেঁড়া চুল জোড়া লাগিয়ে মিথ্যা পরিচয় গঠন করা হয়েছে। চোখের কোটরশূন্য ভয়াল গহ্বর, ঠোঁটে অমানবিক বিকৃতি। উপরের ঠোঁট অন্য কারও, নিচের ঠোঁট অন্য কারও দেহ থেকে ছেঁড়া। আর দুর্গন্ধ! এমন গন্ধ যা শুধু নোংরা নয়, বরং শয়তানের প্রলয়-শ্বাসের মতো হাড়ে প্রবেশ করে আত্মাকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
আদিত্য আর দেরি না করে বাইরে চলে এলো। প্রেম এখনো ভেতরে আছে। এত আগ্রহ নিয়ে ওই লাশটাকে দেখছে। বিশেষ করে লাশের গলায় ঝুলতে থালা একটা লাল রঙের হিরার নেকলেসের দিকে। হঠাৎ আহাদ এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। একবার লাশের দিকে তাকিয়ে অন্যবার প্রেমের দিকে তাকায়। অতঃপর বলে, “স্যার আপনাকে ডেকেছে। থানা থেকে কল এসেছে। প্রত্যুষ দেওয়ান স্বয়ং আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। এমনিতেও উত্তর সব তার কাছে। যেতে তো হবেই। তাই যেহেতু সে ডেকেছে তাই বোধ করি দেরি করা ঠিক হবে না। আদিত্য স্যার বাইরে আছে। আপনি আসুন।”
প্রেম আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে রুম থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। আহাদ পুনরায় একবার লাশের দিকে তাকায়। তারপর লোকেদের বলে, “লাশটা টেস্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। কার লাশ জানতে হবে। সাইকোর মুখের বয়ান যথেষ্ট নয়। আর তাছাড়া এই রুমে আরো ভালো করে তালাশি করো। একটা ক্লু যাতে হাত ছাড়া না হয়। আর অবশ্যই এই রুমের আশপাশে যেন কোনো আউট পার্সোন এলাউ না হয়।” আহাদ কথাগুলো বলে আর অপেক্ষা করল না। জলদি বাইরে চলে গেল। বাইরে স্যার দাঁড়িয়ে আছে। লোকাল থাকায় অনেক কাজ। শালার পুলিশ যদি নিজেদের কাজ একটু ভালো মতো করত, তবে এত নগন্য একটা বিষয়ে ইন্টেলিজেন্স অফিসারের টিমকে আসতে হতো? সবে মাত্র বিয়েটা হলো। হানিমুন টা আঁটকে দিলো এই সরকারি চাকরি। গজব পরবে সব কটার ওপর!
হলুদ বাল্বের ঝিমিয়ে পড়া আলোর নিচে বসে আছে প্রত্যুষ। তার সামনের চেয়ারে প্রেম আর আদিত্য বসে আছে। প্রত্যুষকে পরপর অনেক গুলো প্রশ্ন ছোঁড়া হয়েছে। দেখা যাক, গল্প তার বানোয়াট হয় নাকি বাস্তব। প্রেম হাতের ফোনটা রেখে প্রত্যুষকে বলে, “এবার বল ভাই তিথি কোথায়?”
প্রত্যুষ হেসে বলল, “আমি জানতাম উত্তর জানার জন্য আমার কাছেই ঘুরে ফিরে আসতে হতো। আমি অপেক্ষা তেই ছিলাম। তাহলে আর না ঘুরাই, সব যেহেতু জানাজানি হয়েই গেছে তবে বাকিটা কেন অজানা রইবে? তিথি আমার সঙ্গে ছলনা করেছে, তবুও আমি তাকে মাফ করে দিয়েছি। সে স্বামীর কাছ থেকে আমার কাছে চলে এসেছিল। জানিস, ওর বিয়ের পর ওর কাছে গিয়েছিলাম একবার। তারপর জানতে পেলাম তার বাবা-মা নাকি তাকে জোর করে ওই লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। ভয়ে সে আমাকে বলতে পারেনি৷ তিথিকে তখন বললাম আমার কাছে চলে আসতে। সে প্রথমে রাজি হলো না। তারপর একদিন আবদার করল মানুষের মাংসের বিরিয়ানি খাওয়ার। সেই থেকে আমি খুন করতে থাকি..” বলেই একগাল হাসল প্রত্যুষ। প্রেমের এসব শুনে রাগ হচ্ছে। এসব তো সেই আগের কথাই। এক কথা বারবার শুনতেও বিরক্ত লাগে। প্রেম টেবিলের ওপর আঘাত করে উঠে গেল। প্রেম তেজি গলায় প্রত্যুষকে বলল, “বাল তোমার জন্য আমার বউয়ের সঙ্গে বিক্রিয়া হতে পারছে না। আমার হানিমুনকে তুমি একেবারে বালমুন মানিয়ে দিয়েছো।”
“এত বিক্রিয়া করে হবে?”
” বংশবিস্তার বুঝো না চুদিরভাই।”
আদিত্য টেনেটুনে প্রেমকে বাইরে নিয়ে এলো। প্রেমের রাগ হচ্ছে। প্রচন্ড রাগ হলে, তার আবার বউকে প্রচন্ড আদর করতে ইচ্ছে করে। এই আচ্ছা মুসিবতে ফেঁসেছে সে, নইলে বউয়ের সঙ্গে ইতিপূর্বে দফায় দফায় বিক্রিয়া শেষ করল। ধ্যাৎ হাসপাতালে চলে যাবে নাকি? বউ তো তার অসুস্থ? কিন্তু প্রেম যে আর অপেক্ষাও করতে পারছে না, শরীরের শিরা গুলো কামড়ে ধরছে। উঁহু বউকেই লাগবে, যে করেই হোক। প্রেম আদিত্যকে বলল, “এখানকার কার্যক্রম আপনি সমালান আমি প্রোডাক্ট আবিষ্কারের কাজটা সেরে আসি ভাই।”
“মানে? বিজ্ঞানী নাকি?”
“তো কি মনে হয়? প্রতিটি পুরুষ মানুষই এক একজন বিজ্ঞানী। তারা না থাকলে এত এত আবিষ্কার হতো না, আর এত এত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতো না। যাই আমি বিজ্ঞানীটা আপাতত, একটা হেব্বি জিনিস আবিষ্কার করে বংশ বজায় রেখে আসি।”
” পুরুষ বিজ্ঞানী হলে নারী কি?”
” গবেষণার সময় যে ইঁদুর ব্যবহার করা হয় না? ওইটাই হলো নারী। আমরা আবিষ্কারকগণ পরিশ্রম করি, ওদের মাধ্যমে ফলাফল আসে।”
আদিত্যের মাথায় প্রেমের কোনো কথাই ঢুকল না। প্রেম অপেক্ষা না করে লেদারের জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে হাতের সিগারেটে শেষ টানটা বসিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলি ছেড়ে দিলো বাতাসে। তারপর হ্যালমেট মাথায় পড়ে বাইকে উঠে যায়। আসছে শীত, এমন আবহাওয়ায় বউয়ের মতো হিটার থাকতে থানায় এক আধপাগলের সঙ্গে থানায় বসে থাকা প্রেম নেওয়াজের পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়।
প্রেম হাসপাতালের কেবিন রুমে পা টিপে প্রবেশ করে। বাইরে অংকুর দাঁড়িয়ে ছিল। শিমলা ভেতরে। অংকুরকে দিয়ে শিমলাকে কেবিন থেকে বের করে বলল, “মেলা ধন্যবাদ বউটাকে টেক কেয়ার করার জন্য। যাও বাবা অংকুর রাত হয়েছে বাড়ি গিয়ে ফরজ কাজ সেরে আসো।”
অংকুর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “মানে?”
“ভেতরে আসো জানেমান, তোমার সঙ্গে ছয়-নয় খেলে মানে বুঝাচ্ছি।”
“শালার ভাই ভালো হয়ে যাও।”
“খারাপ ছিলাম কবে রে? হে শালা এখন কেটে পড়ো দেখি।”
অংকুর, শিমলাকে নিয়ে চলে যেতেই প্রেম রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। বাতি বন্ধ। তৃষা ঘুমাচ্ছে? এ বাবা ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে নাকি? ইচিং বিচিং তিচিং চা করার সময় তৃষা ছটফট না করলে তো ফিল আসবে না, মনে হবে লাশের সঙ্গে আসতাগফিরুল্লাহ করা হচ্ছে। প্রেম ফোনের ক্রিন অন করে তৃষার পাশ দিয়ে বসতেই তৃষার ঘুম হালকা হয়ে যায়। তৃষা তার দিকে তাকাতেই প্রেম বলে উঠল, ” শব্দ করো না সোনা।”
“আপনি এখানে?”
“এখন এখানে একটু পর সর্বাঙ্গে বিচরণ করব।”
“মানে?”
প্রেম তৃষার গালে চুমু দিয়ে বলল,” শরীরে ব্যথা আছে?খুব ব্যথা হচ্ছে?”
” আগের তুলনায় কম।”
“তাহলে তৈরি হও ব্যথা আরেকটু বাড়িয়ে দেব।”
“তৃষা কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম তার ঠোঁটে চুমু বসিয়ে দেয়। বিছানায় তৃষাকে ঠেলে নিজের জায়গা দখল করে চটজলদি তৃষার উপরে ঝুঁকে বলল, ” ভুলেও শব্দ করিস না কিন্তু বিটারহার্ট।”
” একশোবার করব। এটা হাসপাতাল আপনার বাসরঘর না। লুচ্চামির একটা লিমিট আছে।”
“ওই লিমিটের আমি পেছন মারি। আর একটা কথা বললে, এমন পানিশমেন্ট দেব শেষে ডাক্তার এসে অপারেশন করতে হবে।”
“প্রেম থামুন বলছি। দূরে সরেন।”
“হিশশশশ সোনা, ডোন্ট সে স্টপ, অনলি সে স্টার্ট, এন্ড কন্টিনিউ।”
তৃষা আর কোনো কথা বলার সুযোগই পেলো না। বলবে কি করে? এই লোক সেই অবস্থায় দেখেছে? বউ মরে যাচ্ছে অসুখে, আর সে মরে যাচ্ছে বউকে কাছে পাওয়ার অসুখে। ছ্যাহ ফকিরা কাজকারবার!
চলবে?
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১১+১২
-
প্রেমতৃষা গল্পের লিংক
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৭+৩৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৫+২৬
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪১
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪৩
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৩+১৪
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২১+২২
-
প্রেমতৃষা সারপ্রাইজ পর্ব