প্রণয়েরব্যাকুলতা সাদিয়া পর্ব৭
মেলা মানেই হাজার মানুষের জনসমাগম, ভীর। আর তা যদি হয় পহেলা বৈশাখের তাহলে তো কথাই নেই। এত বড় মেলা মৌমিতা এই প্রথম দেখছে। ভীর ঠেলে মেলার এই দোকানে ঐ দোকানে ঘুর ঘুর করছে।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে ছেলেদের একটা মানিব্যাগ কিনলো মৌমিতা। কলিজাটা ছ্যাত করে উঠলো তাজের। এই মেয়ে আবার ছেলেদের জিনিস কিনছে কেন? কাকে দিবে? সরাসরি জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না, কেমন উসখুশ করছে। রাদীফ বোধহয় বুঝলো তাজের মনের কথাটা। গলা খাঁকারি দিয়ে মৌমিতাকে শুধালো – কার জন্য নিচ্ছো এটা আছে নাকি কেউ?
মৌমিতা একগাল হেসে বলল – এটা আমার ভাইয়ের জন্য স্যার। আমি এখনও পিওর সিঙ্গেল।
- আমার ভাইপোও কিন্তু সিঙ্গেল।
ভ্রু কুঁচকে তাকালো মৌমিতা, হকচকিয়ে উঠলো তাজ। দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলল – এখন একটু বেশিই বলছো না কাকাই?
- বেশি বললাম কই? আমি তো আরও তোর পথ ক্লিয়ার করছি।
- আমার পথ তোমাকে ক্লিয়ার করতে হবে না। এখন চুপ যাও।
- বারে যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। পশ্চিম আকাশে লাল বর্ন ধারন করে ধীরে ধীরে সে তলিয়ে যাচ্ছে। আধার নামছে প্রাকৃতিতে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরেছে মৌমিতা। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। পরক্ষনেই মনে পড়লো ব্যাগে কিছু একটার কথা। উঠে ব্যাগ খুলল ছেলেদের একটা ব্রেসলেট বের করলো। মেলা থেকে সবার জন্যই টুকিটাকি কিছু কিনেছিল। সাথে রাদীফ আর তাজের জন্য দুটো ব্রেসলেট কিনেছিল। রাদীফেরটা দিয়ে দিয়েছে, তাজের টাও তার হাতেই দিয়েছিলো কিন্তু সে নেয়নি বলেছে তোমার উপহার তুমিই দিও। পরে আর খেয়াল ছিল না। কাল দিয়ে দিবে ভেবে আবার ব্যাগে রেখে দিল ব্রেসলেটটা।
লাইব্রেরীতে তন্ন তন্ন করে তাজকে খুজে চলেছে মৌমিতা কোথাও দেখা নেই এই বান্দার। এমনিতে তো এই সময় লাইব্রেরীতেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে আগুন চোখা শয়তানটা। যেভাবে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকে মনে হয় কবে যেন বইয়ের মধ্যেই ঢুকে যায় মানুষটা। সত্যিই তো বই পড়তে পড়তে বইয়ের মধ্যেই ঢুকে যায়নি তো ঐ বান্দা। মৌমিতা গোল গোল চোখে লাইব্রেরীর বইগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। নাহ আরেকবার খুঁজে দেখা যাক।
একটা বুক সেলফের পিছনে বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে তাজ। একটু পর পর আবার পকেটে হাত দিয়ে কি যেন নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে। আবার একা একা মুচকি হাসি দিচ্ছে। মৌমিতা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করছে তাজকে। এই মুচকি হাসির রহস্যটা কি কিছুতেই উদঘাটন করতে পারছে না সে। মিনিট দুয়েক যেতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল মৌমিতার। ভুতে ধরেছে, হ্যা সেটাই হবে। ভুতে ধরেছে তাজকে না হয় এখানে একা একা দাঁড়িয়ে এমন একটা রসকষহীন মানুষের এভাবে হাসার তো কথা না। পায়ের জুতোটা খুলে হাতে তুলে নিল মৌমিতা। হন্তদন্ত হয়ে তাজের নাকের কাছে ধরলো। চমকে উঠলো তাজ। গোল গোল চোখে জুতোটার দিকে তাকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখা পেল মৌমিতার। বিরক্ত হলো তাজ। এই মেয়েকে যখন দেখবে তখনই কোনো না কোনো আকাম নিয়ে হাজির হবে। এখন আবার জুতো, আবার কি করতে চাইছে মেয়েটা? নাক ছিটকে জুতোটা দূরে সরিয়ে বিরক্তি কন্ঠে সুধালো – সমস্যা কি তোমার? আমার নাকের সামনে তোমার এই বিখ্যাত জুতো কেন ধরেছো?
- ভুত তাড়াচ্ছি ভুত?
- জুতো শুকিয়ে ভুত তাড়ায়? আমি তো জানতাম মৃগী রোগীর কাঁপনী উঠলে জুতো শোকায়।
- আমিও জানি মৃগী রোগীকে জুতো শোকায় আর ভুতে ধরা মানুষকে ঝাঁটা সেটা করে। এখন আপনি তো আমার অনেক বড় আধু ভাই বলে কথা আপনাকে কি আমি ঝাঁটা পেটা করতে পারি ? পাপ লাগবে যে আমার।
কুঁচকে যাওয়া ভ্রু যুগল আরও কুঁচকে এলো তাজের। চোখ ছোট ছোট করে বলল – আমাকে তুমি ঝাঁটা পেটা কেন করবে?
- বারে আপনাকে তো ভুতে ধরেছে। না হয় আপনার মতো একজন রসকষহীন মানুষ ওভাবে মুচকি মুচকি হাসবে অবিশ্বাস্য।
বিরক্তিতে মুখ থেকে চ বোধক শব্দ বেড়িয়ে এলো তাজের। এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। তখনই সামনে আসবে সব আছে বাজে কথার ঝুড়ি খুলে বসবে। মেজাজ বিগড়ে গেলো তাজের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও। কখন আবার চড় থাপ্পড় লাগিয়ে দেব তারপর বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে।
ভেংচি কাটলো মৌমিতা, বলল – আমি মোটেই আপনার সাথে খোশগল্প করতে আসিনি। হাতটা বাড়ান তো।
চোখ ছোট ছোট করে তাকালো তাজ কিন্তু হাত বাড়ালো না। মৌমিতা তাজের হাতটা টেনে নিল। ব্যাগ থেকে একটা ব্রেসলেট বের করে তাজের হাতে পড়িয়ে দিল। তাজ কিছু বলবে তার আগেই মৌমিতা বলল – ভয় পাবেন না। রাখি বাধছি না। জামাইয়ের বয়সী পুরুষকে রাখী বেঁধে জামাইয়ের সিরিয়াল থেকে একজন সুদর্শন পুরুষকে মোটেই বাঁধ ফেলতে পারি না। এটা কাল মেলা থেকে আপনার জন্য কিনেছিলাম।
মৌমিতার এত ঘুরানো প্যাচানো কথা বোধগম্য হলো না তাজের। কিন্তু হাতের দিকে তাকিয়ে হাসি ফুটে উঠলো তার। মৌমিতা ব্রেসলেটটা পড়িয়ে বেড়িয়ে যেতে নিলেই হাত টেনে ধরলো তাজ। বলল – দাড়াও
হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো তাজ। পকেট থেকে এক জোড়া নুপুর বের করে সযত্মে পড়িয়ে দিল মৌমিতার পায়ে। মৌমিতা থমকে গেল। চকিত হয়ে কিছু বলার আগেই তাজ বলল – কখনও খুলবে না এটা। তুমি আমার আশেপাশে আসলে তোমার নুপুরের আওয়াজে যেন আমি বুঝতে পারি তুমি আমার কাছেই আছো।
- এটা তো মোটামোটি দামী অনেক। আমি এটা আপনার কাছ থেকে নিতে পারবো না।
- উপহার কি তুমি দাম দিয়ে বিচার করো ?
- না তা নয় কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে উপহার কেন নেব তাও এত দামী। না আপনি আমার আমার কোনো আত্মীয়, না আপনি আমার বন্ধু। আমরা শুধু মাত্র কিছুদিনের পরিচিত।
- তাহলে তুমি কেন আমার জন্য ব্রেসলেট কিনেছো?
ভরকে গেল মৌমিতা, আমতা আমতা করে বলল – সবার জন্য কিনেছি তাই।
- সত্যিই কি তাই?
- তা ছাড়া আর কি হবে?
- সবাইকেই কি এভাবে হাতে পড়িয়ে দিয়েছো?
উত্তর দিচ্ছে না মৌমিতা। তাজ আবার বলল – কি হলো বলো।
- না
মুচকি হাসলো তাজ। মৌমিতার কানের কাছে পড়া ছোট কাঁটা চুলগুলো কানে গুঁজে দিতে দিতে বলল – সব সম্পর্কের কেন নাম খোজো তোমরা? কিছু কিছু সম্পর্কের নাম হয় না শুধু অনুভব করা যায়। ধরে নেও তোমার আমার সম্পর্কটাও ঠিক তেমন। সময় হলে সম্পর্ক তার পূর্নতা পাবে নাম পাবে তার আগে অনুভব করো। হৃদয় গেথে রাখো আমাকে।
মৌমিতা হতবাক হয়ে তাজের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ছোট মাথায় এত কথা ঢুকছে না। কি বলছে তাজ এসব। সে কি ইনডাইরেক্টলি ওকে ভালোবাসার কথা বলেছে? না না পাগল নাকি। ঐ রকম একটা রসকষহীন মানুষ আবার ভালোবাসতে জানে নাকি? তাজ চলে গেল মৌমিতা এখনও থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে বইয়ে মুখ গুজে আছে তাজ আর ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে মৌমিতা। বারবার পা দুটো নাড়িয়ে নাড়িয়ে নুপুর দুইটা দেখলে আর নিঃশব্দে হাসছে। কোনো কিছুই আড়ল হচ্ছে না তাজের নজর থেকে। সে তো শুধু নামে বই নিয়ে বসে আছে চোখ দুটো তো মৌমিতার দিকেই আছে। মেয়েটাকে এত দেখে তবুও যেন মন ভরে না তার। মেয়েটার এই বাচ্চামো স্বভাবগুলোই সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তাজকে। হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকলো মৌমিতাকে। কাছে যেতেই বলল – বসো।
মৌমিতা বাধ্য মেয়ের মতো তাজের পাশে বসলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাজ বলল – আচ্ছা তুমি একজন মানুষকে চেনো মানুষটা তোমার খুব কাছের হঠাৎ করে জানতে পারলে তুমি উপরে উপরে মানুষটাকে যেভাবে দেখছো মানুষটা আসলে তেমন নয় । মানুষটা সাধারন মানুষের মতো নয় তখন কি তুমি তাকে ঘৃণা করবে?
- আমি কাউকে চিনি যেমন তাকে দেখছি তেমন নয় অন্যরকম, সে সাধারন মানুষের মতো নয় ধুর কি উল্টো পাল্টা কথা বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
- কিছু না বাদ দেও ।
- কিছু না কি আবার বলুন এবার আমি বুঝতে পারবো।
- তোমার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে নীরা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।
হাতঘড়ির দিকে তাকালো মৌমিতা, লাফিয়ে উঠে বলল – ইসসসস দেখেছেন দেরী হয়ে গেছে। আমি এখন যাই আবার পরে এক সময় কথা হবে আপনার সাথে।
মৌমিতা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল ক্লাসে। তাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল , মনে মনে বলল – জীবনটা এমন কেন? আমি তো কখনও কারো মায়ায় জড়াতে চাইনি। তবুও কেন আমিও আজ একজনের মায়ায় জড়ালাম। আমি কি ভালোবাসি মৌকে? হয়তো বাসি। কিন্তু আমি যে ভালোবাসতে চাই না। কাউকে ভালোবাসতে পারি না। আমি কাউকে ভালোবাসলে সে যে আমার চোখের সামনে আমার হাতেই ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে। আমি কিভাবে নিজের চোখে দেখবো আমার ভালোবাসার মানুষটাকে শেষ হয়ে যেতে। না না আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না।
মাথাটা চেপে ধরলো তাজ। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথাটা। কোনো মতে উঠে দাঁড়িয়ে ঢুলু ঢুলু পায়ে ঢুকলো রাদীফের অফিস রুমে। রাদীফ রুমেই ছিল। তাজের এই অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলো রাদীফ। দৌড়ে এসে ধরে বসালো তাজকে। অস্থির হয়ে তাজকে জিজ্ঞেস করল – কি হয়েছে এমন করছিস কেন?
- আমার নিজের উপর নিজের ভীষণ রাগ লাগছে কাকাই। আমি নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আমি তো কাউকে ভালোবাসতে চাইনি। তবুও কেন ভালোবাসলাম। ঐ মেয়েটার জন্য আমার ভিতরে কেন ভালোবাসার অনুভূতিগুলো জেগে উঠেছে। কেন কেন?
গর্জন করে উঠলো তাজ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভয়ে রাদীফের বুকটা কাঁপছে। তাজকে রেখে নিজের ড্রয়ারে অস্থির হয়ে কিছু একটা খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। নিজের রাগ সংবরণ করতে না পেরে নিজের হাত নিজে কামড়ে ধরলো তাজ। তাজের দিকে একবার তাকিয়েই আতকে উঠলো রাদীফ। ধীরে ধীরে তাজ হিংস্র রূপ ধারন করেছে। চোখ দুটো টকটকে লাল বর্ন ধারন করেছে। অবশেষে রাদীফ তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়ে গেল। দৌড়ে গেল তাজের কাছে।
চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে সাথে থাকুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৬
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৭
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৮
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২০
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৮
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৭