আমার নাম মশিউর রহমান, বয়স প্রায় আটত্রিশ। পেশায় আমি ঢাকায় একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সাইট সুপারভাইজার। জীবনে নানা কিছু দেখেছি, কিন্তু একটা ঘটনা আমাকে এখনও মাঝরাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। আমি কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে আসে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়—সেই এক রাত, সেই এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, যার শুরুটা হয়েছিল আমার স্ত্রী নিগারকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
ঘটনাটা তিন বছর আগের। আব্বার মৃত্যুর পরে অনেকদিন গ্রামে যাওয়া হয়নি। আমার গ্রামের নাম কানাইপুর, ফরিদপুরের ভেতর দিকে একেবারে দুর্গম জায়গা। লোডশেডিং হলে আধঘণ্টার বেশি সময় আলো আসে না, মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায় না, আর সন্ধ্যা নামতেই পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। নিগার বরাবরই একটু ভয় পায় এসব জায়গায়, কিন্তু এবার জোর করেই নিয়ে গেলাম। কারণ, আব্বার রেখে যাওয়া ভিটাবাড়ির কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে হবে, আর সাথে স্থানীয় একজন জমির দালালের সাথেও দেখা করতে হবে।
গ্রামে ঢোকার আগেই একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কানাইপুরের সীমানায় ঢুকতেই যেন হাওয়া বদলে গেল—একটা গুমোট, ঘন ধোঁয়ার মতো কিছুর আবেশে চারদিক যেন ভারী হয়ে গেল। নিগার আমার হাত চেপে বললো,
— “মশিউর, তুই খেয়াল করছিস? বাতাসে কেমন একটা গন্ধ আছে।”
আমি জানালা দিয়ে মুখ বের করে ঘ্রাণ নিতে নিতে বললাম,
— “হ্যা, একটা পোড়া কিছু গন্ধ আসছে মনে হচ্ছে… হয়তো কেউ কাঠ পুড়াচ্ছে।”
তখনও বুঝিনি এই গন্ধটা আদৌ কিছু জ্বালানোর নয়।
আমরা যখন বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। পুরনো ভিটাবাড়িটা দেখলেই বুকটা হাহাকার করে উঠল। আগাছায় ঢাকা উঠোন, ভেঙে পড়া বারান্দার চাল, জানালার কাঁচ ভাঙা। নিগার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
— “তোর আত্মীয়স্বজন কই? কাকেই বা বললি আমরা আসছি?”
আমি মাথা চুলকে বললাম,
— “আসলে কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি। মোবাইলে ধরাও যায় না… আর তেমন আপনজন এখন আর তেমন নেই।”
বাড়িতে ঢোকার সময়ই আমি দেখলাম পাশের জমির সীমানায় একটা অদ্ভুত মূর্তি বসানো আছে। রুক্ষ কাঠে খোদাই করা, পেটের ভেতর ফুটো করা একটা মানুষ-সদৃশ অবয়ব। ওটা আগে কখনও দেখিনি।
রাত বাড়তেই সমস্যাটা শুরু হলো। হঠাৎই নিগারের গলা ভেঙে গেল। না ঠান্ডা লেগে, না কথা বেশি বলায়—একেবারে ঘড়ির মতো চুপসে গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম ক্লান্তিতে হয়েছে, কিন্তু রাত দুইটার দিকে ওর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট একটা শব্দ বের হলো,
— “ওরা… ওরা ফিরেছে… ওরা এখানে আছে।”
আমি জেগে উঠেই বিছানার পাশে এসে বসে গেলাম। নিগারের গলা শুকনো কাঠের মতো, চোখজোড়া লাল, যেন কোন ভেতরের পেটানো ভয় ওকে ঘিরে ধরেছে।
— “কে ফিরেছে নিগার? তুই কার কথা বলছিস?”
— “কালো ছায়া… পুকুরপাড়ে… সে বলেছে, তুই এসেছিস, আবার শুরু হবে।”
ঘেমে উঠলাম আমি। নিগার এমনভাবে কথা বলছে, যেন সে না—আরেকজন। ওর গলার টোনও বদলে গেছে। আমার সামনে বসে আছে কিন্তু সেই চেনা মানুষটা নেই।
পরদিন সকালে পাশের বাড়ির পুরনো কাকু—রহিম চাচা—আসলেন। তাঁকে দেখে অনেকটা স্বস্তি পেলাম। কিন্তু উনি চোখাচোখি না করে নিচু গলায় বললেন,
— “তোমারে সাবধান করছি মশিউর, যেই জমিটা তোর আব্বা রেখে গেছে, ওটা এখন আর সাধারণ কিছু নয়। ওটা দখল করেছে একজন… কালোবিদ্যার মানুষ। ওর নাম ‘ফয়েজ বেপারী’।”
— “ফয়েজ বেপারী?”
— “হ্যা। আগেও ছিল, তোর আব্বা তখন ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গত দুই বছর হইছে, আবার ফিরছে। এবার সে আর মানুষ নাই… সে তন্ত্র-মান্ত্র কইরা মাটির নিচে কিছু আটকায়া রাখছে।”
আমার বুক ধকধক করতে লাগল। তখনই বুঝলাম, নিগারের গলার এই অদ্ভুত সমস্যা, ওর ওই কথা বলার ধরণ… সব কিছুর সাথে ওই জমির কিছু সম্পর্ক আছে।
রাত নামতেই আমি সাহস করে হাঁটলাম সেই পুকুরপাড়ের দিকে, যেটার পাশেই জমিটা। নিঃস্তব্ধতা, বাতাসে সেই পোড়া কিছু গন্ধ, আর একটা কর্কশ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মাথা ভারী করে দিচ্ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল পুকুরপাড়ে একটা কুঁড়েঘরের মতো কাঠের ঘর, যেটা আগে ছিল না। আর ঘরের ছাদে কালি দিয়ে আঁকা এক বিশাল পঞ্চভুজ তারকাচিহ্ন—যেটা আমি আগে শুধু বইয়ে দেখেছি। ঘরের ভেতর থেকে একটা ঘষটানো আওয়াজ আসছিল, কেউ যেন নকশা আঁকছে বা মাটি খুঁড়ছে।
আমি পেছন থেকে হঠাৎ একজনে কণ্ঠে শুনলাম,
— “বেশি ঘেঁটে ফেলো না ভাইসাব। ওখানে এখন কিছুর ঘুম ভাঙবে, আর সেটা তোমাদের দম ফেলার সুযোগ দিবে না।”
চমকে পেছনে তাকালাম। অন্ধকারে একজন মাঝবয়সী লোক, মুখে কালো কাপড় বাঁধা, চোখজোড়া ধূসর—অদ্ভুত একটা শীতলতা।
— “আপনি কে?”
— “আমি ফয়েজ বেপারী না। কিন্তু তার যেই অভিশাপ তোমার বউকে ঘিরে ফেলেছে, সেটা খুলতে পারো যদি কাল রাত পার করো…”
— “কেন? কি আছে কাল রাতে?”
— “কাল রাত হবে অমাবস্যা। আর তোর বউ এখন আর শুধু বউ নাই। সে হয়েছে ওর দরজা।”
এতটুকু বলেই লোকটা চলে গেল, ঝোঁপের ভেতর ঢুকে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল, এমনভাবে যেন সেখানে কোনোদিন কেউ ছিল না।
আমি শিউরে উঠেছিলাম। কিন্তু এর থেকেও ভয়ংকর ছিল, যখন আমি বাড়ি ফিরে নিগারকে দেখতে পেলাম না। ঘর ফাঁকা, দরজা অর্ধেক খোলা, আর বিছানার পাশে মাটিতে আঁকা এক অদ্ভুত মন্ত্র—সাদা চাল দিয়ে পেঁচানো। মন্ত্রচিহ্নের মাঝখানে ছিল নিগারের কাটা চুলের গোছা।
আমার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছিল। রাত তখন ১২টা বাজে, হাওয়া থেমে গেছে, চারদিক পেঁচানো নিস্তব্ধতা। আর পেছন থেকে ভেসে এল সেই গলা—
— “মশিউর… তুই জমি আনতে এসেছিস, না নিজের কবর খুঁড়তে?”
আমার শরীরের মধ্যে তখন গরম আর ঠান্ডার একটা অদ্ভুত যুদ্ধ চলছিল। মাথার তালু পর্যন্ত ঠান্ডা ঘাম বেয়ে নামছে, আর বুকের মধ্যে যেন একটা অজানা ছুরি চালিয়ে কেউ বলছে—”তুই দেরি করেছিস, অনেক দেরি…” আমি নিগারের নাম চিৎকার করে ডেকেও কোনো সাড়া পেলাম না।
ঘরের চারদিকে তাকালাম। মেঝেতে চাল দিয়ে আঁকা গোল আকৃতির কিছু চিহ্ন—মাঝখানে নিগারের কাটা চুলের গোছা রাখা, এমনভাবে যেন কেউ ইচ্ছা করেই রেখে গেছে। দরজার পাশেই মাটির ওপর ধুলায় যেন হালকা কেউ হেঁটে গেছে, পায়ের ছাপ—কিন্তু সেটা মানুষের মতো নয়, যেন বড় কোনো প্রাণীর, যে কি না উঁচু পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হেঁটে চলে গেছে।
আমি লাইটটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখন অন্ধকার পুরু হয়ে গেছে। বাড়ির পেছনের বাগানটার দিক থেকে একটা ঘ্রাণ আসছিল—ঘামের, লাশের, আর পোড়া কিছু একটা গন্ধ। আমি আর দেরি করলাম না, সোজা বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ঝোপের পাশে একটা কুয়ো ছিল, অনেক পুরনো, যার মুখ কেউ একসময় ঢেকে দিয়েছিল ভাঙা টিন আর বাঁশ দিয়ে। কিন্তু আজ সেটা খোলা ছিল, আর কুয়োর মুখে বসে থাকা এক পাথরের উপর শুকনো রক্তের দাগ। কুয়োর ভেতর থেকে যেন ফিসফিস শব্দ ভেসে আসছে।
— “মশিউর…”
আমি চমকে গেলাম। নিচে তাকিয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলাম নিগারের গলা, কিন্তু ওর কণ্ঠস্বর যেন অন্য কারো আওয়াজে মিশে গেছে।
— “তুই আসবি… আমি তোকে বলছিলাম… আমি ওকে চিনি না, কিন্তু ও আমায় দেখেছে… আমার শরীরটা… ওর দরকার…”
গলা আর মানুষের মতো শোনাচ্ছিল না। একটা খসখসে জ্বীনের মতো কণ্ঠে মিশে ও বলছে। আমি অন্ধকারে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলাম কোনো দড়ি বা মই যা দিয়ে নিচে নামা যায়। তখনই পিছন থেকে কারো পদক্ষেপের শব্দ।
ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, সেই লোক—যে কালো মুখোশে মুখ ঢেকে রেখেছিল, যার চোখ ছিল ধূসর।
— “তোমার বউ এখন মাঝরাস্তায়। সে পুরোপুরি দখলে যায়নি, কিন্তু বাঁচতেও পারবে না যদি তুই এখনই সিদ্ধান্ত না নিস। সে একটা দরজা হয়ে উঠেছে—একটা ভয়ংকর আত্মার দরজা।”
আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম সামনে।
— “আপনি কি সাহায্য করতে পারেন?”
— “হ্যাঁ। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
আমি থমকে গেলাম।
— “তোর বউকে ফেরাতে হলে তুই নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। কিন্তু পুরোপুরি না—তোর আত্মা নয়, তোর বিশ্বাস। তুই যদি বিশ্বাস করিস, এই কালোবিদ্যার শক্তিকে বদলানো যায়, তবেই কিছু হবে। না হলে… সে ওকে শেষ করে দেবে… আর তোর মরণ হবে না—তুই প্রতিদিন দেখবি ও কীভাবে মরছে আবার বাঁচছে, মরছে আবার বাঁচছে।”
কথাগুলো আমার হৃদয়ে ছুরি হয়ে বিঁধল। আমি কেবল জিজ্ঞেস করলাম,
— “কিন্তু আমার বউ কোথায়? সে তো নিচে আছে, আমি তাকে তুলব কেমন করে?”
লোকটা একটা ছোট মাটির পাত্র বের করল, যার ভেতরে একটা সরু কাঠের তাবিজ—তার চারদিকে শুকনো রক্ত আর একগোছা মানুষের চুল পেঁচানো।
— “এটা ফয়েজের তৈরি। সে এই কালোবিদ্যার সর্বশেষ কাব্য লিখে গিয়েছে। এই তাবিজের মাঝখানে তার আত্মা আটকে আছে, আর সেই তাবিজ এখন তোমার বউয়ের শরীরকে চিহ্নিত করে ফেলেছে। তোর বউ এখন শুধু নিগার নয়, সে এখন একটি খাঁচা।”
আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চারপাশে পোকামাকড়ের অস্পষ্ট আওয়াজ, সেই পোড়া গন্ধ, আর আমার বুক ধড়ফড় করছে।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—আমাকে নামতেই হবে।
লোকটা আমার হাতে একটা মোটা কাপড়ের দড়ি ধরিয়ে দিল, কুয়োর মুখে বেঁধে দিলাম, ধীরে ধীরে নামা শুরু করলাম। নিচে নেমে দেখি ভেজা, পিচ্ছিল, গন্ধে দম আটকে আসে এমন একটা পরিবেশ। চোখের সামনে ধীরে ধীরে আলোর মতো কিছু একটা জ্বলছে—নিগারের শরীর, যা ঘরের শেষ প্রান্তে ঝুলছে, কিন্তু পা মাটিতে ছোঁয় না। সে যেন শূন্যে ভাসছে।
— “নিগার… নিগার… আমি এসেছি… আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
নিগারের চোখ খুলল। কিন্তু সেই চোখ আমার বউয়ের ছিল না। তা ছিল অন্ধকার, ভয়ংকর… আর হঠাৎ করেই নিগারের মুখ বিকৃত হয়ে চিৎকার করে উঠল—
— “তুই এসেছিস! তোকে খুঁজতেই তো এত আয়োজন… এবার তুই আমার।”
চারপাশের দেয়াল থেকে অন্ধকার যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। মাটি কাঁপছে, আমি টের পাচ্ছি পেছন থেকে কেউ বা কিছু এগিয়ে আসছে, নিঃশ্বাসের গন্ধ টের পাচ্ছি—পঁচে যাওয়া কিছু একটা।
হঠাৎ সেই মুখোশপরা লোকটা কুয়োর মুখে দাঁড়িয়ে কিছু পড়তে শুরু করল। তার গলা আরও গম্ভীর হয়ে উঠছে—তন্ত্রমন্ত্রের মতো এক প্রাচীন ভাষা।
— “বলি না দিলে বন্ধ হবে না! বন্ধ হবে না!!”
আমি বুঝলাম, আমাকে কিছু করতে হবে। আমি আমার হাতে থাকা সেই তাবিজ নিগারের শরীরের মাঝ বরাবর ছুঁইয়ে দিলাম। সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। নিগার কেঁপে উঠল, এবং হঠাৎ তার মুখ থেকে এক কুয়াশার মতো কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এলো।
সে ধোঁয়া বৃত্তাকারে ঘুরে গিয়ে এক জায়গায় গিয়ে স্থির হয়ে একটা রক্তাক্ত মুখে পরিণত হলো। সেই মুখটা আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল—
— “তুই তো ওর খেলার পুতুল ছিলি… এখন থেকে তুই হবি আমার… পরের জন… তোর বিশ্বাস কি সত্যিই আছে?”
আমি কান চেপে ধরলাম, আর চিৎকার করলাম—
— “আমার বিশ্বাস আছে! আমি ওকে ভালবাসি! এই কালো শক্তির চাইতে অনেক বেশি ভালবাসি!!”
আলো হঠাৎ নিভে গেল।
চোখ খুলে দেখি নিগার মাটিতে পড়ে আছে, অচেতন। আর সেই রক্তাক্ত মুখ, সেই কালো ধোঁয়া, সেই ভয়ংকর অনুভূতি—সব মিলিয়ে এক নীরবতা।
কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়। মুখোশপরা লোকটা কুয়োর মুখে দাঁড়িয়ে বলল—
— “এই ছিলো শুধু শুরু। কালোবিদ্যার মূল খণ্ড এখনও ছোঁয়া হয়নি। ওটা পড়ে আছে তোর বাবার পুরনো ভিটার মাটির নিচে, আর তোর বউ সেই মন্ত্রের চিহ্ন বয়ে বেড়াবে যতদিন তুই জেগে আছিস।”
আমি নিগারকে কাঁধে করে বাইরে নিয়ে এলাম। আমার শরীর কাঁপছে, বুক ধুকপুক করছে, আর মনে হচ্ছে কেউ পেছনে নিঃশ্বাস ফেলছে।
সেই রাতেই আমরা গ্রাম ছাড়লাম। কিন্তু বাড়ি ফিরে বুঝলাম, সমস্যা সেখানেই শেষ হয়নি।
নিগার এখনো ঘুমের মধ্যে ফিসফিস করে। মাঝরাতে বিছানায় বসে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে—
— “ফয়েজ… আমি তো ফিরিনি… আমি তো এখনও ভিতরে…”
ঢাকায় ফিরে আসার তিন দিনের মাথায় আমি বুঝতে পারলাম, গ্রামে ফেলে আসা ভয়টা আমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে। নিগারকে নিয়ে ফিরলেও নিগার আর আগের মতো নেই। তার চোখে এখনো সেই কুয়োর ধোঁয়া। ঘুমের মধ্যে সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালে তাকিয়ে ফিসফিস করে, মাঝে মাঝে কান্না করে, আর মাঝরাতে হঠাৎ উঠে দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে।
প্রথমে ভেবেছিলাম মানসিক ধাক্কা। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখালাম। ডাক্তার বললেন,
— “বেশিরভাগ সময় মানসিক ট্রমা এভাবেই আচরণে আসে। হয়তো গ্রামে কোনো ভয়াবহ কিছু দেখেছে। সময় দিন, ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু সময় দিয়েও কিছুই ঠিক হলো না।
রাত হলে নিগার বদলে যায়। তার কণ্ঠস্বর বদলে যায়। একদিন ঘুম ভেঙে দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে আমার মাথার কাছে, ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কোনো শব্দ নেই। আমি চোখ খুলতেই হঠাৎ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
— “আমার পেটের ভেতর কিছুরা নড়ছে… ওরা জেগে উঠছে… ফয়েজ এখন কথা বলছে আমার শরীর দিয়ে।”
আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম, আমাকে আবার গ্রামে ফিরতে হবে। এইবার একা। নিগারকে রেখে যেতে মন চাইছিল না, কিন্তু ওর এই অবস্থার কারণ যদি ভিটাবাড়ির নিচে থাকে, তবে আমাকে তা খুঁজে বার করতেই হবে।
রওনা হলাম। বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত শূন্যতা—যেন জানি, আমি কিছু একটা মুখোমুখি হতে চলেছি যেটা কোনোদিনের জন্য আমায় বদলে দেবে।
কানাইপুর ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল এই পথটা এবার একেবারে অন্যরকম লাগছে। আগে যা শুধু গ্রাম্য পথ মনে হত, এবার সেটা যেন কোনো অদৃশ্য চোখের নজরে রাখা মৃত্যুপুরির মতো। দুপুরের দিকে পৌঁছালাম ভিটায়।
বাড়িটা আগের মতোই, কিন্তু আশপাশে যেন নিস্তব্ধতা আরও ঘন। একটা কাক পর্যন্ত ডাকছে না। আশ্চর্যভাবে, আশপাশের কেউই আর বাড়ির ধার ঘেঁষে না। গ্রামের লোকজন দেখলে দূর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
একজন শুধু এল—পুরোনো সেই রহিম চাচা।
চুপচাপ এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
— “বুঝছিলাম তুমি আবার আসবি। জানতাম, বউডা শান্ত থাকবেনা।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— “আচ্ছা চাচা, আমার আব্বা জীবদ্দশায় এখানে কিছু লুকিয়ে রেখে গেছিলেন? কোনো গোপন কক্ষে, কোনো কবর… কিছু?”
রহিম চাচা কাঁধ ঝাঁকালেন,
— “তোর আব্বা যখন তরুণ ছিলেন, তখন থেকেই তন্ত্র-মন্ত্রের ব্যাপারে উনি একরকম ঝুঁকে পড়েছিলেন। তখনো বুঝিনি, উনি একদিন এমন কিছু নাম ডাকবেন যার জবাব থাকবে না।”
— “কী রকম নাম ডাকতেন?”
— “একটা নাম প্রায়ই বলতেন—‘আব্দুল হক’। খুব কম লোক জানে, আব্দুল হক ছিল ফরিদপুর অঞ্চলের এক ভয়ংকর কালোবিদ্যার সাধক। তার শরীর আজ নেই, কিন্তু মাটি এখনো তার নাম ধারণ করে আছে।”
আমি চুপ করে শুনছিলাম।
চাচা তখন ইশারা করলেন বাড়ির পেছনের পুরোনো খড়ির গুদামের দিকে।
— “তোর আব্বা ওখানে রাত কাটাতেন প্রায়ই। একটা সময়, গ্রামের লোকজন দেখতে শুরু করল—তোর আব্বা মাটি খুঁড়ে কিছু তুলে আনছেন, আর পেছনের বাঁশবাগানে নিয়ে গিয়ে কালীপুজোর মতো কিছু করছেন।”
— “তারপর?”
— “তারপর এক রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল, হঠাৎ করে ওখান থেকে আগুন দেখা গেল। সবাই ছুটে এসে দেখল তোর আব্বা অজ্ঞান পড়ে আছেন, আর পাশে একটা পোড়া কাঠের বাক্স—যেটা এখন আর নেই। ওটা আর কেউ কখনো খুঁজে পায়নি।”
আমি সোজা সেই গুদামের দিকে গেলাম। দরজা অনেকদিন খোলা হয়নি, জং ধরা টিন ঠেলে খুলে ঢুকতেই একপলকে ঠান্ডা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। গন্ধটা ঠিক সেই রকম—যেমন নিগারের গলার ভেতর থেকে আসত।
ঘরের মাঝখানে মাটির একটা অংশ কিছুটা নরম লাগছিল। কাঠ দিয়ে খুঁড়তেই একটা কাঠের খোলা বাক্সের মতন কিছু পাওয়া গেল। ওটা পুরোপুরি মাটির নিচে পোঁতা ছিল।
বাক্সের ঢাকনাটা তুলতেই যা দেখলাম, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
ভেতরে ছিল ছয়টা ছোট ছোট কাঁচের পাত্র, যার ভেতরে মানুষের চুল, নখ, শুকনো রক্তের মতো জমাট কিছু বস্তু রাখা। প্রতিটার ওপর সাদা কালি দিয়ে নাম লেখা—“সাব্বির”, “রায়হান”, “নাসির”… এমন ছয়জন মানুষের নাম। আর একদম নিচে একটা ধাতব পাতায় লেখা ছিল—“আত্মার বন্ধন ভাঙলে উন্মুক্ত হবে অতল মন্দিরের পথ।”
পিছন থেকে সেই পরিচিত কণ্ঠ, মুখোশপরা লোকটা আবার কথা বলল।
— “তোর আব্বা এই ছয়জনকে উৎসর্গ করেছিল। কালোবিদ্যার মূল বই, ‘মন্দিরের চুক্তি’, সে পেয়েছিল আব্দুল হকের কাছ থেকে। কিন্তু শেষটায় সে পিছু হটে, কারণ তার নিজের রক্ত দিয়ে শেষ বলি দিতে চায়নি।”
— “শেষ বলি মানে?”
— “তার নিজের সন্তান।”
আমার পায়ের নিচে থেকে যেন পৃথিবী সরে গেল।
— “তোর জন্মের কিছু আগে সে আত্মা চুক্তি ভেঙে দেয়, আর বাক্সটা পুঁতে ফেলে এই ঘরে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, ছয়জনের বদলে সাতমাস আগে যাকে সে চিহ্নিত করেছিল—সেই আত্মা অন্যভাবে ফিরে আসে। আর তোর বউ সেই শরীর।”
আমি কিছু বলতে পারছিলাম না।
— “ওকে ফিরিয়ে আনতে হলে এখন ওই আত্মা ছিনিয়ে নিতে হবে, নিজের মধ্যে নিয়ে নিতে হবে। অথবা… বাক্সের সাত নম্বর কাঁচের পাত্র তৈরি করতে হবে, যার ভেতরে থাকবে নিগারের আত্মা।”
আমি জানি না কিভাবে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম। বুকটা ভারী হয়ে ছিল, নিগারের সেই নিঃশ্বাসের শব্দ বারবার কানে বাজছিল—“আমি তো এখনও ভিতরে…”
আমি ফিরে এলাম ঢাকা।
নিগার তখনো অচেনা মুখে বিছানায় বসে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি তার সামনে বসে, হাত ধরলাম। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
— “তুই ফিরেছিস, তাই না? এবার আমি যাব।”
আমি বললাম,
— “না নিগার, আমি তোর জন্য শেষটা করব। যা করার, এইবার আমি করব। বাকিটা শুধু আমাকে বল… কি চাই ওদের?”
নিগার ঠোঁট কাঁপিয়ে বলল,
— “ওরা চায় রক্ত… বিশ্বাস নয়, ত্যাগ নয়… শুধু রক্ত… শেষ বলি… এবার তোর পালা।”
আমার চোখের সামনে বসে থাকা নিগার, যে এখন আর নিগার নয়—তার চোখে তখন একধরনের নিঃসঙ্গ শূন্যতা। ওর চোখে কোনো রাগ, কোনো কষ্ট নেই, শুধু নির্ভীক এক অনুভূতি, যা মানুষের চোখে থাকার কথা না। আমি ওর হাতটা ধরে বসে ছিলাম, নিঃশব্দে, ঠিক যেমনভাবে কেউ অপেক্ষা করে শেষ ট্রেনটা ছাড়ার। আমার মাথার ভেতর তখনও সেই বাক্সের কথা ঘুরছিল—সাত নম্বর পাত্র, নিগারের আত্মা, কালোবিদ্যার চূড়ান্ত বলি। মুখোশপরা লোকটার কথাও ভুলিনি, যে বলেছিল, “তোর বউ এখন আর মানুষ না, সে একটা দরজা—একটা ছায়ার প্রবেশদ্বার।”
সেই রাতে আমি আর ঘুমোইনি। ঘরে নিগার বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু তার নিঃশ্বাসে একেকটা শ্বাস যেন আর্তনাদ হয়ে কাঁপছিল ঘরটা। আমি জানতাম, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ঠিক ভোর পাঁচটা নাগাদ একটা চিৎকারে ঘুম ভাঙল। নিগার চিৎকার করছে, কিন্তু ঠোঁট নড়ে না। ওর শরীর কাঁপছে, পেটের নিচে কাপড় ভিজে গেছে রক্তে।
আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরলাম। ওর চোখ একবার খুলে বলল, “তুই এখনও দেরি করিস না… যদি ওরা বেরিয়ে পড়ে, আমি তো আর ফিরতে পারব না…”
আমি দ্রুত ওকে কোলে তুলে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। সময় নেই। গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম গ্রামে—শেষবারের মত।
রাস্তাটা মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটা মোড় পেছনের অতীতের কোনো ভুলের মুখোমুখি করছে আমাকে। নিগার তখনও জ্ঞানহীন, মাঝে মাঝে হঠাৎ শরীরটা টান দিয়ে উঠে বসে আবার পড়ে যাচ্ছে। একবার তো স্পষ্ট শুনলাম, ওর মুখ দিয়ে কে যেন বলছে—”এবার শেষটা হোক, মশিউর… তোকে আমরা অনেকদিন ধরে ডাকি।”
বিকেলে পৌঁছালাম কানাইপুর। চারপাশ একেবারে অদ্ভুত রকমের শান্ত—যেন সময় থেমে গেছে। গাছের পাতাগুলোও নড়ে না। হাওয়া নেই, পাখি নেই, কুকুর নেই।
আমি নিগারকে নিয়ে সেই গুদামঘরে ঢুকলাম। বাক্সটা যেখানে পেয়েছিলাম, ঠিক সেখানেই ওকে শুইয়ে দিলাম। পাশে সাদা কাপড় পেতে পাত্রগুলো সাজালাম। এবার বাক্সের ভেতরের প্রতিটা কাঁচের পাত্র খুলে তাদের উপরের সিলটা ভাঙতে শুরু করলাম। প্রত্যেকটা খুলে একটা করে নাম উচ্চারণ করলাম—সাব্বির… রায়হান… নাসির… জসিম… ফাহিম… রবিউল…
প্রতিটা নাম উচ্চারণের সাথে সাথে বাতাস ভারী হয়ে উঠতে লাগল। নিগারের শরীরের আশেপাশে একধরনের ধোঁয়া ঘুরছে—কালো, ঘন, আর বিষাক্ত।
আমি একটানা কাঁপতে থাকা হাতে সপ্তম পাত্রে নিগারের নাম লিখলাম—”নিগার রহমান”।
আর তখনই বাতি নিভে গেল।
ঘরের ভেতর নিঃশব্দ একটা ফাটার শব্দ হল—একটা কাঠের বাক্স ফেটে গেলে যেমন হয়। কিন্তু কোনো বস্তু না, যেন বাস্তবের গায়ে ফাটল ধরেছে।
আমি নিগারের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর শরীর ধীরে ধীরে শূন্যে ভাসছে। পায়ের তলা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আর সেই ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে চক্রাকারে ঘরের মেঝেতে একটা বড় বৃত্ত আঁকছে।
আমি চিৎকার করলাম, “যে কেউ তুই—যা চাস আমায় নিয়ে যা! নিগারকে ছেড়ে দে!”
অন্ধকারের মধ্যে নিগারের গলার আওয়াজ এলো, কিন্তু তাতে নিগার ছিল না—
“তুই তো জানিস না, তোর বাবাই প্রথম দরজা খুলে দিয়েছিল। ও সেইদিন ওর প্রথম সন্তানের বদলে ছয়জন মানুষের আত্মা তুলে দিয়েছিল। এবার শুধু তোর বউ না, তুইও আমাদের দরজা হবি।”
ঘরের দেয়াল থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করল। একটা দেয়ালে ভেসে উঠল একটা মুখ—বড্ড চেনা… আমার আব্বা। কিন্তু তার চোখ ছিল উল্টো, মুখ বিকৃত, আর ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছে।
সে বলল, “মাফ করে দিস… আমার ভুলের ফল তুই কেন পাবে?”
একটা ফাটল তৈরি হল মেঝের মাঝখানে। তার নিচে ছিল এক কালো গহ্বর, যেখান থেকে শ্বাস ফেলার শব্দ আসছিল, যেন এক বিশাল কিছু জেগে উঠছে।
আমি জানতাম, আমার সময় ফুরিয়ে আসছে।
আমি হাতে থাকা শেষ পাত্রটা, যেটায় নিগারের নাম লেখা, সেটাকে ছুড়ে মারলাম গহ্বরের মাঝখানে। সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। নিগারের শরীর নিচে পড়ে গেল। ধোঁয়া হাওয়ায় মিশে গেল।
তিন সেকেন্ড… নিস্তব্ধতা।
তারপর একটা দীর্ঘ চিৎকার… যা কোনো মানুষের নয়, কোনো জানোয়ারের নয়… একেবারে মাটির নিচের কোনো অন্ধকারের আওয়াজ।
সব থেমে গেল।
আমি নিগারকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরে এলাম। ও নিঃশ্বাস নিচ্ছে, চোখ ধীরে ধীরে খুলছে। আমি বললাম, “সব ঠিক হয়ে গেছে, নিগার… সব শেষ…”
কিন্তু সে শুধু ফিসফিস করে বলল, “শেষ? আমি তো এখনও সেই কুয়োর ভেতরেই আছি, মশিউর…”
আমার শরীর হিম হয়ে গেল।
রাত ৩টা ৪৫ বাজে। আমি এখন একটা হাসপাতালে বসে আছি। নিগার নিখোঁজ। আমি বলেছিলাম, সে সুস্থ। সবাই বলছিল, আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছি।
কিন্তু আমি জানি, নিগার আছে। আমি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি, ঘরের ছায়ায় কেউ দাঁড়িয়ে। তার মাথায় ঘোমটা, আর চোখ লাল।
সে শুধু একটা কথাই বলে—
“তুই তো বাক্স বন্ধ করলি, কিন্তু ফাঁদটা রয়ে গেল। এখন তো তুই আমার গল্প…”
ঘরের বাতি নিভে আসে মাঝে মাঝে। দেয়ালে রক্ত ছোপ দেখা যায়, পরদিন সেটা থাকে না। ঘড়ি উল্টো ঘোরে মাঝরাতে।
আমি জানি, আমি শেষ না। শুধু সময়ের অপেক্ষা। হয়তো পরের বলি আমি নিজেই।
গল্প শেষ না হলেও, বাস্তব এখানেই থেমে থাকে। শরীর কাঁপে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে—আর এক অন্ধকার আমাকে ডাকে… আমার নাম ধরে।
এবার সত্যিই কিছু একটা আসছে।
Share On:
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE