Golpo romantic golpo অন্তরালে আগুন

অন্তরালে আগুন পর্ব ৩১


অন্তরালে_আগুন

পর্ব:৩১

তানিশা সুলতানা

সিফাতের কাছে খবর এসেছে নদীর ওপার কোন একটা যায়গায় অনেকগুলো অবৈধ অস্ত্র মদ গাঁজাসহ আরো নেশা দ্রব্য জিনিস রয়েছে। সেই মিশনে সাথে চারজন পুলিশ নিয়ে চলে যায় নদীর ওপার। সেই বাড়ি খানা খুঁজতে খুঁজতে চলে যায় দৌলতদিয়া। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। কিছু একটা রয়েছে এখানে। মনে হচ্ছে সন্ধান পেয়ে যাবে।
বাকি পুলিশদের পেছনে ফেলে সিফাত এগিয়ে যেতে থাকে পতিতালয় নামক সেই ছোট শহরে। পিছন থেকে একটা লোক বলে ওঠে
“আজকাল পুলিশরাও কি ব* খুঁজে বেড়ায় নাকি?

কানে ঢুকলেও পাত্তা দেয় না সিফাত। সে টিনের ছোট গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তে চেনা একটা পারফিউমের ঘ্রাণ নাকি লাগে। কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে আনু রয়েছে।
মেয়েটাকে সে ভালোবাসে। অনেক বছর ধরে। ওয়ান সাইড লাভ। তবুও তার প্রতি মায়া একটুও কমে নি। বলা বহুল্য অনেকটা দূর থেকেও সিফাত আনুর উপস্থিতি টের পায়। বুঝতে পারে তার অস্তিত্ব। এ যেমন এখনো বুঝতে পারছে।
সে চিৎকার করে ডেকে ওঠে
“আনু তুমি কোথায়
দেখো আমি এসেছি

নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে বুড়ো একটা লোকের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিল আনু। তার বিনিময়ে ১০ হাজার টাকা পাবে। এখন ওর কাছে টাকা’টাই সব। মানুষের চেহারা কিংবা বয়স দেখার সময় নেই। অবশ্য একটা পতিতালয়ের বেশ্যার এসব ভাবাও চলে না।
সিফাতের ডাক সে শুনতে পায়। ইচ্ছে করে ছুটে চলে যেতে সিফাতের কাছে। তার হাতটা ধরে বলতে

” আমাকে মুক্তি দিন এই অন্ধকার কুটির থেকে।। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচান।।

দুফোঁটা অশ্রু’কণা গড়িয়ে পড়ে আনুর চোখের কর্নিশ বেয়ে। বুড়ো লোকটা কি বুঝলো কে জানে। সে অনুকে ছেড়ে দেয়।
ফ্লোরে পড়ে থাকা শার্টটা খুঁজে নিজের গায়ে চাপাতে চাপাতে বলে
“চলে যাচ্ছো না কেন ওখান থেকে?
টাকার লোভ ছেড়ে ভালো ভাবেও তো বাঁচা যায়।

আনু প্রতিত্তোরে শুধু একটু তাচ্ছিল্য হাসে। পর পুরুষদের ছোঁয়া লাগতে লাগতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে তার শরীরটা। সেই অপবিত্র গা থাকতে জামাখানা পড়ে নেয়।
লম্বা চুলগুলো হাত খোপা করতে করতে ঘরের দরজা খুলে দেয়।
সিফাত তখনও দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলো মেয়ে নিজেদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছে। কেউ কেউ সিফাতের হাত ধরে টানছে তাদের কক্ষ ঢোকার জন্য। বৃষ্টি আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। সে চেনে এই মানুষটাকে। এই অন্ধকারে আসার আগে কতবার দেখেছে তাকে। তবে আজকে সামনে যেতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে।
বুড়ো লোকটার পেছন পেছন আনুও আসে। সিফাতে চোখ দুটো টলমল করছে। বোধহয় যখন তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠবে সে। তবে আনু স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি।
সে নিজের ডান হাত বাড়িয়ে সিফাতের ডান গালে রাখে।

“আমার হলে না কেনো আনু? আমার একটু ভালবাসতে না কেনো?
তোমার আমার দুজনের জীবনটাই তো অন্যরকম হতো। আমরাও খুব ভালো থাকতে পারতাম।

আনু ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে
“আপনাকে ভালবাসতে যে ভালো থাকতে পারতাম। এই পৃথিবীর সব সুখ আমার হতো। সুখ সইতে না পেরে অকালেই মরে যেতাম। এত সুন্দর দুনিয়া ছেড়ে এত পাষাণ পাষাণ মানুষদের ছেড়ে এত দ্রুত কবরে যায় কি করে? তাই ভালোবাসলাম না।

বলতে বলতে আনুর চোখ দুটো টলমল করে ওঠে। ইচ্ছে করে সিফাতের বুকে মাথা রেখে চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলতে
“আমার এই আফসোস আ-জীবনে মিটবে না। কেন ভালোবাসলাম না আপনাকে? কেন একটা ভুল মানুষের সঙ্গে জীবন জড়ালাম? কেনই বা তাকে দু দু বার বিশ্বাস করে এই নরকের জীবন বেছে নিলাম?

সিফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করে। তারপর অনুর হাতখানা মুঠো করে ধরে বলে
“চলো। তোমাকে আমি নিয়ে যাব।

“বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। আমি অপেক্ষায় ছিলাম। বিশ্বাস ছিলো আপনি আর নুপুর আসবেন। কিন্তু আপনারা আসলেন না। দেখুন! ওই গেটের দিকে তাকিয়ে থাকতাম প্রতিদিন। কত পুরুষ আসতো কিন্তু আপনি আসতেন না।
আপনি জানেন আমি দুইদিন কিছু খাইনি। সারাক্ষণ শুধু ভেবে গেছি কি করে এখান থেকে বেরোতে পারবো। কখন আপনারা এসে আমায় নিয়ে যাবেন।
কিন্তু কিছুই হলো না। মুক্তি পেলাম না আমি।
এখন আর মুক্তি চাই না। এটাই আমার জীবন। আমাকে এখানেই থাকতে হবে।
যদি কখনো মরে যাই খবর পেলে একটু দেখতে আসিয়েন আমায়। মাথায় হাত বুলিয়ে ভালোবেসে একটু কাঁদিয়েন।

“আমার সাথে যাবে না তুমি?

“কি করে যাব? সমাজের চোখে আমি একজন ব*। এ সমাজ আমায় গ্রহণ করবে না।

“তোমাকে বিয়ে করব আমি আনু। থাকবো না এ সমাজে। অনেক দূরে চলে যাবো। যেখানে আমাদের কেউ চিনবে না।

“কিভাবে বিশ্বাস করব আপনাকে? আপনিও যদি আবিরের মত আমায় ঠকিয়ে দেন।

“কি করে ঠকাবো? যেখানে তোমার এক ফোঁটা চোখের পানি আমার রুহু ওব্দি কাঁপিয়ে দেয়।
কথাখানা বিড়বিড় করে বললেও মুখে বলে
“কি প্রমাণ দিতে হবে বলো?

“এই পতিতালয়ে একজন থাকতো। তার নাম সীমা ছিলো। নায়েব তালুকদার খুন করেছে ও মহিলাটিকে।
আর আবিরের জন্মদাতা পিতাও নায়েব তালুকদার। এই খবরটা নুপুর কে জানাবেন। এবং কঠিন শাস্তি দেবেন নয়েব তালুকদার কে।
যেদিন ওই জানোয়ারটা শাস্তি পাবে সেদিনই আমি আপনার সঙ্গে চলে যাব।

সিফাত কোন কথা বলে না। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে আনুর মুখপানে। মেয়েটাকে এখানে ফেলে যেতে মন সায় জানাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে জোর করে তাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু পারছে না।
তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে
নায়েব তালুকদারকে কঠিন শাস্তি দিয়ে আনু কে নিয়ে চলে যাবে।

“আমার জন্য অপেক্ষা করিও আনু। আমি আসবো তোমার কাছে। খুব তাড়াতাড়ি আসবো। ততদিন নিজেকে যত্নে রেখো। মনে রেখো গোটা দুনিয়া তোমার বিরুদ্ধে চলে গেলে, এই পৃথিবীর সব থেকে বাজে মেয়েটা তুমি হলে আমি তখনও তোমায় ভালোবাসবো।। আমি শুধু তোমাকেই চাইবো।

চলে যায় সিফাত। আনু তাকিয়ে থাকে। চোখ ভর্তি পানি আর ঠোঁটের কোণে হাসি।
বৃষ্টি দৌড়ে আসে আনুর কাছে। শুধায়
“কেন চলে গেলে না তুমি? নিরাপদ একটা আশ্রয় পেয়েছিলে তো।

আনু মুচকি হেসে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে। চোখ ঘুরিয়ে প্রতিটা মেয়ের পানে তাকায়
“তোমাদের এই নরকে রেখে আমি একা কিভাবে চলে যাবো?
তোমাদের সাথে নিয়ে, সীমার হ/ত্যার বিচার করে, এই পাপের রাজ্য ধ্বংস করে পাপিকে শাস্তি দিয়ে তবেই এখান থেকে বের হব আমি। তার আগে নয়।


অভি তার বাবার রাজনৈতিক দল বল নিয়ে ঘেরাও করে মানিকগঞ্জ সদর থানা। পুলিশের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে নেহালকে ছেড়ে দেওয়ার আরজি জানায়।
রাজনৈতিক ক্যাচাল তার পছন্দ নয়। ক্ষমতার জোরে মানুষকে হয়রানি করাও অভির স্বভাব নয়। সে বরাবরই শান্তি প্রিয় মানুষ। তাইতো নওয়ান এর সঙ্গে গোপনে বৈঠক সেরে এখানে ঝামেলার সমাপ্তি করতে চেয়েছিল। যেহেতু নওয়ান তালুকদার সমাপ্তি চাইছে না সেহেতু অভির উচিত নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে দেওয়া।
10 মিনিটও লাগে না নেহাল কে জেল থেকে বের করতে। নুপুর থানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে কখনোই ভাবতে পারেনি অভি এভাবে নেহালকে মুক্ত করতে পারবে। মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় নুপুরের। নাহহ তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করাই যায়।

নেহালের হাত ধরে থানা থেকে বেরিয়ে আসে অভি। নুপুর দৌড়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে। অভিকে ধন্যবাদ দিতেও ভোলে না।
অভি চুপচাপ দেখতে থাকে তার মায়াবতী কে।।
বিরবির করে বলে
“তোমার ঠোঁটে হাসি ফোটানোর জন্য আমি নিজের জানটাও দিতে রাজি।


তালুকদার বাড়িতে জরুরী বৈঠক বসেছে। চিন্তিত নায়েব তালুকদার। নওয়ান সোফার হাতলে মাথা ঠেকিয়ে গভীর মনোযোগে সিগারেট টানছে। বল্টু তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। বহুক্ষণ হবে নওয়ানকে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না।
আয়াশ ফ্লোরে বসে বল খেলছে। সবিতা তালুকদার বাঁকা নয়নে আয়াশকে দেখছে। ইচ্ছে করছে চাপকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে কিন্তু পারছে না।
মজনু তালুকদার বলে ওঠে
“কালকে নির্বাচন। তোমাদের ভাব ভঙ্গিমা তো বুঝতে পারছি না। কারো যেন কোনো দায়িত্ব নেই।

বিরক্ত নওয়ান কপালে ভাজ ফেলে বলে
“তো এখন উত্তেজিত হয়ে সবাইকে এক্সাইটমেন্ট দেখিয়ে বাড়াবো?
ননসেন্স কথাবাত্রা। এই বাল ছাল বলার জন্য এখানে ডেকেছো?

মজনু তালুকদার থমথমে খেয়ে যায়। নায়েব রাশেদও কিছু বলার সাহস করে না। তবে বলে নিরব
“দাদু সুস্থ নির্বাচন হতে দাও যে দল উপযুক্ত সে দল এমনিতেই জিতে যাবে।
এত প্যারা নেওয়ার কি আছে?

আমিনা আয়াশের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। সকলের বক্তব্য শুনতে পেয়েছে সে। ইচ্ছে করছে অনেক কথা বলতে তবে বলতে পারেনা। মেয়ে মানুষের এই একটা সমস্যা। তাদের অনেক কথা বলার থাকে তবে শোনার মত কেউ থাকেনা।
“নির্বাচনের পরে নুপুর না কি যেনো ওকে ডির্ভোস দিয়ে ঘাড় থেকে নামাবে। চরিত্রহী

রাশেদ বাকি কথা শেষ করার আগেই নওয়ান দাঁড়িয়ে পড়ে। চিৎকার করে বলে
“দ্যাটস নন অফ ইউ আর বিজনেস।
আমার চাঁদের ব্যাপারে কেউ একটা কথা বললে তার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি।

ভয় পেয়ে যায় সকলে। নায়েব তালুকদার মনে মনে বলে
” হাতের বাইরে চলে যাচ্ছো আব্বা। আমি ক্ষমতা হারাতে রাজি কিন্তু তোমাকে না।
ওই মেয়েটাকে শেষ করতেই হবে।


আজকে নির্বাচন। প্রতিটি জেলা পরিষদে মানুষের ঢল। সকাল আটটা থেকে ভোট নেওয়া শুরু হয়েছে। এখন বেলা এগারোটা। এরই মধ্যে ১০ লক্ষ ভোট দেওয়া শেষ। নওয়ান তালুকদারের ছেলে-পেলেরা এখন থেকে ভোট গণনা শুরু করে দিয়েছে। যত ভোট পড়েছে তার মধ্যে তারা পেয়েছে ২ লক্ষ। এগিয়ে আছে বিপক্ষ দল। খবর খানা নওয়ানকে জানাতেই সে ভোট নেওয়া বন্ধ করে দিতে বলে। মারামারি ভাঙচুর গ্যাঞ্জাম শুরু করতে বলে। এবং মানুষকে বাধ্য করতে বলে তাদের ভোট দিতে। যেকোনো মূল্যেই জিততে হবে।

বেওথা ব্রিজের উপর বসে আছে নওয়ান তালুকদার। বরাবরের মতোই ঠোঁটের ভাজে সিগারেট। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক গুলো দেহরক্ষী।
নুপুর নেহাল এবং অভি ফুচকা খেতে এসেছে। বিকেল বেলা অনেকগুলো ফুসকে স্টল বসে সেই সঙ্গে ভাজাপোড়া তো আছেই। ছোটখাটো একটা মেলার মত লাগে।
নেহাল তার প্রেম কাহিনি শোনাচ্ছিলো ওদের নুপুর হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। অভি মুগ্ধ নয়নে দেখছে মেয়েটাকে। ব্যাপারটা নওয়ানের নজরে পড়ে যায়। সে বড় বড় পা ফেলে এগোতে থাকে নুপুরের দিকে। কাছাকাছি যেতে ঠোঁটের ভাজা থাকা জলন্ত সিগারেট চেপে ধরে নুপুরের ঠোঁটের বা পাশে।

চলবে

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply