অন্তরালে_আগুন
পর্ব:৩০
তানিশা সুলতানা
সীমার কক্ষে নীল রংয়ের সুন্দর একটা ডাইরি খুঁজে পেয়েছে আনু। ডাইরির উপরের পৃষ্ঠ লিখা রয়েছে “নষ্ট জীবন”
কিন্তু ভেতরে রয়েছে সুন্দর একটা গল্প। এক চঞ্চল কিশোরীর পরিবারের মিষ্টি কাহিনী।
দুই বোন এবং দুই ভাই বাবা-মা নিয়েই ছিল সুমির সংসার। বিলাসিতা না থাকলেও সুখের কোন কমতি ছিল না। বাবা প্রচন্ড কষ্ট করে সকলের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিত।
কিন্তু এমন জীবন সুমির পছন্দ ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল বড় হবে বড়লোক হবে বাবার দুঃখ কমাবে।
কলেজে পা রাখার সাথে সাথেই নিজে কিছু করার উদ্দেশ্যে চাকরি খুঁজতে থাকে। ভাবে টিউশনি করাবে। তখনই তার দেখা হয়ে যায় আমিনার সঙ্গে। কিছু মুহূর্তেই দুজনের খুব ভাব হয়। এক পর্যায়ে সুমি আমিনা কে জানায় “সে টিউশনি খুঁজছে”
সঙ্গে সঙ্গে আমিনা প্রস্তাব দেয় তার ছেলেকে পড়াতে।
নওয়ান তখন ক্লাস ফাইভ এ পড়ে।
পরের দিন সকাল ৭ টা থেকে সুমি তালুকদার বাড়িতে নওয়ান তালুকদারকে পড়াতে যাবে।
ভীষণ খুশি ছিল সে। মাস শেষে ৫০০০ টাকা পাবে। যা দিয়ে তাদের গোটা একটা সংসার চলবে। এবার বুঝি অভাব অনটন দূর হবে।
বাড়ি ফিরে বাবা-মা এবং ভাই-বোনদের জানায়। তারাও খুব খুশি হয়।
পরের দিন নিয়মমাফিক নওয়ান তালুকদারকে পড়াতে চায় সুমি। ভীষণ আদুর রাজপুত্র কে দেখে কি যে খুশি লাগে সুমি। তবে বাচ্চাটা গম্ভীর। হাসে না কথা বলে না। চুপচাপ নিজের পড়া করতে থাকে।
সুমি অনেক চেষ্টা করে তার সঙ্গে কথা বলার ভাব জমানোর তাকে একটু আদর করার। কিন্তু ছুঁয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য হয় না।
৪-৫ দিন পড়ানোর পরে হঠাৎ মজনু তালুকদারের চোখে পড়ে যায় সে। তিনি কেমন খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো সুমির পানে। যেনো এখনই
আর পড়তে পারে না আনু। বৃষ্টির কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে। চোখের কোনে জমে থাকা এক ফোঁটা পানি হাতের উলটো পিঠে মুছে খুবই আলগোছে ডাইরি খানা লুকিয়ে ফেলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে।
“আমি জানতাম তুমি এখানে আছো। কোথায় কোথায় খুঁজেছি তোমায়।
বৃষ্টি কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে বলে। আনু একটু হাসার চেষ্টা করে বলে
“কিছু বলবে বৃষ্টি? কেনো খুঁজছিলে?
বৃষ্টি আনুর পাশে বসে। তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলে
“পালাবে আনু?
আজকে একটা সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। চাইলেই আমরা এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারি।
“তুমি পালাও। আমি কোথাও যাবো না।
“কিন্তু কেনো? এই নরক থেকে মুক্তি পেতে চাও না? আমরা এখান থেকে চলে গিয়ে ঢাকার শহরে যাবো। সেখানে গার্মেন্টস বা কোথায় একটা চাকরি নিবো। খুব সুন্দর ভাবে জীবন চলে যাবে। চলো না পালাই
আনু মনে মনে বলে
“পালিয়ে গেলে তো হেরে গেলাম।
আমি আর হারতে চাই না। এসবের শেষ দেখতে চাই। আমাকে ঠকানো প্রত্যেকটা মানুষকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দেব।
জীবন তো নষ্ট হয়েছেই। সমাজের চোখে কলঙ্কিনী হয়েছি। এই কলঙ্কের দাগ কখনো মুছবে না।
বৃষ্টি আনুকে ধাক্কা দিয়ে বলে
“কি ভাবছো?
পালাবে না?
“সুস্থ সমাজে বসবাস করার অনুমতি নেই আমাদের। এখান থেকে বেরোলে মানুষ বাঁকা চোখে দেখবে। কটু কথা শোনাবে। আমাদের জন্য আমাদের পরিবার বিপদে পড়তে পারে।
শুনতে খারাপ লাগলে এটাই সত্যি যে আমরা আর কোনদিনও এখান থেকে বের হতে পারব না।
কখনোই না।
এটাই আমাদের শেষ ঠিকানা।
যে আশা টুকু মনে পুষে আনুর কাছে এসেছিলো মুহূর্তেই সেই আশাটুকু গায়েব হয়ে যায়। চোখে মুখে ভর করে এক রাশ হতাশা।
একটা জীবন তাহলে এভাবেই কেটে যাবে। একটা সুন্দর সংসার সুস্থ জীবন কখনোই পাওয়া হবে না?
নুপুর কে দেখে আমিনা বেগম বেশ খুশি হয়। সে ড্রয়িং রুমে বসে আয়াশকে খাওয়াচ্ছিলো। নুপুর সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমিনা হাসি মুখে সুধায়
“নুপুর ভালো আছো?
জবাবে একটুখানি হাসার চেষ্টা করে নুপুর। তারপর বড় বড় পা ফেলে নওয়ান এর কক্ষের পানে ছোঁটে।
দরজা খোলাই ছিলো বিধায় খুব সহজেই কক্ষে ঢুকে পড়ে।
নওয়ান ফ্লোরে মাথা রেখে সোফার ওপর পা রেখে শুয়ে আছে। ঠোঁটের ভাজে সিগারেট। বুকের উপর গিটার। আঁখি পল্লব বন্ধ করে মনের সুখে সিগারেটে টান দিচ্ছে আর গিটারে টুংটাং আওয়াজ তুলছে। নুপুর নওয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে
“কি চাই আপনার?
চোখ খুলে নওয়ান। কিছু মুহূর্ত পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নুপুরের মুখ পানে। পরমুহুর্তে দৃষ্টি সরিয়ে গিটার নামিয়ে সোজা হয়ে বসে। বা হাতে বড় বড় চুল গুলো পেছনে ঠেলে ডান হাতে ঠোঁটের ফাঁকা থেকে সিগারেট হাতে নেয়।
গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে
“অভির সাথে তোর কি সম্পর্ক?
নুপুরের কপালে ভাজ পড়ে।
“আশ্চর্য
তার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকবে?
সে আমার ভাইয়ের বন্ধু।
আর তাছাড়াও তার সাথে আমার সম্পর্ক থাকলে আপনার কি? কে আপনি?
নওয়ান জবাব দেয় না। পুনরায় সিগারেট খাওয়া শুরু করে। নুপুর বিরক্ত হয়।
“আমার ভাইকে কেনো পুলিশ ধরলো? তার কি দোষ?
“আমি পুলিশ নই।
থানায় গিয়ে জিজ্ঞেস করো।
“আপনার জন্যই পুলিশ আমার ভাইকে ধরেছে। এসব কিছু আপনার পরিকল্পনা।
আমাকে ভাঙতে আমার পরিবারের ওপরে এট্যাক করছেন। আমার মত সাধারণ একটা মেয়ের সাথে কিসের শত্রুতা আপনার? কেন করছেন এমন?
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে নুপুর। হাঁটু মুরে বসে পড়ে নওয়ানের পাশে।
“আমি আপনাকে কোনদিনও ক্ষমা করব না নওয়ান তালুকদার। কখনো না।
আপনার জন্য আমার শুধু ক্ষতি হলো।
নুপুর থামে। ডান হাত বাড়িয়ে নওয়ান এর গালে রাখে। বড্ড মায়া মায়া স্বরপ বলে
” আমাকে দুঃখ দিয়ে
আমার ক্ষতি করে আপনি ঘুমান কি করে? ঘুম হয়? মাঝ রাতে প্রচন্ড যন্ত্রণা হৃদয় কেঁপে ওঠে না? কখনো আফসোস হয় না?
মনে হয় না মেয়েটাকে এক সেকেন্ডও শান্তি দিলাম না?
আপনি তো আমার হাজব্যান্ড। তাই না?
নওয়ান নুপুরের হাতের ওপর নিজের হাত খানা রাখে।এবং বলে
“আমার হয়ে থাকো না চাঁদ।
আম্মুর মতো সংসার করো। ট্রাস্ট মি আদরে মুরিয়ে রাখবো তোমায়।
নুপুর তাচ্ছিল্য হাসে। নওয়ানের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।
“আপনার সঙ্গে আর যাই হোক সংসার করা যায় না। ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না আপনি।
” অভি রাখে?
“হয়ত রাখে।
আর যাই হোক আপনার মতো খারাপ নয় সে।
চোয়াল শক্ত করে ফেলে নওয়ান। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে প্রচন্ড শক্তি খাটিয়ে ফ্লোরে ঘুষি মারি। হাতের উলটো পিঠে বেশ আঘাত পায়। ফেঁটে গিয়েছে কিছু জায়গায়। নুপুর চমকায়। একটুখানি পিছিয়ে বসে।
নওয়ান শক্ত গলায় বলে
“গেট আউট ফ্রম মাই রুম।
নুপুর কেঁপে ওঠে। তবুও দমে যায় না।
বুকে সাহস সঞ্চয় করে বলে
“আমার ভাইকে ছেড়ে দিন। এই খেলা এখানেই শেষ করুন। প্রয়োজনে আমরা এই শহর ছেড়ে চলে যাব।
“নির্বাচনের আগে তোর ভাই ছাড়া পাবে না।
আর অভি দুনিয়াতে তার সময় শেষ।
নুপুর বুঝে যায় শুধু শুধুই সে মাথা নিচু করতে এসেছিলো। এই পাষাণ লোকটা তাকে সাহায্য করবে না।
“আপনি আমাকে চেনেন না। আমি কি করতে পারি সেটাও জানেন না।
প্রতিশোধের খেলাটা তাহলে শুরু করে দেই?
নওয়ান সিগারেটে টান দিয়ে উদাস স্বরে বলে
“প্রতিশোধের নেশায় ডুবলে তোমার অস্তিত্ব বিলীন করে ফেলতে দু বার ভাববো না।
“আমার অস্তিত্ব সেদিনই বিলিন হয়ে গেছে যেদিন আপনার সঙ্গে জীবন জুড়েছে।
এতে সত্যি কথা বলি
ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে গেছে মানুষটা আমারই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রথমবার আবদার করেছিলাম আনুকে এনে দেওয়ার জন্য। আমি জানি আমি কি আপনার বাবা লুকিয়েছে। ভীষণ বাজে একটা জায়গায় রেখে এসেছে।
আমার খুব বিশ্বাস ছিল আপনি বিষয়টা জানেন না। আর যেভাবেই হোক আনুকে এনে দিবেন।
পরে বুঝে গেলাম শুধু আপনার বাবা নয় আপনিও খারাপ জায়গা সম্পর্কে অবগত।
পাপীর সঙ্গে সংসার করা যায়
কিন্তু পাপের সঙ্গে নয়
পাপীকে ক্ষমা করা যায়
পাপকে নয়
আপনি নিজেই একটা পাপ।
আপনাকে ক্ষমা করা মানে নিজেকে পাপী বলে ঘোষণা করা।
চলে যেতে নেয় নুপুর। নওয়ান বলে ওঠে
“এই পাপীকে একদিন পাগলের মতো ভালোবাসবে তুমি। তার সঙ্গে পাওয়ার নেশায় ছটফট করবে।
” সেই দিন আসার আগে আমার মৃত্যু হোক।
চলে যায় নুপুর।একটাবারও পেছন ঘুরে তাকায় না।
ফ্লোরে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে কল করে কারো নাম্বারে।
“অভিকে আমি নিজে হাতে খুন করতে চাই।
অভি এবং নওয়ান মুখোমুখি বসে আছে। দুজনের সামনে কফির মগ রাখা। কেউ সেটা ছুয়ে দেখছে না। আসলে কফি খাওয়ার মুড নেই কারোরই। গুটি কয়েক পুলিশ তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। বল্টু খানিকটা দূরে। সে এক প্রকার যুদ্ধ করেও নওয়ানের কাছাকাছি থাকতে পারেনি। বড্ড চিন্তা হচ্ছে।
অভি যদি তার বসকে আঘাত করে?
“নেহাল কে ছেড়ে দিন। আমরা কেউই আপনাদের রাজনীতি বিষয়ে কথা বলছিনা বলবো না। আমার বাবাও ইলেকশন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। আপনারা আপনাদের মতো থাকুন। আমাদের আমাদের মতো থাকতে দিন।
নওয়ান ঠোঁট বাঁকায়। সিগারেটে দীর্ঘ টান দিয়ে নাক মুখে ধোঁয়া ওড়ায়।
“রাজনীতি আবার কি?
তোকে রাজনীতি থেকে সরাতে আমার জাস্ট দুই সেকেন্ড লাগতো।
“ঠিক আছে।
সব মেনে নিলাম।
এবার নেহালকে ছাড়ুন আর আমাদের
নওয়ান অভিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে
“আমাদের বলে কোন কথা নেই।
তুই একা।
জাস্ট একা
চাঁদ নেহাল ওরা আমার।
আমি বলবো আমাদের। তুই আমাদের মাঝে থেকে এই মানিকগঞ্জ শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে যাবি।
“অবশ্যই যাবো
তবে নুপুর এবং তার পরিবারকে সাথে নিয়ে।
নওয়ান দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে। অতঃপর বল্টুকে ডেকে বলে ওঠে
” বল্টু চাঁদের নামটা পাল্টে দে। ও চাঁদ
আমার চাঁদ
ওর নাম চাঁদ
নওয়ানের চাঁদ
এন্ড ইউ (অভির দিকে আঙুল তাক করে) তুই চাঁদ নামটা মুখে আনলে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।
তারপর পুলিশদের বলে
“এই বাস্টার্ডকে গুম করে দে।
জানে যেনো না মরে। নির্বাচনের পরে আমি নিজে হাতে খুন করবো ওকে।
চলবে
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৩১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৮
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৬
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৮
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৯
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২০