কেয়ারটেকার
✍️ গোবিন্দ মন্ডল
—-
অজিত ভট্টাচার্য , বয়স ৩৮ বছর, কলকাতার বাগুইহাটির বাসিন্দা ।
কলকাতার এক ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে যখন পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে একটি পুরোনো জমিদারবাড়ির কেয়ারটেকারের কাজে যোগ দিল, তখন সে নিজেও জানত না যে কী এক অদৃশ্য টান ওকে ওই জায়গায় নিয়ে চলেছে।
শহুরে জীবনের একঘেয়েমি, ডিপ্রেশন, ও সর্বোপরি একাকিত্ব ওকে ঠেলে দিয়েছিল এই সিদ্ধান্তে।
একটু নিস্তব্ধতা চাই, বলেছিল সে বন্ধুকে। কিন্তু যে নিস্তব্ধতা তাকে ডাকছিল, তার ভিতর লুকিয়ে ছিল অতৃপ্ত আর্তনাদ।
চান্দিল রোড ধরে পুরুলিয়া থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে অবস্থিত সেই জমিদারবাড়ির নাম ছিল ‘কাশিপুর প্রাসাদ’।
পুরুলিয়ার কাশীপুর প্রাসাদ স্থানীয়দের মধ্যে “ভূতের বাড়ি” হিসেবে পরিচিত।
আশপাশে কোনো বসতি নেই, কেবল গাছপালা আর একপাশে ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে যাওয়া এক কুয়া।
লোকজন বলে, ও বাড়িতে রাত কাটাতে সাহস লাগে।
কিন্তু অজিত ছিল যুক্তিবাদী। ভূতের অস্তিত্বে তার বিশ্বাস ছিল না।
প্রথম দিন সন্ধ্যায় যখন সে ঘরে ঢোকে, তখন বাড়ির ভেতর অদ্ভুত এক ঘন গন্ধ টের পায়। কেমন যেন পচা ফুল, ধূপ আর পুরোনো কাঠের গন্ধ মিশে আছে বাতাসে। মেঝের ওপর ধুলোর আস্তরণ, দেয়ালের পলেস্তার ফাটলে ফাটলে ছায়া পড়ে।
বিছানা ছিল না, শুধু একটিমাত্র কাঠের খাট ও তার ওপরে জাল ধরা তোশক। সেখানেই শুয়ে পড়েছিল সে।
রাত ঠিক ১টা ৪৭ মিনিটে তার ঘুম ভাঙে।
জানালার বাইরে কার যেন নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ।
ধীরে ধীরে সে উঠে জানালার পর্দা সরায়।
সামনের বাগানে একটা সাদা শাড়ি পরা মেয়ে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
অজিত চিৎকার করতে গিয়েও থেমে যায়। চোখের পলক বন্ধ করে আবার তাকায় মেয়েটি নেই।
পরদিন সকালে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে সবাই মুখের দিকে চেয়ে থাকে। এক বৃদ্ধ কাকাবাবু বললেন, ওটা নিশ্চয়ই ঝর্ণা। এককালে ওই বাড়ির কেয়ারটেকার ছিল। জমিদারবাড়ির শেষ বংশধররা যখন আত্মহত্যা করে, ঝর্ণাও সে রাতে কুয়োয় ঝাঁপ দেয়।
অজিত জিজ্ঞেস করল–
তারপর?
তারপর কুয়ো থেকে গন্ধ উঠতে থাকে… কেউ কাছেও যায় না আজকাল।
অজিত মুচকি হাসে। পুরোনো লোককথা ভাবতে গিয়ে ভুলে যায়, রাতে আবার সেই কুয়োর পাশেই তাকে হেঁটে যেতে হবে।
তৃতীয় রাতে আবার ঘুম ভাঙে। এবার সে দেখে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সেই সাদা শাড়ির মেয়ে।
কিন্তু এবার মুখ দেখা যায়।
না, ওটা মুখ নয়, ওটা একটা অন্ধকার গহ্বর। চোখদুটো যেন ফুটো কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর ঠোঁটের জায়গায় সেলাই।
সে হেঁটে আসে অজিতের দিকে। ঠক ঠক ঠক…
“তুই আমার জায়গা দখল করেছিস!”
“তুই এখানেই থাকবি… এবার চিরকাল…”
অজিত ঘামতে ঘামতে জেগে ওঠে। বুকের ওপর অদৃশ্য কোনো কিছুর চাপ। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘড়ির কাঁটা—১টা ৪৭।
ঠিক আগের রাতের মতো।
সপ্তাহ গড়িয়ে গেল। অজিত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। কোথাও ফোন নেই, নেটওয়ার্ক নেই। বাইরের জগত থেকে সে বিচ্ছিন্ন।
সেই রাতে, সে লিখে যায় একটি ডায়েরি—
“আমি জানি আমি মরতে চলেছি।
আমি ঘুমোতে পারি না।
কেউ আমার মগজে ঢুকে যাচ্ছে।
আমি আর আমি নেই…”
পরদিন সকালে স্থানীয় কিছু লোক এসে দেখে, কাশিপুর প্রাসাদের সিঁড়িতে পড়ে আছে অজিতের মৃতদেহ। মাথা ঘুরে আছে পিছনে, চোখ দুটো ফেটে গিয়েছে রক্তে।
আর ঘরের এক কোণে পড়ে আছে ডায়েরি।
শেষ পাতায় লেখা:
“আমি এখন কেয়ারটেকার।
ঝর্ণার উত্তরসূরি।
এই বাড়ি এখন আমার।
কেউ আসবে না…
কেউ ফিরবে না…”
বছর ঘুরে গেছে। কেউ আর সেই বাড়ির কেয়ারটেকার হতে সাহস পায় না।
তবে মাঝেমধ্যে শোনা যায় বাড়ির দরজা নিজে থেকে খুলে যায়, আবার বন্ধ হয়ে যায় নিজে থেকেই।
আর বাতাসে ভেসে আসে এক স্ত্রৈণ কণ্ঠ –
“আমি আছি… কেয়ারটেকার!”
ভৌতিকগল্প #HorrorStory #BengaliStory #গোবিন্দমন্ডল #ভূতেরগল্প
Share On:
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE