#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা
#সাদিয়া
#পর্ব_৩৩
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আজ এতদিন পর কোথা থেকে একজন অপরিচিত ছেলে এলো সে নাকি জাহানারা বেগমের মেয়ে জামাই। জাহানারা বেগম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাজকে। না ছেলেটা দেখতে মন্দ নয়। মেয়ের পছন্দ আছে বলতে হবে। পোশাক আশাক দেখেও তো বেশ ভালো ঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। মনির সাহেব মারা যাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিল জাহানারা বেগম তার মধ্যে মৌমিতার মুখে হঠাৎই বিয়ের কথা বিষ্ফোরন ঘটিয়েছিল। তারপর অনেকবারই জাহানারা বেগম চেষ্টা করেছেন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কিন্তু মেয়ে কখনওই রাজী ছিলেন না। মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তার চিন্তায় এই বুড়ো বয়সে দিন কাটছিল তার। এই সময়ে তাজের আগমন কি তার চিন্তা দূর করতে পারবে? নাম না জানা অপরিচিত কোনো ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে মেয়ের মেনে নিতে পারে না কোনো পিতা মাতাই। মেয়েদের বিয়ে নিয়ে যেন একটু বেশিই খুঁতখুঁতে থাকে বাবা মা। তেমনি প্রথমে সবটা মেনে নিতে পারেনি জাহানারা বেগমও বারংবার মেয়ের আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলে দেখেছে তবে মেয়ে বারবার বিষয়টা এড়িয়ে গেছে। মৌমিতা মুখে না বললেও সে বেশ বুঝতে পেরেছিল মেয়ের মনে কি চলছে। মায়েদের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে সন্তানদের মনের কথা বোঝার। আর জাহানারা বেগম কোনো কালেই সেই মায়েদের দলে ছিলেন না যারা সন্তানের মনের কথার গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের ইচ্ছে বড় করে দেখে সন্তানের সাথে জোর জাবরদস্তি করবে। মৌমিতা যেখানে খুশি জাহানারা বেগমও সেখানেই খুশি। মেয়েকে জোর করেন না তিনি, অপেক্ষা করতে থাকে মেয়ের গোপনে বিয়ে করা জামাইয়ের জন্য। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে তিনি বারবারই হতাশ হয়েছেন। অবশেষে দেখা মিলল মেয়ের জামাইয়ের।
তাজ অবাক চোখেই শ্বাশুরি এবং শালাকে দেখছেন। দুজনের চোখ মুখেই চমকানো স্পষ্ট তবে কি এরা সবাই মৌমিতার সাথে ওর বিয়ের কথা জানে? মৌমিতা বলে দিয়েছে সবাইকে? জাহানারা বেগম নম্র কন্ঠে বলল – তুমি কি সত্যিই আমার মেয়েকে বিয়ে করেছো?
তাজ মাথা নিচু করে জবাব দিলো – হ্যা।
জাহানারা বেগম খুশি হলেন নাকি রেগে গেলেন ঠিক বোঝা গেল না তার চেহারা দেখে। নিজের রুমে নিয়ে গেলেন তাজকে বসার জন্য আদেশ দিলেন। তাজও বাধ্য ছেলের মতো বসে পড়লো। জাহানারা বেগম শান্ত কন্ঠে শুধালো – নাম কি তোমার? কে কে আছেন তোমার?
– আমার নাম আবরার তাজ। মা নেই আর বাবা থাকতেও নেই। বাবার সাথে দেখা হয় না কথা হয় না অনেক দিন হলো।
কষ্ট পেলেন জাহানারা বেগম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর কন্ঠে শুধালো – কবে বিয়ে করেছো তোমারা?
– প্রায় দুই বছর আগে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহানারা বেগম। শান্ত কন্ঠে বলল – আমি তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম।
অবাক হলো তাজ , চকিত দৃষ্টিতে জাহানারা বেগমের দিকে তাকালো সে। জাহানারা বেগম একটু থেমে বললেন – যখন শুনেছিলাম মৌমিতা কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করেছে তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি। ওর বাবা থাকলে তিনিও অনেক কষ্ট পেতেন। দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে কত কষ্ট করে ছোট থেকে বড় করেছি ওকে। ওর বাবার প্রান ছিল ও। ওর বিয়ে নিয়ে ওর বাবার আর আমার কত স্বপ্ন ছিল মুহুর্তেই ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে প্রচন্ড রাগ হয়েছিলাম ওর উপর। কিন্তু মা তো রাগটা বেশিক্ষণ রাখতে পারেনি। যখন আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী ওর নামে কুৎসা রটাতে ব্যস্ত তখন ভাবলাম ওর আর আছে কে আমি ছাড়া? বাবা তো চলে গেল । আমি মা হয়েও যদি ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই তখন মেয়েটা বাঁচবে কি করে? হাজার কষ্ট মাটি চাপা দিয়ে মেয়েটাকে আগলে নিয়েছিলাম নিজের বুকে। মেয়েটাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি তোমার কথা তবে কখনও কিছু বলেনি সবসময় কথা এড়িয়ে গেছে। তখন তোমার কথা জানলাম মাহিমের কাছ থেকে। তবে তোমাকে চোখের দেখার বড্ড শখ জেগেছিল তখন। মাহিমের কথা শুনে ভেবেছিলাম তুমি মৌমিতাকে খুঁজতে খুঁজতে আমাদের কাছ পর্যন্ত চলে যাবে। কিন্তু অনেকটা দিন কেটে যাওয়ার পরও যখন তুমি এলে না তখন ভাবলাম হয়তো তুমি আর আসবে না। মৌমিতার আবার বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু মেয়ে আমার কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। কি করবো বলো বাপ মরা মেয়ে মানুষ কুৎসা রটায়। চরিত্র নিয়ে বাজে মন্তব্য করে আমার মেয়ের। মা হয়ে কিভাবে সহ্য করবো মেয়ের অপমান? মেয়েটার মাথার উপর ছাদ নেই। বড়ই চিন্তিত ছিলাম মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে। আর মেয়েটাও দিন দিন একরোখা, বদমেজাজি, নীরব হয়ে যাচ্ছিল। আমার সেই হাসিখুশি চঞ্চল মৌমিতা হারিয়ে গেছে।
আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদলো জাহানারা বেগম। তাজ বলল – এখন আমি এসে গেছি। চিন্তা করবেন না আপনি। এখন থেকে মৌমিতার সব দায়িত্ব আমার। কেউ আর মৌমিতার দিকে আঙুল তুলতে পারবে না কথা দিচ্ছি আমি। আমি আপনাদের ভীষণ খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি। আপনাদের কোনো ঠিকানাও ছিল না আমার কাছে। অবশেষে এই দেড় বছর পর অবসান ঘটলো আমার খোঁজার খুঁজে পেলাম আপনাদের।
তাজ একে একে তার অতীত বর্তমান বলা শুরু করল জাহানারা বেগমকে। জাহানারা বেগম অবাক হয়ে শুনছেন। নিজের রুম থেকে মাথায় গামছা পেঁচাতে পেঁচাতে এলো মৌমিতা। বাহির থেকে এসেই গোসলে ঢুকেছিল সে তাই এদিকে কি হয়েছে না হয়েছে টের পায়নি কিছুই। বাহিরে যা গরম তার উপর শপিং মলে ঘুরিয়েছে অনেকক্ষণ বাসায় এসে পানির ছোঁয়া না পেলে যেন শান্তি পাচ্ছিলো না সে। তাই এসেই গোসল করতে চলে গিয়েছিল।
– কে এসেছে মা?
জিজ্ঞেস করতে করতে মায়ের রুমে যেতেই পা জোড়া থমকে গেল মৌমিতার। চমকে গেল সে। তাজ এখানে কি করছে? বাড়ির মধ্যেও চলে এসেছে এখন।
মৌমিতা চকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল – আপনি এখানে? কেন এসেছেন?
তাজ কিছু বলল না, জাহানারা বেগম তেতে উঠে বলল – এ বাড়ির জামাই এখানে থাকবে না তো রাস্তায় থাকবে?
হতবাক মৌমিতা। তার মানে এসে পরিচয় দিয়ে তার মায়ের সাথে ভাব করাও হয়ে গেছে। ভ্রু কুঁচকে এলো মৌমিতার। বিরক্ত কন্ঠ নিয়ে বলল – এসেছে যখন বিদায় হতে বলো।
জাহানারা বেগম রাগী কন্ঠে বলল – এটা কেমন কথা মৌমিতা?
তাজ শান্ত হতে বলল জাহানারা বেগমকে, বলল – আপনি শান্ত হন আন্টি আমি এমনিতেও এখনই চলে যাবো। আমি শুধু এগুলো দিতে এসেছিলাম আপনাদের।
– আন্টি কাকে বলছো? মা বলো মা।
ছলছল করে উঠলো তাজের চোখ জোড়া। কত বছর পর সেই মধুর ধ্বনিতে আবার কাউকে ডাকবে সে। নিজের মাকে তো সেই ছোট বেলায়ই হারিয়েছে, পরে মায়ের অভাব পূরণ করতে নিয়ে আসা হলো সৎ মাকে। সৎ মা সে তো সৎ মাই থেকে গেল কখনও নিজের মা হয়ে উঠেছে পারলো না। তাজ একটু আবেগী কন্ঠেই বলে উঠলো – এখন তাহলে আমি আসি মা, আবার আসবো।
– কোথায় যাবে তুমি? এখন থেকে তুমি এ বাড়িতেই থাকবে। এটা তো তোমারও বাসা । এখানে তোমার নিজের বাসা থাকতে তুমি হোটেলে কেন থাকবে?
চকচক করে উঠলো তাজের চোখ দুটো। ঠোঁটে গা জ্বালানো হাসি নিয়ে মৌমিতার দিকে তাকালো সে। মৌমিতা যেন আকাশ থেকে পড়লো। অবাকের সুরেই বলল – এখানে কোথায় থাকবে উনি? না না এখানে থাকতে পারবে না উনি।
জাহানারা বেগম রাগ দেখিয়ে বলল – ও আজ থেকে এখানেই থাকবে।
– এখানে কোথায় থাকবে উনি? মাত্র তিনটা রুম এখানে। একটা তোমার, একটা আমার আর একটা মাহিমের। তুমি তো জানোই মাহিম কারো সাথে রুম শেয়ার করতে পারে না।
জাহানারা বেগম ভাবলেশহীন ভাবে বলল – কেন তোর রুমে থাকবে।
– আমার রুমে থাকবে মানে? উনি আমার রুমে কেন থাকবেন?
– কোথাও শুনেছিস স্বামী স্ত্রী আলাদা রুমে থাকে?
– কিসের স্বামী স্ত্রী। মানি না উনাকে আমি স্বামী হিসেবে।
– বিয়ে করার সময় তো কাউকে না জানিয়ে একা একা লুকিয়ে বিয়ে করে ফেললি আর এখন স্বামী হিসেবে মানিস না, বিয়েটা কি তোর কাছে ছেলে খেলা মনে হয়?
– বিয়ের কোনো প্রমান আছে উনার কাছে? আমাদের আইনত কোনো বিয়ে হয়নি বা বিয়ের কোনো ডকুমেন্ট নেই। আমি উনার সাথে এক রুমে থাকবো না কিছুতেই না।
– বিয়ের প্রমান নেই মানে?
মৌমিতা একটু থেমে বলল – আমাদের আইনত বিয়েটা হয়নি শুধু মাত্র কাজী ডেকে মৌখিকভাবে বিয়ে হয়েছিল।
– সেটা কি বিয়ে না? আমাদের দাদী নানিদের তো এভাবেই বিয়ে হয়েছিল তাই বলে কি তারা ঘর সংসার করেনি?
– ওসব আমি জানি না আমি শুধু জানি আমি আইনত উনার স্ত্রী নই তাই এক রুমে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
জাহানারা বেগম কিছু বলবে তার আগেই তাজ সবাইকে একটু অপেক্ষা করতে বলে বাইরে গেল। মিনিট পাঁচেক পর একটা কাগজ নিয়ে আবার রুমে প্রবেশ করলো। কাগজটা জাহানারা বেগমের হাতে দিয়ে বলল – এই আপনার মেয়ে আর আমার বিয়ের প্রমান মা। আপনার মেয়ে ইসলামীক মতেও আমার স্ত্রী আর আইনতও।
অবাক হলো মৌমিতা। আইনী মতে তাজকে কখন সে বিয়ে করলো? জাহানারা বেগমের হাত থেকে ছো মেরে কাগজটা নিয়ে গেল মৌমিতা। কাগজটায় ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো না তাজ ঠিক কথাই বলছে। চকিত দৃষ্টিতে তাকালো তাজের দিকে। তাজ একটু এগিয়ে গিয়ে মৌমিতার পাশে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বলল – আবরার তাজ কখনও কাঁচা কাজ করে না। দেড় বছর আগে তো আরও আমি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। সব সময় তোমাকে হারানোর ভয়ে থাকতাম। সেখানে তুমি ভাবলে কি করে আমি এত বড় একটা ভুল করবো? সুযোগ বুঝে আমি আইনী মতে বিয়েটাও সেরে নিয়েছিলাম। আমি তখন মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলাম ঠিক তবে বোকা ছিলাম না। আমি খুব ভালোভাবেই জানতাম এই সমাজে ঐ মৌখিক বিয়ের কোনো দাম নেই। তোমাকে পেতে হলে, আমার কাছে আটকে রাখতে হলে , তোমার বাবা মায়ের সামনে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই আমার আইনত বিয়ে করার প্রয়োজন ছিল যেটা তুমি তখন চাইছিলে না। বার বার শুধু এক কথাই বলেছিলে বাবা মাকে আগে সবটা জানাবে তারপর আবার বিয়ে করবে তখন আইনত বিয়ে করবে। কিন্তু আমি যে পারছিলাম না। ভিতরে ভিতরে তোমাকে হারানোর ভয় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো তাই গোপনে সুযোগ বুঝে তোমার সাইনটা নিয়ে নিয়েছি।
হতবম্ব মৌমিতা। তাজ যে এমন কিছু করেছে সেটা ওর জানাই ছিল না। এই লোকটা ভীষণ সেয়ানা বটে। তাজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মৌমিতা। তাজের ঠোঁটে বিশ্ব জয়ের হাসি। গা জ্বলে যাচ্ছে মৌমিতার। ইচ্ছে করছে তাজকে নিয়ে ১০ তালা বিল্ডিং – এর উপর দিয়ে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিতে। তবে যদি একটু শান্তি লাগতো। জাহানারা বেগম অবার আদেশের সুরে বলল – ও আজ থেকে তোর রুমে থাকবে। রুম ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রাখিস।
তাজ যেন আজ ঈদের মতো খুশি। মেঘ না চাইতেই যেন জল পেয়েছে সে। এমন একটা শ্বাশুরি থাকতে জীবনে আর কি লাগে?
তাজের দিকে ফিরে তাকালো জাহানারা বেগম । আদুরে কন্ঠে বলল – যাও বাবা ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি খেতে দিচ্ছি। বিকালে হোটেলে গিয়ে তোমার সকল জিনিসপত্র নিয়ে এসো।
চলবে….
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৭
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৬
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৮
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৩
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৯
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৯
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২০
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৮