#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_২৮ ( প্রথমাংশ)
প্রেম দরজাটা হুড়মুড় করে এমন জোরে ধাক্কা দিল যে পুরো ঘর কেঁপে উঠল। টিশার্টটা হাতে কষে চেপে নিয়ে তৃষাকে শক্ত করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। যাওয়ার সময় শুধু একটা জিনিসই হাতে নিল—মদের বোতলটা। আটাশ বছরের গহীন ক্ষত, বুকের গভীরে চাপা দেওয়া দগদগে জখমটা আবার আজ নতুন করে রক্তাক্ত হয়ে উঠল। তৃষা এখনো শ্বাস নিচ্ছে, বেঁচে আছে এটাই যেন তার ভাগ্যের সীমাহীন সৌভাগ্য। প্রেমের ঝড়ের মতো প্রস্থান শেষে, ঘরটায় হঠাৎ মৃত্যু-নেমে আসা নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল। তৃষার বুকের ভেতর তখন তীব্র শূন্যতার চাপা শব্দ। সে ঠাহর করতে পারল কী অমোঘ পাপ করেছে সে! যে মানুষের শিকড় কেটে নেওয়া হয়েছে অনেক আগে, যার মা-বাবা নেই, যার স্মৃতি কেবল ক্ষতের মতো রক্তাক্ত, তাকে সে কীভাবে এত বড় আঘাত দিল? কোন দুঃসাহসে ছিঁড়ে দিল তার পুরোনো দাহকে? চোখের জল তৃষার মুখ ভিজিয়ে দিতে লাগল। কাঁপা হাতে জল মুছে দৌড়ে বেরিয়ে এলো সে। কিন্তু তখন? প্রেম তো ঝড় তুলে বাইক নিয়ে যান্ত্রিক শহরের অতলে মিলিয়ে গেছে। বাড়ির সীমানা অনেক আগেই তার চাকার শব্দকে বিদায় দিয়েছে। এ বিশাল শহরে, পাথরের মতো ঠান্ডা এই নগরে, তৃষা কোথায় খুঁজবে তাকে? কার ভিড়ে, কোন অচেনা রাস্তায়, কোন গহীন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে সেই মানুষ, যার বুকের আগুন সে নিজ হাতে আবার প্রজ্বলিত করেছে?
তৃষা বাইরে পা রাখতেই শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো হয়ে গেল। হাত কাঁপতে কাঁপতে প্রথমেই তাড়াহুড়োয় অংকুরকে ফোন করল সে। কান্নাজড়ানো গলায় সবটা খুলে বলতেই অংকুর এক নিঃশ্বাসে আশ্বাস দিল,
“চিন্তা করো না, আমি দেখছি।” কিন্তু সেই কথার ভরসাতেও তৃষার বুকের গভীরে জমে থাকা অস্থিরতা একচুল কমল না। এই অস্থিরতা তাকে বারবার মনে করাচ্ছে, প্রেমকে না খুঁজে পাওয়া মানে নিজের অর্ধেক শ্বাস হারিয়ে ফেলা। মাথা কাজ করছে না, দিক-দিশা বোঝা যাচ্ছে না। অবশেষে অস্থিরতায় দগ্ধ হয়ে যখন বাইরের গলিপথে ছুটে যাওয়ার জন্য পদক্ষেপ ফেলল, তখনই সামনে প্রত্যুষ এসে পথ আটকাল। প্রত্যুষ জানে না আসল ঘটনা, জানে না তৃষার বুকের ঝড়টা কেন উঠছে। তবে এক নজরে বুঝে গেছে সে, তৃষার অবস্থা বাইরে যাওয়ার মতো নেই। কেবল এই কারণেই কঠোর হাতে আটকাল তৃষাকে। কিন্তু শুধু প্রত্যুষ?
না। হেতিজাও সামনে এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। তার চোখে কোনো দয়া নেই, বরং হিসেবি দৃঢ়তা। সে জানে প্রেম হচ্ছে তৃষার সিনিয়র, সিনিয়র-জুনিয়রের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি নতুন কিছু নয়। এই তুচ্ছ ব্যাপারে এত অস্থির হওয়া, এত পেছন পেছন দৌড়ানো অমূলক।
আর হেতিজার ভেতরে লুকানো আছে আরেকটা প্রবল ইচ্ছা—তৃষাকে সে তার নিজের ছেলের জন্য বেছে নিয়েছে। একজন মায়ের মতো সে তৃষাকে নিজের হাতে বেঁধে রাখতে চায় প্রত্যুষের পাশে। তাই তৃষার চোখ, তৃষার মন, তৃষার প্রতিটি স্পন্দন যেন প্রেমের দিকে না ছুটে যায়—এর জন্য যা কিছু করতে হয়, হেতিজা করতে দ্বিধা করবে না। তৃষার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে দুটো কঠিন প্রাচীর। একদিকে প্রত্যুষের অবুঝ বাঁধন, আরেক দিকে হেতিজার নির্মম নিয়ন্ত্রণ। এত কিছুর মানে তার জানা নেই। অথচ তৃষার বুকের ভেতর তখনো ফেটে যাচ্ছে একটাই আর্তনাদ, “প্রেম…!”
–
পার্কের এক নির্জন কোণে, ঝরাপাতার স্তূপে ঢাকা এক বেঞ্চে বসে আছে শিমলা। তার কোল জুড়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে অংকুর। যেন পৃথিবীর সমস্ত ঝড়ঝাপটা উপেক্ষা করে এ মুহূর্তে আশ্রয় খুঁজছে কেবল তার চোখের ভেতর। শিমলার চোখদুটি এতক্ষণ অশ্রুধারায় গঙ্গার মতো প্লাবিত হয়েছে। সেই অশ্রুতে বুক ভেসে গিয়েছিল তীব্র হাহাকার আর অদৃশ্য ভয়ের ঢেউয়ে। বহু কষ্টে, অবিচল সান্ত্বনার দৃঢ়তায় অংকুর তার বুকভাঙা কান্নাকে স্তব্ধ করেছে। বাড়ির চাপে শিমলার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে পিতার সিদ্ধান্তে তার হাত বেঁধে দেওয়া হবে অপরিচিত এক বন্ধনে। অথচ এই তো সেদিনের কথা মাত্র কয়েক দিনের পূর্বে তাদের ভালোবাসা অঙ্কুরিত হয়েছে কচি অশোকলতার মতো। এখনই যদি সেই প্রেম ছিন্ন হয়, তবে এ যেন জীবনের নির্মমতম উপহাস। বিচ্ছেদের আশঙ্কা শিমলার বুকে আগ্নেয়গিরির মতো দগ্ধ যন্ত্রণা ছড়িয়ে দেয়, তাই অশ্রু অবিরাম ঝরে পড়ে। কিন্তু অংকুর শিমলাকে শপথ দিয়েছে। সমস্ত দুনিয়া যদি উল্টে যায়, যদি আকাশ ভেঙে মাটিতে পড়ে, তবুও এই হাত সে ছেড়ে দেবে না। কারণ এ হাত সে ধরেছে কেবল ভালোবাসার শুদ্ধ অঙ্গীকারে, কোনো সামাজিক প্রথা কিংবা জবরদস্তি নয়। এই একবারের ধরা হাতই তার কাছে চিরন্তন, অবিনাশী, শপথে অটল এক প্রেমের মূর্ত প্রতীক। একে ছাড়া মানে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া।
হঠাৎ অংকুর আর শিমলার পাশের বেঞ্চে দু’টো মেয়ে এসে বসল। বাদাম খেতে খেতে ফর্সামতো লামিয়া নামক মেয়েটি হেসে পাশের জারা নামক মেয়েটিকে বলল, ‘তো কেমন দিলাম বল?’
‘ভাই তুই একটা চিজই। মানে সাদমানের সঙ্গে পাঁচবছর রিলেশন করে এখন তারই কাজিনের সঙ্গে কাল বিয়ে করে কানাডায় শিফট হচ্ছিস!’
‘তো কি করব? সাদমানের মতো ওই বিশ হাজার টাকা মাইনে পাওয়া পুরুষের সঙ্গে সংসার করে জীবন পার করতাম? দেখ সুখ কিনতেও টাকা লাগে। তাই ফ্যান্টাসীতে বসবাস না করে বাস্তবতায় ফেরা উচিত। আর এমনিতেও সাদমান আমার আবেগ ছিল। আর ওর কথা বাসায় বললে কেউ মেনেও নিত না। শুধু শুধু পরিবারকে বিরক্তিতে ফেলে লাভ আছে?’
‘এখন সাদমানের কি অবস্থা? মানে ভাগ্য দেখ তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তাও আবার সাদমানেরই কাজিনের বাড়ি থেকে। তো ওই মজনুর এখন কি অবস্থা? ‘
‘আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। হাসপাতালে আছে।’
‘তুই দেখতে যাবি না।’
‘ভাই মাথা খারাপ হয়েছে? আমি কেন যাব? বিয়ের কত কি কেনা বাকি? মানে কোর্ট ম্যারেজ তো হয়েছেই বেশ কিছুদিন আগে । এখন সবাইকে জানিয়ে অনুষ্ঠান করা। আচ্ছা বাদ দে আর চল তো আমার আরো কিছু কেনাকাটা করতে হবে।’ বলেই লামিয়া উঠে দাঁড়ালো। জারাও তাই করল। দু’জন বসে না থেকে উঠে বের হয়ে গেল। পাশের বেঞ্চের অংকুর তখন শিমলাকে বলল,’ভাগ্যিস আমার কোনো কাজিন নেই।
_
তৃষার মনটা সকাল থেকেই খারাপ। হেতিজা বলল প্রেমা নাকি রুমে ডাকছে। মুখ ধুয়ে রুমে যাবে বলে একবার ঠিক করল। তারপর কি একটা ভেবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। বসার রুমে একটা বিরাট টিভি আছে। সকাল সকাল সিদ্দিক নেওয়াজ চা খান আর টিভিতে খবর দেখেন। তৃষা সারা রাত কাল জেগেছে। কান্না করেছে। দরজার সামনে বসে ছিল। কিন্তু প্রেম ফিরেনি। সিম বন্ধ দেখাচ্ছে। তৃষার অনেক ভয় হচ্ছে। প্রেমের কথা ভাবলেই তো দম আঁটকে আসছে। কেবলমাত্র তার ভুলের কারণে এতসব হয়ে গেল। বসার ঘরে নানার সঙ্গে প্রত্যুষও ছিল। কি নিয়ে কথা বলছে। আজকে শুক্রবার। প্রতি শুক্রবার প্রেম এইখানে পরিবারের সঙ্গে খায়। মানে তার দাদার সঙ্গে টেবিলে খেতে বসে। আজকে সে নেই। কোথাও নেই। একটু পরেই হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যাবে। তৃষাকে দেখতেই সিদ্দিক হাসি মুখে বললেন, ‘আরে দাদু এখানে বসো। চা খাবে? আমার আবার আগে আগে চা খাওয়ার অভ্যাস। এক কাপ আগে খাই অন্যকাপ পরে। বলেই হাসলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, ‘প্রত্যুষ নানুভাই এইযে একের পর এক খুন হচ্ছেই এসব কি বন্ধ হবে না?’ প্রত্যুষ কতক্ষণ ধরেই টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। তৃষা আসার পরও তার দিকে তাকায়নি। স্ক্রিনে বড় বড় করে ব্রেকিং নিউজ লেখা। আজকেই বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল লামিয়া নামক নারীর। কিছুদিন আগেই পারিবারিক ভাবে কোর্ট ম্যারেজ হয়েছে। শত্রুবার বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল তবে তার আগেই খোঁজ মিলল তার লাশের। তৃষার সেইদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ সে প্রত্যুষকে বলল, ‘একটু শুনবেন?’
দুইবার ডাকার পর প্রত্যুষ তৃষার দিকে তাকালো। হেসে জবাব দিলো,’কিছু বলবে?’
‘মানে একটু কথা ছিল।’
প্রত্যুষ উঠে এসে বলল, ‘তুমি ঠিক আছো?’ প্রত্যুষের চিন্তার শেষ নেই। কাল রাতে প্রেমের বাড়ির দরজার সামনে থেকে তৃষাকে রুমে সেই তো এনেছে। রাতে প্রত্যুষ কেবল জিজ্ঞেস করেছে, ‘কি হয়েছে? যদি মনে হয় আমায় বললে আমি সাহায্য করতে পারব। মন হালকা হবে তাহলে প্লিজ শেয়ার করো।’
শেষে তৃষা শব্দ করে কেঁদে উঠল। সব কিছু খুলে বলল। তবে প্রেমের সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক, কি কি পূর্বে হয়েছে ওইসব কথা তার ভেতরেই চাপা রাখল। বাকিসব কাহিনি সব খুলে বলল। তবে সেইসবেও যেন প্রত্যুষ কত কি বুঝতে পেরে গেছে। মানে যার যতটুকু বোঝার সে তো বুঝবেই!
প্রত্যুষ উঠে আসতেই তৃষা তাকে বলল, ‘আপনি একটু দেখেন না সে কোথায়। একটা মানুষ বাড়িতে নেই আপনারা এত নিশ্চিন্ত কেমন করে হতে পারেন?’
প্রত্যুষ কিছু বলল না। বলার সুযোগ কোথায়? অফিস থেকে কল এসেছে। এই ছুটির দিনেও একটু শান্তি নেই। তারই মাঝে সিদ্দিক নেওয়াজ আবার ঘড়ির কাটা দেখছেন নাস্তার টেবিলো বসে বসে। সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে। প্রেম কোথায়? শেষে মোখলেসকে পাঠিয়ে জানতে পারলেন প্রেম বাড়িতে নেই। রাগ লাগল তার। কি করবেন বুঝতে না পেরে মোখলেসকে দিয়ে অংকুরকে কল লাগালেন। অংকুর জানালো,’প্রেম চলে গেছে।’
‘মানে?’
‘মানে আগের মতোই কোথাও একটা চলে গেছে। কোথায় গিয়েছে জানা নেই।’ সেই খবরে সিদ্দিকের প্রেসার লো হয়ে গেলেন। লাস্ট যখন তার প্রেম রাগ করে চলে গিয়েছিলো তখন পাক্কা গুনে ১ বছর জার্মানিতে থেকে তারপর এসেছে। প্রেম বরাবরই এমন। পরিস্থিতির সঙ্গে যখন লড়ে উঠতে পারে না তখন সব ছেড়ে পালায়। এই পালিয়ে বেড়িয়ে রাগ দেখানোর কোনো ফয়দা, কোনো মানে আছে? এবার না জানি কোথায় গেছে, কবে ফিরবে? কি নিয়ে রাগ করেছে।
ডাক্তার এসে সিদ্দিককে দেখে গেছেন। সবাই রুম থেকে বের হতেই তৃষা সেখানে ঢুকে। তাকে দেখে সিদ্দিক নেওয়াজ চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করে। তৃষার তো সেসব দেখে অন্তর ফাটল বলে। কারন সব কিছুর জন্যই দায়ী সে। কি করে ফিরিয়ে আনবে প্রেমকে? সে কি আদৌও ফিরবে? তৃষা বৃদ্ধ সিদ্দিক নেওয়াজের হাত ধরে বলল, আপনি কষ্ট পাবেন না। প্রেম ভাই ঠিক ফিরে আসবে।’ সিদ্দিকের চোখের জল, বুকের কষ্ট এবার আর বাঁধ মানল না। সে বলল, ‘প্রেমকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছি। প্রথমে মা হারালো। পরে বাবা হারালো। একটা মানুষ সব হারিয়ে বাঁচতে পারে? তোমার মনে হয় সে বেঁচে আছে? কবেই ভেতর ভেতর শেষ। যেই ভালোবাসা ওকে দেওয়ার কথা ছিল বাবা-মায়ের সেই ভালোবাসা থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে। আমি জানি প্রেম কেমন করে বড় হয়েছে। ও বাইরে থেকে এক মানুষ ভেতর থেকে অন্য কেউ। কঠিনের ভেতরও যেমন তরল আছে। প্রেম তেমন। সে কখনো নিজের কষ্ট কাউকে বুঝতে দেয় না। সে তার ইমোশন শেয়ার করতে জানে না। ভেতরের মানুষটিকে রোজ ভেতরে দাফন করে, মাটি দেয়। বলেই সিদ্দিকের চোখে জল চলে এলো। সেই জলে তৃষার চোখের জল উতরিয়ে পরল।
চলবে?
(গল্পের মোড় ঘুরে গেছে। ৩০ পর্বে সেই একটা ধামাকা হবে।)
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_২৮ ( বর্ধিতাংশ)
তখন মাসের শেষের দিক। আজকে বিশটা দিন যেই মানুষটিকে তৃষা দেখেনি নিজের চোখে তার নাম হচ্ছে প্রেম নেওয়াজ। দুনিয়া যে কত কঠিন এই বিশটা দিনে প্রেম তাকে হারে হারে বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে শরীরে আঘাত না করেও দূরে সরে গিয়ে কেমন করে মনে আঘাত করতে হয়। সে হারিয়ে গিয়েও তার কথা গুলো রয়ে গেছে। খুঁটির ওপর ঝুলতে থাকা অর্ধেক ব্যথা আজও তৃষাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। প্রেমকে তৃষা কি করে বোঝাবে? কি করে বলবে? তার একটা ‘কেমন আছো’ শুনতে না পাওয়ার আক্ষেপে সে রাতে কত দুঃখ গিলে।
প্রেমকে কি করে চিৎকার করে বলবে, ‘ভালোবাসা যদি দায়হীন হয়, তবুও দায়িত্ব শেখেন। আমি চাই না পুরো জীবন, শুধু আপনার একটুখানি উপস্থিতি আমায় বার বার হত্যা করুক। মৃত্যু যন্ত্রণা খুব কঠিন, আমায় বারেবার এই যন্ত্রণা আপনি দিয়েন না। আমি সইতে পারব না।’
তৃষা এতদিন ঘর থেকে বের হয়নি। চোখের সামনে নাতির চোখে সিদ্দিক নেওয়াজকে পাগলের মতো বিলাপ করতে দেখেছে। অথচ বলার সাহস নেই তার একটা মাত্র ভুলের কারণে সিদ্দিক নেওয়াজের শেষ সম্বল হারিয়ে গেছে। খোয়া গেছে। তৃষা ঘর বন্দী থাকে। অবস্থা ভালো না দেখে কেউ তাকে কোনো চাপ দেয় না। প্রেমাকে এখন তৃষা পড়াচ্ছেও না। খাওয়া-দাওয়া তো ছেড়েই দিয়েছে। কাজ কর্ম, হাসি সবই তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে প্রেম নেওয়াজের শোকে । নিজেকে সবার থেকে দূরে রেখে রোজ এভাবেই শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে তৃষা। প্রেম কোথায় গেছে জানা নেই। কতবার অংকুরকে জিজ্ঞেস করল লাভ হলো না। প্রত্যুষ আইনের লোক হয়েও খোঁজ নিলো না। আর নিতে পারছে না তৃষা। একদিন সে সব ছেড়ে পাখি হয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। সেদিন প্রেম ভাই এলেও তৃষা আর ফিরবে না। ভালোবাসা এত পোড়াবে জানলে তৃষা কখনো সামনে পা বাড়াতোই না। এই বিশ দিনে অন্তত দিনে দুই-চার বার প্রেম ভাইকে নিয়ে লিখতে বসেছে তৃষা। কত কথা। তবে অগোছালো। বার বার লিখেছে আর বার বার ছিড়ে ফেলেছে। আজ আবার লিখবে বলে ঠিক করেছে। যে কথাগুলো মুখে কখনো বলতে পারবে না তার সাদা কাগজের ভাঁজে লিখে রেখে যাবে। এমনও তো হতে পারে একদিন প্রেম ভাই ফিরবে। তবে সেদিন আর কথাগুলো বলার মতো এই তৃষা নুজায়াত থাকবে না।
প্রেম নেওয়াজ,
মাসের শেষের দিক। ঘড়ির কাঁটা যেন দম নেয়া ছেড়ে দিয়েছে। আজ বিশটা দিন হলো তোমাকে নিজের চোখে দেখিনি। বিশটা দিন: সংখ্যাটা কাগজে সামান্য, কিন্তু আমার বুকের মাপে যেন বিরাট এক লোহার খণ্ড। প্রতিটি দিনই আলগা আলগা করে আমার ভিতর থেকে এই খণ্ড কিছু একটা কেড়ে নিচ্ছে। তুমি আমার চক্ষুনজরের সীমানার বাইরে এই টুকুই আমার শরীরে আঘাত না করে সরাসরি মনে আঘাত করার জন্য যথেষ্ট। জানো কি তোমার হারিয়ে যাওয়া ধরে রেখেছে আমার হৃদয়ের অজস্র ক্ষত। তোমার অনুপস্থিতি আমার শরীর অক্ষত রেখে মনে কেমন করে জ্বালাপোড়া দিয়ে যাচ্ছে সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারো? তোমার থেকে দূরে থাকা আমার জন্য অচিরেই অসহনীয়। প্রেমের উত্তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে, জ্বরের মতো; থার্মোমিটারের কাঁচের ঘরে পারদকে বেঁধে রাখা যেন খুবই মুশকিল। তুমি কাছে এলে পারদ নেমে আসে, তুমি দূরে গেলে আবার ওঠে—এই ওঠানামাই এখন আমার প্রতিদিনের জীবনচক্র। আমি কখনো চাইনি রোগ-দলিলের মতো তোমার প্রতি আস্থাহীন হই; তবু তোমার দূরে চলে যাওয়া, তোমার নিয়মহীন ভালোবাসা আমাকে এমন এক অবস্থা দিলো যেখানে ভালোবাসা কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার পায়ে। কত কথা বাকি ছিল আমাদের। সেগুলো যদি পাখি হতো, আমি নিশ্চয়ই তাদের উড়ে যেতে দিতাম। কারণ বুকের ভেতর এত কথা জমিয়ে রেখে এখন আর আমি ভার সহ্য করতে পারছি না। তোমায় বলতে না পারা ছোট্ট বাক্যগুলো বুকের ভেতর জমে জমে কষ্টের পাহাড় গড়ে তুলেছে। পাহাড়গুলো তার চোরা-চোরা মাথার ওপর থেকে শহর কাঁপায়। তুমি কি জানো—একটা ‘ফিরে এসেছি’ শোনার অপেক্ষায় রাতগুলো কষে ওঠে? তুমি কিচ্ছু জানো না প্রেম ভাই, কিচ্ছুই না। কেবল আমায় একফালি রোদের মতো, ঘোর বর্ষার বৃষ্টির মতো আঘাত করতে জানো। তবুও আমি তোমাকে দোষ দিই না পুরোপুরি। আমি শুধু ক্লান্ত। ক্লান্তি তীব্র আমাকে মাঝে মাঝে এমন এক দূর্বলতায় ফেলে কিন্তু সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য আমি নিজেকে আর খুঁজে পাই না। ভালোবাসা যদি রোগও হয়, তবু আমি জানি সেটা আমার একমাত্র উপশম। তাই তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি না। তুমি যদি সত্যিই ভালবাসো, নিয়মটা শিখো, ফিরে আসো,সামান্য সময় দাও, চোখে চোখ রেখে বলো, একটু উপস্থিত হও এগুলোই আমার ‘ওষুধ’।
আমি এই চিঠিতে অভিযোগের সঙ্গে ভালোবাসা রেখেছি। তোমার অবহেলার মধ্যেও যা আমার প্রতি ছিল তা কেবলই ভালোবাসা। তাই ভালোবাসা দিতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা করব না। আমার দুঃখ সমান তোমার সুখ হোক।
তোমার অপেক্ষায় ক্লান্ত,
তৃষা নুজায়াত।
সেই চিঠি ভিজে গেল চোখের নোনা জলে। সেখানেই কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে চোখ – দু’টো বন্ধ হয়ে এলো তৃষার। দরজার পাশে তখন প্রত্যুষ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে। চেয়ে আছে তৃষার দিকে। হঠাৎ কেউ একজন তার পিঠে হাত রাখতেই সে পেছন ফিরল। চেয়ে দেখল হেতিজা নেওয়াজকে। হেতিজা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,’ভালোবাসিস তো ওকে? তাহলে বিয়ের কথাটা বাপজান তুই বলবি নাকি এবার আমি নিজেই বলব?’
–
তখন সন্ধ্যার আজান দিচ্ছে। বাগানের বেঞ্চেতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে তৃষা। একটু আগেই শিমলার কল এলো। কাল রাতে অংকুরের সঙ্গে পালিয়েছে সে৷ ভালোবাসলে ভালোবাসা এমনই হওয়া উচিত। শিমলার বয়স্ক লোকের সঙ্গে বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। শেষে অংকুর যখন বলল,’পালিয়ে যাই।’ তখন শিমলার জীবনের সবচাইতে আনন্দের মুহূর্ত ওই দু’টো শব্দের থেকেও বেশি ছিল। তৃষা একটু আগেই কাজ ছেড়ে এসেছে হেতিজাকে বলে। এই বাড়ি থেকে কাল সে চলে যাবে। ভার্সিটিও যাওয়া বন্ধ। তবে এখান থেকে যাওয়ার পর কোন পথে যাবে, থাকবে কোথায় তা জানা নেই। শুধু জানে এখানে এখন থাকার মানে হয় না। অনেক তো অপেক্ষা করেছে। ফেরার হলে কবেই ফিরত। হঠাৎ বেঞ্চেতে তৃষার পাশেই কেউ একজন বসল। তৃষার দেখার মতো আগ্রহ জাগল না। তবে হুট করেই একটা চেনা কণ্ঠ ভেসে এলো। প্রত্যুষ বলল, ‘ভালোবাসা অনেক কাঁদায় তাই না তৃষা? যে যাওয়ার সে চলে যাবেই। তাকে তাবিজ করলেও সে তোমার কখনোই হবে না।’
তৃষা জবাব দিলো না। প্রত্যুষ ফের বলল,’জানো তৃষা, মানুষকে যতই আঁকড়ে ধরো না কেন যদি তার মন তোমার না হয়, সে হাজার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ভালোবাসা কখনো জোর করে আটকে রাখা যায় না।’
‘ আমি জানি তবুও হৃদয় তো মানতে চায় না। মনে হয়, যদি আরও একবার ডেকে বলতাম তাহলে হয়তো থেকে যেত।’
‘ তুমি হয়তো ভেবেছিলে সেও তোমার মতোই অনুভব করছে, কিন্তু আসলে তার ভেতরে অন্য গল্প চলছিল। ভালোবাসার ভেতরে এমন ভাঙন অচেনা নয়। তার চেয়ে বড় কথা প্রেম তোমাকে মুখে কখনো বলেছে সে তোমায় ভালোবাসে?’
তৃষার কাছে কোনো জবাব নেই। সে চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দেয়,
‘ আমি হয়তো শুধু স্বপ্নকে সত্যি ভেবে আঁকড়ে ধরেছিলাম।
‘আমরা অনেক সময় ভরসা করি—ভাবি, এ মানুষটা আমায় কখনো ছেড়ে যাবে না। অথচ একদিন দেখি, সেই মানুষটিই চলে গেছে দূরে, এমনভাবে যে ফেরা আর সম্ভব নয়।’
‘সেই দৃশ্যটা আমি চোখের সামনে দেখেছি। বিশ্বাসের ভাঙন কতটা তীব্র হতে পারে, তা এখন আমার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’
প্রত্যুষ আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ মেঘলা। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। সে বলল, ‘ভালোবাসা এক ধরণের মোহও বটে। তুমি যা হারালে, তা হয়তো শুরু থেকেই তোমার ছিল না। আমরা যা পাই তার প্রতি আমার আর্কষণ বেশি থাকে। তা আমাদের অতি প্রিয় হয়ে থাকে।’
‘হয়তো সত্যি তাই, কিন্তু তবুও কেন হারানোটা এত বিষের মতো গায়ে লেগে থাকে বলেন তো?’
‘ ওই বিষ আমাদের পুনরায় বাঁচিয়ে তুলে। মানুষ চলে যায়, কিন্তু তার দিয়ে যাওয়া দাগ আমাদের ভেতরে রয়ে যায়। সেই দাগ একদিন শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আর যখন শক্তি হয়ে দাঁড়ায় তখন আমরা পুনরায় প্রেমে পড়ি। ভালোবাসতে শিখি। তুমি বিষ পান করে শক্ত হতে পারবে না?’
‘ হয়তো একদিন পারব শক্ত হতে, কিন্তু বুকের ভেতরটায় যে ফাঁকা স্থান তৈরি হয়ে গেছে তার?’
‘তুমি ভেবো না তুমি একা। যারা হারিয়েছে, তারাই সবচেয়ে গভীরভাবে ভালোবাসতে শিখে। হয়তো এ কষ্টই তোমায় নতুন করে গড়বে। আরেকটা কথা মনে রেখো যে চলে যায়, সে হয়তো তোমার ছিলই না। কিন্তু তুমি যে ভালোবাসতে শিখেছো, সেটাই তোমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর শুনোভালোবাসা আসলে হারায় না, শুধু মানুষ হারিয়ে যায়। ভালোবাসা রয়ে যায় ভেতরে।
হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। আকাশের গর্জন যেন তৃষার বুকের গোপন ব্যথার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে লাগল। তৃষা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। বৃষ্টির ধারায় ভিজতে ভিজতে সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল, চোখের জল আর বৃষ্টির ফোঁটার ভেতর কোনো তফাৎ থাকল না। বুক চিরে বেরিয়ে এলো তার আক্রোশভরা আর্তনাদ,
“আমি তাকে ভালোবাসি প্রেম! তুমি ভালোবাসো কিংবা নয়, আমার ভালোবাসা অমোঘ! আমার সমস্ত রক্তে, শিরায়, শ্বাসে শুধুই সে! তোমায় ভুলতে গেলে আমি নিজেই নিজেকে ভুলে যাব।’
তার কণ্ঠরোধী চিৎকার বৃষ্টির গর্জনের সঙ্গে মিশে বেদনাময় সিম্ফনি হয়ে উঠল। সে হাত ছুঁড়ে বাতাস আঁকড়ে ধরতে চাইল,অথচ শূন্যতা ছাড়া কিছুই তার কাছে এলো না। তৃষার দেহ কাঁপতে লাগল, ভেতরের অগ্নিদাহ তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে চাইছে।
প্রত্যুষ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। এই উন্মত্ত যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে তার নিজের বুকও ভারী হয়ে উঠল। হঠাৎ সে নিজের কাঁধ থেকে ব্লেজার খুলে তৃষার ভিজে যাওয়া কাঁধে জড়িয়ে দিল। মৃদু কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, “তৃষা, নিজেকে ছিঁড়ে ফেলার মতো করে কাঁদো না। ভালোবাসা যদি সত্যিই তোমার হয়, সে একদিন অন্য রূপে ফিরে আসবে। আর যদি না-ও আসে, তবুও তোমার ভেতরের এই ভালোবাসাই তোমায় অমর করে রাখবে। শোনো, মানুষ চলে যায়, কিন্তু ভালোবাসা কখনো মরে না আর কতবার বোঝাব? আচ্ছা যতবার তুমি বুঝবে না আমি বুঝিয়ে চলব।’
তৃষা কাঁপতে কাঁপতে তার গায়ের উপর মাথা রেখে হাহাকার করল। বৃষ্টির প্রবল স্রোতে তাদের দুজনের শরীর একাকার হয়ে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে কেবল ঝড়-বৃষ্টির আওয়াজে ভরে উঠল। সেই মুহূর্তে, তৃষার অন্তর যেন বুঝে নিল ভালোবাসা হারায় না, হারিয়ে যায় কেবল মানুষ।
চলবে?
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষ্ণা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৭+১৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৩+২৪
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৯+সারপ্রাইজ পর্ব
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৫+১৬
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২১+২২
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৭
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৩+১৪
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৮+৯+১০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৯+২০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৫+২৬