Golpo romantic golpo প্রেমতৃষ্ণা

প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯ ( প্রথম অর্ধেক+শেষ অর্ধেক)


#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_৩৯ ( প্রথম অর্ধেক)

কারাগারের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে প্রেম। মুখ গুঁজে রেখেছে দুই হাঁটুর ফাঁকে, দেহ কাঁপছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এক্ষণই ওকে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। অংকুর নিজ হাতে দিয়েছে। প্রেমের পুরনো সমস্যা যখনই মানসিক আঘাত বা অতিরিক্ত ট্রমা আছড়ে পড়ে, তখনই শরীরে সুগারের মাত্রা হঠাৎ নেমে যায় বিপজ্জনক পর্যায়ে। কিছুক্ষণ আগেও সে জ্ঞান হারিয়েছিল ঠান্ডা ঘামে ভিজে গিয়েছিল তার জামাকাপড়, ঠোঁট নীল হয়ে এসেছিল। তখনই অংকুর দৌড়ে গিয়ে ইনজেকশনটা পুশ করে, না হলে হয়তো এ মুহূর্তে প্রেম নিথর দেহ হয়ে পড়ে থাকত। ভাগ্যিস অংকুর নিজের কাছে প্রেমের এই ইনজেকশনটা রাখে। প্রেমকে কতবার বলেছে সবসময় এসব নিজের সঙ্গেই রাখতে। প্রেম এখন আগের থেকে ভালো আছে। কিন্তু শরীর সামলে উঠলেও মন তো এখনো তাণ্ডব করছে ভেতরে। মাথাটা ভনভন করছে, চোখদুটি রক্তাভ।

হাতে যেন স্থিরতা নেই, অবিরাম কাঁপছে। বারবার অংকুরের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলছে,

“ভাই… তৃষাকে নিয়ে আয়… তৃষাকে ফিরিয়ে আন… প্রত্যুষ কোথায় নিয়ে গেল ওকে?” অংকুরের কণ্ঠ কাঁপছে তবু সে শান্তভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে,

“সব ঠিক হয়ে যাবে প্রেম। তৃষা ফিরে আসবে। এই তো বাইরে কথা বলছে সে।” কিন্তু প্রেম কি বোঝে যুক্তি?

যার হৃদয়ে আগুন লেলিহান, সেখানে আশ্বাসের পানি ছুঁয়ে দিলেও , পৌঁছায় না। সে হঠাৎ মুখ তুলে তাকায়। মনে অনেক প্রশ্ন। প্রেম যেন নিজেই এখন প্রজ্জ্বলিত প্রশ্নচিহ্ন। যে প্রশ্নের উত্তর কারাগারের দেয়ালও জানে না।

থানা থেকে কিছুটা দূরে, নিঃসঙ্গ ও গাছপালায় আচ্ছাদিত একটা নির্জন প্রান্তর। বাতাসে কেবল পত্রপাতের মৃদু শব্দ, আর দূর থেকে ভেসে আসা কোনো পথভোলা কুকুরের ডাকে শূন্যতা আরও ঘন হয়ে উঠেছে এই স্থানে। সেই নিস্তব্ধতার মাঝখানে লোহার শীতল বেঞ্চটিতে পাশাপাশি বসে আছে প্রত্যুষ ও তৃষা।

প্রত্যুষ দীর্ঘক্ষণ নীরব ছিল। অবশেষে, এক অদ্ভুত সংকোচ আর ক্ষীণ সাহস মিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন করল,

“তুমি কি আমায় ভালোবাসো না, তৃষা? তোমায় তো প্রেম জোর করেই বিয়ে করেছিল, তাই না?”

তৃষা ধীরে মুখ তুলল। তার চোখ দুটি প্রত্যুষের চোখে স্থির হয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে একধরনের নির্ভীক স্থিতি।

সে বলল, “দেখুন, আমি ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে কথা বলতে জানি না। সরলভাবে সত্য কথাটাই বলব। আপনার ভাই, প্রেম নেওয়াজ—তাকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগেছিল। তবে কখনো তা প্রকাশ করিনি, কারণ তখনও নিজের অনুভূতির গভীরতা বুঝিনি।

পরে আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো আপনিই সেই মানুষ, যাঁর সঙ্গে জীবনটা কোনো শান্ত বাঁধনে বাঁধা যেতে পারে। কিন্তু সময়—সময় সবকিছু বদলে দিয়েছে। আজ আমি নিশ্চিতভাবে জানি, প্রেম নেওয়াজ ছাড়া আমি কিছুই নই।

দিনের পর দিন, তার অনুপস্থিতিতে আমি নিজেকে হারাতে বসেছিলাম। তাকে হারিয়ে যে যন্ত্রণা পেয়েছি, তা কেবল আমিই জানি, তার কোনো পরিমাপ নেই।

তাই ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে কিছুটা ব্যবহার করেছি। আপনার আবেগের উপর ভর করেই আমি চেষ্টা করেছি প্রেমকে ফিরে পেতে। যদি সেদিন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে না ঠিক হতো, হয়তো প্রেম কোনোদিন ফিরে আসত না। আপনি ভালো মানুষ, মিস্টার দেওয়ান। আপনি এমন একজন নারী ডিজার্ভ করেন, যে সত্যিই আপনাকে ভালোবাসবে, আমার মতো নয়। নিজেকে ভালো রাখুন। সুখে থাকার উপায় নিজেই খুঁজে বের করুন। একটি সামান্য বিষয়কে এত বিশাল করে তোলার কোনো মানে হয় না। আর আমাদের মধ্যে কোনো গভীর সম্পর্কও তো ছিল না—একটু সহানুভূতি, সামান্য যোগাযোগ, এই পর্যন্তই। আমি প্রেম নেওয়াজকেই ভালোবাসি। সে-ই আমার সবকিছু।

তার জায়গা কেউ নিতে পারবে না, কোনোদিনও না।

আপনি আজ আপনার নিজের ভাইকে জেলের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছেন। নিজের হাতে হাতকড়া পরিয়েছেন—একবার ভেবে দেখুন, মানুষটা আপনি কী করেছেন! ক্ষমতার প্রদর্শন যতই মধুর মনে হোক, তারও একটা সীমা থাকা প্রয়োজন। আমি চাই, আমি যেমন সব ভুলে গেছি, আপনিও ভুলে যান। কিন্তু মনে রাখবেন আমার স্বামীর গায়ে একটিমাত্র আঁচড় পড়লেও, আমি আর নীরব থাকব না। এই সতর্কবার্তাটাই আমার শেষ কথা, মিস্টার দেওয়ান।”

তারপর তৃষা উঠে দাঁড়াল। চোখে কোনো জল নেই, কণ্ঠে কোনো কাঁপন নেই। আছে কেবল ভয়ংকর দৃঢ়তা, যা নীরব রাতের বাতাসকে ছেদন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

“তোমার মাথা ঠিক আছে, তৃষা? কী বলছ তুমি? তুমি ভুলে গেছ, তোমায় তো প্রেম অপহরণ করেছিল! কী জাদু করেছে ও তোমার ওপর?”

তৃষা শান্ত, অনড় কণ্ঠে জবাব দেয়, “তার আমার ওপর কোনো জাদু করার প্রয়োজন নেই। আমি প্রথম থেকেই ওর প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম।”

প্রত্যুষ বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে, “সত্যি বলছো?”

“একদম সত্যি।”

“তোমার বুক কাঁপছে না?”

“কাঁপছে। কিন্তু যার জন্য এই কাঁপন, তাকে আপনি বন্দী করে রেখেছেন। আপনি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন, তবে অনুরোধ করছি—সব ভুলে যান।

প্রেমকে মুক্ত করুন। আমাদেরকে আমাদের মতো করে থাকতে দিন। আপনি নিজেও শান্তি পাবেন, আমরাও আমাদের সুখ ফিরে পাব।”

প্রত্যুষের চোখে তখন কুয়াশার মতো ঝাপসা জল৷ জল জমে আছে চোখের কোণে কিন্তু সে তা ফেলতে পারছে না। তার কণ্ঠ ভারী, তবুও কোনো অভিযোগ নেই, কোনো প্রতিরোধও নেই। শেষবার তৃষার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “যদি কোনোদিন মনে হয়, তোমার ফেরা প্রয়োজন, ফিরে এসো। আমার দরজা সর্বদা খোলা থাকবে। আমি, প্রত্যুষ দেওয়ান—তোমায় আমার হৃদয়ও দিলাম, মুক্তিও দিলাম। তুমি আমার মন নিতে চাওনি, নিয়েছো স্বাধীনতা। আমি তোমার ভালোবাসার পথে আর কোনোদিন দাঁড়াব না। কখনো হয়তো আর বলব না ভালোবাসি, কিন্তু ভালোবাসা থেমে থাকবে না।”

তৃষা ঠাণ্ডা গলায় বলল, “কথা শেষ? এবার থানায় চলুন। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে না গিয়ে আপনার সঙ্গে এসেছি কেবল এই কথাগুলো বলার জন্য।

প্রথমে সমাধান, তারপর বাকিটা দেখা যাবে।”

প্রত্যুষ উঠে দাঁড়ায়। মুখে যেন কোনো অনুভূতি নেই। তবু চোখের ভেতরে অস্থির স্রোত বইছে।

নিজেকে সামলে বলল, “আমার কিছু বলার অধিকার নেই আর, কথা তো ফুরিয়েই গেছে।”

তৃষা মাথা নাড়ল, “চলুন, থানায়।” থানায় পৌঁছে প্রত্যুষের নির্দেশে প্রেমকে কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়।

দরজার ওপাশে পা রাখতেই প্রেম ছুটে এসে তৃষাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে, যেন সে নিজের প্রাণ ফেরত পেয়েছে। তৃষা তার কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল, “আপনি ঠিক আছেন? শরীর কেমন?”

প্রেমের গলা রুদ্ধ, “তুমি কোথায় গিয়েছিলে, তৃষা?”

তৃষা মৃদু হাসে, “কোথাও যাইনি। আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবও না। বিশ্বাস রাখুন। চলুন, বাড়ি যেতে হবে সব শেষ, এখন শুধু আমাদের গল্প শুরু।”

প্রেম চলে যেতে উদ্যত, এমন সময় অফিসার ঠান্ডা স্বরে বলল, “একটু স্থির থাকুন, মিস্টার প্রেম। একটি কাগজে স্বাক্ষর বাকি আছে। তারপরই আপনি যেতে পারবেন।”

প্রত্যুষ তখন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। জীবনের নির্মম পরিহাস যেন তার সমস্ত অস্তিত্বকে বিদ্ধ করছে। এই জীবনের খেলাটা এমন নির্মম কেন? কী পেল সে? কী হারাল? আর তার সঙ্গে যা ঘটল, তা কি প্রাপ্য ছিল তার? প্রেমের বুকে তৃষাকে দেখে প্রত্যুষের বুকের ভেতর যেন কাচের মতো ভেঙে গিয়েছিল। নিজের ভালোবাসার নারীকে অন্য পুরুষের বাহুবন্ধনে দেখা— এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দুঃস্বপ্ন আর কিছু হতে পারে না। সেই মুহূর্তে সে বুঝল, ভালোবাসা আসলে স্বর্গীয় নয়, সর্বনাশী। ভালোবাসা মানে কখনও কখনও নিজের বিনাশ মেনে নেওয়া, প্রিয়জনের মঙ্গল চেয়ে নিজের সর্বনাশকে আলিঙ্গন করা। প্রত্যুষ জানে, সে যদি তৃষার জীবনে থাকে, তবে হয়তো তৃষার সুখে আঁচড় পড়বে। তাই সে সরে যাবে, অনেক দূরে। এমন দূরে, যেখানে তার ছায়াটুকুও যেন তৃষার সুখে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। তবু তার না-হওয়া ভালোবাসার মাঝে, তৃষা যেন সুখে থাকে সেই কামনাই সে করে। তার না-হওয়ার মধ্যেও তৃষার অস্তিত্ব যেন চিরস্থায়ী হয়ে থাকে তার বুকে, প্রতিটি নিঃশেষিত নিশ্বাসে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে প্রত্যুষ একবার চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর হাতের উল্টো পাশে চোখের জল মুছে মৃদু হেসে বলল,

“তারপর?

তারপর সে হাসল, আমি কাঁদলাম।

সে খুঁজে পেল আলো, আমি হারালাম আঁধারে ।

তারপর তার হলো মুক্তি, আমার হলো বন্দিত্ব।

সে হয়ে গেল দূর নক্ষত্র, আমি অন্ধকারের চাঁদহীন রাত।

শেষে আমি শুনলাম কেবল নিজের ভেতর ভাঙার শব্দ।

সে শুনল না, সে বুঝল না। সে আমাকে আমার মতো বাঁচতেও দিল না।” প্রত্যুষের বুকভাঙা আর্তনাদে যেন প্রকৃতির প্রতিটি সুর ভেঙে যাচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছেঅদৃশ্য সঙ্গীত, এক পুড়ে যাওয়া প্রেমের শোকগাথা। এই প্রত্যুষ যদি তৃষার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবার বলতে পারত,

“তোরে মন দিয়া, মন দিয়া আগুন জ্বালায় যে মনে…

মনের আগুন মনে জ্বলেরে…” তবে হয়তো পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর লাগত না।

তৃষা প্রেমকে ভেতরে রেখে থানার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অংকুর বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। থানায় তার দমবন্ধ লাগে। তৃষা অংকুর কাছে গিয়ে বলল, “কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করে নিয়ে এসো তো। আমি প্রেমের কাছে গিয়ে বসি। খেয়ে বাইকে উঠব। বাড়ি যাব।”

“প্রেমকে এই শরীরে বাইক চালাতে দিবে?”

‘নেভার। আমি আছি না?”

থানার অন্দরমহলে সোরগোল। জমজমাট মানুষের পদচারণা, কাগজের ভাঁজে পুলিশের ঘরোয়া ভ্রূকুটি। মাঝ বেঞ্চে বসে আছে শিমলা ও প্রেম। বেঞ্চের একপ্রান্তে বসা লোকজনের ভিড়। তাদের মাঝে একটি মেয়ে। কপালে চিন্তার রেখা, পাশে থাকা লোকের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বদ্ধ করে বসে আছে। আচমকা এক তরুণ ছুটে এলো। মুখে রক্তচাপের অস্থিরতা। পুলিশের চোখ মুহূর্তেই তাকে টেনে ধরে। পুলিশ গর্জন করে বলল, “এটা থানা — মাছের বাজার নয়।” কথা শুনে ছেলের বুদ্ধিমত্তায় কাঁটা পড়ে; তাকে থামিয়ে আনা হলো। লোকটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় সে চেঁচিয়ে বার বার একই কথা বলতে লাগল। ‘পাঁচটা বছর জানোয়ার তুই আমার সঙ্গে প্রেম করে এখন বড়লোক মাল ওয়ালা দেখে বিয়ে করেছিস? আমার জীবনের পাঁচটা বছর নষ্ট করে এখন তুই সুখে থাকবি? মেরেই ফেলব তোকে।’

শিমলার পাশে বসে থাকা মেয়েটি তখন তার পাশে বসে থাকা নিজের স্বামীকে বলল, ‘দেখেছো বললাম না ওই লোকের মাথায় সমস্যা আছে? এসব কি বলছে? আমি তো ওকে চিনিও না।’

‘সমস্যা নেই বউ পুলিশ বিষয়টি দেখবে। তুমি চিন্তা করো না।’ স্বামীর মুখ থেকে এহেন কথা শুনে মেয়েটি পুনরায় লোকটার দিকে তাকিয়ে স্বামীর কাঁধে মাথা রাখল। শিমলা তখন উঠে এসে প্রেমের পাশের সিটে বসল। কথা বলল না। তবে ফোনটা বের করে মেয়েটির দিকে তাকাল। চোখের চশমাটা ঠিক করে প্রেমকে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আজকে রাতের মধ্যেই কিন্তু এই ঝামেলা শেষ করতে হবে।’

প্রেম জবাব দিলো না। কেবল উঠে দাঁড়ালো। তৃষা তখন ভেতরে প্রবেশ করেছে মাত্র। সে তৃষার দিকে তাকিয়ে হাসল। হেসে মৃদু স্বরে শিমলাকে জবাব দিলো, ‘সকাল হতে না হতে খবর পেয়ে যাবে চিন্তা নেই।’

‘তাই যেন হয়।’

চলবে?

#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_৩৯ ( শেষ অর্ধেক)

প্রেমের বান্দরবানের শখের কাঠের বাড়ি প্রিমরোজে ফিরতে খুব একটা সময় লাগলো না। রুমে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে প্রেম বসে পড়ল। মুহূর্তেই তার কোলে মাথা রেখে তৃষা বলল, ‘আপনাকে আমি কখনো দূরে যেতে দেব না প্রেম। জানেন আপনার জন্য আনা পুতুলটার চুলের রঙ আমি বদলে দিয়েছি? ওটা এখন দেখতে আপনার মতো।’

‘দেখা হয়নি। কখন করলে?’

‘ওই যে ওইদিন কটেজে। মাঝ রাতে আপনি যখন ঘুমিয়েছিলেন। তখন ওঠে গেলাম। নতুন চুল তো লাগাতে পারিনি তাই কটেজের একটা লোককে দিয়ে রঙ আনিয়ে রঙ করেছি বাইরে বসে বসে। এমা জানেন কি হয়েছে? হঠাৎ করে কি যে বৃষ্টি। ওইসব দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। এই যে এই টুকুনি ভিজেছি।’

‘সকালে ড্রয়ারে সিরিঞ্জ পেয়েছি। ইনজেকশন কি তুমি আমার হাতে দিয়েছিলে?’

তৃষা একটু চুপ করে পুনরায় বলল, ‘আর কে দিবে?’

‘কিসের ইনজেকশন জানো?’

‘সুগারের।’

‘কে বলল?’

‘সন্ধ্যায় অংকুর ভাই বলেছিল। বলল প্রতিমাসে আপনার একটা নরমাল সুগারের জন্য এমনিতে নাকি ইনজেকশন দিতে হয়। এত যে নেশা করেন এসবের ফল এগুলো। অংকুর ভাই ওটা হাতে নিয়ে বলল, আজকে ইনজেকশন দেওয়ার ডেট। আপনার হাতে যেন দিয়ে দেই। পরে আমার মনে ছিল না। রাতে ঘুম ভাঙার পর মনে আসতেই দিলাম। আমি ভুল জায়গায় দিয়েছি কি? আমি তো জানি না কোথায় দেয়।’

‘উঁহু পারফেক্ট ভাবেই দিয়েছো সোনা।’

প্রেম তৃষার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘তোমায় অনেক দিন ধরে বলব, বলব করে একটা কথা বলা হয়নি আমার।’

‘কি কথা?’

‘হিমিকা গুলজার আর পরাগ নেওয়াজের কথা।’

‘তারা কে?’

‘আমার পিতামাতা।’

তৃষার ওইদিনের কথা মনে পরে যায়। এই তাদের কথা তুলেই তো একমাসের জন্য হারিয়ে ফেলেছিল সে প্রেমকে। তবে এই মানুষগুলো কি করে হারালো তা এখনো জানা হয়নি। ‘আমার মা বাবার প্রেম করে বিয়ে। শুরুতে তাদের সম্পর্ক ভালোই যাচ্ছিলো। তারপর আমি জন্ম নিলাম। সবাই কত খুশি। তবে আস্তে আস্তে যত বড় হচ্ছিলাম ততই বুঝতে পারছিলাম বাবা-মায়ের সম্পর্কটা আর সুস্থ নেই। ওই যে প্রেম, প্রেম একটা বিষয় ওটা আর নেই। মা রোজ কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে ঝামেলা করতোই। বাবা বিষয়গুলোকে সামলানোর চেষ্টা করলেও মা সব বিগড়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। দেখতে দেখতে ১৯ এ পা রাখলাম। ১৯ ছিল আমার ধ্বংসের প্রথম ধাপ। দেখো তৃষা আমি কখনো খারাপ মানুষ হতে চাইনি। কিন্তু কি করে হয়েছি জানো? কারন আর দশটা মায়ের মতো আমার মা আমায় রাতে বুকে টেনে ভালো মানুষ হওয়ার গল্প শোনায়নি। ঘুম পারায়নি। ঘরে অশান্তি করে মা রান্না বন্ধ করে দিতো। বাবা রাগ করে বাইরে থাকত। ওমন সময় দাদু আমায় যা পারতেন, দেখা শুনা করতেন। মায়ের শাসন, যত্নের অজান্তে কখন যে খারাপ হয়ে গেলাম। আমি জীবনে প্রথম মদ খেতে দেখেছিলাম কাকে যানো? আমার মাকে? বাবার বিজন্যাস ফ্রেন্ড মুইন কাকা প্রায় আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। মানুষটিকে পছন্দ করতাম। কেন জানো? কারণ প্রতিবার বাড়ি আসার সময় সঙ্গে করে আমার জন্য চকলেটের বক্স নিয়ে আসতেন। তার চকলেটের কোম্পানি ছিল বাবা সেখানকার ৩০% শেয়ার হোল্ডারের মালিক ছিলেন। সেই চকলেট খেয়ে আরামের ঘুম দিতাম। তখনো বুঝতে পারিনি আমার পছন্দের আংকেল আমাকে নেশাযুক্ত চকলেট খাইয়ে ঘুম পারিয়ে আমার মায়ের সঙ্গে এক বিছানায়……. ‘ প্রেম থামল। কথা গুলো বলতে গিয়ে ঢোক গিলতেও কষ্ট হলো। তৃষা উঠে বসে আরো মনোযোগ দিলো। প্রেম পুনরায় বলা শুরু করল, ‘আমার বয়স যখন ১৯ সেদিন আমি প্রথম মা আর সেই আংকেলকে ওইভাবে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আবিষ্কার করি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে সময় লেগেছ আমার।’ সেই রাতে আমি রুমের মেঝেতে পরে ছিলাম। সুগার লো হয়। বেহুঁশ হয়ে মেঝেতে পরে ছিলাম। পরদিন বাবা এসে আমায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই জানতে পারলাম মা বাবাকে ডিভোর্স লেটার দিয়ে বাসা থেকে চিঠি লিখে পালিয়ে গেছে। অনেকদিন মাকে দেখিনি। তারপর মাঝে মা ফিরে আসে। তখনো আমি বলতে পারিনি আমি মাকে, কার সঙ্গে কোন অবস্থায় দেখেছিলাম। ওই নোংরা শব্দ গুলো উচ্চারণ করার ক্ষমতা আমার আজও হয়নি। আজও না। মাকে নিয়ে কি করে এসব বলি? মা হয় তো। শেষে বাবা আর মায়ের ডিভোর্স হয়। তার বছরের পর বছর পরকীয়া করার বিষয় জানার পর নেওয়াজ পরিবারের সবাই ভেঙে যায়। বাবা ডিভোর্সের পক্ষে কখনো ছিল না। সে সুযোগ চেয়েছিল। তাতে মায়ের কি? সে আমাকে, বাবাকে রেখে নতুন স্বামীর সঙ্গে চলে গেল। বাবার ব্যবসা ধ্বসে পড়ল। মা নতুন স্বামীর সঙ্গে চলে যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় জানতে পারলাম তার ভয়াবহ মৃত্যু হয়েছে। খুন হয়েছে সে। সেই খুনের রহস্য আজও অজানা। মা তার পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে আমার বাবাকে বিয়ে করার পরই নাকি শুনেছিলাম তার পরিবার তাকে মেনে নেয়নি। বিয়ের পর তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। মেয়ের মৃত্যুর খবরও জানতে পারেনি তারা। যাক সেইসব কথা বাদ। তবে শুনেছিলাম মুইন আংকেলই নাকি মাকে খুন করেছিল। মানুষ এটাই বলত। ওই লোকও এখন বেঁচে নেই। এক্সিডেন্ট করেছিল। কয়েক বছর বেঁচে ছিল ওই অবস্থায়। পরে মারা যান। ছোট থেকেই বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হওয়া এই আমিটা একগুয়ে ছিলাম। ঝগড়া করতাম, ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতাম। আচ্ছা এসবের জন্য আমি দায়ী ছিলাম তৃষা? পেরেন্স ডে তে সবার বাবা-মা আসত, আমার পরিবারের মানুষ আসত না এখানে আমার দোষ কথায়? ওই দাদু ছাড়া কেউ আমায় বুঝেনি তৃষা। ধীরে ধীরে সময় কাটে। আমি ২৩ এ পা রাখি। মা চলে যাওয়ার পর বাবা সব ছেড়ে আমার টেককেয়ার করেছেন। ভরসা যুগিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। আমি ভাবলাম এই বুঝি আমার জীবন এত পরে হলেও এখন সুন্দর হতে চলেছে। তবে ২৩ এ আমার সঙ্গে কি হলো? বাবাকে আবিষ্কার করলাম একটা মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে ওই মেয়ে টা আর কেউ না আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড।।তাও নিজের বাসায়। আমার পরিবারের কারণে আমার পড়ালেখা অনেক বার থেমেছে। কবেই এই পড়ালেখা শেষ হয়ে যেত! ভার্সিটিতে যাওয়ার পর অনেক বন্ধু হয়। আমার কাঠের বাড়িটায় সবাই মিলে আড্ডা দিতাম, গানের আসর বসাতাম। আমাদের সার্কেলে রাফা নামক একটা মেয়ে ছিল। সেও আমাদের বাসায় প্রায় আসা যাওয়া করত। বাবা নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসত। তার নাকি মেয়ের অনেক শখ ছিল। তবে মেয়ে হতে পারল কই? বাবা আর বিয়ে করেননি। জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছিল শেষে প্রেমকে মানুষ করার তাগিদে। সেই বাবাকে যখন নিজের ক্লাসমেটের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম ঠিক ১৯ বছরের ঘটনা পুনরায় মনে পরে গেল। সেদিন মারাত্মক শরীর খারাপ হয়। এক সপ্তাহের মতো হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। অংকুরটা না থাকলে কি যে হতো। বাসায় ফিরে বাবাকে দেখতে পেলাম না। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাবাকে দেখেনি। কি হয়েছে তার, কোথায় আছে জানি না। তবে জিনিয়া রাফার লাশ দেখেছিলাম। আত্মহত্যা করেছিল সে। এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটনাগুলো ঘটে। আজও পুলিশ আত্মহত্যার পেছনকার রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। দেখো তৃষা ওইসবের পর থেকে ভরসা নামক কোনো শব্দকেই আমি বিশ্বাস করেনি। এসব বিশ্বাস, ভরসা করা ছেড়ে দিয়েছি। নেশা, বাজে কাজে এত ভয়াবহ ভাবে লিপ্ত হয়ে যাই। তৃষা এখনো মাঝে মাঝে আমার মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। ১৯ আর ২৩ বছরের সেই দুটো দুঃস্বপ্ন আমায় ঘুমাতে দেয় না। আমি ভরসা করব তো কাকে করব? দেখো আমি তোমার আগে কাউকে ভালোবাসিনি। কি করে ভালোবাসতে হয় জানা নেই। আমার ভালোবাসায় অনেক ভুল ক্রুটি থাকতে পারে। তুমি অন্তত আমায় ভুলে যেও না। এবার তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমি নিশ্চিত মারা যাব। আমায় আর কেউ মৃত্যুর হাত থেকে ফেরাতে পারবে না তৃষা। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমায় ভালোবেসেছি, আমায় যুদ্ধে হারিয়ে পরাজিত সৈনিক সাব্যস্ত করো না।’ প্রেম তৃষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এক মুহূর্তে সে অন্য এক প্রেমকে আবিষ্কার করল। এত ভয়ানক শৈশব? এই ট্রমা এখনো লোকটিকে মেরে খাচ্ছে? এসব যদি তৃষা একবার জানত! তাহলে সেদিন রাতে কখনো প্রেমকে ওইভাবে কষ্ট দিয়ে কথা গুলো বলত না। আসলে মানুষ এমনি এমনি খারাপ হয় না, খারাপ হওয়ার জন্যও কারণ থাকা লাগে। প্রেমের মতো তৃষার চোখেও জল। সে প্রেমকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপনাকে ছাড়া আর মৃত্যুকে বরণ করা সমান কথা। আমাদের বিচ্ছেদ এপারে হচ্ছে না। ওপারের কথা জানি না তবে ওপারে একটা সুযোগ পেলে আমি চাই আপনার আমার দেখা আবার হোক। আমরা আবার প্রেমে পড়ি একে অপরের, আবার বিবাহের মিষ্টি বন্ধনে আবদ্ধ হই।’

প্রেম বাচ্চার মতো গুটিয়ে নিয়ে পুনরায় বলল, তুমি জানো, আমি পাপি হয়ে জন্মাইনি।

আমি একসময় বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসা মানুষকে খোদার কাছাকাছি নিয়ে যায়। কিন্ত এখন বুঝি—খোদা হয়তো হাসেন যখন কেউ এমনটা ভাবে। তবে তোমায় ভালোবেসে আমি আবার বিশ্বাস করতে চাই৷ কেবল তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। আমাকে দোষ দিও না…

আমি ভালো ছিলাম, সত্যি বলছি,

কিন্তু এই পৃথিবী আমাকে ভালো থাকতে দেয়নি। ভালোবাসেনি, আপন করে নেয়নি তৃষা।’

তৃষার চোখের জল প্রেমের সঙ্গে বেগ পায়। কথায় আছে না, “মানুষ পাপ নিয়ে জন্মায় না, তবে পাপ নিয়ে মৃত্যু বরণ অবশ্যই করে।” তবে পাপ ছাড়তেও কিন্তু পারে। সে প্রেমকে বুকের থেকে ছাড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকাতে বলল, ‘এই যে আমি আছি তো। আমি আপন করেছি তো, আমি ভালোবাসি তো। পৃথিবীকে ভুল প্রমাণ করে দিব। খোদা আবার মুচকি হাসবে প্রেম, আমাদের সুন্দর সমাপ্তি দেখে এবার তিনি আবার মুচকি হাসবেন। প্রেম

কথা বলল না। কেবল তৃষার বুকে জড়িয়ে রইল। হঠাৎ বলল,’ ভালোবাসি তোমায়।’ তৃষা চোখের জল আড়াল করে জিজ্ঞেস করল, ‘কতখানি?

‘হিসাব চাইছো? ভালোবাসারও সংখ্যা আছে? পরিমাপ আছে? আচ্ছা তবুও বলছি, আমি তোমায় ভালোবাসি ঠিক ততটুকু যতটুকু অপেক্ষা মরুভূমির ক্লান্ত পথিক আকাশ পানে চেয়ে বৃষ্টির জন্য করে। আমি তোমায় ততখানি ভালোবাসি যতখানি নদী তার কূলকে ভালোবেসে দিনের পর দিন কিনারা ছুঁয়ে আবার ফিরে যায়, তবু প্রতিবার ছোঁয়ার সময় ভাবে, ‘আজই শেষবার।’

‘তাহলে আপনি কি কখনও আমাকে ছাড়বেন?’

‘কভু নয়। তুমি যদি সূর্য হও, আমি হবো ছায়া, তুমি যেদিকে যাবে, আমি অন্ধকার হয়ে তোমার পায়ের নিচে প্রতিবার মিশে যাব। আমি আলো চাই না, আমি শুধু তোমার অস্তিত্ব চাই।’ প্রেম মাথা তুলল। তৃষার চোখের কোণের জলের দিকে তাকালো। কেমন যেন নেশা নেশা লাগছে। অত্যাধিক গরমও সেই সঙ্গে লাগছে। সে হাত দিয়ে তৃৃষার চোখের জল ছুঁয়ে দেখল। অতঃপর চোখের কোণে চুমু এঁকে দিলো। তৃষা তখনো নিশ্চুপ। হঠাৎ প্রেম বলে উঠল, ‘আমার শার্টের বোতমটা খুলে দেবে?’ তৃষা কথা বাড়ালো না। বোতামে হাত লাগাতেই প্রেম বাতি বন্ধ করল। তৃষাকে অন্ধকারে কাছে টেনে বলল, ‘আবারও বলছি ভালোবাসি।’

চলবে?

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply