Golpo প্রণয়ের ব্যাকুলতা

প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৬


#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা

#সাদিয়া

#পর্ব_৩৬

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

গোল মিটিং এ বসেছে মৌমিতাদের বাসার সবাই। অবশ্য তাজ তাদের ডেকেছে। কি উদ্দেশ্যে এখনে সবাইকে এখনও বলেনি সে। আপাতত সবাই নীরবতা পালন করছে। নীরবতা ভেঙে তাজ বলল – আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে আমার এখানকার কাজ শেষ।

জাহানারা বেগম বুঝতে পারলো তাজ কি বলতে চাইছে। মৌমিতাকে সে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়। জাহানারা বেগমের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মেয়েকে ছাড়া সে থাকবে কি করে? এই ছেলে মেয়ে দুটোই যে এখন তার একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন। কিন্তু মেয়েকে নিজের কাছে আটকেও বা রাখবে কি করে? মেয়েদের জন্মই যে হয় অন্যের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। প্রতিটি মেয়েকেই বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়। আর মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি যেতে না দিয়ে তার সংসারে সৃষ্টি করার মতো পাপ কাজ ও সে করবে না। মলিন হয়ে গেল জাহানারা বেগমের মুখটা । ভিতরে কষ্ট চেপে রেখে মুখে শান্ত কন্ঠে বলল – মৌমিতাকে নিয়ে যেতে চাইছো এই তো । ও যাবে, আমাদের প্রথমে একা একা থাকতে একটু কষ্ট হবে তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে।

– আপনারা একা কেন থাকবেন? আপনারাও যাচ্ছেন আমার সাথে। আমরা সবাই যাব। মাহিমকে ঢাকায় একটা কলেজে ট্রান্সফার করে নেব।

– তা হয় না বাবা?

– কেন হয় না মা?

– এভাবে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকা যায় না। মানুষ কি বলবে?

– মানুষের বলাবলিতে কি আসে যায়? আমার মা নেই। আমি আপনাকে মা ডেকেছি। আপনাকে আমি আমার নিজের মা এবং মাহিমকে নিজের ভাইয়ের মতোই মনে করি। তাহলে নিজের মা ভাই আমার বাড়িতে কেন থাকতে পারবে না?

– তুমি বুঝতে পারছো না বাবা…

– আমি বুঝতে চাইছি না মা। আপনি কি আমাকে নিজের ছেলে বলে মনে করেন না?

– অবশ্যই করি।

– তাহলে তো আর কথাই রইলো না। আজ থেকে আপনারা সবাই আমার সাথে আমার বাড়িতে থাকবেন।

___________________________________

তাজ মৌমিতাদের নিয়ে ঢাকায় এসেছে আজ দুই দিন হলো। আসার সময় মৌমিতা একটু টা টু শব্দ করেনি। তাজের সব কথা মেনে নিয়েছে চুপচাপভাবে, বড্ডবেশিই চুপচাপভাবে চোখ এড়ায়নি তাজের। আচ্ছা মৌমিতা হঠাৎ এত চুপচাপ হয়ে গেল কেন? তাহলে কি সে তাজকে মাফ করে দিয়েছে? না না যদি মাফ করতো তাহলে তো কথাই বলতো, ভালোবাসতো এভাবে একদম চুপচাপ থাকতো না। সে কি মনে মনে তবে অন্য কোনো ফন্দি আঁটছে? তাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মৌমিতার দিকে। তাজের এহেনো দৃষ্টি দেখে ভরকে গেল মৌমিতা। সে কেবলই দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। তাজের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মৌমিতা। এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছে – কি সমস্যা?

– সমস্যা তো আমার না তোমার।

– আমার মানে?

– মনের মধ্যে নতুন কি ফন্দি আঁটছো বলে ফেল তো দ্রুত। এক মিনিট এক মিনিট তুমি আবার আমার থেকে পালানোর চিন্তা করছো না তো?

আকাশ থেকে পড়লো মৌমিতা। চোখ দুটো বড় বড় করে বলল – আমি আবার পালাতে যাব কেন তাও আমার মা ভাইকে আপনার কাছে রেখে।

– তা তো তুমিই ভালো বলতে পারবে। না হয় হঠাৎ এমন শান্ত হয়ে গেলে। আমার কাছাকাছি থাকতে দ্বিমত পোষণ করছো না। জড়িয়ে ধরলেও কিছু বলছো না। কাহিনী কি?

তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো মৌমিতা। রুক্ষ কন্ঠে বলল – এখন আমি কিছু বললেও দোষ না বললেও দোষ? আগে আপনার কাছাকাছি আসতে চাইনি, সবসময় মেজাজ দেখিয়েছি তাতেও আপনার সমস্যা ছিল এখন চুপচাপ সব মেনে নিচ্ছি তাতেও সমস্যা। আচ্ছা ঠিক আছে আজ থেকে আবার আসিয়েন আমার কাছাকাছি ঠ্যাং ভেঙে দেব। আর আমি আপনার সাথে এই এক রুমেও থাকবো না খুশি তো?

মৌমিতা কপট রাগ দেখিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে উদ্যত হতেই ঠোঁট প্রশস্ত করলো তাজ। পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মৌমিতার। আদুরে কন্ঠে বলল – ইসসস আমি যেতে দিলে তো। তুমি সবসময় আমার কাছে কাছে থাকবে। আমার সাথে জড়িয়ে থাকবে।

মৌমিতা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। রিনরিনে কন্ঠে বলল – ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন।

– উহু ছাড়বো না ।

শান্ত হলো মৌমিতা। শান্ত কন্ঠে বলল – ভেবে দেখলাম আপনি সেদিন ঠিকই বলেছিলেন আপনি সেদিন আমাকে আটকে না রাখলেও আমি সময়মতো আমার বাবার কাছে পৌঁছাতে পারতাম না। পূরন করতে পারতাম না আমার বাবার শেষ ইচ্ছে। এখানে আপনার কোনো দোষ নেই। সবটাই আমার ভাগ্য। আমার ভাগ্যে ছিল না বাবার শেষ মুহূর্তটা দেখা। আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি আপনার সাথে। যেখানে আপনার কোনো দোষ নেই সেখানে আপনাকে শাস্তি দিয়ে লাভ কি। তবে কি জানেন আমি এত দিনে এই কথাগুলো একবারও ভাবিনি। সবসময় আমি আমার রাগ আর অভিমানে ভরপুর ছিলাম। একবারও ভাবিনি আপনার কথা, আসলে ভাবতে চাইনি। সেদিন যদি আপনি আমাকে ঐ কথাগুলো না বলতেন তাহলে হয়তো এখনও ভাবতাম না। আমিও অন্যায় করেছি বীনা দোষে আপনাকে এতদিন শাস্তি দিয়ে। দুঃখিত মাফ করবেন আমাকে।

খুশি হলো তাজ। মৌমিতা তাকে বুঝেছে। তার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে এই বা কম কিসের? মৌমিতার ঘাড়ে মুখ গুজলো তাজ, কেঁপে উঠলো মৌমিতা তবে বাধা দিল না। তাজ শান্ত কন্ঠে বলল – মাফ করতে পারি একটা শর্তে আবার আমাকে তুমি বলতে হবে।

মুচকি হাসলো মৌমিতা, বলল – ছাড়ুন এখন ঘুম পেয়েছে আমার।

তাজ দুষ্ট হেসে বলল – ভাবছি আজ তোমাকে ঘুমাতে দেব না।

– একদম না। আমি কেবল মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি মানিয়ে নেইনি। তার মধ্যে একদম উল্টো পাল্টা চিন্তা মাথায় আনবেন না।

তাজ অসহায় মুখ করে মৌমিতাকে ছেড়ে দিল। তাজের মুখ দেখে ফিক করে হেসে দিল মৌমিতা। গিয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লো। তাজও গুটি গুটি পায়ে গিয়ে শুয়ে পড়লো মৌমিতার পাশে। গম্ভীর কন্ঠে বলল – একটু জড়িয়ে ধরে তো ঘুমাতে পারি নাকি তাতেও বারন আছে?

– তা ধরতে পারেন। তাতে একদম বারন নেই।

তাজ গম্ভীর মুখ করেই জড়িয়ে ধরলো মৌমিতাকে। মৌমিতা মিটিমিটি হাসছে। বেশ ভালো লাগছে তার তাজের মুখখানা।

______________________________________

অন্ধকার রজনীকে বিদায় জানিয়ে সকাল হয়েছে। মৌমিতার ঘুম ভেঙেছে সকাল সকালই। উঠে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে চলে গেছে সে। অনেকদিন হলো রান্নাঘরের চৌকাঠও পাড়ায় না সে। আজ হঠাৎ কেন যেন ইচ্ছে হলো আগের মতো কিছু করে তাজকে খাওয়াতে। সকাল সকাল ঘুম ভেঙে মৌমিতাকে পাশে না পেয়ে বাসি মুখেই নিচে নেমে এলো তাজ। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে খুঁজছে মৌমিতাকে, কোথাও তার দেখা নেই। রান্নাঘরের টুংটাং আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিতেই হাসি ফুটে উঠল তাজের মুখে। মৌমিতা সেই প্রথম দিনের মতো কোমড়ে ওরনা গুঁজে, চুলগুলো হাত খোঁপা করে একদম পাক্কা গিন্নির মতো রান্না করছে। তাজ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কতক্ষন। মৌমিতাকে বিরক্ত করার ইচ্ছে জাগলো তীব্র কিন্তু নিজের ইচ্ছে দমিয়ে রাখলো সে, উপরে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে জমিয়ে বিরক্ত করা যাবে মৌমিতাকে।

মিনিট দশেক পর ফ্রেশ হয়ে ফুরফুরে মেজাজে ফিরে এলো তাজ। কিন্তু ড্রইং রুমে আসতেই ফুরফুরে মেজাজ আর রইলো। পা দুটো যেন থমকে গেল সেখানেই‌ । ওর সামনেই সোফায় বসে আছে মাঝে বয়সী এক পুরুষ লোক। মৌমিতা চা দিচ্ছে তাকে। তাজের মনে পড়ে গেল পুরোনো স্মৃতি। এই লোকটা ওর বাবা ‌। তবে বাবার দায়িত্ব পালন করেনি কখনও। মায়ের মৃত্যুর পর বাবার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে সে। মাস শেষে ব্যাংক একাউন্টে মোটা অংকের টাকা পাঠিয়েই দায়িত্বের সমাপ্তি ঘটিয়েছে এই বাবা নামক প্রানী। তবে সন্তানের জন্য শুধু টাকা নয় ভালোবাসার ও প্রয়োজন রয়েছে বোঝেনি কখনও। যখন তাজের পাশে আপন কাউকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল কখনও এই বাবা নামক প্রানীকে পাশে পায়নি সে। হ্যা সাদিক চৌধুরী ওর বাড়িতে এসেছে ওর সামনেই বসে আছে। কতদিন পর দেখছে এই মানুষটাকে। শেষ কবে দেখেছিল এই মানুষটাকে, শেষ কবে কথা বলেছিল তার সাথে সেটাও মনে পড়ছে না তাজের। চোখ দুটো ভরে এলো তার। গোপনে ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলো তাজ। বাবা বলতে গিয়েও থেমে গেল, কন্ঠে কিছুটা ফুরফুরে ভাব এনে বলল – কি ব্যাপার সাদিক চৌধুরী আমার কাছে এসেছেন যে?

চোখ তুলে তাকালো সাদিক চৌধুরী। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তাজ তাকে বাবা বলে ডাকে না। ঠিক কবে শেষ বার বাবা বলে ডেকেছিল মনে নেই তার। অবশ্য দোষটা তারই। সে টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে কখনও একজন ভালো বাবা হয়ে উঠতে পারেনি, ছেলের দিকে খেয়াল রাখতে পারেনি। উল্টো এনে দিয়েছিল একজন মা রূপী ডায়নী। তার জন্যই তাজ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আজ যখন এই বয়সে এসে নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারলো তখন দেড়ি হয়ে গেছে বড্ড। সাদিক চৌধুরী শান্ত কন্ঠে বলল – কেমন আছো তাজ?

– ভালোই আছি।

– আমাকে জিজ্ঞেস করবে না আমি কেমন আছি?

– ভালোই থাকবেন আপনি। আপনার খারাপ থাকার তো কোনো কারন দেখছি না।

– সেটা অবশ্য ঠিক বলেছো। তা বিয়ে করলে প্রায় দুই বছর জানালে না তো আমাকে।

– কেন জানানোর কথা ছিল বুঝি?

– আমি তোমার বাবা তাজ। বাবা হিসেবে অন্তত আমার এইটুকু জানার অধিকার ছিল। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো তাজ, বলল – তা বাবারা বুঝি কঠিন সময় সবকিছু জানার অধিকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর সুখের সময় আবার অধিকারবোধ তাজা করে।

– আমি তোমার সাথে তর্ক করতে আসিনি আমি এসেছি আমার বউমাকে দেখে আশির্বাদ করতে। তোমরা আমাকে নাই জানাতে পারো কিন্তু বাবা হিসেবে আমার তো একটা‌ কর্তব্য আছে।

– হঠাৎ এত কর্তব্যবোধ?

সাদিক চৌধুরী উত্তর দিলেন না তাজের কথার। মৌমিতাকে ঠেকে পাশে বসালেন। মৌমিতা এতক্ষন পাশেই দাঁড়ানো ছিল। বাবা ছেলের মান অভিমানযুক্ত কথাগুলো কান পেতে শুনছিল। এই পরিস্থিতিতে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সাদিক চৌধুরী হাত রাখলো মৌমিতার মাথার উপর। শান্ত কন্ঠে বলল – সুখী হও মা। আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো।

একটা ব্যাগ ঘেঁটে সুন্দর কারুকার্যঘটিত একটা বাক্স বের করলো সাদিক চৌধুরী। মৌমিতার হাতে দিয়ে বলল – এই গয়নার বাক্সটা তোমার শ্বাশুরির তাজের নিজের মায়ের। হীরাকে বিয়ে করলেও এই বাক্সে কখনও তাকে হাত লাগাতে দেইনি। তাজের মায়ের মৃত্যুর পর এই গয়নার বাক্সের উপর অধিকার শুধু তাজের স্ত্রীর । আজ আমি তোমার হাতে তাজের মায়ের শেষ চিহ্নটুকু তুলে দিলাম মা। বড় যত্ম করে রেখেছিলাম এত বছর।

তাজ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল – যে মানুষটার রেখে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের তার নিজের অংশকে রাখতে পারেননি তার সামান্য একটা গয়নার বাক্স এত যত্ম সহকারে রাখাটা বেশ হাস্যকর।

চলবে….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply